“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১১

হাজার ঝরাপাতার বুকে



[ এই রচনাটি কবি আলোক সরকারের ৮০ বৎসর পূর্ত্তি উপলক্ষে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন ‘আশ্রয়গৃহ’ (প্রকাশক ‘অনুবর্তন’) তে প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। ঈশানের পাঠকদের জন্য এখানে প্রকাশ করলাম।:সপ্তর্ষি বিশ্বাস;   (c)২য় ছবি,     ৮ম ছবি,   ১১ তথা শেষ ছবি।]


১.
                 দেশগ্রামে আমাদের বাড়ির পিছনে বয়ে যায় একটি ছোট নদী। নদীও নয়। খাল। খাল যেখানে গিয়ে মিশেছে নদীতে, সেখানে বাজার। সেখান থেকে এক বিকালে এক খেয়া নৌকা ভাড়া ক’রে ভাসতে ভাসতে চলে এসেছিলাম আমাদের বাড়িরই পিছন দিকটাতে। দেখতে পাচ্ছি সেই অর্জুন গাছগুলি। কলতলা। বাঁশঝাড়। পিছনের বারান্দা। দিদিভাইয়ের কোঠা। তবু যেন কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে অন্যরকম। আরেকবার রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম, একটি মানুষ হেঁটে চলেছেন আমার খানিকটা আগে আগে। চেনা চেনা ঠেকছে। তবু পারছি না চিনতে। বেশ খানিকক্ষণ পরে বুঝলাম, একটু দূরত্বে, আমার আগে আগে গম্যমান ঐ মানুষটি আমার বাবা! দ্বিতীয় ঘটনাটিতে এমনি আক্রান্ত হয়েছিল চেতনা, যে একটি গল্পও লিখে ফেলেছিলাম ঐ নিয়ে।
         একটু দূরের থেকে দেখলে, প্রকৃতপ্রস্তাবে, চেনা জিনিসেই, জানা মানুষেই পাওয়া যায় এক অপরিচয়ের ইঙ্গিত, যে-ইঙ্গিত প্রতিদিনের মানুষটিকে, বস্তুটিকে, পার হয়ে চলে যায় যেন প্রায় আবহমানেরই দিকে। ‘নিকটের থেকে দেখা’ বলতে আমি বলতে চাই, যে-দেখায় মিশে থাকে আশা, আসক্তি, হতাশা, হাহাকার, অভিমান। ঐ ঘটনাগুলির অনেকদিন পরে একটি ছবি দেখেছিলাম। Ettore Scola’র ‘A Special Day’। সেখানে নায়ক Gabriele এক প্রতিবেশীনির বাড়ির থেকে তার নিজের বাড়িটিকে দেখে চিনতে পারেনি!
          কথাগুলি মনে এল আলোক সরকারের কবিতার প্রেক্ষিতে। কেননা আমার অনুভবে আলোক সরকারের রচনার একটি মৌল অন্তর্বস্তু ঐ ‘দূরের থেকে দেখা’... ঐ দেখা নিয়ত নিবিষ্ট ‘সামগ্রিক’-এর অনুধাবনে...ঐ ‘দূরের থেকে দেখা’ আর দেখানোই আলোক সরকারের কবিতার নিয়ম ও নিয়তি। যেমন নন্দলাল বসুর ছবিগুলি।
           যেহেতু নিয়ম, তাই তাতে সচেতন প্রয়াস মিশে থাকতে বাধ্য। যেহেতু নিয়তি, তাই তাঁর দেখার ভঙ্গীটিই মূলত নিরাসক্ত। জলরঙ্গে আঁকা বিকালের ছবির মতো ছায়াময় তার বর্ণ বিন্যাস। ছায়াময়, তবে কুহকময় নয়। নয় বিষাদে আক্রান্ত। নিরাসক্তির এই বর্ণ বিন্যাস মনে করায় অমিয় চক্রবর্তীকে, যিনি এইপথে আলোক সরকারের একমাত্র পূর্বসূরী। বার্ধক্যের প্রায় সীমারেখায় এসে যে-ভাষায় যে-কথা আলোক সরকার বলেন তাঁর ‘আশ্রয়ের বহির্গৃহ’তে, তার সঙ্গে ১৭-১৮ বছর বয়সী আলোকের ভাবের,ভাষার, আপাতসংশ্রব নেই, আর না থাকাই হয়তো স্বাভাবিক। তবু আমি যে-সংশ্রবটি লক্ষ করি, তা ঐ ‘দূরের থেকে দেখা’র নিয়তিটির উপস্থিতি সাপেক্ষে। ঈশ্বর ও মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর কবিমানসের প্রথম সাক্ষাতের দলিল হিসাবে আমি পাঠ করি তাঁর ‘উতল নির্জন’ গ্রন্থের ‘স্বজ্ঞা’ কবিতাটি :
তা আমি নেবোবা কেন আমার যা নয়?
দেখো দেখি আকাশের সুগম্ভীর মেঘের বিথার
খান খান হয়ে গেলো একমুঠি হাওয়ার ইচ্ছায়।
তা আমি নেবোবা কেন আমার যা নয়?
        ঈশ্বর ও মৃত্যুর মুখামুখি দাঁড়িয়ে ১৭-১৮ বছর বয়স্ক আলোকের যে-উচ্চারণ, তাতে অসহায়তার থেকে বেশি, অভিমানের থেকে বেশি ভাস্বর বর্ণনা। অথচ তা জীবনানন্দীয় ‘নীল ডিম’ (‘একদিন নীল ডিম করেছো বুনন’ ), ‘ধূপের ধোঁয়ার মতো ধলা’ কিংবা ‘নোনা মেয়েমানুষ’ (‘মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়ে মানুষের কাছে’) ইত্যাদির নিকটবর্তী বা ঐ পথাবলম্বীও নয়। এ এক বর্ণিল বর্ণহীনতা যা নিরাসক্তির পূর্বশর্ত। আর এমনই সেই নিরাসক্তি, যে তা অবশেষে বেজে ওঠে প্রত্যাখানে :
আমার তো জানা নেই সহসা এ রঙ্গের প্রণয়
কেন এতো কথা কয়?
আমাকে তা দেওয়া কেন যা আমার নয়?
          পরবর্তীতে যেন এই প্রত্যাখ্যানটুকুকেও পার হয়ে যেতে চান তিনি। ক্রমে। আরম্ভ হয় আরেক স্বরলিপির সন্ধান। ঐ সন্ধানের সূত্র যেন পাই, আমি, তাঁর আত্মজীবনি ‘জ্বালানী কাঠ,জ্বলো’র এই অংশে :
‘ শুদ্ধসত্ত্ব বসু’র ‘একক’ পত্রিকায় অমিয় চক্রবর্তীর একটি কবিতা পড়লুম :
তুমি মোর এসেছো জীবনে ।
তুমি চলে গেছ।
আর কিছু নয়।

দেখো খেজুরের বনে
নির্জন ছায়ার মহিমা।
ওই শোনো
পত্রের মর্মর ধ্বনি।
আকাশের অব্যক্ত ইংগিত জেনে মেনে।
দেখ গ্রামসীমাটুকু ছাড়িয়ে এসেছি
আর ফিরব না।
        হাহাকার নেই, কোনো অভিমান নেই, প্রত্যাশা, এমন কী কোনো স্বপ্নও নেই। কেবল ধূসর অলক্ষ্যে চলে যাওয়া ...’

 আলোকও ক্রমে চলে যেতে চেয়েছেন এমনই হাহাকারহীন, অভিমানহীন,প্রত্যাশা ও স্বপ্নহীন‘কল্পনার স্বরচিত নিশীথ যাত্রা প্রান্তর’-এ।
          এই যাত্রাপথটি সুগম নয়। কখনো সুগম ছিল না। হবেও না কখনও। কেননা ঐ যাত্রায় পাথেয় হিসাবে কেবল মাত্র ‘ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’-এ কাজ চলে না। প্রয়োজন পড়ে ‘ট্র্যাডিশনে’র প্রকৃত দীক্ষার। তাকে আত্মস্থ করবার মতো প্রতিভার এবং অন্তর্গত অবকাশের। ফলত রবীন্দ্রনাথের পর একমাত্র অমিয় চক্রবর্তীই সক্ষম এবং অগ্রসর হয়েছিলেন ঐ পথে যাত্রায়। অন্তত কিছুদূর। আশ্চর্য এই যে, যখন তাঁর সমসাময়িকেরা মত্ত হয়ে পড়ছেন ভাষায়, আঙ্গিকে, জীবনযাত্রায়, আরও বেশি পশ্চিমী মদ, কোকেন, আমদানি করে নিতে, তখনই আলোক সরকার এবং তাঁরই মাত্র কয়েকজন সতীর্থ – দীপংকর দাশগুপ্ত, অলোকরঞ্জনেরা পা বাড়ানোর স্পর্ধা করলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। পরবর্তীতে অন্তত অলোকরঞ্জন আর বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি সেই পথে। তাঁকে গিলে খেয়েছে পশ্চিমী মেধার রাক্ষসীই, শেষ পর্য্ন্ত। দীপংকর দাশগুপ্তও, ক্রমে, আলোক সরকারের সঙ্গে একই পথে না হাঁটলেও, তাঁর পথ বেঁকে যায়নি, অবশ্যই, অলোকরঞ্জনের পথেও।

          (প্রসংগত দীপংকর দাশগুপ্তর ‘নৌকো’ কবিতাটি মনে আসছে।এই কবিতায় ‘সমুদ্র কি সত্যি সত্যি আছে কোনোখানে’, বার বারই এই প্রশ্ন রেখেছেন দীপংকর দাশগুপ্ত। ভাষা এবং নির্মাণের প্রশ্নেও তিনি এখানে আলোকের পথাবলম্বী নন। ভাবনার ( বা ‘ভাব’-      এর ) দিক থেকে আমার মনে হয়েছে, যে এই প্রশ্ন আলোকেও স্পষ্ট না হলেও প্রচ্ছন্ন। আর এই প্রচ্ছন্নতা, ক্রমে, এমনি ‘সাট্‌ল্‌’, যে আমি মনে করে নিতে বাধ্য হই, যে, আলোক মূলত জানেন ‘সমুদ্র’ নেই, তথাপি নৈমিত্তিকতার প্রয়োজনে তাকে গড়ে নিতে হয় মনে মনে।)

           যে-পথে পা বাড়ালেন আলোক সরকার তাকে আমি বলব, অমিয় নির্দেশিত পথই, বহুদূর, যতক্ষণ না আলোকের ভাষানির্মাণ-এর প্রবণতা তাঁকে নিয়ে পাড়ি জমায়নি অপর বন্দরের পথে। । সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে বলে নিই আমার ধারণায় সেই মুহূর্তটির কথা, যখন, যেখানে আলোক যাত্রা আরম্ভ করলেন, সেই পথটিতে, যে-পথে, ক্রমে এসেছেন গৌতম বসু, অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র বা দেবাশিস তরফদার ... অবশ্যই তাঁদের নিজ নিজ প্রতিভার দীপ নিয়ে। তথাপি ঐ পথটির বিদ্যমানতা সম্বন্ধে আলোকই প্রথম দেখিয়েছিলেন আলোর ইঙ্গিত...হায়, উৎপল কুমার বসুও কখনও ঐ পথের রেখাটির সন্ধান পেয়েছিলেন (‘চৈত্রে রচিত কবিতা’), কিন্তু যেহেতু ট্র্যাডিশনকে গ্রহণের মতো প্রতিভা এবং তার অন্তরালে মননের অবকাশ তাঁর ছিল না, ফলে তাঁকেও গিলে খেল গিয়েন্‌স্‌বার্গ! উৎকট আধুনিকতা (‘পুরী সিরিজ’ এবং তৎপরবর্তী সমস্ত কিছু)।
            আলোক সরকারের সবগুলি কবিতাগ্রন্থ আমি এতাবৎ পড়িনি। কারণ হাতে পাইনি। সংগ্রহ করতে পারিনি। নানা সময়ে নানা পত্র পত্রিকায় ছাড়া মূলত একত্রে, সময়ানুগ ভাবে পড়েছি দে’জ থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (জানুয়ারী ২০০৫ সংস্করণ)। অসম্ভব ভালো লেগেছে ‘উতল নির্জন’ আর ‘সূর্য্যাবর্ত’। যদিও এ দু’টি গ্রন্থের থেকে খুব কম কবিতাই সংযোজিত হয়েছে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র এই সংস্করণে। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ঐ সংস্করণটি পড়তে পড়তে চমকে উঠেছিলাম ১৫ পৃষ্ঠায় এসে :
সকালবেলার আলো-আকাশ নতুন দেশের বাড়ি
শান্ত ছবি এঁকেছিল।
দেখেছিল মাঠে মাঠে সংহতির কুয়াশা যেন রহস্যের প্রথম ছবি।
যেন একটি উন্মোচন হাজার সবুজ পাতায় কিংবা শুভ্রতায় তার-ই
প্রতিশ্রুতি। বড়ো-বড়ো টিলা-পাহাড় পরিস্রুত আত্মীয়তায়।
দেখেছিলে সাহসিকা পরিণয়ের উজ্জ্বলতা, প্রেমিক অভিবাদন।

মুহূর্তের পরিচয়ে জেনেছিলে অবিরোধী নিবিড় সমর্থন।
কালো-কালো গাছের ম্লান শাখায় শাখায় করুণ প্রতিবাদ
এবং সেই বাগান-ঘেরা দেয়াল সব-ই সঞ্চারিত অসীম শ্রদ্ধায়।

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
যেন কিশোর আনন্দের রৌদ্রময় সবুজ ঘাসের পাখি
এবং সেই জারুলগাছ মাটির ঘরের সহজ বন্ধুতায়।
তার-ই নিবিড় ছায়া প্রখর উজ্জ্বলতা, একটি স্থির সংবেদনী আঁখি
জ্বেলে রাখে – যখন মলিন বিশ্বাসের কাছে
দেখায় গভীর নিমগ্নতা আত্মলীন সপ্রতিভ যায়।
বুকের মধ্যে শুনতে পাও আন্তরিক ধ্বনি –
হাজার ঝরাপাতার বুকে পায়ের চিহ্ন মর্মরিত আছে।

           কবিতাটির নাম ‘আলোকিত সমন্বয়’। পাতা উল্টে দেখি গ্রন্থটিরও ঐ নাম। টের পেলাম সমন্বয়ই বটে। ‘উতল নির্জন’ আর ‘সূর্য্যাবর্ত’-তে যা ছিল আলাপ কিংবা তরানা, তাই এখানে পূর্ণ হতে চাইল একটি সম্পূর্ণ খেয়ালের অবয়বে। আমার মনে হল :
অবিরোধী নিবিড় সমর্থন : এ যেন ‘স্বজ্ঞা’র ‘তা আমি নেবো না কেন আমার যা নয়?’-এর দ্বিধা পেরিয়ে, ‘যা আমার নয়’ তারই সাথে সমন্বিত হওয়ার অন্তর্গত সমর্থন  যার কাছে প্রতিবাদ ও সঞ্চারিত অসীম শ্রদ্ধায়।আর সেই অসীম শ্রদ্ধায় সঞ্চারিত পথেই কবির আত্মলীন সপ্রতিভ গমন সূচিত হল সেই নতুন দেশের বাড়িটির দিকে ......অতএব ‘উতল নির্জন’ আর ‘সূর্য্যাবর্ত’র সেই মৃদু অভিমানী ইংগিতগুলি, যেগুলি আমার অতিপ্রিয়, সেইগুলি, এখানে এসে সমন্বিত হল নূতন আলোয়,ভাষায় ... তবু সেই পংক্তিগুলি ‘উতল নির্জন’ আর ‘সূর্য্যাবর্ত’ থেকে উড়ে এসে আমাকে অদ্যাপি দেয় উদাস করে...
সহানুভূতির কিছু নয় সান্ত্বনার কিছু নয়
আন্তরিকতার সাথে আমি তার করি না অন্বয়
মুহূর্ত পরেই চলে যাই।
দিই না কিছুই তাকে যেহেতু সামর্থ্য নেই, ম্লান
ঝরা বকুলের মতো অষ্পষ্ট সুদূর এক ঘ্রাণ ...(করুণ কাকলী, সূর্য্যাবর্ত)

এখনো জানিনি তাকে। অন্ধকারে ফুলের মতন
কেবল সৌরভ তার দুঃখ আনে ...
........................... ......... শিশির ঝরেছে।
পথে, হেঁটে বাড়ি যাবো, মনে হবে কীযে হারিয়েছে । (মরমী, সূর্য্যাবর্ত)



           যদিও অপূর্ব, অনবদ্য এই পংক্তিগুলি, তবু তারা সমন্বয় দাবি করে। অভিমানী তরুণ কন্ঠের পরিবর্তে এবার যেন শুনতে পাই সেই ভাবীকালের বনপ্রস্থানের যাত্রীর স্বর, যে এখন দাবি করতে চলেছে তার গার্হস্থ্য। সে বলে :
বিবিধ রঙ, বিচিত্রিত রেখা কিন্তু স্বাভাবিকের।
প্রেমিকাকে নিয়ে তুমি শালবনের গভীর একাগ্রতায়
বিবেচিত স্রোতের সহজতার। সংহতির অরব আনন্দের
ধ্বনি যেন উন্মোচিত নীল শিখায় হৃদয়ময় যায়।
এলোমেলো পাতার ছায়া তোমার প্রিয়ার মুখের উপর
চন্দনের মতন মাত্র ! তুমি অমল অসংশয়ী যাও। (সমগ্রতা,আলোকিত সমন্বয়)

          এই যে পথে নেমে পড়েছেন আলোক, সে-পথ বিবেচিত। সেই স্রোতও বিবেচিত। এই পথ, এই স্রোত ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্টের সঙ্গে ট্র্যাডিশনের মেলবন্ধনের। তাই ঐ পথে তিনি আশ্বস্ত। তাই ঐ পথে তাঁর যাওয়া অমল অসংশয় ।
কবিতাগুলি পাঠ করার এবং তা থেকে উপরবর্ণিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার কয়েক বছর পরে যখন পড়লাম তাঁর সেই অনন্য আত্মজীবনি ‘জ্বালানীকাঠ জ্বলো’, তখন তারও শেষ পৃষ্ঠায় এসে, চম্‌কে উঠতে হল নিম্নোদ্ধৃত অংশটি পাঠ ক’রে : ... ১৯৫৪’র শেষ দিকে আমি ‘আলোকিত সমন্বয়’ রচনা করলুম। ... ... আমি তখন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। তবু বুঝতে পারলুম এই পটভূমির উপর দু’পা রেখে নিজেকে চতুর্দিকে আকীর্ণ হতে হবে। বারবার পরিবর্তনের আঁকা বাঁকা পথ, রোমাঞ্চ বিস্ময়, তবু তারই ভিতরে এটাই আমার স্থির কেন্দ্র।‘
          ১৯৫৪ সালে কবির বয়ঃক্রম তেইশ বৎসর (মাত্র)। ঐ বয়সেই আপনার রচনার স্থিরকেন্দ্রটিকে চিনে নিতে পারার গহনেও কি কাজ করে না সেই স্বাভাবিক ক্ষমতাটি, আলোকের, ঐ ‘দূরের থেকে দেখা’র? দূরের থেকে না দেখলে কীভাবে তিনি ঐ বয়সেই সমন্বিত হতে চাইবেন ‘অবিরোধী নিবিড় সমর্থন’-এ, আর ‘সঞ্চারিত অসীম শ্রদ্ধায়’-এর মতো ধ্রুবপদে? ঐ একই ধ্রুবপদ, রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কবিতাতে একমাত্র ধারন করেছিলেন, করতে পেরেছিলেন তো একমাত্র অমিয় চক্রবর্তীই।

        ২.
          মিয় চক্রবর্তী প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে আলোক সরকার লিখেছেন ‘অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার অন্তর্বর্ণ বর্ণহীনতা। ... সব কিছুই মূলত বর্ণময়, তবু আসক্তিই বর্ণের প্রকৃতি নির্দিষ্ট করে। (‘অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা পাঠের ভূমিকা’, অনুবর্তন, ১০ম - ১১শ বর্ষ, ১৯ সংখ্যা, জানুয়ারি – জুন, ২০০১)। পাশাপাশি তুলনীয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রসঙ্গে জীবনানন্দের সেই উপমা ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা’। দুইটি উপমাই লক্ষভেদী। আসক্তিরই একটি স্তর ‘আশা’, আর তারই বিপরীত শব্দ ‘নিরাশা’। সেই নিরাশাকেই তর্কে, যুক্তিতে, অপরূপ ভাষা ও শব্দবিন্যাসে অক্লান্ত জাহির করে গেছেন সুধীন্দ্রনাথ। পক্ষান্তরে নিরাশার সাধক জীবনানন্দ নিজেও। অর্থাৎ আসক্তির জ্যামিতিতে তিনিও আবিষ্ট। কিন্তু তাঁর নিরাশার রঙ ধূসর। পাশাপাশি অমিয়র দৃষ্টিভঙ্গী নিরাসক্ত। তাই তাঁর রচনায় সংখ্যাতীত রঙ্গীন আবহের, বস্তুর উল্লেখ থাকলেও তাঁর আসক্তি সেই আবহকে,বস্তুকে, দেয় না কোনও বিশেষ রঙ। বরং একটু দূরের থেকে দেখা সমগ্রের বুননে তারা হয় কবির কাঁচামাল। বেশি খোঁজাখুঁজি না ক’রে তাঁর যেকোনো কবিতা থেকেই তুলে নেওয়া যায় সংখ্যাতীত উদাহরণ :

‘ রঙ্গের মাছের স্বপ্ন সচল, নৌকো তলায়
কোরাল্‌ জলে আদিম রঙ্গীন ভাষা
নীল সমুদ্রে, নীচে।
পোর্ট সুদানে।। ‘(নামা ওঠা, সড়া)

‘পাহাড় দ্বীপের সারি রাঙ্গা-ছাত বাড়ি
ঠান্ডা শহর এলো পুরোনো বন্ধুর;
দীপজ্বালা বিদেশী বন্দর।‘ (কালো জলে, সড়া)

‘দরজায় সাড়া । ঘরে আনি
চেনা লোক , চেয়ারে বসাই –
কথা শুনে যাই :
ফুল-সাজি, ছায়া স্থির তার
নীল পর্দা, দুপাশে দুয়ার,
জেনে গেলো তাই।‘ (পরিধি, সড়া)

‘ কোথায় খুঁজে বার করেছে
খুদে কোরাল দ্বীপ,
উতল সাগর, একটু সবুজ টিপ –
– ওদের কথা বলো না – ‘ (মানুষের কথা বলো না, অমরাবতী)

       এমনই আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায় অমিয় চক্রবর্তী থেকে যেখানে রঙিন বস্তু বা আবহের উল্লেখ বস্তুটির নিজস্ব রঙ ব্যতীত কোনো বিশেষ রঙ নিয়ে প্রতিভাত হয় না। নীল সমুদ্র শুধু নীল সমুদ্রই। আশা বা হতাশার বিশেষ কোনও তুলিতে রাঙ্গানো নয়। নীল পর্দা শুধু নীল পর্দাই। আর কিছু নয়। জীবনানন্দ বা সুধীন্দ্রনাথ থেকে প্রতিতুলনা হাজির করা যায় অসংখ্য। কিন্তু তার প্রয়োজন নেই কেননা উপরের ইঙ্গিতগুলি থেকে পাঠক নিজেই সেগুলি খুঁজে নিতে পারবেন। বরং ফেরা যাক আলোক সরকার প্রসঙ্গে।
        অমিয় চক্রবর্তী প্রসঙ্গে যেকথা বলেছেন আলোক সরকার, আমি অনুভব করি, সেই একই কথা প্রযোজ্য আলোকের নিজের রচনা প্রসঙ্গেও। বহুদূর। আলোক সরকারের কবিতাতেও রঙ্গীন বস্তু আর বর্ণময় আবহের ছড়াছড়ি। কিন্তু সেই রঙিন বস্তু বা আবহের উল্লেখ, অমিয় চক্রবর্তীর মতোই, বস্তুটির নিজস্ব রঙ ব্যতীত কোনও বিশেষ রঙ নিয়ে প্রতিভাত হয় না। এর কারণও,অমিয়র মতোই, আলোকের দেখাও নিরাসক্ত।

পথে নেমে দেখেছিলে দূরে দূরে ছড়ানো নীল গাছ
ফুল ঝরছে ঘুঘুর ডাকের মতো। (হেমন্ত, আলোকিত সমন্বয়)


বাড়িটা নেই, এমনকি সেই অশথগাছ।
যখন তোমার কাছে যাবো
তুমি এসে বসবে সেই লালরঙ্গের বারান্দায়?
নাকি ঘরের ভিতর তোমায় পাবো।
তোমার কাছে ফিরে যেতে ভীষণ ভয় করে।
আমের বউল ছিল সেদিন ফাগুন মাসে;
ভালো বাসতে পারবো সবুজ ফলের উজ্জ্বলতা?
চৈত্রমাস আসে।
(এখানে এসে কবি নিজেই যেন দ্বিধাগ্রস্ত। তাঁর আহৃত নিরাসক্ততাহেতু তিনি যদি ব্যর্থ হন ফলের ‘সবুজ’ উজ্জ্বলতার কাছে আত্মসমর্পণে ... একই কবিতায়, পরের অংশে সেই দ্বিধাকেও পার হয়ে কবি সেখানেও লক্ষ করেন সমন্বয়...)
বাইরে লাল বারান্দার নির্জনতায়
চিরন্তনী বিরহী চাঁদ, কোনো
ভাষা তো নেই
আকাশ রাখে একজনের একটি সিংহাসন। (একক সিংহাসন,আলোকিত সমন্বয়)
(যদিও মানুষের গড়া বারান্দার রঙ লাল তবু চাঁদ বিরহী, নির্বিকার। অতএব সমন্বয়ের ভাষা ভিন্ন অপর কোনও ‘ভাষা তো নেই’, ফলত যতই বিরহী হোক চাঁদ, আকাশ তার বিরহ নিরসনের নিমিত্ত অপর কোনও সিংহাসন প্রণয়নে অপারগ ...)

এই নিরাসক্তির বর্ণনা, আরো পরের দিকের আলোকে পাই এইভাবে :
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ..আমি কোনোদিন
অভিভূত নয় কোনো ফুল দেখে, পাখি দেখে। অথচ আমার
সারাদিন মনে পড়ে পাখিগুলি, বাগানের ফুলগুলি সচ্ছল রঙ্গিন
সারাদিন অত্যন্ত নিঃসঙ্গ মনে হয়। (বিচ্ছিন্ন আঁধার, স্তব্ধলোক)

বর্ণকে, রংকে তিনি সংজ্ঞাবদ্ধ করেন এইভাবে :

বর্ণের মাধ্যমে সব মনে রাখি। প্রেমিকার চলে-যাওয়া
পীতবর্ণ। দুপুরবেলার পাতা-ঝরা
ধূসরাভ।

অন্ধকার ঘরে সব বর্ণ জ্বালি। অন্ধকারে
দশ-বিশ-পঁচিশ রকম দ্যুতি। এইসব
অন্তহীন পরিশ্রম। (পদ্ম, মেঘনিবেশ)

       অর্থাৎ এখানে পরিষ্কারই জানান দেন কবি, যে, বিশেষ অনুভুতিতে দাগিয়ে রাখা ভিন্ন, যেমন পরীক্ষাকালীন ছাত্রেরা একেক রঙে দাগিয়ে নেয় বইএর একেক লাইন, বর্ণের ভিন্ন কোনও মূল্য আর নেই তাঁর কাছে। আর এই জানান দেওয়ার আগে তাঁকে পার হয়ে আসতে হয়,‘আলোকিত সমন্বয়’-এর পরেও আরও তিনটি কবিতা গ্রন্থ। আরো কয়েকটি দশক। বর্ণের সাপেক্ষে এখানেই অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে আলোক সরকারের এক প্রকারের সংশ্রব। অমিয় চক্রবর্তীর মতো আলোক সরকারের কবিতার অন্তর্বর্ণও বর্ণহীনতা।



৩.
        বর্ণ ও তার প্রয়োগ সম্বন্ধে লিখতে লিখতে মনে এলো চীনদেশের কবিতায়   (খৃঃ ৬০০ – ৭০০’র কাছাকাছি সময়ের) রঙের, বর্ণের প্রয়োগের ধারণার কথা। বিশেষত লি পো’র কবিতায় এই প্রয়োগের কাছে আমাদের ফিরে আসতে হয় বারবার।

Heaven’s fragrance everywhere pure
emptiness, heaven’s music endless.

……….. ………………..
All bottomless clarity, in which vast
kalpas begin and end out of nowhere.

…. …. …. …. …. …

I hoard sky a setting sun leaves
And love this cold stream’s clarity

………. ………………. ……… ……….

           এখানে emptiness, clarity সকলই ব্যবহৃত হয়েছে ‘অরঙিন’ বা ‘বাহ্য বর্ণের উপস্থিতি হীনতা’ অর্থে। এই ‘বর্ণহীনতা’ দৃশ্যবস্তুর সাপেক্ষে নয়। এই ‘বর্ণহীনতা’ মূলত অন্তরের এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীর। লি পো এখানে এইভাবে ব্যাখ্যা করেন একে :
Blossoms pure, no dye of illusions,
mind and water both are pure idleness.

অর্থাৎ যখনই হয় বিধৌত তখনই সে প্রকৃত বর্ণে ভাস্বর। তখনি সে ‘শূন্য’, ‘বর্ণহীন’। তখনি নিরাসক্ত চোখে দেখা সম্ভব হয় শুধু পৃথিবীকে নয়, স্বর্গকেও :

I sit once and plumb whole kalpas,
see through heaven and earth empty.

(এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, যে, বুদ্ধদেব বসু অনুবাদ করেছিলেন এজরা পাউন্ডের একটি চীনা কবিতার ‘অনুবাদ’:
প্রেমের গান গাও, কুঁড়েমি করো
প্রেমের গুণ গাও, কুঁড়েমি করো,
কী হবে আর সব দিয়ে বা।

পাউন্ডের লেখাটি ছিল এই রকম :
Sing we for love and idleness
Naught else is worth the having. – ইত্যাদি

          Idleness এর উল্লেখ আমরা পেয়েছি পূর্বোল্লিখিত উদ্ধৃতিতেও। কিন্তু তা অবশ্যই নয় ‘কুঁড়েমি’ অর্থে। আর যে-প্রেমের কথা এখানে আছে তা’ও নয় কোনও নারীর প্রতি প্রেম। বিশ্ববিধাতার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে, আবিষ্ট হয়ে তাঁরই গান গাওয়ার কথা বলেছেন চীনা কবিরা। আর যেমন পাউন্ড, তেমনই তাঁর জারজ সন্ততি বুদ্ধদেব বসু একে টেনে নামিয়ে এনেছেন প্রায় একটি অকর্মণ্য মাতালের জবানবন্দীতে, যাকে কয়েক বছরের ব্যবধানেই নিজেদের সুরা ও গণিকা পরিবেষ্টিত যাপনের যুক্তি হিসাবে ব্যবহার করবেন সুনীল-শক্তি-সন্দীপনের দল। তার হাওয়ায়, প্রত্যন্ত মফস্বলেও জন্ম নেমে মদ খাওয়া আর বদমাইসি করার কারখানা ‘অতন্দ্র’ ইত্যাদি।)
          বর্ণের ব্যবহারের এই চৈনিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি অমিয় চক্রবর্তীর এই কবিতাটি পাঠ করলে অমিয়’র তথা আলোকের বর্ণ বিষয়ে দার্শনিক ধারণাটি পরিষ্কার হয় আরও ...আমি পুরো কবিতাটি উদ্ধৃত করছি না। উদ্ধৃত করছি শুধু প্রাসঙ্গিক পংক্তিগুলো :
চিন্তার সমস্ত রং ধুয়ে গেছে শাদা হয়ে,
... ... ... ... ... ... ... ...
বাসনার আলোগুলি ঝিমিয়ে ঝাপসা হয়ে জ্বলে পাশে। (এই বৃষ্টি, পালা বদল)
           অমিয় চক্রবর্তীর কাছে এই হল নিরাসক্তির সংজ্ঞা। তার রঙ। মায়ার ঊর্ণাজাল ছিঁড়ে শ্বাশ্বতকে দেখা। দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ‘আলোকিত সমন্বয়’-এ এই পথেই চলে এসেছেন আলোক সরকার। এই আসা, আগে যেমন বলেছি, স্রেফ ভাবের ঘোরে চলে আসা নয়। একটি সুচিন্তিত আসা। এই আসার পথে তাঁর মনোজ একক সংগ্রামের কাহন তাঁর নিজের ভাষায় বলে নিয়েই এই অংশ শেষ করব :

পুরোনো প্রেমিকা আমি তাকে দূরে রেখে
এখানে এসেছি। তার হাত পুড়ে গেছে
মুখ পুড়ে গেছে।
সারাদিন পথের ধারের জানালা
খোলা রাখি। ভালোবাসব নতুন মেয়েকে।

এখনো আবছা মনে পড়ে। কুৎসিত আঙ্গুলগুলো
চোখের তারার সর্বনাশ
আমাদের পূর্বরাগ তাও মনে পড়ে।
দিনে দিনে রচিত ভালোবাসা
আজ তার ধূলো
মুঠি ভ’রে এনেছি। আমি নতুন মেয়েকে
সেই ধূলো দেবো, দেবো প্রথম বিশ্বাস। ( শরৎকাল, আলোকিত সমন্বয়)

কে এই দগ্ধ পুরাতন প্রেমিকা? তখনকার কুৎসিত আধুনিকতার গণিকালয় ভিন্ন আর কী?

১০/১০/১০১০

৪.
           ‘আলোকিত সমন্বয়ে’র প্রায় সমস্ত কবিতাই সেই নূতন পথকে খুঁজে পাওয়ার, বুঝে নেওয়ার কবিতা। এই পর্বের সকল কথাই ভাষার,শিল্পরীতির,প্রকাশভঙ্গিমার পরিত্যাগের আর পালাবদলের মর্মর । এই নূতন আলোকে সমন্বিত পথের প্রতীক কিংবা objective correlative হয়ে ফিরে ফিরে এসেছে ‘বাড়ি’ আর ‘বন্ধু’র উল্লেখ।

তুমি ভালো আছো। আমি এখন নতুন বাড়ির
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। পশ্চিমের আকাশে
সমারোহে মৃত্যু তাকে সমর্থন করে।

(বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কেননা এখনও দ্বিধা কাটেনি সম্পূর্ণ। ‘তুমি’টি ভালো আছেন, কেননা বাড়ি তাঁকে বদলাতে হয়নি এখনও । অব্যবহিত পরেই এ-সম্বন্ধে কবির আরও সরল স্বীকারোক্তি পাব আমরা।)

পরিশ্রান্ত পাখি বিকেলবেলার অবকাশ
সাদা অনুভবের হাওয়ায়।
কী ক’রে যে তুমি এমন ভালো আছো!
সহজ মেঘ স্বার্থপর অন্যমন অসহায়ের খেয়ায়।

         (কী ক’রে ভালো থাকবে তারা, যারা এখনও পার হ’ল না সেতু? আঁকড়ে পরে রইল সেই ভাষার ও প্রকাশের ক্লিশে ধারণাকে! কী ক’রে ভালো আছে তারা? কী ক’রে ভালো থাকবে তারা, এখনও, সেই কফিহাউসে, শুঁড়িখানায়, হারকাটা গলির অন্ধকারে? এলিয়ট আউড়ে আর পাউন্ড আউড়ে? কই আলোক তো পারলেন না সেখানে, সেভাবে ভালো থাকতে! তবে এ কি তাঁরই ভুল? পরাজয়? অথচ তাকে পেরিয়ে আসতে গিয়েও কী এক বাধা যেন জড়িয়ে থাকে পায়ে পায়ে...)
কীকরে যে আমি এখন নতুন বাড়ির
ফাঁকা ঘরে বিস্ময়ের রহস্যের মতন
কথা বলিঃ প্রতিধ্বনি চাই আমার প্রতিধ্বনি চাই।
        ( ‘প্রতিধ্বনি চাই আমার প্রতিধ্বনি চাই’ উচ্চারণটি লক্ষ করার মতন। কেউ কথা বলছে না তাঁর ভাষায়। তাঁর আঙ্গিকে। এ যেন ‘form’-এর একাকীত্বের নিজেরই উচ্চারণ!)
আপনার মর্মে প্রতিষ্ঠিত একটি ধারণার থেকে অপর একটি ধারণায় উত্তরণের গহনেও থেকে যায় সংকট। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও বলতে হয়েছেঃ
জানি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম,
এমন ধন আর নাহি যে তোমা-সম,
তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা
ফেলিয়া দিতে পারি না যে।।
          চতুর্দিকে সবাই যখন আরও বেশি ঝক্‌ঝকে, আরও বেশি রহস্যময়, আরও বেশি তুখোড় হতে ব্যস্ত, আলোক তখন আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই দক্ষিণারঞ্জনের চিত্রকল্পে। চতুর্দিকে সবাই যখন ‘নেতি’ আর ‘নাস্তি’র মহিমা কীর্তনে সোচ্চার, আলোক তখন তাঁর চলার পথের পার্শ্বের প্রতিটি দৃশ্যে, গাছে,পাতায়,পাখিতে, খুঁজে পেতে চাইছেন, যা শাশ্বত। সে-খোঁজার অন্তিম নিয়ে তখনও দ্বিধাগ্রস্ত হলেও কোথাও তিনি পেয়েছেন সেই ইঙ্গিত, যা তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে :
‘তুমি যুবক হবে কবে কিশোর কবি!’ আলোক লিখছেন :
সময় দেখো সরল ডানায় উড়ে
কাছে যারা ছিলো তাদের শান্ত ইতিকথায়
রেখেছে। আজ একলা অচেনা দেশ।
তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত নিয়মে, তারা অপর মালা গলায়।
তুমি একা চেনা-ছবির ভালবাসায় দূরে
কাকে রাখো। যেন রাখো। কালো মেঘের একাগ্র নির্দেশ
অসীম তিরস্কারে। তুমি যুবক হবে কবে কিশোর কবি! (কিশোর কবি, আলোকিত সমন্বয়)

             তবে এই পর্বের সমস্ত দ্বন্দ্বের, অভিঘাতের প্রায় পূর্ণ রূপ ‘শিল্পীর আক্ষেপ’-এ শিল্পিত। এই কবিতাটি হাঁটে এমন এক সুতোর উপর দিয়ে, যা থেকে পা হড়কে যাওয়া যে কোনও মুহূর্তে স্বাভাবিক। আর তা হলেই রচনাটি তার কবিতারূপ হারিয়ে হয়ে উঠতে পারে একটি মেধাবী প্রবন্ধের কঙ্কাল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয় না আলোক সরকারের নির্মাণকুশলতায়।

বাড়ি ফিরে টেবিলে দ্বীপ জ্বালবো।
একটি গোপন চিরকিশোর অনিদ্রিত ফুলে
আমার ঈপ্সিতার মুখ তাকে কি আমি জানবো?
তোমার জলে তারা আসে নিজেই পাল তোলে।
আমার জল তাদের সমরাগে
না-যদি হয় তারা আমায় ভোলে।

        এখানে লক্ষ করার মতো পংক্তিগুলি হল ‘আমার জল তাদের সমরাগে /না-যদি হয় তারা আমায় ভোলে’, কেননা যে-আস্তিকতার আলোকিত সমন্বয়ের অন্তর্গত আবিষ্কারের মন্ত্রে আরম্ভ হয়েছিল আলোকের এই পর্বের পথচলা, উদ্ধৃত এই উচ্চারণ, লক্ষ করি তার বিরুদ্ধ্বাচার। কেননা, এই উচ্চারণ, হয়, নাস্তিকের। প্রকাশিত অমিয় চক্রবর্তীতে, এমন কি রবীন্দ্রনাথেও নেই এই উচ্চারণ।
            কেন নেই? মনে হয় নেই এই কারণেই, যে রবীন্দ্রনাথ এবং অমিয় দু’জনকেই নির্মাণ করে নিতে হয়নি তাঁদের দেবতাকে। তাই পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে ‘সমরাগ’এ না চলার অপরাধের শাস্তি বা পুরষ্কারের সম্বন্ধে তাঁরা ছিলেন উদাসীন। কিন্তু আলোক সরকার, যেহেতু এই যুগেরই সন্ততি, তাই তাঁকে সমন্বিত হওয়ার কারণে নির্মাণ ক’রে নিতে হয় তাঁর নিজস্ব ঈশ্বর। ফলত ঐ উচ্চারণের হাত তিনি এড়াতে পারেন না।
মনে পড়ে আর এক ঈশ্বরনির্মাতার স্বীকারোক্তি :
           ‘I shall tell you that at such a time one thirsts for faith as ‘the withered grass’ thirsts for water, and one actually finds it, because in misfortune the truth shines through. I can tell you about myself that I am a child of this century, a child of doubts and disbelief, I have always been and shall ever be [that I know], until the close the lid of my coffin. What terrible torment this thirst to believe has cost me and is still costing me, and the stronger it becomes in my soul, the stronger are the arguments against it. And despite this entire God sends me moments of great tranquility, moments during which I love and find I am loved by others; and it was during such a moment that I found within myself a symbol of faith in which all is clear and sacred for me. This symbol is very simple and here is what it is: to believe that there is nothing more beautiful, more profound, more sympathetic, more reasonable, more courageous, more perfect than Christ..if someone succeeds in providing to me the Christ was outside the truth, and if, in deed, the truth was outside Christ, I would sooner remain with Christ than with the truth…’ [Selected Letters of Fyodor Dostoevsky, Rutgers University Press, London, ISBN:0-8135-1185-2]

         এখানে এসে মনে হয়, তবে কী আলোক পাননি সেই ‘credo’, যা দস্তয়ভস্কির ‘যীশু’? আমার মনে হয় – না, পাননি। পরিবর্তে, তিনি যা পেয়েছেন তা শব্দের ঈশ্বর, শিল্পের ঈশ্বর, ভাষার ঈশ্বর। আর ঐ বিন্দুটি থেকেই তাঁর দার্শনিক অবস্থান ক্রমে ভিন্ন হতে থাকে অমিয় চক্রবর্তীর থেকে।
          এখানে মনে আসে আরও দুইজন বিপরীতধর্মী চরিত্রের কথা। Miguel de Unamuno-র Saint Manuel Good Martyr-এর কেন্দ্রচরিত্র Saint Manuel, আর বালজাকের The Atheist's Mass-এর Desplein। প্রথমোক্ত জন নিজমনে নিরীশ্বর। তথাপি তিনি সন্তের বেশে প্রচার করে যান ঈশ্বরের মহিমা। কেননা তাঁর অনুভব তাঁকে বলে, দুঃখী মানুষের পক্ষে, দুর্বল মানুষের পক্ষে নিরীশ্বরতা যাপন মৃত্যুর চেয়েও মর্মান্তিক। বালজাকের চরিত্রটি আদ্যন্ত নাস্তিক, তথাপি তিনি হোতা একটি বিশেষ ‘mass’-এর। কেননা তাঁর এক প্রিয়জন ছিলেন ঈশ্বরে বিশ্বাসী। অন্তিমে এই নাস্তিক চরিত্রটি যা উচ্চারণ করেন তা এই : Great God, if there is a sphere which Thou hast appointed after death for those who have been perfect, remember good Bourgeat; and if he should have anything to suffer, let me suffer it for him, that he may enter all the sooner into what is called Paradise.
কথাগুলি মনে হল, কেননা আলোক সরকারের শিল্পের অন্তর্গত বিশ্বাসের যে- কেন্দ্রস্থল, তার সাপেক্ষে আলোক সরকারের অবস্থানটি এদের কার সাথে তুলনীয়, তা এতাবৎ আমার বিচার্য।
কথায় কথায় অনেক দূর সরে এসেছি। ফিরে যাই তাঁর ‘শিল্পীর আক্ষেপ’-এ। পুনরায়।
তুমি আমার বিশাল অনুভুতি
তোমার জন্যে আমি নতুন ভাষার প্রত্যাশী।
............ ............ ............
কিন্তু ভালবাসার দাবি একি প্রতিশ্রুতি
শিল্পী তার আপাতগৌরবের কাছে চায়!
নতুন অভিভাবে দেখো আমার গান ওঠেনা উচ্ছ্বাসি’
এখন তার পরিশ্রমী সাধনা আয়োজন।
............ ............ ............
তোমার ভালবাসা আমি গ্রহণ করার অসামর্থ্যে
গ্রহণ করি অন্য ম্লান ব্যাখ্যা এনে।
কিন্তু আবার বিশাল অনুভুতি।

            কিন্তু কবিতাটির একেবারে শেষে এসে কবি আবার তাঁর প্রত্যয়ের বিশ্বস্ততায় আমাদেরও করে তোলেন যেন প্রায় সমান প্রজ্ঞাবান :
অন্ধকারে আকাংক্ষিত সিঁড়ির সন্ধান
হিরণ্ময় দুয়ার খোলো, চাবি।
‘ কিন্তু আমি ব্যবহৃত ছন্দে জেনো তোমার সন্মান
চাইনি। আরো অনাশ্রয়ী অন্ধকারে জ্বলি।
প্রত্যাশার দু-বাহু বাঁকা আকাশ করে দাবি
যোগ্যতায়, সপ্রতিষ্ঠ মাটির পরিচয়ে :
হিরণ্ময় দুয়ার, তোমার দুয়ার খুঁজে পাবো
নতুন অভিভাবে যখন আমার গান উঠবে উচ্ছলি’

            ‘আলোকিত সমন্বয়’-এর আলোচনা শেষ করবার আগে লিখে রাখি আরেকটি প্রমাণের কথা ... লিখে রাখি এখানেই আলোক ‘বর্ণ’ বিষয়ে তাঁর ধারণার প্রথম সূত্রটি রেখে গিয়েছেন... রেখে গিয়েছেন এইভাবে :

বাসনা এক প্রবণতা। এবং হৃদয়ের
মৌল স্রোত অপর দিকে যায়। (শ্রাবণ)
এর সঙ্গে কী সরাসরি মিলে যায় না তাঁর এই উক্তির, যা আগেও আমি উদ্ধৃত করেছি, ভাবার্থ : সব কিছুই মূলত বর্ণময় , তবু আসক্তিই বর্ণের প্রকৃতি নির্দ্দিষ্ট করে ...

এর পরের গ্রন্থ ‘অন্ধকারের উৎসব’। এবার আমরা তার দিকে এগিয়ে যাব। ক্রমে।
১১/১০/২০১০


৫.
ন্ধকারের উৎসব’-এর ধ্রুবপদটি, আমার মনে হয় -
‘ ... ... আমি আজ যাবো পাহাড়তলীর
নিরুদ্দেশ গ্রামের ভিতরে। (অমূর্ত বিস্ময়)
          এবার নিজের নূতন পৃথিবীকে দেখে নিতে,চিনে নিতে। এবার তাঁর পথে আসে, একে একে,‘নদী’,‘তেপান্তর’,‘বকুলতলা’, ‘বিদেশীমাঠ’, ’অশথগাছ’, ‘ফণিমনসার ফুল’ ... এইগুলি তিনি দেখেন, না কি পুনরায় নির্মাণ ক’রে নেন নিজের মতো করে,নিজের জন্য? নামগুলি পরপর দেখে গেলে মনে হয় এ যেন সত্যিই এক ভ্রমণ কাহিনী ... তাঁর সামনে কেউ যেন ক্রমে উন্মোচিত করে দিচ্ছে একটি যাত্রার পথ, আর তার কিনারের সমূহ দৃশ্যাবলী...
অরব আলোর দেশ হাওয়ার সংহতি ধ্বনি সম্পূর্ণ পৃথিবী
উন্মোচিত আবির্ভাবে বিস্ময়ের নিবিষ্ট স্বাক্ষর। ( নদী )

ময়ূরপংখির নায়ে আমি সেই তরঙ্গের একাকী নাবিক
চিরদিন আরো দূরে চলে যাবো। আমি ঘুমিয়ে পড়বো না। (রূপকাহিনী)

             যেন একটিই কবিতা লেখা হয় গোটা বইটা জুড়ে। যেন একটি অভিযানকাহিনী ... আর এই অভিযানকাহিনীর তলে তলেই দানা বাঁধেন আলোক। ‘অন্ধকারের উৎসব’-এ-ই আমরা প্রথম লক্ষ ক’রি তাঁর শব্দবন্ধ সৃষ্টির প্রবণতা, যে-প্রবণতা কমলকুমারীয় নয় এই কারণে, যে, যে-শব্দগুলির নিকটবর্তীতায় আলোকের শব্দবন্ধগুলির দেহধারন, সেইগুলি চলিত শব্দ। কিন্তু নির্যাসের প্রশ্নে উভয়ের প্রবণতা একই দিকে। নিজভাব প্রকাশের মারাত্মক প্রয়োজনে ভাষার গতিপথকে নিয়ন্ত্রিত করার প্রচেষ্টার স্পর্ধা। কিন্তু এখানে যে প্রশ্নটি কমলকুমারকে নিয়েও ওঠে, তা’ই ওঠে আলোককে নিয়েও। কখনও অনুভব হয়, যে, ভাবপ্রকাশের নিমিত্ত ভাষাকে ব্যবহার না ক’রে ভাষার প্রয়োজনে ভাব কে এঁটে দেওয়া হয়েছে যেন। হ্যাঁ, কখনও কখনও। সর্বত্র নয়। কদাপি। এই কথা আজ প্রমাণের তর্কের অপেক্ষা রাখে না, যে, ভাষাকে ঐভাবে ব্যবহার না ক’রে সম্ভব ছিল না ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। কিন্তু ‘সুহাসিনীর পমেটম’? আলোকেও, তাঁর লেখার অনেকটা সময় জুড়ে, আমার মনে হয়েছে একই কথা। কোনও কোনও সময়ে যেন ভাষার টানেই ভেসে গিয়েছেন তিনি ...
         আমি কিছু উদাহরণ রাখছি, আপাতত শুধু‘অন্ধকারের উৎসব’ থেকেই। যেহেতু এখানে তাঁর শব্দবন্ধ সৃষ্টির প্রবণতার প্রাথমিক স্বাক্ষরগুলি আছে শুধু, তাই উদাহরণগুলি তর্কাতীত না-ও হতে পারে। তবে, ক্রমে, যথাস্থানে আরও উদাহরণ পাওয়া যাবে।

মুহূর্ত নিবেছে ধূপ স্বাগত সৌরভ। রক্তিম মমতা
নাকি তুমি রজনীগন্ধার আলো তার মূর্ত সমাহিত কাছে।
...... ... ... ...... ... ... ...... ... ... ...
ভালোবাসার ধ্বনি আজো চারিদিকে। আন্তরিক তাকে মগ্ন শোনো।
...... ... ... ...... ... ... ...... ... ... ...
হাওয়া যেন উপহাস, আবর্তিত সঙ্গত নিরালা। (সঙ্গত নিরালা)

ওদিকে হাওয়ার জানলা অভিমানী। ফিরে গিয়ে নিবিড় হারাবো। (হাওয়ার জানলা)

তুমি নিজে ছুটে আসো, আমার আশ্চর্য্য – তুমি আগে কাছে এলে। (সচ্ছল সোপান)

         এই গ্রন্থের অনেকগুলি কবিতাই আমার প্রিয়। তাই তালিকা দেওয়ার মানে হয় না। শুধু আর একটি কবিতার কথা বলেই শেষ করব ‘অন্ধকারের উৎসব’ প্রসঙ্গ, কেননা এই কবিতা,‘রোমাঞ্চিত নদী’তে, আমার মনে হয়েছে আলোক আর একবার বলেছেন তাঁর নিজস্ব শিল্পসংজ্ঞার সূত্রগুলি।
‘ প্রজাপতি, আমি ঘৃণা করি তোমাদের। ... ...
ভাঙ্গা ডালে কী ক’রে যে বসো!’
          প্রজাপতির সঙ্গে এই পর্বের আলোকের প্রথম মিল বোধ করি এই, যে, উভয়েরই ছিল আরেকটি পূর্ব চেহারা। সেই অবয়বকে অতিক্রম করে আলোক আজ তাঁর নূতন পৃথিবীর সম্রাট। প্রজাপতিও। তথাপি প্রজাপতি,নিজে সুন্দর হয়েও,দ্বিধা করে না ‘ভাঙ্গা ডালে’বসতে।‘ভাঙ্গা ডাল’ প্রকৃতির বাস্তব। প্রজাপতিও। তাই এমন ঘটে। কিন্তু আলোক তাকে সমর্থন করেন না এই কারণে, যে, তিনি ‘ভাঙ্গা ডাল’কে সরিয়ে দিয়ে গড়ে নিতে চান আপনার শিল্পিত শাখা। পর মুহূর্তেই বলেন আলোক :
‘ কী করে বিবর্ণ ডালে একটি ফুলের ঘৃণ্য কৃপণতা মানো?
ভালোবাসো শীতের বাগান!’
         এখানেও সেই অস্বীকার। পাঠক,মনে পড়ে ‘তা আমি নেবোবা কেন যা আমার নয়’ ? যা যেমনটি আছে সে তো তোমার। আমি যদি নিই নেব তাকে শিল্পিত ক’রে। আমার ক’রে।
         এই পর্বে আমার মনে পড়ে Baudelaire, যিনি কোনওভাবে প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে মেনে নিতে পারেননি। Baudelaire চেয়েছিলেন সমস্ত প্যারিস হোক সোনায় মোড়া। কিন্তু সেই ‘চাওয়া’র গহনের স্নায়ুরোগ আলোকের নেই। তাই প্রজাপতির জন্য আর এক স্বাভাবিক উপায় নির্দেশ করেই আরম্ভ হয় কবিতাটি :
‘সমান মাপের গাছ কোনোদিন দেখিনি। অথচ
কত গাছ দেখলুম’।
       অর্থাৎ ‘ভাঙ্গাডাল’,‘বিবর্ণ ডালে একটি ফুল’, এ সমস্ত কৃপণতার পক্ষান্তরে সে অপর বৃক্ষ, অপর শাখাকে পারে নির্বাচন করে নিতে। আর তাই তার উচিত। কেননা দুটো গাছ যেহেতু সমান হয় না কদাপি, অতএব এই গাছের, এই শাখার রিক্ততা, সে অন্যত্র পাবে না। এই শীতের বাগান ছেড়ে সে উড়ে যাক সেই গোলার্ধে, যেখানে এখন বসন্ত অথবা – অথবা সে তাঁর মতো চলে যেতে পারে ‘কল্পনার স্বরচিত নিশীথযাত্রা প্রান্তর’এ :
‘ কল্পিত বসন্ত চোখে রাত্রিদিন , নিহত উদ্যম যত নিপুণ সাজানো
আমার বিশ্বাস। ... ... ... ... ...... ... ... ... ... ......
জ্বলেওঠে রোমাঞ্চিত নদী
বিচ্ছিন্ন দুঃখের তবু বিস্তৃত গতির – এটুকুই আমার সন্মান’ ।

        কখনও মনে হয়, তবে কি এই ধারণারই বশবর্তী হয়ে আলোক নিবিষ্ট হয়েছিলেন শব্দবন্ধ সৃষ্টির ‘অন্ধকার উৎসব’এ’ও?
আচ্ছা ‘অন্ধকার উৎসব’, এই নামটিকে যদি এভাবে ব্যাখ্যা করি, যে, এ সেই মাতৃগর্ভের অন্ধকারের ইঙ্গিত, যেখানে এখনও জন্ম-প্রস্তুতিরত ‘অমূলসম্ভব রাত্রি’ বা ‘নিশীথবৃক্ষ’ এর আলোক সরকার?
১৪/১০/২০১০


৬.
         ‘বিশুদ্ধ অরণ্যে’ এসেছেন আলোক সরকার। তাঁকে অনুসরণ করতে করতে সেই অরণ্যে ঢুকে পড়বার আগে চকিতে একটি প্রশ্ন এসে হানা দিয়ে যায়। মনে হয়, কী সেই বিশুদ্ধ অরণ্য? সে কি তাঁর সদ্যনির্মীত নিজস্ব ভাষা-ভূগোলের আরণ্যক, না কি আর কিছু? চেতনায় চালচিত্রের মতো এই প্রশ্নটিকে রেখে দিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকি। টের পাই তাঁর ভাষাভূগোল এবার একটি ষ্পষ্ট রূপ পরিগ্রহের প্রক্রিয়ার প্রায় রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছে। ভাষাদেবীর সঙ্গে এবার তাঁর প্রকৃত দ্বৈরথ। মনে পড়ে‘অন্ধকার উৎসব’-এর সেই প্রতিজ্ঞা :
‘বিপক্ষে ঈশ্বর তবু কিছুতেই হার মানবো না’। (রাজপুত্র)
হয়তো তাই ভাষাদেবীর, ভাষাপাঠকের তোয়াক্কা না করেই এবার তিনি লিখে ফেলতে পারেন :
‘ ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... স্থবির নির্বোধ কোলাহল
অবিচ্ছিন্ন উদ্ধত বাগানে আর নিয়ম নিরুদ্ধ প্রীতস্বরে
গন্ধরাজ কেবল নিপুণ বিন্যাসের, বেলফুল বিনত শুভ্রতা’। (জাগ্রত জ্যোৎস্নায়)
         বাক্যের এই গঠন যেন আর ভাষার ‘নিয়ম নিরুদ্ধ’ স্বরে কথা বলে প্রীত নয়। এইবার বিন্যাসের নৈপুণ্যে তাকে পার হয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই ...
         এখানে এসে বলে নিতে বাধ্য হই, যে, আলোকের এই বিন্যাসনৈপুণ্যের বিজ্ঞাপিত পথে,পরে,হেঁটে যেতে চেয়ে হোঁচট খেয়েছেন, এমন কি, অনেক প্রকৃত কবিও। সেই হোঁচটের আঘাত যে আজও কাটেনি বাংলা কবিতা থেকে, তার উদাহরণ দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। তথাপি এও সত্য,যে, উপরে উদ্ধৃত পংক্তিগুলির মতো পংক্তি,যেখানে form আর content মিলেমিশে গিয়েছে অবলীল একাকারে, তেমনটিও আর পেয়েছে কি বাংলা কবিতা?
একই গ্রন্থে এমন আরও প্রায়-অসম্ভব উচ্চারণের চিহ্ন রয়ে গিয়েছে ...

‘বিকেলবেলায় খুব ঝড় হয়েছিল, তাপসী অশথগাছ তোমার নির্ভয়
তখন আমার রক্তে। ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...’ (স্বাভাবিক)

‘... ... ... ... ... ... তোমরা এসে দেখে যাও
দশটি পাপড়ি গাঢ় নির্নিমেষ একাগ্র জেগেছে। (রাজকন্যা)

নৌকো চলেছে দূর নিরুদ্দেশে জলধ্বনি বিস্তীর্ণ বিরাম –
দু-হাতে জানালা খুলে বিদ্যুতি আকাশে দেখো আলুলিত শ্রাবণ সহসা। (জলধ্বনি)

এদেরই পাশাপাশি, দেখি, এই পর্বেও, স্বাভাবিক নিয়মেই ছায়া ফেলে ভাষাভূগোলে নির্মাণের মারাত্মক কবন্ধগুলিও :

সারাদিন অসহ্য রাত্রির অন্ধ কুটিল বাদামী। (শাণিত বিষাদ)

আমি দাঁড়ালেই স্তব্ধ অন্ধ উপনীত। (ভূত)

           এবার চেতনায় চালচিত্রের মতো যে-প্রশ্নটিকে রেখে দিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করেছিলাম এই গ্রন্থের, আরেকবার সেখানেই ফিরি। উত্তর খুঁজি সেই প্রশ্নের : ‘কী সেই বিশুদ্ধ অরণ্য?’ ... প্রথমে শুনি তাঁর নিজের কথাতেই ... শুনি ‘বিশুদ্ধ অরণ্য’ নামের নামকবিতায় তিনি কি সংজ্ঞা দিয়েছেন এর :
‘দুইপাশে সবুজ ঘাসের স্বাভাবিক। কোনো পদচিহ্ন নেই’।

          এই ঘাস, এই বৃক্ষ, অবশেষে এই অরণ্য স্বাভাবিক, কেননা কোনও পদচিহ্ন নেই। কোনও পদচিহ্ন নেই – অর্থাৎ এই পথে হেঁটে যায়নি কেউ, এতাবৎ। অতএব ভাষার এই ‘কুমারী’ অরণ্যই তাঁর বিশুদ্ধ চরাচর। ব্যবহৃত আঙ্গিক ছেড়ে এই বিশুদ্ধ অরণ্য নির্মাণ করা ছাড়াও গতি নেই তাঁর। কেননা এই পর্বেই তাঁর অনুভব :
‘সব সৎ চেতনাই ব্যর্থ হবে মনোনিবেশের পরিশ্রমে’ (স্বাভাবিক)
          এখানে এসে তাঁর এই ঘোষণা তাঁকে আরও অন্য পথে নিয়ে যায় অমিয় চক্রবর্তীর থেকে। শুধু অমিয় কেন, জীবনানন্দ, এমন কি রবীন্দ্রনাথের চেয়েও। কেননা তাঁরা প্রত্যেকেই রচনা করে গিয়েছেন এই বিশ্বাস নিয়ে,যে,সব সৎ চেতনাই একমাত্র প্রকাশিত হতে পারে মনোনিবেশের পরিশ্রমে ... আলোকের এই উচ্চারণ বরং পরবর্তী ইউরোপীয় ‘শব্দই কবিতা’ এই ধারনার সমান্তরাল একটি ঘোষণা এবং আলোক পরেও হেঁটে গিয়েছেন, স্বচ্ছন্দে, ঐ পথেই। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন অন্যেরা,এই পথে হাঁটতে গিয়ে, কেননা, ঐ পথে হাঁটতে গেলে যতদূর প্রতিভার প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয়, যতদূর, নিজ ‘ট্র্যাডিশন’-এর সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও সচেতনতার, তা ছিলোনা তাঁর অনুগামীদের ... ফলে নিজ নিজ ভাষাভূগোল সৃষ্টির অনর্থক দায়িত্ব নিয়ে, এমন কি, অলোকরঞ্জনের মতো কবিও যা করলেন তাকে বলাচলে ‘শব্দমেধ’...
              এই গ্রন্থেও, মনে হয়, আলোক সংস্থিত নন সেই চিন্তায়, যে, এই ভাষাশরীর অন্তিমে শোনাবে কী গল্প, কোন গল্প। তথাপি তাঁর ধ্রুবপদগুলিকে এখানেও শনাক্ত করা যায়। এখানে তিনি নিরাসক্ত ভাষাপথিক, আর সেই নিরাসক্তির শিক্ষা, এখান থেকেই হয়ে উঠতে থাকে তাঁর দর্শন ...
‘চিরদিন আজ্ঞাবহ থেকে যাবো। বৈশাখ দুপুরে একা
তোমার গোপন চিঠি হাতে নিয়ে খররৌদ্রে যাবো
তোমার প্রেমিক তার বাড়ি। ... ... ... ... ... (প্রকৃতি)
         কী মারাত্মক প্রকাশ নিরাসক্তির! মনে পড়ে দস্তয়ভস্কির ‘ব্রাদার্স্‌ কাররামাজোভে’র এলয়েশা-কে, যে ভ্রাতাদের প্রতি কর্তব্যের টানে সেই মেয়েটিকে সমূলে উপেক্ষা করেছিল যে তাকে ভালবাসে... উপেক্ষা করেছিল, কারণ সে জানত ভালবাসা স্বার্থপর। ঐ ডাকে সাড়া দিলে মানা হবে না নিজগুরু ‘ফাদার জোসিমা’র আদেশ। সাড়া দেওয়া হবে না তার ভ্রাতাদের প্রয়োজনের ডাকে... কিন্তু ঠিক কীসের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে আলোকের এই নিরাসক্তি? সমগ্র আলোক পাঠ ক’রে আমার যে-কথাটি মনে হয়েছে তাই দিয়েই আরম্ভ করেছিলাম এই লেখাটা। বলেছিলাম, দেশগ্রামে আমাদের বাড়ির পিছনে বয়ে যায় একটি ছোট নদী। নদীও নয়। খাল। খাল যেখানে গিয়ে মিশেছে নদীতে, সেখানে বাজার। সেখান থেকে এক বিকালে এক খেয়া নৌকা ভাড়া ক’রে ভাসতে ভাসতে চলে এসেছিলাম আমাদের বাড়িরই পিছন দিকটাতে। দেখতে পাচ্ছি সেই অর্জুন গাছগুলি। কলতলা। বাঁশঝাড়। পিছনের বারান্দা। দিদিভাইয়ের কোঠা। তবু যেন কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে অন্যরকম। আরেকবার রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম একটি মানুষ হেঁটে চলেছেন আমার খানিকটা আগে আগে। চেনা চেনা ঠেকছে। তবু পারছি না চিনতে। বেশ খানিকক্ষণ পরে বুঝলাম, একটু দূরত্বে, আমার আগে আগে গম্যমান ঐ মানুষটি আমার বাবা! দ্বিতীয় ঘটনাটিতে এমনই আক্রান্ত হয়েছিল চেতনা, যে একটি গল্পও লিখে ফেলেছিলাম ঐ নিয়ে।
          একটু দূরের থেকে দেখলে, প্রকৃতপ্রস্তাবে, চেনা জিনিসেই, জানা মানুষেই পাওয়া যায় এক অপরিচয়ের ইঙ্গিত, যে-ইঙ্গিত প্রতিদিনের মানুষটিকে, বস্তুটিকে,পার হয়ে চলে যায় যেন প্রায় আবহমানেরই দিকে। ‘নিকটের থেকে দেখা’ বলতে আমি বলতে চাই, যে-দেখায় মিশে থাকে আশা, আসক্তি,হতাশা,হাহাকার,অভিমান। ঐ ঘটনাগুলির অনেকদিন পরে একটি ছবি দেখেছিলাম। Ettore Scola’র ‘A Special Day’। সেখানে নায়ক Gabriele এক প্রতিবেশীনির বাড়ি থেকে তার নিজের বাড়িটিকে দেখে চিনতে পারেনি!
         কথাগুলি মনে এল, আলোক সরকারের কবিতার প্রেক্ষিতে। কেননা আমার অনুভবে আলোক সরকারের রচনার একটি মৌল অন্তর্বস্তু ঐ ‘দূরের থেকে দেখা’... ঐ দেখা নিয়ত নিবিষ্ট ‘সামগ্রিক’-এর অনুধাবনে...ঐ ‘দূরের থেকে দেখা’ আর দেখানোই আলোক সরকারের কবিতার নিয়ম ও নিয়তি। যেমন নন্দলাল বসুর ছবিগুলি ...
         ঐ দূরের থেকে দেখাতেই তাঁর ভারতীয়ত্ব। বাঙালীয়ানা। দেবী দুর্গা যেমন নিরাসক্ত চোখে তাঁর শেলটি মহিষাসুরের বুকে বিঁধিয়ে দিয়ে চেয়ে থাকেন দূরের দিকে, তেমনই এক নিরাসক্ত কর্মের কথা শোনা যায় গীতায়। তাকেই বঙ্কিম বলেন ‘চিত্তশুদ্ধি’ ... আর আলোক বাংলা কবিতাতে এনে দেন, পুনরায়, সেই নিরাসক্তির স্পর্ধা, প্রতিভা। যার বলে বলীয়ান হয়েই তিনি, কোনও আবেগের চিহ্ন ছাড়াই, বলতে সক্ষম হন, নিজ প্রেমাস্পদাকে :
বৈশাখ দুপুরে একা
তোমার গোপন চিঠি হাতে নিয়ে খররৌদ্রে যাবো
তোমার প্রেমিক তার বাড়ি’।
এর অর্থ কি তাঁর প্রেম নেই? কাম নেই? আদপেই তা নয়। প্রকৃতপ্রস্তাবে এই শিক্ষাই তিনি পেয়েছেন ‘প্রকৃতি’র কাছে তাই তাঁর প্রকৃতি :
‘ ... ... ... ... । নিরাসক্ত জাগ্রত প্রকৃতি’
          এখানে ‘জাগ্রত’ শব্দটি লক্ষণীয়। ঐ শব্দটিই বলে, যে, তাঁরও প্রেম আছে, কাম আছে। ঠিক। তবে রয়ে গিয়েছে কোনও গুরুতর দায়িত্বও ... যে-দায়িত্ব পালনের কারণেই তিনি আজ্ঞাবহ। যে-দায়িত্ব পালনের কারণেই তিনি শক্তি বা সুনীলের মতো অশালীন নারীশরীরের বর্ণন লিখে তারপর থলি হাতে বাজারে গিয়ে হেঁকে উঠতে পারলেন না : ও ভাই মাছওয়ালা, আমি কবি...আমাকে একটু ভালো দেখে মাছ দিয়ো ভাই...একটু শস্তায়... ঠিক যেমনটি করলেন, অব্যবহিত পরেই জয় গোস্বামী আর রণজিত দাশেরা... পক্ষান্তরে শিল্পসৃষ্টির, স্রষ্টার যে-সংজ্ঞা ঐ ‘প্রকৃতি’ কবিতাতেই লিখে রাখলেন, আলোক তা এই :
কোনো অভিমান নয়, অশ্রুজল, নিশ্চেতন প্রবাহিত রীতি
নতুন বৃক্ষের ধারাবাহিকতা উন্মীলন অপর জ্যোৎস্নায়।
অথবা
কেবল একটি ধ্যান একটি নিঃশেষ। (বৃক্ষ)
এই পংক্তি পাঠ ক’রে মনে হয় যেন ‘বৃক্ষ’কে প্রথম জানলাম...যেন এত দিন ‘গাছ’ই দেখে গেছি শুধু...
আলোকের কবিতাবিশ্বে ‘বিশুদ্ধ অরণ্য’র আরেকটি বিশেষ ভূমিকা মনে হয় এই, যে,এই পর্ব থেকেই তাঁর মৃত্যুচেতনার নিজস্ব উন্মেষ ঘটে যায় :
খেলার মাঠের ঠিক পুবদিকে একদিন দরজা খুলে যাবে,
কাশবন লজ্জিত দু-হাত মেলে
বলবে এসো-এসো। আমি এক দৌড়ে যাবো, বিকেল হবার আগে
লাল রঙ আলোর ভিতরে ঝলমল ক’রে উঠবে সেই বটগাছ –
লুকোনো তলোয়ার বের ক’রে নেবো একেবারে আলো না জ্বেলেই।
...... ...... ...... ...... ...... ...... ...... ...... ......

দুটি অন্ধকার মেঘ জানলার আকাশে নিঝুম – মনে হয় সেই বটগাছ।
গভীর কোটরে আছে সোনার মুকুট আমার হীরার জামা
একদিন অনায়াসে চলে যাবো। এইবার বুঝি বৃষ্টি এলো। (বটগাছ)

এখানে এসে আমার মনে পড়ে দক্ষিণারঞ্জন, মনে পড়ে অবন ঠাকুর ... পাঠক, আপনারও মনে পড়ে না কি?

২২/১০/২০১০

৭.
         আলোক সরকার এমনই একজন কবি যাঁর প্রায় প্রতিটি কবিতা, তাদের অন্তর্গত প্রতিটি শব্দের চয়ন এবং বিন্যাস দাবি করে মনন, চিন্তন, আলোচন। প্রায় সেই ভাবেই আমরাও এতক্ষণ হেঁটেছি তাঁর সঙ্গে। এ যেন তাঁর আহ্নিকগতির নিয়মটির আবর্তকে আপন অনুভূতির মর্মে স্থাপিত করার প্রয়াস। এখন, ক্রমে, আমরা উন্মোচিত করার চেষ্টা নেব তাঁর বার্ষিকগতির আবর্তায়নের রহস্যকে। কেননা এতদ্‌ভিন্ন তাঁর,শুধু তাঁরই কেন, যেকোনও কবির – যিনি বিরাট, ব্যাপ্ত – অভিযানকে, সেই অভিযানের অভিকেন্দ্র -অপকেন্দ্রকে, যায় না মর্মাধীত করা। যেসকল কবিকে আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজন পড়ে না এই বার্ষিকগতির নিয়মের ইঙ্গিতকে অনুধাবনের, তাদেরই হয়তো এলিয়ট বলেছেন ‘anthology poets’।
             এতক্ষণে আমরা ইঙ্গিত পেয়েছি তাঁর ধ্রুবপদটির, তাঁর নিজস্ব ভাষা-ভূগোলের নির্মাণ প্রচেষ্টার। আভাস পেয়েছি তাঁর অন্তর্গত ট্র্যাডিশনের, তাঁর মৃত্যুচেতনার। লক্ষ করেছি তাঁর গল্প-কথনেচ্ছার। এই সকল ইঙ্গিতগুলিই হবে আমাদের এই যাত্রার কম্পাস, সূর্য্ঘড়ি, জ্যামিতির সরঞ্জাম। ‘উতল নির্জন’ থেকে ‘আলস্যরঞ্জিতা’ হবে আমাদের ম্যাপ। কেননা এই মুহূর্তে ‘আলস্যরঞ্জিতা’ই তাঁর শেষ গ্রন্থ, কবিতার, যেটি রয়েছে আমার সংগ্রহে। যেহেতু চলেছি তাঁর বার্ষিকগতির সূত্রের ইঙ্গিত উন্মোচনে, তাই এক্ষণে বলব তাঁর ‘উতল নির্জন’ থেকে ‘আলস্যরঞ্জিতা’ অবধি যাত্রার অন্তমে আমার অভিজ্ঞতার কথা। পক্ষান্তরে, আগে যা বলেছি তা ছিল তাঁর একটি পর্যায় থেকে অপর পর্যায়ে গমনের দিনলিপি।
          ‘উতল নির্জন’ থেকে ‘আলস্যরঞ্জিতা’র যাত্রাপথে আলোক সর্বাধিক আলোড়িত, আন্দোলিত হয়েছেন যে-চিন্তায়, যে-চিন্তায় পাঠককেও তিনি ডেকে নিতে চেয়েছেন সর্বাধিক, তা বোধ করি ভাষা-ভূগোলের নির্মাণের প্রক্রিয়াটির। তার নানান পর্যায়ের। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই চলে এসেছে দুইটি বিষয়। এক : ভাষার ক্ষমতা-অক্ষমতা। দুই : নির্মাণপ্রক্রিয়ার রহস্যের নিজস্ব উন্মোচনের অভিজ্ঞতার কথা। এতদ্‌ভিন্ন, যেহেতু তাঁর কাছে বলার ভঙ্গি আর বলার কথার সামঞ্জস্য ও একটি নিবিড় ভাবনার এবং নির্মাণের বিষয়, অতএব এদেরই সঙ্গে, ক্রমে বিস্তৃত হয়েছে তাঁর নিজস্ব দর্শনের ঢেউ, জলতরঙ্গ।
বিশুদ্ধ অরণ্য’ অবধি গমনের পরেও আলোকের মনে হয় :
‘ উচ্চারণ সাধ্য নয় সব কিছু। সাধারণ ভাবনায়
অবশ্য যে-কোনো শব্দ উচ্চারণ করা যায়। যেমন ঈশ্বর
যেমন আকাশ কিংবা ভালবাসা এইসব শব্দগুলি
কত সহজের উচ্চারণ। কিন্তু রাত্রির একায়
কোন আবির্ভাব আসে অনিবার্য । কোন অসম্ভব সরোবর
চারিদিকে স্ফুরিত বিশ্রামে জাগে – পরিচিত শব্দগুলি
মনে হয় অলৌকিক প্রাসাদের বড়ো-বড়ো থামের দরজার’। (অসম্ভব সরোবর, স্তব্ধলোক)

          এখানে এসে আমার মনে পড়ে যায় আর এক কবিকে যিনি লিখেছিলেন :
‘……. ………….. …………….. ……………. what’s said is not said, the
Unsaid is unsayable,’ ( The River, Octavio Paz, Early Poems 1935 – 1955)
এই উচ্চারণের ভূমিকা হিসাবেই যেন, এই স্তবকটি আরম্ভ হয় এভাবে :
In mid-poem a great helplessness overtakes me, everything
abandons me,
there is no one beside me ……… ……… ……… ……… ………
……… ……… ……… ……… ………the pen mutinies,
there is neither beginning nor end nor even a wall to leap,
the poem is a deserted esplanade, ……… ……… ……… ……’
          যদিও ‘সার্বিক’ অর্থে এই দুই কবি সম্পূর্ণ দুই বিপরীত মেরুর তথাপি উদ্ধৃত পংক্তিগুলির সাপেক্ষে উভয় কবির উক্তির মর্মগত যে-সাধারণ দার্শনিক অনুভূতি তা যেমন নিকট, তেমনই নিকটবর্তী তাদের ‘ভাষা’ বিষয়ে অভিমত। তবে আলোকের ক্ষেত্রে ‘ভাষা’ থেকেও, বোধ হয় বলা উচিত, ‘শব্দ’ এই ‘প্রতীক’টির সীমাবদ্ধতা । ‘ভাষা’ বলছি না এই কারণে,যে, ভাষায় শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয় ক্রিয়াপদ। কিন্তু ক্রিয়াপদকে তাঁর কবিতায় আলোক ইতিমধ্যেই দিয়ে ফেলেছেন বা দিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন এক গৌণ অবস্থান। পূর্বজ যে কোনও কবির যে কোনও রচনার সঙ্গে আলোকের যে কোনও রচনাকে পাশাপাশি রাখলেই এই সত্য প্রমাণিত হয় সহজে। উদাহরণ হিসাবে একটি বহুপঠিত কবিতা, যা আমার একটি অতি প্রিয় কবিতাও বটে, তারই একটি অংশ দিচ্ছি তুলে :
একদা এমনই বাদলশেষের রাতে—
মনে হয় যেন শত জনমের আগে—
সে এসে সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে ;
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে ;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে ।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী ;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি ;
একটি পণের অমিত প্রগল্ভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ দিল অবারিত ক’রে ||

             সুধীন্দ্রনাথের ‘শাশ্বতী’র এই অংশে(বা যেকোনও কবিতার যেকোনও অংশে) ব্যবহৃত ‘ক্রিয়া’পদের সংখ্যার সঙ্গে যদি তুলনা চালানো যায় আলোকের ‘অসম্ভব সরোবর’এর উদ্ধৃত অংশের, বা এইসকল পংক্তিগুলির, তাহলেই পাওয়া যায় আমার বক্তব্যের যুক্তি।

‘ ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... স্থবির নির্বোধ কোলাহল
অবিচ্ছিন্ন উদ্ধত বাগানে আর নিয়ম নিরুদ্ধ প্রীতস্বরে
গন্ধরাজ কেবল নিপুণ বিন্যাসের, বেলফুল বিনত শুভ্রতা’। (জাগ্রত জ্যোৎস্নায়)

‘ কল্পিত বসন্ত চোখে রাত্রিদিন , নিহত উদ্যম যত নিপুণ সাজানো
আমার বিশ্বাস। ... ... ... ... ...... ... ... ... ... ......
জ্বলেওঠে রোমাঞ্চিত নদী
বিচ্ছিন্ন দুঃখের তবু বিস্তৃত গতির – এটুকুই আমার সন্মান’ ।

            অর্থাৎ আমি বলতে চাই যে, narration এর এক নিজস্ব কাঠামো প্রায় গড়ে নেওয়ার পরেও, আলোক চিন্তিত তারও গহন ব্যর্থতার বিষয়ে। শব্দের সীমাবদ্ধতার এই কথাটি নানা কবি নানা সময়ে বলেছেন নানা প্রসঙ্গে। কিন্তু নিজ প্রয়োজনে ভাষাকে পুনর্নির্মাণের দিকে সঠিক পা ফেলতে পেরেছেন কতজন? এমনকি কমলকুমারও। যদিও কমলকুমারীয় ভাষাভঙ্গি পরবর্তী সময়ে ভাষার গতিপথে কেটে দিয়েছে আর এক খাল, যে-খাল, ক্রমে, এখন নদী ...
             আলোকের গমনেরও পদছাপ, বাংলার ভাষা-পৃথিবীকে দেখাতে সক্ষম হয়েছে আর এক দিগন্তরেখা ... তবে ঐ দিগন্তের দিকে সদলে কোনও গমন হয়তো সম্ভব নয়। মনে হয় এও অনুভব করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই হয়তো লিখতেও সক্ষম হয়েছিলেন :
‘ সর্বজনীন কোনো ভাষা নেই। এমনকি মাতৃভাষা
প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে স্বতন্ত্র বিশেষ’। ( সহজ বিকেল বেলা, স্তব্ধলোক)
             যদিও ‘স্তব্ধলোক’ গ্রন্থেরই কবিতা, তথাপি ‘অসম্ভব সরোবর’ থেকে ‘সহজ বিকেল বেলা’য় যুক্ত হয় আরও একটি মাত্রা। তাঁর নিজস্ব জীবনদর্শনের পথে এক সহজ আলো ফেলে এই কবিতা। যদিও পরের পংক্তিতেই ফিরে আসবে ভাষার অনুষঙ্গ, তথাপি এই উক্তিগুলির একটি সাধারণ আবেদনও রয়ে যায় না কি :
‘যেখানেই মিলিত আনন্দ দেখি সেখানেই রুগ্ন অক্ষমতা
স্পষ্ট হয়’।
           জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত ‘কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়’ বা বুদ্ধদেবের ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত’ উচ্চারণের অন্তর্গত দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোকের এই পংক্তিগুলিকে তাদেরই সমগোত্রীয় বললে কি ভুল হবে? জীবনানন্দ বা বুদ্ধদেবের উচ্চারণগুলি অন্তত আমাকে কোনও সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় না এই কারণে, যে, তাঁরা উভয়েই, প্রায় ঘোষিতভাবে পাশ্চাত্যের আধুনিকতাকেই সর্ব-রোগ-হরা বলে ধরে নিয়েছিলেন। ফলত তাঁদের কাছে যে ‘মিলিত আনন্দ’ বলে কিছু থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আলোক, যিনি ভারতের,বাংলার ‘ট্রেডিশন’কে প্রকৃতার্থেই করেছেন অনুধাবন এবং অনুসরণ, তাঁর লেখনীর এই কী ঘোষণা? মনে হয় এই ঘোষণা সেসকল ধারণার ফসল হওয়া সম্ভব, সেই সকল ধারনারই নিমিত্ত আলোক অদ্যাবধি ‘কবিদের কবি’ ... বা বলা উচিত ‘কেবল মাত্র প্রবল মনন ও তারও চেয়ে বেশি মেধার চর্চাকারী কবি’দের কবি। অথচ রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কবিতায় অমিয়’র মতো আলোকও চলেছিলেন সেই পথেই, যে-পথে যেকোনও রবীন্দ্রগান আজ বাঙ্গালির প্রকৃত জাতীয় সঙ্গীত ... এই পর্বে এসে এই মনে হয়,যে, সমস্ত অনুশীলন সত্ত্বেও আলোক পাশ্চাত্যমুখী আধুনিকতার হাত থেকে রেহাই পাননি সর্বতো... তাই একই কবিতার পরের অংশটি আমার কাছে উপস্থিত হয় আরো বেশি সংশয় নিয়ে যখন আলোক বলেন :
‘ সহজ বিকেলবেলা চিরদিন অবোধ্য নির্জন’
           কেননা এ উচ্চারণ সাবেক ভারতীয়। মিলে যায় তাঁর অপর অনেক উচ্চারণের সঙ্গেই। ঠিক। তথাপি আলোকের জীবনদর্শনের দৃষ্টির ইঙ্গিতে আমি অনুভব করি একরকমের দ্বন্দ্ব। কুয়াশা... হয়তো সেই কুয়াশাকেই আলোক লিখে রাখতে চান এইভাবে :
............ ............ ............ ............ ............ ভাবনায়
ছায়া নেমে আসে! আমি কতদিন
দুইটি বিষণ্ণ পাখি দেখেছি , স্পষ্টত বসন্তকালে
ফুলগুলো মুদ্রিত নিশ্বাস, ত্রস্ত চোখ আপাতরঙ্গিন।
সহজতা কোথায় যে আছে, আমি ভাবি। ( সহজতা, স্তব্ধলোক)
             যেন এইবার এই ‘সহজতা’কেও, ‘সহজ’কেও নির্মাণে নিমগ্ন হলেন আলোক। ফলত ‘স্তব্ধলোক, বা তৎপরবর্তী ‘মেঘনিবেশ’এর কয়েকটি লেখা ব্যতীত আমাদের চেনা আলোককে ফিরে পেতে অপেক্ষা করতে হয় ‘অমূলসম্ভবরাত্রি’ পর্যন্ত। ঐ পর্বের গ্রন্থগুলি, ’হিমপ্রহর’,‘অর্থহীন অর্থহীনতা’, ’তমঃশংখ’ আমি পার হয়ে আসি, মূলত অস্বস্তিতে। সেই অস্বস্তির মর্মে থাকে মূলত তাঁর ভাষানির্মাণের প্রবণতার মারাত্মক উচ্চাশা ... সেইসঙ্গে প্রয়াস ‘সহজে’র কৃত্রিম নির্মাণের। এখানে একটি জিনিস শুধু লক্ষণীয়,যা থেকে অনুভব হয়, ঐ পর্বের কবিতাগুলির রচনায় সময় আলোক নিজেও অবগত ছিলেন এই প্রচেষ্টার আশু ব্যর্থতা বিষয়ে ...... লক্ষণীয়, হয়, ঐ পর্বের গ্রন্থগুলির নাম...‘হিমপ্রহর’, ‘ অর্থহীন অর্থহীনতা’, ‘তমঃশংখ’...নামগুলিই কি নয় পরাজয়ের গহন সহশব্দ?
            কিন্তু আলোক যেহেতু কবি, আর যেহেতু ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’, তাই, ঐ হিমান্ধকারে আবর্তে অর্থহীন শংখধ্বনিতে বেশিদিন নিরত থাকেন না আলোক। তাঁর পুনর্জন্ম না হলেও, তাঁর ভাষাভূগোল নির্মাণের প্রচেষ্টা একটি স্তর থেকে আরেক স্তরে, আরেক ধাপে উঠে যায় তাঁর ‘অমূলসম্ভবরাত্রি’তে।

৮.
        ‘অমূলসম্ভবরাত্রি’, মনে হয়, মূলত লিখিত, তাঁর ভাষানির্মাণ যাত্রার নতুন বন্দর খুঁজে পাওয়ার ঘোষণার পুলকেই। এখানেও বাক্যে ক্রিয়াপদ গৌণ, তথাপি চোখে পড়ে না তাকে গৌণ করার প্রয়াস। এখানে অবশ্যই তাঁর ভাষানির্মাণ যাত্রা পায় এক রকমের সিদ্ধি । যেন সত্যই নির্মীত হয় এক ‘অমূলসম্ভবরাত্রি’:
‘রাজত্ব কোথাও নেই, শুধু এই রাজা আর মৃগনয়না সুন্দরী –
অমূলসম্ভব রাত্রি বড়ো হলো।
বড়ো হওয়াটাই চাওয়া আরো বড়ো-হওয়া আরো পরিণত।
রঙ আনো যেমন তেমন মেশাও খুশির ঝোঁকে দেখো মৃগনয়না সুন্দরী
রাজত্ব কোথাও নেই তবু সাত মহলের শেষের জানলায়
শেষ বা প্রথম যাই বলো’। (অমূলসম্ভব রাত্রি)
এখানে আমার মনে পড়ে
‘এইখানে শূন্যে অনুধাবনীয় পাহাড় উঠেছে
ভোরের ভিতর থেকে অন্য এক পৃথিবীর মতো;
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
... কেননা এমন স্থান পাথরের ভারে কেটে তবু
প্রতিভাত হয়ে থাকে নিজের মতন লঘুভারে;’ (মহিলা,জীবনানন্দ দাশ, বেলা অবেলা কালবেলা)
         আলোকও শূন্যে, এইবার, প্রকৃতই নির্মাণ করলেন তাঁর অনুধাবনীয় ভাষার প্রাসাদ। রচনা করলেন মৃগনয়না সুন্দরী। সত্য। কিন্তু সেই নির্মিত ভাষায়, অন্তত এই গ্রন্থে তিনি ‘ভাব’কে শেষ পর্য্ন্ত ছুঁতে পারলেন কি? শুধু একটিবার মাত্র তিনি শোনালেন, এই সদ্য হওয়া ভাষার, এই ভাষারই সৃষ্টিকাহিনী, এতদ্‌ভিন্ন, এই গ্রন্থের প্রায় সর্বত্র তাঁর এই নির্মিত ভাষাশরীর রয়ে গেলো ছায়াশরীরই...তবু অন্তত একটি রচনায় তিনি পুনরায় এমনভাবে শোনালেন তাঁর সেই নিরাসক্তির সাধনার কথা, সেই সাধনশক্তির কথা, যে নিস্তব্ধ শুনতে বাধ্য হলেন, হয়তো, ভাষাদেবীও :

তাপস তরুণ অরুণবরুণ কিরণে মেঘ পার হয়ে এলো
আমারই আঙ্গিনায় । আসবার কথা ছিল।
আমার কোনো বিস্ময় নয়। আমি কেবল বলি তুমি এবার জ্বলো। (অরুণবরুণ কিরণে)

          কিসের এমন প্রত্যয় যে তিনি জানেন তাপস তরুণের আসবার কথা ছিল তাঁরই আঙ্গিনায়? এরও উত্তর আছে, এইখানে, আলোকের, আমাদের পূর্বপরিচিত আলোকের মতো করেই :
‘ ............... ............... ............... ............... আমার ছিল শ্রম
আমার ছিল একাগ্রতা একধরনের নিশিজাগরণ।
............... ............... ............... ............... ............... ...............
মানে খুঁজতে গেলেই ফেনিয়ে উঠবে কৌতুক – শ্রমটাই তো আসল কথা’।
পাঠক, আমার মনে আসেন রবার্ট ফ্রস্ট, তাঁর ‘দি মাউন্টেন’
"Warm in December, cold in June, you say?"
"I don't suppose the water's changed at all.
You and I know enough to know it's warm
Compared with cold, and cold compared with warm.
But all the fun's in how you say a thing."
        পাঠক, এ কি নেহাতই কাকতালীয়?
        এরপর তাঁর সদ্যপ্রাপ্ত ভাষার সিদ্ধিতে মিলিত হয় ভাব। সেই ভাবের বিস্তারে রচিত হতে থাকে ‘নিশীথ বৃক্ষ’, ‘আমার বাবার গলা’, ‘রৌদ্রময় অনুপস্থিত’, ‘যে কোনো নিস্তব্ধ’... তারপর? তারপর যেন আবার একটু ক্লান্ত দেখায় আলোককে। সেই ক্লান্তির কথা বলবার আগে আরেকটু দেখে নিই তার পূর্ববর্তী যেটুকু যাত্রায় আলোক উজ্জ্বল, ভাস্বর... আমারও আরও অনেকগুলি প্রিয় কবিতাই তাঁর এই পর্বের...
২৩/১০/২০১০
‘বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ
বাড়ি ফিরে আসেনি ছেলে।
অন্ধকারে দেখা যায়না ভালো উঁচু নিচু আলপথ
বাবলাগাছ আকন্দফুলের গাছ।

আঙ্গুল গোল ক’রে ঠোঁটে রাখে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে নাম
শব্দ এগিয়ে যায় গুমরে গুমরে
শব্দ এগিয়ে যায় অনেকদূর – বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে।
দুয়ারের ধান-কেটে-নেওয়া মাঠ আলো জ্বালিয়ে চলেছে গোরুরগাড়ি
মড়মড় করে উঠছে খড় সড় সড় করে উঠছে শুকনো পাতা।
হেমন্তের শেষদিক
কুয়াশা থেমে রয়েছে চারিদিকে কুয়াশা চিরে চিরে জ্বলছে জোনাকি।


কুয়াশা চিরে চিরে জ্বলছে দুটো চোখ –বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে
বড়ো বড়ো দুটো পা কুয়াশা ভেঙ্গে ভেঙ্গে এগোচ্ছে।
ঝটপট করে উঠছে বাদুড় ককিয়ে ককিয়ে উঠছে প্যাঁচা
লাফিয়ে উঠলো ইঁদুর সড়সড় করে উঠলো খড়।

বড়ো বড়ো দুটো পা কুয়াশা ভেঙ্গে ভেঙ্গে এগোচ্ছে
বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে।
বড়ো বড়ো দুটো পা মড়মড় করে উঠছে সাপের খোলস
আলো জ্বালানো গোরুরগাড়ি হারিয়ে যাচ্ছে চোখের ওপারে’।
(বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে, নিশীথ বৃক্ষ)

           ভাষা এখানে পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে গড়িয়ে নামা নুড়ির অনায়াসের মতো মসৃণ। ছুরি-কাঁচি-সীজারের কারসাজির দাগ-চিহ্ন-হীন। নির্মিত ভাষা, এখানে, অবশেষে পেয়েছে সেই ‘প্রসাদ’ যার বশেই কেবল সম্ভব ‘রচনা’। ‘প্রকৃত’ রচনা। রচিত হয়েছে এমন এক চিত্রকল্প যা প্রকৃতই ‘অমূলসম্ভব’। চিত্রকল্পের ইঙ্গিত দার্শনিক অভিব্যক্তিকে ছুঁয়ে তারপর তাকে পার হয়ে চলে গিয়েছে পৃথিবীর আকাশ পার হয়ে আরেক আকাশের দিকে ... যেন নীড় আর আকাশের দ্বন্দ্ব গিয়েছে ঘুচে। যেন একে অপরের প্রতিভায়,মহিমায় লীন হয়ে গিয়েও,দুইটি চক্রের মতো গতিশীল রেখেছে রথকে ...
এই পর্বের তাঁর রচনার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে সেরে নিই এই কবিতাটি ঘিরে আরও কয়েকটি আবর্তন, যা হবে আমাদের এই পর্বের অভিযানের প্রস্থানবিন্দু।
             ‘বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে’র কোথাও, তবে জানা যায় না ঠিক কোথায়, রয়ে যায় উইলিয়াম ব্লেকের যে-উপস্থিতি তা কবিতার মধ্যমেধার পাঠকের কাছেও ধরা দেয় সহজেই। আর আলোকও তাই চান এখানে। কেননা অব্যবহিত পরেই, তিনি নিজেই, ব্লেককে ঘোষণা করবেন তাঁর কবিত্বের পিতা বলে। জানান দেবেন এও, যে পিতার অন্তর্ধানে তিনি প্রায় বালক হেন অসহায়... এই উচ্চারণটিও আসবে ব্লেকেরই একটি বহুপঠিত কবিতা ‘The Little Boy Lost’-এর প্রতিধ্বনি হয়ে... আলোকের সেই কবিতাটিও আমার অতি প্রিয়। সেই কবিতাটিতে যাওয়ার পূর্বাহ্নে ‘বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে’ প্রসঙ্গে আর একটি ভাবনাকে লিখে রেখে যাব শুধু...
                 যদিও আমরা লক্ষ করেছি এই কবিতায় ব্লেকের উপস্থিতি, যদিও আমরা জানি তাঁর বার্ষিক গতিপথে তিনি ব্লেকের দ্বারা প্লাবিত হবেন অদূরেই, তথাপি,‘বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে’র নির্মিত আবহের সঙ্গে গ্যেটের নিম্নোদ্ধৃত আবহের মিল আমাকে ঠেলে দেয় চিন্তনের আরেক পথে :
‘Who rides so late through night and wind? Crop_erlkoenig
It is the father with his child.
He has the boy close in his arms,
he holds him safe, he keeps him warm.

My son, why are you hiding your face in such fear?
Father, don't you see the Elf King?
The Elf King, with crown and tail?
My son, that is a wisp of cloud.

You darling child, come, go with me!
Such nice games I'll play with you,
there are many bright flowers on the beach,
my mother has many golden robes.

My father, my father, and don't you hear
what the Elf King is softly promising me?
Be still, be still, my child,
in the dry leaves the wind is rustling.

Would the young master like to come with me?
My daughters shall wait on you beautifully,
my daughters lead the nightly lines
and they'll rock and dance and sing you in.

My father, my father, and don't you see
the Elf King's daughters in that gloomy place?
My son, my son, I see it quite well:
it's the old willows shining so gray.

I love you, I'm drawn by your handsome form,
and if you aren't willing, I'll take you by force!
My father, my father, he's grabbing me now,
the Elf King has hurt me.

The father shudders, he rides like the wind,
he holds in his arms the moaning child,
reaches the yard with the utmost pains,
in his arms the child was dead. (Goethe, The Elf King)

           মনেহয় গ্যেটের এই কবিতাটি একটি ভিত্তি হতে পারে ব্লেক আর গ্যেটের এক তুলনামূলক আলোচনার, যা হয়তো করব কোনওদিন। ভবিষ্যতে। আলোকে এই কবিতার আবহের চিহ্ন কিছু থেকে গেলেও, এই কবিতার ‘ব্যালাড’ধর্মিতা আলোকের চরিত্র নয়। কদাপি। যদিও এই পর্বে আলোক অনেক সময়েই কথা বলেছেন গল্প বলার ঢঙ্গে...বরং এবার ফিরে যাই সেই কবিতায় যেখানে ব্লেক্‌কে তাঁর নিজের রচনার পিতৃপুরুষ বলে ঘোষণা করেলেন আলোক সরকার।
‘চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে বাবা বাবা তুমি কোথায় যাচ্ছ!
দামাল সেই কিশোর তার বাবা পালিয়ে যাচ্ছে দূরে।
মরা জ্যোৎস্নার বাঁশবন
তার পাশে দ্রুত নেচে উঠলো ছায়া, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে।

সারাটা পথ হাত ধরা ছিল
আর সে লাফিয়ে ধরতে চেয়েছে প্রজাপতি কুড়োতে চেয়েছে জামরুল।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে চারদিকে শেয়াল ডেকে উঠলো তিনবার
বাঁশবনের ওধারে কাপাসতলির শ্মশান।

তার গলা যতো উঁচু ততো বেশী হারিয়ে যাচ্ছে ছায়া
ভয়ে শিরশির করছে শরীর তবু দৌড়োচ্ছে কচি পা
বনতুলসী বিছুটির ঝোপ
হোঁচট খেয়ে লাফিয়ে উঠছে আমার উঁচু হয়ে খুঁজে দেখছে চারদিক।

আর তার বাবা কত দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে
মরা জ্যোৎস্নার মধ্যে অন্ধকার বোবা একটা পলায়ন।
হাতধরা ছিল সারাদিন
কাপাসতলির শ্মশান সেইখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।
(ব্লেকের প্রতি, যে কোনো নিস্তব্ধ)

           এই কবিতা ব্লেকের পিতৃত্বকে বরণ করে নিয়ে মূলত বরণ করে নেয় ‘ক্ল্যাসিকেল’কে। শুধু তত্ত্বে নয়। প্রয়োগেও। একই সঙ্গে বলে ‘ক্ল্যাসিসিজম্‌’ থেকে মুক্তির কথাও। ভাষা,নির্মাণ ইত্যাদির সাপেক্ষে এই কথাগুলি যদি কোনও পাঠকের মর্মে নাও প্রবেশ করে, কেননা এই প্রবেশ মূলত মেধা ও পাঠজনিত, তথাপিও এই পর্বের আলোক তার গহনে প্রবেশ করতে বাধ্য এই কারণে, যে, এই কবিতা বা এই পর্বের তাঁর আরও অনেক কবিতাই, রচনা করে এমন সব আবহ, চিত্রকল্প, যা সর্বজনগ্রাহ্য ... সত্যের খাতিরে এও বলতে হয়, যে, যা প্রায় অনুপস্থিত ছিল এতদিনের আলোকে...
           আমার মনে পড়ে সেই বিকাল, যখন বালক অপু যাচ্ছিল, নেচে নেচে দৌড়ে দৌড়ে, তার বাবার সঙ্গে, কুঠীর মাঠে নীলকন্ঠ পাখি দেখতে ... মনে পড়ে নিজের বাবাকে ঘিরে অসংখ্য ব্যক্তিগত স্মৃতি ... মনে পড়ে বয়সের নিয়মে বা অনিয়মে কীভাবে পিতা ও পুত্র, ক্রমে, হয়ে ওঠে দুইটি বিভিন্ন দ্বীপ, তাদের মধ্যেকার সেতু কীভাবে ভেঙ্গে পড়ে দৃশ্যত...মনে পড়ে রিল্‌কেও...মনে পড়ে সেই এলিজি, যেখানে মাতার অকুন্ঠ সাবধানতা সত্ত্বেও পুত্রকে কেড়ে নেয় তার নিয়তি ...কেড়ে নেয়? না কি পুত্র নিজেই অনুসরণ করে তাকে?
Yes, you did frighten his heart; but more ancient terrors
plunged into him at the shock of that feeling. Call him . . .
but you can't quite call him away from those dark
companions.
Of course, he wants to escape, and he does;
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
How much you hid from him then. The room that filled
with suspicion
at night: you made it harmless
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
There wasn't a creak that your smile could not explain,
as though you had long known just when the floor would do
that...
And he listened and was soothed. So powerful was your
presence
as you tenderly stood by the bed; his fate,
tall and cloaked, retreated behind the wardrobe, and his
restless
future, delayed for a while, adapted to the folds of the
curtain. (Duino Elegies - The Third Elegy)

            ‘ক্ল্যাসিকেল’এর সঙ্গে ‘কন্‌টেম্পরারি’র, অরিয়েন্টালের সঙ্গে ওয়েস্টার্নের মেলবন্ধনের এই বিশেষ রূপটি অবশ্যই আলোকের দান। বাংলা কবিতাকে। জীবনানন্দেও রয়েছে এই মেলবন্ধন তবে তার অভিযাত্রার পথটি যেহেতু ভিন্ন অতএব তার প্রকাশরূপটিও ভিন্ন। এতদ্‌ভিন্ন আর যেসব প্রচেষ্টা লক্ষিত হয়েছে, অপর ‘কবিতা লিখিয়ে’দের হাতে, সেখানে ঘটেনি কোনও মেলবন্ধন। সেখানে পাশ্চাত্যের মোড়কে আপনাকে মুড়ে নেওয়ার চেষ্টাই হয়েছে শুধু ...
               এই পর্বে আলোককে আমরা বার বারই দেখি ব্লেকের দিকে ধেয়ে যেতে। কখনও প্রায় সরাসরি। কখনো বৃত্তাকার পথে। এই পর্বেই রচিত হয় ‘নেই’,’অভিযাত্রা’, ‘ঈশ্বর’,‘নিস্তব্ধ’,‘সহজপাঠ ‘ বা ‘চোখ’ হেন মারাত্মক কবিতাগুলি – এ যেন আলোকের প্রকৃত ‘ক্ল্যাসিকেল’ যুগ। এবার যেন ‘সহজের নির্মাণ’ নয় , ‘সহজেই’ ফিরে এলেন আলোক। সহজ পথে। হয়তো এই কারণেই তাঁর এই পর্বের কবিতা এত ‘মুক্ত’, যে-অর্থে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘ মুক্তি এই সহজে ফিরিয়া আসা সহজের মাঝে...’


৯.
           এরপরে আসে আরেক পর্ব, যেখানে আবার আলোক পথিক। আবার তাঁর কড়া নাড়া ভাষানির্মাণের নানান পান্থনিবাসের দ্বারে দ্বারে। কিন্তু যারা একবার আস্বাদ পেয়ে গিয়েছে, পূর্ববর্তী পর্বের, সেই ‘ক্ল্যাসিকেল’ আলোকের, তারা যেন ঠিক স্বস্তি বোধ করে না ‘মঙ্গলদীপ’, ‘মেঘময়’ বা ‘নির্মেঘ মন্থর’এ। সেই ‘ক্ল্যাসিকেল’ পর্যায়ে আলোকের কবিতা পরিগ্রহ করেছিল যে-অবয়ব তা এখানে এসে পুনরায় ছায়াশরীর :
‘ এখন বর্ষাকাল। দিন
প্রলম্বিত একটা বর্ষণ
আঁধারিম স্তব্ধ আর মূক অনিঃশেষ

তা যাবতীয় দৃশ্য এবং উজ্জীবন
যথার্থ এবং অনিবার্য্য
একটি দৃশ্য এবং একটি উজ্জীবনের’ ( বর্ষাকাল, মঙ্গলদীপ)

           এখানে শব্দ যেন পায় না কথার অবয়ব, কথা পায় না ভাষার পরিণতি ... সত্য ... কিন্তু তার আড়ালেও কোথাও চলতে থাকে আরেক প্রস্তুতি – যে-গোপন ‘উদ্যোপ পর্বের’ কথা ‘অমূলসম্ভব রাত্রি’তে আগেও বলেছিলেন আলোক :

‘ ............... ............... ............... ............... আমার ছিল শ্রম
আমার ছিল একাগ্রতা একধরনের নিশিজাগরণ।
............... ............... ............... ............... ............... ...............
মানে খুঁজতে গেলেই ফেনিয়ে উঠবে কৌতুক – শ্রমটাই তো আসল কথা’।

           এই একাগ্রতার, নিশি জাগরণের ফসল, ফলে, পুনরায়, পুষ্পিত হয়ে, ‘নির্মেঘ প্রহরের’ অন্তপর্যায় থেকে ‘পিতৃনিলয়’, ‘ঘর উঠোন’ হয়ে ‘খেলার সময়’, ‘গৃহনিলয়’, ’জবা ভালো হয়ে গেছে’ পেরিয়ে ‘ঘাস রঙের আলো’ অবধি। ‘নির্মেঘ প্রহরের’ অন্তিমে এসে তাঁর উক্তি যেন বলে, মৃত্যুচেতনার আপাত মোড়কে জড়িয়ে, এই পথ হারানো আর পথ খুঁজে পাওয়ার অভিযানের   অন্তর্কথাগুলিকেই :
‘ওগো প্রভু, আজ আমাদের বেলা শেষ। আজ
তোমার আমার বেলাশেষ। তুমি ঠিক আছো ? তুমি
অন্ধকারে চিনতে পারছ পথ? আমি কিছুই দেখি না। আমি
হাত এলোমেলো ছুঁড়ি নিষ্ফল প্রয়াস। তুমি কোন দিকে? (মৃত্যুফুল)
         ‘মৃত্যুফুল’এ মৃত্যুচেতনা আধারের মতো হলেও তার পরিণত বিস্তার দেখি আলোকের এই পর্বে। দেখি প্রয়াস মৃত্যুকেও নিরাসক্ত দেখার :
‘ জলের পাশের বালি মাড়িয়ে যাচ্ছিলুম
সন্ধে বেলায়। হঠাৎ ঝলক হাওয়া
প্রশ্ন করলো – মৃত্যুভূমি জানো? কতোকালের
বাসি প্রশ্ন! ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
... অনেক দূরে যাবো, অনেক অনেক ঘন আঁধার
দাঁড়িয়ে আছে সারা আকাশ জুড়ে। ...’ (মৃত্যুভূমি, পিতৃনিলয়)

‘ কালো গোরুর বিকেল হলো আনমনা রঙ বাড়ি ফিরছে
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
বিকেল যেন লুটিয়ে আছে সারা মাঠে, ওগো বিকেল
তোমার কোথায় দুঃখ বলো? তুমিও তো
আঁধার হলেই বাড়ি ফিরবে। ... ... ... ... ... ...
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
... ... ... ... ... ... ... ... ... আঁধার
কতো নিথর তৈরি করছে একটা দুটো বাড়ি।
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কী দেখা যায়? – আঁধার কেবল বাড়ি, আঁধার ফিরে-আসার।
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
চিরদিনের চেনা বিরাম এক দুই তিন আঁধার গুনছি। (বাড়ি,পিতৃনিলয়)
             এই তাঁর ‘পিতৃনিলয়’। এই তাঁর মৃত্যুর স্বরূপ। বিকেলবেলা বাড়ি ফেরা। অন্ধকারে। বাড়িও অন্ধকার। তারপর কী? আবার ফিরে আসা? মুক্তি? আলোক নীরব। কেননা, পূর্বে, দীপংকর দাশগুপ্ত’র কথা বলতে গিয়ে, লিখেছিলাম, যে,দীপংকর দাশগুপ্ত’র ‘সমুদ্র’ কবিতায় ‘সমুদ্র কি সত্যি সত্যি আছে কোনোখানে’বার বারই এই প্রশ্ন দীপংকর দাশগুপ্ত স্পষ্ট রাখলেও, আর এই প্রশ্ন আলোকেও স্পষ্ট না হলেও প্রচ্ছন্ন, আর এই প্রচ্ছন্নতা, ক্রমে, এমনি ‘সাট্‌ল্‌’ যে আমি মনে করে নিতে বাধ্য হই, যে, আলোক মূলত জানেন ‘সমুদ্র’ নেই (তথাপি নৈমিত্তিকতার প্রয়োজনে তাকে গড়ে নিতে হয় মনে মনে।), অতএব ‘মৃত্যু’ই তাঁর কাছে শেষ কথা। তারপরে আর কিছু নেই।
           শেষ হয় ‘পিতৃনিলয়’। আলোক রাখেন না জন্মান্তর বা পূর্বজন্মের কোনও ইঙ্গিত। তথাপি ‘ঘর-উঠোন’এ আলোকের যা ঘটে, তা এক পুনর্জন্মই। ভাবনায়। প্রকাশ ভঙ্গিমায়। এখানে সকলই চিত্র। ছোট ছোট নৈমিত্তিকতার ছবি। যে-ছবিগুলির মৃত্যু নেই ...
দুলে দুলে বলছে একটা না-বলা
বলো আরো বলো, সবুজ আমতলা
গন্ধ ম-ম করছে।
গন্ধ কিছু বলছে?
গন্ধ বলছে বাজনাওলা, ও বাজনাওলা।
... ...
মোহনপুর, মোহনপুর স্টেশন।
হুহু করছে অন্ধকার, লন্ঠন
ঢালুপথে দুলতে দুলতে নামছে।
লন্ঠন কারুকে খুঁজছে?
লন্ঠন ঘুরে ঘুরে বলছে – সুমন, আমার সুমন। (‘ঘর-উঠোন’)

          এইরকম পরিচিত, অথচ গভীরতায় দিগন্তবিস্তারী দৃশ্যগুলির কাঠামো, এই পর্বে, রচনা করে তাঁর নিজস্ব নির্মিত ভাষা। অনায়াসে। আরেক সিদ্ধিতে হয় তাঁর উত্তরণ :

প্রথম কিশোর জানলায় দাঁড়িয়ে।
আর ওই তার বাবা
বাগানে কাজ করছে মুখ নিচু।
... ... ... ... ... ... ... ...

বাবা কাজ করছে ! কতো কতো দিন
কাজ করছে বাবা। সে জানে
তার বাবার সব কাজ
ওই ফুলটার জন্যেই।

সে গলা উঁচু করে বলছে
কষ্ট হচ্ছে! বাবা তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব!
একটা ছাতা নিয়ে
দৌড়ে গিয়ে মাথায় ধরবো তোমার বাবা? (বাবা কাজ করছে, ঘাস রঙের আলো)

           কে ওই অনন্তকালের বাবা, আর কে ঐ অনন্তকালের কিশোর? প্রথম কিশোর? অপু-হরিহর, আমি আর আমার বাবা, না কি সেই পরমপিতা, যাঁর সন্ততি আমরা সকলে? যিনি প্রতিদিন, আপন অন্তরে সকল ব্যথাকে বয়ে নিয়ে, আমাদের জন্যই ফুটিয়ে চলেছেন ফুল, মুহুর্মুহু? বোঝা যায় না। তবু বোঝা যায়ও যেন...হায়, আমরা যদি বুঝতে পারতাম, প্রকৃত, যে,
‘ বাবার সব কাজ
ওই ফুলটার জন্যেই ...’
২৪/১০/২০১০


১০.
          মৌল স্রোত পেরিয়ে, তেপান্তরের মাঠ ছাড়িয়ে, পাহাড় ভেঙ্গে পথ করে, পথ কেটে নদী ক’রে, হেঁটে চল্লেন আলোক সরকার। কিন্তু কোন দিকে? কী নূতন মাত্রা তিনি এনে দিলেন বাংলা কবিতায় ? – এমন প্রশ্ন তুলতেই পারেন তার্কিকেরা। পণ্ডিতেরা। এই সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়বার পরেও। এমনি তাঁদের পাণ্ডিত্য! প্রতিভা! তাই তাঁদের এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অছিলায়, আমি এক্ষণে লিখে রাখবার চেষ্টা করব আমার এই সাতকাণ্ড রামায়ণের সারাংশ। পণ্ডিতদের জন্য শুধু নয়। আমার নিজের জন্যও।
         পড়েছি কমলকুমার নাকি বলেছিলেন, যে এমন একটি উপন্যাস লিখবেন, যাতে জলরঙ্গের ছবি আর ভাস্কর্য যাবে একাকার হয়ে (‘একটি নারী যে একবার জলরঙ এর চিত্র আবার কখনো ভাস্কর্য’...‘গোলাপ সুন্দরী’ আনন্দ সংস্করণে কমলকুমারের উপন্যাস সমগ্রের ভূমিকায় সুনীল, এ ছাড়াও অন্য কারোর লেখায় পড়েছি প্রসংগটি, এখন মনে আসছে না)। ‘গোলাপ সুন্দরী’ নাকি তাঁর সেই নিরীক্ষার ফসল। কমলকুমারের উপন্যাস বা তাঁর উপন্যাসের তালিকায় ‘গোলাপ সুন্দরী’র অবস্থান কী, এই মুহূর্তে তা আমার বিচার্য বিষয় নয়। তবে এটুকু মনে হয়েছে যে, সত্যিই কোনও কোনও মুহূর্তে, যেমন বিলাসের অন্ধকার কক্ষে মণিক চ্যাটার্জী’র আগমনের দৃশ্যে, মণিক যেন প্রায় অবাস্তব। বিলাসের আরেক খেয়ালী কল্পনা... ‘ ... বিলাস তাঁহার সুন্দর কপালের দিকে লক্ষ্য করিল। এ কপালে একটি তারা আসিয়া দেখা দিতে পারে’। ... অবন ঠাকুরের জলরঙের সঙ্গে কোনও সংশ্রব কি নেই এই ছবির?
তারপর মণিক ক্রমে ক্রমে ভাস্কর্য...গোলাপ, গোলাপ সুন্দরী... ‘মণিক ... সূক্ষ চতুর নর্তকীর মতো নিমেষেই, ঝটিতি, চকিতে গোলাপের নিকট হইতে অনিন্দনীয় ভঙ্গী সহকারে, হলের এক কোণে এক পা মেলাইয়া দিয়া হস্তদ্বয় শেল্পের নিকটে রাখিয়া, অসম্ভব ভাবে স্থির করিয়া এখন, “আঃ” বলিয়া মহা যন্ত্রণায় মাথা দুলাইতে লাগিল...’ ... এইভাবে মণিক ক্রমে রঁদ্যা...
          কমলকুমার ও ‘গোলাপ সুন্দরী’র এই প্রসঙ্গ টেনে আনলাম এই কারণে, যে, যদিও অমিয় চক্রবর্তীর পথেই পা বাড়িয়ে যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল আলোক সরকারের, তবে কিয়দ্দূর গমনের পর, উপস্থাপনার ক্ষেত্রে, প্রথমত, আলোক নিলেন জলরঙের তুলি, যেখানে অমিয়র হাতে আমরণ ছিল ভাস্করের ছেনী। আলোকের হাতে শিল্পের ‘মণিক চ্যাটার্জী’র যে-ললাট অঙ্কিত হতে থাকল তাতে সর্বদাই ‘এ কপালে একটি তারা আসিয়া দেখা দিতে পারে’র সম্ভাবনা রয়ে গেল এবং ওই সম্ভাবনার ভগীরথ আলোক সরকারই।
         অমিয়’র উপস্থাপনা ভাস্করের। যা আছে, তা’ই আছে। আছে সর্বাঙ্গসহকারে। সে একেবারে তাঁর প্রথম গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি থেকে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘খসড়া’র প্রথম কবিতা ‘বাড়ি’ সত্যিই বাড়ি। তার সিঁড়ি দিয়ে ছাতে যাওয়া যায়। দেখা যায় কোথায় কী রয়েছে, রয়েছে কী রকম। পক্ষান্তরে আলোকের ‘বাড়ি’ একটি ধারণা। একটি objective correlative। অমিয়র কোথাও নেই কোনও objective correlative।
         জলরঙের ছবির ঐ পথটিতে যেতে গিয়ে আলোক দৃশ্যকে, পারিপার্শ্বকে দিলেন ডানা। সে-ডানা কেবল ঝিলমের আকাশে উড্ডীয়মান বলাকার ডানার আন্দোলনে, পর্বতের বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ হতে চাওয়া, নয়। আলোকের রচনাবিশ্বে ডানা রয়েছে সকলেরই। তারা নির্ভার। তারা সকলেই যেন চরিত্র ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র। দক্ষিণারঞ্জনের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র। এদের মধ্যে আছে শেফালি গাছ, বটগাছ, প্রেমিকা, কিশোর, তার কর্মরত পিতা, জবা ফুল, প্রপিতামহের গানের খাতা – অর্থাৎ দৈনন্দিনের সাধারণ জিনিস, স্বাভাবিক ঘটনা। যেমন অমিয়তে। কিন্তু আলোকে তারা থেকেও যেন নেই।
রোগা অন্ধ ছেলে আলপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে
অভ্যস্ত নিপুণ হেঁটে যাওয়া।
জিজ্ঞেশ করতে বলল সুর্যাস্ত দেখতে যাবে। (অভিযাত্রা,নিশীথবৃক্ষ)

            প্রথম পংক্তিতে যা ছিল ধরা ছোঁওয়ার —‘রোগা অন্ধ ছেলে আলপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে’ তৃতীয় পংক্তিতে তা’ই হয়ে গেল প্রায় রূপক। তার অন্ধত্বের ভার, তার রোগা শরীরের বাস্তবতা ভেসে গেলো তার সুর্যাস্ত দেখার ইচ্ছার কাছে। অথচ নেই কোনও ম্যাজিক বাস্তবতার কোনও জাদুলন্ঠনের ছোঁয়া। এ যেন লালকমল আর নীলকমলের গল্প, গল্প বুদ্ধু ভুতুমের। এইমাত্র তারা বানর। অথচ তারা রাজপুত্রও। ফলে তাদের দুঃখী জীবন ভারি করে না বাতাস কে। বরং তাদের অভিযানে খুলে যায় সেই ভারকে লাঘব করবার রাস্তা।
           অস্তির সত্যের প্রতি প্রত্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে আলোক ওই নির্ভারতাকেও নিয়ে এলেন বাংলা কবিতায়। আর আমার ধারণা, ঐ প্রকরণটি ততদিনে বাংলা ভাষায় না এসে পড়লে পরবর্তী সময়ের কোনো ভগীরথকে তা আবিষ্কার করে নিতে হত ।যে-বিষয়বস্তু (কবিতার যদি সেভাবে কোনও বিষয়বস্তু থেকে থাকে...) নিয়ে গৌতম বসু লিখলেন ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’, তাতে যদি ওই ডানা না থাকত, তাহলে ‘বাদল’এর ভার বহন করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠত কবিতা। হাঁপিয়ে মরতাম আমরা। ‘পথে বিপথে অন্নের থালা’র ‘বৃত্তাকার ক্ষুধা’ আমাদের গ্রাস করে নিত। বাংলাভাষা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে পারত না উচ্চারণ করতে ‘এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন’...
           (এখানে সামান্য প্রসঙ্গান্তরে গিয়েই বলি অমিয় চক্রবর্তী’র কবিতার ভাস্করত্বকে এড়িয়ে আলোক হাঁটলেন আরেক নতুন পথে। ঠিক। কিন্তু সেই পথও পথিক বিরল হলেও পথিকহীন রইল না শেষ পর্যন্ত। সে-পথে পা বাড়ালেন কবি দেবাশিস্‌ তরফদার। কিন্তু দেবাশিস এখানে এলেন একেবারেই ভিন্ন পথ ধরে। আধুনিকতার যে-হিংস্রতা আলোক দেখেননি তাঁর তারুণ্যে দেবাশিসকে দেখতে হয়েছে তা। শুনতে হয়েছে, যে, রণজিৎ দাশও কবি। এই সময়ের কবিতার গতিপথটির মানচিত্রের চরিত্রটির অনুধাবনের প্রয়োজনে অমিয় চক্রবর্তীকে কষ্টিপাথর হিসেবে রেখে দেবাশিসের কবিতার আলোচনা অবশ্য প্রয়োজন। স্থানান্তরে তাও করার ইচ্ছা রয়েছে আমার। )
           এটাও লক্ষনীয়, যে, না আলোক না অমিয়, সেই অর্থে কোনও প্রেমের কবিতা লিখেছেন, যে-অর্থে রবি ঠাকুরের ‘এমন দিনে তারে বলাযায়’, আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি (এক গাঁয়ে , ক্ষণিকা) বা ‘স্মরণ’-এর কবিতাগুলি অথবা ‘ভালবেসে সখী নিভৃত যতনে’ হেন রচনাগুলি জীবন্ত মানুষ-মানুষীর প্রেমের কবিতা। সেভাবে দেখতে গেলে তা লিখেননি সুধীন্দ্রনাথও। তবে তার কারণ হিসাবে সুধীন্দ্রনাথের ‘ক্ষণবাদী’তা, যার নিরিখে মানব-মানবীর প্রেমকেই তিনি প্রায় অস্বীকার করে গেছেন, সেই দর্শনের দায়কে মেনে নিতে হয়। জীবন্ত মানুষ-মানুষীর প্রেমের কবিতা না লিখলেও সুধীন্দ্রনাথ লিখেছেন জীবন্ত মানুষ-মানুষীর প্রেম নিয়ে কবিতা। সেই প্রেমের নশ্বরতা বিষয়ে কবিতা। কিন্তু না আলোক,না অমিয়, লিখেছেন ‘মহামায়া’হেন কোনও কবিতাও, যেখানে মানব-মানবীর জৈব প্রীতিকে তাঁরা ছুঁয়ে গিয়েছেন কোনওভাবে। অমিয়’র ‘চিরদিন’ (‘আমি যেন বলি আর তুমি যেন শোনো’) হেন রচনা, রবীন্দ্রনাথের ‘প্রেম’ পর্বের অধিকাংশ গানের মতোই,মূলতঃ, ‘পূজা’ ও ‘প্রেম চেতনা’র মধ্যবর্তী কোনো বিন্দুকে ছুঁয়েযায় আর আলোকের রচনায় যা ফেলে ছায়া তা হচ্ছে প্রেম সম্বন্ধে এক ধরনের ভীতিঃ
পোকাটাকে দুই পায়ে পিষে ছুঁড়ে দিল বাইরে অন্ধকারে
আমার প্রেমিকা। আমি অবজ্ঞাত লাঞ্ছিত প্রেমিক
পরিত্যক্ত ঘরের বাইরে এসে দেখলাম শুভ্র ব্যবহারে
সমগ্র নিশীথ সান্দ্র অভিসার। ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... তোমার সিঁড়ির শূন্যতায়
একাগ্র মাকড়সা নিঃস্ব স্বাভাবিক জাল বোনে। স্বভাবিক
ধুলো, বাদামের খোসা, মৃত্যুর নিশ্চিত সত্যে স্থির।
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
...। অন্ধকারে মৃত্যুর নিশ্চিতি, স্তব্ধ স্থবির নিঃসংগ একাকার
করোটি কংকালকীর্ণ, স্বভাবী মানুষ ফিরে আসি। ( ‘পারিজাত’, বিশুদ্ধ অরণ্য)
   মরনশীল এই ‘প্রেমিকা’র কাছে স্বাভাবিক হতে পারেন না আলোক। স্বাভাবিক হতে পারেননি আলোক। তাই নিজস্ব ‘স্বভাব’ নিয়ে তিনি, ‘স্বভাবী মানুষ’ ফিরে আসেন। কিন্তু কোথায়? ফিরে আসেন সেই ‘বিশুদ্ধতা’য় যেখানেঃ
সম্পূর্ণ পাতার শিখা হার্দ্য কারুকাজে স্বাগত বিছানো
দুইটি হরিণ নিমীলতা বড়ো চোখ নিস্পৃহ শ্রাবণ।
আর অবিরোধী সাপ কোমল মসৃণ অনায়াসে – একটি ফুলের উষ্ণতায়
সাতটি ভ্রমর যেন চিরিদিন নি্লীন গুঞ্জন। ( ‘বিশুদ্ধ অরণ্য’, বিশুদ্ধ অরণ্য )
এই বিশুদ্ধতা, হায়, এমনি ‘স্বভাবী’ যে, সেখানে প্রকৃতিকেও নিয়ন্ত্রিত হতেহয় সেই ‘স্বভাব’এর দ্বারা ... সাপও হয়েওঠে অবিরোধী ... আর সেই ‘স্বভাবী’ বিশুদ্ধতার গহনেই আলোকের ভালবাসা,প্রেম ঘনীভূত হয়েওঠে, ক্রমে –
‘ ... দিনে দিনে প্রাসাদ রচনা করো, গন্ধময় উষ্ণ নীল মালা –
আমরা বাইরে ছুটি প্রতিটি ফুলের পাশে সুদূর বিস্ময়েঃ’ ( ‘প্রেম’, বিশুদ্ধ অরণ্য )
এই ভিতর ও বাহিরের দ্বন্দ্ব রবীন্দ্রনাথে রয়েছে প্রায় সর্বত্র। একটি সহজ উদাহরণ তুলে নিই আলোচনার সুবিধার্থেঃ
কোথা বাইরে দূরে যায় রে উড়ে হায় রে হায়,
তোমার চপল আঁখি বনের পাখি বনে পালায় ।।
ওগো, হৃদয়ে যবে মোহন রবে, বাজবে বাঁশি
তখন আপনি সেধে ফিরবে কেঁদে, পরবে ফাঁসি–
তখন ঘুচবে ত্বরা ঘুরিয়া মরা হেথা হোথায় ।
আহা, আজি সে আঁখি বনের পাখি বনে পালায় ।।
চেয়ে দেখিস না রে হৃদয়দ্বারে কে আসে যায়,
তোরা শুনিস কানে বারতা আনে দখিনবায় ।
আজি ফুলের বাসে সুখের হাসে আকুল গানে
চির- বসন্ত যে তোমারি খোঁজে এসেছে প্রাণে–
তারে বাহিরে খুঁজি ফিরিছ বুঝি পাগলপ্রায় ।
তোমার চপল আঁখি বনের পাখি বনে পালায় ।।
           রবীন্দ্র কবিতার এই যে ‘বাহির’ তা কিন্তু আলোকের ‘বাহির’হেন ভীতিপ্রদ নয় । এই বাহির সর্বত উন্মুখ ভিতরের সঙ্গে মিলে, মিলনে ঠিক যেমন বাউলের গানের খাঁচার ভিতরের সেই অচিন পাখিটি ... পক্ষান্তরে আলোকের ‘ভিতর’টি যেন ‘বাহির’এর কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচার এক অক্ষয় মনোভূমি ... কাফকার অন্তর্জগতের মতো সেই মনোভূমি শ্বাপদ সঙ্কুল না হলেও এ’ও যেন সেই তথাকথিত আধুনিকতারি সন্ততি যে আধুনিকতার বিপক্ষেই সতত যেতে চেয়েছেন আলোক ...
          এ’ও লক্ষ্যনীয় যে ‘বিশুদ্ধ অরণ্য’ পর্বের পরে আলোকের রচনায় প্রেম বা তজ্জনিত ধারনার কোনো ছায়াপাত আর ঘটেনি সেভাবে।

১৩/১০/২০১০

১১.
              মার আলোকপরিক্রমায় সাময়িক ইতি নেমে আসবে অতি দ্রুত কেননা দে’জ প্রকাশিত জানুয়ারি ২০০৫ সংস্করনের আলোক সরকারের শ্রেষ্ঠ কবিতা শেষ হয়ে গিয়েছে ‘আলস্যরঞ্জিতা’য় এসেই। ‘আলস্যরঞ্জিতা’য় এসে আমার অনুভব হতেথাকে যে ‘ঘাস রঙের আলো’র পর এই যেন আলোক আবার প্রায় প্রায় স্বমহিমায় কেটে নিতে চাইলেন আরেক নূতন পথ । আবারো। বরাবরের মতো। ‘আলস্যরঞ্জিতা’ ঘোষনা করলো সেই যাত্রারম্ভের কথা, এইভাবেঃ
যা নেই
তার প্রণাম মন্ত্র
উচ্চারণ কর।

যা নেই
তা অবশ্যই একটা থাকার
প্রেক্ষিতে নেই। (নিরক্ষবৃত্ত, ‘আলস্যরঞ্জিতা’)

            এই ভাষা আলোকের হলেও এই ভাষাই ইঙ্গিত এমন এক আলোকের যাঁকে আগে আমরা দেখিনি। মন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে যেন মন্ত্রের গঠনকেই ছুঁয়ে দিতে চাইছেন তিনি ... আর সেই ছুঁয়ে থাকার, ছুঁয়ে দেওয়ার প্রেক্ষিতেই বন্দনা করছেন অনাগতের ... ‘যা নেই’ তাকেই নির্মাণ করেছেন আলোক, আগেও। এবারেও সেদিকেই চললেন তিনি তথাপি আগের চেয়ে তিনি যেন একটু কুন্ঠিত এই যাত্রার মুহুর্তেঃ
অচেনা যখনই কিছু দেখি
ভয় হয়।
ওরা কোন দেশ থেকে এলো? ওরা
আমাকে সে দেশে নিয়ে যেতে চায়?
... ... ... ... ... ... ... ... ...

ওগো শান্ত ছায়া
ওগো শান্ত ছায়া
তোমরা আমাকে ছেড়ে যেয়োনা কখনো
তোমরা আমাকে ছেড়ে যেয়োনা কখনো। (ওগো শান্ত ছায়া, ‘আলস্যরঞ্জিতা’)

              এখানে এসে প্রশ্ন জাগে যে আসছে সে কে? সে কী দ্বীপান্তরের নাবিক? সে কী মৃত্যু?
‘আলস্যরঞ্জিতা’ পরবর্তী আলোকের কাব্য হাতেপেলে খুঁজে দেখবো তার উত্তর। পাঠকদের সঙ্গেই। কথাদিলাম।


১২
             শুধু আলোচনা ‘কবি’ আলোকের। কিন্তু বাংলা ভাষাকে আলোক দিয়েছেন কিছু অলোক-সামান্য গদ্য। গল্প। সংলাপকবিতা। সেইখানেও আলোক এমনি ভগীরথ । আলোকের গঙ্গা আনয়নের সেই পথটিও পরিক্রমা করতে হবে আমাকে, আমাদেরকে। অতি সত্বর। অতি শ্রদ্ধায়। আপাতত শুধু এই বলেই থামি, যে, কোনও মহৎ কবিরই যেমন কোনও সরাসরি অনুগামী হওয়া অসম্ভব, তেমনি আলোকেরও নেই কোনও সরাসরি অনুগামী। তবে ‘কৃত্তিবাস’,‘হাংরি’ ইত্যাদির বিপরীতে কবিতার যে-স্রোত গহনতর সেই স্রোতের আলোক এক প্রধান নাবিক ... সেখানেই আলোকের সার্থকতা ...সেখানেই, আমার মর্মে বার বার বেজেওঠে তাঁর সেই অবিনাশী পংক্তিগুলিঃ

বুকের মধ্যে শুনতে পাও আন্তরিক ধ্বনি –
হাজার ঝরাপাতার বুকে পায়ের চিহ্ন মর্মরিত আছে ...

আদি লেখনঃ ৩১/০১/২০১০
ফিরেলেখাঃ অক্টোবর, ২০১০ – ডিসেম্বর ২০১০
বেঙ্গালোর

২টি মন্তব্য:

সুশান্ত কর বলেছেন...

'আলোক সরকারের শ্রেষ্ঠ কবিতা'র দুর্ধর্ষ পাঠ। বেশ পরিশ্রম করেছো, তার জন্যে অশেষ ধন্যবাদ! তোমার এই পাঠে আমাদের সব্বার পাঠ সমৃদ্ধ হবে বলে আমার ধারণা। চালিয়ে যাও।

Chandrani the Dreams বলেছেন...

খুব ভালো লেগেছে পড়ে। খুব ভালো লিখেছেন