“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১২

আমানত


কিছু আগাছার মধ্যে বড় হচ্ছে একটি বনফুলের গাছ। গত কদিন ধরে প্রতিদিন সকালে পরখ করে দেখি কবে ফুটবে বেগুনি ফুলের গোছা। বনফুলেরা একা ফোটে না। একসাথে একই বৃন্তে বেশ কিছু ফুল জানান দেয়, তারা ফুটেছে। অযত্নে হলেও তার রুপের জৌলুসে বনে আজ সুখ লেগেছে। অহংকারী হয়ে ওঠে বনরাজী আর ঝরা পাতার দল।

হেমন্ত সকালের শিশির লেগে আছে বনফুলেদের পাপড়িতে। মনে হয় সঙ্গম শেষে ঘামে ভিজে আছে ফুলের শরীর। সবসময় দেখেছি বন্যতায় প্রকৃতি রঙ ঢালে অকাতরে। বেগুনি, লাল, গাড়ো সবুজ, হলুদ। এই সব রঙের গভীরতায় আছে এক আদীম ভালোবাসার উচ্ছ্বাস। এই জগতের যাবতীয় রঙ ঠিক করে দেয় প্রকৃতি।

আমাদের ভালোবাসার রঙ লাল, মৃত্যুর রঙ সাদা বা শোকের রঙ কালো সব নির্দিষ্ট। আমাদের আমানত এই দুনিয়া। প্রকৃতির আমানত ঈশ্বর। ঈশ্বরের আমানত সৃষ্টি।
আজ সকালে চোখ খুলেই দেখলাম রক্ত মাংসের এক আমানত সাদা কাপড়ের ঢেকে পিস অব হেভেনে জিরিয়ে নিচ্ছে শেষবার। গত কদিন ধরে উশখুশ করছিল মনটা। তেরো দিন, তেরো রাত, তেরোটি সকাল আবার প্রমান করলো ব্ল্যাক ফ্রাইডের কথা।
শুক্রবার আমার প্রার্থনার দিন। তোমার নামাজ পড়ার দিন। ভাবিনি শেষরাতে অপেক্ষা করছে এমন একটা ভয়ানক ডেট লাইন।

আজ ঈশ্বর রোদ্দুর দিয়েছেন ঢেলে আমার উপত্যকায়। অনেকদিন পর রোদে পিঠ দিয়ে কমলা খাচ্ছে পাহাড়ি ছেলে উমন। গত একবছরে আরও একটু বড় হয়েছে ছেলেটি। এই কৈশোরের সন্ধিক্ষণে বাচ্চা গুলি একটা নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেয় মনে মনেই। আজকাল বেশ সুখ এসেছে ওদের ঘরে। মাথায় টিনের ছাদ, ঘরে রঙিন টেলিভিশন, সৌরবিদ্যুতের আলো সর্বক্ষণ জ্বলে ঘরে। অনেকরাত পর্যন্ত রিমোটে চ্যানেল চেঞ্জ হয়। দুমদাম পাল্টে যায় অন্ধকারের রঙ।
ফুলবতীর শরীরে বাড়তি লাবণ্য এসেছে। মুখে মধু আর কমলার খোসার রস মেখে, বসে থাকে সকাল সকাল রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে। এরপর কাঁচা দুধ মেখে জলপাইয়ের আচার খায়। শুনেছি শীত গেলেই আবার পোয়াতি হবে ফুলবতী। এবারও মেয়ে চাই তাদের।

ফুলবতীর স্বামী আজকাল আর মধ্যরাতে দেশী খেয়ে চিৎকার করেনা। চোখ লুকিয়ে চলে। মাঝে মধ্যে আঙ্গুলের ডগায় ধরে থাকে তুলো দেয়া সিগারেট। ধোঁয়ার রিং বাতাসে উড়িয়ে, আবার নিজেই এলোমেলো করে দেয়।

নেই শুধু ফুলবতীর মেয়েটা। শুনেছি, কাঁচুলিতে বেঁধে গত চৈত্রে গাছের মগডালে ঝুলিয়ে দিয়ে এসেছে মেয়েটাকে। অকালে মরেছে এই পাহাড়ের আমানত। বছর দুই ছিল বয়েস। গোলগাল মুখ, লাল খয়েরি চুল, কাঁচা হলুদ রঙের তুলতুলে শরীর, আমপাতায় তোলা কাজল টিপ কপালে। মিষ্টি হেসেই জানান দিত পাহাড়ের সুখ আর সকাল আহ্লাদী হয়েছে এবার।
ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই মেয়ের জান নিবেদন করেছে ফুলবতী! এরপর থেকে সংসারে সুখ এসেছে। ঈশ্বর মেয়েকে নিয়ে, তাদের করে গেছে দোয়া। তাই ফিরেছে দিন।

একটা গর্হিত কাজ আমি করেছি জানো! একটা দুই লাখের ড্রাফট গত তেরোদিন ধরে আমার কাছে। এটা ফুলবতীর নামে এসেছে।
সেদিন পোস্ট অফিসে গিয়েছিলাম তোমার কোন চিঠি এসেছে কিনা তার খোঁজ নিতে। আসার কথা ছিল কিছু বই পত্তরও। কিছুই পেলাম না। মন খারাপ করে বেড়িয়ে আসছি তখন পোস্টম্যানটা ডাক দিয়ে বললো,
- বাবু কিছু যদি মনে না করেন এই চিঠিটা দিয়ে দেবেন ফুলবতীরে! যা ঠাণ্ডা পাহাড়ে, তাইলে আর আমারে যাইতে হয়না এতদূরে...।

হাত বাড়িয়ে নিলাম খামটা। ফুলবতীর নামে চিঠি! একটু অবাকই হলাম। জানি আমাকেই পরে দিতে হবে। তাই খামটা খুললাম। খুলেই দেখি এই দুলাখের ড্রাফট আর সাথে একটা ছোট্ট চিরকুটে লেখা,
'তোমার মেয়ে ভালো আছে। সব টাকা দেয়া হয়ে গেল। ও এখন আমাদের আমানত। ভালো থেকো।'
কোন নাম বা ঠিকানা লেখা নেই।

ভাবছি জানো! ড্রাফটটা কাকে দেবো! ফুলবতীর হাতে না ঈশ্বরের জন্য লটকে দিয়ে আসবো ঐ পাহাড়ের কোন গাছের মগডালে! না ঐ পাহাড়ী নদীর বুকে ভাসিয়ে দেবো!
না রেখে দেবো আমানত করে আমার কাছেই!

শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১২

দামিনীর মৃত্যু অথবা আগুনের জন্ম

 মানত নামে ঘৃণাটা আর না ছড়ালে ও চলত,
কারুর আমানত নয় ,
খোলা আকাশে একমুঠো স্বস্তির নিঃশ্বাস,
 মানুষ পরিচয়ে বেঁচে থাকা,
দাবীটা কি বড্ড বেশী ছিল?
মাতৃগর্ভ থেকে সদর রাস্তা অথবা ফেসবুকের ভুবন,
বলির আয়োজনের বীভৎসতায় ,
সপ্তরথির উন্নাসিক চিৎকারে ,
বাঁচার আশায় শিশু অভিমন্যুর,
ব্যর্থ ডানা ঝাপটানো চক্রব্যূহের দোরগোড়ায় ।
সেই ভাবেই বেঁচে থাকাই যদি জীবন হয়,
তবে মা, নারী হীনতার অভিশাপ লাগুক এবার।
এমন পৃথিবী নিপাত যাক,
যেখানে নারীর গর্ভ থেকে জন্ম নেয়,
নারী মাংস খাদকেরা।

রবিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১২

ক্রমোজোম, প্রেম, আমার জিন্স এবং তুমি/ দুই


তোমার ঠোঁটে কুয়াশাদের আশ্রয়, কপালে লেপ্টে থাকা চাঁদ, কপালে লেপ্টে থাকা এলো চুল আমার স্বপ্ন সম্ভব পৃথিবীর উপমা।
সামনে একটা কলম, তুমি আর কুয়াশার শামিয়ানায় ঢেকে থাকা চাঁদ, সেও তোমারই কথা বলে।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্রীতদাস তুলো চাষির দল তাদের ভালোবাসার নারীকে উপহার দিতে একটা বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল। সেটাই ছিল বোধহয় পৃথিবীর প্রথম বিপ্লব কোন পুরুষের, তার ভালোবাসার নারীর জন্য।
বিপ্লব জয়ী পুরুষ ক্রীতদাসের দল সেদিন মেতে উঠেছিল উৎসবের রাতে। আকাশ জুড়ে উড়িয়ে দিয়েছিল কোটি কোটি তুলোর নরম কোষ। নরম তুলোর দল হারিয়েছিল আশ্রয়। যেমন অবৈধ সুখী জন্মের পর অবাঞ্ছিত কোন শিশু আশ্রয় পায় ডাস্টবিনে। সভ্য আলোর মুক্তি নেই অচেনা এই নিয়মসর্বস্ব পৃথিবীতেও।
সেদিন প্রেম আর যুদ্ধ জয় শেষে পুরুষ তছনছ করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ তুলোর মাঠ।

প্রকৃতির সহ্য হয়নি পুরুষের এই জয়োল্লাস। তাদের ভালোবাসার নারীরা সেদিন প্রত্যাখান করেছিল তাদের যোদ্ধা পুরুষকে। নারীর হৃদয় চাই, পুরুষের শরীর আর চাই জয়, চাই অধিকার।
উপহার চাইল নারী শীতের রাতে আশ্রয়, চাইলো উষ্ণতার জন্য একটি পুরুষের পশমহীন কালো বুক। একটা খোলা পিঠ। উদ্দেশ্য একটাই অসংখ্য নির্মম প্রেমের অত্যাচার দেখে পরখ করে নেবে তার ভালবাসা আর বিশ্বাসকে।
যোদ্ধা পুরুষ ভালবেসে বড় অসহায়।
রিক্ত নিঃস্ব হাতে থাকেনা কোন উপহার।
সেই থেকে শুরু নতুন ভাবনার পুরুষের। অন্য চিন্তা। মিলন পিয়াসী পুরুষ জড়ো করতে শুরু করে পৃথিবীর সব জঞ্জাল। রিক্ত পুরুষের আর কিছুই নেই দেয়ার, তাই জঞ্জালের উপহার নিয়ে আবার নতুন করে বেঁচে থাকার গান ধরে ক্রীতদাসের দল। প্রেমিক পুরুষ প্রত্যাখান হলেই তার মধ্যে শুরু হয় একটা জেনেটিক পরিবর্তন। অসম্ভব শক্ত হয়ে ওঠে মাংশপেশী। পাল্টে যায় ঘামের গন্ধ, চামড়ার রঙ। চুলের রঙে গ্রীষ্ম দুপুরের আগুনে আভা দেখা দেয়।

পরিচিত নীল আকাশে সিঁদুরে মেঘের দাপাদাপি।

অশান্ত পুরুষকে শান্ত করতে সেদিন তাদের প্রিয় নারীরা দিয়েছিল সিঁদুর রঙা শিমূল ফুল।
অশান্ত পুরুষ হৃদয় দিয়ে, সেদিন জঞ্জাল আর শিমূল ফুলের তুলো দিয়ে সৃষ্টি করলো নারীর জন্য প্রথম উপহার। সবুজ শীতচাদর।
অসংখ্য পুরুষ ক্রীতদাস আর তাদের প্রেয়সীরা সেদিন আশ্রয় পেল শিমূল তুলোর সুখে আর উষ্ণতায়।
পুরুষ পেল নতুন আশ্রয়। জেনেটিকেল একটা পরিবর্তন এলো পুরুষ আর নারীর সম্পর্কের। পৃথিবীর সব আগ্নেয়গিরির সুখ শুধু গলছে। হাওয়াই দ্বীপের, মওনা লোয়া নিঃসৃত লাভা গড়িয়ে পড়ছে প্রকৃতির সবুজে। আশ্রয় চাইছে এক নিভৃত ফুল ভাঙ্গা জলের।

মানুষ উষ্ণতায় ভাষা খোঁজে, শীতার্ত হলেও ভাষা খোঁজে। অনুচ্চারিত শব্দ গুলির সুখ খোঁজে শিমূল ফুলের কুসুমে।
এক আকাশ সুখ চাই। এক আকাশ কথা চাই। কিছু নিঃশব্দ উচ্চারনের আজ প্রয়োজন ঝড়ে পড়ার সুখ, তোমার আকাশ থেকে।
স্তব্ধ হয়ে যাওয়া সমুদ্র আড়াল চায় পৃথিবীর কাছে। পৃথিবী আশ্রয় চায় মাটির কাছে। যুদ্ধজয়ী ক্রীতদাস পুরুষ স্পর্শ চায় তার প্রিয় নারীর। শূন্য স্তব্ধ দুই হাত দারুণ অবাধ্যতায় ঢেকে রাখে প্রকৃতির সব লজ্জা।
ক্রীতদাস প্রেমিক পুরুষ জানলো উপহার দিতে। তাদের নারী জানলো তাদের প্রিয় পুরুষকে অভ্যাস করার প্রথম কৌশল।

তোমার আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘের দল আমার নিঃসারিত নিকোটিনের অবশিষ্ট। তোমার আকাশের অসংখ্য তারায় আমার উচ্চারিত শব্দের ভিড় করে থাকা। তোমার আকাশে লেপ্টে থাকা আলোকরশ্মি তে আমার উষ্ণতা। তোমার ঘিরে থাকা উত্তুরে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়, সারাদিনের কাজের শেষে ঝড়ে পড়া ঘামের গন্ধ। তোমায় ঘিরে থাকা রাতে, আমার ক্রীতদাস শরীরের কালো চামড়ায় জমাট বাধা অন্ধকার।

এবার একেকটি জমাটবাধা কালশিটে চাবুকের দাগে খুঁজে নাও তোমার প্রত্যাখ্যানের গল্প, তোমার শেষ হয়ে যাওয়া সুখের শেষ প্রহর। কষ্ট, যন্ত্রণা আর নষ্ট আদর।

এই নিয়েই থাকি। চোখের তারায় তুমিই এসে দাড়াও বারবার।

আমার জিন্স, আমার স্বপ্ন, আমার আকাশ, তুমি, আর আমার শব্দ। আমার বেঁচে থাকা, আমার ক্রমোজোম আর এই জেনেটিক পরিবর্তনের জন্য তুমিই দায়ী। নিন্দিত এক সন্ধ্যায় শুধু খুঁজে চলা উপুড় করা সুরাপাত্রের শেষ বিন্দু। আমার নেশা ধরেনা।
আমার শব্দেরা থেমে যায়। শুধু নীরবতাই আমার শাস্তি। তোমার অসুখ। আমার বেঁচে থাকার জন্য তোমার বরাদ্দ উপহার।

পৃথিবী আজ পাল্টেছে। আজ ক্রীতদাসেরা উপহার দেয় তাদের প্রিয় নারীকে, লাল শিমূল ফুল। বিদ্রোহ হয়না আর আকাশ জুড়ে। তাই আরেকটা পরিবর্তন হয়না শিমূল ফুলের জমিতে। আরেকটা পরিবর্তন হয়না এই স্বপ্নের উপত্যকায়।
শুধু তুমি চাওনা বলে।
শুধু তুমি নেই বলে।
শুধু আমি জানি তাই... তুমি আছো বলেই.........                                                                                                  (চলবে)

শনিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১২

বিশ শতকের অনন্য সম্পাদক মোহম্মদ নাসিরুদ্দীন এবং বাংলা সাহিত্যের ‘সওগাত যুগ’


মোহম্মদ নাসিরুদ্দীন

প্রত্যাখ্যানের অন্য এক রাজনীতির কথাঃ
             “সংস্কৃতায়ন আর আরবি-ফার্সির দিকে ভাষাকে ধাবিত করবার রাজনীতি আমাদের বহু প্রাচীন, কিন্তু একে অতিক্রম করবার একমাত্র পথ কি মিলনের সরকারি বাঁধা বুলি আওড়ানো? পারস্পারিক অপরিচয়ের সমূদ্র কি কেবল কথা আর মিলনের গান গেয়েই অতিক্রম করে যেতে পারব আমরা? নাকি এর মাধ্যমে অসচেতন ভাবে নিজেরাই এক অন্যরাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছি আমি, আমরা? মিলনের তত্ব কি এই স্থিতাবস্থাকেই, সামাজিক ভাবে আরো বৈধ করে তুলছে না? সামাজিক ভাবে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহ এবং ডিভোর্সও যদি সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, তাহলে একই ভাষার দুটি সত্তার পারস্পরিক বিচ্ছেদ এবং সেই বিচ্ছেদকে মেনে নিয়েই পারস্পরিক সহাবস্থান কেন গ্রহণযোগ্য হবে না? একজন রবীন্দ্রনাথের যদি অধিকার থাকে বৈষ্ণব পদাবলীর এবং উপনিষদের ঘরানাকে প্রেরণার উৎস হিসাবে গ্রহণ করবার, তাহলে একজন মুসলমান কবিরও অধিকার আছে কোরানকে তাঁর লেখার অন্তহীন অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করবার। তাঁকে পাঠ করতে গেলে আমাদের পাঠকদেরও অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত কোরান।” কথাগুলো লিখেছিলেন কবি-প্রবন্ধিক অমিতাভ দেব চৌধুরী তাঁর ‘কবির বাড়ি’ বইতে ‘পরিচয়হীনতার আর্ত হাওয়া’ । বরাক উপত্যকা তথা সাধারণ ভাবে বাংলা সাহিত্যে অবহেলিত মুসলমান জীবন, সাহিত্যকৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে। ভালো ‘সাহিত্য’ স্থান-কালের ঊর্ধে চলে যায় বটে, কিন্তু সাহিত্যিক যে পাঠক, সাহিত্যতাত্বিকের মতোই এই সমাজেরই রোগ-শোক নিয়ে এক জীবন্ত মানুষ এবং ‘এক অন্যরাজনীতি চালিয়ে’ যেতে দক্ষ আমরা এটা প্রায় স্বীকারই করতে চাইনা।

               দীনেশ চন্দ্র সেনের সাহিত্যের ইতিহাসের বই পত্তর আজকাল সুলভ নয়। কিন্তু তাঁকে নাকচ করে গালগল্প বেশ চালু আছে । আমার কাছে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদিত ‘ময়মনি সিংহ গীতিকা’ আছে। অনেকের ধারণা দীনেশ সেন শুধু ওই জেলা থেকেই গীতিকাব্যগুলো জুটিয়েছিলেন। আসলে তিনি জুটিয়েছিলেন গোটা পূব বাংলা থেকেই। তাতে সিলেট কাছাড়েরও অনেক গীত আছে এবং এই বহু পরিচিত বইটি ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র ছোট সংস্করণ মাত্র। সুখময় সম্পাদিত বইটির কোথাও এর প্রথম প্রকাশক –সম্পাদক দীনেশ চন্দ্র সেনের একটিও বাক্য নেই। অথচ নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন এই লিখে, “ময়মন সিংহ গীতিকাকে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত করা যায় কিনা, সে সম্বন্ধে সংশয়ের অবকাশ আছে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের সময়সীমা অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। এই গীতিকাগুলি যে তার মধ্যেই রচিত হয়েছিল, তার কোন প্রমাণ নেই।” তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি ‘নদ্যার চান’ ইত্যাদি নামের উল্লেখ করেছেন এবং দুই একটিতে সুকুমার সেন উদ্ধৃত করে ‘মেঘনাদ বধে’র ভাষার ছাপ পড়েছে উল্লেখ করেছেন এবং শেষে ক্ষিতিশ চন্দ্র মৌলিকের সম্পাদিত আরেকখানা ‘প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র জালিয়াতির নথিপত্র দিয়ে শেষে লিখে দিয়েছেন, “ সুতরাং আমরা এদের সাহিত্যরস আস্বাদন করে পরিতৃপ্ত হতে পারি, এদের নিয়ে অন্য কোনভাবে গবেষণা করবার উপায় বর্তমানে নেই ।” বইটি যখন ছাত্রজীবনে পড়েছিলাম আমাদের মুগ্ধ করলেও তাঁর এই অভিমতের জন্যে সমস্ত জিজ্ঞাসাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। অনেক পরে যখন প্রশ্ন করতে শিখেছি তখনই ভেবেছি কই এইকথাগুলোতো এই পণ্ডিতেরা কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল নিয়ে বলেন না। খনার বচনের কথাতো আম জনতাও জানেন। ভাষা দেখে কি কেউ দাবি করে এগুলো বিশ শতকের বলে? দুষ্টামিটা এইখানেই। জনপ্রিয় সাহিত্যে গায়কের মুখে মুখে লিপিকারের , সংগ্রাহকের সম্পাদকের কলমে কালের আঁচ পড়েই যায়। আর ঠিক তাই এগুলো নিয়ে গবেষণার দরকারটা বাড়ে বই কমে না। দীনেশ সেন স্পষ্ট বলেছিলেন, এই সাহিত্যগুলো বাংলাদেশে বৌদ্ধবিস্তারের সময় থেকে লেখা, গাওয়া এবং শোনা হচ্ছিল। সেন ব্রাহ্মণ্যবাদ বাংলার পশ্চিমের যেখানে যেখানে জাঁকিয়ে বসেছিল সেখানেই এই ধারা শুকিয়ে যাচ্ছিল। এগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তার বাইরের পূবের লোকেরা। বিশেষ করে পরের কালের মুসলমানেরা। কেননা তারা এসছিলেন ব্রাত্য সমাজ থেকে আর এগুলো ব্রাত্য সমাজের গান।“নব্য –ব্রাহ্মণ্য যেসকল স্থানে সেন রাজত্বে প্রবেশ করিতে পারে নাই, সেই খানেই ইহাদের প্রাচুর্য, যেহেতু এই সকল পল্লীগীতিকা সেই সকল স্থানে বহুদিন রাজত্ব করিয়াছে।” ( প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান; পৃঃ ৯৪) পশ্চিমের লোকেদের অবজ্ঞা-উপেক্ষার আঁচ তিনি জীবৎকালেই প্রবলভাবে অনুভব করেছিলেন । এবং বহুবার সেই অনুভব ব্যক্ত করেছিলেন। তার একটি এই “এই সাহিত্যের নানাদিক হিতে বিচার করিলে দেখা যাইবে যে , তাহা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সর্ব্ব-সম্প্রদায়ের অতীব উপভোগ্য।শুধু তাহাই নহে, এই নিরক্ষর চাষাদের সাহিত্য এতো বড় যে , তাহার চূড়া বড় বড় শিক্ষিত কবিদের মাথা ছাপাইয়া উঠিয়াছে, আমি লিখিয়াছি পশ্চিম বঙ্গের লোকেদের মধ্যে অনেকেই এই সাহিত্যের গুণে ও অপরাজেয় কাব্য-সৌন্দর্যে মুগ্ধ। কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ আমার প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের জন্যে, কেহ কেহ বা পূর্ববঙ্গের প্রতি বিরূপতার দরুণ এই সাহিত্যকে তাদৃশ্য আদর করেন নাই। বিদ্বিষ্ট ব্যক্তিদের কথা ছাড়িয়া দিলেও এই গীতি সাহিত্যের ভাষা তাহাদের নিকট কতকটা দুর্ব্বোধ এবং শ্রুতিকঠোর । তজ্জন্য তাঁহারা সকলে ইহার রসাস্বাদনের অধিকারী হইতে পারেন নাই।” (ঐ;পৃঃ ৯০) এই সাহিত্যগুলোতে সেকালের হিন্দু মুসলমানের যুগলমূর্তির যে ধর্মবিশ্বাস সম্পর্করহিত চরিত্র দেখে দীনেশ সেন মুগ্ধ ছিলেন সেগুলোকে ব্রাহ্মণ্যপরম্পরা কোনোকালেই সহজভাবে নেয় নি। তিনি লিখছেন,“ এক শতাব্দী পূর্ব হইতে নব্য-ব্রাহ্মণ্য ধীরে ধীরে ভৈরব নদ পার হইয়া কংশ, ধনু এবং ফুলেশ্বরীর তীরদেশে প্রবেশ লাভ করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান একত্র হইয়া যে সাহিত্যের রসাস্বাদন করিয়াছে তাহা তাহাদের মনঃপূত হয় নাই। এই গাথা সংগ্রাহকগণ আমাকে জানাইয়াছেন, ‘এই সকল গীতিকথা এবং পালাগান উচ্চশ্রেণীর হিন্দুগণ অনুমোদন করেন নাঃ তাঁহারা তাহাদের বাড়ীতে এই সকল গান গাহিতে দেন না। ইহাতে প্রাপ্ত-বয়স্কা কুমারীগণের স্বেচ্ছাবর গ্রহণের কথা আছে । ব্রাহ্মণ ও ঠাকুর দেবতার প্রতি ভক্তির কথা নাই, ইহাতে ইতর জাতির নায়কদের প্রসঙ্গ আছে। এবং জাতি নির্বিশেষে নির্বিচার বিবাহ প্রথার কথা আছে।” ( ঐ; ৮০)

                  এর পরে কি আর আমাদের নতুন করে কোন আধুনিকতার তত্ব বিলেত থেকে আমদানী করবার দরকার ছিল? সে আধুনিকতা হোক প্রাক-রাবীন্দ্রিক কিম্বা ‘কল্লোলীয়’ উত্তর-রাবীন্দ্রিক! আমরা লিখব বিশ শতকের একটি বিখ্যাত কিন্তু ভারতে উপেক্ষিত কাগজ ‘সওগাত’ নিয়ে যেটি অবিভক্ত বাংলার সাহিত্যের ‘আধুনিকতা’র ধারক ছিল। আমাদের কথা বলতে হবে সাহিত্যের ‘আধুনিকতা’ নিয়ে। কিন্তু সে কোন আধুনিকতা? কল্লোল –কালিকলম বাদ দিন, মাইকেলের যে কাব্য-নাটকগুলো পড়ে আমরা বললাম, আধুনিক সাহিত্যের কেন্দ্রে থাকবে না ঈশ্বর কিম্বা ধর্ম ---থাকবে মানুষ, থাকবে না বিশ্বাসের কুসংস্কার বরং তার বিরোধিতা---‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র গল্প জানবার পর সেই আধুনিকতা দাঁড়ায় কিসের জোরে? হয়তো কাব্যগুণে মাইকেলের ‘সোমের প্রতি তারা’ অনেক বেশি উজ্জ্বল কিন্তু ভাববস্তুর দিকে ‘মঞ্জুর মা’ পালা কোন অংশেই হেয় ছিল কিসে? কিন্তু বিলেতিরা আমাদের শেখালেন তাঁরা আসবার আগে ইতিহাসের ধর্মান্ধতার একটা যুগ দেখতেই হবে চোখে আর বিলেতি ধাঁচে তার নাম দিতে হবে ‘মধ্যযুগ’ যার থেকে আমাদের মুক্ত করেছে বিলেতি শিক্ষা। ঈশ্বরের বদলে এবারে আমাদের আস্থা জানাতে হবে সেই শিক্ষার প্রতি। তাই আমাদের সাহিত্যের ঐতিহাসিকেরাও মোটের উপর তাদের বিশ্বাস ভরসাকে সারপানি যোগায় এমন সব গ্রন্থকে নিয়ে ব্যস্ত হলেন আমাদের ইতিহাসটাকে দাঁড় করাতে। এবং ধর্মান্ধতাকে প্রতিস্থাপন করল আরো বিপজ্জকনক বিষয়--- সাম্প্রদায়িকতা। আমরা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে সংগত ভাবেই তার প্রাপ্য মর্যাদা দিলাম , কিন্তু শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জুলেখা’কে নিয়ে সন্দিহান হলাম। পূর্ব বঙ্গের সাহিত্য নিয়ে প্রথম গবেষক দীনেশ চন্দ্র সেন যাই বলুন না, আমাদের আধুনিক গবেষককে লিখতেই হবে, “... ‘রূপবতী’তে হিন্দু নারীর প্রতি মুসলমান রাজপুরুষের কুদৃষ্টি এবং তার সাংঘাতিক পরিণাম বর্ণিত হয়েছে। এই পালাগুলি মুসলিম আমলের একটি তিক্ত বিষয়ের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।”( সুখময় মুখোপাধ্যায়;ভূমিকা; ময়মন সিংহ গীতিকা;পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ; ১৯৮২; প্রকাশক ভারতী বুক স্টল) এই মুসলিম আমলেরই অন্যনাম ‘মধ্যযুগ’ কে না জানেন? দীনেশ সেন সেই সেকালেই এই যুগবিভাজন নিয়ে প্রশ্ন তুলে লিখেছেন, “এই অবজ্ঞাত সাহিত্য শিক্ষিত সম্প্রদায়ের দ্বারা উপেক্ষিত। আমরা জনাকতক শিক্ষাভিমানী লোক ইংরাজির শিক্ষানবিশী করিয়া গত অর্দ্ধ শতাব্দীর মধ্যে যে একটি অর্দ্ধ-পক্ক সাহিত্যের সৃষ্টি পূর্বক তাহারই স্পর্দ্ধায় গগন-মেদিনী কাঁপাইতেছি, তাহাতেই বঙ্গ সাহিত্যের আদিযুগ ও মধ্যযুগ পরিকল্পনা করিয়া তৃপ্তিলাভ করিতেছি, অথচ এই সাহিত্যকে কেহ কেহ ফিরিঙ্গিয়ানা দুষ্ট বিকৃত সাহিত্য মনে করিয়াছেন। ( ঐঃপৃঃ ১০০)

                    সাহেবদের অনুমোদন না পেলে কোনো কথা গ্রহণ করে না বাঙালি—এই সত্য জেনে তিনি তাঁর পক্ষে প্রচুর প্রমাণ পত্র যোগাড় করেছিলেন সাহেবদের থেকে। এমন কি র‍্যোঁমা রোলা-র থেকেও। আমাদের পূর্বোত্তরেও কোন কথা ততক্ষণ না দাঁড়ায় যদি ‘আধুনিক’ পশ্চিমের মহানাগরিক বাঙালি তাত্বিকেরা সমর্থন না যোগান। সাধারণত আমি এই ‘পশ্চিমা’দের প্রতি ভক্তির বিরোধিতা করতে গিয়েই তাদের এড়িয়ে চলি। আমাদের যে সাহিত্য-কর্মীকে নতুন জিজ্ঞসা বিব্রত করে তাদের তুলে আনি। এখানেও তাই করেছি শুরুতেই। তবু, জাতে উঠতে গেলেতো কখনো প্রথার অনুগমন করতেই হয়। দীনেশ সেনের প্রতিধ্বনী এখন সর্বত্র শোনা যাচ্ছে সজোরে নতুন করে। আমারা দেবেশ রায়ের থেকে পড়াচ্ছি তার কতকটা, “...আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে ধ্বংস করে দিয়ে সম্পূর্ণ বিদেশী একটি ইতিহাসের কার্যকারণের শৃঙ্খলা সেই ধারাবাহিকতার ওপর অস্ত্রের জোরে চাপিয়ে দেয়া হলে আমরা তাকেও সাহিত্যের ইতিহাসে ও অন্যান্য ইতিহাসে আমাদের নিজস্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যকারণের সঙ্গেই মানিয়ে নিই। যেন বা ইংরেজের ভারত জয়টাও ঘটেছে সেই মহেঞ্জদড়ীয় ও আর্য বৌদ্ধ মৌর্য ভারতের ইতিহাসেরই নিজস্ব গতিতত্বে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চৈতন্য-উদ্দীপিত বৈষ্ণব সাহিত্যের ইতিহাসের পর ইংরেজ প্ররোচিত সাহিত্যের নানা ধরণের ইতিহাসের মধ্যে যেন কোন বিচ্ছেদ নেই। যেন চৈতন্য যে মানবীয় সাহিত্যের বাস্তব অবলম্বন তাই বিকশিত হয়ে উঠল উনিশ শতকে কবিতা, নাটক, উপন্যাসের নানা নতুনত্বে। ইতিহাসের ভেতর ধারাবাহিকতা আবিষ্কারের ঝোঁকে আমরা এ কথা ভুলে যেতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে ভারত বর্ষে ইতিপূর্বে যত বিদেশি শক্তি সামরিক দাপটে এসেছে সেগুলির অব্যবহিত সাংস্কৃতিক উপাদান ভারতীয় উপাদানে পরিণত হয়েছে কয়েক শ বছর ধরে আত্তীকরণের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। মাতৃগর্ভে ভ্রুণের বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে তার হয়তো কিছুটা তুলনা চলে। কিন্তু ইংরেজের কাছে সংস্কৃতির কোন আলাদা উপকরণ ছিল না। ইংরেজের সংস্কৃতি ছিল তার সাম্রায্যনীতির অপরিহার্য অংশ আর সে কারণেই ইংরেজের পক্ষে সম্ভব ছিল না শতাব্দীব্যাপী গর্ভাধান। ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর ইংরেক সংস্কৃতির সেই আরোপকে তুলনা করা যায় ধর্ষণের সঙ্গেই মাত্র—সে ধর্ষণের ফলেও গর্ভাধান হতে পারে বটে কিন্তু সে ভ্রূণ মানবিক শারীরিক নিয়মেই কেবল বড় হয়ে উঠে না, শরীরের বিকারের নিয়মেও বেড়ে ওঠে।“ ( দেবেশ রায়; বাংলা উপন্যাস;উপন্যাস নিয়ে;দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০৩, দে’জ পাবলিশিং; পৃঃ১৫)

           জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’কে নিয়ে রসিকতা করা আজকাল খুব কম বাঙালি পাঠক সহ্য করবেন। অনেকে মনে করেন তিনিই নাগরিক বাংলার মুখ ফিরিয়েছেন ‘ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে’। তিনিও পুরো বাংলার মুখ দেখেননি , দেখেছেন যা নগর দেখিয়েছে--এই কথাতো হজমই হবে না অনেকের। দীপেন্দু চক্রবর্তী সেই রসিকতাও করে রেখেছেন বছর কয় আগে। “ বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি;--তিনি আপন মনে আওড়াচ্ছিলেন। আমি বললাম, ‘বাংলার মুখ আমিও দেখিয়াছি। তবে সে অন্যমুখ।’ তিনি অবাক হলেন, ‘বাংলার কটা মুখ?’—বলুনতো কটা হতে পারে?—আমিতো একটাই জানি।–এ জন্যেইতো সর্বনাশটি হয়েছে। বাংলার কোনো মুখই নেই। জীবনানন্দ প্রায় মুর্ছা যাচ্ছিলেন। আমি শুধরে নিয়ে বললাম, ‘মানে মুখ থাকলেও তার কোন অবেজেকটিভ অস্তিত্ব নেই। ওটা Cultural Construct ---মানে যে যেমন ভাবে পারে বাংলার মুখ বানাতে পারে। ঠিক এই অর্থেই বাংলার মুখ একটা নয় একাধিক।” ( ফুকোমুখো বাংলা” উত্তর আধুনিক আবোল-তাবোল; অনুষ্টুপ;শারদীয় ১৪০৮)

সেই ‘সংবাদ প্রভাকরে’র দি ন থেকে বেরোনো অচেনা যত কাগজের কথাঃ

           মোহম্মদ নাসিরুদ্দীনের স্বপ্ন বেশি কিছু ছিলনা। ঐ ধর্ষণ-জাত আধুনিকতারই শরিক হবারই ইচ্ছে ছিল। এবং ইচ্ছে ছিল নতুন ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্তকে সেই দিকে আকৃষ্ট করবেন। তিনি ‘সওগাত’ কাগজ করেছিলেন। তাঁর মতে এটি সূচনা করেছিল বাংলা সাহিত্যে ‘সওগাত যুগে’র। নজরুলের জীবনী পড়তে গিয়ে আমরা ‘সওগাত’ কাগজের নাম শুনেছি স্কুল জীবনেই। কিন্তু সেটি আবার কোন ‘যুগে’র প্রবর্তন করেছিল তাও আবার কল্লোল-কালিকলম-কবিতা-র মতো শুনলে আমাদের ‘আধুনিকতা’ এখনো ভীরমী খাবে! কে সে নাসিরুদ্দীন! আমরা নামই শুনিনি! তাঁর বই ‘বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগে’ তিনি লিখছেন, আধুনিকতা যেমন করে শুনতে চায় তেমন করে, “বাঙালি মুসলিম সমাজের এক অন্ধকার যুগে—যখন অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতায় আমাদের সমাজ ছিল আচ্ছন্ন; মাতৃভাষা, সাহিত্য ও শিল্প –সংস্কৃতি ছিল অবজ্ঞাত; ধর্ম ও সমাজের নামে কতকগুলি বাধা নিষেধের বেড়া জালে জড়িয়ে ছিল বাংলার মুসলমান; যে কালে অধঃপতিত বাংলার মুসলমান সভ্য সমাজে আত্ম-পরিচয় দিতেও দ্বিধাবোধ করতো—সেই অন্ধকার যুগে সাহিত্যিক বা বিত্তশালী নয় এমন একটি অখ্যাত ও অজ্ঞাত মুসলিম যুবকের আধুনিক সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে চাঞ্চল্যকর অভিযানের ঘটনাবলী প্রকাশ করার ঐতিহাসিক মূল্য আছে বলে মনে করি” ‘আধুনিকে’দের যেমন দোষ –পূর্বতন সবাইকে হেলায় উড়িয়ে দেয়া --নাসিরুদ্দীনও তাই করেছেন এই লিখে, “মাতৃভাষা, সাহিত্য ও শিল্প –সংস্কৃতি ছিল অবজ্ঞাত...” তাঁর কাগজটি প্রথম বেরোয় ১৯১৮র নভেম্বর ডিসেম্বরে, ১৩২৫এর অগ্রহায়ণে। তার প্রায় এক শতক আগে থেকেই সেই ‘সংবাদ প্রভাকরে’র দিন থেকেই বেরুচ্ছে মুসলমান সম্পাদিত বাংলা কাগজ। ১৮৩১এ প্রকাশিত’ সামাচার সভারাজেন্দ্র’, যার নামে চেনা ‘মুসলমান গন্ধে’র ছিঁটেফোটাও নেই, ছিল কোনো মুসলমান সম্পাদিত প্রথম কাগজ। ফারসি-বাংলা দ্বিভাষিক ছিল। দ্বিতীয়-তৃতীয় কাগজের নাম ‘জগদ্দুদ্দীপক ভাস্কর’ ( ১৮৪৬), ফরিদপুর দর্পণ ( ১৮৬১) পারিল বার্তাবহ (১৮৭৩)। প্রথম যে আরবি নামের কাগজটি মেলে সেটি প্রখ্যাত মীর মুসারফ হুসেনের স্ত্রীর নামে, তাঁরই সম্পাদিত, ‘আজীজন নেহার’ ( ১৮৭৪)। এর পরেরটি আবার ‘সুধাকর’ (১৮৮৯)। সম্পাদক শেখ আবদুর রহিম। এনার পৌত্র পরের কালের প্রখ্যাত লেখক আনিসুজ্জামান। এনার সঙ্গে ছিলেন সেকালের আরো তিন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব মেয়রাজ উদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন, এবং আলিয়া মাদ্রাসার সংস্কৃতের পণ্ডিত লেখক চিন্তক রেয়াজ-অল-দীন আহমদ মাশহাদী। পরে কাগজটি মিহিরের ( ১৮৯২) সঙ্গে মিলে হয়ে যায় মিহির ও সুধাকর( ১৮৯৫)। এছাড়াও রহিম সেকালে অনেক গুলো কাগজে হয় সম্পাদক নতুবা সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে জড়িয়েছিলেন। সেগুলো ছিল হাফেজ ( ১৮৯৭), মোসলেম প্রতিভা, মোসলেম হিতৈষী (১৯১১) এবং ইসলাম দর্শন ( ১৯১৬)। এগুলো যে হিন্দুদের বিরুদ্ধাচরণ করবার জন্যেই বেরুচ্ছিল তা নয়। এরকম ‘হিন্দু হিতৈষী( ১৮৬৪) নামে কাগজও বেশ পুরোনো ছিল। এবং সেকালের লেখা লেখি পড়লে দেখা যাবে হিন্দু কিম্বা মুসলমান কোন পক্ষই পরস্পরের ধর্ম দর্শন নিয়ে কম মেতেছিলেন , বেশি চিন্তা ছিল ক্ষমতাধর খৃষ্টান মিশনারীদের প্রচারের বিপক্ষে আত্মপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা। এই যে প্রতিবেশি ধর্ম-দর্শন নিয়ে আলোচনার স্বল্পতা সেগুলো বরং অন্য সমস্যা দাঁড় করাচ্ছিল। দু’পক্ষই তখন ধর্মের নতুন প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিচ্ছিলেন আর নিজেদের পরস্পরকে চেনাজগতের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। মীর মোসারফ হোসেন গো-হত্যা বিরোধী প্রচারে যোগ দিলে ‘সুধাকর’ তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সেরকম ব্যাপার ঘটছে কম। আবার মিশনারীদের প্রচারের বিরুদ্ধে কলম ধরবার সবটা তাদের সংগে কাজিয়া করবার জন্যেও নয়, গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্যেও বটে। ১৮৯৮ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত থেমে থেকে কুষ্ঠিয়া থেকে বেরুতো ‘মাসিক কোহিনুর’। এর সম্পাদনা মণ্ডলিতে অনেক হিন্দুও ছিলেন। এবং কাগজটি সম্প্রীতির পক্ষে সওয়াল করত।এরকম আরেকটি কাগজ ‘ছোলতান’ ১৯০১ থেকে বেরিয়ে থেমে থেমে অনেক দুই দশকের বেশি বেরিয়েছিল। ১৯০৩ থেকে যাত্রা শুরু করে মাসিক ‘নবনূর’ এবং ‘মোহাম্মদী’। ‘মোহাম্মদী’ আহলে হাদিস পন্থী কাগজ ছিল, কিন্তু অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছেপেছিল এবং এই ‘নবনূরে’ই আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বেগম রোকেয়া হোসেনের। ‘নবনূর’ ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধাচরণে, নারী অধিকার এবং সাধারণ শিক্ষা বিস্তার এবং বাংলাভাষার মর্যাদার প্রশ্নে গুরুত্ব আরোপ করত। ‘মোহাম্মদী’ দীর্ঘজীবি ছিল এবং বেশ বিখ্যাত হয়েছিল। ‘সওগাতে’র মতোই কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করে মাঝে মধ্যে থেমে থেমে বেরোতে থাকে। দেশভাগের পর ঢাকাতে চলে যায়। এবং মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বেরোতে থাকে।

           রোকেয়া হোসেনের নামে আমাদের প্রগতিশীল হৃদয় স্পন্দিত হয় এখনো। কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হয় যেন, ইনিতো একক চন্দ্রমা ধর্মান্ধকার আকাশে। বাকিরা ভীষণ গোঁড়া। এই নিয়ে আমরা অন্যত্র লিখব। আমরা তাঁর বড় বোনের কথাটি পর্যন্ত ভুলে যাই। যাকে তিনি তাঁর ‘মতিচূর’ গ্রন্থের ২য় খণ্ড উৎসর্গ করেছিলেন। মীর মশাররাফ হোসেন তাঁর জমিদারিতেই ম্যানেজার ছিলেন এবং ‘বিষাদ সিন্ধু’র প্রথম সংস্করণ উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর অনুদানে প্রকাশ পেত ‘আহমদী’ (১৯২৩) নামে একটি কাগজ। সম্পদনা করতেন আব্দুল হামিদখান ইউসুফজয়ী। প্রথম মহিলা সম্পাদক বেগম সুফিয়া খাতুন এর দু’বছর আগেই চট্টগ্রাম থেকে বের করতেন কাগজ ‘আন নেছা’ ( ১৯২১)। নারী কল্যাণ এদের উদ্দেশ্য ছিল। সুতরাং রোকেয়া হোসেনও হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েন নি, যেমনটা ভাবা হয়। কিন্তু এই দশকেই বেরিয়ে ১৯৫২ অব্দি টিকে ছিল মহিলা সম্পাদিত যে কাগজ তার নাম ‘বর্ষবাণী’। সম্পাদনা করতেন জাহানারা বেগম চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুধীন্দ্রনাথ, লীলা মজুমদার থেকে শুরু করে আশাপূর্ণা দেবী তাঁর সেই কাগজে নিয়মিত লিখে গেছেন। সমকালের কোন প্রখ্যাত লেখকই বাদ পড়েন নি প্রায় তাঁর কাগজের লেখক তালিকা থেকে। বছরে একবার বেরুতো ঢাউস সাইজে। পূজা বার্ষিকী যেমন হয়। আমাদের ইতিহাস তাঁর সম্পর্কে একেবারেই নীরব। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ বেরিয়েছিল ১৯১৮র এপ্রিলে ‘সওগাতে’র বেশ কয়েক মাস আগে। মুজজফর আহমদ, মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ সেকালের বাঘা বাঘা পণ্ডিত সমাজ কর্মীরা এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রচুর হিন্দু লেখকেরাও লিখতেন সেই কাগজে। আরেকটি কাগজ ছিল মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় ‘মুসলিম ভারত’। এই কাগজের প্রচ্ছদে লেখা থাকত রবীন্দ্রনাথের একটি আশীর্বাণী, “ মানব সংসারে জ্ঞানালোকের দিয়ালি উৎসব চলিতেছে। প্রত্যেক জাতি আপনার আলোটিকে বড় করিয়া জ্বালাইলে তবে সকলে মিলিয়া এই উৎসব সমাধা হইবে।” এগুলোতে হিন্দু লেখকেরা লিখতেন বটে। পড়তেনও হয়তো। কিন্তু সাধারণ হিন্দুমধ্যবিত্তদের মধ্যে মুসলমান সম্পাদকের কাগজ পাঠক পেত না। নামে ‘মুসলমান’ না থাকলেও। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এই কাগজের এক প্রধান লেখক, যিনি পরে ‘সওগাতে’ গিয়েও তাই হবেন।

             সুতরাং নাসিরুদ্দীনের এই দাবি সত্য নয় বোঝা গেল, “মাতৃভাষা, সাহিত্য ও শিল্প –সংস্কৃতি ছিল অবজ্ঞাত।” আসলে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন একেবারেই অসাহিত্যিক এক প্রেরণা থেকে। স্কুলে পড়া বয়স থেকেই বই পত্তর পড়বার প্রতি তাঁর দারুণ আগ্রহ। কিন্তু মুসলমানের সম্পাদিত কোন কাগজে ছবিছাপা না দেখে তিনি বিব্রত বোধ করতেন। তাঁর পাড়া প্রতিবেশেও গান-নাটকের উপর নিষেধাজ্ঞা তাঁকে ভাবাতো। ছবিসহ কাগজ ছাপবেন এমন একটা আগ্রহ তাঁতে চেপে বসেছিল। এই ছবিটাও আসলে আম মুসলমান জীবনের ছবি নয়। যে স্কুলে তিনি পড়তেন সেটির নাম বলে দেবে, তাঁর এই প্রেরণার কারণটি কীঃ এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন । এগুলো আসলে ধর্মসংস্কারোন্মুখ, আসরাফ –আতরাফে ঐক্যস্থাপনে উন্মুখ নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছবি। তাতে তীতুমীরের 'তরিকা-ই-মুহম্মদীয়া' এবং হাজী শরীয়তউল্লাহের 'ফারায়েজী আন্দোলন' চাপ এবং তাপ কিছুটা থেকে থাকবে। নতুন করে তখন মধ্যবিত্তদের মধ্যে আহলে হাদিস পন্থাও জনপ্রিয় হচ্ছে। টুকটাক ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে তীতুমীর বা শরীয়তউল্লাহেরা যখন অনৈশ্লামিক সংস্কার ছাড়িয়ে মুসলমান জনতাকে এবং হিন্দু নিম্নবর্ণের কৃষকদের ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের বাইরে বের করে নিয়ে যেতে চাইছেন তখন শুধু যে সামন্তশ্রেণি বা বৃটিশ প্রশাসনই এদের বিরুদ্ধে নেমে পড়েন তাই নয়, যেকোন সংস্কারকের মতোই আম মুসলমানেরও নানা প্রশ্নকে মোকাবিলা করে তাদের এগুতে হচ্ছিল। নইলে মুসলমানেরা খুব গান করতেন, বাজনা বাজাতেন, যাত্রা পালাতে যোগ দিতেন। এমন কি ছবি ছাপানো বইপত্তরেও মুসলমানরা পিছিয়ে ছিলেন না কিছুতেই। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ছিল বটতলার বই আর বটতলাই যদিও বই ব্যাবসার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল নতুন মধ্যবিত্ত সেগুলোকে লুকিয়ে পড়লেও, প্রকাশ্যে ফিরেও তাকাতেন না। বিস্তৃত এখানে লিখবার সুযোগ নেই। আমরা সেরকম একটি বইএর ছবি এখনে তুলে দিচ্ছি। মুসলমান বড় মৌলবাদী এবং ধর্মান্ধ ছিল এই ধারণাকে নাকচ করবার জন্যে এই ছবিই যথেষ্ট। এই দেবতাকে চেনা আজকের যেকোন নব্য শিক্ষিত আধুনিক সংস্কারকের পক্ষেও বড়ই কঠিন।

               সিনেমা মানুষকে ধ্বংস করে এই বোধ টিভি আসবার আগেও ব্যাপক ছিল, দুই দশক আগেও উপন্যাসের বিরুদ্ধে কানাঘুসো শোনা যেত। মেয়েরা ‘থেটার’ করলে ভ্রষ্টা হয় এই সংস্কার দেশভাগের আগেও ব্যাপক ছিল সাধারণ হিন্দু উচ্চবিত্ত সমাজেও। মুসলমানদের মধ্যেও সমস্যা ছিল তারা সংস্কার পরবর্তী সমাজকে আরব্য ওয়াহাবী ধাঁচে গড়ে তুলবেন না সাহেবী বিলেতি ধাচে, অথবা দুটোই মিশিয়ে তৃতীয় কিছু । রামমোহনীয় বেদান্ত কিম্বা বিবেকানন্দের হিন্দুপুনরুত্থানবাদ শুরু থেকেই রাজনৈতিক ভাবে বিলেতি ধাচের সংগে একটা আপস করে নিয়েছিল, ঈদকে প্রতিস্থাপিত করে বড়দিন তাই হিন্দুদের কাছে গৃহীত প্রিয় উৎসব হয়ে উঠে , --—তাতেই বেশ কিছু গুণগত ভিন্নতা দেখা গেছিল, অন্যথা ব্যাপারগুলো মুলগত ভাবে একই ছিল । ইসলামের কোন সংস্কার যে বাংলানবজাগরণের ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদা পায়নি তার একটি কারণ অবশ্যই ছিল শ্রেণিগত। এই যেমন নববর্ষের দিনটিই ছিল খাজনা আদায়ের জন্যে নির্ধারিত। সেদিন জমিদারেরা রীতিমত উৎসব তথা মেলার আয়োজন করতেন। সেই উৎসবে বিচিত্র পুজা পার্বন গীত বাদ্য মদ জুয়া ইত্যাদি হতো। একে বলা হতো ‘পুণ্যাহ’ উৎসব। যাতে হিন্দু-মুসলমান প্রজা নির্বিশেষে যোগ দিতেন। স্বাভাবিক ভাবেই খাজনা প্রশ্নে যে কৃষকেরা বিদ্রোহ গড়ে তুলবেন তাদের এই উৎসবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। এবং এক বৃহত্তর ধর্মদর্শনের মোড়ক ছাড়া এগুলো সম্ভব হতো না। তীতুমীর বা শরীয়তউল্লাহেরা এগুলোই করেছিলেন। ফলে একদিকে যেমন খাজনার চাপে অতিষ্ট হিন্দু দলিত জনতাও তাদের সঙ্গ দিল, জমিদার মাত্রেই তাদের বিরুদ্ধে গেল। এবং ধর্মান্ধ বলে দেগে দিল। যা পরের কালে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাকেও সবল করে ফেলে। এই ভাবনাগুলোই পরে উঠতি মুসলমান মধ্যবিত্তদের মধ্যেও ছড়িয়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক ছিল। এদিকে যখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদে হিন্দু মোড়ক পরানো হচ্ছে, মুসলমান তার সঙ্গে মিশে যাবেন এটা আশা করাইতো ছিল অস্বাভাবিক। যে মীর মশাররাফ হোসেন প্রথম জীবনে ‘গোজীবন’ লিখে গো-হত্যা বিরোধী প্রচারে নামছেন, তিনিও পরের জীবনে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদে’ হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। এসব কারণেই ‘মিহির এবং সুধাকরে’ যখন নাটকের বিজ্ঞাপন এবং আলোচনা বেরুচ্ছে ‘ইসলাম প্রচারক’ তার প্রবল বিরোধিতা করে আশঙ্কা করছে এরা মুসলমান পাঠককে ঘোর ‘নরকে’ নিক্ষেপ করতে চাইছে।

চাঁদপুর থেকে কলকাতাঃ 'সওগাত যুগে'র শুরুর কথাঃ

          মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীনের সমস্যা দেখা দিচ্ছিল এই নব্য-মুসলমানদের নিয়ে এটা আমরা শুরুতেই বুঝে নিলে ভালো। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়াতে লেখা পড়া আধাতে ছেড়েই তাঁকে কাজের সন্ধানে বেরুতে হয়। স্টিমার ঘাটে কিছুদিন স্টেশন মাস্টারের চাকরি করে, বিমার ব্যবসাতে যোগ দেন। সামাজিক আপত্তি ছিল বিমা ব্যবসাতে। সেগুলো অতিক্রম করেই বেশ টাকার মুখ দেখছিলেন। বিয়েও সেরে ফেলেছিলেন তখনই। এগুলো ছিল প্রস্তুতি পর্ব। কিছু টাকা জমিয়ে নিজের বাড়ির কাছে চাঁদপুরে বইএর দোকান খুলে বসেন। তাঁর মানসিকতা বুঝতে নামটি গুরুত্বপূর্ণ-- ‘ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরী’। কিন্তু মুসলমানের লেখা বই পত্তরের অভাব তাঁকে ভাবালো খুব। ‘ভালো’ বই পত্তর কিচ্ছু নেই। যা আছে সবই বটতলার পুথি পাঁজি। ব্যবসা তিন বছরের বেশি চলল না, লোকসানে বন্ধ হয়ে গেল।

              কিন্তু এই লোকসান তাঁকে আরো জেদী করে তুলল। তিনি পূব বাংলার চাঁদপুর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে গেলেনে কলকাতাতে ‘ভালো’ কাগজ করবেন বলে।এবারে, ভালো কাগজ মানে, শুরুতেই যেটি হবে সচিত্র। অনেকেই হতাশ করলেন তাঁকে ‘গুনাহ’ হবে বলে। অনেকে সঙ্গও দিলেন। তার মধ্যে ছিলেন এক মৌলানাও। ইনি আগে থেকেই ‘দ্য মুসলমানস’ নামে একটি কাগজ সম্পাদনা করতেন। শুরুতেই একটি কোম্পানি খুলে কাজ শুরু করবেন ভাবলেন। নাম দিলেন ‘মোসলেম প্রিন্টিং এণ্ড পাব্লিশিং কোং’ কিন্তু জমবার আগেই এটি ডুবে গেল। টাকা লগ্নি করবার লোক বেশি পাওয়া গেল না। ফলে কোম্পানি উঠে গেল। সোজা ব্যক্তিগত মালিকানাতে ‘সওগাত’ নামে কাগজে হাত দিলেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল পুরো মুসলমান লেখকদের কাগজ হবে, কিন্ত পাঠক হবেন হিন্দুরাও। শুরুতেই ছবির চিন্তা। মুসলমান চিত্রশিল্পী পেলেন না, যাঁকে দিয়ে ছবি আঁকাবেন। গণেশ ব্যানার্জি বলে এক শিল্পীকে দিয়ে আঁকালেন। যেমন লেখা চাইছিলেন মুসলমানদের মধ্যে তেমন বেশি পাচ্ছিলেন না। হিন্দুদের দ্বারস্থ হতে হলো। সেকালের খ্যাত নামা অনেকেই লিখলেন, তারমধ্যে ‘ভারতবর্ষে’র সম্পাদক জলধর সেন, ঐতিহাসিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মানকুমারী বসু, কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের মতো কবিরাও। বেগম রাকেয়া সেই প্রথম সংখ্যাতেই লিখলেন কবিতা ‘সওগাত’। প্রবন্ধ লিখলেন, ‘সিসিম ফাক’। কায়কোবাদ, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী এমন বেশ কজন মুসলমান লেখকেররাও লিখলেন। কিন্তু এহ বাহ্য, এই কাগজ হৈচৈ ফেলল ১৮ খানা ছবি আর কার্টুনের জন্যে। তার মধ্যে বেশ কতকগুলো মানুষের ছিল। ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখলেন অনেকে। তার মধ্যে একটি ছিল ফরিদপুরের ফরায়েজী নেতা বাদশা মিয়ার লেখা। বাদশা মিয়াকে তিনি সহজেই ‘সওগাতে’র গ্রাহক করে ফেলেন। বাদশা মিয়া লিখেছিলেন ছবি ওয়ালা কাগজ ঘরে রাখলে নামাজ পড়া যাবে না। নাশিরুদ্দীন তাঁকে চিঠি লেখেন, যদি ইংল্যাণ্ড রাজার ছবি ওয়ালা টাকা রাখা ঘরে থাকতে পারে তবে ‘সওগাত’ নয় কেন? বাদাশা মিয়া হার মানেন। প্রথম সংখ্যা আমরা আগেই লিখেছি বেরিয়েছিল ১৯১৮র নভেম্বরে। ভারতীয় চিত্রকলার মোঘল ঘরানার কথা কি তিনি জানতেন না, নজির দিলেন না কেন, আমরা জানি না।

                  কিন্তু যে সম্মানে মুসলমান পাঠক এবং সমাজ তাকে বরণ করে নিল তার তুলনাতে প্রতিরোধ ছিল সামান্যই। পরের মাসেই ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র তৃতীয় অধিবেশন বসে চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি আমন্ত্রিত হন। এই সমিতির সম্মেলনে গিয়ে তিনি এক ছবি তোলার লোক ভাড়া করলেন। কিন্তু অধিকাংশি রাজি হন না ছবি তুলতে। বলে কয়ে কয়েকজনকে রাজি করলেন। নিজেও উঠলেন শেরওয়ানি-পাজামা পরে। পরের সংখ্যা ‘সওগাতে’ সম্মেলনের প্রতিবেদন বেরুলো সেই সব ছবি সহ। এই প্রতিবেদনই তাঁর প্রথম মূদ্রিত লেখা। এমনিতে খুব একটা তিনি লিখতেন না। কাগজের সম্পাদক হিসেবেও নিজের নাম জাহির করতেন না। প্রথম দু’চারটি সংখ্যাতে সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের। নিজের পরিচয় দিতেন জেনারেল ম্যানেজার বলে। পরে সাহিত্যবিশারদ তাঁকে বলে কয়ে সম্পাদক হিসেবে নাম লেখাতে রাজি করান। দ্বিতীয় সংখ্যাতে ২৭টি লেখার মধ্যে ২২টিই ছিল হিন্দু লেখকদের। রবীন্দ্রনাথও লিখলেন একটি কবিতা। সঙ্গে ‘সওগাত’ নামে একটি গদ্য। তখন টাকা নিতেন রবীন্দ্রনাথ লেখা দিলে। কিন্তু তাঁকে উৎসাহীত করতে শুরুতে টাকা দেবার কথা বললেও পরে বিনে পয়সাতে পাঠিয়ে দেন। পরেও স্বেচ্ছাতেই লেখা পাঠিয়েছিলেন বেশ ক’বার।

           
          দু’বছর চলবার পর ১৯২১এর মার্চ-এপ্রিল সংখ্যা বেরিয়ে দেনা আর পাওনাদারদের মামলার দায়ে কাগজটি বন্ধ হয় দিন কতক। আবার বীমা ব্যবসাতে নেমে তিনি দেনা শোধ করেন, বেশ কিছু টাকাও জমিয়ে ফেলেন। আবার বেরুতে থাকে ১৯২৬এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর তথা ১৩৩৩এর আশ্বিন থেকে। এই সময়ের মধ্যে একই চিন্তার আরো বেশ কিছু কাগজ বেরিয়ে পড়ে। তাঁর মধ্যে ১৯২২এর আগষ্টে বেরুনো নজরুলের ‘ধূমকেতু’ও রয়েছে। এবারে এবারে বেশ কিছু মুসলমান লেখক তিনি জুটিয়ে নিলেন। এর মধ্যে এস ওয়াজেদ আলিও ছিলেন যিনি ১৯১৯এ ইংরেজিতে Bulletin of the Indian Rationalistic Society নামে জার্নাল বের করেছিলেন। এ ছাড়াও মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ শাহাদাৎ হোসেন প্রমুখ ছিলেন। মাস কয় পরেই ১৯২৭এর নববর্ষে বের করেন ‘বার্ষিক সওগাত’। এর প্রথম সংস্করণ দু সপ্তাহেই ফুরিয়ে যায়। তিনটি সংস্করণ বের করে পাঠক চাহিদা মেটাতে হয়েছিল। এই সময়ে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তারের প্রসঙ্গ নিয়ে ‘মোহম্মদী’ আর ‘সওগাতে’ বেশ একটা বিতর্ক কমে উঠেছিল। ধীরে ধীরে ‘সওগাত সাহিত্য মজলিশ’ নামে এক আড্ডাও গড়ে তুললেন। বসত প্রথমে ৮২ কলুটোলা স্ট্রিটে পত্রিকা দপ্তরেই প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা। ১৩টি সংখ্যা কাগজ বেরুবার পর যে দপ্তর উঠে যায় ১১ ওয়েলসলি স্ট্রিটে। সেখানে তিনি পরিবার নিয়েও উঠে আসেন। দোতলা বাড়ির নিচেই নিজস্ব ছাপাখানা খোলেন।

                     কাজি নজরুল প্রথম বছরেই জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬ সংখ্যাতে ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ নামে গল্প লিখেছিলেন । দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম সংখ্যা থেকে নজরুলই হয়ে উঠেন ‘সওগাতে’র প্রধান লেখক। সে সংখ্যাতে বেরোয় নজরুলের বিখ্যাত ‘সর্বহারা’ কবিতাটি। ইতিমধ্যে তিনি বাংলা সাহিত্য জগতে পরিচিত হয়ে উঠলেও আর্থিক সমস্যার সুরাহা করতে পারছিলেন না। স্থায়ী আবাস বলতেও ছিল না কিছু। ১৯২৭এর মার্চে এলবার্ট হলে ‘নজরুল সাহায্য রজনী’র আয়োজন করেন নাসিরুদ্দীন। তাতেও সুরাহা না হলে মাসিক দেড়শ টাকা মাইনেতে তাঁকে ‘সওগাতে’ কাজ দেন। কাজ বলতে ছিল প্রতি সংখ্যাতে লেখা এবং বিকেলে আড্ডা দেয়া। নজরুল থাকতেন নলিনী কান্ত সরকারের বাড়িতে। সেখানে থাকার অসুবিধে হলে ‘সওগাত’ দপ্তরের উপরের দুটো কামরাতে বিনা ভাড়াতে নজরুলকে থাকার ব্যবস্থাও করে দেন। নজরুলের কবিতাতে আরবি ফারসি শব্দাবলীর বাহুল্যে মনে হয় নাসিরুদ্দীনের একটি ভূমিকা আছে। নজরুলকে তিনি মুসলমান সমাজে প্রচলিত শব্দ-বাগ্বিধি ব্যবহার করে মুসলিম সমাজ এবং বিষয় নিয়েই লিখতে বলেছিলেন। নজরুল তাতে ক্ষেপে গেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, কোনো জাতি-ধর্ম নিয়ে লিখলে তা আর যাই হোক কাব্য হবে না। নাসিরুদ্দীনের পালটা যুক্তি, মুসলমানের সমাজচিত্র এবং মুখের ভাষা বাদ দিলে বাংলার গণসাহিত্য গড়ে উঠবে না কোনদিন। নজরুল রাজি হলেন, কিন্তু জানিয়ে দিলেন ধর্মের নামে কোনো ভণ্ডামী চলবে না। নাসিরুদ্দীনের তাতে আপত্তি করবার কিছু ছিল না, উলটে তিনি এই ব্যাপারে নজরুলকে নেতৃত্ব দিতেই অনুরোধ জানালেন। ধর্মের নামে ভণ্ডামী আর একটি ধর্মীয় সমাজে প্রচলিত সমাজের ভাষা-বিষয়ের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটি আমাদের ‘আধুনিক’ মন এখনো বুঝে উঠতে দ্বিধান্বিত বহু সময়। নাসিরুদ্দীন বুঝতেন, কেননা তাঁর সামাজিক এবং ( ব্যবসায়িক বলতেও অসুবিধে নেই) বাধ্যবাধকতা ছিল। নাসিরুদ্দীন মুসলমান সমাজের উত্থান চাইতেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার দায় তাঁকে কোন শত্রুও দিতে পারেন না। একেতো ‘সওগাত’এর হিন্দু লেখকের তালিকা সবসময়েই দীর্ঘ ছিল। নজরুল ছাড়াও প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখকেরাও চাকরি করেছিলেন ‘সওগাতে’। নজরুলের জোরে এমন লেখকদের আড্ডাতে আসাটাও সহজ হয়ে গেছিল অনেকটাই। নজরুল অনেক সময় লেখা না দিয়ে পালাবার ধান্দা করতেন। একবার তাঁকে কামরাতে তালাবন্দি করে লেখা আদায় করবার সরস ঘটনাও ঘটেছিল। দু’জনের সম্পর্কই এমন গভীরতার পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ১৫ ডিসেম্বর , ১৯২৯এ সেই আলবার্ট হলে নজরুলকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেই সভাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ‘কল্লোলে’র সঙ্গেও যে ‘সওগাতে’র সম্পর্ক ঘনিষ্ট ছিল তার নজির হলো সেই সভার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন ‘কল্লোল’ সম্পাদক দীনেশ চন্দ্র দাস। নেতাজি সুভাষ বসুও সেই সভাতে বক্তৃতা করেছিলেন। নজরুল আসার পরেই এপ্রিল-মে ১৯২৮থেকে ‘সওগাত’ সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। সাপ্তাহিক কাগজটিও বেশ জনপ্রিয় হচ্ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবসায়িক এবং ভাবপ্রস্থানের প্রতিদ্বন্দ্বিরাও বসে ছিলেন না। নজরুল বিরোধী একটি শিবির ছিলই এরা তখন ‘মোহাম্মদী’র কে কেন্দ্র করে সরব হতে থাকে। নজরুল এবং ‘সওগাত’কে ইসলাম বিরোধী বলে চিহ্নিত করে আক্রমণ শানায়। নজরুলের যোগ দেবার মাস কয় পরেই ১৯২৮এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংখ্যাতে ‘সওগাতে’ সম্পাদকীয় লিখে জানানো হয় তাঁরা সংস্কার আনতে চান মুসলমান সমাজে , ইসলাম ধর্মে নয়। এবং ‘মোহম্মদী’কে এই কাজে সহযোগী বলেই বর্ণনা করেন। কিন্তু ‘মোহম্মদী’ পক্ষ তাতে শান্ত হয় নি , বরং চড়া এবং প্রচুর মিথ্যা স্বরে আক্রমণ চালাতে থাকে। কয়েক সংখ্যা ধরে দুই কাগজের মধ্যে উত্তর-প্রত্যুত্তরের পালা চলেছিল। নজরুল আসার আগে অব্দি দুই কাগজ পরস্পরের বিজ্ঞাপন ছাপাত বিনামূল্যে। কিন্তু সম্পর্ক খারাপ হলে ‘মোহম্মদী’ বিজ্ঞাপনের টাকা চেয়ে মামলা করে বসে আদালতে। আদালত একতরফা ডিক্রি জারি করলে আকরম খাঁ ছেলেকে নিয়ে ‘সওগাত’ অফিসে এসে পড়েন মেশিন ক্রোক করবেন বলে। সে যাত্রা তৎক্ষণাত ধার করে টাকা দিয়ে মান বাঁচাতে হয় নাসিরুদ্দীনকে। কিন্তু এই পুরো ঘটনা ‘সওগাত’এর খ্যাতি বরং বাড়িয়েই দেয়। নজরুলের আসন ‘সওগাতে’ আরো পাকা হয়। ইনি বেশিদিন কোথাও কোনোদিনই পাকা হতেন না। ‘সওগাতে’ পাঁচ বছর চাকরি করেন। পরে রেকর্ড কোম্পানিতে যোগ দিলে চাকরিটি ছাড়েন বটে কিন্তু লিখে গেছেন এই কাগজে অসুস্থ হবার আগে অব্দি। এ কাগজে শেষ কবিতা তাঁর বেরিয়েছিল মার্চ-এপ্রিল ১৯৪২ সংখ্যাতে। মুজফফর আহমেদকে বাদ দিলে নজরুলের সবচে’ ভালো বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ী ছিলেন এই নাসিরুদ্দীনই। ১৯৭৬এ নজরুল যখন মারা যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত শোক সভাতে সংগত কারণেই সভাপতিত্ব করবার ডাক পড়েছিল মোহম্মদ নাসিরুদ্দীনের।

             ‘মোহম্মদী’ টাকা পেয়ে সাময়িক সন্ধি করে নিলেও শত্রুতা ছাড়েনি কোনদিন। প্রখ্যাত মুসলমান সংস্কারক, ‘হিস্ট্রি অব দ্য স্যারসিন্সে’র লেখক বিচারপতি আমীর আলীর মৃত্যুতে শোকসভা আয়োজন করলেও ‘মোহম্মদী’ আমন্ত্রিতদের ভয় দেখায়। ‘সওগাত’, ‘শিখা’ ইত্যাদি কাগজের লেখিকা ফজিলতুন্নেসা প্রথম মুসলমান ছাত্রী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম হয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি বিলেত যেতে চাইলে নাসিরুদ্দীন টাকাও যোগান, ‘সওগাত’ কার্যালয়ে তাঁর সংবর্ধনা সভারও আয়োজন করেন। সেখানে ‘মোহম্মদী’ গোষ্ঠী রীতিমত গুণ্ডা লেলিয়ে দেয়। পরে আবার কুৎসা রটিয়ে সেই সংবাদ ছাপে নিজেদের কাগজে। সম্ভবত এই ঘটনা তাঁকে একটি নারী সংখ্যা বের করতে প্ররোচিত করে। লেখিকারা লিখতেনই সওগাতে। বেগম রাকেয়াতো ছিলেন ই, পরের কালের বিখ্যাত লেখিকা বেগম সুফিয়া কামালকে ‘সওগাতে’র সন্তান বললে ভুল বলা হবে না। আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ১৯২৯এ বেরোয় সেই নারী সংখ্যা। নাসিরুদ্দীন তাঁর বইতে দাবি করেছেন, এটি ভারতের প্রথম কোন কাগজের মহিলা সংখ্যা। এই সংখ্যাতে ৮৩টি ছবি ছিল। তার মধ্যে অনেকগুলো নারীর। লেখিকাদের এতোটাই উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন নাসিরুদ্দীন যে দেশ ভাগের ঠিক আগেই ২০ জুলাই , ১৯৪৭এ আরেকটি আলাদা এবং ঐতিহাসিক কাগজ ‘বেগম’ বের করতে শুরু করেন। কাগজটি শুরু থেকেই ছিল সাপ্তহিক। শুরুতে সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল , পরে সম্পাদনার দায়িত্ব নেন নাসিরুদ্দীনের মেয়ে নূরজাহান বেগম। তার আগে আরো একটি বিশাল উদ্যোগ নিয়েছিলেন নাসিরুদ্দীন। ১৩৪৪এর মাঘ মাসে, ১৯৩৮এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ‘শিশু সওগাত’ বলেও আরেকখানা কাগজ বের করেন। এটিও ব্যাপক ব্যবসা সফল কাগজ ছিল। এর গ্রাহক সংখ্যা বাইশ হাজারে গিয়ে পৌঁছেছিল। কিন্তু শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে এর আজ নামটুকুও উচ্চারিত হয় না। দেশ ছেড়ে যাবার আগে অব্দি কাগজটি বের করেছিলেন নাসিরুদ্দীন। কিন্তু এর পরে আর বেরোয় নি।

কলকাতা থেকে ঢাকাঃ 'সওগাত যুগে'র বাকি ইতিহাস এবং 'বেগমে'র ইতিকথাঃ

               দেশভাগ কেন অবিভক্ত বাংলার অধিকাংশ মুসলমান বৌদ্ধিক নেতৃত্বকে পূর্বপাকিস্তান নিয়ে গেলো সে নিয়ে আলাদা আলোচনা করবার এখানে সুযোগ নেই। নজরুলকেও যেতে হয়েছিল, যেতে হয়েছিল নাসিরুদ্দীনকেও। তবে কিনা এমনিতেও তিনি পূর্ববাংলারই লোক ছিলেন। সুতরাং তাঁর পক্ষে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। ঢাকার পাটুয়াটুলির বিজয়া প্রেসের মালিকের প্রেস এবং বাড়ির সঙ্গে নিজের প্রেস এবং বাড়ি বিনিময় করেন তিনি। ১৯৫০এর মে মাসে তিনি সেখানে চলে গেলেন। কিন্তু সেখানে ঊর্দু জাতীয়তাবাদের চাপে তাঁর কাজ অনেক কঠিন হলো। দিন কতক কাগজের কাজ বন্ধ রাখলেন। বাংলা সাহিত্যের জন্যে আরো বড়ো লড়াইএর জন্যে তাঁকে প্রস্তুতি নিতে হলো। এবং তিনি নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন। ১৯৫২তে ‘সওগাত’ বেরুবে বেরুবে এমন সময় ঢাকাতে ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চলল। ‘সওগাত’ অফিসকে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠিত হলো 'পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ'। ঢাকার সাহিত্য মহলের তিনি হয়ে উঠলেন মধ্যমণি।সংসদের সভাপতি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহ্‌মদ।এটি অনেকটাই দেশভাগের আগেকার 'প্রগতি লেখক সঙ্ঘে'র মতো ব্যাপার ছিল। সম্পাদকের পরিচয় দিলেই স্পষ্ট হবে। ফয়েজ আহমেদের সঙ্গে কলকাতা থাকতেই আলাপ হয়েছিল নাসিরুদ্দীনের। পাকিস্তান আমলে তিনি বামপন্থা আশ্রয়ের দায়ে বছর সাতেক জেলও খেটেছিলেন। ষাটের দশকে একসময় বিপ্লোবত্তর চীনে গিয়েও বেশ ক’বছর কাটিয়েছিলেন। মাও ৎসে তুঙের চিন্তাধারাতেও প্রভাবিত হয়েছিলেন অনেকটা। বেইজিং বেতারে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচলনেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন । ফয়েজ আহমদে মারা যান ২০১২র ফেবুয়ারীতে। সেই সংসদের যেকোন সভাতে তখন দুই আড়াইশজনের উপস্থিতি ছিল সাধারণ কথা। বেগম সুফিয়া কামালরাতো ছিলেনই, সেকালে যাদের হাতে বাংলা ভাষা সাহিত্য এবং আন্দোলন দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশে তাদের প্রায় সবাই সমবেত হতেন সেই সংসদে। যেতেন শামসুর রহমান, শওকত ওসমান,বদরুদ্দীন ওমর, আনিসুজ্জামান, মুনীর চৌধুরী, আশরাফ সিদ্দিকী, আল মাহমুদ, আবদুল হাই প্রমুখ অনেকে।

             ১৯৫০এর ডিসেম্বর থেকে ‘বেগম’ কাগজটি বের করতে শুরু করেন। ঠিক চার বছরের মাথাতে মহিলাদের নিয়ে একটি সংস্থা ‘বেগম ক্লাব’ও গড়ে তোলেন ১৯৫৪তে। ‘সওগাত’ আবার বেরুতে শুরু করে ১৯৫৩র নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে। স্বাভাবিক ভাবেই পূর্ব-পাকিস্তানের নতুন রাজনৈতিক পরিবেশে সমস্ত প্রতিবাদী প্রগতিশীল লেখকদের মুখপত্র হয়ে উঠে ‘সওগাত’। বিখ্যাত

                'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি ...', গানটির লেখক সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা ‘সওগাতে’এরই লেখক গোষ্ঠীর অন্যতম। তিনি ‘বেগমে’ চাকরি করতেন সেই সঙ্গে চালিয়ে যেতেন পড়াশোনা। ৫২র লড়াইতে লাঠির ঘায়ে আহত হয়ে বেশ কিছুদিন হাসপাতালেও ছিলেন। তখন বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমানকে পাঠান নাসিরুদ্দীনের কাছে। এই হাসান হাফিজুর ঢাকাতে যেন কাজি নজরুলের বিকল্প হয়ে উঠলেন। হাসান হাফিজুর লেখকদের টেনে আনতেও বেশ উদ্যোগী হয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪তে 'পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ' ঢাকার কার্জন হলে প্রথম সম্মেলন আয়োজন করতে সমর্থ হয়। ‘মোহম্মদী’ সেখানেও ‘সওগাতে’র পিছু ছাড়ে নি। এবারে তাদের সঙ্গ দিল ‘আজাদ’ বলে আরো একটি কাগজ। আর লড়াইর বিষয় হলো, বাংলা ভাষা, বাংলা হরফ, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং কাজি নজরুলের উপর দখলীস্বত্ব। এবারেও মামলা হলো। অভিযোগ গুরুতর। রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ধর্মদ্রোহিতা এবং কমিউনিষ্ট হবার অভিযোগ। একরাতে পুলিশ নাসিরুদ্দীনকে তুলেও নিয়ে যায়। বাড়িতে তল্লাসী চলে। পরে হতাশ হয়ে মুক্ত করে দেয়।

                   এ পর্যন্ত এসে পাঠক নিশ্চয়ই অনুভব করেছেন যে বিপুল ব্যবসা সফল এই উদ্যমী ব্যক্তিত্ব , যিনি কাগজের সম্পাদক হিসেবেও নিজের নাম ছাপতে কুণ্ঠিত ছিলেন নিছক ব্যবসায়ী ছিলেন না। নিছক ‘আধুনিকতাবাদে’র তাত্বিক বিলাসীও ছিলেন না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বাঘা-বাঘা সব কাগজ যেমন কল্লোল-কালিকলম-কবিতা-কৃত্তিবাসের কীর্তিগাঁথাতে সরব থাকতে পারে, কিন্তু এই মেঘনা পারের এই অসম উদ্যমী ব্যক্তিত্ব যেখানেই গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পুরো সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিজে বিশেষ লেখেন নি, কিন্তু এই ত্যাগের বিনিময়ে এক বিশাল লেখক এবং পাঠককুল তিনি গড়ে তুলেছিলেন। মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজে এবং পরের কালে বাংলাদেশের বৌদ্ধিক উত্থানে গোটা বিশ শতক জুড়ে তিনি রীতিমত নেতৃত্ব দিয়ে গেছিলেন মঞ্চের পেছনে থেকে।

               স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁকে সম্মান জানাতে কুণ্ঠা বোধ করেনি। যদিও যে শহরে তিনি জীবন শুরু করে তিনটি দশক কাটিয়ে গেছিলেন সেখানকার ‘প্রগতিশীল’ বৌদ্ধিক মহলও তাঁকে মনে রাখার সামান্য দায়ও স্বীকার করে নি কোনদিন, বাকিদের আর কী কথা। স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭৫এ তাঁকে বাংলা একাডেমী পুরস্কারে সম্মানিত করে। ১৯৭৭এ অর্পণ করে একুশে পদক এবং সেদেশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিবস রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। এছাড়াও নানা সম্মানে তিনি ভূষিত হন । ১৯৭৯র ১৬ নভেম্বর তারিখে, তাঁর ৯২তম জন্মদিনের দু’দিন আগে তাঁকে জাতীয় স্তরে সংবর্ধনা দেয়া হয়। জীবিতাবস্থাতে কাউকে সংবর্ধনা দেয়ার এটিই ছিল সেদেশে প্রথম ঘটনা। পরের বছরেও জন্মদিনের দিন কতক আগে ৩ নভেম্বর 'বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ' সহ ৩৩টি মহিলা সংগঠন তাঁকে সংবর্ধনা দিতে গিয়ে ‘নারীজাগরণের অগ্রদূত’ বলে সম্মানিত করে। ১৯৮৯ সনে তাঁর জীবিতাবস্থাতেই শতবার্ষিকী পালন করে বাংলাদেশ। সেবারেও তাঁকে জাতীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়। তিনি বেঁচেছিলেন সক্রিয় ছিলেন গোটা বাংলা চতুর্দশ শতক। মারা গেছিলেন ১৯৯৪ সালের ২১শে মে,৭ই জ্যৈষ্ঠ ১৪০১। ঢাকায় । তাঁর বয়স তখন ১০৬।

এবং এক নতুন শুরুর কথাঃ

      
নূরজাহান বেগম
       যিনি গোটা জীবন মঞ্চের পেছনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন, ১৯৭৬এ তিনি চালু করেন ‘নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক’। উদ্দেশ্য একটাই--- মৃত্যুর পরেও যেন বাংলাভাষা –সাহিত্যের প্রতি তাঁর সেবা স্তব্ধ না হয়ে যায়। নিজে পাওয়া পুরস্কারগুলোর অর্থমূল্যেই চালু হয় এই পদক। 'শিরি-ফরহাদ', 'আল্লার নবী মুহম্মদ (সা.)' , 'সওগাত যুগে নজরুল ইসলাম' ইত্যাদি নামে গুটি কয় বই তিনি লিখেছিলেন। ১৯৮৫তে যখন তাঁর বয়স ৯৭ তখন গিয়ে লেখেন ১৬০৩ পৃষ্ঠার বিশালবপু গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ’। হয়তো ‘বেগম’ তখনো বেরুচ্ছে বলেই নামে ‘বেগম যুগ’ কথাটা জুড়েন নি। তাঁর মৃত্যুর পর তিনখণ্ডে বেরিয়েছে ‘নির্বাচিত বেগমঃ অর্ধশতাব্দীর সমাজচিত্র ১৯৪৭-২০০০’। ‘বেগম’ এখনো বেরোয় । সম্পাদনা এখনো করেন তাঁর কন্যা নূরজাহান বেগম। যার জীবনও কম উপন্যাসোপম নয়। বাংলাদেশের ‘নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠ চক্র’ আমাদের অসমে পরিচিত সংগঠন, তার মুখপত্র ‘বরাক নন্দিনী’ এক দশকে বেশি সময় ধরে শিলচর থেকে বেরুচ্ছে । তাই উল্লেখ করা ভালো, সেই সংগঠন ১৯৯৬ তাঁকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ব্যাক্তিত্বের সন্মান জানায়। মনে হয় না নাসিরুদ্দীন কিম্বা তাঁর অতিবৃদ্ধা সুযোগ্যা কন্যা নূরজাহান বেগমকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য মঞ্চে এতো এতো লেখিকা এবং পাঠিকাদের উত্থান সম্ভব ছিল। ভারতে তাঁকে নিয়ে খুব কম হলেও লেখালেখি হয়েছে। মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায় ১৯৯৭এর মার্চে তাঁর ‘দেবাঞ্জলি’র প্রথম সংখ্যাতে ছেপেছিলেন নাসিরুদ্দীনের একটি সাক্ষাৎকার। শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত তাঁর একটি ছোট্ট পুস্তিকাতে ‘সওগাত’কে স্মরণ করেছেন। আর জাহিরুল হাসান তাঁর ‘বাংলায় মুসলমানের আটশো বছর’ বইতে “ ‘সওগাত’ পত্রিকাই শুধু নয়, একটি আন্দোলনের নাম” নামে একটি প্রবন্ধ রেখেছেন। আমাদের বর্তমান প্রবন্ধের তথ্যপাতির বেশিটাই জাহিরুল হাসানের বই থেকে নেয়া, বাকিগুলোর উৎস নানা আন্তর্জালিক সূত্র। আন্তর্জালে ঘেটে দেখলাম ড০ দিলীপ মজুমদার ‘সওগাত, রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলিম মানস’ নামে একখানা গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন সম্প্রতি ২০১০এ। আমাদের বর্তমান রচনা তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ বাড়াবার পথে একেবারেই প্রাথমিক সংযোজন মাত্র। যদি অন্যেরাও হাত বাড়ান তবে এক স্বতন্ত্র মূল্যবোধের সঙ্গে পরিচিত হবে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য। বিশেষ করে আমরা যারা প্রান্তীয় পূর্বোত্তরের বসে কাজ করি , আমাদের জন্যে এগুলো জরুরী বিষয়। প্রেরণার স্রোত। আধুনিকতার পশ্চিমা স্রোতে অবগাহন অনেক হলো, অনেক হলো অমিতাভ যেমন লিখেছিলেন ‘এক অন্যরাজনীতি চালিয়ে’ যাওয়া, এবারে না হয় হোক ‘ঘরে ফেরার গান’।

________________
কিছু দরকারি সংযোগঃ

শুক্রবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১২

ওঁ মধু


                                                             ।।
শক্তিপদ ব্রহ্মচারী।।
  
সৌজন্য ঃমেঘ অদিতি





















বিষ্টি বিষ্টি অনাচ্ছিষ্টি ভেতরে তুলকালাম কাণ্ড
মেয়েমানুষ খেয়াল গাচ্ছে লোপাট হচ্ছে মধুর ভাণ্ড
সব শেয়ালের এক রা হুজুর মধুবাতা ঋতায়তে
নাগালয়ে মা ভবানী বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে
হরি তোমার ওপার লীলা তুমি মধু কৈটভারি
"কে ওখানে?" "আমি হুজুর, শক্তিপদ ব্রহ্মচারী।"

নখদন্তবিহীন এবং বারোমাস নিরামিষাশী
সচ্চরিত্র বামুনের পো গুণ করেছে সর্বনাশী
আত্মচরিত লিখব এবার সহস্র রুধিরের ফোঁটায়
চুমু খাওয়ার শর্ত ছিল, ঠোঁট ঘষেছি বুকের বোঁটায়
ইন্দিরাজি দিল্লি থেকে হিন্দি শেখায় সস্তা দরে
কিলোখানেক তা-ও কিনেছি জাতীয় সংহতির ডরে
হুজুরের রাজত্বে করি খুশমেজাজে চৌকিদারি
"কে ভেতরে?" "আমি হুজুর, শক্তিপদ ব্রহ্মচারী।"

ইকিড় মিকিড় ফন্দি ফিকির যা কড়ি মন্তরের গুণে
শ্রীখোলে রবীন্দ্রগীতি কীর্তনিয়া নেড়া বুনে
হুজুর এবার ঢাকি হবেন, আমরা হব ঢাকের কাঠি
নব্যসমস্কৃতি বিনা সব শালা খেজুরের আঁটি
গণ্ডাখানেক চণ্ডী পেলে একটু ঠান্ডা হতে পারি
ছিচরণের দাসানুদাস শক্তিপদ ব্রহ্মচারী।

(অনুলিপিঃ Prabuddhasundar Kar)

সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২

সন্ত্রাসের সাতকাহন


(লেখাটা বেরিয়েছিল সন্তরণ ১২শ বর্ষ, ২০০৯ সংখ্যাতে। বাংলা ওয়ার্ডে লেখা ছিল বলে সরাসরি তোলা গেল না। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে লেখাটার প্রাসঙ্গিকতা অক্ষুন্ন ভেবে তুলে দিলাম পিডিএফ-এ। নিচের বোতামগুলো দেখুন। ইচ্ছে করলে পুরো পর্দা জুড়ে এখানেও পড়তে পারেন। বা নামিয়ে নিয়ে অবসরেও। শুধু দরকারে নামিয়ে নিতে পারেন ফ্লাসপ্লেয়ার এখান থেকে।)
 
  "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খলনায়ক হিটলারকে কিন্তু সন্ত্রাসবাদী হিসাবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না। অথচ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূরণের ভূমিকা তার ধ্বংস লীলার পেছনে ছিলনা এমন কথা গবেট মূর্খও নিশ্চয় বলতে সাহসী হবে না। ইতিহাসকে যদি সাক্ষীমানা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে সাম্রায্যবিস্তারের লক্ষ্যে যে যুদ্ধ ,সে ব্রিটিশ কিংবা মার্কিন সাম্রায্যবাদের অতীত অথবা সাম্প্রতিক যে কোন অভিযানই হোক না কেন, সেগুলোকে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ( Propaganda)-র দৌলতে নায্য এবং অধিকৃত দেশের পক্ষে হিতকর বলে চালানোর সব রকম প্রেচষ্টা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বরাবর হয়েছে, আজও হচ্ছে।"
সন্ত্রাসের সাতকাহন

মেক্সিকোয় গডজিলা


















ন দিয়ে শোনো আমার সোনামনিঃ 
মেক্সিকো সিটিতে তখন বোমা পড়ছে
কিন্তু সেটা কেউই খেয়াল করছিলো না।
বিষ বয়ে নিয়ে যাওয়া বাতাস 
ছড়িয়ে যাচ্ছিল সব রাস্তায় আর খোলা জানালায়।
তুমি তখন সবে মাত্তর খাবার শেষ করে
টিভিতে কার্টুন দেখছিলে।
পাশের বেডরুমে বই পড়তে পড়তে
হঠাৎ খেয়াল হল এই রে,আমরা মারা যাচ্ছি
গা গুলানো বমি ভাব আর মাথা ঘোরা সত্ত্বেও
নিজেকে টেনে হিঁচড়ে রান্নাঘরে নিয়ে গেলাম
দেখলাম তুমি শুয়ে আছো মেঝেয়
একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলাম আমরা।
জানতে চাইলে তুমি কী ঘটছে
বললাম না যে মরণের অনুষ্ঠানে শামিল হতে যাচ্ছি
তা পাল্টে বললাম আমরা বেড়াতে যাচ্ছি।
একসঙ্গে,আরেকটিবার,ভয় পেওনা সোনামণি।
সব থেমে যাবার পর,মরণ আমাদের চোখ বুঁজিয়ে দিতে পারেনি।
আমরা কিএকহপ্তা বা বছর পরে তুমি জানতে চাইলে,
পিঁপড়েমৌমাছি নয়তো ভুল সংখ্যা
কদাকার এই সম্ভাবনার সেদ্ধ ঝোলে?
আমরা মানব সম্প্রদায়,খোকা আমার,প্রায় পাখীই যেন,
সার্বজনিক নায়ক এবং অন্ধিসন্ধি।
 
                            **************

( এক চরম ভবঘুরে কবি ছিলেন চিলির রোবার্তো বোলানো। বেসামাল। উদ্দাম জীবন কাটিয়েছেন। পরে একসময় জীবনে থিতু হন। ওর একটা কবিতা ইংরিজি-স্প্যানিশ থেকে অনুবাদের দুঃসাহস করলাম। জানিনা আপনাদের কেমন লাগবে। খানিকটা ভাবানুবাদ আর বাকিটা গুগল ট্রান্সলেট দিয়ে স্প্যানিশ বোঝার চেষ্টা। ফাঁকিবাজিটা স্বীকার করলাম। আর হ্যাঁ, উপরের ইলাস্ট্রেশনটা আমার। দুতিনটে ফটো এদিক-সেদিক থেকে জুটিয়ে ফটোমাস্তানি করেছি। ছবির কবিতাটা আসল স্প্যানিশে )

রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২

হেমাঙ্গ বিশ্বাস স্মরণে

                                                 অরূপ বৈশ্য

(বরাক কণ্ঠের জন্য)
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সৃষ্টি আমাদেরকে একটা উত্তাল সময়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু সেই সময়ের আবেগ কী এখনো আমাদের মনকে নাড়া দেয়? আবেগ কাল-নির্ভর, আবার কাল নিরন্তর প্রবহমান। তাহলে একই আবেগ কী বারবার ফিরে ফিরে আসে? তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে কালের আমরা পর্বভাগ করব কী করে, প্রতিটি সময়ের পরিধিকে আমরা আলাদা করে চিনব কী করে? অথচ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মত সংগঠক-শিল্পী উত্থানোন্মুখ সমাজ-পরিবর্তনকামী শ্রেণির অফুরন্ত গতিশীলতায় সৃষ্ট প্রাণশক্তিকেই ধারণ করেছেন তাঁর সৃষ্টিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সূচনা সেই সময়ে যখন ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রগতিশীল ভূমিকা নিঃশেষিত হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা প্রাধান্যের জায়গায়, যখন এই শ্রেণিটির দেশীয় গ্রামীণ সামন্তশ্রেণির সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে তাদের উপনিবেশিক প্রভুদের সাথে আপস রফা চূড়ান্ত, যখন চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চিনে শ্রমিক-কৃষকের নেতৃত্বাধীন নতুন শক্তি উদিত, যখন একের পর এক কৃষক বিদ্রোহে ভারতের মাটিতে পোঁতা লাল-পতাকা আকাশে উড্ডীন।

                 সেই সময়ের সৃষ্ট এবং সেই সময়কে বদলে দেওয়ার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত একজন শিল্পী কালজয়ী হয়ে যাওয়ার নিদর্শন হচ্ছেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় হেমাঙ্গ বিশ্বাস। কিন্তু আমাদেরই এই সুরমা-বরাক উপত্যকার সন্তান শহিদ মাধব নাথের স্মৃতিতে গাওয়া হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান ‘আমরা তো ভুলি নাই শহিদ, সেকথা কি ভুলা যায়......” কি সত্যিই আমাদের এখনও আবেগতাড়িত করে? করে না, করার কথা নয় – কারুর কাছে এটা স্মৃতিমেদুরতা – কাররু কাছে বিশেষ করে নব্য প্রজন্মের কাছে যোগসূত্রহীন। সেজন্যই সম্ভবত আমাদের এই সুরমা-বরাক অঞ্চলের একজন মহান সংগ্রামী শিল্পীর জন্মশতবর্ষেও আমরা বেশ নির্লিপ্ত। এঅঞ্চলের বোদ্ধারা তাদের ঘরের এই মহান মানুষকে নিয়েও যে বিশেষ কোন চর্চা করার, তার জীবন ও সৃষ্টির ডকুমেন্টশন করার ব্যপারে কোন উৎসাহ দেখান না, তার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে সম্ভবত শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস যে আবেগকে সাধারণীকৃত ও আধুনিক প্রগতিশীল মননে পরিশীলিত করতে পেরেছিলেন তা আজকের এই পরজীবী মনস্কতায় আচ্ছন্ন মধ্যশ্রেণির সাথে যোগসূত্র স্থাপনের আবেগ নয়, এটা এমন এক আবেগ যা জাগ্রত লোকায়ত আবেগকে সাধারণীকৃত করে এবং আধুনিক সমাজ দেখতে আগ্রহী মধ্যবিত্ত মনকেও তার গণ্ডির মধ্যে আকৃষ্ট করে নিতে সক্ষম হয়। তাই এই আবেগ ফিরে ফিরে ভেসে আসে প্রবহমান কালের স্রোতকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে এবং মানুষ এই আবেগ-স্নাত হয় যখন তার মনে জয়ের আকাঙ্খা, পরিবর্তনের আকাঙ্খা, নতুনের আকাঙ্খা সঞ্চারিত হয়। পরাজয়ের গ্লানি ও সামগ্রিক হতাশার বাতাবরণেও কালজয়ী আবেগ মানুষের মন জয় করে নিতে পারে, কিন্তু সে এক ভিন্ন ধরনের আবেগ, এক ভিন্ন শ্রেণির – ভিন্ন পরিস্থিতির আবেগ যেখানে আলস্য - কর্মবিমুখতা – অসন্তুষ্টি আধুনিক বুর্জোয়া মনকে গ্রাস করে নেয়। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে মানুষ আত্মসন্তুষ্ট, ন্যায়-অন্যায় ভেদ ভুলে সাফল্য – আয়েস – স্থবিরতাকেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে জ্ঞান করতে শিখে সেই বাস্তব পরিস্থিতিতে কালজয়ী সৃষ্টির আবেগ চোরাস্রোতে বয়ে চলে, মানুষের আবেগে ধরা দেয় না। কালকে আমরা যদি এরকম বাস্তব পরিস্থিতির গুণাবলি দিয়ে ভাগ করি তাহলে কালজয়ী সৃষ্টি আমরা তাকেই বলতে পারি যা সময়ের এক বিশেষ মূহূর্তে নতুন রূপে নতুন বার্তা নিয়ে ফিরে ফিরে আসে।

                 যারা শ্রমিক-শ্রেণির নেতৃত্বাধীন এক নতুন সভ্যতা গড়ার কল্পনা করেন, তারা রাষ্ট্র-উৎপাদন পদ্ধতি-বিনিময় মূল্যকে যেমনি অন্য বিকল্প দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার রূপরেখা তৈরি করার কথা ভাবেন, ঠিক তেমনি সভ্যতার অবিভাজ্য অঙ্গ কলা-সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প রূপরেখা তৈরির দায়ও তাদের উপর বর্তায়। তাদের কাছে হেমাঙ্গ বিশ্বাস চর্চা ভীষণ জরুরি বিশেষ কর সেই যুগ-সময়ের সন্ধিক্ষণে যখন জয়ের আকাঙ্খা, পরিবর্তনের আকাঙ্খা, নতুনের আকাঙ্খা সঞ্চারিত করার সামাজিক শক্তির আবারও ঘুম থেকে জেগে ওঠার বার্তা আকাশে-বাতাসে ভেসে বেরায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মত সংগঠক-শিল্পীর সৃষ্টি আবার ফিরে আসবে, কিন্তু সচেতনভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে নতুন রূপে, নতুন উপলব্ধিতে, নতুন সভ্যতার প্রয়োজনে। সেজন্যই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কর্মকাণ্ড নিয়ে চর্চা এতো জরুরি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সলিল চৌধুরী-হেমাঙ্গ বিশ্বাস বিতর্ক নিয়ে কিছু কথা বলা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

               হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম শতবর্ষে তারা মিউজিক চ্যানেলে আজ সকালের আমন্ত্রণের অতিথি শিল্পী শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদারের অনুষ্ঠানে শুভেন্দু মাইতী বলেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস যে অহং-বর্জিত একজন বড়মাপের মানুষ তার প্রমাণ মেলে সলিল চৌধুরীর সংস্কৃতি-সংক্রান্ত মতকে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। দুটি ভিন্ন মতের বিতর্কে অন্যের মতের সাথে একমত হয়ে গেলে নিজের মত ত্যাগ করে তার মান্যতা দেওয়ার মধ্যে নিশ্চয়ই নিরহংকারী ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো সাধারণ মানুষের কাছের শিল্পীর এই তথ্য থেকে তাঁর নিরহংকারী ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া খুব জরুরি বিষয় নয়, যা আমাদের কাছে জানা বেশি জরুরি তা হল সেই বিতর্কের মোদ্দা কথা এবং সলিল চৌধুরীর মতকে মেনে নেওয়ার সঠিকতার বিষয়। এই বিতর্কের কোন লিখিত ডকুমেণ্ট পাঠের সুযোগ না হওয়া সত্বেও, বিভিন্ন আলোচনা থেকে এই বিতর্কের সারকথা বিধৃত করা যায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মত ছিল এই যে লোকায়ত জীবন থেকে রূপ-বিষয়কে নিয়ে গান রচনা করে লোকায়ত মানুষকে ভবিষ্যত সমাজের জন্য লড়াইয়ে উদ্দীপ্ত করা, অন্যদিকে সলিল চৌধুরীর মত ছিল আধুনিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আধুনিক বিষয়কে নতুন রচনায় লোকায়েতের সাথে সমন্বিত করতে হবে।

এক সঠিক মত থেকে শুরু করে বিতর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সলিল চোধুরীর মতকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস নতুন সমাজ গড়ার প্রাণশক্তি স্তিমিত হয় আসার সেই সময়ের অন্তর্বস্তুকে মেনে নিয়েছেন। সেজন্যই হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা আসামের সমাজ জীবনে অন্তর্নিহিত উগ্রজাতিয়তাবাদী মূল্যবোধ ও উত্থানোন্মুখ উগ্রজাতিয়তাবাদকে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করতে পারেননি এবং সেই শক্তির কাছে প্রগতিশীল শক্তির পরাজয়কে অসহায়ের মত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই বাস্তবস্তাকে এবার খানিকটা ব্যাখ্যা করা যাক।

              
               যখন কোন সমাজ আন্দোলিত হয় - যখন সমাজের প্রগতিশীল শ্রেণি-বর্ণ তাদের পুরোনো অবস্থা পরিবর্তনে সচল হয়ে উঠে, তখন পুরোনো-প্রতিক্রিয়াশীল ও নতুন-প্রগতিশীল মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সংঘাত সমাজের অভ্যন্তরেই চলমান সংগ্রামের রূপে দেখা দেয়। এই সংঘাতে নতুনের বিজয় ঘটবে কিনা বা যদি বিজয় ঘটে তাহলে পরিবর্তিত সমাজের সংস্কৃতি চর্চার রূপ কী হবে বা হওয়া উচিত তা কিন্তু নির্ধারিত হবে সেই সমাজের অভ্যন্তরেই এবং তা বহন করবে সেই গণ-সমাজই।     শিল্পসংস্কৃতি-সংগঠক এবং শিল্পের স্রষ্টাও কিন্তু এই জেগে ওঠা সমাজেরই অঙ্গ। সুতরাং শিল্পীর সৃষ্টি মানুষের অবচেতনে থাকা নতুনের বার্তাকে বহন করবে গণ-সমাজের সচেতন হয়ে ওঠার সংগ্রামী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এ এক বিচিত্র পথে বহুমুখী আন্তঃক্রিয়া যেখানে বিভিন্ন মত-পথ শুধু নয়, পুরোনোকে ভাঙার রস আস্বাদনে উত্থিত বিভিন্ন শ্রেণি-বর্ণের মূল্যবোধেরও এক অন্ত ও আন্তঃক্রিয়া। সুতরাং প্রগতিশীল শিল্পী যদি আধুনিক বা নতুন অন্তর্বস্তু সংগ্রামের স্থান-কালের সীমার বাইরে থেকে বহন করে এনে লোকায়ত চর্চার সাথে জুড়ে দিতে চান তাহলে তা আপাত আধুনিক মনে হতে পারে, কিন্তু গণ-সমাজ তাদের সংগ্রামের বর্ষাফলক যার দিকে তাক করার কথা তাকে চিনতে ভুল করবে এবং ফলে এই সংগ্রামের মধ্য থেকে সৃষ্ট শিল্প-রচনাকেও তার জীবনের অঙ্গ করে নিতে বিফল হবে।

           আসামের উদাহরণ এব্যাপারে আমাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারে। আসামে কৃষক অভ্যুত্থানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চীনের শ্রমিক-কৃষকের লড়াই থেকে, আমেরিকার শ্রমিকদের লড়াই থেকে দিন-বদলের কথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংযোজিত করা হল, কিন্তু আসামের এই সংগ্রামী কৃষকদের অবচেতনে থাকা উগ্রজাতিয়তাবাদ বিরোধিতাকে (লোকায়ত স্তরে থাকা উগ্রজাতিয়তাবাদী আবছা রূপের বিরোধিতা) কোন ভাষা দেওয়ার প্রচেষ্টা হল না, আমেরিকার গণসঙ্গীত ‘নিগারদের’ চিনল – কিন্তু এখানে চা-শ্রমিক ঝাড়খণ্ডী-আদিবাসীদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে তেমন কোন রচনা হল না এবং ফলে গণ-সমাজকে তাদের সংগ্রামের সমস্ত অন্তর্বস্তুকে জলাঞ্জলি দিয়ে আশ্রয় নিতে হয় উগ্রজাতিয়তাবাদী শিবিরের কাছেই ।

             হেমাঙ্গ বিশ্বাসই তখনকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব যিনি সঠিক পথটি চিনতে পেরেছিলেন, কিন্তু এই পথে আরও বহুদূর অগ্রসর হয়ে সঠিক চিন্তাকে সম্প্রসারিত ও সার-সংকলিত করার বিপরীতে তখনকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল ধারার চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে গিয়েছিলেন। সে সময়ের সংগ্রামী উত্তাপ এবং চোখের সামনে থাকা মডেলকে অনুসরণ করার আবহ সম্ভবত বিকল্প চিন্তার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছিল। এই রুদ্ধদ্বার আমাদের সামনে আজ নেই, অথচ শীতের ভোরে সংগ্রামের উত্তাপ নেওয়ার সূর্য বহুদূরে উঁকিঝুঁকি মারছে, তাই এখনই সময় নতুন করে – নতুন ভাবে দিন-বদলের গান বাঁধার উদ্যোগ নেওয়ার এবং সেই কাজটি সবচে ভাল হতে পারে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কর্মকাণ্ডের চর্চার মধ্য দিয়েই। 


১) হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কিছু গানের সংযোগ-1।
২) হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কিছু গানের সংযোগ-2।

শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১২

প্রেমভিক্ষা




ভালোই  যদি না বাসিতে হায় কখনো  
কেন ধরেছিলে সেদিন হাতে হাত বলো 
ভালবাসা যদি মরীচিকা ছিলো তবে 
কেন সেদিন আগলে দাড়ালে মোর পথ বলো ।।

ঘৃণা ভরে দিলে অন্তরে আজ ভালোবাসি বলে 
আমি যে নই গো তোমার সেই স্বপ্নকন্যে 
প্রীতিমূর্তি রূপে যে নারী এসেছিলো সেদিন 
বাদল মেঘে ভেসেছিল ওই আকাশ নবীন ...

নিথর হয়ে পড়ে রইলো আমার স্বপন 
কেটেছিলো সেদিন মিথ্যা প্রেমঘোর যেমন 
চিরতরে দূরে চলে যেতে সময় এলো চলে 
অশ্রু হয়ে ঝরবো এবার তোমার নয়ন হতে---

দেখব আজ কে প্রিয়জন মুছাবে সে অশ্রু 
মনে পর্বে একদিন ভিখারী সে এসেছিল এক 
তোমার দুয়ারে নিতে প্রেমের ভিক্ষা --
আজ দেখো মিশে আছে সে তোমার চরণ ধুলায় 
নীরব প্রাণ এক --একমুঠো প্রেমভিক্ষার আশায় ।।

                                               ..........অরুণিমা 

বুধবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১২

কৃষ্ণ পক্ষ

















টানবি আবার
হুজুগ ভরে বৃন্দাবনের অস্তাচলে 
একলা রাখাল 
কৃষ্ণচূড়ার নির্জনতা  রক্ষা করে ...

হিসেব কত গোলমেলিয়ে 
শ্যাওলা জমা একটা বাঁসি 
জটলা করে যোগ বিয়োগে 
স্পর্শকাতর ঠোট পিয়াসী 

আমরা সবাই চশমা চোখে
খুজছি যখন প্রেমের চিঠি 
একলা রাখাল হেঁসে বলে ,
"রাষ্ট্রবাদী পাবলিসিটি "....

ঝুলবে কবে ফাঁসির কাঠে 
ওপারের কোন দ্বন্দ্বপ্রেমী 
আমরা সবাই চা মুড়িতে 
খুশির আমেজ অস্তগামী 

চিঠি একটা গেল পাওয়া 
অনেক করে ঘাটাঘাটি 
রাখাল বলে ,"ওটা দেশের 
peace policy র খসড়াপাতি।"

বারোর হুজুগ এবং আমাদের ‘বারোমাস্যা’

(সৌ) মেঘ অদিতি
 বছর দুই আগে একটা হলিউড ছবি বাজারে চালাতে গিয়ে গোটা দুনিয়া জুড়ে জানিয়ে দেয়া হলো যে দুনিয়াটা আর থাকবে না ডিসেম্বর বারোর পর। এমনিতে যে মায়া সভ্যতার উত্তরসুরী লাল-ভারতীয়দের আমরা মার্কিনিদের দেখা দেখি মানুষ বলে ভাবতে শিখিনি হঠাৎ তাদের পুরোনো ধাঁচের জ্যামিতি আর জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা উপচে পড়ল যেন। কেন, না হলিউডে টাকার গাছের কারবার করেন  যারা সেই  সাহেবেরা আমাদের বলেছেন সে কথা। আমাদের বিশ্বাস না হয়ে যায় কোথায়! সাহেবদের কথা বেদের বাক্য। সাহেব না বললে আমরা রবীন্দ্রনাথ- বিবেকানন্দকেও জাতে তুলিনি। তাদের  অমান্যি করলে পাপ হয়। কলেজে অধ্যাপকেরা যখন ছাত্রদের জানিয়েছেন এসব মিথ্যাচার—--ছাত্র নাক কুঁচকে তার বন্ধুদের জানিয়ে দিয়েছে, স্যর বড্ড সেকেলে মানুষ। ‘বিজ্ঞানী’রাও বলছে দুনিয়া ধ্বসে যাবে ! স্যর মানেনই না। আজ সেই মৃত্যু ভয় উবে গেছে। যারা সেই ভয় জাগিয়েছিল তারা সব চুপ মেরে গেছে । এখন তারা বিয়ে আর ভ্রমণের বাজার গরম করেছে নতুন হুজুগে। সেই হুজুগ বারোর হুজুগ। এমন দিনটি বুঝি আর আসবেই না। আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, শেষ বারোর আগেতো একখানা বিশ( ২০) আছে রে বাবা! বাজার জানিয়ে দেবে আপনার কণ্ঠে বিষ। মানুষের ভালো কিছুই দেখেন না। সত্যিই বিষ! এই বারোতো আর আসবে না। কিন্তু আমাদের বারো? বলছি দাঁড়ান। তাকে ছেয়ে ফেলা হয়েছে, ঢেকে ফেলা হয়েছে...একটুতো পশ্চিমী মেঘের বিষ সরাতেই হবে।  

                              তস্মিন্নদ্রোকতিচিদবলাবিপ্রযুক্ত স কামী
                              নীত্বামাসাঙ্কবলয়ম্ভশরিরক্ত প্রকোষ্ঠঃ
                              আষাঢ়স্যপ্রথমদিবসে মেঘমাশিলষ্ট সানু
                             বপ্রক্রীড়া পরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ম দদর্শ।।

                মেঘদূতের একেবারে শুরুর দিকের দ্বিতীয় স্তবক এটি। স্ত্রী বিরহে কামনা তাড়িত যক্ষ ঐ পর্বতে মাস কয় কাটিয়ে দিল। আষাঢ়ের প্রথম দিনেই পাহাড়ের চূড়োতে ঝুকে পড়া মেঘকে ও যখন, দেখল মনে হলো যেন প্রেমোন্মত্ত হাতি শূঁড়ে তার প্রেয়সীর গা ধাক্কা দিচ্ছে।
           মোটামোটি অনুবাদটা এমনি। আষাড়-শ্রাবণের কাব্য এটি। স্মরণ করুন এর দুই ভাগের নাম পূর্বমেঘ এবং উত্তর মেঘ। অনেকে তাই বলেন একে ‘বর্ষাকাব্য।’ তার মানে পুরো এক ঋতুর কথা। ঋতুর কথাতে পরিপূর্ণ কালিদাস এবং সংস্কৃতের কাব্য যত। ঋতু কিম্বা প্রকৃতি নইলে যেন অলঙ্করণ পূর্ণ হতো না তখনকার কাব্যকথার।  তাই কালিদাসের একটি পুরো কাব্যের নামই হলো ‘ঋতু সংহার’। কোন কাহিনি নেই। আছে বিরহী পুরুষের চোখে নারী আর প্রকৃতির বিচিত্র সব রূপ বর্ণনা আর আছে অবশ্যই বিরহের কথা। এখানে সবটার পরিচয় দেয়া স্বস্তিকর হবে না, আমাদের আধুনিক রুচিবোধে আটকাতে পারে। কিন্তু এখন যখন এই বারোর হুজুগে মেতেছে বিশ্ব তখনকার ঋতু হেমন্ত বলে আমরা হেমন্তের কথা বলতে গিয়ে লেখা প্রথম স্তবকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি নির্বিরোধ।
                                  নবপ্রবালোদ্গমসস্যরম্যঃ
                                 প্রফুল্ললোধ্রঃ পরিপক্বশালিঃ
                                বিলীনপদ্মঃ প্রপতত্তুষারো।
                                হেমন্তকালঃ সমুপাগতঃ প্রিয়ে।।

হেমন্ত এসেছে প্রিয়ে। নতুন পাতা দিয়েছে দেখা, শষ্যেরা  উঠেছে  সেজে। লোধফুল ফুটেছে দেখো,শালিধান পেকেছে মাঠে, নিস্প্রভ হয়েছে পদ্ম আর তাতে ঝরছে তুষার।
                কিন্তু ঋতুতো ছয়ের হিসেব। আমাদের কাজ বারোকে নিয়ে।  চান্দ্রপঞ্জিকাতে বারোমাস থাকলেও সে নিয়ে তত মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না  তখনকার কবিদের। মেঘদূতের 'আষাঢ়স্যপ্রথমদিবসে'র মতো নজির বেশি মেলে না তেমন। প্রেম আর প্রকৃতিকে মেলাতে পারলেই কাজ চলে যেতো তখন। তাই মেঘদূতের আগে পরে, দূত কাব্যের এক জনপ্রিয় ধারা ছিল, যেমন পবনদূত, পদাঙ্কদূত, হংসদূত, ভ্রমরদূত, বাতদূত, কোকিলদূত ইত্যাদি নামে একগাদা কাব্য থাকলেও বারোমাস্যা জাতীয় কিছু নেই। হয়তো কবিরা রাজসভার কবি ছিলেন বলেই এক একটা মাস যে সময়ের হিসেবে অনেক সে যন্ত্রণা তাদের পোহাতে হয় নি।
         যারা রাজসভার কবি ছিলেন না তারাও মাসটাস নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন বলে মনে হয় না। হাজার বছর আগে বাংলা যখন ভাষা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে তখন কিছু কিছু বাঙালি কবি অবহট্টে কিছু কবিতা লিখেছিলেন।   এই যেমনঃ সো মঝু কন্তা/ দূর দিগন্তা/ পাউস আএ / চেলু দুলায়ে। এর বাংলাটা মোটা মোটি এরকম। প্রিয়তম দূর দেশে/ দিগন্ত পার/ ওড়না ওড়ালো এসে মেঘ বরষার। কিম্বা ধরুনঃ গজ্জই মেহ কি অম্বর সামর/ ফুল্লই ণীপ কি বুল্লই ভামর/ এক্কল জীঅ পরাহিণ অস্মহ/কীলউ পাউস কীলউ বম্মহ।। এর বাংলাটা কাব্য অনুবাদে  মোটামোটি এরকমঃ মেঘে ডাকছে কি?  আকাশ কি হয়েছে  কালো?  কদম ফুটেছে কি?    ভোমরা কি গাইছে ভালো? পরের অধীন আমার এই একলা জীবন,/  নাচুক বর্ষা, নাচুক নাহয় মত্ত মদন।
             ঠিক ওই সময়েই বাংলাতে খনার বচন বেশ জনপ্রিয় হচ্ছিল। ইনি যে কবেকার মহিলা, কেউ ভালো জানেন না। সিংহলের মেয়ে বলে বলেন অনেকে। অনেকে বলেন চব্বিশ পরগনার বারাসতের দেউলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম।  ওড়িয়া ঐতিহ্যে খনার নাম লীলাবতী।  কেউ কেউ অতি উৎসাহে একে কালিদাসের কালের রাজা বিক্রমাদিত্যে নবরত্নদের একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহের ছেলে মিহিরের বৌ ভাবেন। বিপরীত পক্ষ বলেন সেরকম হলে তাঁর উল্লেখ কালিদাসেও থাকত, আর বাংলা ওড়িষার বাইরেও তাঁর পুরনো প্রভাব পাওয়া যেত। তাই খনার বচন আসলে বাংলার কৃষকদের সন্মিলিত এক আবিষ্ক্রিয়ার নাম। সে যাই হোক,  খনার জনপ্রিয়তা এখনো বাংলার গ্রামে গঞ্জে এতো প্রবল যে সেকালের ভাষাতে তাঁর বচন পাবার উপায় নেই। তাঁর বচনে একেবারেই অকাব্যিক বৈষয়িক দরকারে বারোমাস মেলে। এই যেমনঃ  দাতার নারিকেল, বখিলের বাঁশ/কমে না বাড়ে বারো মাস। কিম্বা ধরুনঃ  বারো মাসে বারো ফল/না খেলে যায় রসাতল।মাসগুলোর উল্লেখ বা ইঙ্গিত পাবেনঃ এই যেমনঃ গাছে গাছে আগুন জ্বলে/বৃষ্টি হবে খনায় বলে। কিম্বাঃ চৈত্রেতে খর খর।/বৈশাখেতে ঝড় পাথর।।/জ্যেষ্ঠেতে তার ফুটে।/তবে জানবে বর্ষা বটে। কিম্বাঃ আষাঢ়ে পনের শ্রাবণে পুরো/ধান লাগাও যত পারো। কিম্বাঃ  তিন শাওনে পান/এক আশ্বিনে ধান। কিম্বা ধরুনঃ  পটল বুনলে ফাগুনে/ফলন বাড়ে দ্বিগুণে। কিম্বাঃ  ফাগুনে আগুন, চৈতে মাটি/বাঁশ বলে শীঘ্র উঠি।       ( সৌজন্যঃ somewhereinblog)
            আমাদের চাষাভূষাদের আধুনিক মধ্যবিত্তরা মুর্খ  ভাবেন। কিন্তু ওমন সুন্দর অলঙ্কার এবং নিখুৎ ছন্দজ্ঞান বহু বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকেও দুর্লভ। এমন নয় যে যারা এই বচনের স্রষ্টা তারা সবাই নিরক্ষর, স্বাক্ষরও ছিলেন অনেকে। কিন্তু এগুলো তৈরি হয়েছে কিন্তু মুখে মুখে। লেখা হয়েছে পরে। মনে হয় না বটতলার পঞ্জিকা চালু হবার আগে।
              এরমক প্রায় প্রতিটি মাসের কথা খনাতে পাবেন।  এ বোধ করি এর জন্যেও যে তাঁর বচন স্পষ্টতই কৃষক জনতার জন্যে আর তাঁরা বাংলার চর্চা করতেন। যারা সংস্কৃতের চর্চা করতেন তাঁরা কৃষি কাজ করতেন না সরাসরি। এই খনা, প্রাকৃতপৈঙ্গল এবং আমাদের বিখ্যাত চর্যাগীতিকোষ  প্রায় একই সময়ের রচনা। এগুলো  বা পরবর্তী কালেও কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা পদ্মাবতী কাব্যের মতো কিছু রচনা বাদ দিলে  প্রায় কোনটাই রাজসভার কাব্য নয়। এগুলোতে চিত্রিত চরিত্রদের কেউ কেউ রাজপরিবারের বলে বর্ণিত হলেও কৃষিজীবনের সঙ্গে এদের দূরত্ব খুবই কম। এরা নিতান্তই স্থানীয় দেওয়ান যাদের রাজা বলা হতো তেমন কিছু  হয়ে থাকবেন।  অন্যথা সতীনের ষড়যন্ত্রে খুল্লনা ছাগল চরাতে যাবেন কেন, কিম্বা মৃত স্বামী নিয়ে বেহুলা কলার ভাসানেই ভাসবেন কেন। আর ব্যাধ কালকেতু পরে এতো সহজে গুজরাট নগরের রাজা হবেন  কী করে? পূর্ববঙ্গ গীতিকার রাজাতে আর প্রজাতে এই প্রভেদবিহীনতা অনেক বেশি স্পষ্ট। সম্ভবত তাই, ঐ দূতকাব্যের মতো ‘বারোবাস্যা’ বলে বাংলাতে এক কাব্যধারাই গড়ে উঠেছিল। কখনোবা কবিরা এগুলো বড় আখ্যান কাব্যেই জুড়ে দিতেন। তাতেই কবিকঙ্কনের চণ্ডীর ফুল্ল্রার বারোমাস্যা আমাদের খুব পরিচিত। সতীন ভয় দূর করতে ফুল্লরা ইনিয়ে বিনিয়ে তাঁর বারোমাসের বড় দুঃখের কথা বর্ণনা করছে চণ্ডীর কাছে । হয়েছিল এই, সারা দিনমান ঘুরে শিকার টিকার না পেয়ে কালকেতু ব্যাধ এক সাপকেই পথে পেয়ে ধরে আনে। ফুল্লরাকে ঘরে না পেয়ে সেই সাপকে রেখে  বেরিয়ে যায়। হাটে গিয়ে তাকে পেয়ে  সেই সাপের কথা জানায়। ফেরার পথে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে খুদ লবন কিছু ধার করে নিয়ে যেতে বলে। সেই সাপ ততক্ষণে ষোড়শি সুন্দরী সেজে বসে আছে। শুধুই কি তাই ! বিশ্বকর্মাকে ডেকে এনে সেই সাজের ষোল কলা পুরো করে রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ি ফিরে এই মেয়েকে দেখে ফুল্লরার মাথাতে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। খিদে তৃষ্ণা সব ছুটে পালায়।  কে সে মেয়ে,  কোত্থেকে এসছে ইত্যা্দি হাজারো প্রশ্ন আর বাড়ি ফিরে যাবার অনুরোধে জেরাবার করে। সে চাপে  হার না মেনে মেয়ে বলে কিনা’ মোরে এতো জিজ্ঞাসায় তোর কিবা কাজ।/ থাকিব দু’জনে যদি না বাসহ লাজ।”। তখন  ওকে ভয় দেখাতে  ফুল্লরা ‘বারোমাস্যার’ ফন্দি ধরেঃ
                            পাশের বসিয়া রামা কহে দুঃখবানী।
                            ভাঙ্গা কুড়্যা ঘরখানি পত্রের ছাওনী।।
                            ভেরেণ্ডার খাম তার আছে মধ্য ঘরে।
                            প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে।।
                           অনল সমান পোড়ে খরতর রবির কিরণ।
                            শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞার বসন।
                            বৈশাখ হৈল আগো মোরে বড় বিষ।
                            মাংস নাহী খায় সর্বলোকে নিরামিষ।।
                           পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস প্রচণ্ড তপন।
                           খরতর পোড়ে অঙ্গ রবির কিরণ।।
                           পসরা এড়িয়া জল খাত্যে যাত্যে নারি।
                           দেখিতে দেখিতে চিলে লয় আধা সারি।।
                           পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস।
                             বেঙচের ফল খায়্যা করি উপবাস।
এমনি করে করে ফুল্লরা যখন এসে চৈত্রে পৌঁছোয় শুনে মনে হবে গোটা বছর সে না খেয়েই থাকে। শুধু কি তাই?
                           সহজে শীতল ঋতু ফাগুন যে মাসে।
                          পোড়ায়ে রমণিগণ বসন্ত বাতাসে।।
                          মধুমাসে মলয় মারুত বহে মন্দ।
                          মালতীর মধুকর দিয়ে মকরন্দ।।
                          বনিতা-পুরুষ যত পীড়য়ে মদনে।
                           ফুল্লরার অঙ্গ পুড়ে উদর দহনে।।
                           দারুণ দৈব দোষে গো দারুণ দৈব দোষে।।
                           একত্র শয়নে স্বামী যেন ষোল ক্রোশে...

             এর পর অন্তত ফুল্লরা আশা করতেই পারত বেহায়া মেয়ে তার বাড়ি ছেড়ে উঠে চলে যাবে। বলে কিনা, “আজি হইতে মোর ধনে আছে তোর অংশ।” বেচারি ফুল্লরা আর করে কী? চোখের জলে কাজল গলিয়ে মুখ কালো করতে করতে হাটে গেল স্বামীকে ধরে একটা বোঝাপড়া করে নিতে।   সেই বোঝাপড়ার পরিণাম কী হয়েছিল আপনারা জানেন, কালকেতু রাজা হয়েছিল, আর ফুল্লরা রাণি।
            তেমনি একখানা কাব্য আছে ‘দেওয়ানা মদিনা’ । পূর্ববঙ্গগীতিকাতে সংকলিত হয়েছিল। দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে এই গীতিকাগুলোই আসলে বাংলা সাহিত্যের প্রধান স্রোত। এগুলোতে ধর্ম কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নয়। দেব মহীমাতে ভাগ্যের ফের পাল্টায় না চরিত্রগুলোর ।  ভাতৃপ্রেমের টানে আলালের ভাই  দুলাল যখন ছেলে সুরুজ  সহ স্ত্রী মদিনাকে ফেলে রেখে যায় বৌ একদিন কেঁদে কেঁদে স্মৃতিচারণ করেঃ
                                    লক্ষী না আগন মাস বাওয়ার ধান মারি।
                                    খসম মোর আনে ধান আমি ধান লাড়ি।।
                                    দুইজনে বইসা শেষে ধানে দেই উনা।
                                    টাইল ভইরা রাখি ধান করি বেচাকিনা।।
                                    হায়রে পরানের খসম এমন করিয়া।
                                  কোন পরানে রইলা তুমি আমারে ছাড়িয়া।।
            খ্যাতনামা কাব্যগুলো যখন গতানুগতিকতার অনুসরণ করে বৈশাখ মাসে বারোমাস্যার শুরু করত, ‘দেওয়ানা মদীনা’র কবি সেখানে অনেক বেশি বাস্তবোচিত বলে দীনেশ সেন প্রশংসা করেছিলেন। অগ্রহায়ণে নবান্ন। সুতরাং বিরহিনীর সেই দিনগুলোর কথাই আগে মনে পড়েছে।
        এখন অঘ্রান মাস। বাংলা সন মাসের কথা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। অথচ যদি তা না করতাম তবে বর্ষোৎযাপন  করতে গিয়ে আমাদের নিজের গোলাভরা  এই ‘বারোমাস্যা’ গীতের সোনার ধান তথা পরম্পরার থেকে মণিরত্ন তুলে আনবার কথা আমাদের মনে থাকত।বারো বারো বারোর ( ১২-১২-১২) বাজারের তৈরি হুজুগে মাততাম না আমরা।  সেগুলোকে ভুলে থাকা সত্যি আমাদের কঠিন হতো।  হয়তো, আমরা নিজেরাই সেগুলোর একালের সংস্করণে মন দিতাম। শুধু কি বাংলাতে? অভিভক্ত বাংলাদেশের অন্যান্য ভাষাগুষ্ঠী যেমন চাকমা, হাজং, ত্রিপুরি, রাজবংশীদের মধ্যেও এই পরম্পরা সমানে জনপ্রিয় ছিল। খুঁজতে গেলে হয়তো দেখা যাবে ওই সব কোন জনগোষ্ঠী থেকেই এই বারোমাস্যার এই রীতি বাংলাগানে সাহিত্যে এসে ঢুকেছিল। এই যেমন একটি হাজং গানঃ
                          সাধুরে, পৌষ মাসনি সাধুরে ময় পুজি অধিকারী।
                          ভাতার ভুকতি করে যারা ভাগ্যবতী নারী।।
                          ভাতার ধন, ভাতার মন, ভাতার সকল সার।
                          ভাতার বিনে নাইরে গতি এ ভব সংসার।।
                          সাধুরে সিয়ুমাস ফলে সাধুরে মোলা ইয়ুমাস ফলে।
                           কান্দে গাবুর কইন্যা হাত দে কপালে।।
                            সাধুরে- পৌষ মাসেগো সাধু পুজি অধিকারী।
                          পতিভক্তি করে যারা ভাগ্যবতী নারী।।
                           পতিধন, পতিধন, পতি সকল সার ।
                            পতি বিনে নাইরে গতি এ ভব সংসারে।। (সৌজন্যঃ shapludu)
           শুনে কি মনে হয় যে এ কোনো একক বিরহিণী সতীর কান্না! মনেকি হয় না,  কোনো এক দূর অতীতের দিকে ক্রমেই পশ্চাদধাবমান আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি , তার হয়তো নাম ‘বাংলা’, আমাদেরই মতো বিশ্বাসঘাতক উত্তরপুরুষদের ডেকে ডেকে আকুতি করছে, ফিরে দাঁড়াতে। রবীন্দ্রগীতে যেমন ছিল ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে,   আ য় আ য় আয় ।/ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে,   মরি   হায়   হায়   হায়…কোন সে নাটকে জুড়েছিলেন  গানটা মনে করুন। রক্তকরবী।  আর আমরা শুনেও না শোনার ভান করে কোন এক হঠাৎ নবাব আলালের জালের  জড়াচ্ছি এর নাম দিয়েছি ‘প্রগতি’ , নাম দিয়েছি ‘আধুনিকতাবাদ’।