“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

মা তুমি শিগগির এসো


                                                 হেমাঙ্গ বিশ্বাস
My Only Wish
imikimi - sharing creativity





পাইনবনে শীত-ভালুকের
গা –কাঁপুনি গোঁ গোঁ থেমে গেছে;
চিকন পাতার তারে বেজে উঠেছে স্প্যানিশ গিটার।

বৈরাগ্যের বরফে ঢাকা
নগরীর কুমারী বুকে
পুষ্পধনু শর হেনেছে; পত্রহীন শীর্ণ নাসপাতির ডালে ডালে
অফুরন্ত ফুলের সমারোহ।

এপ্রিল সকালে সোনালি রোদের ঢল নেমেছে।

পাশের বাড়ির দিন-মজুরনি
খাসিয়া মেয়েটি
মাথায় বাঁধা, পিঠে ঝোলানো থাপা নিয়ে
দিনের কাজে বেরিয়ে গেল
ছোট্ট শিশুটিকে চুমু খেয়ে।


পিছনে হতে
ঠাকুমার কোলে রেখে যাওয়া শিশুটি
পাহাড়ের কোলে বাতাসে-দোলা ফার্ন পাতার মতো
কচি হাতটা নেড়ে নেড়ে
আধ-ফোটা ভাষায় কাঁদো কাঁদো সুরে ডাকতে লাগলঃ
তা তা, তা তা—ইম্মেই ওয়ান ক্লোয়—
--মা তুমি শিগগির এসো।
আপেল টুকতুক গাল বেয়ে তার
আবেগের মুক্তাকণা ঝরে পড়ল।

মা তুমি শিগগির ফিরে এসোঃ
এ আকুতি ছড়িয়ে আছে
এই পাহাড়ে অনেক ঝরনার বুকে,
নিঃশব্দ পাথরে আর
ফুল-ঝরা হাইড্রেঞ্জিয়ার ডালে।
আকুতি এপ্রিল সকালে
মগ্নচেতনার রুদ্ধ-খাতার পাতাগুলি
একে একে মেলে দিয়ে গেল।

এইতো সেদিন—
তবু কত যেন যুগ।
হ্যাপিভ্যালির চূড়ায়
মিলিটারি ব্যারাকগুলি মাথা তুলেছে সবে।
বিধ্বস্ত রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর যায় যায়—
সীমান্ত অঞ্চল।
রাজধানীর উপকন্ঠে-উমখ্রা নদীর বাঁকে
পাহাড়ের ঢালু গায়ে ঝোলা
আমার নির্জন কুটির।
রোগশয্যায় আমি।
দুপুরের পাতলা ঘুমের পর্দা কাঁপিয়ে
বেজে উঠল একটি করুণ সুর
এ বাবু কাডিঊএং—
খাসিয়া মেয়ের ডাক।
বিক্রির বিজ্ঞাপন নয়
যেন বন-ভোমরার গুঞ্জরণ।

মধ্যম বয়সি,
আভরণহীন,
পিঠে লাকড়ির বোঝা,
বলিষ্ঠ বাঁকা ভঙ্গিমা,
সৌন্দর্যের সলজ্জ আভা, ঝলসে উঠেছে
ঘাম-ঝরা দুটি লাল গালে।
আবার সে ডাক দিল—সুরটা চড়িয়ে
হে বাবু, কাডিয়েং।

শৈলাবাসের অভিভাবক
পরিচর্যাকারী রণবাহাদুর
হেঁকে বললঃ
জরুরৎ নেহি
খড়ি কাফি হ্যায়
তবু আমি তাকে ডেকে
সব কাঠ গুনে গুনে রেখে দেই।
রণবাহাদুর, মঙ্গোলীয় মিটমিট চোখে মুচকি হাসে—
নীরস জ্বালানি কাঠের গূঢ় সরসতায়।

গালে একটা কোয়াই পান পুরে
পয়সা ক’টা গুনে গুনে
মিষ্টি হেসে মেয়েটি বিদায় নিলঃ
লেই ন, বাবু।
বাবু, তবে যাই।
এমনই কত দিন
নিজঝুম তন্দ্রালু দুপুরে
মিহি ঘুমের দেশে
দূর পাহাড়ের একটি বন-ভোমরা
গুনগুনিয়ে আসত।
নাম তার ইবন নংরুম
আমি তারে ডাকি ইকং ইবন
ইবনদি বলে।
প্রয়োজনের বেচা-কেনার হাটে
অপ্রোয়োজনের ঘনিষ্টতা জমে ওঠে
চড়াই-উৎরাই-ভাঙ্গা ক্লান্ত পসারিনির
ছায়া –বৃক্ষ যেন।
ইবনদি হাসে, গল্প করে;
ভাষার দুর্বোধ্যতা
ভাবে সহজ হয়।
অনেক অনুরোধে
একদিন ইবনদি গান শোনায়ঃ
শিকারির শর –সন্ধানে নিহত হরিণ শিশুর জন্য
এক হরিণ –মাতার বিলাপ—
কোখুন জঙ্গা সিয়ের লাপালাং...
কোখুন বাব্রিউ, কোখুন লামফ্রাং...
--ও আমার জাদুধন
আমার হৃদয়ের রক্ত দিয়ে
যে হৃদয়ের রক্ত দিয়ে
যে হৃদয়ে স্পন্দন তুলেছিলাম
 কোন সে শিকারির
নিষ্ঠুর বিষ-তির
তোর সেই কোমল হৃদয়ের রক্ত
শুষে শুষে খাচ্ছে;
ও আমার দুলাল...।

দূরে একটা পাহাড়ি ঝিঁঝিঁ
একটানা ডেকে যাচ্ছিল
উমখ্রা নদীর ঝির ঝির
নুড়ির তালে তালে রেখে।
ইবনদির চোখ ছলছল করে উঠল।

ঘরে তার ছোট্ট মেয়ে
নাম তার কাসান্থিউ—
-ফুলকুমারী,
আসবার সময় তাকে কিছুতেই ছাড়ে না
চোখের জলে মাকে বিদায় জানায়ঃ
ইম্মেই ওয়ান ক্লোয়
--মা তুমি শিগগির ফিরে এসো।
কিছু মিষ্টি, আর
ফুলদানি থেকে জিরেনিয়াম ফুলের তোড়াটা তুলে
তার হাত দিয়ে বলেছিলাম
ইবনদি, তোমার ফুলকুমারীর জন্যে।

হঠাৎ, তোমার ফুলকুমারীর জন্যে।

হঠাৎ একদিন সাইরেন বেজে উঠল।
মণিপুরে বোমা পড়েছে।
ব্ল্যাক আউটে--
গুজবের বাদুড়গুলি ডানা মেলে ওড়ে।
পালাবার পথ রুদ্ধ পলাতকের ভিড়ে।
গির্জায় গির্জায় আর্তত্রাণের ঘন্টা বাজে।
এয়ার কোবরারা
ফণা মেলে উড়ে বেড়ায়।
অবরুদ্ধ নগরী
রুদ্ধশ্বাস প্রহর গোনে।
দলে দলে নবাগত
উদ্ধত ইয়াঙ্কি –গামবুটের চাপে
পাহাড়পুরীর হৃদপিণ্ড দুমড়িয়ে যায়।
শিলং কি টেকসাস? না, পেনসিলভেনিয়া?

বহুদিন ইবনদি আসে না।
কবে একদিন এসেছিলে—
হরিণ –মাতার ভয় দুচোখে তার
মাথার বোঝাটা নামিয়ে
খবর দিয়েছিল—
তাদের পুঞ্জির পাশে
মিলিটারির ছাউনি পড়েছে।
সরল শিশুর মতো শুধিয়েছিল,
‘বাবু, যুদ্ধ কী? কেন যুদ্ধ লাগে?’
তাকে বোঝাতে পেরছি কি না
জানি না।
তারপর কতদিন
ইবনদি আসে না।
একদিন মুলকি পাহাড়ে
এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরতে
সন্ধ্যা হয়ে গেল।
পানাসক্ত কারফিউর শিলং।
আউট অব বাউণ্ডস-এর
সীমানা ডিঙিয়ে
হায়েনাদের সন্ধানী চোখ
আঁধারে ঝলসে ওঠে, ঝোপে ঝাড়ে।
নংথুমাই-এর মাঠে
লজ্জায় জোনাকিও আসে না,
শুধু কামাতুর সিগারেটগুলি
জোনাকিরই মতো জ্বলে আর নেভে।

ভয়ে ভয়ে চলি
হাতে একটা ছোট টর্চ
নংথুমাই-এর মাঠটা এড়িয়ে
লুমমাউরির একটা গলিপথ ধরি।
হঠাৎ সামনে একটা শব্দ পেয়ে
টর্চ মারতেই
এ কি!!
ইউক্যালিপটাস গাছটার তলায়
একটা প্রকাণ্ড অজগর
কুণ্ডলী পাকিয়ে জড়িয়ে ধরেছে
কোনো হরিণ-মাতাকে?
খোলাবুক জার্কিন-পরা
লোমস মার্কিনীর
বাহুবেষ্টনীতে পিষ্ট কে সে?
ইবনদি না?

ইবনদির সাথে
এই আমার শেষ সাক্ষাৎ।
মাঝরাতে হ্যাপিভ্যালির চূড়ায়
ভয়ে ভয়ে চাঁদ উঠেছিল
কুয়াশার ঘোমটা পরে।
সারারাত জেগেছিলাম আমি।
আর জেগেছিল
সুদূর খাশিয়া পুঞ্জিতে
ফুলকুমারী কাসান্থিউ।
থেকে থেকে কেঁদে উঠেছিল—
ইম্মেই ওয়ান ক্লোয়
মা, তুমি শিগগির ফিরে এসো।
soruo-white swan
imikimi - sharing creativity
                                                              ( 'সীমান্ত প্রহরী ' কবিতা গ্রন্থের থেকে)

কোন মন্তব্য নেই: