“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১২

মায়ের কাছে লেখা চিঠি

প্রতি,
       প্রধান শিক্ষিকা
        ৯২৩ মবারকপুর এল পি স্কুল।
        করিমগঞ্জ, আসাম

মা,    

       প্রথমে আমার শতকোটি সালাম নিবেন, আশা করি আপনারা সবাই আল্লাহর ফজলে ভালো আছেন, আমারা ও একপ্রকার কুশলেই আছি। পর সমাচার এই যে... 
ব্যাস আর মনে নেই। ভাবছ হঠাৎ করে এ কি, রোজ ই তো দু/তিন বার ফোনে কথা হয়, আজ হঠাৎ এমন চিঠি আর তা ও একেবারে খাঁটি সিলেটী ট্র্যাডিশনালে, মফঃস্বলইয়ানা কায়দায়। আরে আছে আছে, ব্যাপার একটা আছে। আর জানিয়ে রাখি যে এই চিঠি টা তুমি পড়ার আগে আরও অনেকে পড়ে নিয়েছে। কিভাবে পড়লো আর কেনই বা পড়লো সে না হয় পরে বলব।
         ভেবেছিলাম চিঠির শুরু টা আমার মত করেই করবো, কিন্তু শুরু করতে গিয়েই ওই ‘শতকুটি’ ওলা লাইন আর ‘পর সমাচার...’ যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল চারপাশে, যেন বিলুপ্তপ্রায় “চিঠি জনজাতিরা” খবরটা আগাম পেয়ে গেছে, যে আজ বহুকাল পর কেউ তাঁদের মনে করেছে, কেউ তাঁদের কে আবার লিখছে, একটা অস্রুসিক্ত চাঁপা আনন্দ ভাব যেন বেরিয়ে আসছে রঙ বেরঙের পকেট সাইজের টেলিফোনে গাঁথা কবর খুঁড়ে। আর আকশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে সেই প্রথম দুটি লাইন, ঐতিহাসিক সেই লাইন দুটো, যার একটার শুরু হতো এক কারখানা সালামের সাথে কুশল বিনিময়াদি দিয়ে আর পরেরটাতে থাকতো আজকালকার সংবাদ পত্রের “ঘটনার বিবরণে প্রকাশ” এর ন্যায় অতি সামান্য কোন ঘটনার অসামান্য আবেগ, পর সমাচার...দিয়ে যার শুরু। আর তাই কুনো কিছু চিন্তা করার আগেই লাইন দুটো আপনা আপনিই এসে ঠিক জায়গা করে নিয়েছে, আর আমি ও সসম্মনে ওদের বসিয়ে রেখে এগিয়ে চলেছি।
         জানি তুমি মুচকি হাসছ আর এও জানি যে তুমি মোটেই ভাবছ না যে আমি পাগল হয়ে গেলাম কি না। তুমি তো ভালো করে জানো যে আমার কাণ্ড, দুনিয়ার বাকিদের কাছে যার  আরেক নাম “খাইয়া কাম নাই”, কিন্তু তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। তোমার মুচকি হাসিতেই আমার ভুবন জয়। আরে হ্যাঁ ব্যাপার টা বেশ সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে, তাই আসল কোথায় আসি। কেন এ চিঠি? আসলে ব্যাপার টা কাল হঠাৎ করে মাথায় এল। জুম্মার  নামাজে যেতে যেতে কোত্থেকে যে হঠাৎ মোবাইল ফোন গুলোর উপর এমন রাগ উঠলো, ভাবতে লাগলাম কি এমন যন্ত্রণা, কথায় কথায় ফোন টেপা, এতো দূরে থেকেও ও সেকেন্ডের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া, আর জত্র তত্র এই যন্ত্রটার উপস্তিতি দেখে কেন জানি শুধু রাগ ই উঠছিল, ভাবতে লাগলাম কত ভালোই না ছিল আগের দিনগুলো, এরকম কুনো যন্ত্রণাকে পকেটে নিয়ে ঘুরতে হতো না। আর এমনটা ভাবতে ভাবতেই চিঠির কথা মাথায় এল। নামাজে কতটুকু খেয়াল ছিল বলা মুশকিল আর ফেরত পথে ঠিক করে নিলাম তোমাকে চিঠি লিখবো। ঘরে ফিরে মুচকি হাসিতে বউ এর কৌতুহলি প্রশ্ন, বললাম মা কে চিঠি লিখবো, ও একটু থতমত খেয়ে বলল আমার মা কে ও একটা লিখো।
          এবার বল, কেমন আছ? আজ স্কুলে গিয়েছিলে? আচ্ছা আমার এই চিঠিটা তোমার কেমন লাগছে? ভালো লাগছে তাই না? তোমার সাথে এখন আমি ও হাসছি। এ এক মজার অনুভুতি। রোজ ই তো কথা হয়, কই এমন টা তো হাসনি কোনদিন? আজ এই যে হাসছ, তাঁর যে কোন তুলনা হয় না, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এই হাসি। কি? বুঝলে এর রহস্য? রহস্য টা হচ্ছে এই চিঠি মা।  এই চিঠি। মনে পড়ে তোমাকে লেখা মেজ মামার চিঠি, কোনটা ফেব্রুয়ারির বাইশ তারিখে তো পরের টা নভেম্বরের সতেরয়। আর কখনও বছরে একটা মাত্র। কিন্তু কি সে আনন্দ সেই চিঠি গুলো তে, তুমি স্কুল থেকে ফিরে এসে ব্যাগ থেকে বের করে পড়তে আর পরে আমার পালা আসতো। আমি পড়তাম, আর আবার ও পড়তাম, বার বার পড়তাম। কিছুদিন পর আব্বার জরুরি কাগজ খুঁজতে গিয়ে বাজারের লিস্টের সাথে আবার ও সেই চিঠির সাথে দেখা, আবার পড়া শুরু। সেই তো আমার চিঠির সাথে প্রথম পরিচয়। “রাশিয়ার চিঠি” তে কবিগুরু আর “লেটারস ফ্রম ফাদার টু ডটারে” নেহেরু ততটা ভালো লাগেন নি, যত টা ভালো লাগতো মামার ওই চিঠি গুলো। আব্বার কাছে যে গুলো আসতো তাঁর তো বেশির ভাগই পোস্ট কার্ডে। হয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের, নয়তো ঐকতান কিংবা আর কোন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী থেকে। সেই চিঠি গুলোতে শুধু আব্বার নামের বানানটা মজার লাগতো। আব্বার অনুজরা আব্বাকে লিখত “মৈন্দা” বলে। আমার খুব হাসি পেত। আর কখনও কোন নব্য প্রতিষ্ঠিত মসজিদ মাদ্রাসার গৃহ নির্মাণের চাঁদার জন্য। কিন্তু আব্বার এমন চিঠিতে কোন আনন্দ হতো না যত টা হয়েছিল আব্বাকে লিখা উনার এক সহ শিক্ষকের চিঠি। সুদুর “চিটাগং ইন্টার মেডিয়েট কলেজ” থেকে যার এখনকার নাম বোধ হয় মহসিন কলেজ। যাই হোক সে চিঠিটির সবচেয়ে মজার ব্যাপার টা হয়েছিল চিঠিটা ভুলক্রমে বাংলাদেশেরই কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার এক স্কুল শিক্ষকের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। আর উনি চিঠিটা নিজের মনে করে পড়ে যখন বুঝলেন এটা ইন্ডিয়ার কোন এক করিমগঞ্জের, তখন নিজের সাফাই দিয়ে আরেকটা চিঠি যোগ করে আমাদের ঘরে পোস্ট করলেন। আব্বা তো পড়লেনই, অনেক খুশি ও হলেন। কিন্তু আমার জন্য এ যেন এক বাড়তি পাওনা। এ যেন একটার সাথে আরেকটা ফ্রী এর মত। কি সুন্দর ছিল সেই চিঠি দুটো আর কি ভাষা। বার বার পড়তে মন যেত। প্রথম চিঠিতে আব্বার সেই বন্ধুর নষ্টালজিক ভাবনা মেশানো প্রত্যেক টা লাইন যেন আমাকে নস্টালজিক করে তুলত। ভাবতে লাগতাম ইশ আমি যদি আব্বার জায়গায় থাকতাম।  আর ভালো লাগতো যখন তুমি বলতে তোমার ছোটবেলার চিঠি লেখার গল্প। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর নানা বসতেন তোমাদের নিয়ে মুককচঙ্গে থাকা নানার বাকি দুই ভাইকে চিঠি লিখার জন্য। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম চিঠিতে বাকি দুই খালার বানান ভুলের কথা আর তোমার নির্ভুল বানানের জন্য নানার আদর। আজ ও হাসি পায় যখন তুমি বলেছিলে যে তোমার এক মামা চিঠির শেষে লিখেছিলেন “ইতি তোমাদের মামা তোতন”।
            কি মজার দিন গুলো সে না মা?  তাই ভাবলাম চলো আজ একবার ফের সেই পুরনো দিনগুলো কে তাজা করি। এবার বলি কি ভাবে এই চিঠিটা আর ও কয়জন পড়ে নিয়েছে। আসলে তুমি তো জানোই আজকাল নতুন একটা নেশায় দেশ মত্ত। ফেসবুকের নেশা। তাই ভাবলাম চিঠিটা ফেসবুকে দেব। আমার কিছু বন্ধুরা আছে যারা হয়তো এমন চিঠিতে আনন্দ পাবে। হয়তো দু একজন ব্যস্ততার ফাঁকে কলম হাতে নিয়ে দু চার লাইন লিখে ফেলবে তাঁদের প্রিয়জনের উদ্দেশে। সাহস করে পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্ট ও করে ফেলবে, যেমন আমি এই চিঠিটি করবো। আর এভাবেই হয়তো এক হারিয়ে যাওয়া অভ্যাস কে কেউ কেউ ফের তাজা করবে। যাই হউক আর বিশেষ কি লিখিব। গতকাল কিছু চিংড়ি মাছ কিনেছিলাম, আজ রাত টা ওতেই কেটে যাবে। দুদিন থেকে এখানে আবাহাওয়া টা একটু ভদ্র। কিন্তু গরম পড়লেই মেজাজ ছেঁড়ে, ভাবি কেন বেঙ্গালোর ছাড়লাম। চেষ্টায় আছি আবার ফিরে যেতে। ভালো থেকো, আর আব্বাকে অতিরিক্ত লবন খেতে মানা করবে।
                                                                     ইতি
                                                                    । অপু।
                                                                     মাদ্রাজ
                                                                     ১৩ অক্টোবর, ২০১২
                                                     (c) Picture:ছবি

কোন মন্তব্য নেই: