“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৭ আগস্ট, ২০১২

নাগরিক পঞ্জি নিয়ে রাজনীতি : হেনস্থার নয়া নক্সা

(এই লেখাটা বেরিয়েছিল 'সংবাদ লহরী' তে । খুব চটজলদি ও হাল্কা চালে লেখা, দৈনিকের জন্য। অথচ মজার ব্যাপার হলো, এটা প্রকাশের দেড়-দু' মাসের মাথায় বরপেটার ঘটনা ( ২১ জুলাই, ২০১০) ঘটে।)
                                                                                                    ।। মৃন্ময় দেব  ।।

র-পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায় । ঘটনাচক্রে বাঙালি হয়ে জন্মেছি বলেই , বিশেষত অসমের বাঙালি হয়ে জন্মেছি যখন , প্রবচনটির তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা আমার মত অনেকের কাছেই নিশ্চয় গভীর । ইদানীং সে ভয় পুনরায় ফণা তুলেছে , আর তার ফলে এমনিতেই 'ভীরু জাতি' বদনাম ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো উত্তরপূর্বাঞ্চলের বাঙালি প্রায় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে । সন্ত্রস্ত হওয়ার কারণ ? তা কারণ একটা আছে নিশ্চয় , তবে সেটা মুখ্য নয় । মুখ্য নয় , কেননা স্বাধীনতার পর থেকেই নানান ছলছুতোয় এ অঞ্চলের বাঙালিকে বারবার হেনস্থার স্বীকার হতে হয়েছে । ধন-সম্পদ , মান-সম্মান , মায় প্রাণ অবধি খোয়াতে হয়েছে । সাম্প্রদায়িকতার বিষ-ছোবলে জর্জরিত হয়েছে শরীর-মন । অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে তারা এটা খুব ভালো করেই জানেন যে , আপাতনির্দোষ একটা কারণও রাজনীতির কূট চালে কেমন অবলীলায় প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে ! ভয়টা বহুবার বহুরূপে সম্মুখে এসেছে । ষাটের দশকে ভাষা-আন্দোলনের নামে , সত্তরে শিক্ষার মাধ্যমের প্রশ্নে , আশির দশকে বহিরাগত দিয়ে শুরু করে বিদেশি বিতাড়নের প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে । সম্প্রতি সেই ভয়টি পুনর্বার মাথা চাড়া দিয়েছে ‘নাগরিক পঞ্জি’ তৈরির প্রস্তাব গ্রহণের অনিবার্য অনুষঙ্গে । বিষয়টা স্পষ্ট হওয়া দরকার । নাগরিক পঞ্জি তৈরির পরিকল্পনায় দোষের কিছু দেখি না । সমস্যা পরিকল্পনা নিয়ে আদৌ নয় , সমস্যা হচ্ছে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার পদ্ধতি নিয়ে । সে বিষয়ে যাবার আগে আমরা কয়েকটি আপাতভাবে অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু জরুরি প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চাই । গোটা দেশে রাজ্য হিসাবে অসমের স্থান মোটেই সম্মানজনক তো নয়ই , বরং শিক্ষা-স্বাস্থ্য কিংবা গড় আয় এবং গড় আয়ুর নিরিখে এ রাজ্যের অবস্থা শোচনীয় । সারা দেশের মধ্যে শিশু ও মাতৃ-মৃত্যুর হার অসমেই বেশি । মজার ব্যাপার এই যে , এসব বিষয় নিয়ে ‘অসমের স্বার্থ’ সম্পর্কে অতি মাত্রায় ‘সচেতন মহল’ বিন্দুমাত্র বিচলিত নন । এদের হৈ চৈ এমন যে মনে হয় ‘বিদেশি নাগরিকে’র সমস্যা ব্যতীত আর কোন সমস্যাই বুঝি নেই এ রাজ্যে । ছিল না কোন কালে । অথচ আঞ্চলিক রাজনীতির এই সুচিন্তকেরা প্রায় অর্ধ শতাব্দি ধরে গোটা একটা জাতিকে বিদেশি জুজুর ভয় দেখিয়ে দিব্যি খোশ মেজাজে নরক গুলজার করে চলেছে । উপরে যে মৌলিক সমস্যার কথা বলা হল তার জন্য যে ‘বিদেশি নাগরিক’ দায়ী হতে পারে না সেটা দুগ্ধপোষ্য শিশুও জানে । কিংবা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চকে যদি বিদেশি সনাক্তকরণের সময়সীমা মেনে নেওয়া হয় তাহলে ধরে নিতে হবে যে ওই তারিখের আগে অসমে বাস্তবিক অর্থে তেমন কোন সমস্যা ছিল না । অথবা ওই তারিখের আগে উপরে উল্লেখ করা সূচক সমূহ উন্নতির অবিতর্কিত অধ্যায়ের জানান দিত । ইংরেজ শাসনাধীন ভারতবর্ষে হিতবাদীরা অনেকটা একই ধাঁচে প্রাচীন ভারত সব অর্থেই ‘রামরাজ্য’ ছিল কথাটা প্রচার করত , (যদিও রামরাজ্য ব্যাপারটা আদৌ লোভনীয় কিছু নয়) এবং সেই ‘সুখের স্বর্গ’ হারানোর জন্য মুঘলদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাত । যাবতীয় লাঞ্ছনার জন্য যারা মূলত দায়ী সেই ব্রিটিশ সরকারের সরাসরি কিংবা প্রকাশ্যে সমালোচনা করার সাহসের অভাবে ওরকম পলায়নবাদী অবস্থান গ্রহণ করা ছাড়া তাদের অন্য বিকল্প ছিল না । 
                   একথা আজ সর্বজনবিদিত যে আজকের ভারতবর্ষে উগ্র হিন্দুয়ানি জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ওই হিতবাদী গোষ্ঠীর উত্তরসূরীরাই বহুলাংশে দায়ী । অসমের তথাকথিত বুদ্ধজীবীকুল যারা বিগত অর্ধ শতাব্দি ধরে ভাষা প্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ‘হিতবাদী’ সেজে এ রাজ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারাই প্রকৃত বিচারে ভাষিক সাম্প্রদায়িকতার বৌদ্ধিক(?) পটভূমি তৈরির ভূমিকায় স্বেচ্ছা-নিয়োজিত । এদের ‘তত্ত্বের’ খোলসটি এমনই আলগা যে সামান্য টোকা দিলেও চট করে খসে পড়ে । তর্কের খাতিরে যদিবা ধরেও নেওয়া হয় যে বিদেশি নাগরিকের বাড়তি চাপ এ রাজ্যের অর্থনৈতিক অবনতির একটা অনিবার্য কারণ সেক্ষেত্রেও বড় রকমের একটা ফাঁকি ধরা পড়ে । সেটা এই যে, তথাকথিত বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা প্রসঙ্গে সর্বদা এক মনগড়া তথ্য হাজির করা হয়ে থাকে তথ্যসূত্রের উল্লেখের নৈতিক দায়টুকুও অস্বীকার করে । তার চেয়েও মারাত্মক হচ্ছে অনৃতভাষণ, সাধারণ মানুষকে বোঝানো হচ্ছে যে এই বিদেশিরা অসম তথা অসমীয়াদের যাবতীয় সম্পদ লুটে নিচ্ছে । কোন পদ্ধতিতে সে প্রশ্ন নাহয় মুলতুবিই থাক, কিন্তু এই মানুষেরা জীবনের তাগিদে ভোগ (?) করার সঙ্গে সঙ্গে সম্পদ সৃষ্টিতেও তো ভূমিকা নিচ্ছে ! তার হিসেব নিকেষ করার ক্ষেত্রে অনীহার কারণ নাহয় বোধগম্য , কিন্তু বিদেশির সৃষ্ট সম্পদের সুফল ভোগ করার প্রশ্নে দ্বিধাহীনতার কারণ বোধগম্য হয় না । প্রব্রজন নিয়ে যারা আধুনিক কালে গবেষণা করেছেন অথবা করছেন তাদের সংগৃহীত তথ্য বলছে অনুপ্রবেশকারীরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবশ্যই সদর্থক ভূমিকা পালন করে থাকে । অর্থাৎ , অর্থনৈতিক ক্ষতির যুক্তি পুরোপুরি ধোপে টেকে না । এ যুক্তি অতি অবশ্যই হাজির করা যায় যে যেহেতু ‘বৈধ উপায়ে’ প্রবেশ করেনি অতএব এদের থাকার অধিকার নেই । নীতিগত ভাবে এ যুক্তি মেনে নিতে আমাদেরও আপত্তি নেই , তবে মেনে নিয়েও কয়েকটা প্রশ্ন অনায়াসে তোলা যেতে পারে । বৈধতার বিচার কিভাবে হবে ? কাগুজে ছাড়পত্র ছাড়াই যাদের একদিন সীমান্ত ঊন্মুক্ত করে দিয়ে ‘শরণার্থী’ হিসাবে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল তাদের আচমকা ‘বিদেশি অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দেওয়া হয় কোন যুক্তিতে ? (কথাটা এ কারণেই উঠছে যেহেতু ’৫১ কিংবা ’৬১ সালকে ভিত্তিবর্ষ করার প্রস্তাব বারংবার এসেছে এবং এখনো কেউ কেউ প্রস্তাব করেন) । বড় জোর একথা বলা যেতে পারে যে এক সময় আশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলে আজীবন এদের দায়িত্ব এই রাজ্যের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয় । একথার যৌক্তিকতা স্বীকার্য , কিন্তু সেক্ষেত্রে উভয় দেশের সহমতের ভিত্তিতে শরণার্থীর প্রত্যার্পণ ও পুনর্বাসনের পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি উত্থাপিত হওয়া উচিত ছিল । কিন্তু মানবিক সে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা আন্দোলনের কোন পর্যায়েই উচ্চারিত হয়নি । এটা নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা । এখানে একথাও স্মর্তব্য যে ভারত সরকারের তরফে কিন্তু শরণার্থীদের ফিরে যাবার অথবা (বাংলাদেশ সরকারকে) ফিরিয়ে নেবার কথা বলা হয়নি । আরো মজার বিষয় এই যে সীমান্ত খুলে দেবার ঘোষনা কালে অসমের ‘থিংক ট্যাঙ্কদের’ কেউ আপত্তি জানায়নি । কেবল তাই নয় , বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পর হঠাৎ যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙল ও আন্দোলনের বাঁশি বাজল ! 
                   অনেকেরই নিশ্চয় মনে আছে যে প্রথমাবস্থায় ‘বহিরাগত’ শব্দটা ব্যবহৃত হত । পরে বিভিন্ন মহল থেকে ভিন রাজ্য থেকে আসা মানুষদের অধিকারের বিষয়ে প্রশ্ন ওঠায় উপায়ান্তর না দেখে অগত্যা ‘বিদেশি’ শব্দের আমদানি । এর থেকে একটা সত্য পরিষ্কার যে অসমীয়াভাষী নন অথচ দীর্ঘ কাল অসমে বসবাস করছেন এরকম ভিন্নভাষী মানুষদের চাকরি-বাকরি , ভূ-সম্পত্তি ইত্যাদির অধিকারী হওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়াই লক্ষ্য । মানসিকতাটি যে সংকীর্ণ শ্রেণীস্বার্থ পূরণের সহযোগী তা বলার অপেক্ষা রাখে না । এই মানসিকতা অবশ্যই গরিষ্ঠ সংখ্যক অসমীয়া মানুষের নয় । বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলনে এদের সমর্থনের কারণ ভিন্ন , সে বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাবে । যা বলছিলাম , এই ভিন্নভাষীরা মূলত বাংলা , হিন্দি ও নেপালি-ভাষী মানুষ । লক্ষণীয় যে নেপালিদের ক্ষেত্রে ‘অজ্ঞাত’ কারণে বিদেশি তকমা প্রযোজ্য হয়নি বা হয়না । (দোহাই , কেউ যেন ভেবে না বসেন যে নেপালি-বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে । প্রসঙ্গটি তোলা হল নির্মোহ বিশ্লেষণের স্বার্থে , যা আমাদের প্রতিপাদ্য থেকে অচিরে স্পষ্ট হবে । ) হিন্দিভাষীদের তত্ত্বগত ভাবে রেহাই দেওয়া হয় ভিন রাজ্যের বলে , যে কারণে ‘বহিরাগত’ শব্দটি বাধ্য হয়ে বাদ দিতে হয়েছে । তবে তত্ত্বের দিক থেকে ছাড় পেলেও কার্যত তারা যে মোটেও নিরাপদ নন ‘বিহারি নিধন পর্বে’ সে তো প্রমাণিত । বাকি থাকছে বাংলাভাষী মানুষ , যাদের বৃহত্তর অংশ ইংরেজ আমল থেকে এবং ইংরেজ শাসনের দৌলতে অসমের অধিবাসী । একাংশ দেশভাগের দরুণ বাধ্য হয়ে চলে আসা । যারা ’৭১ সালের পরে অসমে এসেছেন তাদের থেকে ’৭১ সালের আগে আসা বঙ্গভাষীদের পৃথকীকরণের কোন সদিচ্ছা কিংবা প্রয়াস আন্দোলনের কোন পর্যায়েই নেতৃবৃন্দের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি , এমনকি আজ অবধিও না । কিন্তু কেন ? অসমবাসী বাঙালি হিসেবে এ প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে আজ । বিদেশি বিতাড়নই যদি মুখ্য ছিল তাহলে যে বাংলাভাষীরা বিদেশি আর যারা বিদেশি নয় তাদের মধ্যে ভেদরেখা টানা এবং বাংলাভাষী ভারতীয় নাগরিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা আন্দোলনের স্বার্থেই আবশ্যক ছিল । অথচ এই অবশ্য করণীয় কাজটি না করে ভেদরেখাটি মুছে ফেলার কৌশল গ্রহণ করা হল । উল্টে এরকম অভিযোগও উঠল যে ‘স্বদেশী’ বাংলাভাষীরাই ‘বিদেশি’ বাংলাভাষীদের রক্ষণাবেক্ষন দিচ্ছে । অর্থাৎ , এই ছলে বাঙালি মানেই ‘অসম তথা অসমীয়া বিরোধী’ তত্ত্বটিকে জবরদস্তি করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল । এই সাম্প্রদায়িক তত্ত্বের বহুবিধ প্রয়োগ বিগত তিরিশ বছর ধরে আমরা দেখেছি ও দেখছি । নাগরিক পঞ্জি তৈরি নিয়ে যে বিতর্ক দানা বেঁধেছে তাতে পুরনো তত্ত্বের নয়া সংস্করণ ও নব্য প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যাবে এই আশঙ্কা বস্তুত অমূলক নয় । স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে যে বাঙালিরাই বা লক্ষ্য হচ্ছে কেন ! তার কারণ হচ্ছে এই যে , স্বাধীনোত্তর সময়ে যে অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা লাভের ক্ষেত্রে তাদের মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে বাঙালি মধ্যবিত্তের অগ্রসর শ্রেণীটির সঙ্গে । হিন্দি কিংবা নেপালিভাষীরা প্রতিযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অবস্থায় ছিল না এবং এখনো নেই বলে ওদের নিয়ে মাথাব্যথাও নেই তেমন । তাছাড়া প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা ক্ষুদ্র অংশ (ইংরেজ শাসকদের সুনজরে থাকার সুবাদে) স্থানীয়দের প্রায়শ হেয় জ্ঞান করত সেকথা অসত্য নয় । এই উন্নাসিক মনোভাবের দরুণ বাঙালিদের সম্বন্ধে এক বিরূপ মনোভাব একাংশ অসমীয়ার মধ্যে গড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিল । তার ফলে সামাজিক সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে প্রতিযোগিতা যত তীব্র হয়েছে ততই বিরূপতা থেকে বিরোধ এবং অবশেষে বিদ্বেষ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে । এখানে মনে রাখা দরকার যে উক্ত বাঙালি শ্রেণীটি শাসক সম্প্রদায়ের ‘ছোট শরিক’ হওয়ার সুবাদে ইংরেজ আমলে (এবং কেউ কেউ পরবর্তীতেও) অসমীয়াভাষীদের প্রতি যে অনভিপ্রেত দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছিল হালের অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীটিও শাসক গোষ্ঠীর কাছের ‘সরু গোঠ’ (ছোট গোষ্ঠী) স্বরূপ অনুরূপ মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ই দিয়ে যাচ্ছে । এর মধ্যে ক্ষুদ্র শ্রেণীস্বার্থ ছাড়া অন্য কিছু নেই , ভাষা-সংস্কৃতি তো বহু দূরের বিষয় । কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে গোটা অসমীয়া জাতি আন্দোলনের সমর্থক হতে যাবে কেন ! জানি , এ প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিক ভাবেই । যে কোন সমাজে এমন একটি শ্রেণী গড়ে ওঠে যাদের অনেকসময় বুদ্ধিজীবী আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে এবং এই শ্রেণীটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামাজিক চিন্তা-ভাবনা নিয়ন্ত্রণের মত কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে পড়ে । আর সে কারণেই এদের পক্ষে নানান কৌশলে জনমতকে নিজেদের স্বার্থের সপক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব হয় । বলা নিষ্প্রয়োজন এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয় না , আজ শত প্রচেষ্টায়ও সে জাতীয় সমর্থন অর্জন করা দুঃসাধ্য প্রায় । রাজনীতির অঙ্গনে আঞ্চলিক দলগুলোর সাম্প্রতিক হাল হকিকৎ সে সাক্ষ্যই দেয় । সমাজ অথবা জাতির একটা অংশ বা স্তরকে বেশ কিছুকাল নানা কারণে স্ব-শিবিরে ধরে রাখা সম্ভব হয় বলে পুরনো ভোঁতা দাবি নির্দিষ্ট ব্যবধানে পুনরুত্থাপিত হতে পারে এবং এই দল সমূহের গণভিত্তি রয়েছে বলে ভ্রমও জন্মাতে পারে । নাগরিক পঞ্জি তৈরির বিষয়টি আজ রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেছে উক্ত বিভ্রম জনিত কারণেই । এবারে দেখা যাক ইস্যুটি নিয়ে বিতর্কের বাতাবরণ সৃষ্টির পেছনের গোপন অভিপ্রায়টি কি ! আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে বিদেশি নাগরিকের সমস্যা (?ইস্যু) সমাধানের সদিচ্ছা - যারা দাবিটা করছে , আর যাদের কাছে করছে তাদের কোন পক্ষেরই নেই । নেই , কারণ তাহলে ঘোলা জলে মাছ ধরার সহজ খেলাটা চালিয়ে যাওয়া দুষ্কর । অগপ দল দু’দুবার ক্ষমতায় এলেও উক্ত সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে একটিও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি । কেন , সেটা দলের নেতৃবৃন্দ ভাল বলতে পারবেন । ক্ষমতাসীন ও অন্যান্য সর্বভারতীয় দলগুলোর ক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রাক মুহূর্তে ইস্যুটিকে চাঙা করে ভাষিক সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা হীনতার বলয়ে ঠেলে দিয়ে ভোট আদায়ের খেলাটা বরং অধিক সহজ ও লাভজনক । ডি এন এ টেষ্ট ইত্যাদির অবাস্তব দাবি আসলে জল ঘোলা করার কৌশল বই অন্য কিছু নয় । এরকম দাবিদাওয়া যারা তোলে তারা কার্যত জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে ক্ষমতাসীন দলের ‘বি টিম’ হিসাবেই কাজ করে । 
               ভা জ পা’র মত দলগুলি আবার আরেক কাঠি সরেস । এরা ভাষিক সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার মিশেল দিয়ে রাজনৈতিক ককটেল তৈরি করায় উৎসাহী । এদের যুক্তি হচ্ছে হিন্দুরা শরণার্থী , শুধু মুসলমানরাই বিদেশি । বিষয়টা যে মূলত ক্ষমতা দখলের লড়াই সেটা সহজবোধ্য । এজন্যই অ গ প দলের সঙ্গে ‘আন্দোলন বিরোধী’ সি পি এম কিংবা আসু-অগপ’র চোখে যারা ন-অসমীয়া সেই মুসলিম-বিরোধী ভাজপা’র মিত্রতা এত অনায়াসে ঘটে যে চক্ষুলজ্জার বালাই পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না । নাগরিক পঞ্জি নিয়ে আশঙ্কার কারণ যথেষ্ট । ভোটারদের ফটো পরিচয়পত্র প্রদানের পরিকল্পনার অ-বাস্তবায়ন থেকে ধরে এক বিশেষ ভাষাভাষী মানুষের অনেককে অযথা অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক ভাবে ‘ডি’ ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করা ইত্যাদি অভিজ্ঞতার দৌলতে এটা সহজেই অনুমেয় যে ভাষিক সংখ্যালঘু মানুষের জন্য এও আরেক ‘নয়া হেনস্থা প্রকল্পে’ পর্যবসিত হবে । নাগরিক পঞ্জিতে নাম নথিভুক্ত করার জন্য প্রমাণ সহ আবেদন করতে হবে । এমন অসংখ্য অগণন মানুষ আছেন যাদের ভিটেমাটি বলে কিছু নেই (অথবা থাকলেও বেহাত হয়ে গেছে) , জন্মের প্রমাণপত্র সংগ্রহ করাটা যে আবশ্যক সে জ্ঞান পর্যন্ত নেই ( কিংবা সংগৃহীত হয়ে থাকলেও রোদ-বৃষ্টি-ঝড় থেকে বাঁচিয়ে রাখার উপযুক্ত আস্তানাও নেই ) , স্থায়ী বসবাসকারী হিসেবে এদের প্রাপ্য শংসাপত্র (পি আর সি) প্রদান রাজ্য সরকার বন্ধ করে দিয়েছে বহুকাল । শিক্ষাদীক্ষা-চালচুলোহীন ‘নাগরিক শব্দের অর্থ না-বোঝা’ এই নাগরিকেরা কোন প্রমাণ নিয়ে সরকারের দরবারে হাজির হবে ? হবেই বা কেন ? অন্ন-বস্ত্র–বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ন্যুনতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত এই মানুষদের কাছে নাগরিক প্রমাণপত্রের কী-ই বা মূল্য ! নাগরিক পঞ্জি তৈরির দায় নাগরিকদের নয় , সরকারের । এতদিন সরকার এর প্রয়োজন বোধ করেনি কেন সে প্রশ্ন তোলা যাবে না , অথচ নিরীহ নির্দোষ নিরুপদ্রব নাগরিককে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বাদে সরকারের দরকার হবে আন্দাজ করে কোন একখণ্ড কাগজ কেন সযত্নে রাখেনি তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে ! এর চেয়ে হাস্যকর ও আজগুবি আর কিছু হতে পারে ? নাগরিক পঞ্জি হোক , কিন্তু কাগুজে প্রমাণ নেই বলেই ‘বিদেশি’ লেবেল সেঁটে দিলে চলবে না । যেভাবে বরাক-ত্রিপুরার বাংলাভাষী বহু মানুষকে মেঘালয়-মিজোরাম-নাগাল্যাণ্ড কিংবা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় যখন-তখন হেনস্থার শিকার হতে হয় প্রতিদিন । অভিযোগকারী অথবা সরকারকে বিদেশি তকমা লাগানোর আগে অ-নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতেই হবে । দরকার হলে আইন সংশোধনও করতে হবে এজন্য । একজনও যথার্থ নাগরিক যাতে নিগৃহীত না হয় সেটা নিশ্চিত করাই তো যে কোন সভ্য দেশের আইনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত । অথচ এ রাজ্যে না সরকারি তরফে না সমাজচিন্তকদের তরফে এ বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে । এর চেয়ে ন্যাক্কারজনক আর কি হতে পারে ! এই গুরুত্ব না পাওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে শঙ্কার কারণ, বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলনের আড়ালের কর্মসূচীও (hidden agenda) । একাত্তরে যারা এসেছে তারাও চার দশকের বাসিন্দা এ রাজ্যে । তবু এরা বিদেশি , মারাত্মক মারণাস্ত্র যেন ! (দুর্নীতির এই রমরমা যুগেও) ‘স্থায়ী বাসিন্দা’র সামান্য কাগুজে প্রমাণটুকুও যোগাড় করতে অক্ষম এই মানুষগুলো নাকি অহর্নিশ অসমীয়া জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ! প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় , নেলীর ধ্বংসলীলার নায়কদের চেয়েও কি মারাত্মক এরা ? ধেমাজির পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের জন্য যারা দায়ী তাদের চেয়েও সাংঘাতিক এরা , গুয়াহাটি বিস্ফোরণের কিংবা বেলতলা কাণ্ডের মূলে যারা ছিল তাদের তুলনায়ও কি অ-মানুষ এরা ? নেলীর নিহতদের এই আত্মীয়েরা ? এরকম প্রশ্ন তো হাজারো , কিন্তু জবাব দেবে কে ? জবাব যাদের দেবার কথা তারা ব্যস্ত বহু বীভৎস ধ্বংসলীলার নায়কদের যথার্থ মর্যাদায় জেলে রাখা হয়েছে কি না তার বিচার-বিশ্লেষণে ! আর মুষ্টিমেয় যে কজন শুভবোধসম্পন্ন মানুষ শুরু থেকে প্রতিবাদে মুখর ছিলেন ও আছেন তাদের অবস্থা ‘বিদেশি নাগরিকের’ চেয়েও মর্মান্তিক । বলা বাহুল্য , এরকম স্থিতি যে কোন জাতির জন্য অশনি-সংকেত স্বরূপ । এই অবস্থান থেকে সামনের দিকে গতি করতে হলে উপরের প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সৎ সাহস অর্জন করা চাই । যদিও সে লক্ষ্মণ এযাবৎ স্পষ্ট নয় , তাহলেও , বাজার-কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের এ যুগে উগ্র জাতীয়তাবাদের বাজার যে মন্দা অনেকেই সেটা বুঝে উঠতে পেরেছেন । ফলে ইস্যুটি জিইয়ে রাখার মধ্যেই যাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব নির্ভর করে তারা যে ‘শেষ বলে ছক্কা হাঁকানোর’ অন্তিম চেষ্টাটি করবে সে তো স্বাভাবিক । তাছাড়া এতসব কিছুর পর ‘অন্তত একটা কিছু’ও যদি না পাওয়া যায় তো মুখ লুকোনোর যায়গাও যে থাকে না ! দাবিটি ওঠার পেছনে এও একটা কারণ বইকি । সম্প্রতি আরেক হুজ্জত দেখা দিয়েছে । কোন এক আজমল নাকি অসমের মুসলমান বাঙালিদের প্রতি চলতি লোকগণনায় মাতৃভাষা ‘অসমীয়া’ লেখানোর জন্য আবেদন জানিয়েছেন । এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে আলফা নাকি এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে । কোন যুক্তিতে ? যুক্তিটা হচ্ছে , ভারত রাষ্ট্রের ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির উপনিবেশবাদী প্রকল্প নাকি এর ফলে মার খাবে ! এই যুক্তির খেই ধরে যদি এমন প্রস্তাব আসে যে অসমের সকলে ধর্ম পরিচিতিতে ‘মুসলমান’ লিখুক তাহলে তা কি গ্রাহ্য হবে ! হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ঘুচিয়ে ফেলার এমন সুবর্ণ সুযোগ আলফার মত বিচক্ষণ দলের তো কিছুতেই হাতছাড়া করা উচিত নয় । আজমল সাহেব যে ‘ভারত রাষ্ট্রের উপনিবেশবাদী নীতির’ বিরুদ্ধ নীতিতে আস্থাবান এই ‘তথ্যটি’ (নাকি ‘সত্যটি’) আলফার কল্যাণে যা হোক জানা তো গেল ! ‘বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো’ ইহাকেই বলে ! ভোটের মত লোকগণনার প্রাক্কালেও এই সব পাঁয়তারা কষা বরাবর দেখতে পাওয়া যায় । চিত্ত পালদের আচমকা আবির্ভাব ঘটে ।
                  অসমীয়াভাষীরা কোন কালেই অসমে সংখ্যা গরিষ্ঠ ছিল না , বর্তমানে যে নয়ই সে তো সহজেই অনুমেয় । বরাক উপত্যকার কথা নাহয় ছেড়েই দেওয়া গেল , কিন্তু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়ও বড়ো-কার্বিরা আজকাল এবং এমনকি দিমাছারাও আর নিজেদের অসমীয়াভাষী বলে পরিচয় দেন না , উজানে মরান-মটকদেরও ভিন্ন সুর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে , অন্যান্য জনজাতি গোষ্ঠী এবং বেলতলা কাণ্ডের সূত্রে চা-জনজাতি গোষ্ঠীও যদি অসমীয়াভাষী হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে অস্বীকার করেন তাহলে কোন সাংখ্যদর্শন ঘটবে সে তো জানাই আছে । অসমীয়া মধ্যবিত্তেরও অঙ্কটা জানা বলেই ‘নিরাপত্তার’ অভাববোধটাও প্রকট । আর এই অহেতুক সন্ত্রস্ততা থেকেই অসমীয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের সৃষ্টি , এবং সন্ত্রাসবাদেরও । কিন্তু তারা এটা বুঝতে অপারগ যে ওই উগ্র মানসিকতার জন্যই বিভিন্ন জনগোষ্ঠী সমূহ ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, যাচ্ছে । বাঙালি জাতির যে সাংস্কৃতিক সামর্থ্য রয়েছে তাতে বাঙালির অসমীয়াকরণ একটি অসম্ভব সম্ভাবনা মাত্র । এবং এই সাংস্কৃতিক পরিচয় টিকিয়ে রাখার জন্য জনসংখ্যার আধিক্য অবান্তর এবং অপ্রয়োজনীয় , গুণগত কারণেই তা টিকে থাকা স্বাভাবিক । অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির বেলায়ও কথাটা প্রযোজ্য । এই বাস্তবতা অনুধাবনের ব্যর্থতার দরুণ শান্তিপূর্ণ সহবাসের পরিবর্তে বৈরীতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে । সেটা যে অসমীয়া জাতির নিজের জন্যও ক্ষতিকর হয়েছে সেকথা (মনে মনে হলেও ) সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য । অসম রাজ্যের সার্বিক উন্নতি যদি সত্যিই কাম্য হয় তাহলে চিন্তার এই চক্রব্যুহ ভেদ করতেই হবে । আর তার জন্য প্রত্যেক অসমবাসীকে জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে নিজস্ব ভূমিকা অবশ্যই পালন করতে হবে । কিন্তু এই কাজের একটি জরুরি পূর্বশর্ত আছে । অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে অসমীয়া জাতির অগ্রবর্তী অংশকেই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে । ভিন্ন ভাষাভাষীদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হবে । কাজটা কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ সন্দেহ নাই , কিন্তু এই কঠিন কাজটাই করা চাই । অবিশ্বাসের দলিল-দস্তাবেজ এত দীর্ঘ ও বঞ্চনাময় যে সেইসব রক্তাক্ত স্বাক্ষর চট করে মুছে ফেলার ভাবনাও হঠকারী বিবেচিত হতে বাধ্য । তবে প্রয়াসের আন্তরিকতায় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খাওয়াও সম্ভব হয় । শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তখনই সম্ভব হবে যদি নাগরিক জীবনযাপনে, চিন্তায় ও মননে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার অভিষেক ঘটে । অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থান সহ মানবিক ভাবে বেঁচে থাকার অধিকারের দাবিটুকু নিয়ে গঠিত হোক আগামী দিনের নূতন পৌর সমাজ - যে সমাজে ভাষা-ধর্ম ইত্যাদির নিরিখে নয় , মানুষ পরিচিত হবে মানুষেরই পরিচয়ে । আর , মানবিকতার সে আধারে বিকশিত হবে বহু ভাষা , বহু ধর্ম ও বিবিধ সংস্কৃতির সমন্বয়ে সৃষ্ট বহুবর্ণী ফুল । ভবিষ্যতের ডি এন এ টেস্টেও নিশ্চয় ধরা পড়বে সেই ‘জেনেসিস’ । সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করা ব্যতীত আমাদের গত্যন্তর নাই । গত্যন্তর নাই ঠিক , তবে তার মানে এই নয় যে আমরা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখব । অসমের বাঙালিদের যদি মান-সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাহলে একটু অন্যভাবে ভাবতে হবে । প্রথম যে কাজটি করা চাই তা হচ্ছে একটি নির্ভরযোগ্য সংগঠনের জন্ম দেওয়া । বলা অহেতুক যে ‘আমরা বাঙালি’ মার্কা সংগঠনের কথা বলা হচ্ছে না । উপযুক্ত সংগঠন না থাকার জন্যই বেশি করে হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে এবং কোন প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাচ্ছে না । সংগঠনকে সদর্থেই হিন্দু ও মুসলমান বাঙালির প্রতিনিধিত্বকারী হতে হবে । এবং ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকার বাঙালির মধ্যেকার ভুল বোঝাবুঝি দূর করে মানসিক সংযোগ গড়ে তুলতে হবে । বরাকের বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির কথা ভাবে না , কিংবা বরাকের ভাষা আন্দোলনের প্রতি ব্রহ্মপুত্রের বাঙালি উদাসীন – এ জাতীয় মারাত্মক ছেলেমানুষি চিন্তা বস্তুত বিপক্ষের হাতে বিভাজনের সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় । দুই উপত্যকার বাঙালির অস্তিত্বের সমস্যার মাত্রা ও গুণগত পার্থক্য রয়েছে । এই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই পন্থা নির্ধারণ করতে হবে । আরো ভাল হয় , যদি সমগ্র উত্তরপূর্বাঞ্চল ভিত্তিক একটা সংগঠন গড়ে তোলা যায় । মনে রাখতে হবে যে , ভাষা অথবা ধর্ম- কেন্দ্রিক কোনরূপ সংকীর্ণতাকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না । সব রকম সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে অসমীয়া সমাজের অ-সাম্প্রদায়িক অংশের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে । কাজটা কঠিন অবশ্যই , কিন্তু অসম্ভব নয় । তাছাড়া ‘আসু’র আন্দোলনের মধ্যপর্বে সেরকম একটা প্রচেষ্টা করাও হয়েছিল, কিন্তু অসংগঠিত প্রয়াস ছিল বলে ফলপ্রসূ হতে পারেনি । অর্থাৎ, পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে মানসিক স্তরে একটা পরিপূরক আন্দোলন শুরু করাটাই প্রাথমিক এবং জরুরি বিষয় ।
            আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে একটি দাবি সনদ তৈরি করা হোক । কী থাকবে সেই দাবি সনদে ? ১) বাংলাদেশি খোঁজার নামে কোন ভারতীয় নাগরিককে হয়্ররানি করা হবে না সে বিষয়ে গ্যারান্টি দিতে হবে সরকারকে । ২) কমপক্ষে বিগত এক বছর ধরে যারা এদেশে বসবাস করছে তাদের নাম নাগরিক পঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে । ( অবশ্য যদি অ-নাগরিকত্বের সন্দেহাতীত প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, তবে তা যেন অমানবিক না হয় সেটাও দেখতে হবে ) । ৩) নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিতর্কিত বিষয়গুলি নিরসনের জন্য মানবাধিকার আয়োগ সহ একটি ত্রিপাক্ষিক (সরকার , আসুর মত দল ও ভাষিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিদের নিয়ে) ‘বিবেচনা সমিতি’ গঠন করতে হবে আগামী দিনের জন্য । ৪) পঞ্জিভুক্ত প্রত্যেক নাগরিককে সচিত্র পরিচয়পত্র প্রদান করতে হবে । ৫) প্রাথমিক প্রমাণ ব্যতীত কাউকে ‘বন্দি শিবিরে’ (detention camp) রাখা চলবে না । এই মূল দাবিগুলির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রয়োজনে অন্যান্য বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত করা যাবে । দ্বিতীয় দাবিটি নিয়ে যে জোর আপত্তি উঠবে তা বলাই বাহুল্য । কারণ , এই দাবিটি মেনে নিলে সমস্যাটির অস্তিত্ব চিরতরে লুপ্ত হতে বাধ্য । এবারে দেখা যাক এরকম দাবির যৌক্তিকতা কোথায় । সবচেয়ে বড় যুক্তিটা এই যে , (দাবি না করা সত্ত্বেও) সেরকমের অধিকার সামাজিক এবং প্রশাসনিক উভয় ভাবেই মেনে নেওয়ার নজির বর্তমান । আমরা অসমবাসী নেপালিদের প্রসঙ্গে পূর্বে বলেছি । ভারত কিংবা অসম সরকার , কারো সঙ্গেই নেপাল রাজ্যের কোন চুক্তি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই যার ভিত্তিতে নেপালের মানুষ এদেশে বসবাসের নিঃশর্ত সুযোগ পেতে পারে । এমনও নয় যে ভারতীয় কোন ভাষার সঙ্গে এদের ভাষাগত তেমন সাদৃশ্য রয়েছে যার ফলে ‘ভিনদেশি’ বলে সনাক্ত করা কঠিন । অথচ , বসবাসের প্রসঙ্গ বাদ দিলেও বিশ্বস্ত দ্বাররক্ষী থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা বিভাগ পর্যন্ত এদের সরকারি-বেসরকারি নিযুক্তি নিয়েও কোন প্রশ্ন তো উঠছে না ! এমনকি , উচ্চপদস্থ আমলা থেকে মন্ত্রীসভা অবধি তাদের উপস্থিতি স্বীকৃত । তাহলে বাঙালিদের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিটা আলাদা হবে কেন ? এ প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সমস্যার শেকড় , এবং সমাধান সূত্রও । তথাকথিত বিদেশি বাঙালিরাও অন্তত ছয় দশক আগেও ভারতীয় ছিল , কিন্তু নেপালিরা অদূর অতীতেও এদেশীয় ছিল তেমন ঐতিহাসিক সাক্ষ্য কোথাও নেই । অধুনার বাংলাদেশের অধিবাসীদের সঙ্গে ভারতীয় বাঙালির ভাষাগত অভিন্নতাই যে ‘বিদেশি’ (=বাংলাদেশি=বাঙালি)- বিরোধী আন্দোলনের আতুঁড় ঘর সে কথাটা তো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির এই ভিন্নতার মধ্যেই সুস্পষ্ট । ঠিক এই কারণেই অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রাখা বাঙালি ব্যক্তিত্বের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শনে অসমীয়া সমাজ আজও অকুন্ঠ নয় । উপরের কথাগুলো থেকে এমন মনে করার করণ নেই যে নেপালিভাষী মানুষদেরও ‘বিদেশি’ চিহ্নিত করে তাড়িয়ে দেওয়ার আমরা পক্ষপাতী । অসমের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা অস্বীকারের প্রশ্নই ওঠে না । এরা নিঃসন্দেহে অসমের অধিবাসী এবং ভাষিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অংশ হিসাবে বঞ্চনারও শিকার । আমাদের বলার কথা কেবল এটাই যে , অসমের বাঙালিদের বেলায়ও একই অবস্থান গ্রহণে বাধা থাকার তো কথা নয় । অথচ বাধা আসছে , আসবেও । কিন্তু কেন ? সে প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বিদেশি-খেদা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য , এবং চরিত্রও । এই সরল সত্যটা অসমীয়া সমাজের শুভবোধ সম্পন্ন প্রত্যেক জন ব্যক্তিকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে । স্বীকার করতে হবে , কেননা , বিভেদের এই খেলা গোটা অঞ্চলের জন্য সাংঘাতিক বিপদ ডেকে আনতে পারে । এই ষড়যন্ত্র বানচাল করতে না পারলে দ্বিতীয় কাশ্মীর সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব নয় । উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির মধ্যে তাই পারস্পরিক আদান-প্রদান নতুন ভাবে শুরু করা দরকার । বিভিন্ন ভাষা-ধর্ম-জাতি-জনজাতির মিলনভূমি এই উত্তরপূর্বাঞ্চল প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদের প্রাচুর্যে ঈর্ষনীয় ভাবে সমৃদ্ধ । গোটা বিশ্বের ক্ষুদ্র সংস্করণও বলা যায় অনায়াসে । অভাব কেবল ঐক্যের, একাত্মবোধের । একবার যদি একাত্মতার ভিত তৈরি হয় তো সব অভাব দূর হয়ে যাবে পলকে । আর সে জন্যই নানান ছলছুতোয় বিভেদের রাজনীতি উসকে দেওয়ার খেলা চলে , নিরঙ্কুশ লুন্ঠনের স্বার্থে । শুভবোধসম্পন্ন প্রতিজন উত্তরপূর্বাঞ্চলবাসীকে এ বিষয়ে সচেতন হয়ে তার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে । প্রক্রিয়াটা যদ সত্বর আরম্ভ হয় ততই মঙ্গল ।

কোন মন্তব্য নেই: