“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১২

লোকাল লেডিস কামরা~~~~~~~~~~~~~~~

  ঐ আসছে ক্যাটারপিলার !কোমর দোলাতে দোলাতে । রোজদিন  রিয়া টেনশন ফ্রি  হয় এ ভাবে !! এরপর তো যুদ্ধ শুরু । ঐ এল । ওঠা গেলো  । মহিলা কামরা । একটি  ছোটখাটো প্রমিলা রাজ্য বল্লেও কম বলা হয় ।  আপাত শ্রেণি বিভাজন আছে কিন্তু আধিপত্য উচ্চবর্গের হাতে নেই। স্কুলের দিদিমনিরা সংখ্যায় বেশী। নরেন্দ্রপুর ,গড়িয়া , থেকে বনগাঁ  , কৃষ্ণনগর   ,ডানকুনি । কোথায় নয়? উত্তর থেকে দক্ষিন , পুব থেকে পশ্চিম ;  মেন থকে কর্ড সব লাইন । কখনো গঙ্গা পেরিয়ে ,কখন  ভ্যান  রিক্সায় , ট্রেনের আগু পিছু সব কিছু চেপে হাঁপাতে হাঁপাতে  ট্রেন ধরা ।  তবুও  যথেষ্ট সেজেগুজে পরিচ্ছন্ন হয়ে আসেন । পোশাক নিয়ে অনেক হাল্লা চিল্লা পেরোতে হয়েছে তাদের । কেউ নড়াতে পারেনি । দিদিমনিদের দেবী ভাবের  ধাচা  থেকে বেশ ভালই  মুক্ত হতে পেরেছেন নতুন প্রজন্ম । বসে কেউ একটু ঝিমিয়ে নেন । সকালে ঘুম থেকে ওঠা অব্দি ঘোড় দৌড়  । রান্নার লোক থাকলেও বাচ্চার টিফিন , নিজের টিফিন ,  বরের টিফিন । এখন খাওয়া তখন খাওয়া  বন্দোবস্ত করা ।দিনের সব কিছুর ব্যবস্থাপনা  করে রেখে আসা । ফিরতে ফিরতে তো সেই সন্ধ্যে । সুতরাং একটু খানি চোখ বোজা । কেউ কেউ আবার বই খুলে বসেন । এই তো দিনে একটুখানি নিজের মত করে সময় পাওয়া । কখন দেড় , কখন দুই ঘণ্টার যাত্রা । কেউ কেউ আবার এই সময় টুকু নিজের খাতা খুলে বসেন । কোথায়  কবে কি করলেন । বর কবার বিদেশ গেলেন  ,ছেলে কত টাকা রোজগার করে , সে বছর ক টাকা বর ইনকামট্যাক্স দিয়েছে ।  তা নিয়ে আবার মজাও কম হত না । এই রকম লোকদের খচাতে জুড়ি ছিলনা সুমির ।  'তারপর কি হল বলুন না  সীমাদি । ছেলের জন্য পাত্রি পেলেন , কোটিপতি ,ইঞ্জিনিয়ার ?' তিনি অতি উৎসাহে বলতে লাগলেন বর এবং ছেলের খতিয়ান । আর তারপর পিটপিট করে হাসতে লাগলো  আশপাশ।
           তা সে দিদিমনিদের ওপর আবার অনেকে মহা খচা । 'এই এসেছেন ~ এখনি শুরু হবে কোথায় নামবেন , কোথায় নামবেন ।' দোষ নেই এতক্ষনের যাত্রা বসতে তো হবেই ।  কোন কোন যাত্রি সহৃদয় । উদ্যোগী হয়ে  বল্লেন কোথায় নামবেন । কেঊ কেঊ  কিছু বললেন না । কিন্তু টুক করে পরের স্টেশনে নেমে গেলেন ।   সিটটি হয়ত পাওয়া গেল না ।
         সাড়ে দশটার ট্রেনে থাকে সবজি মাসিরা । ভোর চারটের উঠে বেরোতে হয় । তারপর শেয়ালদায় সবজি বিক্রি ।সব সময় কিছু বলার জন্য  ব্যস্ত ।  হয়ত সারা দিনের ক্লান্তি ।  তবে প্রায়ই সবার সঙ্গে উচ্চকিত । দিদিমনিরা জায়গা পাননি দাঁড়িয়ে আছেন । চুল উড়ে যদি কোন কারণে গায়ে লাগে তাহলে খুব রাগ হয় মাসিদের । এ নিয়ে বেশি কথা বলতে গেলে বলে বসল হয়ত' জানি জানি ব্যাগ দুলিয়ে কোথায় যাও ! 'সব্বনাশ ! তারপর আর মুখ খোলে কেউ ? ভদ্রলোকের  নিকুচি করেছে । পুরো আকুপাংচার ভদ্রতার মানদণ্ড। জেনারেল কামরায় থাকলে  দেখা যাবে  সঙ্গে  একটি  প্রেমিকপ্রবর  বর নয়, আশনাই -এর রকম সকম দেখলেই  বোঝা যায় ।  চোখে মুখে লজ্জা । এরপর উঠবে  সকালের খাবার । সেই কোন রাতে  উঠে কোনোমতে দৌড়ে বেরিয়ে আসা । কারো  কারোকে  আবার এর মধ্যে রান্না বান্না করে রেখে আসতে হয় । মুখে চা ছাড়া কোন কিছু দিয়ে আসা হয় না । তাই খাওয়া । পরোটা ,আলুর দম , ডিমের ঝোল কখনো কখনো । সঙ্গে জল ও নিয়ে আসে ভেন্ডার ছেলেটি । শেষে মিষ্টি । খুব যত্ন করে খাওয়ায় ছেলেটি । সবাই মিলে হই হই  ,যেন যৌথ পরিবার খেতে বসেছে । এটাই হয়ত সারাদিনের পুষ্টিকর খাওয়া ! তারপর সারা পরিবার কে খাইয়ে কি আর জোটে । বাড়ি পৌঁছেই তো ঘোড় দৌড় শুরু হবে । ফুলওয়ালি  ও ব্লাউস মাসিদের  আবার কাজেও বসতে হয় বাড়ি গিয়ে ।  দশটি  টি  ব্লাউসে বোতাম লাগালে এক টাকা । দশটি মালা গাথলে এক টাকা । তখন বাড়ির কন্যা সন্তানটিকে রান্নার হাল ধরতে হয় । তাই কখন কখন  ট্রেনে বসেই হাত চলতে থাকে ।বিকেলের ট্রেনে থাকে শেয়ালদার দিদিরা । দাঁড়াতে হবে স্টেশনের বাইরে খদ্দের ধরার জন্যে । ভেতরে গেলে পুলিশের ঝামেলা । তাদের মুখে সব সময় একটি সংকুচিত ভাব । সিঁথিতে এক ঢাল সিদুর । নিপুন শাঁখা পলা । মলিন একটি  ব্যাগ । কথা খুব কম বলে । ঝামেলা হলে অন্যকথা । তখন রণরঙ্গিণী ।  আর আছেন সুনিপুন নারী সাজে  মানুষ । দঙ্গল বেধে ওঠেন । চুন থেকে পান খসার দরকার নেই ,এমনিতেইরাখে হরি মারে কে । ভয়ে কাঁটা । বসার জায়গা দিয়ে নিশ্চিন্ত ।

             অপূর্ব মানুষের অবিরাম চলা । মনে হয় সমস্ত সমাজটা যেন এক কামরায় ঢুকে গেছে ।  শ্রেণিহীন রেলের কামরা । ছোট্ট একটি বাংলা । ভারতবর্ষ ছোট হয়ে নিজস্ব অবয়ব খুঁজে নিয়েছে।

1 টি মন্তব্য:

সুশান্ত কর বলেছেন...

দারুণ! এমন আরো লিখে চলুন! বহু কথা জানাও যাবে!