“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ৮ জুন, ২০১৫

সুরমা গাঙর পানি-- ভাটি পর্ব ৮

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার অষ্টম  অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
 
আট


 লুলা এক ছুতোর মিস্ত্রির বাড়ি দেখিয়ে বলে,
--- তোর গুরুর বাড়ি । যা
  যা বলেই ধা । কী জানি কোন আভিমানে কৃষ্ণ সুদামার বিচ্ছেদ হয়ে যায় । দুজনেই ভেতরে ভেতরে ভেঙে খানখান । বন্ধুত্বের অভ্যাস ছাড়তে বড় কষ্ট । কিন্তু মচকাবে না কেউ । তাই দুপথে দুজন । লুলা এবার কোথায় যাবে জানে বৈতল । কিছুদিন হয়তো দেশের বাড়িতেই যাবে । মা ছাড়া নানার বাড়িতে থাকবে, ছগলসহ মাচানের উপর শুয়ে নানার কাছে মায়ের কথা শুনবে । একদিন চোনার গন্ধে বিরক্ত হয়ে বাড়ি ছাড়বে , যাবে বইয়াখাউরি বৈতলের খোঁজে । দেখা না হলেও তার অন্য আকর্ষণ যে আছে বৈতল- বাড়িতে ওখানে মা আছে । মা –এর আদরে থাকবে কিছুদিন বৈতল – বাপের গালমন্দ খেয়ে । লুলার পথ যে শেষ হয় নি । বেরিয়ে পড়বে আবার মাধবগঞ্জও থেকে জাউয়া, জাউয়া থেকে সুনামগঞ্জ , লক্ষণশ্রী । অনেকদিনের সাধ লুলার । যাত্রাপথও দুই বন্ধু মিলে ঠিক করেছে । এই জীবনে কী আবার মিলবে দুই বন্ধুতে বৈতল জানে না । মাছুয়া বৈতল এখন নিজেকে তৈরি করতে চায় । তার মার ইচ্ছা পূরণ করতে চায় , পুঁথি পড়া শিখতে চায় । লুলাকে বৈতল বলেছিল বিয়ানিবাজারের চৈতন্য চরণ পাল-এর কথা । বাংলায় নাকি জেলায় জেলায় মনসাপুথির রচয়িতা আছেন । চৈতন্য চরণ তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তিনি মহাভারতের ব্যাসদেবের মতো । তিনি জুড়েছেন , ব্যাস দিয়েছেন , সবঘটের জল দিয়ে পূর্ণ করেছেন পদ্মপুরাণ । এই বাড়ি কই তাঁরই তবে । তিনিই চৈতন্য চরণ পাল । বইয়াখাউরির বৈতল উত্তেজনায় সরাসরি কাঠমিস্ত্রিকে প্রশ্ন করে,
--- আপনে চৈতন্য চরণ পাল নি ।
মিস্ত্রি জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে বলেন ,
--- তাইন তো সিষ্টিধর রে বাবা, আমি অইলাম সিষ্টিছাড়া । কেনে রে বা কী কাম । আমি করাতির কাম করি আর আইর সেবা করি । নাচি , গান গাই । তুমি কিতা চাও কও ।
     মানুষটির কোনো গুণ জানে না বৈতল । কিন্তু এমন মমতাময় পুরুষ এই প্রথম দেখে । দেখে আর তাঁর ধূলি ধূসরিত পায়ের দিকে তাকায় । বৈতল মনে মনে ঠিক করে এই পায়েই ঠাই নিতে হবে । পিতা, মানে বাপ দেখেছে বৈতল বইয়াখাউরিতে , বড় হাওরে । হেই বৈতল পানিত লাম, খলই ধর বলতে শুনেছে বাপকে । খাটিয়ে মারা শুধু , চাকরের জীবন । বৈতল চোখ বুজে ঠিক করে নেয় তার গন্তব্য । হাঁটু মুড়ে বসে । মনের ভিতর তখন বড় হাওরের উথালপাথাল জলের ঢেউ । কান্না , বৈতলের কান্না কেউ দেখতে পায় না । শুকনো চোখে একবার হাত বুলিয়ে সেই হাত দিয়ে নাম পরিচয় অজানা পুরুষের পায়ে প্রণাম করেবলে,
--- আপনে আমার গুরু ঠাকুর অইবা নি । আমি নাচ শিখতাম , গান শিখতাম । বিষরির গান, জিয়ানি ঢলানি !
    গুরু বলেন,
--- ঢলানি জিয়ানি । আমি কুনু গুরু নি বা । আমি শখর উঝা ।
--- আপনে যেতা কইবা করমু করাতর কামও করমু ।
--- বুঝছি বাবা । থাকবায় কই , খাইবায় কিতা । আমার নিজর অউ বুঝ নাই । কাঠ মেইস্তরর আর কত পয়সা ।
বৈতল বলে,
--- আমার আছে পয়সা ।
   পুন্দো নাই চাম, রাধাকৃষ্ণ নাম । বলে তো দেয় বড় মুখ করে । দেওয়ার মতো কানা পয়সাও নেই সঙ্গে । বৈতল হেরে যাওয়ার পাত্র নয় । বাপ তাকে হাওরের মাঝখানে ছেড়ে দিয়েছে , হাঁকপাক করে নি , জল খেয়ে দম বন্ধও হয় নি । মনের জোরে সব করেছে । খলুই এর ভিতর আলদের বাচ্চা রেখে দিয়েছে বাপ, বৈতল বের করে ফেলে দিয়েছে । লড়াই শুরু হওয়ার আগেও হারে না বৈতল , পরেও না । বাপের দেওয়া তেলাল শরীর তো আছে । আরো তেল মেখে নেয় নিশুতি রাতে । বেরিয়ে যায় অন্ধকারে । সিঁদকাঠির দরকার হয় না বৈতল পাটনির । বৈতল গুরুদক্ষিণা যোগাড় করে আনে । গুরু পদে দিয়ে বলে,
--- বাপ দিয়েছে ।
ওঝাগুরু শিখিয়ে দেন গুরুমন্ত্র । বলেন,
--- কও বাবা আমার লগেলগে,
     ‘ আগে বন্দি মাতা পিতা আর শিক্ষাগুরু
       এ জগতে যারা হন বাঞ্ছা কল্পতরু ।’
   সৃষ্টিধর সূত্রধরের বাড়িতেই তার দোকান ও কারখানা । রইদপুয়ানি গ্রামে ঢোকার মুখেই বৃন্দাবন কামারের দোকানবাড়ি । মাঝখানে পুকুর । ওপারে গুরু সৃষ্টিধরের ভদ্রাসন , দোকান ও শাকসব্জির বিচ্‌রা । দোকানেই থাকে বৈতল । গুরুর বিশ্বাসের অমর্যাদা করে নি । গুরুবাক্যের অমান্য করে নি । বিয়ানিবাজারে , কসবাবাজারে টুল জলচৌকি মিটসেফ আলনা বিক্রি করে হাটবারে । গুরু সন্তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ করেন শিষ্যকে বলেন,
--- কাম না থাকলে টুকিটাকি কাম করিও । বেলাইন চাকি বানাইও , খাদা বানাইও । কতরকম হাতর কাম করা যায় । কাঠর পুতুল বানাইতায় পারো । দেপতার কুস্‌সি বানাও না কেনে ।
--- আমি তো কাম না থাকলে গান গাই ।
--- গানও গাওন লাগব মাছও মারণ লাগব মৎস মারিব খাইব সুখে    
       রসিকতার কথা বলে মিষ্টি করে হাসেন । গুরুর হাসিতেও নির্দেশ পায় বৈতল । পুকুর থেকে মাছ ধরে দেয় । কাঠের কাজ করতে করতে বৈতলের গালে নরম নরম দাড়ি গজায় । কেন জানি দাড়ি ঘন হয় না
       সৃষ্টিধর ওঝার পাঁচ মেয়ে , কোনও ছেলে নেই । সব কটিই বিবাহযোগ্যা , বিয়ে হয় না । ওঝারও কোন চেষ্টা নেই বিয়ে দেওয়ার । ছোটটির নাম চায়না । বড় চারজনের ফুলের নামে নাম । জবা, মালতী , করবী আর পদ্মা । নামের বাহারে অবাক হয়ে বৈতল চায়নাকে বলে ,
--- তুমার ই কিতা বিদকুটি নাম ।
--- আমরার সব ফুলের নামে নাম ।
--- চায়না আবার কী ফুল ।
--- চামেলি চিন না নি ।
--- চিনি , তুমি চামেলি অইলেও কেউ তুমারে চায়না ।
--- অইব ।
মনোদুঃখী হয় চায়না । বৈতল বিব্রত হয় । বলে,
--- অউ দেখ , তুমি অখন কান্দি দিবায় নি , কান্দলে কইলাম তুমারে খুব সুন্দর লাগব ।
      একা একা একরাতে বৈতল দোকানঘরে সুন্দর দেখে । সুখের স্বপ্নে বিভোর হয় । স্বপ্নের ভিতর চামেলির সুগন্ধ ।
       কাঠের কারখানায় শুয়ে শুয়ে গুরুকন্যাকে খাবলে খুবলে আদর করে বৈতল । গুরু দৃষ্টির ভৎর্সনা দুঃখও মেশে সুখস্বপ্নে । গুরুর মায়াময় চোখের তারা কথা বলে। বলে, তুমিও বাবা । বৈতল গুরুকে কখনও রাগতে দেখে নি, তাই স্বপ্ন দেখার সুখে তেমন ব্যাঘাতও হয় নি ।
        স্বপ্নদোষ হয় বৈতলের । তরল বীর্যপতনের সুখ ও বিষাদ । এর পর অনেকবার ঘটেছে । করাতি গুরুর কনিষ্ঠা কন্যাকে কামনা করে প্রায়ই অঘটন ঘটিয়েছে কাঠ- কারখানার করাত – গুঁড়োয় ।


চলবে

< ভাটি পর্ব ৭ পড়ুন                                                                       ভাটি পর্ব ৯ পড়ুন >


কোন মন্তব্য নেই: