“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২৮ আগস্ট, ২০১২

‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’ বনাম ‘আম্‌গো বাসা কইলকাত্তা’?

                                                                                              ।। সপ্তর্ষি বিশ্বাস।।

           ‘‘রক্ত ঝরাতে পারিনা’ক একা   তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা
            বড় কথা, বড় ভাব আসেনাক মনে, বন্ধু বড় দুখে,
           অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছো সুখে ...’’
                                                নজরুল ইসলাম, আমার কৈফিয়ৎ
কাতারে কাতারে ছেলে মেয়ে পালিয়ে চলেছে বেঙ্গালোর, পুণা, হায়দ্রাবাদ, বোম্বে থেকে। প্রাণের ভয়ে । এরা সব উওরপূর্বের মানুষ। মূলতঃ আসামের।হয়তো এর পেছনে রয়েছে গুজব, হয়তো ‘রাজনীতি’। সে প্রসঙ্গে পরে যাবো। তার আগে বলে নিই যে, যেহেতু আমিও ‘অফিসিয়ালি’ ‘আসাম’এর, যেহেতু আমিও থাকছি এই বেঙ্গালোর শহরেই, ফলতঃ এই ঘটনা ঠিক ‘তাত্ত্বিক’ বা ‘দার্শনিক’ ভাবে নয়, আমাকে আক্রমন করে রক্তে-মাংসে। আমি টিভিতে খবর শুনি, ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি কোন দিকে যাচ্ছে ঘটনার গতি এবং অন্তিমে ফোন করি, ই-মেইল্‌ করি বেঙ্গালোরবাসী অন্য চেনা পরিচিতদের। তারা বলে, মনেহয় ঠিকই বলে, কেননা সেটাই স্বাভাবিক, যে, ‘আমাদের ভয় নেই, মেইন্‌লী ট্রাইবেল্‌রা’ই টার্গেট’ তারপর সামান্য থেমে ‘আর আমাদের চিন্তা কি? কেউ বললে বলবো আমরা কলকাতার’ ... ফোন রেখে দিই। নানান ভাবনা এসে ভিড় করে মগজে। 
          বলা হয়েছিল মাতৃভাষা ‘অসমীয়া’ হলে কোনো ‘ডর’ নেই। ভোটাধিকার পাক্কা। কেননা এতে আসামে ‘অসমীয়া ভাষী’ জনতার পরিসংখ্যানে যে প্রভাব তা’তে প্রমাণিত হবে আসামে ‘অসমীয়ারা’ই সংখ্যা গরিষ্ঠ। অতএব ‘আপার আসাম’ (ধেমাজি, ডিব্রুগড়,লখিমপুর, গোলাঘাট, শিবসাগর ও তিনসুকীয়া) এর নানা স্থানে বসবাসকারী  বঙ্গভাষী জনতার এক বৃহৎ অংশ ‘তোমার মাতৃভাষা কী’ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন ‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’। তথাপি  ঘটে গেলো ‘নেলী’। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ্য দিবালোকে নগাঁও’এর নেলীতে খুন হলেন ২১৯১ মানুষ ( বেসরকারী হিসেবে ৫০০০ এর’ও বেশী)। এঁরা মূলতঃ বাংলাভাষী মুসলমান। এঁদেরকে খুন করা হলো কেননা এঁরা চলেছিলেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। হয়তো আসামের অসমীয়া ‘প্রভু’দের পক্ষে ঐ ভোটাধিকারের প্রয়োগফল হতোনা তেমন সুবিধা জনক সুতরাং ঘটে গেলো এই গনহত্যা। অর্থাৎ ‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’ বলেও জান বাঁচাতে পারলেন না আসামের অনসমীয়া জনতা। এই মুহুর্ত্তে আমরা যারা ‘অফিসিয়ালি’ আসামের, বাস করছি বেঙ্গালোর এ , আমরা যারা নন্‌ট্রাইবেল, আমাদের কে কি জান বাঁচানোর জন্য  ‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’র প্রতিধ্বনি তুলে বলতে হবে ‘আম্‌গো বাসা কইলকাত্তা’? আর যদি বা তা বলিও তাহলেও কি আখেরে বাঁচবে জান? বাঁচলেও তা আর কতদিনের জন্য?
             না বেশি দিনের জন্য বাঁচবে না আমাদের জানও কেননা আসামের অসমীয়া ‘প্রভু’রা যখন অনসমীয়া মুসলমানদের দিয়ে  দিয়ে ‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’ বলিয়েছিল তখন তার উদ্দেশ্য ছিল আসাম থেকে অনসমীয়া মধ্যবিত্তদের উচ্ছেদ কেননা অসমীয়া ‘প্রভু’দের বিচারে তখন এ’ই মনেহয়েছিল, যে, অনসমীয়া মধ্যবিত্তরা’ই আসামের সমস্ত মধ্যবিত্ত সুলভ পেশা ইত্যাদি নিয়ে বসে আছে কাজেই এদের তাড়ালেই আসামে তাদের আর কোনো প্রতিদ্বন্দী থাকবেনা। সেই ‘অনসমীয়া মধ্যবিত্ত’দের নব্বই শতাংশই যেহেতু ছিল হিন্দু বাঙ্গালী সুতরাং  অসমীয়া প্রভু’রা যাকে বলেন ‘আসাম আন্দোলন’ তা মূলতঃ ছিল ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন। ( হ্যাঁ, কিছু অসমীয়া মানুষ এর প্রতবাদ করেছিলেন, নিগৃহীত হয়েছেন এঁরাও তবে এ’তে ‘আন্দোলন’এর চরিত্রের সংজ্ঞা বদলায় না)। সেই বঙ্গালখেদা’র আঁচে পুড়ে গিয়েছিল বরাক উপত্যকাও।
               সেসব পঞ্চাশের দশক আর ষাটের দশকের কথা। এরপর নেলী ঘটলো আশির দশকে। ঘটলো কেননা এবার অসমীয়া ‘প্রভু’রা টের পেলেন মধ্যবিত্ত নয়, নিম্নবিত্তদেরকে নিয়েই সমস্যা। কেননা বাঙ্গালী তাড়িয়ে যে কেরাণীর পদটি খালি হলো তাতে ঢুকতে ‘পাশ করিব লাগে’। কিন্তু মুটে-মজুর হতে গেলে তা লাগেনা। কাজেই এবার দেখো মুটে-মজুর কারা। সেই মুটে-মজুরের তালিকায় যেহেতু ছিল নেলীর মুসলমানরা তাই তাদের জান দিতে হলো এইবার। আমরা, আসামের বর্ণহিন্দুরা স্বস্তি পেলাম। যা বাব্বা। এবার লেগেছে অসমীয়ায় আর মুসলমানে। আমাদের নিশ্চিন্তি।
                কিন্তু এরও পরে আমরা দেখলাম, না, নিশ্চিন্ত থাকা গেলোনা। এলো ১৯৮৬। ২১ শে জুলাই। অগপ’র আমল। বরাকের করিমগঞ্জে চল্লো অনর্থক গুলি। মারা পরলো মানুষ। কেন? কেননা আমরা যেমন জানি, তেমনি জানেন অসমীয়া ‘প্রভু’রাও, বরাক উপত্যকা বাঙ্গালীর উপত্যকা। আমরা মনে প্রানে অনসমীয়া। তাইতো বার বার এতো ফরমান জারি “অহমীয়া মিডিয়ামে পড়িব লাগে”, “মাইলষ্টোনত্‌ অসমীয়া ভাহায় লিখিব লাগে”। কিন্তু তাতেও সাবুদ হয়না ‘বঙ্গাল বিলাক’। অতএব এই ‘উপত্যকা’টির মাজা না ভাঙ্গলে শান্তি নেই। ... যাই হোক, মাজা ভাঙ্গলো কি’না বোঝা গেলোনা, তবে ২১ জুলাই’র পর আবার কিছুদিন সব দিক রইলো থমথমে। বোড়ো ল্যান্ড ইত্যাদি আন্দোলন চলতেই থাকলো পাশাপাশি... কখনো ঢিমেতালে কখনো বেশ রমরমায় ...
                       তারপর? তারপর ২০০৩ সালে আবার দাঙ্গা। আসামে। এবারে লক্ষ্য বিহারের মানুষ। যেহেতু এই ঘটনাটি খুব বেশী দিন আগের নয় তাই Frontier এর Volume 20 - Issue 25, December 06 - 19, 2003 থেকে সামান্য তথ্য সূত্র দিয়েই ছেড়ে দিচ্ছিঃ
On November 9, candidates from outside the State who had travelled to Guwahati for tests conducted by the Railway Recruitment Board, Guwahati, for appointment to Class III and Class IV jobs (now re-designated Category C and Category D jobs) were prevented from writing their tests. According to some reports, they could not write their tests because some local aspirants for these jobs seized and destroyed their entry cards. Among those affected were candidates from Bihar and Tripura.

           অর্থাৎ  এবারে অসমীয়া ‘প্রভু’দের ধারনা হলো যে ‘বঙ্গাল বিলাক’কে তাড়ানো যখন গেলোই না তো এবার অন্যদের সঙ্গে ‘কাজিয়া’ বাধিয়ে দেখাযাক কতোদূর কি হয়। ... আর বেশী কাদা ঘাঁটবোনা, সোজা চলে আসবো সাম্প্রতিক ঘটনায় যেখানে দাঙ্গা বেঁধেছে বোড়ো আর বাঙ্গালী মুসলমানে আর সেই বাঙ্গালী মুসলমানদের ‘”নিয়ো এসামিজ্‌” ’ বলে ভূষিত করছেন আল্‌ফা নেতা পরেশ বরুয়াঃ “The ULFA leader said the violence has harmed the interest of the "greater Assamesse society". ... He also termed the Bengali-speaking Muslim immigrants from erstwhile East Bengal region as "neo-Assamesse".
আর তারি জেরে সারাদেশে ছড়িয়ে পরছে অস্থিরতা ...  
              বেঙ্গালোর ছেড়ে  যারা চলে গেছে, চলে যাচ্ছে তারা কারা? তারা কি আমার মতো ‘আইটি প্রো’? না। একদল ছাত্রছাত্রী আরেকদল নানান ফ্ল্যাটের বা মলের সিকিউরিটি বা এরকমই কোনো জীবিকা নির্বাহ করা মানুষজন যাদের ‘খেদা’ দিলে সেই শূন্যস্থানে সহজেই ঢুকে যেতে পারে কন্নড়, তামিল, মারাঠি ... মানে যে সব কাজ করতে ‘পাশ দিব নালাগে’ ... ঠিক যেমনটা ছিল অসমীয়াদের মাথায় নেলীর সময়ে বা পরে বিহারি নিধনের কালে ...
                     না, আমার, আমাদের, মানে অফিসিয়ালি ‘আসাম’এর বাঙ্গালীদের, বেঙ্গালোরে আপাততঃ বিপদ নেই। আমরা ‘মিড্‌ল্‌ ক্লাস’, আমরা টিঁকে যাবো। আমরা নিরাপদে বসে বড় বড় জাতিয় সংহতির বুলিও দেবো। ফ্ল্যাট্‌ করবো বেঙ্গালোর নইলে কলকাতায়। ...কিন্তু যারা তা নয়, যারা এই দেশের ৯৯ ভাগ, যারা অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত তারা বাঁচবে কিভাবে? আজ না হোক কাল টিঁকে থাকার জন্য হয় তাদের বলতে হবে ‘আম্‌গো বাসা কইলকাত্তা’ ... আর নাহলে আসামে থাকলে, মুখে কিংবা কায়দায়  ‘আম্‌গো ভাহা অহইম্মা’ বলে, ভূপেন হাজারিকা’কে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড় বলে সালাম ঠুকে ‘অহইম্মা’ হয়ে।
হ্যাঁ, এ’ই আমাদের, পূর্ব বাংলা থেকে  উদ্বাস্তু হয়ে আসা বাঙ্গালীদের নিয়তি।
[ সূত্রঃ
নেলীর হত্যাকান্ডঃ
http://en.wikipedia.org/wiki/Nellie_massacre
http://www.ummah.com/forum/showthread.php?203713-Recalling-Nellie-1983-Assam

কোন মন্তব্য নেই: