“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৩ এপ্রিল, ২০১২

বাংলা দেশের হৃদয় হতে এলো উপহারঃ মেঘ অদিতির 'জল ডুমুরের ঘুম'

          মার মতো দূর দিগন্তবাসির কপালে ওমন উপহার কালেভদ্রে মেলে। হঠাৎ কোনো ঘুড়ি ভোকাট্টা হলে উড়ে এসে জুড়ে বসে। ঢাকার 'মেঘ অদিতি' আমার পুরোনো বন্ধু। একটা ঘুড়ি ইচ্ছে করেই সে আমার দিকে ওড়ালো। কলকাতা হয়ে ওর প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই ' জল ডুমুরের ঘুম' দিনকতক আগে আমার কাছে এসে পৌঁছুলো। ঢাকা থেকে ডাক খরচ প্রচুর, আমি অতোটা আশা করিনি। তবু সে পাঠালো যে তার জন্যে আমার মুগ্ধতা প্রকাশের কোনো ভাষা নেই। তার উপর আমি কবিও নই! বইটি ওর প্রয়াত বাবাকে উৎসর্গ করেছে। সেই বাবার প্রেরণা ও প্রশ্রয়ে ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্যের ও    সুপাঠিকা । বাংলা সাহিত্যের গলিঘুঁজি ও চষে বেড়িয়েছে আশৈশব ওর বাবার আঙুল ধরে, আর এখন বেড়াচ্ছে একা । কিন্তু লিখত না। সম্ভত আঁকত। ঠিক আঁকতও না, যারা ওকে জানেন তাঁরা জানেন যে ফটোশপে ও যাদু দেখায়। ফটোশপে কবিতা লেখে। শব্দে আঁকেনি এতোদিন। যদি ভুল না বলি, আর বন্ধুকে বলা কথাগুলো সত্য হয়, তবে ওর এই কবিতার বইএর ছবিগুলো আঁকার বয়স এক দু'বছরের বেশি নয়। হ্যাঁ, ও ছবিই আঁকে। জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, তোমার ঐ কথাটার অর্থ কীগো? সে অবশ্যি কোনো ভালো কবিতাতেই জিজ্ঞেস করা উচিত নয়। সেই অর্থ যখন ধরা দিয়ে দেয় এবং সমস্ত বিসঙ্গতি সহ-- তখনই বোধহয় আমরা বলে উঠি, এটা কী হলো? আমার মনে হয় না, মেঘ অদিতির ( নিশ্চয়ই ওর আসল নাম নয়) কবিতা পড়ে কেউ প্রশ্ন করতেও চাইবেন , এটা কী হলো? এর মানে কী? জিজ্ঞেস করতে নেই। স্রেফ দেখে যেতে হয়, যেমন দেখে আমরা ব্রহ্মপুত্রের বুকে গুনি ঢেউ, কিম্বা  চোখ ধরে গেঁথে দিই  বালিহাঁসের পালকে  পশ্চিমা সূর্যের গুড়ো । 
       মেঘের কবিতাগুলো দেখে যেতে হয়। সেই 'কফিহাউসের আড্ডা'র দিনগুলো থেকে ওর সঙ্গে আলাপ। দেখেছি, ওর ছবি দেখে যেতে হয়। ফেসবুকের জনপ্রিয়তার দিন গুলো থেকে পড়ে যাচ্ছি ওর কবিতা, দেখেছি ওর কবিতা দেখে যেতে হয়! ওখানে 'যেন খুব করে কেউ রঙ গুলে আকাশকে স্নান করিয়েছে' কিম্বা, উঠোনে আজ জলজ্যোৎস্নার গায়ে নকশীচাদর' --ওমন সব ছবি। কিম্বা ভাবতে বসতে হয়, যখন সে লেখে, " নির্ঘুম ঘাসের সাথে, সন্ন্যাসী তারার সাথে আমার কোনো পার্থক্য নেই আজ।" কিম্বা 'সন্ধেবাতি দেবার হিড়িক ঘরে ঘরে অথচ স্ট্রীট লাইটগুলো মুখতোম্বা করে আছে।" নিজেরই লজ্জা লাগবে, কত সব চেনা ছবি, আমরা ফিরেও তাকাইনি, ওর কবিতা তাকাতে শেখাবে মাত্র। 
   আমার বলবার উদ্দেশ্য এই নয়, যে কীসব আশ্চর্য পংক্তি সে লিখে গেছে। পংক্তি কী করে লিখে যায় লোকে জানি না, লিখে যায় গোটা এক কবিতা। রামধনু হতে পারে সম্পূর্ণ  নীল আকাশের  গায়ে চিরল চিরল মেঘের খেলা আর সূর্যের কোনো প্রশ্রয় ছাড়া? পুরোটা নিয়েই ছবি। আমি ওর টুকরোগুলো তুলে ধরবার কারণ আর কিছু নয়, ওর থেকে পুরোগুলো পড়ে ফেলবার আগ্রহ যদি জাগাতে পারি । এর মানে এই নয় যে সে আঁকে শুধু শিশুদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতার জন্যে 'সুন্দর' সব ছবি, লেখে কবিতা। 
      কোথাও যেন সেই সব 'সুন্দর'কেই খোঁজে ফেরে সে। আগেই বলেছি, বুঝে নিতে গেলে গোল বাঁধবে। শুধু অনুভব করতে হয় মেঘের কবিতা। এভাবে গল্প বলতে বলতেও   তো সে আঁকে এমন ছবিও," অরণ্য বালিকা, সেদিন বাড়ি ফিরে কি দেখেছি জানো?/ ম্যাজিকের মতো আমাদের বাড়িটাই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। শূন্যে একটা উঠোন, সেখানে পড়ে আছে দোলা, আমার একটি মাত্র বোন যার সর্বাঙ্গ ঝলসে গিয়ে কুঁকড়ে গিয়ে এই এই টুকুনি... এক খাবলা দোলা হয়ে গেছে।"   ও হ্যাঁ,  কবিতাগুলোতো সবই গদ্যে লেখা, পড়তে পড়তে এই ভ্রমেও পড়তে হয় এগুলো কি কবিতা না গল্প? ভ্রমটাকে দেখলাম লেখিকার প্রশ্রয়ে   প্রকাশক টিকিয়েও রেখেছেন ভেতর প্রচ্ছদে এই লিখে, "  প্রচলিত কবিতা ও গল্পের বাইরে এই বই।" সেসব দুষ্টুমি ফাঁস করে দিয়ে আমি বলি, একটিও গল্প নেই গোটা বইতে।  সেরকমই আরো অনেক খেলা আছে, বইটির পরতে পরতে। পড়তে পড়তে মনে হয় যেন এক স্বপ্নের পুরিতে নিয়ে এলেন  লেখিকা, একটু পরেই দেখবেন সেখানে স্বপ্নগুলোর এখন দুঃস্বপ্নের সাথে লড়াই ভীষণ। নাহয় পঁয়ত্রিশটি কবিতার মধ্যে যে কবিতাটির নামে বই, সেটি পুরোটা পড়াই যাকঃ
জল ডুমুরের ঘুম

রিযায়ী পাখিদের পায়ে বেঁধেছি বৃত্ত। মহাদেশ পেরিয়ে যেতেই তারা সংখ্যায় বাড়ে। পরবর্তী কোনো এক মধ্যাহ্ন মিলিয়ে যাবার আগে আগে বরফ ভেঙে উপত্যকার কাছে ওরা ফিরে আসে। নেমে আসে আবার দিগন্তে। আমাদের অন্যমনস্কতার মধ্যে ঢুকে পড়ে এক-একটি বৃত্ত। আগুন নিভে যাওয়া বুনোগন্ধ তখনও জেগে। আমাদের রাতগুলো বহুবর্ণা আলোর নীচে ঘুরপাক খায়। বৃত্তে বৃত্তে বাড়ে উপনিবেশের ছায়া। আমাদের খিদে মরে যায়, তৃষ্ণা হয় না অথচ শরীর অতিকায় হয়ে ওঠে । শহরের রাস্তাগুলো যখন যে যার মত নিরাপত্তা খোঁজে তখন আমাদের ঘোর কাটে। আমারা জেনে যাই এক অন্ধজীবনের কথা। আমারা জানি তীরন্দাজের বোধের মরণ হয়ে গেছে। তবু ঝরে পড়ার আগমুহূর্তে আমাদের গায়ে এসে পরা রোদের মুখ মায়া মাখা, গাছের চিরল পাতার গায়ে থাকে সম্ব্রমমাখা দুরন্ত সবুজ আদর আর আমাদের কাছে এসে দাঁড়ায় মৃত্যুদূত।

আমরা ধ্রুবতারার সাথে পূর্বজন্মে ফিরে যেতে চাই।

লোকাল ট্রেনের মত ধীরগতি হয়ে পড়া আমাদের চোখ তখন কেউ বেঁধে দিয়ে বলেঃ
ঘুমাও জলডুমুর। 


২টি মন্তব্য:

Indira Mukhopadhyay বলেছেন...

সুশান্ত, আপনি ভাগ্যবান । জলডুমুরের ঘুম নিয়ে ভালো সময় কাটুক আপনার । আর মেঘকে আমার তরফ থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই ।

সুশান্ত কর বলেছেন...

হা! হা! হা! হ্যাঁ, ওর বই এতোদূর থেকে পাওয়া ভাগ্যই বটে!