“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

মানুষ বনাম ‘মানব-সম্পদ’

        ‘মানবাধিকার’ ও ‘মানব সম্পদ’ – এ দুটি শব্দ আজকাল যেথায় সেথায় যথেচ্ছ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বিশেষত, দৈনিক পত্রিকায়। মানবাধিকার শব্দটির বয়েস খানিকটা বেশি, ব্যবহারও অধিক। সে তুলনায় মানব সম্পদ নবীন, মানবাধিকার-এর মত ‘ব্যবহারে ব্যবহারে শূয়োরের মাংস’ হয়ে যায়নি এখনো, যদিও বহুল ব্যবহৃত। রাজনৈতিক মাতব্বর থেকে সরকারি আমলা, অকাদেমিক আলোচনা কিংবা কর্পোরেট প্রকল্প, সর্বত্র, শব্দটি নিয়ে সকলেরই লোফালুফি। ফলে, সঙ্গত কারণেই, শব্দটিকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখার লোভ সামলানো গেল না। সম্পদ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি তা এমন বস্তুকে বোঝায় যার উপযোগ সম্ভব। এবং তা প্রকৃতির দান। A resource is any physical or virtual entity of limited availability that needs to be consumed to obtain a benefit from it. In most cases, commercial or even non-commercial factors require resource allocation through resource management. There are two types of resources; renewable and non-renewable. সম্পদের বৈশিষ্ট কি? Resources have three main characteristics: utility, quantity (often in terms of availability), and consumption. (However, this definition is not accepted by some, for example deep ecologists who believe that non-human elements are independent of human values) এই সম্পদ হচ্ছে সত্তাহীন বস্তু কেবল, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকার প্রশ্নও ওঠে না। তা যদি মেনে নেওয়া যায় তো শব্দের যুগলবন্দি হিসেবেও ‘মানব-সম্পদ’ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না (যদি না মানবসত্তাটিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা যায়)। সম্পদের মানবিক রূপান্তর অসম্ভব নয়, অকল্পনীয়। 
               তবে কি একদল লোক মানব-কে মানবিক বৈশিষ্ট-বিবর্জিত সম্পদ-বস্তুতে রূপান্তরের দুঃসহ স্বপ্ন দেখতে চাইছেন? কেমন উদ্ভট শোনাচ্ছে, তাই তো! কিন্তু এরকম উদ্ভট স্বপ্ন সত্যিই দেখছে এক শ্রেণীর লোক। বিষয়টা তলিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হবে। মানবসম্পদ কথাটি য়ুরোপে প্রথম চালু হয় আশির দশকে, নয়ের দশকে তা বেশ জাঁকিয়ে বসে। মূলত একদল নয়া অর্থনীতিবিদের বদান্যতায়। Political economy বলতে যা বোঝায় এই নয়া অর্থনীতিবিদকুল হচ্ছে তার হোতা। বিশ্বজোড়া মন্দা এদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে বলে এরা ‘সঞ্জিবনী বিদ্যা’ খুঁজছে, আর তাতেই শব্দটির উদ্ভাবন। আজকাল প্রচলিত ‘শ্রমিক’ (labour) কথাটি সচেতন ভাবেই স্বল্প- কিংবা অ-ব্যবহৃত। কর্পোরেট দুনিয়া বরং তার পরিবর্তে ‘মানব সম্পদ’ ব্যবহার করায় অত্যধিক আগ্রহী। সোজা কথায় এ হচ্ছে শোষণের প্রক্রিয়ায় একটা মানবিক প্রলেপ লাগানোর ছল মাত্র। আর তাই Human resource কথাটার পাল্টা হিসেবে Human capital কথাটাও আমদানি করা হয়েছে সুচতুর কৌশলে। নানা তত্ত্বের (?) যোগান ধরাও হচ্ছে এর সপক্ষে। এমনকি এদেশে ‘মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’ নামে একটা বিভাগ পর্যন্ত খোলা হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা নিতান্ত সাধারণ বুদ্ধির মানুষ কিছুতেই বুঝতে পারি না যে এই ‘মানব সম্পদ’ উন্নয়নের দুর্ভাবনা যাদের ধ্যান-জ্ঞান তারা কারা? তারা কি তবে কোন উন্নততর প্রজাতির ‘মানব’ যারা উন্নয়নের চূড়ায় বসে আছে? সম্পদ যেহেতু নিজেই নিজেকে উন্নীত করতে কিংবা উন্নত স্তরে নিয়ে যেতে পারে না তাই কি দায়িত্বটা ওদের ঘাড়ে বর্তেছে? তাহলে একথাও মানতে হয় যে একদল মানব(!), যারা মোটেই সম্পদ নয় তারা ‘মানব সম্পদ’ শ্রেণিভুক্ত বিরাট সংখ্যক মানুষের উপর নিরন্তর খবরদারি করে যাবে। আর এরই নাম বুঝি ‘মানবাধিকার’। এরকম মানবাধিকারই বোধহয় এদের অভীষ্ট। কেননা, সম্পদের তো নিজের কোন অধিকারবোধ নেই, থাকা সম্ভব নয় বলেই। কনজিউমারিজমের (consumerism) জমানার খাসা এবং যুতসই তত্ত্বই বটে, কিন্তু বাগড়া দিচ্ছে অন্য কিছু বিষয়। দেখাই যাক না কিভাবে! 
               অর্থনীতির অর্থ না বুঝলেও ‘সম্পদ যত বেশি হয় ততই ভাল’ এই সহজ কথাটা আহাম্মকেও বোঝে। অথচ যারা সম্পদশালী হতে উদগ্রীব তারা সম্পদ হ্রাসের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা চালু করার আহাম্মকি কেন যে করে সেটা একটা ধাঁধা বইকি! হ্যাঁ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথাই বলা হচ্ছে। মানুষ যদি সম্পদ হয় তো তার উত্তোরত্তর বৃদ্ধিই কাম্য হওয়া উচিত। জন-বিস্ফোরণের তত্ত্ব তো তাহলে মানব সম্পদের ফুৎকারে পালাবার পথ পায় না! এ-কে কী-ই বা বলা যাবে - গোড়ায় গলদ, না কি গূঢ় (অর্থ)নীতি! সত্যিই বোঝা দায়। কিন্তু তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদরা ভুল করছেন তা-ই বা কী করে মেনে নেওয়া যায়! তবে কি ভুল বুঝছি আমরাই? হয়ত তাই। মানুষ আর মানবের মধ্যে এক গুণগত পার্থক্য নির্ধারণ করবার চেষ্টা করেছিলেন জীবনানন্দের মত মহত্তম কবি, লিখেছিলেন- ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব বেঁচে থাকে।’ আর হালের অর্থনীতির কেউকেটারা পার্থক্য করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে নামিয়ে এনেছেন নিষ্প্রাণ নির্জীব (সম্পদ)বস্তুর স্তরে, এবং সেই সম্পদের শোষণের মাধ্যমে মুষ্টিমেয় আরেক শ্রেণীর মানুষ ‘মানব’ হয়ে ওঠার দানবীয় প্রয়াসে মত্ত। জীবনানন্দের অমোঘ পঙক্তিটি এদের পরিচর্যায় ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবেই মানব বেঁচে থাকে’ হয়ে উঠতেই যেন চায় (নিম্নরেখ লেখকের)। এই প্রক্রিয়াটিকে কি বলা যাবে - Dehumanization of human being? আমরা অন্তত এর চেয়ে যুক্তিযুক্ত অন্যতর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। পাচ্ছি না যে তার পেছনে বড় যুক্তিটা হচ্ছে মানুষ তো কেবল শ্রমের পুঁজি নিয়েই জন্মায় না, বেঁচে থাকে না। শ্রমদান সে করে নিশ্চয়, সেই আদিম কাল থেকেই করেও এসেছে। কিন্তু তারও তর বেতর আছে। 
                আদিম মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে যেমন করত, বেঁচে থাকার তাগিদে, জীবনের জন্য আধুনিক মানুষও তেমনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে শ্রম দান করে থাকে অবশ্যই। আধুনিক মানুষকে শ্রম দানে বাধ্য করে এক বিশেষ ব্যবস্থা, যার মূল উদ্দেশ্য হল অর্থনৈতিক লাভের অঙ্ক বাড়ানো। এ কারণেই আদিতে যে শ্রম ছিল সৃষ্টিশীল, ক্রমে বাধ্যবাধকতার ফলে তার সৃষ্টিশীলতা খর্ব হতে থাকে, এবং প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে যতক্ষণ না সৃষ্টিশীলতা সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়। মানুষ (human) তো আসলে সম্পদ (resource) নয়, মানুষ হচ্ছে সম্পদ সৃষ্টিকারী (creator of resource)_ এই অর্থে যে সে সম্পদ বস্তুর সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করে পণ্যে পরিণত করে। আর এই সত্য গোপন করার উদ্দেশ্যেই ‘মানব সম্পদ’ কথাটা চালু করা হয়েছে চতুরতার সঙ্গে। কেননা, মানুষ যে সম্পদ সৃষ্টিও করে তা স্বীকার করে নিলে সম্পদের ওপর স্রষ্টা মানুষের অধিকারও স্বীকার করে নিতে হয়। আর ঠিক সে কারণেই রাজনীতি এসে অর্থনীতির হাত ধরতে চায়, জন্ম নেয় political economy, এবং শুরু হয় মানুষকেই পণ্যে (commodity) পরিণত করার প্রাণান্তকর প্রয়াস। ‘মানব-সম্পদ’ ভূষণটি যে আসলে শোষণের নয়া হাতিয়ার মাত্র – part of strategic labour management – সেটা সহজেই অনুমেয়। যেখানে টাকার অঙ্কে লাভ-লোকসানের হিসেব কষা হয়, পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদরাজি সংরক্ষণের নৈতিক দায়িত্ব পর্যন্ত অস্বীকৃত, সেখানে ‘মানব-সম্পদ’ শব্দবন্ধের চতুর ব্যবহার নিতান্ত স্বাভাবিক। তবু অনেকেই আমরা মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ি, ভূয়ো তত্ত্বের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলি অসাবধানে। কিন্তু এই কূট চাল তো শেষকথা হতে পারে না। অতএব মানব-সম্পদ নিয়ে শুরু করা যেতেই পারে নয়া এক ‘সামাজিক সংলাপ’। সামাজিক সংলাপের মাধ্যমেই এ পৃথিবীর কোথাও কোথাও যে তুমুল ওলট-পালট ঘটে যাচ্ছে সে তো এখন আর কারো অজানা নয়! এসব দেখে শুনে সমাজচিন্তকরা কি আসবেন এগিয়ে? _______________________________________________ 
(লেখাটা বেরিয়েছিল দৈনিক যুগশঙ্খে, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১১

কোন মন্তব্য নেই: