“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৫ মে, ২০১৪

বাজার

    (কথাশিল্পী রণবীর পুরকায়স্থ (জন্ম: ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯,আসামের সাবেক কাছাড় জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত লালখিরা গ্রামে। শৈশবের কিছুদিন চা বাগানে , কিছুদিন লোয়াইরপুয়া গ্রামে, তারপর শিলচর শহরে। শিক্ষা:- অভয়াচরণ ভট্টাচার্য পাঠশালা, কাছাড় হাইস্কুল, কাছাড় কলেজ থেকে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে  এম.কম. ।কর্মজীবন:- ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার আধিকারিক হিসেবে কলকাতা থেকে অবসর। লেখক বর্তমানে কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। লেখালেখি:- চারটে গল্প গ্রন্থ, দুটো উপন্যাস। বর্তমান গল্পটি বেরিয়েছিল গুয়াহাটির ‘পূর্বদেশ’ গল্প পত্রে। ভালো লাগল বলে তুলে রাখলামঃ সুব্রতা মজুমদার )
     রমুজকান্দি বাজারের জাতই আলাদা ।  নতুন জেলা হাইলাকান্দির একমাত্র রবিবারের হাট । বরাক, কুশিয়ারা, ধলেশ্বরীর যখন একটিমাত্র জেলা তখনও করমুজকান্দিই ছিল একমাত্র রবিবারের বাজার ।

     এই কাছেই, জানকীর বাজারে সারা শনিবার রাতভোর বাজার হয় । দুপুর থেকে হাঞ্জারাত পর্যন্ত সব হাটের যেমন , শনিবারি বাজারেরও আলাদা কিছু নেই। শুধু চেনা পসরার বিকিকিনির সাথে ‘থিথি থরর হই’ অবিরাম শুনতে শুনতে একসময় বাজারের মাঠ শুধু গরুতেই ছেয়ে যায়। বসে গরুর বাজার । গরুর বাজার, না চোরের বাজার, ঠগের হাট । তেলগুড় খাইয়ে একপোয়া দুধআলি গাইকে পাঁচসেরি করে দেয় বেঁচে । নাক কান ছিঁড়ে , ব্যাঙ্কের নথ খুলে চোরাই গরু বেচে দেয় খোলাোখুলি । রাতভোর বাজারে পুলিশের তৎপরতা থাকে ভাল, আদায়ও হয় ভাল ।

       সকাল দশটায় পুলিশের গাড়ি থেকে নামতে নামতে কনস্টেবল বাবুল মিয়া হাই তুলে। দুই হাত উপরে উঠিয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বলে,

---   হারা রাইত ঘুম নাই আইজ্ঞা। তেও কই, করমুজি বাজারর জাতঅউ আলেদা ।

              হাইলাকান্দি আর লালা শহরের ঠিক মধ্যবিন্দুতে করমুজি বাজার । সরকারি পরিবহনও রবিবার সকাল বিকাল দুই খেপ বেশি বাস চালায় । বাজারের কথা মাথায় রেখেই । বাজারের সামনে তো অন্যদিন দুমিনিটের থামা। বাজারবারে পনের মিনিট পাক্কা! বেশিও হয়ে যায় কখনও। মণির কাকার এক গেলাস মাগনা চায়ের লোভে দেরি করে দেয় ড্রাইভার । শিলকুড়ির রামুর সিঙাড়া যেমন বিশুদ্ধতায় বিখ্যাত, কাকার চাও তেমন। কাকা নিজের হাতে গেলাস গরম জলে ধুয়ে এক এক কাপ করে না ফুটিয়ে চা করে । কাপের মাপে ছোট গেলাসে এক টাকার চা । মণির কাকার চা খেতে শহুরে মানুষের ভিড়ই হয় বেশি ।

     সব বাসগাড়িই কাকার দোকানের সামনে এসে থামে । তেপথি মোড়ে থামলে প্যাসেঞ্জার হয় বেশি । বাজারবারে বেশি সময় থেমে থাকায় কেউ খুব অখুশি নয় । বাজারি, বেপারি , ড্রাইভার, কনডাক্টার, হেন্ডিমেন  আর সরকারি নিগম সবাই খুশি ।

     চিঁড়ে চ্যাপ্টা ভিড় , উৎকট গাত্রগন্ধ , আর বাসে উঠেই ‘ছারতায় না নিবা’ হাঁকেই রবিবারি বাজারের শেষ মজা । ঐ হাঁক যেন  হে আল্লা বা হরিস্মরণ । কেউ কিছু মনে করে না । ড্রাইভার কন্ডাক্টরও যাত্রীয় জয়যাত্রার আদুরে সম্ভাষণ বলে মেনে নেয় । কথক তো হেঁকেই নির্বিকার , কোমরে প্যাঁচানো খুতির অবস্থান দেখে রডে হাত বাড়ায় , হাতে বাঙ থাকলে সিটের নীচে চালান করার চেষ্টা করে , বাজারি মানুষের গালাগাল খায় , সহ –বেপারির সহানুভূতিও পায় ।

      --- অতাউ ইখানোর মজা , আমার বাড়ি তো স্যার আলগাপুরো, দেখি। ঘুমঘোরে ‘দেখি’ কথাটা আলগা করে বলে বাবুল কনস্টেবল ।

       আলগাপুর, সরসপুর, মোহনপুর ,কুচিলা এমনকি বাঘবাহার , আইরংমারা থেকেও দল বেঁধে মানুষ বাজার বাহার দেখতে আসে । দলে দলে রঙ বেরঙের সোয়েটার চাদর জড়ানো মানুষজন । এরা সবাই ক্রেতা নয় শীতকালের মর্নিং  রাইডার এদিকের লালা রাজ্যেশ্বরপুর ওদিকের হাইলাকান্দির মধ্যবিত্তরা দুরকম বাসে, অটো, স্কুটার, বন্ধুর বাইকে , উচ্চবিত্তরা নিজের গাড়িতে , গাড়ি ওয়ালা চাকুরেরা অফিসের গাড়িতে ।

     অন্য প্রান্তিক শহর লালা থেকে আসে হাটের মুখ্য বেপারিরা । ছোট এবং বড় ব্যবসায়ী । তুলারাম সিপানি, করমচান্দ সুরানা , ভবানীচরণ এরা আসেন ধোপদুরস্ত ধুতি শার্টের উপর ময়লা বুঝার উপায় নেই তুষ চাপিয়ে, সরকারি বাসে । হাজি সাহেব আর লাতু মিয়া মাটিতেলের ডিপুআলা, কাটলিছড়ার বাসে । তাদের হাতে থাকে সাধারণ সুতি কাপড়ের থলে , দামী বেসাতির জিনিষ কিছুই নেই, আছে শুধু কাগজপত্র । তাগাদার কাজে লাগে

     গরিব গুর্বোরাও হাটের লোভ ছাড়তে পারে না ওরাও আসে । ওদের জন্য ও আছে নানা প্রলোভন । করমুজি বাজারের যে জাতই আলাদা । এখানে আসতে তাই দাদনদার মহাজনেরা ভোলেন না।

     পাশের সব চা বাগানেই শনিবারে হপ্তা । মানে তলব দিন । কুচুর মুচুর হাড়িয়া মাড়িয়া খেয়েও যা বাঁচে তা নিয়ে রবিবারের মজা ও হলো, দু'পয়সার সওদা হলো, মহাজনরা তো বুঝে শুনে বাকিও দেয় । চাষিদের ও তেমন কিছু না থাকলে গান্ধিপোকায় খাওয়া আধপচা লাউ দুটো নিয়েই বাজারে চলে আসে । বাজারে বাসে আট আনার এক গেলাস সিদ্ধ চা , চার আনার টুস বিস্কুট , একটা খাওয়ার একটা খাওয়ানোর মোট দুটো বিলাসি বিড়ি চাইই চাই ।

      মহাজনেরা জানেন, খাতককে চোখে চোখে রাখতে হয় । আদায় আশু না হলেও চলে। গরিবরা তাদের শত্রু ভাবে না । চাষিদের  কুলি – কামিনদের সারা বছরের , পরবের প্রয়োজন মেটাতে এঁরা সদা প্রস্তুত । বাচ্চাদের রঙিন জামা, বৌ বেটিদের বেলাউজ , আর গামছা ধুতি , লুঙি , অসময়ের নগদ টাকা সবই এরা পায় । ধান উঠলে বা বোনাস পেয়ে আদায় না করলে বকুনিও খায় কষে । আবারও পায় । সব মহাজনদেরই কল্পতরু দোকান আছে বাজারে । কর্মচারী চালায়, বেছে বেছে বাকি দেয় । শহরে আড়ত আছে সবার । লাতুমিয়ার তো কেরোসিনের ডিলারশিপও আছে । বাজারে তারা সবার সুখ দুঃখের শরিক হতেই আসেন । গরিবের ভগবান ফেরেস্তারা চেনেন ও সবাইকে বালবাচ্চা সমেত ।

--- মানুষ খারাপ নায় স্যার । এরা জুলুম করে না । আমরার কুনু কেইছ নাই । বাবুল মিয়া হাতের ডাণ্ডা মুছতে মুছতে বিশেষজ্ঞের মন্তব্য করে ।

   এইসব ভগবান ফেরেস্তাদের পাশাপাশি গাদাগাদি হয়ে গরুর গাড়িতে ছোট ব্যবসায়ীদেরও পসরা আসে। বাজার সাজিয়ে বসলে শুরু হয় প্রতিযোগিতা । বাকি সময় তো ‘চল থি থি’র তালে সারে সারে দল বেঁধে চলা । মঙ্গলচণ্ডীপুরের আশে পাশে লালা, কৃষ্ণপুর , কয়া, কাটলিছড়া , নতুনবাজার ,মণিপুর, রাজ্যেশ্বরপুর , ঝাঁপিরবন্দ , গাগলা-ছড়ার হাট ছন্তরেই বেপারিদের সব বেসাতি , শীত গরম বর্ষায় তেরপাল বাঁধা হয়ে রাতের পর রাত এক বাজার থেকে অন্য বাজারে ঘুরেই চলেছে ।

    ‘হের থি থি’র শব্দে নতুন গাড়ির সারি এসে থামে আজান ডাকের ভোরে । দোকান দখল আর সাজানোর হুড়োহুড়ি লেগে যায় । তখন আর সারা রাতের আত্মীয় স্রীদামদাকে দাদা মনে হয় না, এক খেলার শত্রুতায় মেতে যায় সবাই ।

     গরুগুলিও চরে খেতে যায় । দল চেনে তারাও । বেড়া ভেঙে ক্ষেতে ঢুকলেও দল বেঁধে ঢুকবে । খোয়াড়ওয়ালা রামচন্দ্র সাউ সব কটাকে চেনে । ধরে না, বন্দোবস্ত আছে বলে ।

 --- আমরারও আছে স্যার। বন্দোবস্ত ।

     উর্দিপরা কনস্টেবল বাবুল মিয়ার সরলতায় উদ্বিগ্ন এ এস আই চক্রধর হাতের লাঠি জিপের বডিতে টং টং করে । বলে,

--- ওবা ইন্তাজ , চলো বাজার ঘুরিয়া আই , বাবুল চল রে বা । নন্দী সাবে গাড়িত থাকি খেয়াল রাখইন ।

    তিন পুলিশ বাজারের দিকে যায় । বাবুল যাওয়ার আগে বলে যায়,

   --- বুঝইন  অউত্ত তো স্যার। আমরার এরিয়াত পড়ে ।

  ড্রাইভার এন্তাজ আলি, এএসআই চক্রধর দাশ আর বাবুল মিয়া , এই পুলিশের টিম । ব্যাঙ্ক ম্যানেজার মহাজন নন্দী এদের বুঝবার চেষ্টা করে । সেই ভোর আটটায় স্টার্ট দিয়েছে , কৃষ্ণপুর, কয়া, নতুনবাজার , আয়নারখাল ঘুরে ধুলো উড়িয়ে সকাল দশটায় করমুজি বাজারে এসেছে । সারা রাস্তা কনস্টেবল বাবুল মিয়া একটানা কথা বলে গেছে তার মতো । মহাজন নন্দী ও নিজের মতো সাজিয়েছে এই হাট আর হাট নিয়ে সব বৃত্তান্ত ।

       সরল কনস্টেবল ভেবেছে নতুন ম্যানেজার শহুরে মানুষ, গ্রাম চেনে না , জানানো গেল । মহাজন দশ বছর আগে এই তল্লাটে ,একই শাখায় , ভিন্ন পদে কাজ করে গেছে । সব কিছুই তার বড় চেনা , তবু বার বার নতুন লাগে। সব নতুন, দৃশ্যে আকারে ঘ্রাণে ।

       এএসআই চক্রধর কী তাকে গাড়ির জিম্মায় রেখে গেল। ধুর! পুলিশের গাড়ির আবার  কিসের তত্বাবধান ।

      মহাজন গাড়ি ছেড়ে আয়নাখাল বাগানের দিকে যায় । ফ্যাক্টরির গেট থেকে বাজার শুরু। আঁটি বাঁধা লাইশাক, ধনিয়াপাতা , আলুপাতা, পালইশাক, হেলাইঞ্চার আঁটি , ভাগা করে ঠুনমানকুনির সঙ্গে চার টাকা হালির আদাজামির কয়েকটা নিয়ে বাগানের কিশোরী তার লাজুক পশরায় এক দামের গোঁ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর । ক্রেতারাও দরদাম না করে কিনবে না বলে ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে।                                      

       পাশেই কৃষ্ণপুরের বিখ্যাত ফুলকপির ঢেরি হুড়োহুড়িতে উধাও হয়ে যাচ্ছে। জানুয়ারির প্রথম রবিবার , উত্তরায়ণের বাকি কদিন । লালমূলো একটু কুলীন , সাদামূলো মুখ দেখিয়েছে । মেড়ামেড়ির পর একমাত্র সাদাই চলবে ফুরিয়ে যাওয়ার আগের কটা দিন ।

       আলু পেঁয়াজ ছাড়িয়ে চালের বাজারে নতুন বৈচিত্র , বিরইন চাল কেনে শহুরেরা । হাকরাইতের জন্য বেছে বেছে চুঙাও কেনা হয় এখান থেকে । যত কচি তত গন্ধ । সেদ্ধ ভাত খাওয়ার জন্য ভাজা সর্ষের তেল কেনে হুঙ্গিয়া হুঙ্গিয়া।

       ভার, টুকরি ভর্তি করে কমলা রঙের গুয়া আসছে , যা ঘা আর ভি র হিসেবে বিক্রি হচ্ছে আর মস্ত মস্ত বস্তায় ঢুকছে ।

      মশলাপাতিতে এক টাকার সর্ষের তেল , চার আনার লবণ , দশ পয়সার গোটা হলুদের খদ্দেরই বেশি ।

      লইটকা, টেংরা , কেচকি আর ইচার শুটকির সঙ্গে হাঁড়িতে সিদল নিয়ে পাশাপাশি কয়েকজন দোকানি হাঁকছে, বাংলাদেশি হিদল বাবু ।

       সিদল শুটকির দোকানের একপাশে মুড়ির লাড্ডু , চিড়ার লাড্ডু , গুড়, চিটা , তামাকের দোকান । তামাকের গন্ধ অনেক দূর পর্যন্ত যায় ।

       পিতলের ডাবা , কাঠের ও রাবারের নলে একটি ফারসি হুক্কা ছিল দাদুর, বাবাও খেয়েছে কিছুদিন, এখন কেউ খায় না । মাঝে মাঝে মহাজন রবারের নল টায় গন্ধ শোঁকে, শৈশবকে ডাকে। শৈশব জবাব দেয় ‘ গুড় গুড় গুড়র’ ।

       খাম্বিরা তামাকের অহংকারী গন্ধ মহাজনকে আবিষ্ট করে রাখে অনেকক্ষণ। এত বেশি কেজো হয়ে গেছে জীবন , মহাজন অবাক হয় , ভাবে এক বছর হল পোস্টিং পেয়েছে , কোথাও বেরোয় নি । কত পরিচিত এলাকা তার ।

       ছোটবেলায় আয়নারখাল বাগানে এসে থেকেছে । ভুলু মামার বাড়ি গেছে ভিসিংসায় । বড় মামার বাইণ্ডার ছিল ভুলু মামা , ভুলু মিয়া । সে সব তো বড় হয়ে জেনেছে । সে জানত ভুলুমামা বড়মামারই এক ভাই। জানত না ভুলু মামাকে কেন কলাই করা থালায় আর এনামেল গ্লাসে একা একা ভাত খেতে দেওয়া হয় । ওর বাসন ওকেই ধুয়ে রাখতে হয় ।

      হাইলাকান্দির শৈশব ভিসিংসায় বেড়াতে যাওয়ার মতো , বিশ্বনাথ টকিজে নীলাচলে মহাপ্রভু দেখা , ধলেশ্বরী নামের স্বল্পতোয়া নদীটিকে শুধু নামের গুণে ভাল লাগা, আর ছোটমামার পাঠশালা , কখনও দেখে নি তবুও নিশ্চিন্তপুর পাঠশালাটি বড় প্রিয় ছিল তার ।

        হার্বাটগঞ্জ বাজার । বিকেলের বাজার দেখা শুরু হয় পুলের রেলিং এ উঠে, বাজারময় সাদা মাথার মেলা । তকি মাথায় মুসলমান হাটুরের সংখ্যাই বেশি ছিল তখন । মাছ মাংস ওজন করে কিনত না কেউ । ছোট মাছের ভাগা আর বড় বলতে তো রুই কাতলার পেটি আর গজের চাকা । ছিল তুষের উপর বসানো সাদা সাদা বড় হাঁসের ডিম আর ছোট মেটে রঙের মুরগির ডিম , দেশিই সব । হিন্দুবাড়িতে তখন সরাসরি মুরগি বা মুরগির ডিম কেনার রেওয়াজ ছিল না । উঠনের লুকনো কোণে ভুলুমামার তদারকি আর বাসন বর্তনের যোগানে বড় মামা রান্না করতেন, মুরগির ঝোল আর কলাপাতায় ভাত । সে এক মোচ্ছব হতো ।

  --- স্যার, ছাওয়াত গিয়া বইন , আমরা অখনঅউ আইয়ার, সাইকেল দেখলেউ স্যার... ।

    বাকিটা ইশারায় বুঝিয়ে দেয় । শুধু এই কথাটি বলার জন্য বাবুল মিয়ার উদয় ও অন্তর্ধান ।

    মহাজন ছায়া খোঁজে । জিপটার কাছাকাছি ফিরে এসেছে আবার । সামনেই নেপাল মাস্টরের চায়ের দোকান। বাঁশের নড়বড়ে বেঞ্চি দুটো দোকানের দুপাশে । মহাজন তারই একটিতে বসে ফাৎনায় মনোনিবেশ করে , হারানো সাইকেল খোঁজে ।

     পুলিশও খুব মজা করছে সেই সকাল থেকে । এন্তাজ আলি যে এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে দেবে ভাবতে পারে নি মহাজন । কাণ্ড তো কী একটা সাইকেল চুরির তদন্তে গোটা মহকুমা তোলপাড় করে তুলে এক বেলায় ।

--- ওই বেটার সাইকেল দেখইন স্যার ।

       নেপাল মাস্টর বলে। নেপাল মাস্টর চা-ওয়ালাও জেনে গেছে তার সাইকেল হারানোর গল্প । চায়ের কাপ হাতে মহাজন সাইকেল আরোহীকে দেখে । তার নয়, এক মণিপুরি হাটুরের নিজের বাহন । উৎসুক নেপাল হোটেলওয়ালাকে হতাশ করে মহাজন ।

    সাইকেলের কথা আর ভাবতে চাইছে না মহাজন, আলাদা জাতের এই বাজারটা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে ।

   --- আইচ্ছা মাস্টর ইখানো মাছর বাজার বয় না ।

  মহাজনের কথার জবাবে মাথা নাড়ে নেপাল । তারপর ভুড়ুৎ করে নাক ঝেড়ে লুঙিতে মুখ মুছে নেপাল জ্ঞননিষ্ঠের মতো জানায় ,

   --- না স্যার, মাছ ইখানো কে কিনত , সব তো বাগানর কুলি আর গাউর লেংটা লুংটা মানুষ । অই ডালাত করি ইচা পুটি মকার ভাগা লইয়া বই রইছে দুই একজন । বাজার তো হইল হউ , আপনারা যার টানে আইন ।

    --- মুরগি নি।

    --- না স্যার, ই বাজারর জাত অউ আলাদা । ই বাজারর জাত অইল তার পাঠা আর ছাগল । যাইন না ,দেখিয়া আইন । দেখলেউ কিনার হাউস অইব ।

     যাবে বলে এগোয় । ইতিমধ্যে একটা লোক মরা মুরগি একটা, কেজি দেড়একের হবে , নেপালের রান্না ঘরের সন্তর্পণে রেখে দেয় । একটা লেনদেনও হয় । মহাজন দেখে হোটেলওয়ালা লোকটাকে একটা পাঁচ টাকার নোট দেয় ।

    গ্রাম দরিদ্রের সব স্নেহের পুত্তলি, ছাগশিশুতে ছেয়ে আছে বাজারের বড় অংশ । সাদা, কালো আর পিংলা রঙের মুখ্যত । একজনকে চিনতে পারে মহাজন, ধনু মিয়া, আরটিও লোনি । ট্রাক নিয়েছে ছমাস হলো , শোধ দেয়নি একটি কিস্তিও । কুচিলা থেকে এসেছে বোনের বিয়ের পাঁঠা ছাগল কিনতে । .

    --- ইখানো খুব সস্তা স্যার , কিনঅইন না একটা ।

    --- কিনতাম তো বা, তে নিমু কেমনে ?

   --- আপনার তো পুলিশর গাড়ি অউ আছে । তারা না নিলে আমি পউছাই দিয়া আইমু নে । মকবুলদা, স্যারর লাগি একটা কচি দেখি দেও । জান নি

তাইন কে ।

 --- ওবা ধনু ।

--- না স্যারে, ইতা ঠগ হাবুগুলি । একটু ডর দেখানি লাগে । একটু কম নিব । এমনেউ দাম বেশি নায় , আশি টেকার উপরে দিবা না । মাছও খুব দাম আইজ কাইল । জানইন নি স্যার , ই বাজারর নাম আমার এক বুজুর্গর নামে । ঠাকুরদার দাদু, করমুজ মিয়া ।

    ধান্দাবাজ ছেলেটির হাত থেকে ছাড়া পেতেই উল্টো দিকের গাছতলার একটি কালো নধর বাচ্চা পাঁঠা নেড়ে চেড়ে দেখে মহাজন । তখনই , তার ঘাড়ের উপর শ্বাস ফেলে এক ধূসর জিনস প্যান্ট জ্যাকেট পরিহিত সুপুরুষ । যার মুখশ্রীর খুঁত তার সামনের পাটির দুটো দাঁতে ফাঁকা জমি । মুচকি হাসিতে নিজের পরিচয় দেয় রোদ চশমা হাতের মানুষটি ।

    --- মিস্টার এফ এ বড়ভূইঞা , এএসইবির এসডিও, এলিয়াস ফকির আহমেদ ওরফে রুপাই মিয়া আর্টিস্ট । আর আপনে, মানে তুই । তুই একটা কালা পাঠা ।

       অবাক আনন্দের অভিব্যক্তি মহাজনের । বন্ধুকে দেখে । বন্ধু বলে,

 --- তুইন বেটা মাজন , করমুজিত তর কিতা কারবার ।

      রুপাই জানে না মহাজন আবার বদলি হয়ে মঙ্গলচণ্ডীপুর চলে এসেছে । এরকম তো হয় না একই জায়গায় দুই টার্মে খুব কম বদলি হয় । মহাজন জানায় সব বৃত্তান্ত বন্ধুকে । এক বন্ধুর হাতে কাঁঠাল পাতার কিতা আর আর একজনের হাতে ছাগল বাচ্চার গলায় বাঁধা দড়ি ।

     ধনুমিয়া মহাজনের হাত থেকে কৃষ্ণবর্ণ ছাগ শিশুটিকে উদ্ধার করে । বলে,

    --- স্যার বাড়ি পৌছাই দিয়া আইয়ার ।

 --- আরে কিতা মাতো বা । দরদাম করলাম না , কিনলাম না , বাড়িত দিয়া আইতায় কিতা ! আর তুমি যাইবায় একদিকে আমি যাইমু উল্টা ।

    মহাজনকে আশ্বস্ত করে অবিশ্বস্ত আরটিও লোনি ছোকরা জানায় ,

   --- ইতা ভাবইন না যে স্যার , আপনার গাড়ি তো রইছে আমার কাছে ।

   মহাজন বুঝে অকৃতজ্ঞ ব্যাঙ্কঋণী তার বন্ধকের গাড়ি স্যারের উপকারে লাগাতে চায় । তাই বলে,

   --- হি নায় অইব , দাম ফুরাও ।

  --- ইতা অই যাইব স্যার, একলগে অতটাইন কিনিয়ার ।

  --- কেনে আমারটা মাগনা নি ।

   মহাজনকে বিরক্ত হতে দেখে ফকির আহমেদ ইঞ্জিনিয়ার পাশ থেকে বন্ধুকে সমঝোতার শর্ত দেয় বলে,

 --- পছন্দ অইলে কিনিলা , পৌছানির প্রবলেম অইত নায়, অনুকূল তরে পৌছাই দিয়া আইব নে পাঠার লগে ।

  --- অনুকূল কে বে ।

  --- আমার ড্রাইভার ।

   --- আর তুই যাইতে নায় ? তে আর পাঠা কিনলাম কেনে ।

   --- তবা তবা । তর ইতা ছেদ মারা গোস্ত খাইমু নি আমি ।

  --- আইচ্ছা অইব নে , অখন রায়ট লাগাইছ না । আইবায় তো বা বড়ো ভুইয়া ।

    মহাজন নন্দী চরাচর লুপ্ত অবস্থায় বন্ধুর মুখের দুটো দাঁতহীন গহ্বরের দিকে তাকিয়ে শুনে খাম্বিরা তামাকের ডাক । দাদুর ফারসি হুক্কার জলভর্তি ডাবায় উথাল পাথাল মন্দ্রধ্বনির ডাক শুনে ‘গুড় গুড় গুড়র’ ।

   পুলিশ, পুলিশের গাড়ি , হারানো সাইকেল , চক্রাকারে ঘুরে আসা ধুলোউড়ি পথ, মরা মুরগি, কচি পাঁঠা সবই এক অপ্রতিম প্রভায় দেবদেহে যেন লীন হয়ে যাচ্ছে । যে ছিল তার বাল্যসখা , বন্ধু থেকে ক্রমশ নিয়েছে ব্যাপ্তি । বাঙালির ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে বারো ভুইয়ার এক ভুইয়া হয়ে ।

   --- বড়ো ভুইয়া কইয়া ইয়ার্কি মারিও না , আমরার ধমনীত বারো ভুইঞার রক্ত বর রে মাজন ।

     সদঅর্থেই অনেক ফুটানি দাপদাপিয়ে বেড়ায় রুপাই । দুটো দাঁতহীন গহ্বরও তার এক সত্য গোঁয়ার্তুমির ওয়ারিশান ।

    বছর দশেক আগে , বয়স তখন দশ বছরের ছোট । তিরিশ ছোঁয়া এক বিপজ্জনক কাল । ধর্মে সইবে না এমন কাজ করতে গিয়ে, সখের চিত্রকর তার দুটো , সামনের পাটির দাঁত হারালো । কী সব ছবি ।  একটায় ,

      ঘরের মেয়ে বউ হয়ে বেঘরে যাচ্ছে , এক খাঁচা থেকে অন্য খাঁচায় পাঠানোর ট্র্যান্সফার ফী বা দালালি ফী নিচ্ছে ধর্মীয় নেতা ।

       দুই খানদানি তেল ঘিএ লুতুপুতু ভুঁড়ির মাঝখানে শীর্ণকায় নামাজির চেপ্টে যাওয়ার দলিল ।

       সোনাই শহরে এমন প্রদর্শনী শুধু রুপাই মিয়াই করতে পারে দাঁত খোয়ানোর জন্য । ছুটির দিনে মহাজন নন্দীকে পাঁঠা কেনায় উৎসাহিত করে রুপাই মিয়া ওরফে ফকির আহমেদ বড় ভুইঞা , তার ডাকাবুকো বাল্যবন্ধু বলে , সরকারি আলো নিগমে চাকরি করে । বলে, অন্ধকার মেরে আলোর উৎস রক্ষা করাই কাজ । বলে, আঁধার মহিষকে কটাতে গিয়ে নিজেও কাটা পড়তে পারি কোনদিন, তো ক্যা । মহাজন বন্ধুর এসব গোঁয়ার্তুমির কথায় ভয় পায় । বন্ধুর জন্য গর্বও হয় আবার ভয়ও হয় । তাই ঘোর লাগা বোকা বন্ধু বেমুতালিক একটা প্রশ্ন করে বসে ,

 --- আইচ্ছা বেটা, অইছে । অখন দাত দুইটা বান্দাইলা । বান্দাইতে না নি ।

মহাজন জানে দাঁত না বাঁধানোতেই রুপাই মিয়ার বরফুটানি ।

অগূঢ় কথাটা বলে ফেলে স্বভূমে ফিরে আসে মহাজন । ধনুমিয়াকে উপেক্ষা করে সরাসরি পাঁঠার মালিককে বলে,

--- কতত দিবায় কইলাও । কালা বাইচ্চা ইটা । একশ , এক কতা, দিলাও ।  

পাঁঠার মালিকানা নিয়ে বন্ধুর দিকে ফেরে , বলে,

--- দেখ ফকির , তোর লাগি ধনী মাজন বেটার অতটাইন টেকা গেল , অখন তোর অনুকূল মহারাজ রে দিয়া গাড়িত উঠা আর চল মঙ্গলচণ্ডীপুর ।

 মহাজনের দরাদরিতে কাজ হয় না ।

  পাঁঠার দাম দিতে হয় দেড় শো টাকাই ।

 কথা ঠিক হয় অনুকূল ও তার প্রভু বিকেলের আগেই মঙ্গলচণ্ডীপুর পৌঁছবে । কারণ এসডিও সাহেবের বিভাগে আলোর বিতরণ নিয়ে ভজকট সামলাতে দুপুর গড়িয়ে যাবে ।

 স্থির হয়, পাঁঠা যাবে পুলিশের গাড়িতে ।

 পুলিশ বাহিনিও মহাজনকে পাঁঠা কিনতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে । চক্রধর বলে,

--- কিনলা নি ।

 মহাজনের সম্মতি পেয়ে পাঠাওলাকে ধমকায় এএসআই । বলে,

  --- নতুন মানুষ পাইয়া খুব ঠগাইলে বেটা । পাঠা ছাগল বেচার লাইসেন আছে নি তোর, দেখা ।

লোকটি জোড় হাত করে বলে,

 --- তুলা দিছি বাবু

--- হুঁ । যা গাড়িত উঠাইয়া দিয়া আয়, বালা করি বান্দিছ । মেনেজার বাবু চলঅইন ।

 --- যাইন , আইয়ার , বন্ধুরে তো নিমন্ত্রণ করলাম , বাড়ির ঠিকানা তো দেওন লাগব ।

এতক্ষণের রসিক মানুষটি পুলিশ দেখে রসের ধারায় ঘন হয়, হয় তির্যক । বলে,

 --- তুই যা, আমি বার করি লাইমু । ছোট শহরো দারোগারে চিনে চুরে আর ড্রাইভারে । কিন্তু হক্কলে চিনে পোস্টমাস্টর, ষ্টেশনমাস্টর আর হেড মাস্টর রে , ব্যাঙ্ক মাস্টররে ও চিনে ।

  --- না রে বা আমার খুব লো প্রফাইল । এক বছরর তো ডেরাডাণ্ডা । আগে আছলাম মেছো । অখন সংসারী মাইনষর কোয়ার্টার অইছে ।

   ---লো না হাই তো দেখিয়ার । পুলিশ লইয়া ঘুররে এক পাশশ টেকার সাইকেলর লাগি।

   --- ব্যাঙ্কর সাইকেল বেটা ।

  --- বুঝছি , অখন দেখবে নে চোররে তো ধরত নায়, খামকা কুনু নিরপরাধরে ধরব । দেখিছ ছাইকেল পাইতে নায় ।

  --- ইতা বাদ দে পাইলে পাইলাম নাইলে না । রেকর্ড রইল পুলিশর লগে তো ঘুরলাম । অখন ক কেমনে আইবে আমার বাড়িত ।

  --- চিনি নি কুনু , বার করিলাইমু ।

--- পারতে নায়, তিন রকমের পথ আছে ।

 --- ক, এক নম্বর ।

--- চন্দ্রপুর দিয়া ঢুকি যাইছ । মসজিদর ধারে দি রাস্তা ।

--- দুই নম্বর।

--- ষ্টেশন পার অইয়া , মাধব মন্দিরের সামনে ব্যাঙ্ক , কাচা রাস্তা পার অই যাওন লাগব । পার্কিং পাইবে ব্যাঙ্কর সামনে ।

--- তিন।

--- ই এক আতান্তরি পথ । পটাপট যাওয়া যায় । লেভেল ক্রুশিং দিয়া দুই মিনিটর হাটাপথ । কলেজ পার অইলেউ কবরখানা কালীবাড়ি । দুই কমিটিয়ে মারামারি , তুই ভুলেও যাইছ না । তুই গেলউ রায়ট লাগাই দিবে ।

 --- তে তো যাইমু ।

রুপাই মিয়া একদিকে , পুলিশের গাড়ি আমলার দিকে ধূলো উড়িয়ে বাজার ছাড়ে।

পাঁঠা চেঁচায় বাবুল মিয়া বলে,

--- বেশি না স্যার , তিন কেজির বেশি অইত নায় গোস্ত । দাম কমউ নিছে দেড়শো নানি । চক্রধর বলে,

 --- ইঞ্জিনিয়ার আপনার বন্ধু ।

--- অয় দেখলা তো । আপনারেও চিনঅইন ।

--- চিনন লাগে । রুপাই মিয়া ই জিলার বড় বিপজ্জনক ব্যক্তিত্ব , কনটিনজেণ্ট লায়বেলিটি  । আসামি নায়, আবার যে কুনু সময় ... আপনার বাল্য বন্ধু তো, কইন না কেনে ?

--- কিতা কইতাম ।

--- ইন্তাজ,  একটু  আস্তে যাও চাইন বা ।

  আমালার পুলের কাছে এসে চক্রধর গাড়ি থামাতে বলে। কয়েকটা সাইকেল জড়ো করা এক জায়গায় ।

 --- দেখি লাইন, এর মাঝে আসে নি আপনার । আমরা একটু আই গিয়া , ইনকাম আছে ।

    বাবুল মিয়া যাওয়ার আগে মহাজনকে জানিয়ে যায় বার্তা । ভিডিও শো হচ্ছে ভেতরে, বাইরে সাইকেল রেখে গেছে। কাঁচা ঘরটায় যেখানে শো হচ্ছে ঢুকে যায় তিনজনে ।

    গোটা পনের সাইকেল , একটা একটা করে দেখে মহাজন, আর পুলিশ বাহিনির উপর কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হয় । কৃষ্ণপুর, নতুনবাজার, কয়া হয়ে এত ঘুরে , কাঁচা পাকা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে শুধু ব্যাঙ্ক এর এক সাইকেলের জন্য এত করল । সাইকেলটা ব্যাঙ্কের হলে কী হয় , নিয়ে তো বেরিয়েছিল মহাজন ।

    রবিবার এত ভোরে ব্যাঙ্ক এর সাইকেল নিয়ে কেন বেরুবে , ম্যানেজারের সাইকেলের কী দরকার । ওর কাছ থেকেই তো উশুল করবে ব্যাঙ্ক । করলেও, কতই বা দাম , এর জন্য পুলিশ এত করবে ।

   এন্তাজ ড্রাইভার মহাজনের উপর খুব কৃতজ্ঞ , ওর বাবার কিছু টাকা ছিল শিলচর  শাখায়, হেয়ারশিপ সার্টিফিকেটের ঝামেলায় টাকা পাচ্ছে না, মহাজন ব্যবস্থা একটা করে দিয়েছে । টাকা পেয়েও যাবে এন্তাজ ।

    বাবুল মিয়া মহাজনকে বলে,

  --- চলঅইন স্যার , ইখানো পাওয়া যাইত নায় , ইখানো দিনর বেলা অন্য

লীলা ।

--- বাবুল ।

চক্রধর  ধমকের ডাক দেয় ।

চক্রধর গম্ভীর মানুষ। বলে,

--- পাওয়া যাইত না কেনে , অত সাইকেল ইখানো, একটা উঠাই লাও বাবুল ।

--- না না । আপনারা অত করছইন ।

 --- আমরা আর কিতা, করছে ইন্তাজে । গগৈ দারোগায় কইলে কিতা অইব , এন্তাজেরে কিতা জাদু করছইন, হে গাড়ি বার না করলে অইল না নে । পুলিশ এক সাইকেলর লাগি অততা করে না ।

      ব্যাঙ্ক এর সামনে গাড়ি থামায় ইন্তাজ আলি ।

      কালা দাঁড়িয়েছিল মাধবমন্দিরের সামনে । মহাজনকে দেখে দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে আসে ওপার থেকে । বলে,

  --- সাইকেল পাওয়া গেছে আইজ্ঞা ।

      হারানো প্রাপ্তির খুশিতে কালার কণ্ঠে হাঁপ ।

     মহাজনের গলায়ও । খুশি উৎসুক হয়ে বলে,

 --- কই পাওয়া গেল বে ।

 --- আপনেউ রাখি আইছলা সুবুদদার চা-র দুকানো । আমি গিয়া আনছি ।

 --- বালা করচছ , অউ নে ।

 মহাজন কালাকে খুশির বখশিস দিতে পকেটে হাত দেয় ।

 --- কিতা কররা স্যার ।

তিনজন  পুলিশ কর্মীই একসাথে বাধা দেয় মহাজনকে । চক্রধর ছোট দারোগা বলে,

 --- ইগু কিগু কইন চাইন ।

 --- হে কালা , ব্যাঙ্কর জমাদারর পুয়া , আমার বাড়িত কাম করে ।

 --- হি তো বুঝলাম । বাবুল চিনরায় নি বা ।

এবার বাবুলের পালা । বলে,

--- অয় স্যার ইগুঅউত্ত একবার তিনদিন আছিল হাজতো । বিধুবাবুর বাড়িত চুরি করছিল ।

  নিশ্চিন্ত হয়ে চক্রধর ফরমান দেয়,

 --- উঠ উঠ , উঠাও ইগুরে ।

        অসহায় মহাজন তার ভাল পুলিশ দলকে অনুনয় করে ,

 --- দেখইন চক্রধর বাবু , হে অখন বালা অই গেছে , আমার বাড়িত থাকে তো , সব সময় দেখি , হে চুরি করছে না , ছাড়ি দেইন ।

 --- ইতারে আপনে চিনঅইন না স্যার , হাড়ে হাড়ে বদমাইশ , পুলিশরে একটু কাম করতে দেইন না ।

   পুলিশ বাহিনি হঠাৎই তৎপর হয়ে ওঠে ।

--- আমি জামিন চাইলে দিবা নি। ছেলেটা আমার লাগ... প্লিজ চক্রধর বাবু ।

  মহাজন ছোট দারোগার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে ।

 --- কইরা যখন, ঠিক আছে , একটু লাড়ি চাড়ি ছাড়ি দিমু , ভাবঅইন না যেন।

ছাড়ি দিমু একবার বাবুল আইয়া আপনার একটা সই লই যাইব ।

চক্রধরের আদালতের রায় পাল্টায় না ।

পাঁঠা নামে, কালা ওঠে ।

মিনির হাসি

                 (গল্পটি এখানে এই বাংলা লাইব্রেরি ফোরামেও আছে।)                                                                                                                                                                 
           ।।  রণবীর পুরকায়স্থ ।।

   মার সাগর দেখার কৌতূহলেও মিনি হেসেছিল। ও খুব জোরে হাসে না। মিনির হাসির কোনো শব্দ নেই।      মিনি সবসময় মুখেও হাসে না,- ওর চোখের মনি দুটো শুধু এপাশ ওপাশ করে। কখনও একটা ঠোঁট ভাঙে, কখনও  কখনও দুটোতে চাপ দেয় শক্ত করে, কখনও  নিচেরটাকে ওপরে উঠিয়ে আলতো চেপে রাখে। এরকম অনেক নীরব ভঙ্গি  আছে ওর হাসির। মিনির চৌকো ফ্রেমটাও ওর চোখ দুটোকে আরো রহস্যময়ী করে তোলে। মিনির রহস্যময়ীতা আমাকে বিব্রত করে।
(C)Image:ছবি
         

            আমরা শেষপর্যন্ত  সাগর পারেই বেড়াতে এলাম। কেয়ারটেকারের হাত থেকে চাবিটা নিয়ে আমি মিনিকে শুনিয়ে শুনিয়েই নম্বরটা বললাম। দুশো বারো । মিনি শুনল এবং আমার হাতের দিকে তাকিয়ে হাসলো । আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নম্বরটা আবার ভাল করে দেখলাম । দুশো বারোইতো ! চাবির রিংটা অবশ্য খুব মজার । গোল মতো একটা টিনের পাতে ফুটো করে চাবিটা লাগানো । ঠিক গোলও নয় ডিমের আকারের একটু লম্বাটে পাতটায় দুশো বারো সংখ্যাটাই খোদাই করা । ঘরের নম্বরই হবে । তবে কি চাবির রিং এর অভিনবত্বেই মিনি হাসলো ? আমি চাবিটাকে শক্ত করে হাতের মুঠোয় ধরে রাখলাম ।

           মিনি আমাকে কোন ব্যাপারেই তাড়া দেয় না । - আমার উপর নির্ভর করতে চায় মিনি । এখনও, আমার এত ভুলের জন্যে তাড়া দিল না । ঝড়বৃষ্টি বাঁচিয়ে সিঁড়ির নিচে মালপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দুজনে । চৌকিদারকেও একটু সাহায্যের জন্য বলতে ভুলে গেছি । বিপদের সময় এরম ভুল আমার হয়ই । প্রচণ্ড সামুদ্রিক ঝড় চলেছে চতুর্দিকে ,- শহরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার,- ডি ভি সির পাওয়ার সাপ্লাইও বন্ধ। অন্ধকার আর ঝড়বৃষ্টির শব্দে চলন্ত বাসে বসে মনে হয়েছিল আমাদের দুপাশেই সাগর,- সাগরের বুকের উপর দিয়ে  এগিয়ে যাচ্ছি ভাবতেও বুকে হৈ চৈ হচ্ছিল খুব। দরজা জানালা বন্ধ বাসে করে এলেও নামতে গিয়ে , জিনিষপত্র সামলাতে ভিজতে হয়েছে দুজনকেই । মিনির জন্যই কষ্ট হচ্ছে খুব। নূতন জায়গায় এলে ঠাণ্ডা গরমের কোন অনুভূতি থাকে না আমার। উল্টো উত্তেজনা , গরমকে ঠাণ্ডা ও ঠাণ্ডাকে গরম করে তোলে। মিনির কষ্টে আমি নিজেকেই সম্পূর্ণ দায়ী করি । তবে, এরকম ভাবনাকে খুব দীর্ঘায়িত না করে হঠাৎই আমি সব জিনিষপত্র কাঁধে , হাতে ও বগলে নিতে শুরু করি । মিনিকে কোন ভারই দিতে চাই না। কিন্তু বড় স্যুটকেসটা নিয়েই হয় ঝামেলা। মিনিকে বললাম – চলো। - ওটা থাক।

         শুনে মনি হাসল,- হেসে স্যুটকেসটা তুলে নিল। দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস খুব করে অনুভব করলাম ।

        এরকমটা কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না। আমরা এত ঝামেলা পোয়াতে চাইনি । সেদিন লাক্সারি বাসের টিকিট কাটতেই মেট্রোর বারান্দা দিয়ে হাঁটছিলাম । মিনি আর আমি। মিনিকে বলি –-

-       এই বারান্দা ঘিরে আমার একটা দারুণ বিশ্বাসের ব্যাপার আছে। কারো সাথে দেখা হয়ই !

-       সেদিন তো ফিরেই যাচ্ছিলে ! বলেই মনি হাসে ।

-       ভাবছি, ফিরে গেলেই ভাল ছিল! কোন কিছু না ভেবেই দুষ্টু গাম্ভীর্যে কথাকটা বলি। শুনে মনি হাসে। খুব অপরিচিত হাসি।

      দু বৎসর আগে মিনির সঙ্গেই দেখা হয়েছিল । মিনিকে দেখাতে যাচ্ছিলাম দু বৎসরের পুরনো তবু খুব টাটকা স্মৃতির জায়গাটা। কিন্তু হঠাৎই মিনি আমার কাঁধ খামচে এক ভদ্রলোককে ডাকতে বলে। ‘রমানাথ বাবু’ বলে ডাকতে হবে। প্রথমে হতভম্ব পরে খুব সপ্রতিভ ভাবেই ডেকে আনি ভদ্রলোককে । মিনিদের পাড়ার লোক । মিনি বলে রমাদা—ওর রমাদা ওকে তুই। মিনি আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়,- ‘ এই রমাদা, রমানাথ চক্রবর্তী, তোমাকে বলিনি ?’ মিনি কখনও বলেনি, তবু বলতে হলো –-আপনার কথা খুব শুনেছি মিনির কাছে । আমার উত্তর শুনে মিনি হাসে। আমার কি অন্য কিছু বলা উচিত ছিল?

               ভেবেছিলাম নির্ভার থাকব। হোটেলে মোটেলে যেমন খুশি । কিন্তু মিনির ওর রমাদার উপর খুব শ্রদ্ধাভক্তি । উনিই বললেন কম খরচায় ব্যবস্থা করে দেবেন। আমাকে কিছুই করতে হলো না , সব ব্যবস্থাপত্র করে ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘আসামে যাব একবার, ধুবড়িতে আমার এক বন্ধু থাকে, সমীর সেনগুপ্ত, খুব ভাল তবলা বাজায়, ওর বাড়িতেই যাব। তখন দেখা হবে নিশ্চয়?’ ধুবড়ি, শিলচরের দূরত্ব জেনেও মিনি হাসলো না। আমি ভদ্রলোককে দেখা হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত করলাম। মিনি তখনই হাসল।

       মেয়েছেলে সঙ্গে থাকলে কিছু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায় অনেক সময়। ড্রাইভার লোকটিকে একবার বলতেই আমাদের পৌঁছে দিতে রাজি হয়। এত দুর্যোগের মধ্যেও মানুষ এত দয়ালু হয়! লোকটি শুধু একবারমাত্র একটি অসুবিধা দৃষ্টি দিয়ে মিনির দিকে তাকিয়েছিল । আমি কিছু মনে করিনি । কারণ সমুদ্রের এত কাছে এসেও সমুদ্র দেখতে না পারায় আমি খুব উত্তেজিত হয়ে আছি। দয়ালু লোকটাকে জিজ্ঞেস করি,- আচ্ছা দাদা,--আমরা কি সমুদ্রের পাশ দিয়ে যাচ্ছি ? লোকটা একবার আমার দিকে আর একবার মিনির দিকে তাকায় , তারপর জানায় , হ্যাঁ, প্রায় পাশ দিয়ে যাচ্ছি । কিছুই বুঝি না, আবার বলি, -- এল.আই.সি. বিল্ডিং থেকে সমুদ্র কতদূর হবে বলতে পারেন?

       এবার লোকটি নির্বিকার ভাবে জানায় – এই  কিছু দূর হবে ।

       অস্পষ্ট উত্তরে অসন্তুষ্ট হয়ে আমি মিনির দিকে তাকাই । অন্ধকারেও মিনির চোখের মনি দুটোর স্থানান্তর টের পাই। মিনি হাসে।

       রমাদার পরামর্শেই সেদিন লাক্সারি বাসের টিকিট কাটা হলো না। খড়গপুর লোকেল থেকে নেমেই ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে উঠতে হলো এই ‘নোয়া’র বাসে। হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার সময় একবার মাত্র মিনিকে বলেছিলাম,- কোলাঘাটে চা খাওয়া হলো না, শরৎসেতু দেখা হলো না, তাছাড়া বাসজার্নির মেজাজই আলাদা ।

     --তা হলে বাসেই চলো। মিনি বলে। আমার মতের বিরুদ্ধতা করা মিনির স্বভাব নয়। তবু ট্রেনে যাওয়াই ঠিক থাকে । আমার এ সিদ্ধন্তেও মিনি হাসে। আমি টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েও দোমনা হই ।

       থাক,তবু সব ঝামেলা কাটিয়ে আমরা দুশো বারো নম্বর ঘরের মুখোমুখি হলাম। সেখানেও নূতন বিভ্রাট। দুশো বারো নম্বর চাকতি লাগানো চাবি দিয়ে দুশো বারো নম্বর ঘরের তালা কিছুতেই খোলে না। মালপত্র সহ আমি মিনি আর একটা মাত্র টর্চ সম্বল। চৌকিদার লোকটিকে বেরই বা করি কি করে, মিনি আর আমি নিচে নেমে গেলে মালপত্রই বা দেখবে কে? মিনিকে বসিয়েও রাখা যায় না—কি জানি ভয়ও পেতে পারে! শৈশবের সেই অস্বস্তিকর নড়বড়ে সাঁকোর ধাঁধা মনে করেও জট খুলতে পারলাম না। ঘাসের আঁটি, বাঘ ও ছাগল । যে কোন একটা নিয়ে পারাপার  করা যায় । কিছুতেই জট খোলে না । হতবুদ্ধি হয়ে মিনির পরামর্শ চাই। মিনি বলে, --তালা ভেঙে ফেল। ও জানে এ কাজ আমি পারব না। তাই বলে ফেলেই হাসে মিনি । আমি মিনিকে নিয়ে নিচে নেমে আসি।

       বৃদ্ধ লোকটি প্রথমে ব্যাপারটি বুঝতেই চায় না। দুশো বারো  নম্বরের চাবি দিয়েই তো দুশো বারো নম্বর ঘর খুলবে । এরকম ব্যাপার তো কখনও হয় না । কিছুই বোঝে না । শেষ পর্যন্ত মিনির পরামর্শেই সবকটা চাবি নিয়ে লোকটি আমাদের সঙ্গে আসে। এ চাবি ও চাবি করে দুশো এগারো নম্বর দিয়েই খুললো  দুশো বারোর তালা । লোকটি খুব দুঃখিত হয়, আবোল তাবোল ক্ষমটমা চেয়ে নেয় বলে,--‘ বলেন তো সকালে আমি চা দিয়ে যেতে পারি , না হলে সামনের হোটেলে গিয়েও খেতে পারেন, সকালে রসও পাবেন প্রচুর, বেলা করে খাবেন না কিন্তু , গেঁজে যায় , নেশা হবে ।’ রসের ব্যাপার বুঝি না কিছুই । মিনি বলে দেয় ---

     --‘খেজুরের রস গো! এখানে খুব হয়,বেলা হলে তাড়ি হয়ে যায়’। মিনি জানেও এতসব । আমি বলি,--‘ খুব খাবো কিন্তু , --বেলা করেই খাবো’। আমার কথা শুনে মিনি হাসে ।

        লোকটি চলে যেতেই মনে পড়লো খাবার কিছু আনা হয়নি । এই দুর্যোগের রাতে কিছু পাওয়াও অসম্ভব । মিনির কথা ভেবেই অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। সারারাত না খেয়ে থাকবে। আমার ভাবা উচিত ছিল । শেষ পর্যন্ত মিনির ভাঁড়ার থেকেই ফ্লাস্কের চা আর অর্ধেক প্যাকেট বিস্কুট বেরোল । দুজনেই হাত মুখ ধুয়ে টর্চের আলোয় খানকয় বিস্কুট আর প্রায় ঠাণ্ডা চা দিয়ে আমাদের অভিনব ডিনার শুরু করি । চায়ে চুমুক দিয়েই একটু নড়ে চড়ে বসলাম। বাইরে দারুণ ব্যাপার হচ্ছে নিশ্চয় । প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে বাইরে । যেমন তেমন ঝড়ের এত শব্দ থাকতে পারে না, একটা মিষ্টি মত তালে তালে , সমুদ্রের ঢেউই নিশ্চয়, ভেঙে পড়েছে । অনেকগুলো জেট প্লেনের ক্রমাগত ল্যান্ডিং আর টেক অফের মতো তুমুল ব্যাপার । শব্দ গুলো এত কাছের যে মনে হচ্ছে এই বাড়ির দেওয়ালে এসেই ঢেউগুলো ভাঙছে । টগবগে উত্তেজনায় মিনিকে বললাম একটা সিগারেট বের করে দিতে । সিগারেট ধরিয়ে দিল মিনি । দিয়াশলাইয়ের আলোয় মিনির মুখের দিকে তাকালাম , খুব অসুখী মনে হলো না ওকে । জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ‘শুনতে পাচ্ছ?’

       মিনি বলল,-- হুঁ! আমি জানালা খুলে দিলাম । অন্ধকারে সাগরের অস্তিত্ব ঠিক বোঝা যায় না। বললাম,-- ব্বাঃ সাগর এত কাছে’?

       মিনি বলল,-- হুঁ! ওর মুখের পাশে মুখ রেখে আমি বললাম, -- ভয় করছে ?

      -- হুঁ! এবার স্পষ্ট দেখলাম মিনি হাসছে ।

      বললাম, -- ‘এল. আই. সি. এমপ্লয়ীরা খুব পয়সাওয়ালা , সাগর পারে এত বড় বড় বাড়ি বানিয়েছে।’  

      --‘এ বাড়ি কিন্তু  এল. আই. সির নয়, সরকারি বাড়ি এল. আই. জি লোয়ার ইনকাম গ্রুপ।’  আমার কাঁধে ওর থুতনির একটু চাপ দিয়ে কথাগুলি বলেই হাসে মিনি । মিনি যদি একটু শব্দ করে হাসত! মিনি তো জানে ওকে নিয়ে বড় হোটেলে উঠার সামর্থ্য আমার ছিল!

       ভোর হলো ঠিক চারটায় ।আমার ভোর । মিনি জাগিয়ে দিল ,--‘ ওঠো, সমুদ্রে চান করতে যাবে না?’ মিনিকে বলে রেখেছিলাম সাগর পারে যতদিন থাকব সাগরে চান করতে করতে সূর্যোদয় দেখব । ‘হুঁ’ বলে ঘুমঘুম চোখে ঘরের দিকে তাকালাম। মিনি অনেকক্ষণ হলো উঠেছে । ঝড় ও থেমে গেছে কখন । হয়তো রাতেই । মিনি ঘরটাকে গুছিয়ে নিয়েছে । ছড়ানো ছিটানো শালপাতা , ছেঁড়া কাগজ, কিছুই নেই ঘরে । মিনিকে বেশ বউ বউ লাগছিল । চশমা ছাড়া মিনিকে অন্য মিনি লাগছিল । দেবীর মতো । ভাবলাম বলেই ফেলি কবিতায়, --‘প্রাতে কখন দেবীর বেশে তুমি সমুখে উদিলে হেসে ।’ কেন জানি লাইনটাকে পছন্দ করেও বলতে পারলাম না । কাছে ডাকলাম ওকে । কাছে আসতে বললাম। কানের কাছে মুখ নিয়ে এলো , বললো ,--‘সমুদ্র কিন্তু খুব কাছে নয়।’ বিশ্বাস করি কী করে, কানের কাছে এখনও টেকঅফের শব্দ পাচ্ছি । জানলা থেকেই সাগর দেখা যাবে ভেবে দু কনুই এ ভর দিয়ে জানালা খুলে দিই। চোখ দুটো বন্ধ করেই রাখি । কানামাছি খোলার মতো ডাক দিই সাগরকে ,

      --‘ আয়রে আমার সাগর’ চোখ খুলি ,

      -- কোথায়,কই সাগর? কোথাও তো সমুদ্র নেই । কিছু উঁচু নিচু টিলা আর ছড়ানো ছিটানো বাড়িঘর রয়েছে সামনে । কাল রাতের অন্ধকারে এসবকেই সাগর ভেবেছিলাম । মিনির দিকে ফিরে দেখলাম , -- খুব মিহিন হাসি মুখে নিয়ে আমার সাগর দেখা উপভোগ করছে। চোখে চোখ পড়তেই বলল,--‘ চলো—রিক্সা করে যেতে হবে, অনেক রিক্সা রয়েছে নিচে। ’

---‘হ্যাঁ চলো, কখন আবার সূর্য উঠে যাবে’ বলে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আড়মোড়া ভাঙলাম ।



শতক্রতু ১৯৭৬

শুক্রবার, ২৩ মে, ২০১৪

১৯কে নিয়ে এক গুচ্ছ কবিতা
























সূর্যলোভী

ঊর্ধ্বেন্দু দাশ


শরীরে অযুত ক্ষত, সুপ্তিহীন অপমানিতের—
হৃদয়ে দুরন্ত ঝড় অগ্নিক্ষরা গতির নেশায়,
দুপায়ে শৃঙ্খল-বাঁধ হেসে ওঠে দুর্বিনীত হাসি—
ভ্রুভঙ্গে অশনি ঝরে অভিশপ্ত বিদ্যুৎ -লেখায়।
শঙ্কিত সূর্যের লোভে স্বর্গীয় পাখির সন্ততিরা
গুনেছে প্রহর শুধু, অনুক্ষণ ফেরারি আশায়,
নিশান্তে তাদের ডানা অভীপ্সার মেরুন-পতাকা
প্রহত মেঘের গায়ে মেলে দ্যায় আশ্চর্য হেলায়
বারুদের নেশা, বন্ধু, চোখে-মুখে প্রকট আমার---
এ বুকে এখনো দীপ্ত এগারোটি প্রাণের আগুন।
দম্ভিতের সপ্তরথী-চক্রান্তের বেড়াজালে আজ
বন্দী অভিমন্যু, জেনে, নিয়েছি এ শপথ দারুণ!
শোনেনি তো বেদব্যাস, এ যুগের অভিমন্যুদের
অ-নত দেহের কোষে ঝঞ্ঝাপ্লাবী শোণিতের স্বর;
জানেনি---কমলা বোন কী দুর্বার আবেগের বীজ
রেখেছে ছড়িয়ে , আজ, ক্ষুব্ধ ধমনীতে নিরন্তর!----
বৈদিক যুগের ভাষ্য, জেনো বন্ধু, অচল এখন---
বারুদের অভিজ্ঞান আমাদের কবচ-কুণ্ডল;
অযুত মৃত্যুর দ্বার পার হইয়ে, চেয়ে দ্যাখো, আজ
আমরা নিয়েছি জন্ম সূর্যলোভী স্বর্গশিশু-দল।
বিশ্বাসের তীর্থভূমি, জানি বন্ধু, প্রকম্পিত আজ---
কুচক্রীর লুব্ধ ঠোঁট ছেঁড়ে তাই অন্ত্র , আমাদের;
তবু জেনো, আশংসার দুর্নিবার কুরোশিয়ো –গান
পারেনি তা কেড়ে নিতে, অত্যাচার, রক্তলোভীদের!
আমরা বিজয়রথী, জেনো বন্ধু!—পূর্বাচল, তাই
লাল-সূর্য ঠোঁটে নিয়ে স্বর্গীয় পাখির ডিম থেকে
দিয়েছে ফিনিক্স-জন্ম, অগণিত বীর সন্ততির---
কৃশানু-স্বাক্ষর-বুকে যারা আজ ব্যাপ্ত দিকে দিকে।


১৯শে মে, ৮৫



অনুরূপা বিশ্বাস

তোমার কাছে প্রাপ্তি অনেক
            প্রাপ্য ছিল আরো বেশি
নিষ্কলঙ্ক আকাশ এবং
হা হা হাসির আগলভাঙা
            আনন্দকে খুঁজে নেবার প্রতিশ্রুতি
সব কেবলি ওলোট-পালট
সামনে ধুধু বালিয়াড়ি
উটের সারি...মরু জাহাজ
এবং খেজুর বনের কাঁটা
            জনশ্রুতি


উনিশে মে ১৯৬১ শিলচর

                         শক্তিপদ ব্রহ্মচারী

দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল, ‘এই যে ঈশান কোণ—
কোন ভাষাতে হাসে কাঁদে কান পেতে তা শোন।’

 শুনলি না? তো এবার এসে কুচক্রীদের ছা
তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা---
‘বাংলা আমার মাতৃভাষা, ঈশান বাংলা মা।”





শহীদ কমলাকে

দিলীপ কান্তি লস্কর



সময়ের কারাগারে বাস্তুবন্দী এই ভূবনের
চক্রব্যুহে বৃত্তবন্দী এই ভুবনের
            প্রাণে পণ দাও
কি ঐশ্বর্যে প্রাণ দিতে হয় তুমি
            কবিকে শেখাও
১৯শের মহিলা শহীদ।

কি করছ ওখানে তুমি? কি করছে ওরা দশটি ভাই?
জানি জেগে আছো, অমৃতে অরুচি
            প্রতীক্ষার আদ্যোপান্ত নাই।

বড় বেশি বৃষ্টি হচ্ছে বড় ঘাস জন্মাচ্ছে এখানে
উপজিব্য ফুল-বেলপাতা-অর্থ চাঁদ ও অপ্রেম।
যারা কৌরব তারা খেলে যাচ্ছে দৃঢ়পণে
            আরো দ্রুত শকুনির পাশা
নির্লজ্জ ও ক্লীব চোখে দ্রৌপদীর বস্ত্র হয়ে ঝরে বর্ণমালা
তবু কুরুক্ষেত্র ছিল, আছে, মর্যাদার রণ আছে
পাণ্ডবের কাছে।



মাতৃভাষা



                        দিলীপকান্তি লস্কর

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা
আমাদের ছায়াছবির ভাষা হিন্দি

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা
আমাদের সংগীতের ভাষা হিন্দি

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা
আমাদের আনন্দের ভাষা হিন্দি

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা
আমাদের উচ্চাশার ভাষা ইংলিশ





অবস্থান



                        দিলীপকান্তি লস্কর


আমি কোত্থেকে এসছি, তার জবাবে যখন বললামঃ
করিমগঞ্জ, আসাম
তিনি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেনঃ বাঃ, বেশ সুন্দর
বাংলা বলছেন তো!
একজন শিক্ষিত তথা সাহিত্যিকের যখন এই ধারণা, তখন
আমি আর কী বলতে পারি!
ওকে ঠিক জায়গাটা ধরিয়ে দিতে গিয়ে বললামঃ
            বাংলাভাষার পঞ্চদশ শহিদের ভূমিতে আমার বাস।
তিনি তখন এক্কেবারে আক্ষরিক অর্থেই আমাকে ভিরমি
খাইয়ে দিয়ে বললেনঃ
                        ও! বাংলাদেশ? তাই বলুন।



 সাকিন

সঞ্জয় চক্রবর্তী





এপার বাংলা ওপার বাংলার মাঝে
এক অপার বাংলা আছে।
কার্তিকের নবান্নের দেশ থেকে
অশ্বত্থ বটের পথ থেকে
পদ্মানদীর মাঝি থেকে দূরে
আমি সেই বাংলায় থাকি,
যেখানে, একুশ তত আত্মীয় নয়,
এমন-কি উনিশও।

 ২
জন্মদিনের পায়েস, বলো, কার অনুগামী হব?
বলো মাতৃদুগ্ধ, ওই যারা তড়িঘড়ি
গঙ্গাতীরে দিচ্ছে পাড়ি, ওদের বাড়ি?
এদের সঙ্গে আমার আড়ি।

তাহলে সুড়ঙ্গই ভালো, ভালো সহাবস্থান
এক হাতে বর্ণপরিচয়, অন্যহাতে তাম্বুলপান,
যখন একা, ভীষণ একা,
হাতে শুধু গীতবিতান।


অরুণ বরুণ কিরণমালা


স্বর্ণালী বিশ্বাস ভট্টাচার্য

ভাইগুলো তার পাথর হল
বোনটি একা বাড়ি---
বুকের ভেতর উনিশে মে,
একুশ ফেব্রুয়ারি।
মায়া পাথর, মায়া সাগর,
অথৈ মায়া খেলা---
অরুণ বরুণ হারিয়ে গেছে,
একলা কিরণমালা।
দুচোখে ভরে আগুন নিল
দুঠোঁট ভরে ঘৃণা—
পেরিয়ে গেল সাতাশ নদী,
মৃত্যু পরোয়ানা।





আবার এসেছে ফিরে



                        বিজয় কুমার ভট্টাচার্য

আবার এসেছে ফিরে রক্তাক্ত ঊণিশে মে
শব্দের শরীরে তাই সঘন রোমাঞ্চ নামে
বর্ণমালা ছিঁড়ে খোকা আজো বলে
            ‘এ’-য় একাগাড়ী
ভাঙ্গনের কূলে এসে
            এইবেলা ফিরে কি দাঁড়াতে পারি?
 স্বপ্নের আকাশ চোখে একদিন তারমতো
দেখেছি নীলিমা
নক্ষত্র খচিত রাত্রি ধান্যশীর্ষে হলুদ পূর্ণিমা
অবিরল বৃষ্টিপাতে মার মুখে সীতাকে শুনেছি
বাঙলার অমর কবি কৃত্তিবাস নিজেকে ভেবেছি
বর্ষায় ভরা নদী বেহুলা মান্দাসে;
বাঙলায় গল্প শোনা মার কোলে বসে---!
এরপর কারা যেন শব্দকে ভেঙ্গেছে পাথরে
সে কথা জানাতে আসে বছরে বছরে বছরে
রক্তের ঊণিশে মে একুশে ফেব্রুয়ারী
বর্ণমালা ছিঁড়ে খোকা বলে যায়
            ‘এ’-য় একাগাড়ী—
বাংলার শব্দমালা কথা বলে বৃষ্টির অক্ষরে
রূপসী বাংলার কবি
            বাংলাকে জেনেছে গভীরে
বিপন্ন বিস্ময়বোধে আমি দেখি পরবর্তী কাল
একুশের ভোরে বাংলা ঊণিশের রক্তাক্ত সকাল
আমার মায়ের চোখে দঃসহ দুঃস্বপ্ন জেগে থাকে
সম্ভাব্য সংকটে দিন
            রাত্রি কাটে ভীষণ উদ্বেগে
কালক্রমে নিভে যাচ্ছে সব আলো, দৃষ্টি অন্ধ,
মরাও নিরাপত্তাহীন---
চৈতন্যে জড়ায় সাপ অনাগত আসন্ন দুর্দিন।
শৈশবের স্তন্যপানে আমাদের
বালক সময়
জেনে গেছে প্রাত্যহিক, সেও আর বিপন্মুক্ত নয়।


ব্রহ্মপুত্রের ঝড় উঠে, নৈসর্গিক বিদ্রোহে বরাক
অস্তিত্ব বিপন্ন জেনে এ মুহূর্তে কাকে দিই ডাক


(মূল বানান রেখে দিয়েছি)






























সোমবার, ১৯ মে, ২০১৪

একাদশ শহীদ চেতনায়, অবচেতন মনে



মি সুদূর প্রবাসে,
উনিশের আগুন বুকে,
বাঙলার গান গাই।
ভিনদেশী এক হলুদ পাখী সুর মেলায়,
তারই সুরে।
দুটো অবুঝ পাহাড়ি বালিকা,
মাথা নাড়ে কবিগুরুর সুরের মূর্ছনায়।
আমার ঈশানের বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ,
স্পষ্ট হয়,এই মাটির সোঁদা গন্ধে।
তাই হয়তো কৃষ্ণচূড়া ও হাত বাড়িয়ে,
আমার দখিনের জানালায়।
আকাশের নীলিমায়,
ভেসে ওঠা এগারোটি মুখ,
ছায়া ফেলে মনের শার্সি কাঁচে।
মাতৃভাষার মিষ্টতা,
ছুঁয়ে যায় আমার উদাস প্রহর।
কোন অচিন পাখীর ডানায় করে,
এক মুঠো যুঁই, পাঠিয়ে দেই ,
তোমাদের উদ্দেশ্যে।
জেগে থাকো তোমরা চেতনায়,
অবচেতন মনে।

বর্তমানের প্রেক্ষিতে ভাষা-সংস্কৃতির সংকট ও উনিশের ঐতিহ্য


৯শে মে শহিদ দিবসকে সামনে রেখে ১১মে মধ্যশহর সাংস্কৃতিক সমিতির কার্যালয় হলে কোরাসের উদ্যোগে এক মনোজ্ঞ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হলো। এই আলোচনা সভায় বক্তারা প্রশ্ন তোলেন ১৯৬১-৭১-৮৬-এর ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৯১-তে এসে আমাদের কেন উগ্র-হিন্দু সাম্প্রদায়িকতায় আশ্রয় নিতে হল? ভাষা আন্দোলনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য কী করে প্রতিক্রিয়াশীলতায় রূপান্তরিত হলো? ১৯ শে মে’র পর ১৯ শে জুনের ঘটনা কেন ঘটল? কেন একাত্তরের ভাষা আন্দোলন পর্যবসিত হলো গুণ্ডাবাহিনীর সম্মুখ সমরে? প্রশ্ন উঠল একষট্টির ভাষা আন্দোলনের পর যে চুক্তি হলো তার ৬(ক) ধারা অনুসারে তৎকালীন কাছাড় বা বর্তমান বরাক উপত্যকার প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সাথে সরকারি-প্রশাসনিক যোগাযোগের মাধ্যম সেইসব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় হওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়িত না হওয়ার জন্য উনিশ উদযাপনের আয়োজন থেকে কেন কোন জোরদার দাবি উত্থাপিত হলো না? কেন মাতৃভাষার বিষয় শিক্ষক প্রকারান্তরে উঠিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বাঙালিরা নীরব ভূমিকা পালন করছে? কেন চা-বাগানে বসবাসকারী চা-শ্রমিক ও প্রাক্তণ চা-শ্রমিকদের মাতৃভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগ করে দিতে উনিশের ঐতিহ্য বহনকারীদের কোন তৎপরতাই লক্ষ্য করা গেল না?

      
   নির্দিষ্ট আলোচকরা এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজারও চেষ্টা করেন। ড০ সুবীর কর ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতাকে স্থানীয় ও উদ্বাস্তুদের দ্বন্দ্বকে সমাধান করার উপযুক্ত প্রয়াস ও পরিকল্পনার অভাবকে দায়ি করেন এবং এই সুযোগে শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক চক্রান্ত ও বাম আন্দোলনকে প্রতিহত করার মানসিকতা থেকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সৃষ্টি হিসেবে তিনি ঘটনা পরম্পরা বিশদভাবে উল্লেখ করেন। সঞ্জীব দেবলস্কর বলেন ভাষা নিয়ে বাঙালিদের আবেগ-প্রবণতা আর কোন জাতির মধ্যে দেখা যায় না। আক্রান্তরা আক্রমণকারী হতে পারে না এই সূত্র ধরে তিনি বাঙালি-অবাঙালি সম্পর্কে বাঙালির উদারতার নিদর্শন তুলে ধরেন ও মধ্যযুগের অন্ধকারময় সময় পেরিয়ে বাংলা ভাষা গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে এক বিকাশমান ভাষা বলে উল্লেখ করেন। মুজাম্মিল আলি লস্কর সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন যে বাঙালি শিক্ষিত বর্ণহিন্দু সমাজ তাদের প্রতিবেশিকে আলিঙ্গন করে নিতে এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। প্রতিবেশিদের সাথে নিয়ে যদি একজোট না হওয়া যায় তাহলে আমরা বাইরের আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারব না। শিক্ষাহীনতাই বঞ্চিত মুসলিম সমাজের আসল সমস্যা যারা অতি সাধারণ প্রলোভনেই আকৃষ্ট হয়। কিন্তু আজ নিজস্ব সামাজিক প্রচেষ্টায় এক শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠছে এবং আমরা একে অপরকে চেনার ও আপন করে নেওয়ার প্রচেষ্টা নিলে ঐক্য গড়ে উঠতে পারে এবং এক্ষেত্রে শিক্ষিত বর্ণহিন্দুদের দায়িত্ব অনেক বেশি এবং এই প্রক্রিয়ায় ঐক্যের শেকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত হবে। ১৯ শে মে থেকে কেন ১৯ শে জুন হলো তার সঠিক অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা এখনও করা হয়ে উঠেনি, দোষারোপ করেই আমরা আমাদের দায় সারছি। ড০ মৃন্ময় দেব অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বর্তমান প্রেক্ষিতকে বিশ্ব প্রেক্ষাপট থেকে বরাকের স্থানিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে এসে বলেন যে বাঙালি সত্ত্বাও বহুকেন্দ্রিক এবং দুর্ভাগ্যজনক যে বরাকের কেন্দ্রটির জিয়নকাঠি হয়ে উঠেছে অসমীয়া উগ্রজাতিয়তাবাদী কোন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যাকে তিনি কনডিশনড রিফ্লেক্স হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্য সময় এই কেন্দ্রটি আধিপত্যবাদী ও কলকাতামুখীন। ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সবচেয়ে প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন বাংলা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদার শ্রেণি থেকে যারা এখানে এসছেন তারাই জনমত গঠনে প্রাধাণ্যকারী অবস্থানে রয়েছেন এবং তাদের বর্ণহিন্দু জমিদারি মানসিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ নির্ধারিত মানসিকতা এই বিভাজন দূর করার প্রধান প্রতিবন্ধক। শেকড় থেকে উচ্ছেদ হয়ে এর স্মৃতি বহন করে চলেছেন এই উদ্বাস্তুরা কিন্তু এখানে নতুন কোন শেকড় গড়ে তুলতে সক্ষম হননি। অন্যদিকে বরাকের বিভিন্ন সমাজ থেকে উঠে আসা বুদ্ধিজীবীরাও ভাষা আন্দোলনের হাল ধরতে পারেননি এখনও। এভাবে তিনি এক কাঠামোগত ও কার্যপ্রণালীর দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করেন। কাজল দেমতা ঝাড়খণ্ডী তথা চা-শ্রমিক ও প্রাক্তণ চা-শ্রমিকদের করুণ অবস্থা বর্ণণা করেন এবং তাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে শিক্ষার অভাবকে দায়ি করেন। মাতৃভাষায় তাদের পঠন-পাঠনের সুযোগ না থাকায় অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী প্রাথমিকস্তরেই বাধার সম্মুখীন হয় এবং পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। উনিশের মে উদযাপনের ক্ষেত্রে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মর্মবেদনা ব্যাক্ত করে তিনি বলেন একটি অনুষ্ঠানে ঝুমুর নাচ ও আদিবাসী গান পরিবেশন করতে দিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী উদ্যোক্তাদের আপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন। উনিশের মে’র দিন বাংলা ছাড়া আর কিছু চলবে না বলে তারা আপত্তি তোলেন। ড০ শান্তি কুমার সিং বলেন যে তাঁরা ভীষণভাবে মর্মাহত এই কারণে যে যখন মাতৃভাষার বিষয় শিক্ষক পদটি প্রকারান্তরে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট ভাষা না জানা অসমীয়াভাষীদের দিয়ে তা পূরণ করে দেওয়া হচ্ছে তখন কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালিদের তরফে কোন আপত্তি উঠেনি। সর্বশেষ বক্তা সুব্রত কুমার পাল (শ্যামা) একষট্টির আন্দোলনের সফলতা ও বিফলতার দিক তুলে ধরে বলেন যে আমাদের সীমিত সফলতা ভাষা চুক্তির ৬(ক) ধারার সংযোজন। কিন্তু এরপর অধিকারের আন্দোলনকে আর প্রসারিত করতে পারিনি এবং তার অন্তর্নিহিত কারণ একষট্টির আন্দোলনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। করিমগঞ্জ জেলার বিস্তৃত বাস্তব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি দেখান কোথায় এবং কীভাবে একষট্টির ভাষা আন্দোলন শহর-গঞ্জের এলিট সীমানা অতিক্রম করে নিম্নবর্গীয় হিন্দু-মুসলমান হৃদয় স্পর্শ করতে ব্যার্থ হয়েছে এবং তারা এই আন্দোলনকে শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখেছেন। আন্দোলনের উদ্যোক্তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার-মিরাসদার শ্রেণি থেকে উঠে এসেছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই রায়ত শ্রেণির আম-জনতারা ন্যায্য দাবিকেও সন্দেহের চোখে দেখেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন ছিয়াশির ভাষা আন্দোলনের পরও একান্নবইতে এসে করিমগঞ্জ জেলার অবিসিরা হিন্দুত্ববাদীদের কাছে আশ্রয় নিলেন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে কোন স্যাকুলার রাজনীতি গড়ে তোলার বিফলতা ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতাকেই দেখায়। এখনও যখন বিটিএডিএ-তে শিশুদেরকেও নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে তখনও আমরা বাঙালি-মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে দ্বিধান্বিত। এই প্রক্রিয়া আমাদের সবার অস্তিত্বকে ক্রমশঃ বিপন্ন করে তুলছে। সবশেষে বিটিএডির ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়ে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর আইনি ও সহিংস আক্রমণের বিরুদ্ধ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের এবং সব জনগোষ্ঠী যাতে তাদের নিজস্ব সমস্যা তুলে ধারতে পারে ও তার সমাধানে যৌথ প্রয়াস নিতে পারে তারজন্য সব জনগোষ্ঠীর এক যৌথ মঞ্চ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন সভার সঞ্চালক বিশ্বজিত দাশ।         
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

বর্তমানের প্রেক্ষিতে ভাষা-সংস্কৃতির সংকট ও উনিশের ঐতিহ্য
[ভাষা শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে এই বিষয়ের উপর কোরাস আয়োজিত আলোচনা সভায়
কোরাসের অ্যাপ্রোচ পেপার
স্থান ঃ মধ্যশহর সাংস্কৃতিক সমিতির কার্যালয়, পার্করোড।
তারিখ ঃ ১১-০৫-২০১৪।   সময় ঃ সকাল ১০-৩০ টা]

প্রতিবারের ন্যায় ১৯শে মে ভাষা শহিদ দিবস হিসেবে এবারও পালিত হবে। আমরা সবাই, যারা এদিবসকে ঘটা করে পালন করতে প্রতিবছর সচেষ্ট থাকি, অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে সেই দিবস পালন নেহাতই এক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হচ্ছে এবং ভাষিক অধিকারের প্রশ্নে যে প্রাণশক্তি সমগ্র জাতিকে নাড়িয়ে দেয় তা ক্রমশঃই ক্ষীয়মাণ ও সংকীর্ণ বদ্ধজলায় আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। আমাদের মনে হয় একষট্টির আন্দোলনের যে ঐতিহ্য আমাদেরকে নতুন পরিস্থিতিতে নতুনভাবে উজ্জীবিত করার কথা ছিল তা করতে না পারার পেছনে ঐতিহ্যকে পুননির্মাণ করার আমাদের উদ্যোগের অভাব দায়ি। এই ভাবনা থেকেই কোরাস এবার নির্দিষ্ট দিবসের পূর্বে ১১ মে, ২০১৪ তারিখে এই আলোচনা সভার আয়োজন করেছে যাতে ভাষা দিবস পালনে আমাদেরকে নতুনভাবে ভাবতে শেখার সূত্রপাত ঘটায়। এই আলোচনা সভায় আলোচকদের উদ্দেশ্যে প্রথামাফিক উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে কিছু বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে এবং কোরাস আশাবাদী এগুলির উপর ভিত্তি করে এই আলোচনাসভা নতুন দিক উন্মোচিত করার প্রক্রিয়া শুরু করতে সক্ষম হবে।

           (১) একষট্টির আন্দোলন যদিও সীমাবদ্ধ ছিল রাজ্য ভাষা আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের দ্বারা এক ভাষাকে অন্য ভাষাভাষীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এক গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের মধ্যে, কিন্তু তার অন্তর্বস্তুতে ছিল মাতৃভাষায় প্রশাসনিক কাজকর্ম ও পঠন পাঠনের অধিকারকে সাব্যস্ত করার নিরন্তর ও দীর্ঘকালীন গণতান্ত্রিকীকরণের এক প্রক্রিয়ার শুরুয়াত। আমরা জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরের এই মর্মবস্তুকে আড়াল করে শুধুমাত্র একমাত্রিকভাবে বাইরের চাপের বিষয়কেই গুরুত্ত্ব দিয়েছি। চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতি নিশ্চিতভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ, কিন্তু অভ্যন্তরিণ গণতন্ত্রকে বিকশিত না করলে যে বাইরের চাপের কাছে প্রতিনিয়ত নতি স্বীকার করতে হয় – এই সাধারণ সত্য থেকে আমরা বিস্মৃত হয়েছি। ফলে একষট্টির আন্দোলনের বিষয়ও সফলতার মুখ দেখতে ব্যার্থ হয়েছে এবং নিরন্তর হয়ে চলেছে। এই বিফলতার স্বরূপটা কী?

        (২) বাঙালি ও বাংলা ভাষার কথাই ধরা যাক। ভাষা যদি জনগোষ্ঠীয় ঐক্যের এক প্রধান মাধ্যম হয়, তাহলে এই ভাষার অন্তর্গত প্রতিটি সমাজ উক্ত ভাষার সাথে একটা যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারতে হবে। অর্থাৎ প্রতিটি সমাজের মায়ের মুখের বুলি এক সাধারণ মায়ের ভাষায় রূপান্তরিত হতে হবে যাতে এই ভাষা সবার মাতৃভাষা হয়ে উঠে। কিন্তু মান্য ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার গঠন প্রক্রিয়ায় ফোর্ট-উইলিয়ামের মত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের মুখ্য ভূমিকা থাকায় এলিট শ্রেণির সংস্কৃত প্রভাতযুক্ত ভাষায় রূপান্তরিত হয়। শ্রীচৈতন্য নিজে সিলেটি হয়েও সিলেটি বুলিকে অপবাদ অবহেলা করে যে ভাব-আন্দোলন করেন তাতে নদীয়ার আঞ্চলিক বুলি মান্য ভাষায় স্থান পায়। কিন্তু ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল আধিপত্যবাদী স্বার্থের প্রভাব ও বৈষ্ণব ভাব-আন্দোলন বাংলা ভাষাকে বৃহত্তর বাঙালি সমাজ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে বাংলা ভাষার অনেক গণতান্ত্রিক পরিমার্জন পরিবর্ধন হয়েছে, কিন্তু এখনো বাঙালির ভাষা হিসেবে দাবি করা এই ভাষা সমগ্র বাঙালির মান্য ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। এই উপলন্ধি কিংবা তার বিকল্প উপলব্ধি থেকে মান্য ভাষার বিষয়কে কীভাবে বিচার করা যায়?

          (৩) কৈবর্তদের মত সম্প্রদায় কিংবা মুসলমানি বুলি যখন মান্য বাংলার সাথে কোন যোগসূত্রই খুঁজে পায় না, তখন এটা ধরে নেওয়া যায় যে এই ভাষা সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের গণ্ডিকে অতিক্রম করতে পারেনি এবং আমাদের ভাষা জাতিয়তাবাদ অত্যন্ত দুর্বল ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বাঙালি ভাষিক জাতিয়াবাদের দুর্বলতার স্বরূপ কী এবং  এনিয়ে আমাদের কী করণীয়?

         (৪) ভাষার সাথে গণ-শিক্ষার প্রশ্ন ও শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যখন বাংলা মান্য ভাষাটি সমগ্র বাঙালি সমাজের সাধারণ মাতৃভাষা হয়ে উঠতে পারেনি, তখন নিশ্চিতভাবে আমাদের এই ভাষার বিকাশের স্বার্থে এক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যেহেতু ভাষার নির্মাণ সমাজের এক অভ্যন্তরিণ নিরন্তর জীবন্ত নির্মাণ, তাই গরিষ্ঠাংশ শিক্ষাবিহীন কোন সমাজের ভাষা ও ভাষিক ঐক্যও দূর্বল ও ভঙুর হতে বাধ্য। আবার যেহেতু মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ উৎকৃষ্ট ও কার্যকরী পদ্ধতি, তাই মুখের বুলিকে গুরুত্ত্ব দিয়েই আমাদেরকে পঠন পাঠনের ব্যবস্থা করা জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় আমরা     ধর্ম – বর্ণ বিভাজনের উর্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের উর্ধে ভাষার ভিত্তিতে ঐক্যকে প্রসারিত করতে পারি এবং সবধরণের ভাষিক আধিপত্যবাদকে মোকাবিলা করার ভিত্তিভূমি তৈরি করতে পারি। বিশ্বায়নের প্রকোপকে মোকাবিলা ও ভাষিক জাতিয়তাবাদী ঐক্য কীভাবে করা যেতে পারে? বরাক উপত্যকার সমাজে শিক্ষা আন্দোলনের স্বরূপ কী হতে পারে?

         (৫) ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল প্রভাব থেকে ভাষাকে মুক্ত করেই ভাষার উপর যে বর্তমান বাজার সংস্কৃতির আগ্রাসন তার মোকাবিলার এক গণতান্ত্রিক পথ নির্মাণ করা সম্ভব। আমাদের একথা স্মরণে রাখা এবং একে উন্মোচিত করা জরুরি যে ব্রিটিশ কলোনিয়্যালিজম থেকে আজকের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে এক ধারাবাহিকতা ও ছেদ দুটোই রয়েছে। ভাষাকে ও ভাষিক অধিকারকে বাঁচাতে গেলে আমাদেরকে ধারাবাহিকতার এই অন্তঃসলিলা ফল্গুধারা এবং মাঝেমধ্যে ভঙুর বাঁধ নির্মাণের প্রচেষ্টার অন্তর্নিহিত সূত্রগুলি আমাদের চর্চার বিষয় হয়ে উঠতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের দীর্ঘ ইতিহাসে ভাষা কীভাবে বিপন্ন হয়ে উঠছে?

            এতো গেল বাংলা ভাষা ও বাঙালির গণতান্ত্রিকীকরণের বিষয়। এবার দেখা যাক আমাদের প্রতিবেশি অন্যান্য ভাষিকগোষ্ঠীদের ঐক্যের প্রশ্নটি –

            (১) যে মাতৃভাষার আন্দোলনে একষট্টির বাঙালিরা যোগ দিল, সেই বাঙালির উত্তরসূরীরা বিভিন্ন ভাষিকগোষ্ঠীর ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক যান্ত্রিক ঐক্যের কথা বলল বটে, কিন্তু কখনওই এক গঠনমূলক ও জীবন্ত ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খুব বেশি সফল হল না। বরাক উপত্যকার বিভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠীর ঐক্যের জন্য আমাদের কী করণীয়? অসমীয়া – বাঙালি ঐক্যও কোন পদ্ধতিতে গড়ে উঠতে পারে এবং সেক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয়?

 
     (২) বাঙালিদের প্রতিবেশি এক বিশাল জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকারের প্রশ্নে বিশেষ কোন আগ্রহই দেখাল না। চা-বাগানে বসবাসকারী এই বিশাল জনগোষ্ঠীটি মাতৃভাষার অধিকারহীনতায় শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত হয়ে রইল। গণশিক্ষা ছাড়া যে কোন অঞ্চলেই গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি হতে পারে না এই বাস্তব সত্যের প্রতি আমাদের অনীহা বরাক উপত্যকার জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে আনল। উনিশের ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় আনতে সক্ষম হলাম, ভাষা শহিদ স্টেশনও হয়ত একদিন হবে, আমরা আরও বহুবিধ দাবি উত্থাপন করলাম, কিন্তু ভিন জনগোষ্ঠীর দাবি ও অভিমানের প্রতি আমরা উদাসীন থাকলাম।   চা-বাগানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জন্য শুধু মাতৃভাষার অধিকারের দাবি জানানোই যথেষ্ট নয়, উনিশের ঐতিহ্য আমাদেরকে যে আরও বিশাল কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার আহ্বান জানায় সেটা আমরা বিস্মৃত হলাম। বরাক উপত্যাকার বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে অন্যান্যদের প্রতি আমাদের দায় অনেক – উনিশের ঐতিহ্য থেকে আমাদের সে দায়েরও উন্মোচন হোক আজকের আলোচনা থেকে। চা-বাগানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ভাষিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের ভাষিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কীধরনের ভূমিকা নেওয়া উচিত?      

রবিবার, ১৮ মে, ২০১৪

আধিপত্যবাদ ও উনিশের ঐতিহ্য



১৮ মে, ২০১৪ যুগশঙ্খ
।। অরূপ বৈশ্য ।।



অসমীয়া মধ্যশ্রেণির বোধোদয় ও বাঙালি উদারতা

ম্প্রতি বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও অসমীয়া মধ্যশ্রেণির ইতিহাস নিয়ে মূল্যবান গ্রন্থের লেখক ড০ প্রফুল্ল মহন্তের একটি নিবন্ধ বেরিয়েছে অসমীয়া এক দৈনিক কাগজে। এই নিবন্ধে লেখক অসমীয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া থেকে জনজাতীয়দের দূরে ঠেলে দিয়ে অসমীয়া জাতির ধ্বংস ডেকে আনার জন্য অসম সাহিত্য সভা, কংগ্রেস সরকার ও অসমীয়া বর্ণহিন্দু সমাজকে দায়ি করেছেন। গণতন্ত্রের প্রতি এই সজাগতা তার স্বাভাবিক নিয়মে আরও নতুন গঠনমূলক দিক উন্মোচিত করে। এই লেখাটি আসলে অসম সাহিত্য সভার কোন এক অধিবেশনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণের সংক্ষিপ্ত রূপ। অসম সাহিত্য সভার মত এক জনপ্রিয় অসমীয়া জাতির প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রতিষ্ঠানে এধরনের খোলাখুলি বক্তব্য পেশ এটাই দেখায় যে আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদের দীর্ঘ ইতিহাস অসমীয়া জাতিরও যে সমূহ ক্ষতি সাধন করেছে এই উপলব্ধি অসমীয়া মধ্যশ্রেণির মননে জায়গা করে নিচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করেই যে উগ্রজাতিয়তাবাদ তার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে এই উপলব্ধি গড়ে ওঠা জরুরি এবং তার থেকেও জরুরি একে প্রতিহত করার কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করা। তবে এই মধ্য শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগেই আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদী ইতিহাসের লুক্কায়িত তথ্যগুলি একে একে উন্মোচিত হয়ে চলেছে। অন্য জাতির কল্যাণ সুনিশ্চিত না করে কোন জাতি নিজের কল্যাণ সুনিশ্চিত করতে পারে না – এটাই মানব সভ্যতার অমোঘ নিয়ম। কিন্তু ইতিহাসের করুণ পরিহাস এই যে আসামকে বধ্যভূমি করে তুলে, আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদী ইতিহাসে বাঙালি বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের লাগাতার গণহত্যার মুখে ঠেলে দিয়ে মানব সভ্যতার এই শিক্ষা নিতে হচ্ছে। এই শিক্ষা কতটা গভীর তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু নিবন্ধের লেখক যদি আরও একটু পেছন দিকে তাকাতেন তাহলে কী তিনি বাঙালির উদারতা - মহৎ আবেগপ্রবণতাকে আবিষ্কার করতেন, না তিনিও আঁতকে উঠতেন কলকাতার বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক মধ্যশ্রেণির ভূমিকার কলঙ্কিত অধ্যায়কে দেখে। এই আঁতকে উঠার কাহিনী নিশ্চিতভাবে একমাত্রিক নয়, এই শ্রেণির অভ্যন্তরেই তার প্রতিকল্প নির্মাণের প্রয়াস নিরন্তর অব্যাহত ছিল। কিন্তু যা প্রাধাণ্যকারী ভূমিকায় ছিল তা আঁতকে ওঠার মতই বৈকি।

ব্রিটিশ প্রভাবান্বিত বাংলার ভাষিক-সাংস্কৃতিক নির্মাণ

ইতিহাস ব্যাখ্যার পদ্ধতির প্রভূত উন্নতির পরও অতীত ও চলমান ঘটনাকে কিছু লক্ষণ ও তথ্য দিয়ে চিহ্নিত করার প্রবণতা সাধারণকে আচ্ছন্ন করে রাখে – বিশেষ করে বরাক উপত্যকার মত অঞ্চলে যেখানে ইতিহাস চর্চা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কিন্তু পরিচিতি ও সংস্কৃতির বলয়কে চেনার জন্য শুধুমাত্র চর্চার অভ্যন্তরিণ কাঠামোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে চলে না, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে এই চর্চা নির্মিত হয়েছে তার দিকেও তাকাতে হয়। ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল শাসকদের বাংলায় পদার্পণ ও কলকাতায় প্রথম রাজধানী গড়ে ওঠা বাংলার ভাষা-সংস্কৃতিকে ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। উপনিবেশিক শাসনের ছত্রছায়ায় ও মদতে অতীত সাবলিল বাঙালি সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ায় ছেদ ঘটিয়ে ভাষা-সংস্কৃতির যে নতুন বয়ান তৈরি হয় তাকে খণ্ডন করার প্রভূত প্রয়াস সত্ত্বেও বাঙালির হিন্দু ভদ্রলোক মধ্যশ্রেণির মননকে এখনও এই বয়ান আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাই এখনও যখন মধ্যযুগকে অন্ধকারময় ও যে সময়ে অসমীয়া জাতিয় চেতনা গড়ে ওঠেনি সেসময়কার অসমীয়াদের প্রতি কলকাতার বাঙালি ব্যক্তিত্ত্বের ভূমিকা ও অবদানকে বাঙালির উদারতার লক্ষণ হিসেবে যখন বরাকের কোন বুদ্ধিজীবী উল্লেখ করেন, তখন মর্মাহত হতে হয় বৈকি। কারণ এভাবে দেখার মধ্যে ব্রিটিশ প্রভাবে কলকাতার বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিদাম্ভিকতার সংমিশ্রণে নির্মিত রেঁনেসার বয়ানেরই পুনরুল্লেখ হিসেবে প্রতিভাত হয়। যদুনাথ সরকারের মত ইতিহাসবিদ এই প্রভাবেই জটিল ইতিহাসকে অতি-সরলিকরণ করেছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন। ১৭৭০ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষকে এঁরা ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের নীতির মাধ্যমে লুণ্ঠনের রাজত্বকে কখনও দায়ি করেননি। ব্রিটিশ রাজত্বকে কল্যাণকামী হিসেবে দেখার মধ্য দিয়েই জাতিয়তাবাদী রাজনীতির সাথে এক বড়সড় বিচ্ছেদ রেখা টানা হয়। এখান থেকেই নির্মিত হতে থাকে ভদ্দরলোকি আদবকায়দা, হিন্দু সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠতা, মুসলমানদের অপর ভাবা, ভাষাকে মুসলিম প্রভাব মুক্ত করা ইত্যাদিকে আশ্রয় করে নতুন ভাষিক-সাংস্কৃতিক বয়ান। এর পেছনে ছিল এই শ্রেণির জমিদার-মহাজনী স্বার্থের ভাবাবেগ এবং এজন্য এরা কৃষকদের উপর হওয়া কোন অত্যাচারকেই দেখতে অপারগ ছিলেন। তবে এর বিরুদ্ধ বয়ানও এই শ্রেণিভুক্ত কিছু বুদ্ধিজীবীরা নির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু এরা কখনওই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেননি। ১৯৩৭ সালে অষ্ট্রীয়া থেকে এক লেখায় সুভাষ বোস ভারতীয় ইতিহাসে ‘মুসলিম যুগের’ উল্লেখের বিরোধিতা করেছিলেন এবং পলাশির যুদ্ধকে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। বাংলা বিভাজনের ক্ষেত্রে এই বর্ণহিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির ভূমিকাই যে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে তা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক জয়া চাটার্যি তাঁর বেঙ্গল ডিভাইডেড গ্রন্থে। তাদের আধিপত্য কায়েম করতে তারা বাংলা বিভাজনকে কায়মনোবাক্যে চাইছিলেন, এর বিনিময়ে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরণেও তাদের আপত্তি ছিল না। সি আর দাশের প্রজা-কৃষক পার্টিকে তারা হেয়র চোখে দেখতেন এবং পরবর্তীতে বাংলা বিভাজন রোখার জন্য শরৎ বোস ও আবুল হাসিমের প্রস্তাবকেও তারা আমল দেয়নি।  ব্রিটিশ শাসনের আশ্রয়ে এই শ্রেণিটি যে কীভাবে সম্পদশালী হয়ে উঠেছে এবং নিম্নবর্ণীয়দের অধিকারের প্রতি উদাসীন থেকেছে তার ব্যাখ্যা পাই আমরা ইতিহাসবিদ শেখর বন্দোপাধ্যায়ের কাস্ট, পলিটিকস অ্যাণ্ড দ্য রাজ গ্রন্থে। মুগল আমলে প্রতিপত্তিশালী কৈবর্ত জমিদার ও স্বচ্ছল কৈবর্ত সমাজের সন্ধান পাওয়া যায় মেদিনীপুর অঞ্চলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে নতুন মধ্যশ্রেণির সৃষ্টি করে তাতে নিম্নবর্ণীয়রা চিরতরে অধিকারহীন ব্রাত্যতে পর্যবসিত হন। ব্রিটিশদের প্রতি এই নব্য-মধ্যশ্রেণির আনুগত্য ও মুসলিম ও নিম্নবর্ণীয় কৃষক প্রজাদের প্রতি তাদের অবজ্ঞার কারণটি এভাবেই বোঝা যায়। সুতরাং অসমীয়া জাতিয় চেতনা যখন বিকশিতই হয়নি তখন কিছু সংখ্যক বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অসমীয়াদের প্রতি উদারতার সাথে ব্রিটিশ আনুগত্যে নির্মিত মতাদর্শের কোন বিরোধ ছিল না। তাই এই উদারতার নিদর্শনে আমাদের পুলকিত হওয়ার কিছু নেই। তবে বাংলার কায়স্থ সমাজটি যে হিন্দি বলয়ের মত গঠিত হয়নি, তা গঠিত হয়েছিল করণিক শ্রেণি থেকে, যাদেরকে মনু উল্লেখ করেছিলেন ব্রাত্য-কায়স্থ হিসেবে, তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিত্রলেখা গুপ্ত তাঁর দ্য কায়স্থ – এ স্টাডি ইন দ্য ফর্মেশন অ্যাণ্ড আরলি হিস্টরি অব এ কাস্ট গ্রন্থে দেখিয়েছেন। এটা সম্ভবত একটা কারণ যে উপরিকাঠামোয় বাঙালি বর্ণহিন্দু সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে একটা নমনীয়তাও ছিল এবং এদের মধ্য থেকেই বিরোধিতাও উঠে এসেছিল, কিন্তু সেই বয়ান কখনওই প্রাধান্যকারী অবস্থান নিতে পারেনি। ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগকে বিশিষ্টতা দেওয়ার প্রবণতার মধ্যেও খামতি রয়েছে। দেশ-রাষ্ট্রের সীমানাবিহীন ভাষিকগোষ্ঠী ভাষাকেই আবেগের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, দেশ-রাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট হয়ে গেলে ভাষা ও দেশের আবেগ এক জায়গায় মিলে যায়। ভাষিক আবেগ যে গোষ্ঠী আবেগ ও স্বার্থের সীমানা অতিক্রম করেনি বাংলা বিভাজনের ইতিহাসই তার প্রমাণ। এবার বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের সমস্যা নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।

নতুন পরিস্থিতিতে উনিশের ঐতিহ্যের পুনর্নিমাণ

বরাক উপত্যকায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা যে সাম্প্রদায়িকতা একথা যে কোন পর্যবেক্ষকই স্বীকার করবেন। বরাক উপত্যকার বাঙালিরা বঞ্চিত এবং তাদের ভাষাও অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মত আক্রান্ত। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরাই আক্রান্ত। এই আক্রান্তরা পরিচিতির দিক দিয়ে মূলতঃ বাঙালি-মুসলমান হওয়ায় এখানকার ভাষা-সচেতন বাঙালি হিন্দু সমাজ কি আক্রমণকারীদের মিথ্যা ভাষণের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না? নিম্ন অসমের অধিবাসীদের উপর নির্বিচারে বাংলাদেশি তকমা সেঁটে দিয়ে প্রকারান্তরে হত্যালীলাকেও কি বৈধতা দেওয়া হয় না? এভাবেই তৈরি হয় আক্রান্তদের মধ্যেই আক্রমণকারীর মানসিকতা যে মানসিকতার বশবর্তী হয়েই ভাষা আন্দোলনে শহিদত্ব বরণ করা এই বড়ো জনগোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদীরা আজ হত্যার রাজনীতি করছে। শাসক শ্রেণির বঞ্চনা ও মতাদর্শের কাঠামোটি এতই সর্বগ্রাসী ও সুক্ষ্ম যে তা এক বঞ্চিতদের অপরের বিরুদ্ধ লেলিয়ে দিতে পারে। এখানে রাষ্ট্র কাকে মদত দিচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ কারণ রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতেই আক্রান্তরা আক্রমণকারী হয়ে উঠতে পারে। সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ নিজের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে রাষ্ট্রের এই মদত গ্রহণ করতে প্রস্তুত করে রাখে। মতাদর্শের এই প্রতিবন্ধকতাকে দূর করতে না পারার ক্ষেত্র তৈরি হয় চিন্তা ও কাজের দৈন্যতা থেকে। চিন্তা ও কাজ পরস্পর সম্পৃক্ত। কিছু পূর্বধারণা, কিছু প্রতীক, কিছু প্রচলিত বয়ানকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়ে মস্তিষ্কের রসায়নকে নিয়ন্ত্রণ করলে কিছু স্টিরিওটাইপ তৈরি হয়। যে প্রতিবেশিকে বাস্তবে দেখা হলো না, আবার যদি বা দেখা হলো তাকে জানার চেষ্টা করা হলো না, কিন্তু তার সম্বন্ধে একটা মত তৈরি করে নেওয়া হলো। এভাবে যে মতটি নিজের বলে ভাবা হলো তা আসলে প্রচলিত আধিপত্যকারী মত। এভাবেই শাসক শ্রেণি তার বয়ানকে চাপিয়ে দেয় এবং মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করার সুপ্ত স্পৃহার বাস্তবায়নের সহজ পথ খুঁজে নেওয়া হয় শাসক শ্রেণির সাম্প্রদায়িক হাতিয়ারের মধ্যে যেখানে কিছু সংখ্যককে অপর বানিয়ে একটি ধর্মীয় বয়ানে অন্যদের উপর আধিপত্য স্থাপন করা যায়। বরাকের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিন্তার উপর এই সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের আধিপত্য বিস্তারের আরেকটি সুবিধে রয়েছে। যেহেতু বরাক উপত্যকার বিশেষ করে শিলচরের শিক্ষিত মধ্যশ্রেণিটি মূলতঃ তৈরি হয়েছে তাদের দিয়ে যারা ছিন্নমূল হয়ে এখানে এসেছিলেন। সুতরাং ছিন্নমূল হওয়ার মর্মবেদনা এবং অতীত সচ্ছলতা হারানোর স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে চোখে দেখা, বাস্তব অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনা আংশিক ঘটনাকে তারা সাধারণীকরণ করে ফেলেন এবং তাদের অপরকে খুঁজে পান। সাম্প্রদায়িকতার এই সুবিধা দূর করতে পারে নির্মোহ ইতিহাস চর্চা। বরাক উপত্যকার শিক্ষিত সমাজ হিসেবে আমরা এব্যাপারে বড্ডই স্থাণু। একষট্টির ভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ও বরাকের সমাজে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির শেকড় প্রোথিত করার এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের গণ্ডী অতিক্রম করে আম  কৃষক-জনতার মধ্যে কোন যোগসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা নেওয়া হলো না। ফলে একদিকে বামপন্থী কৃষক আন্দোলন যেখানে নিম্ন শ্রেণির হিন্দু-মুসলমানরা সমাবেশিত হয়েছিলেন এবং ভাষা আন্দোলন যেখানে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাবেশিত হয়েছিলেন উভয়ই পরাস্ত হলো। পরাজয়ের এক দীর্ঘম্যাদী পথ বেয়ে একানব্বইতে এসে সবাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কাছে আশ্রয় নিল। সুতরাং নতুন গণতান্ত্রিক নির্মাণে আমাদের এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এই শিক্ষা নেওয়ার সময় আমাদের একথা মাথায় রাখা জরুরি যে আশির দশক থেকে বিশ্বায়নের অঙ্গ হিসেবে যে কাঠামোগত পুনর্গঠণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে বরাকের সমাজের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিশুদ্ধ কৃষকের সংখ্যা বরাকের গ্রামাঞ্চলে এখন খুবই সীমিত – কৃষকরা একাধারে শ্রমিকও। তাই ভাষা-পরিচিতির অধিকার,জনগোষ্ঠীগত অধিকার ও শ্রমিক শ্রেণির অধিকারের প্রশ্নে আমাদের যুগপৎভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এবারের উনিশ হোক এই পর্যালোচনা শুরু করার দিন।

বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০১৪

নৈরঞ্জনা










নৈরঞ্জনা তুমি গল্প শোনাও ,
সূর্যোদয়ের সেই প্রত্যুষের।
চেতনার ঢেউ আছড়ে পড়ুক,
ধূলোময় কাঁচের ঠুনকো দেয়ালে।
নৈরঞ্জনা ! তোমার কুলু-কুলু শব্দে,
হারিয়ে যাই, উরুবিল্বের পরিচয়হীন প্রান্তরে,
চেখে নেই সুজাতার পায়েস।
নৈরঞ্জনা , তোমার শ্রান্তবুকে;
ঢেউ জাগাক আবার, পূর্ণিমার চাঁদ।
তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রহর, লুম্বিনির চোখে চোখ রেখে।।
নৈরঞ্জনা, তুমি কবিতা লিখ,
গোপার অশ্রুবিন্দুর শিশিরে।
বিষাদসিক্ত অক্ষরেরা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতরো হয়ে উঠুক,
তিতিক্ষার স্নিগ্ধ উজ্জ্বলতায়।
নৈরঞ্জনা , তোমার কূলে-কূলে লালিত হোক,
শাক্যতরুণ সিদ্ধার্থের স্বপ্ন।

নিষ্কাম বুদ্ধের মৈত্রীর মন্ত্র,
ছড়িয়ে পড়ুক শতচ্ছিন্ন প্রাণে।
নৈরঞ্জনা , ভেঙে ফেলো এবার মোহের প্রাচীর,
দৃষ্টিপথ ভেদ করে , মুক্তির ঘুড়ি উড়ে চলুক,
ব্রহ্মাণ্ডের শিরায় শিরায়।
নৈরঞ্জনা , মিলে মিশে যাও,
গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র , বরাকের কালো জলে। 
ব্যক্ত হোক আবার সেই সর্বত্যাগীর স্নিগ্ধ স্বরূপ,
মানবতা সঞ্জীবনীর আবাহনে।

১১মে যুগশঙ্খের রবিবারের বৈঠকে প্রকাশিত