“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১২

ছিঃ.. ছিঃ..এত-তো জঞ্জাল...!

 (লেখাটি সম্প্রতি বেরিয়েছে 'দৈনিক যুগশঙ্খে'।অজ্ঞাত কারণে  লেখাটার মূল পাণ্ডুলিপি থেকে কিছু অংশ ছেঁটে পত্রিকায় বেরিয়েছে)
      শকুন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। আশংকা করা হচ্ছে, দুনিয়াতে আবর্জনা বেড়ে যাবে। দুশ্চিন্তার কারণ নেই। নিচের ছবিটা দেখুন। সে কাজটা গবাদি জন্তুই সেরে নিচ্ছে । শহর শিলচরে অন্ততঃ শকুন বিলুপ্তি জনিত কারণে দুশ্চিন্তা নেই। বাঁচা গেল। প্রসঙ্গক্রমে পুর আইনের [Municipal Solid Wastes (Management and Handling) Rules, 2000] একটা নির্লজ্জ (?) ধারা (Schedule – II./viii) কলমে উঠে আসছে, যেখানে ঊল্লেখ রয়েছে, গবাদি পশুদেরকে পুর আবর্জনার ধারে পাশে যেতে দেওয়া উচিত নয়, বখাটের মত শহরে ওদের ঘুরে ফেরাও অনুচিত, এবং সংশ্লিষ্ট নিয়ম মাফিক এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। (“Stray animals shall not be allowed to move around waste storage facilities or at any other place in the city or town and shall be managed in accordance with the State laws’’.)। এবার সেই স্টেট রুল টা কি? উদাসীনতা ? হু…..উঁ! বলা বাহুল্য।
                     
            রাজধানী দিল্লী এবং অন্যান্য বড় শহরে আবর্জনা বয়ে নেওয়ার ঠেলা-গুলোতে সাধারণত দুটো খোপ থাকে, একটাতে জৈব এবং অন্যটাতে অজৈব বর্জ্য বয়ে নিয়ে যায়। এটার একটা মানে হয়। শিলচর সহ উত্তর পূর্ব ভারতের কোথাও অমন চিত্র দুর্লভ।
             ঈশান বাংলার হু হু করে জনসংখ্যা বেড়ে উঠা এই প্রান্তিক শহর শিলচরের আবর্জনা নিষ্কাশন পৌর প্রশাসনের পক্ষে একটা নিতান্ত বড় চেলেঞ্জ। বিশেষত, নাগরিকদের পৌর- ব্যবস্থায় ধাতস্থ হওয়ার যে সোপান, যে পন্থা, তার প্রতি গোঁড়া থেকেই কেউ কোনদিন গা দেন নি। ওই বিষফোঁড়া এবং উদ্বাস্তু মানসিকতার যুগলবন্দি-তেই তিলু-পিসির বাড়ীর আজ এই দুরবস্থা। ওদিকে দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ, দুই পরিসরেই শহরের কলেবর উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে !
 
          এই তো সেদিন, সাবেক সত্তর এবং আশির দশকেও তো শিলচর একটা ছোট্ট শহর ছিল। শতকরা প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ বাড়িতেই স্যানিটারি ল্যাট্রিন ছিল না। ভোঁর বেলা নাগা কর্মী এসে টিন পালটে দিত প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে। এখনও শহরের সাবেকী বাড়িগুলোর পেছনে সরু এক চিলতে পথ দেখতে পাওয়া যায়, ওই রাস্তা দিয়েই নাগাকর্মীরা যেত-আসতো। সময় পাল্টে গেছে, এবং পাল্টে গেছে নাগাকর্মীদের রুটি–রুজির পথও। তেমনটাই বাঞ্ছনীয়, ভালই হয়েছে, উন্নত বিজ্ঞান আর বর্ধিষ্ণু মানবধিকারের দিনে অমন অমানবিক কাজ! ভাবতেও কেমন!
             সময়ের সাথে সব কিছুই পাল্টায়, এবং ওই স্বাভাবিক নিয়মেই সত্তর এবং আশির দশকের সাথে দু'হাজার দশ কিংবা বারোর এত বিস্তর ফারাক। পাড়ায় পাড়ায় লাকড়ির ডাম এর জায়গায় আজ গ্যাস এজেন্সি, আসাম টাইপ বাড়িগুলোর জায়গায় আজকাল অমুক এপার্টমেনট বা তমুক এনক্লেভ। কেরোসিনওয়ালাদের ঠেলাগাড়ির সেই ‘ক্র-ও-ক্র-ও’ শব্দটা যেমন নাই হয়েছে, তেমনি নাই হয়েছে শহরের নির্মল পরিবেশও। গোটা শহরটা যেন ‘ঝুপর–পট্টি’ হওয়ার দৌড়ে সামিল!
           শহর শিলচরের যে বিবরণ তুলে ধরা হল, সেটা উত্তর পুর্বাঞ্চলের অন্যান্য ছোট কিম্বা মাঝারি শহরের প্রতিকি রূপ। এই শিলচর শহরেই প্রতিদিন গড়পড়তা ৯০ টন আর্বজনা সৃষ্টি হচ্ছে। আর্বজনা নিস্কাসনের যেটুকু বন্দোবস্ত রয়েছে, তা সোজাকথায়, অপ্রতুল। এই পরিকাঠামো দিয়ে শহরের আর্বজনা মোকাবিলা সহজ সরল কথায় অসম্ভব। এর দায়ভার যে শুধু পুর-কর্তপক্ষের ওপর বর্তাচ্ছে, তা নয়, সামুহিক শহরবাসীরই এটা লজ্জা, বলা যেতে পারে, আমাদের গণ-লজ্জা! দ্বিধা-দ্বন্দ্বের বাইরে এসে এইটুকুতে যদি আমরা এক মত হই, তাহলে এর থেকে উত্তরণের পথ বেছে নেওয়া সম্ভব। বর্ষার পঙ্কিলার্বতে আবদ্ধ হয়ে কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি করব, কিম্বা ধুলাবর্তে নাসিকাবরণ নিয়ে আরও কিছুদিন থাকব, সেটা ভাবার সময় কি এখনও বাকি ?
          
       সাধারণতঃ মিউনিসিপালিটি আর্বজনাকে ৫টি মুখ্য-বর্গে ভাগ করা হয়। ১ম বর্গ হচ্ছে, সব্জির খোসা ইত্যাদি, যেগুলো জৈব এবং পচনশীল, ২য় বর্গ হচ্ছে, যেগুলো-কে রিসাইকল করে পুনরায় ব্যবহার করা যায়, যেমন, কাগজ ইত্যাদি। ৩য় বর্গের আর্বজনা হচ্ছে, বাড়িঘর বানানোর সময় সৃষ্ট হওয়া বর্জ্য পদার্থ, যেগুলো সেই অর্থে ক্ষতিকারক নয়, কিন্তু সোজা কথায় আর্বজনা। ঘরোয়া পাঁচমিশেলি আর্বজনা ৪র্থ বর্গের অন্তর্গত এবং বাচ্চাদের খেলনা, ব্যটারী, ইলেক্ট্রনিক উপাদান, কম্পিউটারের ভগ্নাবশেষ, কীটনাশকের কৌটো ইত্যাদি ৫ম বর্গের আর্বজনা। সাম্প্রতিক কালে ই-ওয়েস্ট একটা বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
          নাগরিকদের পরিচ্ছন্ন এবং সুস্থ পরিবেশ সুনিশ্চিতকল্পে আদর্শ নিয়মাবলিতে সময় সময় মিউনিসিপাল কর্তৃপক্ষ জনসভা, সচেতনতা সভা ইত্যাদি আয়োজন করার বিধান রয়েছে। এটা মিউনিসিপাল আইনের ২য় তপসিল ভুক্ত ধারা মোতাবেক। এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংঘটন, বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক সমিতি এতে সদর্থক ভুমিকা নিতে পারেন। সেরকম একটা সভা সমিতি সাম্প্রতিক কালে কিম্বা সাম্প্রতিক অতীতে হয়েছে বলে কেউ জানেন কি?
        এই শহরে সকালের দিকে অফিসগামি অনেকেরই খোলা ট্রাকে আবর্জনা নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে নাকে রুমালও চাপা দিয়েছেন আপনারা নিশ্চয়! মিউনিসিপাল আইনের ২য় তপসিল বলছে, যে আবর্জনা বহনকারী গাড়িগুলো উন্মক্ত থাকবে না, বয়ে নেওয়া আবর্জনা পথচারী জনসাধারণের নজরে আসা উচিত নয়, আবর্জনা নিয়ে যাওয়ার সময় উন্মক্ত পরিবেশে বা রাস্তায় ওই দুর্গন্ধ ছড়ানো একে বারেই অনুচিত। শিলচরের পথে রোজ সকালে খোলাগাড়িতে আবর্জনা নিয়ে যাওয়া কি ওই আইন লঙ্ঘন তাহলে করছে না? আইনের ওই ধারা আরও বলছে, আবর্জনা রাখার নির্দিষ্ট জায়গা গুলো রোজ পরিস্কার করতে হবে, আবর্জনা যেন উপচে না পড়ে...... বাস্তবে এ সমস্ত আইনের কতটুকু মানা হচ্ছে?
পুর আবর্জনাকে পদ্ধতিগত ভাবে নিস্ক্রিয় তথা পরিবেশ বান্ধব করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনে কিছু কিছু পন্থা-পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে। VERMICOMPOST বা কেচোঁ-চাশ, ANAEROBIC DIGESTION বা অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে দহন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য, যা আমাদের শহরের অভিভাবকদের বর্নমালায় নেই; হায়! একেবারেই আনকোরা নতুন শব্দ।
           বছর তিনেক আগে শহরেরই পরিধি অঞ্চলে একটা মিটিং-এর আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম; এলাকাটা দুর্গন্ধের জন্য বিখ্যাত! বলা যেতে পারে গোটা শহরেরই সেটা ব-র্জ্য-ভূ-মি! এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, মাছির উপদ্রপে তাদের অবস্থা নাজেহাল। বাড়িতে মশারি টাঙ্গানো থাকে বারোমাস! সকাল- দুপুর সব সময়ই ওই মশারির ভেতরই ডান হাতের কাজটা সেরে নেন। আত্মীয়-স্বজন কেউ বাড়িতে এলে, উনাকেও ওই মশারির ভেতরই চা খেতে দেওয়া হয়, অন্যথায়, অতিথিকে যে চায়ের সাথে বিস্কুটের বদলে মাছি খেতে হবে!
         লন্ডনের ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল, ‘দ্য লান্সেট’ (২৫ জানুয়ারি,২০০২) জানিয়েছে যে আবর্জনা ঢিপির তিন কিলোমিটার পরিধির মধ্যে বাস করা মহিলাদের শতকরা ৪০ ভাগেরই বিকলাঙ্গ শিশু জন্মানোর প্রবণতা দেখা দেয়। আমাদের পুর আইনের তৃতীয় তপসিলে উল্লেখ রয়েছে যে আবর্জনা নিক্ষেপের স্থান মনুষ্য বসবাসের এলাকা থেকে যথেষ্ট দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়, এবং ধারে-পাশে যেন কোনো মুল্যবান জলাভুমি, জলাশয় ইত্যাদি না থাকে। আবর্জনা নিক্ষেপের স্থান এবং লোক বসতি এলাকার অন্তবর্তী স্থানে যেন নিরাপদ ‘বাফার-জোন’ রাখা হয়। এছাড়াও আবর্জনা নিক্ষেপের স্থানে প্রদুশন মাপার যন্ত্র, সাফাই কর্মীদের স্নানের জায়গা, পানীয় জল ইত্যাদির বন্দোবস্ত থাকা নিতান্ত জরুরী। আইন অনুযায়ী, পুর-কর্তৃপক্ষ নিয়ম মাফিক এগুলো পরিদর্শন করবেন।
          পুর আইন, ২০০০এর যে সমস্ত ধারা এই আলোচনাকে ঋদ্ধ করার জন্য অবিকৃত ভাবে তোলে ধরা হল, বাস্তবে সেই সমস্ত ধারার রূপায়ন এই শহরে যে আদৌ কতখানি সম্ভব তা নিরুপনের দ্বায়িত্ব কাদের? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে থাকা শহরবাসীর? আর ওই সমস্ত ধারার সার্থক রূপায়ন যদি না করা হয়, তাহলে সংবিধান ছাড়া যেমন দেশের অস্তিত্ব যেমন অসম্ভব, পুরসভাও সেরকম একটা অশরীরী দেহ নিয়ে বিরাজ করবে?
         শহরবাসীদের কাছে এই মুহূর্তে সেটাই কি একমাত্র খোলা পথ?

সূত্রঃ
১) Municipal Solid Wastes (Management and Handling) Rules, 2000


1 টি মন্তব্য:

সুশান্ত কর বলেছেন...

আপনার এই লেখাগুলো ঈশানের গৌরব! ঈশানকে সমৃদ্ধ করছে এই লেখাগুলো। চালিয়ে যান পার্থঙ্করদা!