“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

জাহাজডুবির পূর্বসংকেত
















                              


                                                               
 
 
 
 
 
 
 
 
 
     ।। ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ।।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 নিয়নের ত্রিসীমানা ছাড়ালেই বাঁশবন, পচা ডোবা, টিম-টিম কেরোসিন-আলো
অনন্ত ডুবোমাঠে উপুড় আকাশ, ঝিঁঝিঁ, রাতভোর শেয়ালের প্রহর –ঘোষণা;--
উলুঝুলু কবি, তুমি ভুলেও কখনো যেন কলকাতা ছেড়ো না...
কলকাতার চতুর্দিকে হাঁ-মুখ দাঁড়িয়ে ধু-ধু অন্ধকার মফসসল, ধুলো—
মাঝে মাঝে আলটপকা ঝলসে ওঠা শিল্পবলয়, কোনো রিকেটি শহর
কিছুদূরে চেকপোস্ট, কাঁটাতার, খোলা বেয়োনেট; আরো দূরে
ফেডারেল স্ট্রিম লাইন, প্রদেশ বা ভাষাগত মারমুখী জনতা,-পরবাস।...
ওখানে টিউব নেই, এয়ারকুলার নেই, টিভি নেই , লিফট নেই, ফ্লাইওভার নেই
স্টেশন –সিটিং নেই, গ্যালারি সদন নেই; বইমেলা, থিয়েটার, ফিলমক্লাবও নেই
কুলীন কাগজ নেই, দাগী প্রকাশক নেই; লেঙ্গি নেই, ভাঁওতা নেই, ডুডু ও তামাক নেই
কফি-ভবনের ভিড়ে তুখোড় দাদারা নেই, স্তাবক চামচারা নেই, পিঠ-চুল্কুনি নেই
দালাল-প্রতিভা নেই, ফরেইন মিশন নেই, মদ-মাগি-মচ্ছবের জবরদস্ত আখড়া নেই
শহীদ মিনার নেই, ফিচারের মজা নেই, শেয়ার-বাজার নেই, ঘোড়ার ঠিকুজি নেই
স্টিমার-পিকনিক নেই, ট্র্যাফিক জ্যামিং নেই; লাগাতার লোডশেডিং,
                                       চুরি ও ছিনতাই নেই
মাস্তানি-বিপ্লব নেই, মহান পুলিশ নেই, শৈল্পিক নির্লিপ্তি নেই, বিশুদ্ধ পাতাল নেই
লিগের মরশুম নেই, শেল কিংবা লাঠি নেই, চিকিৎসা-বিভ্রাট নেই,
                                      বৈদ্যুতিক চিতা নেই
যশোকামী কবি, তুমি ভেবে দেখো মফসসলে কত কিছু নেই। ...
মফসসল মানে চাপা পাড়াগাঁর অন্ধকার, লণ্ঠন-রহস্য, পচা পিছুটান, ক্লেদ—
গ্রামীণ বিষাদ ছুঁয়ে চাষাড়ে কবির জীর্ণ মলিন কাঁথার ফোঁড়, তেল-চিটচিটে
নোংরা লিটল ম্যাগ, ম্যাদামারা কবি-সম্মেলন, ত্রাহি গানের উৎপাত, চাঁচাছোলা
ভাষণের অত্যাচার , জোলো আপ্যায়ন, ধুলো-কাদায়-লোপাট পথে ভূত হয়ে ফেরা।–
পরবাস আরো বেশি ক্লান্তিকর, পশ্চিমে ততটা নয়, পূবদিকে যতটা দুঃসহ—
ওখানে লণ্ঠন কিংবা ভৌতিক রহস্য নেইঃ শুধু গ্রানিটের দীর্ঘ ওঠানামা, ভারী
নদীর গর্জন; হিংস্র মানুষ ও পশুতে ভরা নিওলিথ-অরণ্যের জমাট আঁধার।–
ওখানে বাঙালি যারা, নিতান্ত ছাগল—কেউই বাংলা জানে না; এই কলকাতা হতে
নেহাত কাগজপত্র কিছু রোজই উড়ে গিয়ে এখানে ওদের মোটামোটি মানুষ রেখেছে;
পদ্যের ব্যাপারে ওরা নির্ঘাত পিছিয়ে আছে একশো বছর , আর
             দুঃখের কথা কী বলব,---
অমন রবীন্দ্রনাথ, তেনাকেও মিনিমাম তিনজোড়া লাথির ঘায়ে যারা অনায়াসে
ধুলোয় লুটোলো,--ঘোর মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে, রমণী দমন করে, যারা
শুধু কবিতার জন্যে ভুবন পেরিয়ে এসে, শিল্পকে পেঁদিয়ে করল তুরুপের তাস—
সেসব বিশ্রুতকীর্তি, তুলকালাম প্রতিভার নাম এরা স্বপ্নেও শোনেনি। ...
এসব জেনে ও বুঝে, হুঁশিয়ার কবি, তুমি ভুলেও কখনো যেন কলকাতা ছেড়ো না;--
কলকাতার কবি মানে রাজকবি, জমিদার—তামাম মফসসলে ছড়ানো রয়েছে এনাদের
হাজারো মহাল; আছে নায়েব, গোমস্তা, পাইক, পেয়াদা এবং যত বংশবদ প্রজা।–
মাঝে মাঝে ট্যুরে যাবে, হাওয়া বদলাতে যাবে, কখনো-বা সপরিবারেও—
দেদার কবিতা পড়বে, মুফতে আরাম লুটবে, ঢালাও অ্যাডভাইস দেবে,-দেখো
এদেশে এখনো শুধু উপদেশ ট্যাক্সো লাগে না; আর-সাধ্যের ভিতরে যেন কোনো
প্রতিশ্রুতি কাউকে দেবে না। শোন মদ খাবে বুঝে শুনে, লুকিয়ে-চুরিয়ে; আর
রমণী-ঘটিত ঝুটঝামেলা এড়িয়ে চলবে; দিনকাল খারাপ—
             হুম, জানোই-তো ভায়া—

এদানিং মফসসলও যথেষ্ট লায়েক হচ্ছে, ইতি বলতে বেমালুম বুঝে নেয় গজঃ ।...
সম্প্রতি মহালে বেশ হামলা চলছে, দ্রুত অসন্তোষ বাড়ছে নির্বিরোধ প্রজাদেরও মনেঃ
কাগুজে বাঘের খুব উপদ্রব; কয়েকটি মহাল চাইছে অটোনমি, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভবন।–
এইসব দুর্বিনীত , বিচ্ছিন্নতাকামীদের পিছনে নির্ঘাত আছে বিদেশি শক্তির উস্কানি,--
এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র সেলে জোর গবেষণা চলছে; আপাতত বন্ধ আছে ধোপা ও নাপিত,
কুলীন কাগজ আর বইপাড়ার সবকয়টি গোপন জানালা বন্ধ; এই সব রাজদ্রোহীদের
কী করে শায়েস্তা করবে কলকাতার জানা আছে; এরপর মোক্ষম ছাড়বে বিলিতি দাওয়াই,
 কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা, বিষেন বিষক্ষয়; সংক্ষেপে বলিতে গেলে, হিং-টিং-ছট।...
জনান্তিকে বলে রাখি, মেট্রোপলেট কবি! নিতান্ত প্রাণের দায়ে সবিশেষ করহ শ্রবণঃ
মফসসলি বালিকারা প্রণয়কুশলা নয় কলকাতার সুরঙ্গমা, কলাবতী নারীর মতন—
বিবাহে প্রশস্ত এরা, টলমলে দুটি শান্ত চোখের ছায়ায় যেন দিঘির অতল হাতছানি;
এদের সহিত তুমি নিছক আলাপ রাখবে, ডাকবিভাগের কোনো সদাশয় পিয়োন-মারফত—
সেইসব পিয়নেরা , যাহাদের গোঁফ ভারী, চোখ লাল, পরিধানে খাকিরং পুলিশি পোশাক,
পুলিশের চোখে ধুলো আদৌ সম্ভব নয়;--

আর, যদি নিতান্তই গ্রহের বৈগুণ্যে তুমি, নিজে
জেনেশুনে পান করো হলাহল, ঝাঁপ দাও দিঘির অতলে—তবে, সাফ জেনে রাখো
তখন দমকলে কিন্তু খবর দিতেও কেউ ছুটে আসবে না।–
                                                                       (c) ছবিঃ সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়

দিল্লির গ্রন্থমেলাতে বরাক উপত্যকার বাংলা গল্পের ইংরেজি অনুবাদ 'BARBED WIRE FENCE

ছবিতে সংবাদটি পড়তে প্রতিটিতে দু'বার করে ক্লিক করুন, তাতেও অসুবিধে হলে ছবিতে ক্লিক করে ctrl+ টিপুনঃ


সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

মানুষ বনাম ‘মানব-সম্পদ’

        ‘মানবাধিকার’ ও ‘মানব সম্পদ’ – এ দুটি শব্দ আজকাল যেথায় সেথায় যথেচ্ছ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বিশেষত, দৈনিক পত্রিকায়। মানবাধিকার শব্দটির বয়েস খানিকটা বেশি, ব্যবহারও অধিক। সে তুলনায় মানব সম্পদ নবীন, মানবাধিকার-এর মত ‘ব্যবহারে ব্যবহারে শূয়োরের মাংস’ হয়ে যায়নি এখনো, যদিও বহুল ব্যবহৃত। রাজনৈতিক মাতব্বর থেকে সরকারি আমলা, অকাদেমিক আলোচনা কিংবা কর্পোরেট প্রকল্প, সর্বত্র, শব্দটি নিয়ে সকলেরই লোফালুফি। ফলে, সঙ্গত কারণেই, শব্দটিকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখার লোভ সামলানো গেল না। সম্পদ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি তা এমন বস্তুকে বোঝায় যার উপযোগ সম্ভব। এবং তা প্রকৃতির দান। A resource is any physical or virtual entity of limited availability that needs to be consumed to obtain a benefit from it. In most cases, commercial or even non-commercial factors require resource allocation through resource management. There are two types of resources; renewable and non-renewable. সম্পদের বৈশিষ্ট কি? Resources have three main characteristics: utility, quantity (often in terms of availability), and consumption. (However, this definition is not accepted by some, for example deep ecologists who believe that non-human elements are independent of human values) এই সম্পদ হচ্ছে সত্তাহীন বস্তু কেবল, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকার প্রশ্নও ওঠে না। তা যদি মেনে নেওয়া যায় তো শব্দের যুগলবন্দি হিসেবেও ‘মানব-সম্পদ’ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না (যদি না মানবসত্তাটিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা যায়)। সম্পদের মানবিক রূপান্তর অসম্ভব নয়, অকল্পনীয়। 
               তবে কি একদল লোক মানব-কে মানবিক বৈশিষ্ট-বিবর্জিত সম্পদ-বস্তুতে রূপান্তরের দুঃসহ স্বপ্ন দেখতে চাইছেন? কেমন উদ্ভট শোনাচ্ছে, তাই তো! কিন্তু এরকম উদ্ভট স্বপ্ন সত্যিই দেখছে এক শ্রেণীর লোক। বিষয়টা তলিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হবে। মানবসম্পদ কথাটি য়ুরোপে প্রথম চালু হয় আশির দশকে, নয়ের দশকে তা বেশ জাঁকিয়ে বসে। মূলত একদল নয়া অর্থনীতিবিদের বদান্যতায়। Political economy বলতে যা বোঝায় এই নয়া অর্থনীতিবিদকুল হচ্ছে তার হোতা। বিশ্বজোড়া মন্দা এদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে বলে এরা ‘সঞ্জিবনী বিদ্যা’ খুঁজছে, আর তাতেই শব্দটির উদ্ভাবন। আজকাল প্রচলিত ‘শ্রমিক’ (labour) কথাটি সচেতন ভাবেই স্বল্প- কিংবা অ-ব্যবহৃত। কর্পোরেট দুনিয়া বরং তার পরিবর্তে ‘মানব সম্পদ’ ব্যবহার করায় অত্যধিক আগ্রহী। সোজা কথায় এ হচ্ছে শোষণের প্রক্রিয়ায় একটা মানবিক প্রলেপ লাগানোর ছল মাত্র। আর তাই Human resource কথাটার পাল্টা হিসেবে Human capital কথাটাও আমদানি করা হয়েছে সুচতুর কৌশলে। নানা তত্ত্বের (?) যোগান ধরাও হচ্ছে এর সপক্ষে। এমনকি এদেশে ‘মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’ নামে একটা বিভাগ পর্যন্ত খোলা হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা নিতান্ত সাধারণ বুদ্ধির মানুষ কিছুতেই বুঝতে পারি না যে এই ‘মানব সম্পদ’ উন্নয়নের দুর্ভাবনা যাদের ধ্যান-জ্ঞান তারা কারা? তারা কি তবে কোন উন্নততর প্রজাতির ‘মানব’ যারা উন্নয়নের চূড়ায় বসে আছে? সম্পদ যেহেতু নিজেই নিজেকে উন্নীত করতে কিংবা উন্নত স্তরে নিয়ে যেতে পারে না তাই কি দায়িত্বটা ওদের ঘাড়ে বর্তেছে? তাহলে একথাও মানতে হয় যে একদল মানব(!), যারা মোটেই সম্পদ নয় তারা ‘মানব সম্পদ’ শ্রেণিভুক্ত বিরাট সংখ্যক মানুষের উপর নিরন্তর খবরদারি করে যাবে। আর এরই নাম বুঝি ‘মানবাধিকার’। এরকম মানবাধিকারই বোধহয় এদের অভীষ্ট। কেননা, সম্পদের তো নিজের কোন অধিকারবোধ নেই, থাকা সম্ভব নয় বলেই। কনজিউমারিজমের (consumerism) জমানার খাসা এবং যুতসই তত্ত্বই বটে, কিন্তু বাগড়া দিচ্ছে অন্য কিছু বিষয়। দেখাই যাক না কিভাবে! 
               অর্থনীতির অর্থ না বুঝলেও ‘সম্পদ যত বেশি হয় ততই ভাল’ এই সহজ কথাটা আহাম্মকেও বোঝে। অথচ যারা সম্পদশালী হতে উদগ্রীব তারা সম্পদ হ্রাসের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা চালু করার আহাম্মকি কেন যে করে সেটা একটা ধাঁধা বইকি! হ্যাঁ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথাই বলা হচ্ছে। মানুষ যদি সম্পদ হয় তো তার উত্তোরত্তর বৃদ্ধিই কাম্য হওয়া উচিত। জন-বিস্ফোরণের তত্ত্ব তো তাহলে মানব সম্পদের ফুৎকারে পালাবার পথ পায় না! এ-কে কী-ই বা বলা যাবে - গোড়ায় গলদ, না কি গূঢ় (অর্থ)নীতি! সত্যিই বোঝা দায়। কিন্তু তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদরা ভুল করছেন তা-ই বা কী করে মেনে নেওয়া যায়! তবে কি ভুল বুঝছি আমরাই? হয়ত তাই। মানুষ আর মানবের মধ্যে এক গুণগত পার্থক্য নির্ধারণ করবার চেষ্টা করেছিলেন জীবনানন্দের মত মহত্তম কবি, লিখেছিলেন- ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব বেঁচে থাকে।’ আর হালের অর্থনীতির কেউকেটারা পার্থক্য করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে নামিয়ে এনেছেন নিষ্প্রাণ নির্জীব (সম্পদ)বস্তুর স্তরে, এবং সেই সম্পদের শোষণের মাধ্যমে মুষ্টিমেয় আরেক শ্রেণীর মানুষ ‘মানব’ হয়ে ওঠার দানবীয় প্রয়াসে মত্ত। জীবনানন্দের অমোঘ পঙক্তিটি এদের পরিচর্যায় ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবেই মানব বেঁচে থাকে’ হয়ে উঠতেই যেন চায় (নিম্নরেখ লেখকের)। এই প্রক্রিয়াটিকে কি বলা যাবে - Dehumanization of human being? আমরা অন্তত এর চেয়ে যুক্তিযুক্ত অন্যতর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। পাচ্ছি না যে তার পেছনে বড় যুক্তিটা হচ্ছে মানুষ তো কেবল শ্রমের পুঁজি নিয়েই জন্মায় না, বেঁচে থাকে না। শ্রমদান সে করে নিশ্চয়, সেই আদিম কাল থেকেই করেও এসেছে। কিন্তু তারও তর বেতর আছে। 
                আদিম মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে যেমন করত, বেঁচে থাকার তাগিদে, জীবনের জন্য আধুনিক মানুষও তেমনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে শ্রম দান করে থাকে অবশ্যই। আধুনিক মানুষকে শ্রম দানে বাধ্য করে এক বিশেষ ব্যবস্থা, যার মূল উদ্দেশ্য হল অর্থনৈতিক লাভের অঙ্ক বাড়ানো। এ কারণেই আদিতে যে শ্রম ছিল সৃষ্টিশীল, ক্রমে বাধ্যবাধকতার ফলে তার সৃষ্টিশীলতা খর্ব হতে থাকে, এবং প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে যতক্ষণ না সৃষ্টিশীলতা সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়। মানুষ (human) তো আসলে সম্পদ (resource) নয়, মানুষ হচ্ছে সম্পদ সৃষ্টিকারী (creator of resource)_ এই অর্থে যে সে সম্পদ বস্তুর সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করে পণ্যে পরিণত করে। আর এই সত্য গোপন করার উদ্দেশ্যেই ‘মানব সম্পদ’ কথাটা চালু করা হয়েছে চতুরতার সঙ্গে। কেননা, মানুষ যে সম্পদ সৃষ্টিও করে তা স্বীকার করে নিলে সম্পদের ওপর স্রষ্টা মানুষের অধিকারও স্বীকার করে নিতে হয়। আর ঠিক সে কারণেই রাজনীতি এসে অর্থনীতির হাত ধরতে চায়, জন্ম নেয় political economy, এবং শুরু হয় মানুষকেই পণ্যে (commodity) পরিণত করার প্রাণান্তকর প্রয়াস। ‘মানব-সম্পদ’ ভূষণটি যে আসলে শোষণের নয়া হাতিয়ার মাত্র – part of strategic labour management – সেটা সহজেই অনুমেয়। যেখানে টাকার অঙ্কে লাভ-লোকসানের হিসেব কষা হয়, পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদরাজি সংরক্ষণের নৈতিক দায়িত্ব পর্যন্ত অস্বীকৃত, সেখানে ‘মানব-সম্পদ’ শব্দবন্ধের চতুর ব্যবহার নিতান্ত স্বাভাবিক। তবু অনেকেই আমরা মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ি, ভূয়ো তত্ত্বের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলি অসাবধানে। কিন্তু এই কূট চাল তো শেষকথা হতে পারে না। অতএব মানব-সম্পদ নিয়ে শুরু করা যেতেই পারে নয়া এক ‘সামাজিক সংলাপ’। সামাজিক সংলাপের মাধ্যমেই এ পৃথিবীর কোথাও কোথাও যে তুমুল ওলট-পালট ঘটে যাচ্ছে সে তো এখন আর কারো অজানা নয়! এসব দেখে শুনে সমাজচিন্তকরা কি আসবেন এগিয়ে? _______________________________________________ 
(লেখাটা বেরিয়েছিল দৈনিক যুগশঙ্খে, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১১

রবীন্দ্রনাথ ও একটি খুনের মামলা

              ‘মরণ’! ফাঁসির আগে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে চায় কিনা জানতে চাইলে ‘শাস্তি’ গল্পের চন্দরা ওই রহস্যময় শব্দটি উচ্চারণ করেছিল। বাঙালি পাঠক মাত্রেই জানেন যে ওই একটি মাত্র শব্দের অমোঘ প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথ কি সাংঘাতিক অভিঘাত তৈরি করেন। কেবল তাই নয়, ছোটগল্পের সমাপ্তি হিসেবে শব্দশিল্পের কারুকৃতি উৎকর্ষের কোন শিখর স্পর্শ করতে সমর্থ এ গল্প তার বিরল দৃষ্টান্ত বইকি! সাহিত্য বিচারের নান্দনিক তুলাদণ্ডে এ গল্প যে একশ শতাংশ নম্বর পাওয়ার অধিকারী সে বিষয়ে সন্দেহের লেশ মাত্র থাকার কথা নয়। কিন্তু নান্দনিক তৃপ্তিই তো সব নয়, শেষ কথাও নয়। সাহিত্য রচনার একটা বৈষয়িক অভিপ্রায়ও যে থাকে, প্রত্যক্ষ কিংবা অপ্রত্যক্ষ, অন্তত রবীন্দ্রনাথের গল্পে যে থাকেই সে তো অস্বীকারের জো নেই। ‘শাস্তি’ গল্পের সুঠাম শরীরটিকে খানিকটা কাঁটাছেঁড়া করে দেখা যাক সে অভিপ্রায়টি স্পষ্ট হয় কিনা! ‘শাস্তি’ গল্পের পরিসমাপ্তিতে আদালত চন্দরাকে শাস্তি দিল নাকি চন্দরা স্বামীর অবিচারের শোধ নিল (অথবা স্বামীকে শাস্তি দিল) এই ‘অমীমাংসিত’ প্রশ্নের জন্যই গল্পটি নাকি সার্থক এরকম অভিমত ব্যক্ত করেছেন বহু অভিজ্ঞ বিশ্লেষক। কেউ কেউ আবার চন্দরার চরিত্রে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও খুঁজে পান। আমরা একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিরীক্ষণ করার প্রয়াস করব, এবং আমাদের প্রয়াসে গল্প থেকেই প্রয়োজনীয় সাক্ষী-সাবুদ পেশ করব। তবে তার আগে ওই ‘মরণ’ শব্দটি সম্পর্কে দু একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। 
               প্রথমত, বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত ঐশ্বর্যের পরিচয় ব্যতিরেকে শব্দটির মর্মোদ্ধার যে অসম্ভব এবং ভাষান্তরে তা যে কিছুতেই প্রকাশযোগ্য নয় তা স্বীকার করে নেওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, ‘মরণ’ শব্দটির উচ্চারণে রাগ, অভিমান ও ক্ষোভের অভিব্যক্তি যেমন রয়েছে, তেমনি তার মধ্যে দাম্পত্যের আকর্ষণ-বিকর্ষণ মিশ্রিত অম্লমধুর সম্পর্কের- ইংরেজিতে erotic বলতে যা বোঝায় তার - আভাসও অবর্তমান নয়। আর সে কারণেই শব্দটির অসাধারণ ব্যঞ্জনা গল্পের শেষে এক অনন্য অভিঘাত তৈরি করতে সক্ষম হয়, নির্মাণের দিক থেকে সার্থকতার নিদর্শন হয়ে ওঠে। তবু, গল্পের সময়, সামাজিক প্রেক্ষিত ইত্যাদির নিরিখে অব্যর্থ ‘মরণ’ শব্দটি উৎসারিত হয় যে চরিত্রটির মুখ থেকে, সেই চন্দরা নাম্নী গৃহবধূর চরিত্রটি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের পটভূমিতে কিভাবে ও কতটা সার্থক বা অসার্থক ভাবে চিত্রিত হয়েছে তা একটু খতিয়ে দেখা যেতেই পারে। ‘মরণ’ শব্দটির অনুষঙ্গে চন্দরার চরিত্রে আদৌ কোনো বিশেষ মাত্রা সংযোজিত হয়েছে কিনা একটু খতিয়ে দেখাই যাক না! গল্পের মধ্যে ঘটনা বলতে যেটুকু তা হচ্ছে, দুখিরামের হাতে ‘আকস্মিক ভাবে’ তার স্ত্রী রাধার খুন হওয়া ও দুখিরামকে বাঁচাতে খুনের দায় চন্দরার ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা। মজার বিষয় হচ্ছে যে, চন্দরার স্বামীই পরিকল্পনাটির উদ্ভাবক এবং সে চন্দরাকে দায়টা মাথা পেতে নিতে অনুরোধ পর্যন্ত করে। এই অস্বাভাবিক অনুরোধের জন্য সামান্য অস্বস্তিও সে বোধ করে বলে চন্দরার শাস্তি মকুব করার আশ্বাসও সে দেয়, যদিও শাস্তি মকুবের ব্যাপারে সে নিজেই নিশ্চিত হতে পারে না। ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত চন্দরা প্রাথমিক বিমূঢ়তা কাটিয়ে, বলা যায়, বিক্ষুব্ধতা প্রকাশ করে ছিদামের কথা মত আত্মরক্ষার চেষ্টামাত্র না করে। 
             এই গল্পের খুনের মামলায় পাত্র-পাত্রীরা কে কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ এবং তার বিচার-বিশ্লেষণ থেকে কি তথ্য সংগৃহীত হয় দেখা যাক। ‘শাস্তি’ গল্পটির বিভিন্ন স্তর ও মাত্রা বর্তমান। কেন্দ্রিয় স্তরে রয়েছে চন্দরা-ছিদাম সম্পর্ক। এই দাম্পত্য সম্পর্কের আপাত স্বতন্ত্রতা বিঘ্নিত হয় খুনের ঘটনার ফলে। কেন্দ্রাতিগ স্তরে রয়েছে একটি যৌথ পরিবারের চিত্র, যা আবার এক বিশেষ সময় ও সামাজিক ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে বিন্যস্ত। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, চরিত্রগুলি এতটাই সুবিন্যস্ত যে তার বিশ্বাসযোগ্যতা কিংবা বাস্তবতা নিয়ে আদৌ কোন প্রশ্ন ওঠে না। প্রশ্ন ওঠে না ঠিক, তবে এই বিন্যাস যে সরল ও একরৈখিক নয়, বরং বেশ জটিল সেও স্বীকার্য। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। দুখিরাম সন্ধেবেলা কাজ থেকে ফিরে ভাত দিতে বললে বড় বউ উত্তরে বলে - 'ভাত কোথায় যে ভাত দিব। তুই কি চাল দিয়া গিয়াছিলি। আমি কি নিজে রোজগার করিয়া আনিব।' আর তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে - (লেখকের মতে) শেষ কথাটার ‘কুৎসিত শ্লেষ’ অসহ্য বোধ হওয়ায় - দুখিরাম খুনটা করে ফেলে। লক্ষণীয় যে ঘরের বউয়ের রোজগার করে আনার বিষয়টি এক নিতান্ত ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ পরিবারের পুরুষ কর্তাটির কাছেই কেবল আপত্তিকর ও অমর্যাদাকর নয়, গল্পকার রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তার মধ্যে ‘কুৎসিত শ্লেষ’ দেখতে পান। এক্ষেত্রে ‘আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদাভেদ নাই’ – রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দুখিরামেরও আশ্চর্য মিল।
            ঊনবিংশ শতাব্দির বহু বিজ্ঞাপিত আলোক যে পুরুষতান্ত্রিকতার দুয়ার ভাঙতে পারেনি এ নিশ্চয় তারও প্রমাণ! খুনের ঘটনার খানিক বাদে রামলোচন এসে হাজির হলে ছিদাম যখন বউয়ের কাঁধে দোষ চাপিয়ে বাঁচবার উপায় জানতে চায় তখন রামলোচন কিন্তু ‘ভাত দেয় নি বলে দুখি খুন করে ফেলেছে’ কথাটাই থানায় গিয়ে বলার পরামর্শ দেয়। অর্থাৎ, রামলোচনের অভিজ্ঞতায় উক্ত কারণটির সামাজিক, এবং এমনকি ‘আইনি’ বিশ্বাসযোগ্যতা যে বর্তমান সেটা স্পষ্ট। ওরকম সংসারে খুনের আর্থ-সামাজিক সম্ভাব্য ও বিশ্বাসযোগ্য কারণটি যা হতে পারে সে বিষয়ে রামলোচন অবশ্যই ওয়াকিবহাল। গল্পের প্রারম্ভে গল্পকার ‘জন খাটতে যাওয়া’ দুখি-ছিদামের চিত্তবিক্ষোভের বাস্তব কারণ ব্যাখ্যাও করেছেন নিপুণতার সঙ্গে। দেখা যাচ্ছে খুনের ঘটনার ‘সত্য’ আর প্রাণ বাঁচানোর উপায় হিসেবে রামলোচনের বাতলানো ‘মিথ্যা’ একাকার হয়ে জায়গা বদল করে নিচ্ছে। গল্পের পরিণতিতেও আমরা দেখি কিভাবে ‘বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত মিথ্যা’ সমাজ তথা আইনের চোখেও ‘সত্যে’র মর্যাদা অর্জনে সক্ষম হয়। সে যা হোক, গল্পের উপজীব্য কিন্তু এক মর্মন্তুদ খুনের ট্র্যাজিক বাস্তবতা নয়, বরঞ্চ খুন পরবর্তী একটি মিথ্যার সূত্রে গড়ে ওঠা চন্দরা নাম্নী নারীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি। দাম্পত্য নামক একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রে গড়ে ওঠা চন্দরার জীবনের এই সংকট যে আসলে সমাজ নির্দিষ্ট সেটাই দেখানোর প্রয়াস থাকবে নিবন্ধের পরবর্তী অংশে। চন্দরাই এ গল্পের প্রোটাগোনিস্ট চরিত্র। গল্পের বিন্যাস এমন যে মনে হতে পারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিকতায় পুরুষের আধিপত্য অথবা নারীর অধীনতার বিষয়টি এখানে ‘হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ’ অবস্থায় রয়েছ। চন্দরা বুঝি পুরুষের আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক চপেটাঘাত। বস্তুত এ গল্প সম্পর্কে এরকম অভিমত ব্যক্ত করেছেন বহু বিদগ্ধ সমালোচক। গল্পের পরিণতিতে এ ধারণা গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এক সচেতন ও সযত্ন নির্মাণ-কৌশল। গল্পপাঠের অভিজ্ঞতায় সাধারণত যেসব তথ্য আপাত গুরুত্বহীন বিবেচিত হয়ে থাকে নিবিড় পাঠে বহুক্ষেত্রে তারাই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আপাত গুরুত্বহীন এইসব তথ্যের সাক্ষ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে ‘শাস্তি’ গল্পে আগাগোড়া পুরুষের নিরঙ্কুশ প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত। গল্পের আরম্ভেই পাঠক ‘রমণীরা সচরাচর কলহপ্রিয়’ এই প্রচারিত ধারণার অলিন্দে চন্দরাকে আবিষ্কার করেন। সন্দেহের বশে ছিদামের তাকে ঘরে দরজা বন্ধ করে আটকে রাখা, অন্যান্য খুঁটিনাটি বর্ণনা এবং চন্দরার ঘাড়ে খুনের দায় চাপানোর সপক্ষে সে যে যুক্তি দেয় ('ঠাকুর, বউ গেলে বউ পাইব, কিন্তু আমার ভাই ফাঁসি গেলে আর তো ভাই পাইব না1’) তা থেকেও পুরুষ প্রাধান্যের বিষয়টি অবিতর্কিত ভাবেই প্রতিষ্ঠিত। 
              এমনকি রবীন্দ্রনাথও ‘সারাদিনের শ্রান্তি ও লাঞ্ছনার পর অন্নহীন নিরানন্দ অন্ধকার ঘরে প্রজ্বলিত ক্ষুধানলে গৃহিণীর রুক্ষবচন’ শুনলে পুরুষ কর্তাটির মাথা ঠিক রাখা যে দায় তেমন অভিমতই ব্যক্ত করেছেন। ভাবটা এমন যে দুখিরামের বউ রাধা বুঝি সারাদিন পাটরানী সেজে বসে থাকার সৌভাগ্য নিয়ে ওই পরিবারে এসেছে। ক্ষুধার জ্বালা রাধাদের যেন থাকতে নেই, ‘দেড় বৎসরের ছোটো ছেলেটি কাঁদিতেছিল’ (সম্ভবত পেটের খিদেয়) - সে তথ্য সরবরাহ করা সত্ত্বেও রাধার মত নিরুপায় মায়েদের ক্ষুব্ধ হবার কারণ খুঁজে পান না মরমী রবীন্দ্রনাথ। আরো আশ্চর্যের বিষয় যে, চন্দরার ঘাড়ে দোষ চাপানোর নীচ পরিকল্পনাটিকে পর্যন্ত তিনি নিতান্ত হালকা করে ফেলার চেষ্টা করেন। এমন ভাব করেন যে ছিদাম যেন আগপিছ না ভেবে আচমকা একটা মিথ্যে কথা বলে ফেলে জালে জড়িয়ে গেছে। “... যখন নিজের স্ত্রীর নামে দোষারোপ করিয়াছিল তখন এ সকল কথা ভাবে নাই। তাড়াতাড়িতে একটা কাজ করিয়া ফেলিয়াছে, এখন অলক্ষিতভাবে মন আপনার পক্ষে যুক্তি এবং প্রবোধ সঞ্চয় করিতেছে”।
                মনোযোগী পাঠকের পক্ষে এমন ওকালতি মেনে নেওয়া কষ্টকর যেহেতু বউ মরলে যে বউ পাওয়া যাবে সে বিষয়ে ছিদামের বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না। পুরুষের পক্ষে পুরুষের যুক্তি যেমন হওয়া উচিত এও তেমন। উল্লেখযোগ্য যে, ছিদামের পক্ষ অবলম্বন করে এ যুক্তি আসলে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। কিন্তু তার প্রয়োজন হল কেন? হল এই কারণে যে, ‘কাজটা যে ছিদাম ঠিক করেনি’ সেকথাটা সাধারণ পাঠকের মত লেখক নিজেও জানেন এবং মানেনও। এরকম স্ববিরোধিতার উদাহরণ আরো আছে গল্পটিতে। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় চন্দরা হল ‘একখানি নূতন-তৈরি নৌকার মতো’, আর ওই নূতন নৌকায় সওয়ার হয়েই দুখি-ছিদাম পাপের পাথার পাড়ি দেয়। নৌ-চালনার দায়িত্বে থাকেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এমন কোন তথ্য গল্পকার আমাদের দেননি যাতে চন্দরার চরিত্রে কোন প্রতিবাদী লক্ষণ স্পষ্ট হয়। গোসা করে মামাবাড়ি চলে গেলেও ফিরে আসতে তার দেরিও হয় না। বড় জোর চন্দরা চটপটে চালাক-চতুর মেয়ে এই পর্যন্ত ধারণায় আসে মাত্র। এই প্রেক্ষাপটে চন্দরার ‘আত্মাহুতি’ যে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রূপে বিবেচ্য হতে পারে না তা সহজেই অনুমেয়। কাজেই ‘আদালত চন্দরাকে শাস্তি দিল না চন্দরা ছিদামকে শাস্তি দিল’ এরকম দ্ব্যর্থতার অনুসন্ধানকে কষ্টকল্পনা বলে চালানোও দুষ্কর। এ আসলে পুরুষালি জবরদস্তি ছাড়া কিছু নয়। পুরুষের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যদি মুখ্য হত তাহলে চন্দরা সরাসরি খুনের দায় গ্রহণে অসম্মতি জানাতো যা সে করেনি। চন্দরা আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মৃত জায়ের ওপর মিথ্যে দোষারোপ করা থেকে বিরত থেকেছে মাত্র। সেটাই স্বাভাবিক, কেননা প্রতিবাদের পরিণামেই দুখির বউকে খুন হতে হয়। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে যে খুনের দায় স্বীকার করা অব্দি চন্দরা স্বামীর নির্দেশ রাগে-দুঃখে-অভিমানে হলেও পালন করেছে। স্বামীর অনুরোধে প্রাণ বাঁচাতে মিথ্যে কথা বলেনি শুধু অভিমানের বশে। তাছাড়া রাধার সঙ্গে ‘নিত্য কলহ’ সত্ত্বেও বস্তুত সে তার চক্ষুশূল ছিল না। আদালতে ‘আমি তাকে দেখতে পারতাম না’ উক্তির অন্তর্গত তীক্ষ্ণ শ্লেষ সে সাক্ষ্যই দেয়। মৃতের ওপর মিথ্যে দোষারোপ যে আসলে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ স্বরূপ তা জানে বলেই চন্দরার সে কাজে রুচি হয় না, আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও না। এতদিন যে সে সব সহ্য করেও সংসারে মানিয়ে চলেছিল সে তো এজন্যই যে তার ধারণা ছিল ‘স্বামী তাকে ভালবাসে’। কিন্তু ভালবাসার কল্পিত সৌধটি এক লহমায় চৌচির হয়ে যেতে দেখে বেঁচে থাকাটাই চন্দরার কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে। ছিদামরূপী তার একান্ত পুরুষটির ভালবাসার কপটতা উপলব্ধি করে স্বভাবতই চন্দরা ভেতরে ভেতরে অভিমানে ফেটে পড়ে, আত্মরক্ষার চেষ্টা পর্যন্ত করে না। ফাঁসির আগে ছিদামের সঙ্গে দেখা করতেও অস্বীকার করে সেই অভিমানবশতই। তখন সে ‘স্বামী রাক্ষসের’ হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেও চায় না। পিতৃতান্ত্রিকতার নিগড়ে বাঁধা জীবনে পারিবারিক চৌকাঠ ডিঙানোর সামর্থ্যহীন অনন্যোপায় নারীর পক্ষে ওই পরিস্থিতিতে মৃত্যু ছাড়া পরিত্রাণের অন্য পথ দৃষ্টিগোচর হয় না। খুব সচেতনভাবে না হলেও ওই ‘স্বামী রাক্ষস’ শব্দটির ব্যবহার বলে দেয় যে নারীর ওপর স্বামী-পুরুষের নির্যাতন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ অনবহিত ছিলেন না। রামায়ণের কাল হলে চন্দরার ‘পাতাল প্রবেশ’ ছাড়া গতি ছিল না। শেষবারের মত মা-কে দেখতে চাওয়াও সে হিসেবে অর্থবহ – ‘ধরণী দ্বিধা হও’ বলার পরিস্থিতি নেই বলেই হয়ত গর্ভধারিণীর কোলে মুখ লুকোনোর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে সে। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসাধারণ নির্মাণ কুশলতায় চন্দরাকে ‘মহিয়সী’ করে গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন পুরুষ-প্রাধান্যের স্বার্থেই, কারণ গল্পের পরিশেষের নাটকীয় মোচড় সত্ত্বেও বস্তুত চন্দরার মৃত্যুবরণের মধ্য দিয়ে পিতৃতন্ত্রের স্বার্থই চরিতার্থতা লাভ করে। গল্পের সমাপ্তির যে আপাত দ্ব্যর্থবোধকতা তার ধরন অবশ্যই রক্ষণাত্মক। সাধারণ পাঠকের এমন মনে হতেই পারে যে চন্দরা বুঝি নিজেই মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে। আর তাই যদি হয় তো আদালতের মৃত্যুদণ্ড প্রদান অর্থহীন ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। স্বেচ্ছায় যে মৃত্যুবরণ করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া কি আদালতের পক্ষেও সম্ভব? এই অনুচ্চারিত যুক্তি-পরম্পরার অবলম্বন ব্যতিরেকে গল্পের পরিসমাপ্তি পাঠকের কাছে গৃহীত হবার যোগ্যই নয়। বলা বাহুল্য, এই প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হলে একথাও মেনে নিতে পাঠক বাধ্য হন যে চন্দরার মধ্যে আসলে এক অসাধারণ ‘আত্মশক্তি’, প্রায় ঐশ্বরিকও বলা চলে, রয়েছে যার জোরে সে মৃত্যুকেও স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করতে পিছপা হয় না। অর্থাৎ, চন্দরা সামান্য নারীমাত্র নয়। কিন্তু চন্দরা সে শক্তি পাবে কোথায়? তার সামাজিক প্রেক্ষিত ও অবস্থান তাকে সে সামর্থ্য অর্জনের সুযোগ দেয় না, দিতে পারে না। আর দিতে পারে না বলেই লেখক রবীন্দ্রনাথ চন্দরাকে সে সুযোগ করে দেন। অর্থাৎ, নিজের ইচ্ছায় নয়, চন্দরাকে মরতে হয় তারই স্রষ্টার অভিপ্রায়ে।ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে বাইরের যা কিছু এক লহমায় দেখে নেবার তৎপরতার মধ্যে যে জীবনাসক্তি ব্যক্ত তা থেকে এও তো স্পষ্ট যে চন্দরা (তার স্রষ্টার মতই) এমন অনায়াসে ‘মরিতে চাহে না’, যদিও তার ভুবনটি তার স্রষ্টার ভুবনের মত নিপাট সুন্দর নয়। কিন্তু তবু তাকে মরতে হয়? এই অন্যায় শাস্তি চন্দরাকে কেনই বা দিতে চান গল্পকার? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাবার আগে একটু অন্য কথা বলে নেওয়া যাক। 
            স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটিকে রবীন্দ্রনাথ সামাজিক-রাজনৈতিক ও আইনি প্রেক্ষিতে বিন্যস্ত করেছেন। এবং সেই প্রেক্ষিতেও নির্দোষ চন্দরার জীবনের বাস্তবতা ও সত্যের আবেদন সামাজিক অথবা আইনি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠানের অসাড় অঙ্গে সামান্য সাড়া জাগাতেও সক্ষম হয় না। পক্ষান্তরে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের সাবেক স্বার্থ ও আধিপত্যই রক্ষিত হয় – যাকে দেখা হয় ‘পারিবারিক মর্যাদা’ রূপে। আর এরই জন্য উৎসর্গিত হয় চন্দরা। (আধুনিক গণমাধ্যমের ভাষায় honour killing ছাড়া আর কী-ই বা বলা যাবে একে!) এমন কি দুখিরামের স্বীকারোক্তি পর্যন্ত গ্রাহ্য হয় না, বরং আইনের অন্ধদৃষ্টি তার মধ্যে ঘরের বউকে রক্ষা করার পুরুষ-সুলভ বদান্যতা কিংবা মহানুভবতা খুঁজে পায়! পাবে নাই বা কেন, পুরুষের ‘রক্ষক’ ইমেজটি বজায় রাখার দায়িত্ব যে আইনের হাতে অর্পিত। আর একারণেই দুই উকিলের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে চন্দরার পক্ষে দাঁড়ানোর বিষয়টি সামান্য গুরুত্ব পর্যন্ত পায় না গল্পে, আদালতে! অথচ এর থেকে প্রমাণ হয় যে (গল্পকারের ঘোষণা অনুযায়ী) গাঁ-সুদ্ধ সকলেই একবাক্যে চন্দরাকে ‘খুনি’ সাব্যস্ত করেনি। সমালোচকরা তো ঘটনাটি লক্ষ্য অবধি করেন না। উকিল নিয়োগের সামর্থ্য না থাকা অভিযুক্তের জন্য দুজন উকিল যোগাড় করে দিয়ে গল্পকার হয়ত সামাজিক ও সরকারি ভদ্রতাটুকু বজায় রাখতে চেয়েছেন। এর থেকে এটাও স্পষ্ট হয় যে গল্পের পেছনের পরিকল্পনাটি ছিল ‘ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার মত’ আগাগোড়া নিখুঁত।          
           এদেশে এক কালে সতীদাহ প্রথা ছিল, সহমরণে যাবার জন্য অনুপ্রেরণা যোগানো হত। তারই এক আধুনিক নয়া সংস্করণ ও সম্প্রসারণ যেন দেখতে পাই চন্দরার আত্মবিসর্জনের মূলে। হিন্দুত্বের ধারাটি যদি সযত্নে লক্ষ করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে এদেশে অনিবার্য বিপর্যয়কালে দেশ-জাতি-সমাজ-পরিবারের মর্যাদা রক্ষার দায় চিরকাল নারীর কাঁধে বর্তেছে, চূড়ান্ত আত্মত্যাগের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে নারীর ওপর। সতীপ্রথা কিংবা জহর ব্রত ইত্যাদিকে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টা ও প্রবণতা সেই সত্যের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে। উনিশ শতকের নায়করা নানা সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে নারীর ‘স্বাধীনতার গণ্ডি’ কিছু পরিমাণে বৃদ্ধি করার প্রয়াসী হয়েছিলেন যদিও, কিন্তু তাতে পুরুষের নিয়ন্ত্রণ যাতে অটুট থাকে সে বিষয়েও পূর্ণ সজাগ থেকেছেন। এর ফলে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিষয়ক পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা কিছু পরিমাণে জটিল রূপ ধারণ করে। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক-রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে পুনর্বিন্যাস ঘটে তার ফলে জাতীয়তবাদী ধ্যান-ধারণায় নারীর সামাজিক অবস্থান ও ভূমিকা নির্ধারণের প্রশ্নে দেখা দেয় দ্বিমুখী বৈপরিত্য। সামাজিক-সাংস্কৃতিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন এবং নারীর স্থান নির্দেশের এলাকা ভিত্তিক যে আদলটি তৈরি হয় তাকে ঘর/বাহির (অথবা বিশ্ব), আধ্যাত্মিক/বস্তুতান্ত্রিক, ব্যক্তিগত/সাধারণ, পূর্ব/পশ্চিম এবং নারী/পুরুষ এই দ্বিধা-বিভক্তি হিসাবে সনাক্ত করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মত বিদগ্ধ ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ববিদরা। নারীর শারীরিক আবদ্ধতা (পর্দা প্রথা ইত্যাদি) মোচনের পক্ষে ওকালতি করে স্ত্রীশিক্ষার দৌলতে নারীকে ‘সক্ষম স্বাধীন’ করে তোলার উনিশ শতকীয় প্রস্তাবনার মধ্যে খাঁচাটাকে বৃহদায়তন ও তত্ত্বগত ভাবে গ্রহণীয় করে তোলাই যে মুখ্য ছিল তা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বিভিন্ন আধুনিক গবেষক। এক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) শব্দটির এক সংকুচিত ভারতীয় তাৎপর্য নিরূপণ করে পাশ্চাত্যের ধারণা থেকে পৃথকীকরণের প্রয়াসও লক্ষণীয়। পাশ্চাত্যের ‘ফ্রীডম’ এদের বিচারে ‘যথেচ্ছাচার’, আর প্রাচ্যে তার অর্থ ‘অহং’ থেকে মুক্তি – অর্থাৎ, স্বেচ্ছা-অধীনতা। এই অনৈতিহাসিক বিচার-বিবেচনার দরুণ ঘরের বাইরে বহির্বিশ্বে নারীর বিচরণ সে পর্যন্তই অনুমোদিত হয় যে পর্যন্ত নারীর সনাতনী ‘সর্বং সহা’ কল্যানী মূর্তিটি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চূর্ণ না হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে সমঝোতা ও আপোষের ফলে পাশ্চাত্যের চিন্তা-চেতনা যে পরিমাণে সাঙ্গীকৃত হয়েছে উনিশ শতকের বাঙালির পিতৃতান্ত্রিক মননে, প্রতিক্রিয়ায় সে অনুপাতেই দেখা দিয়েছে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের এক অনৈতিহাসিক, অসুস্থ ও রক্ষণশীল প্রবণতা। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাধীনতার বিপ্রতীপে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে ‘অন্তর্লোকের স্বাধীনতা’ অটুট রাখার ছদ্মতৃপ্তি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে সমাজ সংস্কারকদের। জাতীয় মর্যাদার এই অন্তর্জগতেই (inner domain) হয় নারীর নয়া সংস্থান - স্ত্রী-ধর্ম পালনই যেখানে মুখ্য ও মোক্ষ স্বরূপ। আর এই মর্যাদা রক্ষার কল্পযুদ্ধে বলিপ্রদত্ত চন্দরারা যেন ‘মৃত্যুর নৈবেদ্য গেনু রাখি’ বলে ক্রমাগত অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। স্মর্তব্য যে, ‘মুক্তি’ কবিতার নায়িকাও সংসারের অবজ্ঞা অবহেলার হাত থেকে রেহাই পেতে মৃত্যুর মধ্যেই মুক্তি খুঁজেছে। নির্যাতিত নারীর নিরুপায় মৃত্যুবরণকে মহিমান্বিত করার এক নিরুপদ্রব প্রয়াস এবং প্রবণতা রবীন্দ্রসাহিত্যের অন্যত্রও বর্তমান। কেবল তাই নয়, রমাবাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথ তার জন্য তাত্ত্বিক ভিতও নির্মাণ করেন সচেতন ভাবে, অসাধারণ সতর্কতায়। পাঠক, এই উদ্ধৃতিটি লক্ষ্য করুন- “পূর্বকালে মেয়েরা পুরুষের অধীনতা গ্রহণকে একটা ধর্ম মনে করত তাতে এই হত যে, চরিত্রের ওপর অধীনতা কুফল ফলাতে পারত না, অর্থাৎ হীনতা জন্মাত না, এমনকি অধীনতাতেই চরিত্রের মহত্ত্ব সম্পাদন করত। প্রভুভক্তিকে যদি ধর্ম মনে করে তাহলে ভৃত্যের মনে মনুষ্যত্বের হানি হয় না ।” (রমাবাইয়ের বক্তৃতা উপলক্ষে পত্র/পরিশিষ্ট,রবীন্দ্ররচনাবলী) চন্দরার চরিত্রে এই মহত্ত্বই রবীন্দ্রনাথ আরোপ করতে চেষ্টা করেছেন। স্বামী প্রভুর প্রতি ভক্তিধর্মে অচল থেকে স্ত্রী-ভৃত্যের মৃত্যুবরণে যে ‘মনুষ্যত্বের হানি হয় না’ বরং উজ্জ্বলতা বাড়ে এই বক্তব্যটি প্রতিষ্ঠার জন্যই নিপুণতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ চন্দরাকে সৃষ্টি করেন। কেননা তাঁর আজন্ম বিশ্বাস - “সাধ্বী স্ত্রীর প্রতি যদি কোনো স্বামী পাশব ব্যবহার করে, তবে সে-ব্যবহারের দ্বারা স্ত্রীর অধোগতি হয় না, বরং মহত্ত্বই বাড়ে। কিন্তু যখন একজন ইংরেজ পাখাটানা কুলিকে লাথি মারে তখন তাতে করে সেই কুলির উজ্জ্বলতা বাড়ে না।” (ঐ) নির্মাণের দিক থেকে অতুলনীয় হওয়া সত্ত্বেও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির দরুণ গল্পটি শেষ পর্যন্ত নারীর নিয়ন্ত্রিত মুক্তির উনিশ শতকীয় প্রয়াসের আড়ালে পিতৃতান্ত্রিক শৃঙ্খলটিকে আধুনিক সাংস্কৃতিক সাজ পরানোর পরিকল্পনার বিশ্বস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে থাকে মাত্র। পিতৃতন্ত্রের কাছে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শব্দশিল্পীর এই আত্মসমর্পণ, সে যে কারণেই হোক না কেন, চন্দরার আত্মাহুতির চাইতে কম বেদনাদায়ক নয় - অন্তত বাঙালি পাঠকের কাছে!

রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

'অসমের বাঙালির সমস্যা :কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনা'

              বাঙালি আর সমস্যা প্রায় হরিহর আত্মা। সমস্যা যেমন বাঙালির পিছু ছাড়ে না, বাঙালিও তেমনি সমস্যা না থাকলে যেন হাঁপিয়ে পড়ে। এটা গুণ কিংবা দোষ, সে বিচার আপাতত নাহয় মুলতুবি থাক। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালির এমনিতেই সমস্যার অন্ত নেই, নতুন করে আরেকটা সমস্যা খাঁড়া না করাই মঙ্গল। দেশ বিভাগের ছয় দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, অথচ শেকড় ছড়িয়ে থিতু হতে পারে তেমন স্বভূমির সন্ধান বাঙালির বরাতে আজো জুটল না। ত্রিপুরায় যারা বসবাস করছেন তাদের অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল বলা যায়। উত্তরপূবের অন্যান্য প্রদেশে বসবাস করা বাঙালিরা আজো ‘বহিরাগত’ পরিচয় নিয়েই কোনক্রমে জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে সঙ্গীন অবস্থা অসমের বাঙালির। আরো স্পষ্ট করে বললে মূলত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির অস্তিত্বের সংকট সবচেয়ে গভীর এবং তীব্র। বরাক উপত্যকার বাঙালিরা ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে খানিকটা সুবিধেজনক অবস্থায় রয়েছেন এবং কেবল মাত্র ভাষা-কেন্দ্রিক আন্দোলনের চৌহদ্দিতেই নিরাপত্তার চাবিকাঠি মিলবে এরকম এক ‘ইউটোপিয়া’য় আক্রান্ত হয়ে খোশ-মেজাজে দিনাতিপাত করলেও বস্তুত পরিস্থিতি যে অতটা সরল নয় সেটা বোঝার আগ্রহ সেভাবে চোখে পড়ে না। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই উদাসীনতা যে জটিল সমস্যা তৈরি করতে পারে তা হৃদয়ঙ্গম করা অবশ্যই দরকার। 
            বিগত চার দশক যাবৎ ‘বহিরাগত’ দিয়ে শুরু করে ভায়া (via) ‘বিদেশি’ হয়ে অবশেষে ‘বাংলাদেশি’ (? বাঙালি)-তে থমকে থাকা অসম আন্দোলন যে ঘোলাটে রাজনীতির ব্যুহে প্রবেশ করে পালাবার পথ পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছে না তার দরুণ অনেকেই আপাতত স্বস্তি বোধ করছেন, ভবিষ্যতের চিন্তা শিকেয় তুলে দিয়ে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির পক্ষেও এই অ-বিবেচনা ক্ষতিকারক প্রমাণিত হতে বাধ্য। বিদেশি নাগরিক সংক্রান্ত সমস্যার এক মৌলিক ও চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে গেছে নয়ের দশকে এসে। অসম গণ পরিষদ দল সরকার গঠনের আগে পর্যন্ত অসমীয়াভাষীরা সমস্যাটিকে ও তৎ সংক্রান্ত আন্দোলনকে তথাকথিত জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষিতেই বিচার বিবেচনা করতে অভ্যস্ত ছিলেন। অ-গ-প দলের দু দফার শাসনকালে এবং বিগত পনেরো বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতায় অধিকাংশের দিবাস্বপ্ন ভাঙতে দেরি হয়নি। দলটির প্রতি যে অনাস্থা নির্বাচনে লাগাতার পরিলক্ষিত তা থেকে একথা স্পষ্ট যে অসমের মানুষ বিদেশি জুজুর চেয়ে রুটি-রুজির সমস্যাকেই মৌলিক সমস্যা রূপে পরিগণিত করার জরুরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছেন। আসু-র আন্দোলনকে বাঙালি বিরোধী বিবেচনা করতে অভ্যস্ত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিদের একাংশও কিন্তু নয়ের দশকে এসে অবস্থান পাল্টেছেন কিয়ৎ পরিমাণে। ’৭১ এর পরে আসা বাঙালিরা বিদেশি সেকথা মেনে নিয়েছেন মূলত ওই সময়ে বি-জে-পি হাওয়া জোরদার থাকার ফলে। অর্থাৎ, আন্দোলনটা এদের কাছে আর সর্বাংশে ‘বাঙালি বিরোধী’ রইল না। 
               বরাকে একটু ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। সেখানে বাংলাদেশি (আরো সঠিক ভাবে বললে মুসলমান বাঙালি)রা হল বিদেশি। ভাষাগত ঐক্যের বিষয়টা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল। আর তাই অ-গ-প দলের হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এল বাঙালি মুখ, এমনকি নির্বাচিতও হওয়া গেল বিস্ময়কর ভাবে। মোদ্দা কথাটা হল উভয় উপত্যকায়ই সমস্যাটিকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন প্রকট হল। সেকারণেই অগপ-ভাজপা সমঝোতা সম্ভব হয়, যদিও ভা-জ-পা জাতীয় দল বলে মাঝে মাঝে ‘হিন্দুরা শরণার্থী’ ধুয়ো তোলে। রাজনৈতিক নানান জটিল সমীকরণের ফলে বাঙালিদের এক হতবুদ্ধি অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে। যথার্থ কোনও সংগঠন না থাকার ফলে পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে অনেকেই নানান দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন বিভিন্ন সময়ে, বর্তমান নিবন্ধকারও একটু-আধটু লিখেছেন। তবে এখানে অন্য একটি জরুরি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করব। 
           তত্ত্বগত ভাবে যারা বিদেশি নয়, অর্থাৎ,৭১ এর আগেই যে বাঙালিরা অসমে এসে বসবাস শুরু করেছেন, স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে, তাদের উভয় গোষ্ঠীই কিন্তু এক নতুন প্রজন্মের জন্মদাতা। বাস্তুভিটে ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্য হয়ে যারা এসেছেন, আর নতুন প্রজন্মের যে বাঙালির জন্ম বস্তুত এই উত্তরপূবের কোমল মাটিতে তাদের চিন্তা-চেতনার প্রকৃতি ও পরিধি ভিন্ন হতে বাধ্য। কেননা, বাপ-ঠাকুর্দার মতো এদের কোন ‘হারানো স্বদেশের’ স্মৃতি নেই। অথচ, জ্ঞানচক্ষু মেলার পর থেকেই বাবা-কাকাদের বিলাপের দৌলতে এদের মধ্যে ‘এ ভূমি আমার নয়’ গোছের এক মানসিকতা গড়ে ওঠার অবারিত সু্যোগ পেয়েছে ও ক্রমে বদ্ধমূল হয়েছে। যে মাটিতে শেকড় রয়েছে সেই মাটির সঙ্গেই ফলে তৈরি হয়েছে নিদারুণ এক আত্মিক বিচ্ছিন্নতা। একদিকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই উদ্বাস্তু মানসিকতা আর অন্যদিকে আশির দশকের আন্দোলন-মার্কা ভাষাকেন্দ্রিক উগ্র-জাতীয়তাবাদী প্রত্যাখ্যান, দুয়ে মিলে বস্তুত দেহে-মনে নিজভূমে পরবাসী হয়েছে এই নতুন প্রজন্মের বাঙালি। দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হওয়ার থেকেও তা ভয়ানক। মানুষ যখন আত্মিক ভাবে উদ্বাস্তু হয় তখন কোন ভূমিকেই আর স্বভূমি বলে মনে হয় না। বরাক উপত্যকার বাঙালির ক্ষেত্রেও এই উদ্বাস্তু মানসিকতা বর্তমান যদিও তার চরিত্র আলাদা।                       
                 ’৬১-র ভাষা আন্দোলন নিয়ে বরাকের বুদ্ধিজীবীদের গৌরবান্বিত ও আবেগাপ্লুত হতে দেখা গেলেও বাস্তবে ধর্মনিরপেক্ষ ভাষিক ঐক্য গড়ে তোলার কোন সদর্থক প্রয়াস দৃষ্টিগোচর হয় না আদৌ। এখনো নির্বাচনের অঙ্ক কষা চলে হিন্দু-ভোটার ও মুসলমান-ভোটারের সংখ্যা কত তার নিরিখে। ভৌগোলিক সান্নিধ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি করতে পারেনি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমীয়া-বাঙালির মধ্যে যে দূরত্ব বরাক উপত্যকায় হিন্দু ও মুসলমান বাঙালির মধ্যেকার দূরত্ব অন্তত পরিমাণগত ভাবে তার চেয়ে কম নয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-বাঙালির ভূমিকাই মুখ্য। সামাজিক কর্তৃত্বের ভূমিকায় থাকা হিন্দু-বাঙালির অংশটি মূলত অবিভক্ত শ্রীহট্টের অধিবাসী। দেশভাগ ও বিতর্কিত গণভোটের ফলে শ্রীহট্টের যে অংশ ভারতভুক্ত হয় সেখানে এই অংশটি স্বাভাবিক কারণেই সামাজিক আধিপত্য সাব্যস্তের যাবতীয় প্রচেষ্টা আরম্ভ করে। সোজা কথায় ‘দেশের বাড়ির নকল’ তৈরির জন্য ব্যস্ত এবং উৎসাহী হয়ে পড়ে। নিম্ন বর্গের হিন্দু ও মুসলমান বাঙালির সঙ্গে এদের যে দুরত্ব দেশভাগের আগে ছিল দেশ বিভাজনের পরেও তা বহাল রইল। এটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। কর্তৃত্বকারী বাঙালির এই শ্রেণিটি উপায়ান্তরবিহীন হয়ে অসম-ভুক্তি মেনে নিলেও মানসিক ভাবে অসম তথা উত্তরপূর্বাঞ্চলের অন্যান্য প্রদেশের অধিবাসীদের থেকে স্বেচ্ছায় এবং সচেতন ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল। বরং ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এরা কলকাতামুখীনতাকেই জরুরি বলে সাব্যস্ত করে বসল। অর্থাৎ, এদের ‘মনোভূমি’ ও ‘বাসভূমি’ পৃথক হয়ে গেল। শারীরিকভাবে তো ছিলই, মানসিক ভাবেও উদ্বাস্তু হল। উভয় উপত্যকার বাঙালির মধ্যেই এই উদ্বাস্তু-মানসিকতা প্রকট হল, যদিও তার পেছনের ঐতিহাসিক এবং আর্থ-সামাজিক কারণ ভিন্ন। এই বিষয়টি নিয়ে নতুন প্রজন্মের বাঙালির চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে আজ। 
                অসমের আর্থ-সামাজিক জটিল পরিস্থিতিতে ‘বিদেশি জুজু’র ভয় দেখানোর ‘নিরাপদ’ রাজনীতি অসম তথা অসমের স্বার্থকে যেভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে তার মাশুল কিন্তু গুণতে হচ্ছে ভাষা-ধর্ম নির্বিশেষে সকল অসমবাসীকেই। এই উপলব্ধি ভীষণ জরুরি এসময় – অসমীয়া ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের জন্যই। উভয় সম্প্রদায়ের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন তরুণদের তাই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে এ বিষয়ে জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অসমীয়া এবং বাংলাভাষীদের উভয়কেই আজ অথবা কাল এই উপলব্ধি লাভ করতেই হবে, সে প্রক্রিয়া ইতিহাসের নিজস্ব নিয়মেই হয়ত ইতিমধ্যে এক সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রয়োজন কেবল সেই সম্ভাবনাকে চিনে নিয়ে ইতিহাসের গতিপথকে বাধাহীন করার লক্ষ্যে সচেষ্ট হওয়া। উত্তরপূবের নব প্রজন্মের বাঙালির সে উপলব্ধি একেবারেই নেই তা নয়, তবে উপলব্ধি অনুসারে সক্রিয় ভুমিকা গ্রহণের জন্য সচেষ্ট হওয়া দরকার, অবিলম্বে। এটাই সময়ের দাবি, উভয় সম্প্রদায়ের কাছে। দাবি মেনে সেতুবন্ধনের শর্ত পূরণে কৃতকার্য হলে সুদিন আসবে উভয় সম্প্রদায়ের জন্য, অন্যথায় উত্তরপূবের হিন্দু ও মুসলমান বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যতর বিকল্পের অনুসন্ধানে ব্রতী হতে হবে। ৮মে,২০১১

শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বোধি


                                                    











                                                      


                                                                                            রণজিৎ দাশ
 রমণী এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতহীন রাম-এর আসর চাই—
একটা মফসসল শহরের ভগ্নপ্রায় ডাক-বাংলোর বাদুর ওড়া ছাদে,
লোড শেডিং-এর রাতে, তিনজন বিষাদঘন কবিবন্ধুর সঙ্গে,
দামি সিগারেটহীন, চিকেন পকোড়াহীন, বিড়ি ও বাদাম খেয়ে,
মশার কামড় খেয়ে, ছাদের কোণে বুড়ো ষাঁড়ের অণ্ডকোষের মতো একটা লালচে বালব
জলপাই গুড়ি বা পুরুলিয়ার তিনজন হার্ডকোর কলকাতা বিদ্বেষী কবিবন্ধুর
ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে—কলকাতার কবির প্রতি তাদের ব্যঙ্গ ও করুণা মেশানো
অনবদ্য আন্তরিকতায়, মুগ্ধ হয়ে, লজ্জিত হয়ে, চাপা অপরাধবোধে,
চাপা ভণ্ডামীর বোধে, বন্ধুদের প্রত্যেকের হাত ছুঁয়ে মনে মনে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে,
তিন পেগ রাম অ তিনজন মাফিয়া –কবির মুণ্ডুপাতের পর,
বন্ধুদের সন্মিলিত অট্টহাসি আর স্খলিত গানের সুরে, মহানন্দে আমি
একটা ডোবার ধারে সঙ্গমরত কুকুরদের ধাক্কায়
একটা হৃষ্টপুষ্ট কচুঝোপের মতো দুলে দুলে, আমি এই পৃথিবীর
শুদ্ধতম রামের আসরে, মফসসল শহরের নিঃসীম নৈরাশ্যময় অন্ধকারে
বুক ভরে শ্বাস নিতে চাই, আকাশের তারা দেখতে চাই।
                                               (c) ছবি

বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

আজ বসন্ত


আমায় সহ্য করতে না পেরে
শীত নদীর রক্তস্রাব বন্ধ।

একটা বেশ্যাও তার রাতের খোরাককে আজীবন মনে রাখে

একদিন উটের পীঠে চড়ে
কোন এক আরব্য দুপুরে আমার দৌড়


আশ্চর্য জুয়ায় মেতে উঠেছ তুমি
আমায় নিয়ে, বাঞ্ছারামের বাগান বাড়িতে

তবু তুমি আছো
তাই আজ বসন্ত

বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

অসমের নানা শহরে ২১শের অনুষ্ঠান , ২০১২

        অসমের প্রথম একাদশ ভাষা শহীদের শহর শিলচরে রেল স্টেশনে  সাড়ম্বরে পালিত হয় ২১শে ফেব্রুরারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সন্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ, শিলচর এবং ভাষা শহীদ স্টেশন শহীদ স্মরণ সমিতির যৌথ উদ্যোগে সকাল সাতটা ঠেকে নটা অব্দি এই এই অনুষ্ঠান হয়। বিভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সাজানো ছিল পুরো কর্মসূচী। মুখ্য বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভাষা সেনানি সুমিত্রা দত্ত। এ ছাড়াও ডিমাছা সাহিত্য সভার সাধারণ সম্পাদক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। হিন্দি এবং মনিপুরী লোক নৃত্য ছিল অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ। নিচে উদ্যোক্তাদের পাঠানো তারই কিছু ছবি তুলে রাখা হলো।  

        
  এছাড়াও শিলচরে অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন, এ আই ডি এসও ইত্যাদি একাধিক সংগঠন মিলে গড়ে তুলল সংগ্রামী জোট। শপথ নিল অন্য এক সংগ্রামের। তারই সংবাদঃ
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
         গুয়াহাটিতে 'ব্যতিক্রম সাংস্কৃতিক মঞ্চ' আয়োজন করেছিল দু'দিনের মিলনোৎসব তাতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সমবেত হন বৌদ্ধিক সাংস্কতিক কর্মীরা। ছিলেন অসম সাহিত্য সভার সভাপতি রং বং তেরং। সংবাদে সেই অনুষ্ঠানঃ
                             
                                     ছবিগুলোতে দু'বার ক্লিক করুন , বড় হয়ে যাবে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
             দিকে তিনসুকিয়াতে 'উজান সাহিত্য গোষ্ঠী' গেল প্রায় একদশক ধরে  ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনের ঐতিহ্য এবারেও ধরে রেখেছে। কর্মসূচির শুরু হয়েছিল  ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১২তে দুর্গাবাড়ি শিশু বিদ্যালয়ে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা দিয়ে। তিনসুকিয়ার প্রচুর স্কুল থেকে প্রায় ২০০ শতাধিক প্রতিযোগী এতে যোগ দেয়। চারটি বিভাগে চারজন করে ষোলজন বিজয়ী প্রতিযোগীকে আজ ২১ শের অনুষ্ঠানের শেষে পুরস্কৃত করা হয়। ২১শের দুপুর তিনটেয় সংস্থার সভাপতি সুজয় রায়  সংস্থার পতাকা তুলে  অনুষ্ঠানের সুচনা করেন। শহীদ বেদিতে পুষ্পাঞ্জলী অর্পন করেন অসম সাহিত্য সভার তিনসুকিয়া শাখার সভাপতি আব্দুল রৌফ সহ উপস্থিত সদস্য এবং অভ্যাগতরা। এর পর সবাই দাঁড়িয়ে  'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি' গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ২১শের ইতিবৃত্ত এবং মাতৃভাষা সংকটের স্বরূপ নিয়ে শুরুতেই বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক সুশান্ত কর। একে একে বক্তব্য রাখেন অসম সাহিত্য সভার তিনসুকিয়া শাখার সভাপতি আব্দুল রৌফ, সভার প্রাক্তন সভাপতি পূর্ণানন্দ বরুয়া, নেপালি কবি দুর্গা দত্ত শর্মা, সুপরিচিত চিত্র শিল্পী রাজেন খাউন্ড, মহেশ্বর মূর্মু, শ্রমিক আন্দোলনের কর্মি অসীম দত্ত প্রমুখ অনেকে। আকর্ষণীয় বিষয় ছিল এদিন প্রত্যেকে তাদের মাতৃভাষাতে বক্তব্য রাখছিলেন।  রাজেন খাউন্ড এবং দুর্গা দাস দত্ত অবশ্য নিজেদের লেখা কবিতা পড়েও শোনান সবাইকে । এছাড়াও শুক্লা সরকার, উজানের সম্পাদক ভানু ভূষণ দাস, সহ-সভানেত্রী সবিতা দেবনাথ, সদস্যা নিহারিকা দেবী এমন আড়ো অনেকে কবিতা পড়ে শোনান। এক সঙ্গে কবিতা আবৃত্তি করেন সৌমেন ব্যানার্জী এবং রূপা পাল। জীবন সরকার, অমৃত রাজখোয়া, পৌষালি কর প্রমুখ অনেকে সঙ্গীতেও সুরময় করে তুলেন অনুষ্ঠান। পুরো অনুষ্ঠানে আশাতীত দর্শক শ্রোতার সমাগম দেখে উৎসাহীত আব্দুল রৌফ প্রস্তাব করেন যে আগামী বছর আরো ব্যাপক আকারে , নানা ভাষার আরো বহু সংগঠনকে যুক্ত করে অনুষ্ঠান করতে হবে জেলা গ্রন্থাগারে। ২১শের অনুষ্ঠান থেকেই তিনসুকিয়াতে  সামাজিক বৈচিত্রের গৌরবকে তুলে ধরে নতুন এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম দিতে হবে।
 বাকি ছবিগুলো দেখুন এখানে ঃ

এছাড়াও তিনটি ভিডিওঃ

১) রবীন্দ্র সংগীত গাইছে পৌষালি কর।


২) রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি করছেন সৌমেন ব্যানার্জী এবং রূপা পাল।


৩) নেপালি ভাষাতে বক্তৃতা দিচ্ছেন এবং কবিতা পড়ছেন কবি দুর্গা দত্ত শর্মা

সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

তিস্তা ভালো নেই...



        পৃথিবীর এই গোলার্ধে এখন গভীর রাত। আর কিছুক্ষণ পরেই সাত সকালের আমন্ত্রণে এই গোলার্ধে কিছু সংখ্যক মানুষ জেগে উঠবেন। গত ক'দিন এই পৃথিবীর মানুষ মেতে ছিলেন ভালবাসায়। ব্যাতিক্রমও ছিল। কোথাও পুড়েছে ভালবাসার ছবি আবার কোথাও, শুধু ভালোবাসাবাসিরা মাখামাখি করেছে প্রথম বসন্তে।

             ভালবাসা দিবসের প্রথম প্রহরে সংবাদ শিরোনামে তিস্তা...। হৃদয় কৃষ্ণ লেইনের মেয়েটি কুরবানি দিয়েছে রেল লাইনে নিজেকে। তিস্তা হৃদয়, কাজল চোখ, কিছুই বাঁচানো যায়নি।সময় মতো ভূগোলটা জানলে সংরক্ষণ করা যেতে পারতো কলকাতা মিউজিয়ামে। 'সুইসাইড ডে', সারাবছর ধরেই উদযাপন হয় এই পৃথিবীতে।সুইসাইড নোটে সেই পরিচিত লাইন,'আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমাকে ক্ষমা করে দিও...। ইতি, তোমাদের তিস্তা।'

           প্রেম আর মৃত্যুর এক অপূর্ব গন্তব্য। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালির সেই অপূর্ব দৃশ্য, রেললাইনে কান পেতে ট্রেনের দূরত্ব মাপা। আহা, সেই মেয়েটির দু'বুকের মধ্যে দূরত্ব কতটা ছিল কে জানে! রেললাইনে ঝাঁপিয়ে পড়তেও নাকি এর চেয়ে কম সময় লেগেছিল তিস্তার, লাইভ টেলিকাস্টে  তার চেয়েও কম সময় লেগেছিল।

           বাঙালি সংস্কৃতিতে এই ফেব্রুয়ারি মাসটি যেন বিশেষ গাম্ভীর্যের মাস। এতো আদিখ্যেতা কোন ভাষা নিয়ে কোন কালে কোন জাতি করেছে কিনা জানিনা। অনেকটা কার্ল মার্ক্সের কম্যুনিজমের মতো। সহজ সরল তত্ব, শ্রেণী সংগ্রাম। কোন বৈষম্য চলবে না। সবাই সমান, সবাই রাজা সবার দেশে। প্রদেশ একটি, দেশ একটি। কিছু কিছু  শ্রদ্ধেয় কমরেড আজকাল এই সহজ সরল তত্বটিকে জটিল করে দিয়েছেন। আজ সারা বিশ্বজুড়ে মার্ক্সের বড্ড অকাল, ঐ সুইসাইড নোটের মতো। অথচ কার্ল মার্ক্স এতোটাই রোম্যান্টিক ছিলেন যে, জেনি আর নিজের প্রেম সম্পর্কিত জীবনদর্শন থেকেই সৃষ্টি করেছিলেন মার্ক্সীয় তত্ব। মানুষের ভাষাতো মাতৃ জঠরেই ভ্রূন হয়ে জন্ম নেয়। পৃথিবীর এতো মায়ের 'ভ্রূণদিবস' পালন করার সময় আছে কি বাঙালির! মৈথিলি, অসমিয়া, ককবরক, উর্দু, পালিতেও আজকাল বাঙ্গালি অভ্যস্থ। ক্যালেন্ডারের পাতায় কোন দিবসের জন্য আজ আর কোন স্থান নেই কিন্তু।

           আরেকটি কাঁচ ভাঙ্গার খবর দিই। শুধু মার্ক্সীয় কিছু নীতিবাগীশের কারনেই পয়ত্রিশটি শিশু চব্বিশ ঘণ্টা  ধরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছে ত্রিপুরার পাহাড়ে এই ভালোবাসার মাসে। আজ পাহাড়ের উপর যাবতীয় ক্ষোভ উগড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। গত দুই দশক ধরে ত্রিপুরার পাহাড়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য উন্নয়নে তালা দিয়েছিল কিছু ভূমিপুত্র। সবার স্বাধীন রাজ্য চাই, দেশ চাই। কিছু মানুষ তালিবানের সঙ্গে ভালবাসাবাসি করে আবার নতুন জিগির তুলছে, স্বাধীনতা চাই। এই গৃহযুদ্ধ পৃথিবীর প্রায় সব প্রদেশেই। সবাই চায় স্বাধীনতা। পৃথিবী কতবার টুকরো হবে! ভালোবাসার মাসটি আরও কতবার আহত হবে কে জানে!
            
          ভালোবাসেনা কে?? খৃষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, মুসলমান সবার যেন ভালো না বেসেই বাচ্চা হয়ে
যায়!তবে বাঙালি একটু বেশিই ভালোবাসাবাসি করেন। তাই আজকাল বিচ্ছেদের পাহাড়ে জবুথবু স্বয়ং দার্জিলিং। এতো কান্না বাঙালি মেয়ের, যে বঙ্গোপসাগর নাকি জলে থইথই। তিস্তার শরীর নিয়ে টানাটানি চলছে। তিস্তার জন্য খারাপ লাগে। যুবতি তো হোক, তারপর নাহয় ভোগে লাগুক! চিকিৎসা দরকার তিস্তার। পেটে পাথর হয়েছে। এখন গর্ভবতী হলে মেয়েটির বিপদ আরও বেড়ে যাবে। কে শোনে কার কথা! দুই পুরুষ ধরে সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিস্তার দখল চাই! একই খাদ্য, একই ভাষা, একই কথা বলে এই মানুষেরা। কিন্তু শুধু পৌরুষ জাহির করার জন্যেই তিস্তা চাই। পৃথিবীর বহু ভাষা হারিয়ে গেছে। বহু ধর্ম হারিয়ে গেছে, কিন্তু রসগোল্লা হারায়নি।

           বাঙালি গোগ্রাসে রসগোল্লা মুখে দিয়ে চোখের পিচুটি মোছেন, হাত চালান করেন প্যান্টের পকেটে।ত্রিপুরার পাহাড়ের ত্রিশ থেকে চল্লিশটি শিশু জেট্রোফা ফল খেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিল গত ক'দিন। এদের পাহাড়ী ভাষা বোঝেনি বাঙালি চিকিৎসক, নেতা, মন্ত্রী কেউই। একজন মাত্র চিকিৎসক বুঝতে পেরেছিল খিদেয় জর্জরিত এই শিশু গুলি ইস্কুল পালিয়ে খেয়েছে বিষাক্ত জেট্রোফা ফল। এই দিনটির জন্যও একটি বিশেষ দিন নির্ধারিত হোক। 'শিশু খুদা দিবস' এই মধুমাসে! বিষাক্ত মদ খেয়ে যে মানুষ গুলি মারা গেছেন, তাঁরা আজ সাদা কালো।
          এক্সক্লুসিভ একটা খবর দিয়ে রাখি, এই বঙ্গদেশের সর্বহারা মানুষ আবারও বিষাক্ত মদ খেয়ে পেট ফুলিয়ে মরতে চাইছেন, বেঁচে থাকলে এই অর্থ পাওয়া যাবে না, যে দরদ পাওয়া যায় মদ খেয়ে মরলে। মদ, সরকার, অর্থ, বেঁচে থাকা, ঋণমুক্তি, সবুজ ধান আর ভাতের মদের দারুন ভালবাসাবাসি।

           ঐ শিশু গুলিতো বউ পেটাতে বা মহাজনকে গালি দিতে নেশা করেনি, ইস্কুল পালিয়ে জঙ্গল থেকে ফল খেয়েছে, খিদে পেয়েছিল তাই। এত্তো বড় পেটে কালো নাভিমূল এখনও হোমিওপ্যাথির বোতল বন্দী হয়নি। এরপরও কি ঘৃণা করবেন? আর যদি না করেন, তাহলে আপনিও ফল খাওয়া ছেড়ে দিন। দেবেন ওদের একটা কমলা বা একটা আম! হোক কামড় বসানো এঁটো আপেলটিই। ওরা খেয়ে নেবে। আদম ইভের বিষ ফল তো নয়!  অন্যথায় একবার আপনি চেখে দেখতে পারেন জেট্রোফা ফল।

      
        স্যারেরা ছিলেন সব ভ্যালেন্টাইন ডে'র ছুটিতে, সুযোগ পেয়েই মার্কসবাদের ক্লাশে ছুট।  পাঠ শেষে প্রেমিকাকে বলেছেন প্রমোশনটা এই মাসে হয়েই যাবে, এরপরই বিয়েটা। একটা জায়েন্ট স্ক্রিন টিভিতে মধ্যরাতে নীল ছবি। আহা মার্ক্সবাদী রক্ষণশীলতা নীল মধ্যরাতে।
    
          আঙ্গুরের কিলো একশ পঞ্চাশ। আজ তিস্তা পাড়ের মা'য়েরা সব মেতে উঠেছেন বৈষ্ণব সেবায়। ছেলে মেয়ের মাথা গুনে বাড়ি বাড়ি ভিখ্যে করে যোগার চলছে ভগবানের নৈবদ্যের। এরপরও রক্ষা হলোনা ছেলে মেয়েগুলির। তিস্তার মা নেই। খিদার ভালবাসা, জলের ভালবাসা, ভাষার ভালোবাসা, গম্ভীর ফেব্রুয়ারি প্রেমের ভালবাসা, মারক্সিয় ভালবাসা, তিস্তার ভালবাসা সবাই মরে যাক। বেঁচে থাকুক ছেলে মেয়েগুলি।  কে বাঁচে, কে মরে কে জানে! আমিও জানিনা।

           এবার ঘুম পেয়েছে শহীদ মিনারের। ঐ শুনুন মিষ্টি মিষ্টি মুখ করে তিস্তা আপনাকে সাত সকালের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। নুন চিনি জল গুলে স্যালাইন খেয়ে নিন। আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে শুনেছি।ফল না খাওয়াই ভালো... আজ অন্তত!

রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সুরমা নদীর গাংচিল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আকাশী গঙ্গা


(নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলনের তিনসুকিয়া শাখার মুখপত্র 'প্রতীতি'র জন্যে হেমাঙ্গ বিশ্বাস নিয়ে এক প্রাথমিক পাঠ              
                                                                                                      দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।
                                                                                                দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
                                                                                             ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
                                                                                              একটি ধানের শিষের উপরে
                                                                                                         একটি শিশিরবিন্দু।
  
              বীন্দ্রনাথের এটি জনপ্রিয় অনুকবিতা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের পূর্বোত্তরের বাঙালিদের কথা ভেবে লেখেন নি তো? গেল বছর আমরা রবীন্দ্রসার্ধশতবর্ষ নিয়ে মাতলাম। অথচ কই, কেউ কবি অশোক বিজয় রাহার কথা বিশেষ মনে রাখলেন না তো! এবারে আমরা স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে মেতেছি, সব্বাই। প্রায় সমস্ত ছোট বড় শহরে তাঁকে নিয়ে উৎসব অনুষ্ঠান হচ্ছে আর হবে, কিন্তু কই, আমাদের ঘরের কাছের মানুষ যিনি আমাদের জন্যেই আজীবন পণ করেছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, জেলে গেছেন সেই হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে স্মরণ করবার দায় আমরা গুটি কয় ‘বুদ্ধিজীবি’র কাঁধে চাপিয়ে দিব্বি সুখে আছি! এবছর তাঁর শতবর্ষ! তাঁকে সেভাবে স্মরণ না করবার কারণটুকু কি? তিনি আমাদেরই লোক, ‘গাঁয়ের যোগী’ বলে! কলকাতাতে দীর্ঘদিন থাকলেও ঠিক সেখানকার মূলস্রোতের সিলমোহর তাঁর গায়ে পড়েনি বলে? এভাবে যে আমরা কোনদিনই স্বনির্ভর হয়ে, স্বমর্যাদাতে নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না, সে যতই রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষের উত্তরাধিকার আমাদের উপর বর্তাক -- এই সত্যটুকু নিয়ে কি খানিক অবসরেও ভাবব না?
            ‘হেমাঙ্গ বিশ্বাসঃ সাংস্কৃতিক চেতনাৰ অমল সুবাস’ নামে ফটিক বরার এক চটি বই রয়েছে। সেখানে তিনি এক জায়গাতে আক্ষেপ করে লিখেছেন, “আধুনিক অসমৰ আকাশৰ তিনিটা উজ্জ্বল তাৰকাই সংস্কৃতিৰ পোহৰেৰে জনজীৱন পোহৰাই আছে। ডিব্রুগড়ৰ তামোলবাৰী বাগিচাত ওপজা জ্যোতিপ্রসাদ, সুদূর সাগৰ পাৰৰ ঢাকাত ওপজা বিষ্ণুপ্রসাদ আৰু সুৰমা উপত্যকাৰ শ্রীহট্ট জিলাৰ মিৰাশী গাঁওত ওপজা হেমাঙ্গ বিশ্বাস---তিনিও আঢ্যবন্ত, আটন্তিয়াৰ পৰিয়ালত , সোণৰ নহলেও, ৰূপৰ চামুচ মুখত লৈ জনম লৈছিল। উত্তৰাধিকাৰ ৰূপে পোৱা সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আৰু প্রাচুর্য্য নেওচি বোকা-পাণী, ধুলি-বালি , জেং জোং ভৰা গাঁৱলীয়া বাটেৰে , বাহনি-ঝাৰণিৰ মাজেৰে অনাহাৰে অর্দ্ধ্বাহাৰে  পৰৰ কাৰণে কন্দা জীৱন কটাই গ’ল।...তিনিও দুখীয়া হালোৱা, হজুৱা, বণূৱা, তলমজলীয়াৰ ঘৰে ঘৰে গানৰ  অগণী সিঁচি সিঁচি গ’ল। তিনিও গাঁৱলীয়া বাটেৰে , ভৰা নৈৰ ঘাটেৰে বাট বুলি লোককৃষ্টি, কলা, লোকসঙ্গীতৰ সেণ চেকুঁৰা বুটলি, বুকুৰ মৌৰ তিওৱা প্রেমৰ অমিয়া মাধুৰী ঢালি সেণসেৰীয়া সংস্কৃতি সৃষ্টি কৰি গ’ল। জ্যোতিপ্রসাদ আৰু বিষ্ণু ৰাভাক অলপ হ’লেও মানুহে চিনি পায়। পিচে তৃতীয় জনক আজিৰ অসমৰ মানুহে, বিশেষকৈ আজিৰ পুৰুষে, চিনি নাপায় বা পোৱা সকলেও পাহৰি পেলাইছে।”  ফটিক বরাকে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হেমাঙ্গ বিশ্বাস কোন?’ তার উত্তরে তিনি বইটির ভূমিকাতেই লিখেছেন, “...হেমাঙ্গ বিশ্বাস এনে এজন মানুহ যিজনে চিলেটৰ (শ্রীহট্ট) বঙালী হৈও অসমীয়া ভাষা, কৃষ্টি আৰু সংস্কৃতিৰ লোকায়ত ৰূপটো সংৰক্ষিত কৰিবলৈ আন বহুতৰ লগে ভাগে আৰু অকলেও প্রাণে পণে চেষ্টা কৰি গ’ল; যিজনে জ্যোতিপ্রসাদ, বিষ্ণু ৰাভা, ভূপেন হাজৰিকা, নৰহৰি বুঢ়াভকত, মঘাই ওঝা, ব্রজেন বৰুৱা, ৰমেন বৰুৱা, আব্দুল মালিক, দিলীপ শর্মা, কুলধৰ চলিহা, প্রফুল্ল চন্দ্র বৰুৱাকে আদি কৰি আন বহুতো প্রতিভাশালী আৰু একনিষ্ঠ লিখক –শিল্পীক গোটপিত খুৱাই একেলগে অসমৰ জনসংস্কৃতিৰ প্রচাৰ কৰি উন্নতি সাধনৰ বাবে কাম কৰিবলৈ এখন মঞ্চলৈ উলিয়াই আনিছিল...।” তথ্যগুলো দিলাম, এই ইঙ্গিত দিতে যে এতো বিশাল ব্যক্তিত্বের পুরো একটা পরিচয় তুলে দিতে আরেকটা বই লিখতেই হয়। আবার কোনো একটা দিক তুলে ধরাও সমস্যা, কেননা আমাদের এই শহরে অধিকাংশের  কাছে ব্যক্তি হেমাঙ্গের প্রাথমিক পরিচয়টুকু তুলে ধরাটাই এখনো এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমরা তাই , সেই কাজটাই করব ভাবছি।
হেমাঙ্গ জীবনীঃ   খোয়াই তাঁর ভালোবাসা
soruo-white swan
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের রাজনৈতিক প্রেরণার স্থল নিশ্চয়ই সাম্যবাদী আন্তর্জাতিকতাবাদ, কিন্তু যেহেতু সারা জীবন বাংলা এবং অসমিয়াতেই কাজ করেছেন তাই যে মাটিতে তাঁর শেকড়কে পুষ্ট করেছে তার প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ পেয়েছিল ‘সীমান্ত প্রহরী’ কাব্যগ্রন্থের’ খোয়াই’ ( ১৯৫৩) কবিতার এই ক’টি পংক্তিতে, “‘তোমার কূলকে ভালবেসেই তো/কূল ছাড়া আমি/...ব্রহ্মপুত্র আমার বিস্ময়/পদ্মা আমার শ্রদ্ধা/গঙ্গা আমার ভক্তি/তুমি আমার ভালবাসা... খোয়াই।”।
          এই খোয়াই নদীর পাড়েই তখনকার অসমের , এখনকার বাংলাদেশের সিলেটের হবিগঞ্জের মিরাশি গ্রামে ১৯১২র ১৪ জানুয়ারি তারিখে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম। তাঁর বাবা হরকুমার বিশ্বাস ছোটখাটো হলেও জমিদার ছিলেন। তখনকার দিনের মেট্রিক পাশ হলেও বাংলা ইংরেজি সংস্কৃতে তাঁর বেশ চর্চা এবং জ্ঞান ছিল। ফলে পাঁচ গাঁয়ের ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের মধ্যেও তাঁর বেশ সম্মান ছিল। মা সরোজিনী বিশ্বাসের পরিবারটিও  সঙ্গীত কাব্য চর্চাতে সমৃদ্ধ ছিল। একদিকে সামন্তীয় শাসন শোষণ এবং অন্যদিকে গীতা বেদান্ত সঙ্গীতের সুর এবং স্বর যুগপৎ দেখেছেন ও শুনেছেন বাড়িতে। একদিকে হিন্দুত্বের বড়াই অন্যদিকে ঢুলি মালি নমশূদ্র মুসলমান প্রজাদের মুখের ভাত কেড়ে নিয়ে দূর-দূর-ছাই-ছাই তাঁকে ছেলেবেলা থেকেই বিরক্ত করে তুলেছিল। ফলে তিনি বাড়ি ছেড়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন খোয়াই নদীর পাড়ে পাড়ে। প্রজাদের পাড়ায় পাড়ায়। বাড়িতেই পদাবলী কির্তন , ওঝাপালা লেগেই থাকত ।সেগুলোতো আয়ত্বে এসছিলই, প্রজাদের মধ্যে ভিড়ে গিয়ে লোকগীত, লোক নৃত্য, যাত্রা।  বাউল গানেও মজে গেলেন। শুধু বাংলা নয় মণিপুরি নৃত্যগীতের সঙ্গেও তার পরিচয় ঘটেছিল গ্রামের বাড়িতে থাকতেই।  মিরাশি গ্রামের স্কুলেই নিয়েছিলেন প্রাথমিক স্কুলের পাঠ। সেদিনগুলোতেই স্কুলে যাবার আসবার পথে পথেই হয়েছিল তার এই লোকসংস্কৃতির আদি পাঠ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত। পরে অবশ্যি মা তাঁকে শেখাতে শুরু করেন । মা শিখিয়েছেন প্রচুর মেয়েলি ব্রতকথার গান, শ্যামাসঙ্গীত এমন কি রজনীকান্তের গানও। 
           ক্লাস সেভেনে পড়বার সময়ে বাবার হঠাৎ খেয়ালে তিনি চলে এলেন উজান অসমের ডিব্রুগড়ে। জর্জ হাইস্কুলে ভর্তি হলেন, থাকার ব্যবস্থা হলো বিখ্যাত ওম বাবার আশ্রম বা বিরাজ আশ্রমে। এখানে অসমিয়া গান কবিতা সাহিত্যের প্রতি তাঁর সমান আগ্রহে পেয়ে বসল। বন্ধু লোহিত কাকতি তাঁকে শেখালেন, প্রথম অসমিয়া গান,” কিয়োনো পাহৰা অসমীয়া হেৰা/ চিৰদিন তুমি আছিলা স্বাধীন/ ভাৰতৰ মাজে তোমাৰ জননী/ বীৰ প্রসৱিনী আছিল এদিন...।”  কিন্তু এখানে স্থায়ী হলেন না। ধর্মমতি বাবারই মনে হলো, এই আশ্রমে অধর্ম বেশ ঘাটি গেড়েছে। নিয়ে গিয়ে আবার ভর্তি করে দিলেন হবিগঞ্জের সরকারী হাইস্কুলে। সেখানেই ১৯৩০শে তিনি মেট্রিক পাশ করেন।


             হবিগঞ্জে তিনি যখন ছাত্র তখনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গোটা ভারত চঞ্চল হতে শুরু করেছে। হবিগঞ্জও তখন নীরব ছিল না। ভগৎ সিঙের মামলা, যতিন দাসের অনশনে মৃত্যু, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ইত্যাদি হেমাঙ্গের মনে প্রবল ছাপ ফেলে। নিজেও একটা দুটো করে মিছিলে পা মেলাতে শুরু করেন। ‘অনুশীলন সমিতি’তে যোগ দিয়ে কিছুদিন অনুশীলন করলেও, গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেই ১৯৩০এই ১৪৪ ধারা ভাঙার অপরাধে হেমাঙ্গের হাজতবাস হলো। বয়স তাঁর তখন মাত্র সতের। হবিগঞ্জ, সিলেট হয়ে পরে তাঁকে নগাওঁ জেলে নিয়ে আসা হয়। এখানে তাঁর জেল সঙ্গী হিসেবে পেলেন পরে যিনি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হবেন সেই বিমলাপ্রসাদ চালিহা এবং আরো অনেককে। বিমলাপ্রসাদের কাছেই জেলেই তিনি পার্বতী প্রসাদের ‘বনগীত’ এ পাঠ নিলেন। অসমীয়া ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আকর্ষণ আরো খানিকটা বাড়ল। ক’মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পেলেন। হেমাঙ্গ গিয়ে সিলেট মুরারি চাঁদ কলেজে বিজ্ঞানে নাম লেখালেন। কিন্তু আইন অমান্য আন্দোলনে সময় গান্ধির আহ্বানে প্রকাশ্য জনসভাতে নিজে আবার কলেজ ছাড়ার কথাও ঘোষণা করলেন। ইতি পড়ল তাঁর প্রথাগত শিক্ষাতে। ইতিমধ্যে কংগ্রেসে নেতাজি সুভাষের প্রভাব বাড়ছে। নেতাজি সিলেটে এলে সেই সভা সংগঠনে হেমাঙ্গ অগ্রণী ভূমিকা নিলেন। সুভাষের প্রভাবেই হোক, আর বাড়ির কাছে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার মতো ঘটনার জন্যেই হোক, কিম্বা রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ , গোর্কির ‘মাদার’এর বাংলা অনুবাদ কিম্বা বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে ফেলবার জন্যেই হোক-- ধীরে ধীরে গান্ধির প্রতি তাঁর আকর্ষণ কমছিল। কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী ঝোঁককেও তিনি ভালো চোখে নিতে পারছিলেন না, কেননা বাড়িতে এই ঝোঁকের প্রতি তাঁর ছিল আবাল্য লড়াই। সুতরাং নিজে থেকেও কিছু সঙ্গীকে নিয়ে এক সময় তিনি কংগ্রেসের স্বীকৃত পথের বাইরে গিয়ে কিছু রাজনৈতিক প্রচারে মন দিলেন। ফলে আবার গ্রেপ্তার। এবারে আড়াই বছর। আবারো একই জেল বদলের অনুক্রমে নগাওঁ এলেন, পরে গুয়াহাটিও গেলেন। এই যাত্রাতেই তিনি হেলে বসে শুনলেন এবং শিখলেন জ্যোতিপ্রসাদের ‘গছে গছে পাতি দিলে ফুলৰে শৰাই।’
এদিকে জেলেই তাঁর শরীরে যক্ষা বাসা বাঁধে। তখন যক্ষা মানে মারণ রোগ! উপায়ুক্ত মোলান সাহেব রাজনীতি করবেন না বলে দাসখত লিখে দেবার শর্তে মুক্তি দিতে রাজি হলেন। হেমাঙ্গ থুড়িই দেবেন! সরকার নিজেই পরে উপায় না দেখে মুক্তি দিল। শিলঙে তখন ডাঃ বিধান রায় চিকিৎসা করতেন। তাঁর কাছে গেলেন। তিনি তাঁকে যাদব পুরে নিজের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে পাঠালেন। সেখানেই কমিউনিষ্ট নেতা অনিলেন্দ্র রায়ের কাছে তাঁর মার্ক্সবাদে দীক্ষা। সেখানেই সিলেটের দুই কমিউনিষ্ট নেতা দিগিন দাসগুপ্ত এবং চঞ্চল শর্মার সঙ্গে চেনাপরিচয় হয়। সুতরাং সেই হাসপাতাল থেকেই তিনি সিলেট পার্টির প্রতি সহমর্মীতা প্রকাশ করেন। এবং সুস্থ হয়ে সিলেট যখন ফেরেন ততদিনে তিনি পুরো দস্তুর কমিউনিষ্ট।
           তখনই তাঁর গ্রামে একটি ঘটনা ঘটে যাতে কেবল মানচিত্রের স্বাধীনতা নয় খোলনলচে পালটানো নিয়ে তাঁর প্রত্যয়দৃঢ়তার পরিচয় মেলে।  তাঁদের গ্রামে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের উদ্যোগে একটি হিন্দু মন্দির গড়ে তোলা হবে। তাতে কোনো অসুবিধে ছিল না। কিন্তু সেখানে অনেকেই এলেন যারা হিন্দু ঐক্য নিয়ে প্রবল ভাষণ দিচ্ছিলেন। সেই সভার সভাপতি ছিলেন হেমাঙ্গের  বাবা হরকুমার বিশ্বাস। বাবার উপস্থিতিতেই হেমাঙ্গ সেখানে দাঁড়িয়ে বললেন,” হিন্দু ঐক্য নয়, চাই শোষিত মানুষের ঐক্য...মানুসের সেবা, বিশেষতঃ, শোষিত জনগণের সেবা আমার ধর্ম।” এরকম কিছু লড়াই পরিবারের ভেতরেই করার পরিণাম যা হবার ছিল তাই হয়েছিল। ছেলে বলে রেয়াত করেন নি বাবা। ১৯৪২এ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন হেমাঙ্গ।
            সে সময় একবার হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচঙে  ম্যালেরিয়া রোগ মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এতে হাজার হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে। এ সময় বানিয়াচঙে মানুষের সেবাতে  ছুটে গিয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সে সময়ই গান লিখেছিলেন, 'বাইন্যাচঙে প্রাণ বিদরী ম্যালেরিয়া মহামারী/হাজার হাজার নর-নারী মরছে অসহায়,/শান্তি ভরা সুখের দেহ/শূন্য আজি নাইরে কেহ/মৃত সন্তান বুকে লইয়া কান্দে বাপ-মায়...'
ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করেছে, ফ্যাসীবাদের বিপদ ঘণ্টাও আতঙ্কিত করে তুলেছে বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষকে। স্পেনের গৃহযুদ্ধে কডওয়েল , লোরকার মতো কবি বুদ্ধিজীবিদের মৃত্যুও লেখক শিল্পীদের আতঙ্কিত করতে শুরু করে।  রম্যাঁ রল্যাঁ, গোর্কি, আইনষ্টাইন, আদ্রেঁ জিদ প্রমুখদের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক স্তরে গড়ে উঠে ‘ফ্যাসীবাদ বিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘ’। এর সঙ্গে বিশ্ব জুড়েই কমিউনিষ্টরা ছিলেন বটে, কিন্তু কমিউনিষ্টরা ছাড়াও অনেকে এর সঙ্গে জুড়েছিলেন,  ফ্যাসীবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা যারাই আক্রান্ত বোধ করছিলেন সেই সমস্ত লেখক শিল্পীরা। যেমন ভারতে এর সঙ্গে জুড়েছিলেন জহরলাল নেহরু, রবীন্দ্রনাথের, পণ্ডিত রবি শঙ্কর, পৃথ্বিরাজ কাপুর , বুদ্ধদেব বসুদের মতো ব্যক্তিত্বও । ১৯৩৬এ লক্ষ্ণৌতে  এঁদের সবার উদ্যোগে এবং মুন্সি প্রেমচান্দের পৌরহিত্যে আয়োজিত হয় এর প্রথম অধিবেশন। ভারতে এর নাম হয় ‘সারা ভারত প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সংঘ’ । এই সংগঠন দীর্ঘস্থায়ী না হলেও  শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে ‘প্রগতিশীল’ শব্দটি এই সংঠনের নামের থেকেই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। পরের বছর রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এর কলকাতা বা বঙ্গীয় শাখা গড়ে উঠে। ১৩৩৮এ কলকাতাতে সর্বভারতীয় সংগঠনটির দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
           যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি, জাপানের ভারতের দোরগড়াতে এসে ব্রহ্মদেশ আক্রমণ, ৪২এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সংগঠনে কিছু মতভেদ এবং বিশৃঙ্খলাও দেখা দেয়। কমিউনিষ্ট পার্টি তখন সাংস্কৃতিক কাজে কর্মে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৩এ পার্টির মুম্বাই কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গড়ে উঠে ভারতীয় গণ নাট্য সংঘ , যেটি পরে আই পি টি এ নামে বিখ্যাত হয়। কায়ফি আজমী,  বলরাজ সাহনী, শংকর, শৈলেন্দ্র, পৃথ্বিরাজ কাপুরেরা উদ্যোগ নিয়ে সংগঠনটি গড়তে তোলেন।  বাংলার প্রাদেশিক কমিটিতে মনোনীত হন সুনীল চ্যাটার্জী, দিলীপ রায়, সুধী প্রধান, বিজন ভট্টাচার্য,দেবব্রত বিশ্বাস , শম্ভু মিত্র, সুজাতা মুখার্জী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, স্নেহাংশু আচার্য, বিষ্ণু দে’র মতো ব্যক্তিত্ব।  হেমাঙ্গ বিশ্বাস এর আগেই ১৯৪২এ তাঁর শিল্পীদল নিয়ে এসে কলকাতাতে অনুষ্ঠান করে গেছিলেন। সুতরাং তিনিও রইলেন প্রাদেশিক সংগঠনে। পূর্বোত্তরের আর যে খ্যাতনামা ব্যক্তিটি সংগঠনের শুরু থেকেই এর সঙ্গে ছিলেন তিনি ত্রিপুরার সচীন দেব বর্মণ।
হেমাঙ্গ জীবনীঃ   .ব্রহ্মপুত্র তাঁর  বিস্ময় 


                আমরা গণনাট্যের নাটক ‘নবান্ন’ কিম্বা বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রদের নিয়ে কিছু লিখছি না এই ভেবে যে এগুলো সবাই এক আধটু জানেন এবং এখানে এগুলো হবে অপ্রাসঙ্গিক। পার্টি এবং কৃষক সভার কাজ করতে করতেই পার্টির সাংস্কৃতিক কাজে কর্মের নেতৃত্বে চলে এসছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস।  যেমন ১৯৮৮ এ এখনকার কাছাড়ের কাটাখালে    বসেছিল কৃষক সভার জেলা সম্মেলন। প্রকাশ্য অধিবশনের সভাপতি আরেক শিল্পী প্রতিভা ইরাবৎ সিং । সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনার দায় হেমাঙ্গের কাঁধে। ১৯৪৫এ নেত্রকোনাতে অনুষ্ঠিত কৃষক সভার সর্বভারতীয় সম্মেলনে সেই ইরাবত সিং হেমাঙ্গের ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান’কে মনিপুরি নৃতিনাট্যে রূপান্তরিত এবং অনুবাদ করে পরিবেশন করেন। তেভাগা আন্দোলনের সময়ের বার্মা সীমান্তে শহীদের মৃত্যু বরণ করেন ইরাবৎ সিং।  এই ইরাবৎ সিংকে হেমাঙ্গ উৎসর্গ করে লিখেছিলেন ‘সীমান্ত প্রহরী’ নামে বিখ্যাত কবিতা এবং একই নামের পুরো একখানা বই। প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৬১তে।   এই গণনাট্যের আদর্শে গড়ে ১৯৪৫এ তুলেছিলেন ‘সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াড’। সেটি নিয়ে তিনি শিলচর, শিলং , গুয়াহাটি হয়ে অসমের প্রধান প্রধান সমস্ত শহরে ভ্রমণ করেন। অভিনব ছিল সে পরিকল্পনা। “মণিপুরি বীর টিকেন্দ্রজিৎ, খাসিয়া জাতীয় বীর তিরোৎ সিং, জয়ন্তীয়া বীর কিয়াং নাবা, অসমের মণীরাম দেওয়ান, কুশল কোঁয়র, কনকলতাকে নিয়ে ব্যালে, কার্টুন, ছায়ানৃত্য, গণসংগীতে প্রস্তুত করেছিলেন  অনবদ্য আলেখ্যে। যার আবেদন সহজেই তখন পৌঁছুতে পেরেছিল মানুষের মনে।   সর্বত্র বিপুল সাড়া এবং সমর্থণ পেয়ে এরই শাখা খুলে খুলে  এগুতে থাকেন। সে যাত্রাতেও তিনি দ্বিতীয়বারের জন্যে ডিব্রুগড়ে আসেন এবং সেখানে গোবিন্দ শর্মাকে সভাপতি ও নগেন কাকতিকে সম্পাদক করে ডিব্রুগড় শাখাও গঠন করেন। ১৯৪৬এর শুরুতে তেজপুরে তাঁদের অনুষ্ঠানের কথা শুনে  অভিভূত হলেন জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা। অসুস্থতার জন্যে হাজির হতে পারেন নি। ডাক্তারে নির্দেশ উপেক্ষা করে ডেকে পাঠান হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে । দু’জনার দীর্ঘ আলাপ হলো জ্যোতিপ্রসাদের বাড়িতে । জ্যোতিপ্রসাদ যেন বহুদিন ধরে  সন্ধান করে ফেরা বন্ধুকে কাছে পেলেন। তেজপুরে তাঁরা সাদ্রিভাষাতেও চা বাগানের শ্রমিকদের সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে একখানা নাটক করেছিলেন, ‘বদলা লেনা’। জ্যোতিপ্রসাদের সঙ্গে সেই শুরু হওয়া বন্ধুত্বকে আমৃত্যু সম্মান জানিয়েছিলেন হেমাঙ্গ। নিজের দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘ কুল খুড়ার চোতাল’ তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁকে।
        তাঁর এই ভ্রমণের সফলতার উপর ভিত্তি করেই ১৯৪৭এ শিলচরে বসে ভারতীয় গণ নাট্য সংঘের প্রথম প্রাদেশিক সম্মেলন। জ্যোতিপ্রসাদ শারীরিক অসুস্থতার জন্যে সেই সম্মেলন উপস্থিত থাকতে পারেন নি , কিন্তু শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতেই তাঁকে সভাপতি করে সঙ্ঘের প্রাদেশিক সমিতি গঠন করা হয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস হলেন সম্পাদক আর ডিব্রুগড়ের নগেন কাকতি সহ –সম্পাদক। এই সম্মেলন অবিভক্ত অসমের সমস্ত জাতি-জনজাতির সাংস্কৃতিক সমানাধিকারের আর সমমর্যাদার আকাঙ্খাকে সামনে তুলে ধরে। বড় জাতিগুলোর আধিপত্যকামী এবং জনজাতিদের বিচ্ছিন্নতার মানসিকতা –দুইএরই বিরোধীতা করা হয় এই সম্মেলনে। শিলচর সম্মেলনেই বডো শিল্পীদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নীলেশ্বর ব্রহ্ম, রবীন বসুমাতারি। যোরহাট থেকে যাওয়া মিশিং শিল্পীদলের নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষ্মীনাথ দলে। মণিপুরি দলের নেতৃত্বে ছিলেন কামিনী সিংহ প্রমুখ। জ্যোতিপ্রসাদ এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সমগ্র অসমে গণনাট্য শক্তিশালী সংগঠন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সে এতোটাই যে শাসক শ্রেণি আতঙ্কিত হয়ে ১৯৪৯এর জুলাই মাসে ডিব্রুগড়ের নালিয়াপুলে যে দ্বিতীয় প্রাদেশিক সম্মেলন হয়েছিল তার শেষ দিনের শান্তি সমাবেশে এসে পুলিশ বিনা প্ররোচনাতে গুলি চালায়। সে পুলিশ কিন্তু স্বাধীন দেশের স্বাধীন পুলিশ! সাংস্কৃতিক সম্মেলনে ভয়ার্ত প্রশাসন। গুলিতে বীনা বরা এবং ষোড়শী নাগ নামে দুজন মহিলা সাংস্কৃতিক কর্মী শহীদ হন। স্বাভাবিক ভাবেই জ্যোতিপ্রসাদ এই প্রতিবাদে সংবাদপত্রে যে বিবৃতি দিলেন কোনো কাগজ সেটি ছাপবার সৌজন্যও দেখায় নি।পরে তিনি ‘নালিয়াপুলের বিপদ সংকেত’ নাম দিয়ে প্রচার পত্র হিসেবে বিলি করেন। অসমের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই প্রচার পত্রের শক্তি এতোটাই যে জ্যোতিপ্রসাদের রচনাবলীর প্রথম সংস্করণেও প্রকাশক/সম্পাদকেরা এটিকে ঠাই দিতে সাহস করেন নি। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নজরে পড়তে তিনি এর বিরোধিতা করেন। পরে আরো অনেকে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। চাপে পড়ে দ্বিতীয় সংস্করণে একে ঠাই দেয়া হয়।
                  ইতিমধ্যে বিষ্ণু রাভাও এসে গণনাট্যে এসে যোগ দিলেন। ১৯৪৮এ খোয়াঙে অনুষ্ঠিত জনজাতি ছাত্র সম্মেলনে হাজির হয়ে গণনাট্য  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে  জ্যোতিপ্রসাদের পরামর্শে। বিষ্ণু রাভা ছিলেন সেই সম্মেলনের সাংস্কৃতিক শাখার সম্পাদক। ১৯৫৫তে গুয়াহাটির জাজেস ময়দানে অসম গননাট্য সঙ্ঘের তৃতীয় অধিবেশনের আয়োজনে বিষ্ণু রাভা, ভূপেন হাজারিকা মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন।  ঔপন্যাসিক হাওয়ার্ড ফাস্ট, এরেন বুর্গ, টিখনভের মতো ব্যক্তিত্বরা সেই সম্মেলনে শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছিলেন। বলরাজ সাহানী, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুমিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখ এসছিলেন সর্বভারতীয় সংগঠনের পর্যবেক্ষক হয়ে। মেঘালয়, মণিপুর, কাছাড়, গোয়াল পাড়ার মতো প্রত্যন্ত জেলাগুলো থেকে এসছিলেন প্রতিনিধিরা।  মঘাই ওঝা সেই সম্মেলনের ঢোল বাজিয়ে প্রথম বারের জন্যে গোট সবাইকে মুগ্ধ করেন। এর পরে তিনি বহুবার ভারতের বহু জায়গাতে গিয়ে ঢোলবাদনের জন্যে ডাক পেয়েছিলেন, গিয়েও ছিলেন। গোটা দেশ মোহিত হয়েছিল অসমের ঢোলের তানে।

               গণনাট্যরে স্বর্ণযুগে ১৯৫৫র গুয়াহাটি সম্মেলনই ছিল শেষ। ১৯৫১তে জ্যোতিপ্রসাদের অকাল প্রয়াণ হলো, হেমাঙ্গও সুস্থ রইলেন না তেমন ১৯৫৫র সম্মেলনের পর। তাছাড়া  পার্টির ভেতরে বাইরেও নানা রাজনৈতিক বিতর্কে তখন  পুরোনো বন্ধুরা অনেকেই আলাদা হতে শুরু করেন গোটা দেশেই। সে প্রসঙ্গে বিস্তৃত আমরা এখানে যাব না। কিন্তু তাই বলে গণনাট্যরে প্রয়াস ব্যর্থ হবার ছিল না, হয় নি। সে এক দিশা নির্দেশের কাজ করেছিল। সেই দিশাতে পরেও অজস্র শিল্পী মাঝে মধ্যেই গণনাট্যের পতাকা তলায় বা তার বাইরে নিজেদের মতো সংগঠন করে কাজ করে গেছেন এবং যাচ্ছেন । বাংলা অসমিয়া বডো নানান ভাষা সম্প্রদায়ের মধ্যে।
              হেমাঙ্গ বিশ্বাসের শরীরের সেই পুরোনো অসুখ মাঝে মধ্যেই চাগিয়ে উঠত। চিকিৎসার জন্যে তাঁকে চিনে পাঠানো হলো ১৯৫৮তে। চিনে গিয়েও অবসরে কাল কাটাবার মানুষতো আর তিনি নন, বিপ্লবোত্তর চিনকে দেখে নেবার বুঝে নেবার সুযোগ ছাড়বেন কেন? সেই অভিজ্ঞতাগুলো লিখে পাঠালেন ‘নতুন অসমীয়া’ কাগজে অসমিয়াতে। সম্পাদক তিলক হাজারিকা সেগুলো ধারাবাহিক ভাবে ছেপে গেলেন। পরে সেগুলোই সংকলিত করে প্রকাশ পায় ‘চীন চাই আহিলোঁ।’ পরে এর বাংলা সংস্করণও প্রকাশিত হয়। অসমিয়া এবং বাংলা সাহিত্যে এই ভ্রমণ কাহিনির সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অপরিসীম!  বিপ্লবোত্তর চিন সম্পর্কে এটি কেবল অসমিয়াতে নয়, যেকোনো ভারতীয় ভাষাতে প্রথম বই।

              চিন থেকে ফিরে আসার ক’দিন পরেই ১৯৬০ এর ভাষা আন্দোলন এবং পাশাপাশি ভাষা সংঘর্ষ শুরু হয়। সেই সময় তিনি ভূপেন হাজারিকাকে সঙ্গে নিয়ে নানা ভাষা সম্প্রদায় থেকে শিল্পী নিয়ে শিলং থেকে যাত্রা শুরু করেন। সেই সুরমা ভ্যালী কালচারাল স্কোয়াডের দিনগুলোতে যেন ফিরে গেলেন। কৌশলগত অবস্থান থেকে সেবারে গণনাট্যের নাম ব্যবহৃত হলো না। ‘Let us meet cultural troupe’ ছিল নতুন স্কোয়াডের নাম।  কিন্তু ইতিমধ্যে ব্রহ্মপুত্রের জল অনেক দূর বয়ে গেছে , বিদেশি সাম্রায্যবাদীদের জায়গাতে ভাতৃঘাতি রক্তপাতে উষ্ণ এবং লাল হচ্ছে জল এবং উপত্যকা। সুতরাং এবারের অভিযান ছিল অনেক বেশি সাহসী এবং ঝুঁকি পূর্ণ। কিন্তু বিখ্যাত ‘হারাধন –রংমনে’র গীতি আলেখ্য সহ আরো প্রচুর গান, কবিতা, নাটক নিয়ে দু’ই তাঁরা যেন সংগ্রামী ঐক্যের যুদ্ধ জয় করলেন। বাংলা অসমিয়াতে  ভূপেন হাজারিকার সাগর সঙ্গমে গানটিও ছিল সেই অভিযানের অন্যতম জনপ্রিয় গান।  যে দিকে গেলেন, গানের সুরেই দাঙ্গাবাজদের প্রতিহত করতে করতেই এগুলেন তাঁরা।
হেমাঙ্গ জীবনীঃ   গঙ্গা তাঁর ভক্তি
            হেমাঙ্গ চিনে যাবার আগে থেকেই স্তালিনের মৃত্যুর পর থেকে চিন-সোভিয়েত লাইনের বিতর্কে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলন দু’ভাগে বিভাজিত হতে শুরু করে। ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদের পথে ফিরে যাবার অভিযোগ উঠছিল। এমন কি চেকোশ্লাভাকিয়া আক্রমণের মধ্যি দিয়ে সোভিয়েতের সাম্রায্যবাদী চরিত্র স্পষ্ট হয়ে বেরুচ্ছিল বলে সাম্যবাদীদের থেকেই অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিল। ভারতেও তার অভিঘাত এসে পড়তে শুরু করেছিল, যদিও স্পষ্ট হতে সময় নিয়েছিল। আমরা জানি চিন –সোভিয়েত লাইনের বিতর্কে কমিউনিষ্ট পার্টি প্রথমে ১৯৬৪তে এবং পরে ১৯৬৭তে ত্রিধা বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯৬৮তে গড়ে উঠা সিপিএম আসলে মধ্যপন্থা একটা নিয়েছিল, তাই তাকেও ভাঙ্গনের মুখে পড়তে হয় ১৯৬৭তে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে দুটো বিদেশী দেশের তর্কে ভারতের দলগুলোর এতো উৎসাহ কেন? আর তাতে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো অসমের এই ব্যক্তিটির কী সম্পর্ক? সংক্ষেপে বলতে পারি, পুঁজিবাদ একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা । পুঁজির স্বার্থে শ্রমকে শোষনের ব্যবস্থা। সুতরাং তার বিরুদ্ধে লড়াইটাও শ্রমিকদের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। সোভিয়েতের সমর্থণে দাঁড়াবার মানে ছিল পুঁজিবাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান , আর চিনের সমর্থণে দাঁড়াবার মানে ছিল বিপ্লবের পতাকাকে তুলে ধরা। তাছাড়া চিন ভারতের মতোই ছিল এক সামন্তীয় কৃষি নির্ভর দেশ। সে দেশে বিপ্লব হয়ে গেছে ক’বছর আগে, এটি ভারতের মতো যেকোনো আধা সামন্তবাদী দেশের কাছে আলাদা এক প্রেরণা এবং শিক্ষার স্থল। পুঁজিবাদের শিক্ষা যদি বিলেতি মার্কিনিদের থেকে নেয়া যেতে পারে তবে তার বিরুদ্ধে লড়াইর দীক্ষা সোভিয়েত-চিনের মতো বিদেশের থেকে নেয়াটা দোষের হয় কেবল কুযুক্তির জোরে।
            সে যাই হোক, হেমাঙ্গের জীবিকার একটা দরকার ছিল। ১৯৫৯তে তিনি পার্টি কর্মী রুনু দত্তকে বিয়ে করেন। পরের বছর তাঁর পুত্র মৈনাকের জন্ম। ১৯৬১তে তিনি কলকাতার রুশ দূতাবাসের বার্তা বিভাগে অসম শাখার দায়িত্বের   চাকরি পেয়ে চলে যান। তাই বলে, ১৯৬৪তে তিনি সিপি আই-র সোভিয়েত লাইনে রইলেন না। এমন কি ১৯৬৭তে সিপিএমের সুবিধেবাদেও না, সিপিএম যখন গণ আন্দোলনের পথ ছেড়ে পশ্চিম বাংলাতে  রাইটার্স দখলের পথ করছে হেমাঙ্গের তখন সগর্ব উচ্চারণ, “মাথা নিচু করে রাইটার্সে যাব না!” তিনি একাই রইলেন।  নকশাল বাড়ির বিদ্রোহকেও তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন। ফলে  সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ যখন তাঁকে চিন সমর্থণ ত্যাগ করবার চাপ দিল, তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে  ‘ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিস স্মৃতিরক্ষা সমিতি’র হয়ে দ্বিতীয়বারের জন্যে চিনে যান। ডাঃ কোটনিস হচ্ছেন সেই মহান ভারতীয় যাকে জাপান চিন আক্রমণ করলে চিনা কম্যুনিষ্ট পার্টির অনুরোধে চিনা বিপ্লবীদের চিকিৎসার জন্যে পাঠান ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯৩৮এ তিনি সদলবলে সেখানে যান, এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে মহান চিনা লং মার্চে যোগ দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ৩২ বছর বয়সে দারুণ অসুখে পড়ে ১৯৪২এর ৯ ডিসেম্বরে তিনি চিনেই মারা যান। নানকান গ্রামে বিপ্লবী শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। শুনা গেছে যে বিপ্লবীদের সেবাতে এই মহান ডাক্তার কখনোবা টানা বাহাত্তর ঘন্টা কাজ করে গেছেন। সেই পরিশ্রমই পরে তাঁর প্রাণ নেয়। সেই মহান বিপ্লবী ডাক্তারকে চিন কোনদিন ভুলেনি। সেই স্মরণীয় ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানাতেই আরো অনেকের সঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের এই দ্বিতীয়বার চিন যাত্রা। এবারেও তাঁর ভ্রমণ কাহিনি লিখে বের করেন, ‘আকৌ চিন চাই আহিলো’। বইটি ১৯৭৭এ ছেপে বেরোয়। এবারের বইতে ষাটের              দশকের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়কার মতাদর্শগত বিতর্কের  আভাস তুলে ধরবার প্রয়াস নেন। এই নিয়েও ভারতীয় কোনো ভাষাতে এটিই প্রথম বই। অসমিয়াতেও , বাংলাতেও।  ১৯৮০তেও তৃতীয়বারের জন্যে তিনি চিন গেছিলেন। সেবারে চিন সরকারের আমন্ত্রণে।
হেমাঙ্গ জীবনীঃ   পদ্মা তাঁর  শ্রদ্ধা
               ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর ‘মাস সিঙ্গার্সে’র সঙ্গী রত্না সরকার, প্রীতি চৌধুরী, মিঠুন মুখার্জি, টুঙ্কু সরকার ও দীপক পাত্রকে সঙ্গে  নিয়ে তিনি গেছিলেন বাংলাদেশে । পুরোনো সংগ্রামী সাথি নজরুল ইসলাম খানের গোপীবাগের বাড়িতে উঠেছিলেন। তাঁর সে ভ্রমণের উদ্যোক্তাদের মধ্যে সেদেশের প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী তাত্বিক  বদরুদ্দীন উমরও ছিলেন । ছিলেন ফকির আলমগীরের মতো শিল্পীরাও। সেবারে ঢাকাতে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে গান গেয়ে গেয়ে যোগ দিয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে   ঢাকার ২৭টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের জোট  'গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট' হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে সংবর্ধনা দিয়েছিল । দেশ ছেড়ে আসার পর এই প্রথম এবং শেষবারের জন্যে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন তার পৈতৃক ভিটে হবিগঞ্জের মিরাশি গ্রাম।  জয়দেবপুরে  গিয়েছিলেন কবি গোবিন্দ দাস ও কবিয়ালগুরু হরি আচার্যের ভিটে দেখতে। তিনি সেদিন গোবিন্দ দাসের একটি গান সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন ফকির আলমগীরকে ,”স্বদেশ স্বদেশ করছ যারে, এদেশ তোমার নয়।”  সত্যিতো যে দেশকে বাল্যে নিজের বলে জেনেছিলেন, সেই দেশই তাঁর রইল না! তাঁর একখানা গান রয়েছে,” হবিগঞ্জের জালালি কইতর, সুনাম গঞ্জের কুড়া, সুরমানদীর গাংচিল আমি শূণ্যে দিলাম উড়া/শূণ্যে দিলাম উড়ারে ভাই যাইতে চান্দের চর/ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাতার উপর/তোমরা আমায় চিননি/তোমরা আমায় চিননি।” তাঁকে চেনাতো সত্যি আমাদের এখনো অনেক বাকি। কলকাতা প্রবাস তাঁকে যে সুখি করতে পারেনি এওতো এই গানে বোঝাই যায়। কলকাতা সত্যি তাঁকে আজও তেমন চেনেও নি, জীবনের শেষ দিকে বোধহয় দুটো মাত্র কেসেট বেরিয়েছিল এই মহান শিল্পীর। নিজে তিনি কখনোই সেরকম প্রকাশক খোঁজে ফেরেনও নি। হবিগঞ্জের মিরাশি গ্রাম, সুরমা নদী নিশ্চয় তাঁর স্মৃতিকে ভারাতুর করে তুলত।  কিন্তু ভুলে থাকতে পারতেন না ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে তাঁর জীবনের সবচে’ উজ্জ্বল দিনগুলোকেও । সেতো তাঁর কলকাতার বাড়ির নামেই প্রকাশ-- ‘জিরণি’। আর একমাত্র কন্যার নাম রেখেছিলেন –‘রঙিলী’।
                অসমের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আমৃত্যু কখনোই বিচ্ছিন্ন হয় নি। প্রায়ই তিনি এসছেন এটা ওটা অনুষ্ঠানের বা ব্যক্তিগত উপলক্ষে। শেষ দিকে তিনি দলের বাইরে গিয়ে ‘মাস সিঙ্গার্স’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। সেই সংগঠন নিয়ে দেশে বিদেশে গেছেন, এসছেন অসমেও বহুবার।  মঘাই ওঝার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল নিতান্তই ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক। আজীবন তাঁর এবং তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে বিপদে সম্পদে।  মঘাই ওঝার মৃত্যুর পরেও নিজের বহু অর্থ কষ্ট সত্বেও নিয়মিত অর্থ সাহায্য পাঠাতেন। ‘অসম আৰু বঙ্গৰ লোক সঙ্গীত সমীক্ষা’ বইটি তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন। লিখেছিলেন, মঘাই তাঁর শিল্পী জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।  আশির অসম আন্দোলনের দিনগুলোতেও তিনি ছুটে এসছিলেন ষাটের দিনগুলোর মতো সাংস্কৃতিক বাহিনী নিয়ে বেরুবেন বলে। কিন্তু ভূপেন হাজারিকা সেবারে সঙ্গ দিলেন না। গুয়াহাটিতে এক ট্যুরিষ্ট লজে এসে উঠেছিলেন। সেখানে যে গুটিকয় গুনমুগ্ধ এবং পুরোনো বন্ধু দেখা করতে গেছিলেন তাদের তিনি বলেছিলেন, “ যি দেখিছো অসমত যেন এখনো নিরপেক্ষ ঘৰ নাই।...ইয়ালৈ আহি দেখিছো অস্তিত্বৰ চেতনা বৰ দলৈ সোমাইছে। পৰিস্থিতি কেতিয়াও এনে হোৱা নাই। ই ভাষিক সমস্যা নহয়...মিলনৰ প্রক্রিয়া কিন্তু থানবান হৈ গৈছে। সাংস্কৃতিক ভেটি কঁপি উঠিছে, সংহতির মূলতে ভাবুকিয়ে দেখা দিছে।” ( তিলক হাজারিকা সম্পাদিত ‘বিপ্লবী গণ শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস’ বই থেকে ফটিক বরার পূর্বোক্ত গ্রন্থে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি)
               ১৯৮২তে ‘দিশারি’ সাংস্কৃতিক সংস্থার আমন্ত্রণে তিনি গেছিলেন শিলচরে। দিশারি তখন ‘মৈত্রী উৎসব’ নামে তিনদিনের এক বার্ষিক অনুষ্ঠান নিয়মিত করত। এই ‘দিশারি’র প্রতিষ্ঠাতা অনন্ত দেবও ছিলেন আসলে পুরোনো গণনাট্য আন্দোলনের কর্মী। সেই অনুষ্ঠানে হেমাঙ্গ ছাড়াও আমন্ত্রিত হয়ে গুয়াহাটি থেকে গেছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী দিলীপ শর্মা, গোয়াল পাড়া থেকে লোক সঙ্গীত শিল্পী প্রতিমা পাণ্ডে বরুয়া। আলোচনা চক্রে যোগ দিতে গেছিলেন অমলেন্দু গুহ। বহুদিন পরে পুরোনো বন্ধুরা সমবেত হয়েছিলেন আবারো। স্বাভাবিক ভাবেই এক আলাদা আবেশময় পরিবেশ তৈরি হয়েছিল গোটা শহরের সাংস্কৃতিক মহলে। সেকালের ‘দিশারি’র কর্মী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দীমজুমদার ঠিকই লিখেছেন,  এর পরে যেন আবারো নতুন করে তাঁর ‘মাস সিঙ্গার্সে’র আদলে গণ সঙ্গীতের দল করবার ধুম উঠে গেল শহরে।   বর্তমান লেখকেও তখন জড়িয়েছিলেন ‘শান্তসেনা’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে। যাদের গণসঙ্গীতের নিজস্ব দল ছিল। সেই সংগঠনের বার্ষিক অনুষ্ঠানে একক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান ‘জন হেনরি’র তালে তালে একক নৃত্য অনুশীলন এবং পরিবেশনের দুর্বল হলেও একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে ১৯৮৩র কথা। 
              ‘মাটি আৰু মানুহ’ নামে অসমের অন্য এক সাংস্কৃতিক  কিংবদন্তি লোকনাথ গোস্বামীর নেয়া হেমাঙ্গের এক সাক্ষাৎকার রয়েছে। লোকনাথ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন ১৯৮৬র নভেম্বরে । তখনো তিনি জানিয়েছিলেন শীত পেরুলেই তিনি অসমে আসবেন আবার। কিন্তু শরীরের  অসুস্থতা ক্রমে বেড়েই গেল। ঠিক পরের বছর ১৯৮৭র ২২ নভেম্বর হেমাঙ্গ থেমে গেলেন।  কিন্তু অসমের বাঙালি কিম্বা অসমিয়া হয়ে উঠার অর্থ যে অন্তর থেকে অর্জিত প্রতিবেশি চেতনা এই যে দীক্ষা এবং শিক্ষা তিনি তাঁর গোটা জীবন দিয়ে  গেছেন তা এতো সহজে হারিয়ে যাবার নয়।
             সিলেট থেকে  যাত্রা শুরু করে জীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায় অসমে যাপন করলেও বাংলা এবং অসমীয়াতে ‘গণ সঙ্গীতে’র ধারাটি প্রতিষ্ঠা পায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের দৃঢ় সাংগঠনিক এবং তাত্বিক অবস্থানের জন্যেই। গণসঙ্গীতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “স্বাদেশিকতার ধারা যেখানে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার মহাসাগরে গিয়ে মিলেছে, সেই মোহনায় গণসঙ্গীতের জন্ম।” শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যেমন ‘ঘরানা’, তার বিপরীতে লোক সঙ্গীতের ‘বাহিরানা’ নিয়েও তাঁর চিন্তা পরের চিন্তকদের ভাবনার দিশা দিয়েছে। সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াডের এবং গণনাট্যের শুরুর দিনগুলোতে তৈরি হয় তাঁর বিখ্যাত  গান ‘তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান’। তখন এবং পরের জীবনে তাঁর লেখা এবং গাওয়া   বিখ্যাত গানগুলো হলোঃশঙ্খচিলের গান,   জন হেনরীর গান,   মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য,   বাঁচব বাঁচব রে আমরা,   মশাল জ্বালো,    সেলাম চাচা,    আমি যে দেখেছি সেই দেশ,‘হবিগঞ্জের জালালী কইতর সুনামগঞ্জের কুড়া’, ‘ও সোনা বন্ধুরে’, ‘আমার মন কান্দে পদ্মার চরের লাইগ্যা’ । ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘লালন ফকির’ ইত্যাদি ছায়াছবিতে, যাত্রাপালা ‘লেনিন’এ এবং  কল্লোল, তীর, লাললণ্ঠন ইত্যাদি নাটকে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন । ‘লাললন্ঠন’ নাটকে তিনি বিভিন্ন চিনা সুর ব্যবহার   করেছিলেন । তিনবার চিনে গিয়ে চিনা ভাষাটাও তিনি অনেক রপ্ত করেছিলেন। ফলে বেশ কিছু চিনা গান কবিতা বাংলাতে অনুবাদও করেছিলেন। এছাড়াও দেশ বিদেশের প্রচুর বিখ্যাত গানকে তিনি ওমন ভাবে বাংলাতে অনুবাদ করে জনপ্রিয় করেছিলেন যে সাধারণ শ্রোতাদের অনেকেই এগুলোকে  হেমাঙ্গের বিশুদ্ধ বাংলা বলেই জানেন এখনো। যেমন পিট সিগার কলকাতার ময়দানে এসে গেয়েছিলেন ‘উই শ্যাল অভার কাম।’ হেমাঙ্গকে তিনিই ডেকে তুললেন মঞ্চে । তিনি গাইলেন ‘আমরা করব জয়।’ এটি এর পর  নানা ভাষাতে অনুদিত হয়ে এতো জনপ্রিয় হয় যে গোটা ভারত জয় করে বসেছিল বটে, যদিও ‘মা তুমি শিগগির এসো’ কবিতার ‘ইবনদি’ এখনো ফিরে আসে নি।
             ‘সীমান্ত প্রহরী’ কবিতার বইএর এক দুর্দান্ত দীর্ঘ কবিতা এটি। শেষ হয়েছে, “ইবনদির সাথে/এই আমার শেষ সাক্ষাৎ।/মাঝরাতে হ্যাপিভ্যালির চূড়ায়/ভয়ে ভয়ে চাঁদ উঠেছিল/কুয়াশার ঘোমটা পরে।/সারারাত জেগেছিলাম আমি।/আর জেগেছিল/সুদূর খাসিয়া পুঞ্জিতে/ফুলকুমারী কাসান্থিউ।/থেকে থেকে কেঁদে উঠেছিল—/ইম্মেই ওয়ান ক্লোয়/মা, তুমি শিগগির ফিরে এসো।” অসমের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি তপন মহন্ত লিখেছেন, “ ‘ইবনদি’ ... কি সাম্রাজ্যবাদীর নিগড়ে পিষ্ট ভারত বর্ষের প্রতীক নয়?...কবিতাটিও  এলিজি কবিতা হিসেবে বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। কবিতাটি শুধু বাংলায় লেখা বলেই কি প্রচারের অভাবে তলিয়ে গেল বিস্মৃতির অন্তরালে?”আমরা কথাটার একটাই মানে করতে পারি, কবিতাটি হারাবে না, হারাবেন না কবিও, শুধু দিন কাল এখনো পাল্টায় নি বিশেষ ফুরোয় নি সেই ফুলকুমারী কাসান্থিউর মায়ের পথ চেয়ে থাকা। কোথাও কি ভুল হয়েছিল? পার্টির ভুল  নাহয় হয়েইছিল,  কিন্তু হেমাঙ্গ নিজেই বা কেন ফিরে এলেন না! কেনই বা কলকাতাতে তাঁকে ‘জিরণি’ নিতে হয়েছিল? চল্লিশের দশকে সুরমাভ্যালী স্কোয়াডের যিনি মহানায়ক, ষাটের দশকে “‘Let us meet cultural troupe’ এর যিনি দুর্নিবার সংগ্রামী , আশির দশকে তিনি ‘মাস সিঙ্গার্সে’র অতিথি গায়ক কেন? ‘ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়া নয়া বাংলা গড়বার’ কিম্বা “ সমতলে লুইতের বুকে/ উদ্দাম ঝরনা হয়ে নেমে আসুক; ঝুমুর মাদল আর বিহু পেঁপায়/ পারে পারে ঐকতান তুলুকঃ /জীবনের/ সৃজনের/ স্বপ্নের/ শান্তির।” ( সীমান্তপ্রহরী) এই পংক্তিগুলোতো তাঁর নিজের ছিল, শুধু পার্টির নয়।  সেখানে, “...মিলনৰ প্রক্রিয়া কিন্তু থানবান হৈ গৈছে। সাংস্কৃতিক ভেটি কঁপি উঠিছে, সংহতির মূলতে ভাবুকিয়ে দেখা দিছে।” বলে আত্মতুষ্টি লাভের সুযোগ রয়েছে কি? যে ডানা ভেঙ্গে তিনি কলকাতার উপর গিয়ে পড়েছিলেন সেতো আমাদের সব্বার  এক স্বপ্নেরও ডানা। আর কোথাও কি কোনো ভুলচুক ছিলনা, সত্যি? বাবা ‘হরকুমার বিশ্বাস’এর  যে শ্রেণি বিশ্বাস এবং প্রতাপ তাঁকে হবিগঞ্জের বাড়ি থেকে তাড়িয়েছিল সেই ক্ষমতাই তো  তাঁকে এবং আমাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল! তার কোনো সুরাহা  করতে হবে না? প্রশ্নটা আমাদের নিজেদের  করতে হবে। হেমাঙ্গকে জেনে তাঁকে ছেড়ে এগিয়ে যেতে হবে। কেননা, আমাদের  ‘জিরণি’ এখানেই এই মাটিতেই যে গড়তে হবে, সে কথা ভুললে চলবে কেন?
তথ্যসূত্রঃ
 ১) হেমাঙ্গ বিশ্বাসঃ সাংস্কৃতিক চেতনার অমল সুবাস; ফটিক বরা; সুভাষ সুরভি প্রকাশন;ডিব্রুগড়-০৩; ২০০২।  
 ২) উজান গাঙের নাইয়াঃ হেমাঙ্গ বিশ্বাস; তপন মহন্ত; নাইন্থ কলাম’—অসমের কৃতী বাঙালি সংখ্যা; গুয়াহাটি; মে , ২০১১)
 ৩) সুরমা থেকে ভোলগা; শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার।
 ৪) বাংলা গণসঙ্গীত আন্দোলন ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস;  মাহফুজুর রহমান;সমকাল।
 ৫) সুরমা নদীর গাংচিল;ফকির আলমগীর;সমকাল।

৬) হেমাঙ্গ বিশ্বাসৰ গান আৰু কবিতা; অমিয় ভূষণ চক্রবর্তী; ‘অনীক’ ফেব্রুয়ারী মার্চ, ১৯৮৮ হেমাঙ্গ বিশ্বাস স্মরণ সংখ্যাতে প্রকাশিত ‘অগ্নিখেলার সাথী’ প্রবন্ধের হরেন্দ্র নাথ বরঠাকুরের করা অসমিয়া অনুবাদ; নতুন পদাতিক ; গুয়াহাটি ১ আগষ্ট, ২০০৩।