“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

তিস্তা পারের কাব্য...



একটা ঝড়ো হাওয়া আজ সকাল থেকেই আমায় আনমনা করেছিল। আজ তিস্তার আমার পাহাড়ে ঝর্ণা হয়ে ঝরে পরার কথা ছিল। সকাল হয়, দূপুর গড়ায়, বিকেল হয়, সন্ধ্যায় বাজে কাশর। রাত ঘনিয়ে আসে। আমার পৌরুষ তখন ভিজে চুপ চুপ। অসম্ভব শান্ত আমার রক্তচাপ। পাহাড় হাসে আমার এই লজ্জাবনত পেশীর সঙ্কোচন দেখে। নিজের স্খলন আমাকে অপবিত্র করে। আমাকে আহত
করে। তখন ডুব দিতে ইচ্ছে করে বরাকের জলে। ছেলেমানুষের মতো ঝর্ণা খুঁজি।  মৈথিলীর পাশ কাটিয়ে বরাকের জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে আমি লজ্জা পাই।

তিস্তা যখন এলো তখন আমি শিলং পাহাড়ে ভোরের কবিতা আওড়াচ্ছি। শরীর অবশ। তিস্তা জানে আমার শরীরী ভাষা। আলতো করে ঠোট রাখল উদোম পিঠের শিরদাঁড়ায়। একপাত্র দেশী মদ আমার সামনে মেলে ধরতেই আমার জিভ লকলক। হালকা করে তার চুল ছুয়ে গেল আমার গাল। পেটে পড়তেই সহবাসের আকণ্ঠ ইচ্ছে আমার। আজ তিস্তা নিস্পৃহ। রাগ উঠছে আমার। আমায় ঘুম থেকে তুলে চোখ বুজে আমার বুকে মাথা গুঁজে চুপ করে শুয়ে আছে। কথার খই ফুটছে আজ। আমায় পাহাড়ি মেয়ের গল্প শুনাল। বুনো ফুলের কথা শোনাল। বসন্ত পাখির দেখা নেই। ভাবলাম মন বুঝি তাই খারাপ।

আমার শরীর ভোর রাতে জেগে উঠেছে। বাঘিনীর নখ, নিথর শরীর আমাকে রোধ করবে সেই
শক্তি কোথায়! খুলে ফেললাম তিস্তার আকাশী রিয়া। দুটি চাঁদ আমার হাতের মুঠোয়।
তিস্তার ঠোট চেপে ধরেছে আমার ক্যালসিয়ামে ভরপুর ত্রিশটি দাঁত। তিস্তার বিণুনীর বোগেনভেলিয়ার
পাপড়ি আমার গালের চাপে ছিড়ে খানখান। আস্তে আস্তে তিস্তার শরীর আমার জন্য অনিচ্ছায় তৈরী।
তিস্তার পাছড়া ভিজে আছে। তার উরুতে হাত দিতেই তিস্তার প্রবল আপত্তি। কে শোনে কার কথা,
বাঘ একবার মানুষের রক্ত পেলে অন্য পশুরা বেঁচে যায় নির্ঘাত। আমার তিস্তার রক্তই চাই। কি যে
হল আজ! ঝড়ের কাছে প্রকৃতির সব বাধাই সমর্পণ সম। বরাকের জলে শুধু জলের ছলাৎ ছলাৎ
উদোম শব্দ, শীৎকারের আওয়াজে আজ ক্ষোভ।
তিস্তার, শরীর খারাপ ছিল আজ। যখন বুঝতে পারি, তখন দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি শুধু।

কামরূপে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রে স্নান শেষে মানুষ শিবলোকে গমন করে। আমার আশ্রয় নেই শিব লোকে। শেষ
মুহূর্তেই আমায় বলি হতে হয় ত্রিপুর রাজের রাঙ্গামাটিতে, গোমতীর তীরে। এই তুষের ঢিপিতে আমি আজও বন্দী।
তুষ অলক্ষ্মীর প্রিয় বস্তু। আমার পাহাড়ে ধান মাড়িয়ে অনেককাল আগেই নিয়ে গেছে লিকার দল।
আমার প্রেয়সী আকাশে কাপড় শুকোতে ব্যাস্ত।

পিঠালি পাতায় এক মোচা অন্ন নিয়ে আমার জুমে যাওয়ার সময় এবার।

মোচা ভাত এখনও গরম। এক মোচা অন্নে আর এক মোচা বাড়ে। তবু আমার পেট জুড়ায় না। সারারাত্তিরে খিদে আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে।  বরাকের জল আজ থামিয়ে দিয়েছে আমার তিস্তার ঋতুস্রাব। আজ লঙত্রাই বাবা রুষ্ট। তিস্তা কি আর জানে আমার পাহাড়ের রাগ। আজ হাতি নামবে পাহাড়ে। আবার অঘটন। উপায়ান্তর নেই। ভেওর বাজিয়ে আয়োজন করতে হবে লঙত্রাইকে শান্ত করার পথ। বলি চাই মেঘ হংসের। গজস্কন্ধ আমার আজ ভারি। তিস্তার সখের কর্ণলম্ব এখনও পড়ে আছে বরাকের চরে।
ত্রিপুর কামে বিভোর হয়ে আজ অহরহ হুঙ্কার দিচ্ছে আমার পাহাড়। আমারও জেদ, তিস্তাকে বাঁচাতে আজ
থামিয়ে দিতে হবে বরাকের জল। বাচাতেই হবে।
নিদান হল তন্ত্র মতে আজ রাতে হবে নদী পুজা। বলি চাই নির্দেশ চন্তাইয়ের। কাকে বলি দেব। তিস্তাকে গৃহবন্দী করে রেখেছে লংত্রাই বাবার সৈন্য সামন্ত। কাকে বলি দেব এই পাহাড়ের! না করে দিলাম। চাইনা তন্ত্রপুজা। লণ্ডভণ্ড করে দিলাম সব আয়োজন। সেই সক্কাল থেকে তিস্তা কিছু খায়নি। এবার তাকে খেতে দেব শামুকের নরম মাংশ। আগুন জ্বালালেই নিস্তার বন্য হাতির হাত থেকে। সেই আগুনে সেদ্ধ হবে তিস্তার শামুক। হাতির দল পালাবে।

হঠাৎ ঝড়ো বৃষ্টি, নিভে গেল আগুন। ঘরে গিয়ে দেখি তিস্তা নেই।
সকালে দেখি তিস্তা পরে আছে বিবস্ত্রা বরাকের বালিচড়ে। রক্তের স্রোত বেয়ে অজস্র শামুক বরাকের জলে নেমে যাচ্ছে। তিস্তার অসুখ করেছে।
তিস্তার পাপ সব ধুয়ে গিয়ে মিশেছে কামরূপে। এই ধারা বেয়ে এবার আমি নেমে যাবো বরাকের জলে। সত্যিই আজ বরাকের জল থেমে গেছে।
তিস্তা এবার চোখ খোল! সূর্য তোমায় দেখে ফেলবে তিস্তা। ঘরে চল এবার।

1 টি মন্তব্য:

সুশান্ত কর বলেছেন...

বাহ! এতো কবিতা নয়, ঈশানের পুঞ্জমেঘের ইস্তাহার! লিখে চলো!