“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

জাহাজডুবির পূর্বসংকেত
















                              


                                                               
 
 
 
 
 
 
 
 
 
     ।। ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ।।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 নিয়নের ত্রিসীমানা ছাড়ালেই বাঁশবন, পচা ডোবা, টিম-টিম কেরোসিন-আলো
অনন্ত ডুবোমাঠে উপুড় আকাশ, ঝিঁঝিঁ, রাতভোর শেয়ালের প্রহর –ঘোষণা;--
উলুঝুলু কবি, তুমি ভুলেও কখনো যেন কলকাতা ছেড়ো না...
কলকাতার চতুর্দিকে হাঁ-মুখ দাঁড়িয়ে ধু-ধু অন্ধকার মফসসল, ধুলো—
মাঝে মাঝে আলটপকা ঝলসে ওঠা শিল্পবলয়, কোনো রিকেটি শহর
কিছুদূরে চেকপোস্ট, কাঁটাতার, খোলা বেয়োনেট; আরো দূরে
ফেডারেল স্ট্রিম লাইন, প্রদেশ বা ভাষাগত মারমুখী জনতা,-পরবাস।...
ওখানে টিউব নেই, এয়ারকুলার নেই, টিভি নেই , লিফট নেই, ফ্লাইওভার নেই
স্টেশন –সিটিং নেই, গ্যালারি সদন নেই; বইমেলা, থিয়েটার, ফিলমক্লাবও নেই
কুলীন কাগজ নেই, দাগী প্রকাশক নেই; লেঙ্গি নেই, ভাঁওতা নেই, ডুডু ও তামাক নেই
কফি-ভবনের ভিড়ে তুখোড় দাদারা নেই, স্তাবক চামচারা নেই, পিঠ-চুল্কুনি নেই
দালাল-প্রতিভা নেই, ফরেইন মিশন নেই, মদ-মাগি-মচ্ছবের জবরদস্ত আখড়া নেই
শহীদ মিনার নেই, ফিচারের মজা নেই, শেয়ার-বাজার নেই, ঘোড়ার ঠিকুজি নেই
স্টিমার-পিকনিক নেই, ট্র্যাফিক জ্যামিং নেই; লাগাতার লোডশেডিং,
                                       চুরি ও ছিনতাই নেই
মাস্তানি-বিপ্লব নেই, মহান পুলিশ নেই, শৈল্পিক নির্লিপ্তি নেই, বিশুদ্ধ পাতাল নেই
লিগের মরশুম নেই, শেল কিংবা লাঠি নেই, চিকিৎসা-বিভ্রাট নেই,
                                      বৈদ্যুতিক চিতা নেই
যশোকামী কবি, তুমি ভেবে দেখো মফসসলে কত কিছু নেই। ...
মফসসল মানে চাপা পাড়াগাঁর অন্ধকার, লণ্ঠন-রহস্য, পচা পিছুটান, ক্লেদ—
গ্রামীণ বিষাদ ছুঁয়ে চাষাড়ে কবির জীর্ণ মলিন কাঁথার ফোঁড়, তেল-চিটচিটে
নোংরা লিটল ম্যাগ, ম্যাদামারা কবি-সম্মেলন, ত্রাহি গানের উৎপাত, চাঁচাছোলা
ভাষণের অত্যাচার , জোলো আপ্যায়ন, ধুলো-কাদায়-লোপাট পথে ভূত হয়ে ফেরা।–
পরবাস আরো বেশি ক্লান্তিকর, পশ্চিমে ততটা নয়, পূবদিকে যতটা দুঃসহ—
ওখানে লণ্ঠন কিংবা ভৌতিক রহস্য নেইঃ শুধু গ্রানিটের দীর্ঘ ওঠানামা, ভারী
নদীর গর্জন; হিংস্র মানুষ ও পশুতে ভরা নিওলিথ-অরণ্যের জমাট আঁধার।–
ওখানে বাঙালি যারা, নিতান্ত ছাগল—কেউই বাংলা জানে না; এই কলকাতা হতে
নেহাত কাগজপত্র কিছু রোজই উড়ে গিয়ে এখানে ওদের মোটামোটি মানুষ রেখেছে;
পদ্যের ব্যাপারে ওরা নির্ঘাত পিছিয়ে আছে একশো বছর , আর
             দুঃখের কথা কী বলব,---
অমন রবীন্দ্রনাথ, তেনাকেও মিনিমাম তিনজোড়া লাথির ঘায়ে যারা অনায়াসে
ধুলোয় লুটোলো,--ঘোর মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে, রমণী দমন করে, যারা
শুধু কবিতার জন্যে ভুবন পেরিয়ে এসে, শিল্পকে পেঁদিয়ে করল তুরুপের তাস—
সেসব বিশ্রুতকীর্তি, তুলকালাম প্রতিভার নাম এরা স্বপ্নেও শোনেনি। ...
এসব জেনে ও বুঝে, হুঁশিয়ার কবি, তুমি ভুলেও কখনো যেন কলকাতা ছেড়ো না;--
কলকাতার কবি মানে রাজকবি, জমিদার—তামাম মফসসলে ছড়ানো রয়েছে এনাদের
হাজারো মহাল; আছে নায়েব, গোমস্তা, পাইক, পেয়াদা এবং যত বংশবদ প্রজা।–
মাঝে মাঝে ট্যুরে যাবে, হাওয়া বদলাতে যাবে, কখনো-বা সপরিবারেও—
দেদার কবিতা পড়বে, মুফতে আরাম লুটবে, ঢালাও অ্যাডভাইস দেবে,-দেখো
এদেশে এখনো শুধু উপদেশ ট্যাক্সো লাগে না; আর-সাধ্যের ভিতরে যেন কোনো
প্রতিশ্রুতি কাউকে দেবে না। শোন মদ খাবে বুঝে শুনে, লুকিয়ে-চুরিয়ে; আর
রমণী-ঘটিত ঝুটঝামেলা এড়িয়ে চলবে; দিনকাল খারাপ—
             হুম, জানোই-তো ভায়া—

এদানিং মফসসলও যথেষ্ট লায়েক হচ্ছে, ইতি বলতে বেমালুম বুঝে নেয় গজঃ ।...
সম্প্রতি মহালে বেশ হামলা চলছে, দ্রুত অসন্তোষ বাড়ছে নির্বিরোধ প্রজাদেরও মনেঃ
কাগুজে বাঘের খুব উপদ্রব; কয়েকটি মহাল চাইছে অটোনমি, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভবন।–
এইসব দুর্বিনীত , বিচ্ছিন্নতাকামীদের পিছনে নির্ঘাত আছে বিদেশি শক্তির উস্কানি,--
এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র সেলে জোর গবেষণা চলছে; আপাতত বন্ধ আছে ধোপা ও নাপিত,
কুলীন কাগজ আর বইপাড়ার সবকয়টি গোপন জানালা বন্ধ; এই সব রাজদ্রোহীদের
কী করে শায়েস্তা করবে কলকাতার জানা আছে; এরপর মোক্ষম ছাড়বে বিলিতি দাওয়াই,
 কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা, বিষেন বিষক্ষয়; সংক্ষেপে বলিতে গেলে, হিং-টিং-ছট।...
জনান্তিকে বলে রাখি, মেট্রোপলেট কবি! নিতান্ত প্রাণের দায়ে সবিশেষ করহ শ্রবণঃ
মফসসলি বালিকারা প্রণয়কুশলা নয় কলকাতার সুরঙ্গমা, কলাবতী নারীর মতন—
বিবাহে প্রশস্ত এরা, টলমলে দুটি শান্ত চোখের ছায়ায় যেন দিঘির অতল হাতছানি;
এদের সহিত তুমি নিছক আলাপ রাখবে, ডাকবিভাগের কোনো সদাশয় পিয়োন-মারফত—
সেইসব পিয়নেরা , যাহাদের গোঁফ ভারী, চোখ লাল, পরিধানে খাকিরং পুলিশি পোশাক,
পুলিশের চোখে ধুলো আদৌ সম্ভব নয়;--

আর, যদি নিতান্তই গ্রহের বৈগুণ্যে তুমি, নিজে
জেনেশুনে পান করো হলাহল, ঝাঁপ দাও দিঘির অতলে—তবে, সাফ জেনে রাখো
তখন দমকলে কিন্তু খবর দিতেও কেউ ছুটে আসবে না।–
                                                                       (c) ছবিঃ সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়

কোন মন্তব্য নেই: