“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১২

কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের ‘পুলিপোলাও’


‘পুলিপোলাও’ কবিতার বইটির এটি পান্ডুলিপি। প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩এ। লিখেছেন বাংলাদেশ থেকে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিশালী কবিদের একজন। ১৯৬৫তে ঢাকার কলাকোপা-বান্দুরায় জন্ম।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর । এখন কাজ করেন অষ্ট্রেলিয়ার একটি কর্পোরেট হাউসে।
                   এবং ‘প্রবাসে দৈবের বশে’ থাকতে হচ্ছে বলে যে যন্ত্রণা, তার থেকে বেরিয়ে আসে এমন পংক্তিমালা, “শুধুই প্রকৃতি, প্রকৃতির উচ্ছিষ্টেই তুষ্ট ছিনু বটে;/ না মরে পাষাণ দেশ, দিলা দীপান্তর /তোমার--তোমারই জন্যে তবু আমি দিবা বিভাবরী/ পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি!” বইটির মূল সুর এই।
                 বেশ কিছুদিন আগে  তাঁর নিজের পাঠের শরিক করতে পান্ডুলিপিটি আমাকে পাঠিয়েছিলেন ত্রিপুরার থেকে কবি বন্ধু প্রবুদ্ধ সুন্দর কর। প্রবুদ্ধকে বলেছিলাম, সুব্রতকে পড়বার কিছু সূত্র ধরিয়ে দিয়ে একটা ছোট্ট নোট লিখে দিতে। তবে, ‘ঈশানের পুঞ্জমেঘে’র মধ্যি দিয়েও সহপাঠি খোঁজে নেয়া সহজ হতো। প্রবুদ্ধ বুদ্ধিমান, সে দায় এড়িয়ে গেছেন। হয়তো আলস্য,নয়তো আমি যে শরিক হলাম তা প্রমাণের অপেক্ষায়।
          এবারে, আমি এই গদ্যের কারিগর, কবিতা পড়ি মাঝে মাঝে।কিছুটা ভালোবাসায়, কিছুটা দায়ে। যেমন এখন বন্ধুদায় এই দুটোকেই মিলিয়ে দিল। পড়েছিলাম সঙ্গে সঙ্গেই। দারুণ রকম টেনেওছিল। কিন্ত প্রবুদ্ধের কাছে ফিরে যাবার জন্যে আরো কিছু প্রস্তুতির দরকার ছিল। সত্যি বলতে কি এর আগে সুব্রত আমার পরিচিত ছিলেন না একেবারেই। তাঁর কবিতা কোথাও পড়লেও মনে ছিল না।  ইতিমধ্যে  ‘অগ্রবীজ’ কাগজটি হাতে এলো। যার সম্পাদক মন্ডলীর অন্যতম সুব্রত। সেখানে সাম্প্রতিক সংখ্যাতে ভাষা নিয়ে তাঁর একটি লেখা আছে ‘প্রমিতাক্ষরা’। সে লেখাতে আরো অনেকের সঙ্গে ভাষা নিয়ে তিনি প্রচলিত বহু সিদ্ধান্তকে প্রশ্নের মুখে এনে ছেড়ে দিয়েছেন। এই ব্যাপারটি আমাকে টানল। কেননা, আমারও ভাষা নিয়ে ভাবনার স্রোত ঐ খাতে বয়। খুব ছোট্ট নজির তাঁর গদ্যের এবং বক্তব্যের , “অফ দ্য রেকর্ড। তোরেই তো? অনেক অনেক দিন আগে বোধ হয় একবার কইছিলাম যে বাংলাদেশের স্কুলগোয়ার-গো একই লগে কমসে কম তিনটা বাংলার লগে কুস্তি কইরা বড়  হইতে হয়,...... এই দুর্ঘট কলকাতার ছেলেপুলেদের নাই।এইটা একটা প্রকৃত হ্যান্ডিক্যাপ, কিন্তু আমাগোরই সমাজের একটা উপরওয়ালা শ্রেণি চায় যিশুর কাঁটার মুকুট-সম আমরা চিরকাল এইটা ধারণ করি, চিরকাল রক্তাক্ত হই (কেননা, আমরা হইলাম ইউনিভার্সাল ব্লাড ডনার)।”   ইনি যে একাবারে ফাজলামো করছেন না তা জানবার এবং বুঝবার জন্যে পাঠক ‘অগ্রবীজে’ লেখাটা পড়েই নিতে পারেন। ভাষার উপর তাঁর দখল যে কত গভীর তাঁর কবিতার নির্মাণেও তা ধরা পড়বে। যাদের তাও পড়বে না তাঁরা নিচের টীকা টীপ্পনি দেখে নিতে পারেন।
            ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে পরিচিতও হওয়া গেল। সেটি আজকের দিনে খুব কঠিন কিছু নয়। ফেসবুকে। কিন্ত কবিতা নিয়ে আলাপ হলো না। হবে। কিন্তু বইটি এখানে তুলবার অনুমতি নেয়া গেল। আলাপটি  করা গেল এবারে প্রবুদ্ধের সঙ্গে। কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগকে  হিসেবের বাইরে রেখে দিলেও তাঁর কবিতা পড়তে কারো অসুবিধে হবে না। ছন্দের মসৃণ টানে এবং তানে তা যাবে এগিয়ে। হ্যাঁ, সেই দশ আট ছয়ের পয়ারের লিখেছেন। কিন্তু পর্বগুলোকে সাজিয়েছেন নানা রঙে,ঢঙে এবং  বিস্তারে, নির্মাণ যেখানে যেভাবে দাবি করেছে। সেখানে তাঁর নৈপুন্য প্রশ্নাতীত। যারা অন্তমিল আশা করেন, তাদেরকেও তিনি অত্যুৎসাহেই প্রশ্রয় দিয়েছেন।  নাম নেই, আছে নম্বর। তাঁর মানে ১৯৯৫ থেকে ২০০১ অব্দি সিডনিতে বসে লেখা ৬৪টি কবিতার সবক’টিকে একটি মাত্র দীর্ঘ কবিতা বলে ভেবে যদি কেউ পড়ে ফেলেন তাতেও আপত্তি করবার কিচ্ছু থাকবে না। সেই দীর্ঘ কবিতার নাম ‘পুলিপোলাও’। ‘পোর্টব্লেয়ারে’র প্রচলিত  নামগুলোর একটি।
আমাদের কাছে ‘পোর্টব্লেয়ার’ নামটাইতো পরিচিত এবং প্রচলিতও? তবে আর এই সখ করে দুর্বোধ্যতার আমদানি কেন? এখানেই যেন তিনি ‘পরিচিত’, ‘প্রচলিত’ , ‘দুর্বোধ্যতা’র মানেকেও তীব্র শ্লেষে প্রত্যাহ্বান জানিয়ে বসেন। কার কাছে , কাদের কাছে? কারা এই ‘আমরা’? এই প্রশ্নগুলোও  বড় করে উঠে আসে। গ্রন্থনামের একটা টীকা তিনি জুড়েছেন এবং পড়ে আমাদের মনে হয়েছে তাঁর নামটিই সঠিক।  আমাদেরটিই এক ঔপনিবেশিক নির্মাণ। এই যে আত্মপরিচয়ের ঔপনিবেশিক নির্মাণ, একে ভাঙ্গতে গিয়ে তিনি ভ্রমণ করেছেন  বাংলাদেশ থেকে সিডনি কেবল নয়। সেতো করেইছেন এবং সেই ভ্রমণে থেকে গৃহকাতরতার কথা দিয়েই নির্মিত তাঁর প্রায় কবিতা। কিন্তু সেই সঙ্গে দেশ বিদেশ এবং অবশ্যই বাংলা তথা প্রাক-বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি খাঁজে পা ফেলেছেন নিবিষ্ট পরিব্রাজকের মতো। এবং সেখান থেকে যা কিছু সম্পদ পেয়েছেন তুলে এনেছেন। এবারে সে কাজওতো করেন যেকোনো কবি। কিন্তু তিনি যে কাজ করেছেন তাঁর চিহ্ন রাখবার জন্যে অনেক জায়গাতেই কোনো উদ্ধৃতি চিহ্নের দরকার বোধ করেন নি। তার চেয়েও বড় কথা সাধু-চলিতের যে রেল লাইনটির সঙ্গে আমরা পরিচিত, তার কোনো একটিতেই চেপে বসেন নি। তাঁর ভাষা পথ তিনি নিজেই নির্মাণ করে নিয়েছেন। ‘ছিনু’, ‘বাহিরিতে’ এই যে শব্দগুলোকে আমরা বাদ দেয়াটাকেই আধুনিকতার নির্দেশ বলে মেনে নিয়েছি, সেই নির্দেশকে তিনি হেলায় দূরে ঠেলেছেন।  তাঁর কবিতার ভাষার ‘আধুনিক’ যুগবিভাজনের কাজটি কঠিন বটে। এবারে যারা বাংলা ভাষাটিকে ভুলে গেছেন তাদের কাছেই মনে হতে পারে তাঁর ভাষাটি কঠিন।
হ্যাঁ, সাহিত্যের পরম্পরার সঙ্গে অপরিচিতিটা তাই বলে অপরাধ নয়, যদিও কবিতা পড়তে গেলে সেগুলোর চেয়ে কাজে  আসার সম্পদ আর কিছুই নেই, তাই তিনি এক দীর্ঘ টীকা জুড়ে দিয়েছেন শেষে। এটি তাঁর আগে কেউ করেন নি, করবার দরকারও বোধ করেন নি। কিন্তু তাঁর যেন আহ্বান, “হে পাঠক! যিনি আমার কবিতা পড়বেন তিনি আমার পূর্বসূরীদের পাঠ নিয়েছেন তো?” এ যেমন একধরণের কৃতজ্ঞ বিনয় তেমনি এক নতুন দীক্ষাও বটে। প্রবুদ্ধ বলছিলেন, আল মাহমুদ, ফারহাদ মাজহারদের পর আজকের বাংলাদেশে  সে ধারার কাউকে যদি পড়তে হয় তবে এই তরুণ সুব্রত অগাস্টিন গোমেজকে দিয়ে শুরু করতে হবে। তিনি আর দুই একটি নাম নিয়েছেন। কিন্তু আপাতত আমরা উল্লেখের দরকার বোধ করছি না।  
এই বইটির আগে পরেও বেরিয়েছে তাঁর বেশ কিছু বই। তার মধ্যে রয়েছে কিছু অনুবাদ এবং একটি উপন্যাস।  ‘অন্তউড়ি’ (আধুনিক পদ্য-রূপান্তরের চর্যাপদ, ১৯৮৯), ‘তনুমধ্যা’( কবিতা , ১৯৯০), ‘নির্বাচিত ইয়েটস’ ( অনুবাদ, ১৯৯৬), ‘এলিয়টের প’ড়ো জমি’ (অনুবাদ, ১৯৯৮), ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ (উপন্যাস , ২০০২), মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল’ (গল্প, ২০০৪), ‘কবিতা সংগ্রহ’ (২০০৬), দিগম্বর চম্পূ (কবিতা, ২০০৬), ‘গর্দিশে ছাসমে সিয়া’ (কবিতা, ২০০৮), ঝালিয়া ( কবিতা, ২০০৯), মর্নিং গ্লোরি (২০১০) এছাড়াও কিছু অষ্ট্রেলীয় কবিতার অনুবাদ করেছেন সৌম্য দাসগুপ্ত এবং অংকুর সাহার সঙ্গে, নাম ‘কবিতা ডাউন আণ্ডার’ (২০১০)। এক সময় মাসুদ আলী খানের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন ছোট কাজ ‘প্রসূন’। আশা করছি, এই নামগুলো অন্তত তাঁর সম্পর্কে সামান্য একটা ধারণা দিতেও বেশ খানিকটা সাহায্য করবে।



পড়ুন ‘পুলিপোলাও’ নিচে। আপনি একে নামিয়েও নিতে পারেন  পরে পড়বেন বলে, আর এখনই এখানে পড়তে হলেও পুরো পর্দাজুড়েও পড়তেই পারেন। নিচে দেখুন বোতাম আছে। হ্যা, আপনার ফ্লাসপ্লেয়ারের দরকার পড়তে পারে। সেটিও নিয়ে নিন এখানথেকে। ভালো লাগবে, যদি আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা এখানেই লিখে রাখেন। নথিবদ্ধ হয়ে থাকবে। লেখকও দেখতে পাবেন।
Pulipolao

৫টি মন্তব্য:

Ankur বলেছেন...

Bangla kabitaar ek gurutwopurNo milestone -- Pulipolaao. praay ek doshok aage prothom poRechhilaam. ekhono maajhe maajhe poRi. Sushanta-babu ke osonkhyo dhannyabaad!!

Subrata-r boiTir naam -- "gardishe chasme sia" -- maajher shabdaTi baad poRechhe. aar "chompu" bodh hoy deergho U habe.

aantorik shubhechchhaay.... Ankur

সুশান্ত কর বলেছেন...

আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ, অংকুর বাবু। তাহলে আশা করতেই পারি এখন আবার আপনি আপনার ভালোলাগা এই বই পাঠে বন্ধুদের শরিক করে নেবেন এখানে। হ্যা, 'চম্পূ' বানানটা ভুলই ছিল। ঠিক করে নিলাম। আর এটা দেখুনতো ঠিক হলো কিনা,"‘গর্দিশে ছাসমে সিয়া"।

Masud Khan বলেছেন...

Subrata Augustine Gomes Bangla Bhashar e-somoykar ekjon guruttopurno kobi o sahityik. TNar sobguli grothoi, bishesh kore Tonumoddhya, Pulipolao, Kalketu o Phullora (uponyash),AntouRi (Charyapad-er adhunik Bangla Rupantor).....Bangla Sahitye mulyobaan songjojon bole bibechona kori.

Osonghyo dhonnobaad, Sushanta.

সুশান্ত কর বলেছেন...

আপনার এই মূল্যবান মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ!

anita das tandon বলেছেন...

কবি সুব্রত আগস্টিন গোমেজের কবিতা গুলি পড়লাম । কবিতাগুলি বেশ কয়ক বার পড়ার পর প্রথম অনুভুতি ই বারে বারে হোল । অনুভূতির জায়গা কবি বড় খাঁটি রেখেছেন আর তাই আধুনিকতার মিশ্রণ এই কবিতাগুলি কে শুধু আধুনিক বা শুধু সো কাল্ড পুরানো কবিতা হিসাবে চিন্হিত করা যায় না । কিছু কবিতা খুব ভালো লেগেছে, কিছু একেবারে communicate করে নি । তবে অনুভুতির সাথে বুদ্ধির সংমিশ্রন খুব বেলেন্সড । তা ছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব কথক (if i am not wrong) ভাষা কে ব্যবহার করায় সুব্রতর কবিতায় একটা লোক সংগীতের মত স্বাদ পাওয়া যায়ে ।