“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ৮ মার্চ, ২০১২

বিশ্বনাট্যের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের ‘পান্থ সঙ্গীত’



                                                 ।।   বিশ্বজিৎ শীল ।।  

              ( এটি  ২রা মার্চ , ২০১১ সংখ্যা দৈনিক সকালবেলাতে প্রকাশিত সমালোচনা । সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য এটিকে ইউনিকোডে রূপান্তরিত করেছেন বলে তাঁর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। নাটকটি রূপম আয়োজিত সর্বভারতীয় নাট্য প্রতিযোগিতাতে সেরা পান্ডুলিপি এবং আলোর পুরস্কার পেয়েছে। )
           রাক উপত্যকার নাট্যচর্চায় যে কটি নাট্যদলের নাম শুনলেই নড়েচড়ে বসতে হয় তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম ‘রেস’ পয়লাপুল। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই মর্যাদার আসন ধরে রেখেছেন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া রূপমের নাট্য প্রতিযোগিতায়ও ‘রেস’ আবারও প্রমাণ করলেন বরাকের অলটারনেটিভ থিয়েটারে তাদের মর্যাদার আসনটি পাকা। এবারের প্রতিযোগিতায় তারা উপস্থাপন করলেন ইন্দ্রনীল দে রচিত টেক্সট ‘পান্থ সঙ্গীত’। পরিচালনাও তাঁরই। এই টেক্সটের মঞ্চায়ন দেখে বারবার মনে হয়েছে তিনি শেক্সপিয়রীয়- চেকভীয়-দস্তয়েভস্কীর ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার অর্জন করেছেন। এ না হলে  কেউ এমন একটি টেক্সট রচনা করতে পারেনা। এই উত্তরাধিকার না থাকলে  এতো সূক্ষ্মতায় মানব মনের গহনে যাওয়া যায় না, যায় না প্রান্তীয় মানুষ কে মানবিকতার আলোকে বিশ্লেষণ। পারা যায়না মানব মনের কালো অতলে উঁকি দেওয়া। এ না হলে সম্ভব হয় না বাস্তবকে অধিবাস্তবের আলোকে সংশ্লেষণ করা।  এর সবটাই ইন্দ্রনীল আনতে পেরেছেন তাঁর টেক্সটে। এনেছেন হোঁচট না খেয়ে। ইন্দ্রনীল বাস্তবতাকে যেভাবে ভেঙ্গে বেরিয়ে যেতে পারেন তেমনি সঠিক সময়ে বাস্তবতায় ফিরে আসতেও জানেন। তাঁর রচিত অন্য সব টেক্সটের মতো এই টেক্সটটিও আনপ্রেডিক্টেবল। দর্শক কিছুতেই আঁচ করতে পারেন না। অথচ নাট্যকার অদ্ভুত যাদুতে পরতের পর পরত উন্মোচন করেন তাঁর আখ্যানের, তাঁর চরিত্রগুলির। কোথাও কোনও জ্ঞান দেন না, ফলে চরিত্রগুলি বাস্তবতা পায়।চরিত্রগুলির বিকাশেও তাই কোনও অসঙ্গতি বা কিছু চাপানো এমন মনে হয় না।
                     ইন্দ্রনীল মেসেজ দেন না। তিনি জীবনদর্শনের কথা বলেন, কঠোর কঠিন জীবনযন্ত্রনায় হারিয়ে যাওয়া মানবিক ফল্গুধারার কথাও বলেন। মেসেজ দিতে গেলে জীবনদর্শন রচনা হয়না। ইন্দ্রনীল এই কথাটুকু ভালোই জানেন। ‘শখের মজদুরিতে’ তাঁর আস্থা নেই। তাই এসব বিষয় নিয়েও আলাদা করে নাট্য রচনা করেন না। তিনি জীবন খুঁজেন, মানব খুঁজেন। খুঁজেন ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষের মুখ। স্পর্শ করতে তিনি বোধের গভীর থেকে উৎসারিত দর্শন নিয়েই নাটক রচনা করেন। তাই তাঁর প্রতিটি নাটকের আখ্যান বার বারই থাকে আনপ্রেডিক্টেবল। অথচ মৃত্তিকা-গন্ধী। তাঁর আখ্যানের বহিরঙ শুধুই ‘কিসসা’ নয়। আরও ‘বেশি কিছু’। সেই ‘বেশি কিছু’ যাতে সৃষ্টি হয় উন্নত টেক্সট। এবারো তাই হয়েছে। এটাও ঠিক বলা হল না। আসলে আলোচ্য টেক্সটটি ইন্দ্রনীলের উৎকৃষ্টতম সৃষ্টি। তিনি নিজেই নিজেকে সার্‌পাস্‌ করে গেছেন এবার। এই টেক্সটের প্রতিপাদ্য কি? উত্তরটা এক কথায় শেষ হওয়ার নয়। কারণ টেক্সটের বহুমাত্রিকতা। এক, বাস্তবতার কঠিন পাথরের চাপে হারিয়ে যাওয়া মানবতার উৎসমুখ যে কোনও মুহূর্তে উৎসারিত হতে পারে আমাদের জীবনে। দুই, ছটি মানুষই ভীষণ রকম মানবিক। তিন, আমাদের সবারই সুখদুঃখগুলো প্রায় একরকমের। শুধু এগুলোর গতিপ্রকৃতি ভিন্ন হতে পারে। কিংবা নাট্যকার বলতে চান মানুষের শিল্প-সাহিত্যে ‘থিম’-এর সংখ্যা খুব বেশি নেই। যা হয়, সে একই থিমের বিভিন্ন ন্যারেটিভ, ট্রিট্‌মেন্ট। একই থিম কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণই মানব সভ্যতার শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস।
              নাটক শুরু হলে দেখা গেলো একটি ঘরে চারটি মানুষ। ক্রমে জানা যায়, এরা কেউ জুয়াড়ি, কেউ ভণ্ড সাধু, কেউ মাতাল, কেউ বাড়িটির দারোয়ান। দারোয়ান ছাড়া এরা তিনজন ঘরটিতে ভাড়া থাকে। তাদের আরেক সঙ্গী রয়েছে। সে একটু পরে মঞ্চে আসে। এরা সবাই লোভী, স্বার্থপর এবং বিভিন্ন ভাবে শোষিতও। একসময় তারা নিজেরাই একে অন্যের নগ্নতাকে, মুখোশকে খুলে দেয় আমাদের সামনে। জানা যায় সাধুটি আসলে চোর, শহরের কোনও এক গহনার দোকান থেকে এক গাঁট গহনা চুরি করেছিল সে। এবার সেই সোনার হদিশ জানতে তার সঙ্গীরা তাঁকে যখন খুন করতে উদ্যত তখন প্রবেশ ঘটে অদ্ভুত সাজপোশাকে এক ব্যক্তির। তখন বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি চলছে। আগন্তুককে তারা সহজে মেনে নিতে চায় না, গ্রহণ করতে পারেনা। পরে জানা গেল আগন্তুক একজন জাদুকর।তাদের মন পেতে সে নানারকম জাদুর খেলা দেখায়। এক  সময় সে প্রস্তাব দেয় ‘গল্পের জাদু’ দেখাবে । তারা সবাই প্রস্তাব মেনে নেয়। জাদুকর একটি গল্প বলা শুরু করে। কিন্তু জাদুকরকে থামিয়ে দিয়ে একটি চরিত্র সেই গল্পের মোড় ঘুরিয়ে অন্যভাবে গল্পটি বলে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তাকেও থামিয়ে দিয়ে অন্যজন গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, এইভাবেই চলতে থাকে গল্প।
                 একই গল্প, একই দুঃখ সবার মনে। কিন্তু তার রূপ ভিন্ন মাত্রা ভিন্ন। সবার গল্প-সূত্র একই তবুও ভিন্ন। আমরা অবাক হয়ে যাই। তখন আমাদের মনে ভেসে ওঠে বিশ্ব সিনেমার অমর সৃষ্টি কুরোশোয়ার ‘রশোমন’-এর কথা। এটা বলার অর্থ এই নয় যে ইন্দ্রনীল ‘রশোমন’ প্রভাবিত। কুরোশোয়া একই আখ্যানের বিভিন্ন চরিত্রদের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সত্য কী সেটা খুঁজতে চেয়েছেন। আর ইন্দ্রনীল মূলত বলতে চেয়েছেন মানবিক অনুভূতিগুলি বাস্তবতার চাপে চাপা পড়লে ঘটনাচক্রে সেগুলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। গল্প বলা শেষ হয়। সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, ভোর হয়। পরিচালক ইন্দ্রনীলও কম যাননা। নাটকের শুরুতে যেখানে মদ খাওয়ার প্রসঙ্গ আসে সেখানে আবছায়া থেকে পরিচালক মদের বোতলের যে টুংটাং আওয়াজের ছন্দ তুলে প্রসঙ্গে আসেন তাতে তাঁকে বাহবা দিতেই হয়। এটা তার উজ্জ্বল নাট্যবোধ এবং ছন্দবোধের প্রমাণ। ইন্দ্রনীল এসময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা। কিন্তু ‘পান্থ সঙ্গীত’-এর সংলাপে তাঁর এই বাহাদুরি দেখা গেলো না। ‘পান্থ সঙ্গীত’-এর প্রযোজনা টানটান গোটা পরিকল্পনা-ভাবনা নিরাভরণ অথচ বাঙ্ময়। ছন্দ-গতি নাট্যোৎকন্ঠা-ক্রমোন্মচন সবই আছে। এগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে সচেতন পরিমিতি বোধ দিয়ে।
                 আবহ এবং আলোক পরিকল্পনা ভাল কিন্তু এখানে ওখানে দু-একটি বিচ্যুতি থাকায় শেষরক্ষা হল না। বিশেষ করে শুরুর মেঘের গর্জন। মঞ্চসজ্জা সেও ভাল। বুদ্ধিদীপ্ত। একটা ভাঙ্গাচোরার ব্যঞ্জনা রয়েছে। রয়েছে এবড়োখেবড়ো জ্যামিতি। বিষয়ের সঙ্গে মিলে মিশে যায়। অভিনেতারা গোটা মঞ্চকে ব্যবহার করেন। কিন্তু ঘরের দুদিকে দুটি দরজা থাকা সত্ত্বেও  আমরা একটি দরজাও দেখলাম না। দারোয়ান যে দরজা দিয়ে আসে যায় সেটা দেখা না গেলেও চলে যায়। কিন্তু লম্বু এবং জাদুকরের মত দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে যে দরজা খুলে ঘরে আসতে দেওয়া হল  সেটা না থাকলে কি চলে? অভিনেতারা সবাই ভাল করেন। কিন্তু তাদের অভিনীত চরিত্রগুলি প্রায়ই পরিশীলিত শহুরে শব্দ ব্যবহার করে, উচ্চারণ করে। কেউ কেউ আবার যে সুরে সংলাপ বলেন শুরুতে পরে সেটা হারিয়ে ফেলেন (সাধু চরিত্র)। এই ছোটোখাটো ত্রুটিগুলিকে বাদ দিলে ‘পান্থ সঙ্গীত’কে উন্নতমানের প্রযোজনা বলে স্বীকার করতেই হয়। সার্বজনীন আবেদনের এই টেক্সটটি আমাদেরই নাট্যচর্চার সাথী কেউ একজন রচনা করায় আমরা গর্বিত। গর্বিত বাংলা ভাষা।           

২টি মন্তব্য:

Indranil বলেছেন...

লেখাটিকে ব্লগে প্রকাশ করার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে দৈনিক যুগশঙ্খে নয়, লেখাটি দৈনিক সকালবেলা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

সুশান্ত কর বলেছেন...

এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্যে দুঃখিত ইন্দ্রনীল। ঠিক করে দেয়া হয়েছে। আমিও ভাবছিলাম, এটা ভুলই। কিন্তু কিসেযে প্রকাশিত হয়েছিল মনেও করতে পারছিলাম না, পাচ্ছিলামও না কোথাও। সে যাক, ঠিক করে দেয়া হয়েছে। আপনি বেশ বাংলা লিখছেন। ভাবুন আপনার নাটকগুলো ব্লগে করে ছড়াবেন কিনা। ঈশানের পুঞ্জমেঘ আপনারই ব্লগ!