“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১১

রেডিও রূপকথা ~~


 
জকাল মোবাইল দেখি আর আমার কেন জানি রেডিওর কথা মনে হয়। রাস্তায় চলতে চলতে কানে গোঁজা দুই সুতো, বুকের কাছে লকেটের ঝুলছে স্পিকার, হাতের মধ্যে সাত রাজার ধন মানিক । সারা দিনের সঙ্গী, এক মুহূর্ত হাতের কাছে না থাকলে দিন সুনসান, যেন সর্বস্বান্ত । তেমনি আমাদের ছোটবেলায় ছিল রেডিও ! আর ট্রানজিস্টার ! সকালে প্যাঁ প্যাঁ পে পে পে ,রবিশঙ্কর , তারপর বন্দেমাতরম । আমাদের ঘুম ভাঙ্গুক না ভাঙ্গুক সে হাজির , সূর্য ওঠার মত তারপর খবর পড়াখবর পড়ছি নীলিমা সান্যাল বা দেবদুলাল বন্দ্যো ,আর কত কত । আজ কানে বাজে সেই স্বর গুলো ! মনে হয় একটা মানুষ থিতু হয়ে যায় তার গলা দিয়ে । তার চেহারা,  অবয়ব ,সবই যেন তার স্বরের মধ্যে ঢুকে  পরিচিতি তৈরি করে । মানুষগুলোকে তো কোনদিন দেখা হয়নি কিন্তু তাদের স্বরের বিস্তার মনের মধ্যে গেথে আছে । যাকগে , রেডিওর দখলদারি তো বড়দের হাতেই থাকত ।এই খবর রে ,এই খেলা রে ইত্যাদি । তারপর মায়েদের ছায়াছবির গান   ,শুক্রবারের নাটক ।আমাদের জন্য বরাদ্দ আর কততুকু ?  আমাদের ছোটবেলা শৃঙ্খলা ব্যাপারটি বড় জোরদার ছিল । রেডিওয় বাচ্চারা কি শুনবে ,সিনেমা কি দেখবে--তা বড় নির্দিষ্ট ছিল । আমাদের জন্য সিনেমা বরাদ্দ থাকত বীরেশ্বর  বিবেকানন্দ , সুভাষচন্দ্র ,মহাতীর্থ কালীঘাট । তেমনি রেডিওতেও কিছু কিছু অনুষ্ঠান শোনার অনুমতি থাকত না । হিন্দি গানশোনা , হিন্দি সিনেমা দেখা –দুটোই ছিল নিষিদ্ধ ফলের মত । আর যায় কোথা ! হিন্দি গানতো শুনতেই হবে ।  ছিল বিনাকা গীতমালা আর আমিন সায়ানির গলা। নিশির ডাকের মত । কত ছল ছুতো বার করতে হত । বিনাকা গীতমালার সময় যেন বাবা বাড়ি না থাকেন তার জন্য নিয়ত প্রার্থনা । জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে নিশ্চিন্ত হয়েই মারফি  বেবির ঠোঁটে আঙ্গুল ছবি খানার দিকে তাকিয়ে খুশির জোয়ার । টকাস করে রেডিও অন করেই নিষিদ্ধ ফলে অবগাহন । কখন কখন পরিবেশ অনুকুল না হলে মানে বড়রা সব রয়ে গেছেন । কোন উপায় নেই, একখানা অঙ্ক খাতা নিয়ে সাঙ্ঘাতিক কঠিন মুখ করে রেডিওর টেবিলে বসে পড়া ! কি মনোযোগ অঙ্কে ! কানের কাছে একেবারে লো ভলিউমে নিষিদ্ধ ফল । অদ্ভুত এক আনন্দ !  এখন তো হিন্দিগানে ডুবে থাকলেও সেই আনন্দের সন্ধান আর মেলে না ।  গান শোনারও রকম ভেদ ছিল । ক্লাসিক্যাল ,রবীন্দ্রসংগীত , নজরুলগীতি –আমাদের তো সম্ভার রয়েছে । তারপর আর কি চাই ! এই ছিল বড়দের যুক্তি ।
                   মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধের সময়কার কথা আবছা মনে পড়ে । দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্য ইতিহাস রচনা করেছিল । একদা মাতৃভূমির টান ছাড়তে না পারা মানুষগুলো কি কাতর হয়ে সারাদিন রেডিও আকড়ে বসে থাকতেনএক একটা জায়গা মুক্তাঞ্চল হয়েছে শুনলে ওদের চোখে আলো  জ্বলে  উঠত । কোন জায়গার নাম শুনলে সেই জায়গাটা যে কত চেনা সেটা বোঝাবার জন্যে ব্যকুল হয়ে উঠতেন । কোথাও কি আশা ছিল আবার নিজের মাতৃভূমিতে নিজের ভিটে পাবার ?        সেই অসাধ্যসাধন করেছিল রেডিও ।  এক টানে একদা ফেলে আসা ভিটে মাটির দোর গোড়ায়   পৌছে দিয়েছিল সেইসব মানুষকে, যাদের মনের ভেতর কুল কুল করে বইত ফেলে আসা দেশ । আমারা সাক্ষি হিসেবে সব সময় সেই ফেলে আসা স্বপ্নের দেশের গল্প শুনতাম । আর আপ্লুত হয়ে তাকিয়ে থাকতাম উজ্জ্বল মুখগুলোর দিকে । এ দেশের সবই খারাপ ও দেশের সবই স্বপ্নময়, সোনায়মোড়া । আর সেই সময় যে গানের বন্যায় ভাসিয়েছিল রেডিও সে-ও এক ইতিহাস !  
          তারপর তো এল ট্রানজিস্টারটেবিল থেকে ঠাই হল হাতে । দিব্যি ঘাড়ে, মাথায় ,বগলে চড়ে বেড়াতে লাগল । মোবাইল রেডিও । গান শোনা , খেলা দেখা ,যুদ্ধের খবর শোনা সব কিছুই হেটেচলে  বেড়িয়ে । ছায়ার মত চলেছে । তবে খেলার ধারা বিবরণীতে ট্রানজিস্টার রেডিওকে লাং মেরে যে মাঠ দখল করেছিল তা এখন চলছে । রেডিও এখন ইতিহাস ! এফ এম চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ! মোবাইল অবশ্য তার পুরান তান কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। তবে খেলার জগতে ট্রানজিসটার এখনও ব্যাটিং করে চলেছে !
জয় রেডিও মাইকি জয় ! জয় রেডিও বাবা কি জয় !      
              ~~~~~~~~~~~ 
          

কোন মন্তব্য নেই: