“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১২

কবি মাসুদ খানের কবিতার বই 'পাখিতীর্থদিনে'

            ই সময়ের বাংলা কবিতাবিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি কানাডার টরন্টো প্রবাসী বাংলাদেশের মানুষ মাসুদ খান তাঁর কবিতার বইটির নাম 'পখিতীর্থদিনে'। বের করেছিল ঢাকার 'নদী' সেই ১৯৯৩তে। তার মানে বয়সে বইটি দুই দশকের 'বুড়ো'   পেয়েছিলাম মাস কয়েক আগেই। সময় নিলাম পড়তে, ভাবতে এবং তাঁকে আরো ভালো করে জানতে। বইএর নামটি থেকেই আমাদের কথা শুরু করা যাক। আমরা কি নামটি ভুল লিখলাম? দু'টি বা তিনটি শব্দকে জুড়ে দিলাম কি? না, বরং এরকম শব্দনির্মাণে তাঁর আশ্চর্য ঝোঁক আছে। সবচাইতে দীর্ঘশব্দটি 'বালিচূর্ণস্বর্ণরেণুভস্মকার্বণকর্দমকণাকুলহরিনের' (ধুলিবিদ্যা) এরকম তৎসম শব্দবাহুল্যে ধ্বনি ঝংকার নির্মাণপ্রয়াস বাংলা সাহিত্যে নতুন নয়, বরং মধুকবির থেকে  এর শুরু, সুধীন দত্ত  এর গুরু। কিন্তু এই কৌশলকে যে পেছনে ফেলে আসতে হবে তারতো কোনো যুক্তি নেই, আমাদের সেরকম যুক্তিবোধকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করান মাসুদ। তেমনি দাঁড় করান আমাদের স্থান কালের ধারণাকে। তাঁর ইচ্ছে 'দিগদিগন্ত থেকে অখিল বুদ্ধিরাশি/এখন ধাবিত হোক ঐ দূতের মস্তিষ্ক অভিমুখে।"( পাখিতীর্থদিনে) তাঁর কুড়িগ্রামের মানুষ যখন "রাত গভীর হলে আমাদের এই প্রচলিত ভূপৃষ্ঠ থেকে/ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়।/অগ্রাহ্য করে সকল মাধ্যাকর্ষণ।/তারপর তার ছোট রাজ্যপাট নিয়ে উড়ে উড়ে/চলে যায় দূর শূন্যলোকে।" তখন শুধু মনে পড়ে আমাদের রবীন্দ্রনাথের সেইসব গানের কলি, "মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে /আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ...॥" খণ্ড স্থানকাল বোধের বাইরে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে আসেন মাসুদ শুরুতেই। তাঁর পরেই পড়তে বসতে হয়, তাঁর কবিতা। তিনি যখন প্রকৃতি কথা শুনান তখন তা কেবল 'কুড়িগ্রাম' কিম্বা 'বগুড়া' ( তাঁর জন্মভূমি) হয়ে থাকে না। যখন নদীর কথা বলেন, তখন তা আর থাকে না কেবল 'জলাঙ্গীর ঢেউ' কিম্বা 'ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে'। বিচরণ করেন 'ট্র্যান্স-আকাশগাঙ্গেয় পথে' (প্রজাপতি) । পড়তে পড়তে বোঝাই যায় বিজ্ঞানে কবির অধ্যয়ন গভীর, সেই মতো ধ্যান তাঁর দর্শনে। 
           
            শুদ্ধ অক্ষরবৃত্তকে নিয়েও সাজিয়েছেন বেশ কিছু কবিতা কিন্তু অধিকাংশতেই তিনি শুধু শব্দ নয়, বাক্যকেও ভেঙ্গেছেন চুরেছেন সাজিয়েছেন তাঁর মতো, লিখেছেন গদ্যে। যেমন "শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া/বস্তুর থেকে বিকশিত ফের বস্তুতে ফিরে যাওয়া!/শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া/শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া/শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় /শ্রবণ বধির /শ্রবণ " ( সার্কারামা)। এ কবিতার শুরুটা কিন্তু এই, "আজ এক রুগ্ন অগ্নিকুণ্ডের কিনারে বসে আছি জবুথবু/চারদিকে চলমান সার্কারামা/ছবিগুলো খুব দ্রুত নাচতে নাচতে আসে আর যায়।" গদ্যে , পয়ারে নয় মোটেও।
             কিছুটা দুরারোহ ঠেকবে তাঁর কবিতা বিশ্বে পা রাখা, কিন্তু দুর্গম নয় একেবারেই। এমন সুন্দর স্তবক তথা পংক্তিমালা তার প্রমাণঃ"চন্দ্রের মন্থরা ছোট মেয়ে হাওয়া/অর্ধেক অধরা সে, অর্ধেক পাওয়া/অর্ধেক লুপ্ত সে ছিলো গতকাল/তার দিকে ছুটে গেছে সারাটা সকাল।" এটি 'ক্লাউন' কবিতার থেকে নেয়া। পাঠক দেখবেন এতে তিনি ছড়া আর পয়ারের  ছন্দকে নিয়ে কেমন কুশলি খেলা খেলেছেন।  এমন খেলা ছাড়া কবিতাটা জমতনা কিছুতেই। শুধুমাত্র ভুল পাঠকই উচ্চারণ করতে পারেন , "কেউ বলে, সে অলবড্ডে/হ্যাংলা বেশি। ভুল পদ্যে/মঞ্চে মাতে।..." (ঐ) আমাদের বিশ্বাস যত্ন নিয়ে যে পাঠক বইটা পড়ে যাবেন তিনি স্বয়ং কবিতা বিশ্বভ্রমণে সমৃদ্ধ যাত্রী হবেন। 
              তাঁর মানে এই নয় যে দু'দশক আগের শৈলীতে মাসুদ আটকে আছেন। এরপরেও তাঁর বই বেরিয়েছে, নদীকূলে করি বাস (একুশে, ২০০১); সরাইখানা ও হারানো মানুষ (একুশে, ২০০৬)।  তাঁর কিছু অতীব ভাবসমৃদ্ধ কিন্তু সহজবোধ্য সাম্প্রতিক কবিতাও আমাদের পড়বার সৌভাগ্য হয়েছে।যেমন 'ডাকাতি' কিম্বা 'সুশীল ও দুঃশীল'। পাঠক এখানে পড়তে পারেন। কিম্বা পড়তে পারেন ওখানেও।
              বস্তুত যে বইটি আপনাদের পড়তে দিচ্ছি, সেটি বেরুবার পর ব্রাত্য রাইসু এবং সাজ্জাদ শরিফের নেয়া একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও আমাদের নজরে পড়েছেযেটি, আমরা পাঠকদের অবশ্যই পড়ে নেবার অনুরোধ করব। সাক্ষাৎকার নেবার নামে ওমনটি জেরা আমরা খুবই কম পড়েছি। সেও হবে পাঠকের এক উপরি পাওনা। 
             বইটি পড়তে পাবেন নিচে। আপনার কম্পিউটারে নামিয়ে নিতে পারেন নাও নিতে পারেন, পড়তে পারেন পুরো পর্দা জুড়ে। নিচের বোতাম গুলো দেখুন। আপনার শুধু দরকার পড়তে পারে ফ্লাসপ্লেয়ারের। নামিয়ে নিন এখান থেকে।

Pakhitirthadiney

কোন মন্তব্য নেই: