“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১২

অসমের দেউরি জনগোষ্ঠীর বিবাহ পদ্ধতি:একটি অবলোকন



  ( হেমালক্ষী গগৈ,  তিনসুকিয়া মহাবিদ্যালয়ের অসমিয়া বিভাগের অধ্যাপিকা। লোটা লিখেছেন শিলচরের সুপরিচিত লোক সংস্কৃতি বিষয়ক কাগজ 'জাতিঙ্গা'র পরবর্তী সখ্যারন্যে)
.0 অবতরণিকাঃ
 সম হচ্ছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতির এক মিলন ক্ষেত্র। অসমে বসবাসরত প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষেরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে অসমে এসেছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে এই জনগোষ্ঠীগুলো এক সঙ্গে বাস করবার জন্যে ভাষা সংস্কৃতির দিক থেকে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। অস্ট্রিক, মোঙ্গলীয়, আর্য, দ্রাবিড় ইত্যাদি নানা নৃগোষ্ঠীগত উপাদানে অসমিয়া সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যদিও অসমে বসবাসরত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে নৃগোষ্ঠীগত আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এই বৈচিত্র তাদের সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিকে নজরে পড়ে।
                     নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ অসমের জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দেউরি জনগোষ্ঠী অন্যতম। নৃতাত্বিক বিচারে দেউরিরা মোঙ্গলীয় গোষ্ঠীর এবং ভাষাতাত্বিক দিক থেকে চিন-তিব্বতীয় ভাষা পরিবারের তিব্বত-বর্মি শাখার অন্তর্গত। আজকাল দেউরি জনগোষ্ঠীর মানুষ লখিমপুর, ধেমাজি, যোরহাট, শিবসাগর, ডিব্রুগড় ইত্যাদি জেলাতেই মূলত বাস করেন। দেউরিদের মধ্যে তিনটি শাখা আছে। এই ক’টি শাখা হচ্ছে দিবঙিয়া, টেঙাপনিয়া, বরগঞা। ২০০১ সনের আদমশুমারি অনুসারে অসমে দেউরিদের মোট জনসংখ্যা ৪১, ১৬১ জন। তার ২০, ৮০৯ জন পুরুষ এবং ২০, ৩৫২ জন মহিলা।
বিবাহ সমগ্র মানবজাতির এক সামাজিক অনুষ্ঠান। বিবাহের মধ্যি দিয়ে আধ্যাত্মিকভাবে আত্মা এবং দেহের পরিপূর্ণ মিলন ঘটে। প্রত্যেক সমাজের বিবাহ পদ্ধতি এক নয় ,যদিও তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিবাহ হচ্ছে এমন এক সামাজিক অনুষ্ঠান যার দ্বারা সমাকে এক পুরুষ এবং এক নারীকে সমগ্র জীবনের জন্যে পারস্পারিক দায়বদ্ধতা এবং বন্ধনের কিছু অধিকার উপভোগ করবার স্বীকৃতি দেয়। এই বন্ধন এবং অধিকার সমাজের পারস্পারিক বিধান দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। বিবাহ নারী-পুরুষ দু’জনকে স্বামী-স্ত্রী রূপে স্বীকৃতি দেবার উপরেও সমাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবার অধিকার প্রদান করে।

.০ দেউরি সমাজের বিবাহ পদ্ধতি
           অসমের অন্যান্য জনগোষ্ঠীগুলোর মতো দেউরি সমাজেও বিবাহকে এক প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এসছে। তাদের সমাজে বিভিন্ন ধরণের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মধ্যি দিয়ে প্রচলিত রীতি-নীতি মেনে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়। বিবাহের ক্ষেত্রে সমাজে তারা কিছু বিধি নিষেধ মেনে চলেন। একই শাখার মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। তার উপর বাবার ভাই-বোনের সন্তানের সঙ্গে পিসির ছেলে-মেয়ে মাসির ছেলে –মেয়ের বিয়ে হতে পারবে না। এই সম্বন্ধগুলোকে সমাজ কাছের সম্পর্ক বলে মনে করে। অন্যদিকে দিদি আর ছোট বোনের সন্তানেদের মধ্যে আর মামার সন্তানের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে অসুবিধে নেই। উল্লেখযোগ্য যে, অসমের খামতি, কার্বি, চিংফৌ, মিশিং জনগোষ্ঠীর মতো দেউরিদের মধ্যেও মামার মেয়েকে বিয়ে করাটা রীতি সম্মত। এমন বিবাহকে উত্তম বিবাহ বলে গণ্য করা হয়। অবশ্য, কোনো পুরুষ মামার মেয়েকে বিয়ে করবার ইচ্ছে না থাকলে অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে পারে।

.১ বিবাহের প্রকারঃ
            দেউরি সমাজে আনুষ্ঠানিক বিবাহের ব্যয়বহুলতা এবং উদযাপনের দিনের ভিত্তিতে তিন ভাগে ভাগ করা হয়।
() বর বিবাহ বা বাংলাতে বড় বিবাহ(দেমাচি বিয়া)
() মাজু বিবাহ বা বাংলাতে মধ্যম বিবাহ ( চচিবাচি বিয়া)
() সরু বিবাহ বা বাংলাতে ছোট বিবাহ ( চুরুবাচি বিয়া)
এই তিনরকম বিয়ের মধ্যে বড় বিবাহ স্বাভাবিক ভাবেই ব্যয়বহুল। বড় বিবাহ আয়োজন করতে বর –কনে দু’পক্ষককেই আর্থিক দিক থেকে সবল হতে হয়।বিয়েতে বরের ব্যয়ই সবচে’ বেশি। সাধারণত বড় বিবাহ তিনদিন, মধ্যম বিবাহ দু’দিন এবং ছোট বিবাহ একদিনে আয়োজন করা হয়। অভিবাবকের সম্মতি থাকলে মধ্যম বিবাহও আয়োজন করা যায়। এতে জাকজমক এবং ব্যয় দুটোই কম। অন্যদিকে ছোট বিবাহে ব্যয় আরো কম। এই বিয়েতে বরের বাড়ি থেকে কনের বাড়িকে ‘গা-ধন’ দিতে হয়। উল্লেখযোগ্য যে, বরগঞা, দিবঙিয়া, টেঙাপনিয়া—এই তিন শাখার মধ্যে বিবাহ সম্পর্কিত রীতিনীতিতে সামান্য তফাৎ থাকলেও মূলত পরম্পরাগত রীতিনীতিতেই বিয়ের কাজ সারা হয়। টেঙাপনিয়া এবং বরগঞা শাখার মানুষ দৈনন্দিন জীবনে দেউরি ভাষা ব্যবহার যদিও করেন না বিয়ের মন্ত্র উচ্চারণ করবার সময় কিন্তু দেউরি ভাষাই ব্যবহার করেন।

.২ বিবাহ অনুষ্ঠানের স্তরঃ
          দেউরি সমাজের রীতি অনুযায়ী সম্পন্ন আনুষ্ঠানিক তিনরকম বিয়ের বেলাতেই বেশ কিছু স্তর চোখে পড়ে। এই স্তরগুলো হচ্ছেঃ
) বিয়ের প্রারম্ভিক স্তর
) বিবাহের দিন ধার্য
) গা-ধন নির্ধারণ করা সম্মতি প্রদান।
) বিয়ের আয়োজন এবং নিমন্ত্রণ
) বিবাহ কার্য সম্পাদন।

..১ বিবাহের প্রারম্ভিক স্তরঃ
            দেউরি সমাজে বিয়ের প্রারম্ভিক স্তরে গোত্র এবং সম্বন্ধ বিচার করার পরেও সমস্ত দিক থেকেই মিল হলে বা দু’পক্ষ মেয়ে দেখতে যায়। মেয়ে না দেখে বিয়ের আয়োজন হতেই পারে না। দেখতে যাবার আগে কনের বাড়ির সঙ্গে দিনক্ষণ ঠিক করে নেয়া হয়। বরের বাড়ির হয়ে গ্রামের বা বংশের বয়োজ্যষ্ঠ জনা দুই ব্যক্তি মেয়ের বাড়ি গিয়ে শরাই এগিয়ে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কনের বাড়ির লোকেরাও বংশের অন্যান্য ব্যক্তিদের সামনে শরাই গ্রহণ করে। এবং মেয়ের মতামতও সবার সামনেই নেয়া হয়। কনে সম্মতি দিলে সেই অনুযায়ী বাড়ির অন্যেরাও সম্মতি দেন। মেয়ে দেখতে যাবার সময় বরের বাড়ির লোকেরা একটি পান-তাম্বুলের পোটলা , মদের ভাড় এবং মাছ নিয়ে যান। সাধারণত বিয়ে সুসম্পন্ন করবার জন্যে বরের বাড়ি থেকে দু’জন বিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ করে। একজনকে বলে ‘বর পাথরিয়া’ , অন্যজনকে ‘সরু পাথরিয়া। এই পাথরিয়া দু’জনেই বরের বাড়ির হয়ে কনের বাড়ি গিয়ে সব ঠিকঠাক করে আসেন। কনের মত নিয়ে মা-বাবা সম্মতি দিলে রীতি অনুযায়ী মদ বিলিয়ে সেই কাজ সম্পন্ন করা হয়। দেউরি সমাজে আঙটি পরাবার নিময় নেই যদিও এই নিয়মকে আঙটি পরাবার সঙ্গে তুলনা করতে পারি।

..২ বিবাহের দিন ধার্যঃ
          কনে দেখার পর বর-কনে দু’বাড়ির মধ্যে আনুষ্ঠানিক বিয়ের সূত্রপাত হয়। দু’বাড়ির সম্মতি সাপেক্ষে বড় বিয়ে না মধ্যম বিয়ে না ছোট বিয়ের আয়োজন হবে আর কবে কোন বারে হবে সেসব ঠিক করা হয়। বিয়ের যদি দীর্ঘদিন বাকি থাকে তা হলে বরের বাড়ি থেকে কনের বাড়িকে ‘বোজা দিয়া’ র রীতি আছে। সাধারণত বৈশাখ, অগ্রহায়ণ এবং ফাল্গুন মাসে ‘বোজা’ দেয়া হয়। এই ‘বোজা’ দেবার জিনিসগুলো হলোঃ পান-তাম্বুলের পোটলা, চাল, না ছাকা এক কলসি মদ, একটু মোরগ, লবন, তেল, লংকা, আদা, রসুন, একজোড়া শুকনো কুড়িমাছ মশলা ইত্যাদি। একটা নতুন বাঁশ বেতের টুকরিতে সব ক’টা জিনিস ভরিয়ে নতুন সাদা কাপড়ে ঢেকে জনা কয় যুবতী মেয়ে কনের বাড়ি যায়। উল্লেখযোগ্য যে এই মেয়েদের মা-বাবা জীবিত হতে হবে। এই প্রথাকে দেউরি সমাজে ‘বুজনি লেবা’ বলে । দু’একজন ‘ভকত’ সাক্ষী রেখে কনের বাড়ির লোকেরা এই ‘বোজা’ গ্রহণ করেন। বংশ পরিবার, আত্মীয় কুটুম্ব ডেকে এই ‘বোজা’ ভাঙা হয়। এবং বর-কনে দু’জনেরই ভবিষ্যত মঙ্গল এবং শুভমিলনের কামনা করে মদ বিলিয়ে আশীর্বাদ দেন।

..৩ গা-ধন নির্ধারণঃ
          দেউরি সমাজে আগে ‘গা-ধন’ দেবার নিয়ম ছিল। উভয় পক্ষের বোঝাপড়ার মধ্যি দিয়ে কনের বাড়ি থেকে ন্যুনতম কী পরিমাণ ‘গা-ধন’ চান সে সম্পর্কে এক স্পষ্ট সিদ্ধান্ত বরের বাড়িকে জানিয়ে দেয়া হয়। একটা বিয়েতে ঠিক কি পরিমাণ গা-ধন দিতে হবে তার কোন ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। যদিও ছ’কুড়ি ছটাকার বেশি নিতে মানা আছে।
১৮৮১সনের আদমশুমারির প্রতিবেদনে দেউরি সমাজে প্রচলিত ‘গা-ধন’ সম্পর্কে এরকম লেখা আছেঃ সাধারণত বাবা-মা ছেলে-মেয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত করেছিলেন। বিয়েতে ‘গা-ধন’ দেবার নিয়ম ছিল। কখনো বা ‘গা-ধনে’র মূল্য ১০০ টাকা অব্দি উঠেছিল। ছেলে-মেয়ের মনের মিল হলেও বাবা-মা বিয়েতে অনুমোদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু এমন বিয়েতেও ‘গা-ধন’ দেবার নিয়ম ছিল। ( Census Report of India, 1881, Assam, Chapter 11, p-17)
আজকাল এই প্রথা উঠে গেছে দেখা যাচ্ছে। উল্লেখযোগ্য যে, দেউরি সমাজে বরকে কনের বাড়িতে বিয়ের অনেক আগে থেকেই ‘গা-খাটি’ দিতে হতো। এই নিয়ম প্রাচীন কাল থেকে চলে এসছিল। এখন আর এই নিয়ম দেখা যায় না।

..৪ বিয়ের আয়োজন এবং নিমন্ত্রণঃ
          বিয়ের দিন বার ঠিক হবার পরেই বিয়ের আয়োজন শুরু হয়। বাড়ির কর্তা গ্রামের ছেলে-মেয়েদের ডেকে পান-তাম্বুল দিয়ে সম্মান জানিয়ে বিয়ের কাজে কর্মে সহযোগিতা করবার আহ্বান জানান। বিয়ের আসর সাজানো, মণ্ডপ- তোরণ ইত্যাদি তৈরি করা, বিয়ের নিমন্ত্রণ করবার জন্যে পান-তাম্বুলের পোটলা ( ঠিক খিলি নয় -অনুবাদক) বাঁধা ইত্যাদি কাজগুলো বিয়ের দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে হতে থাকে। নিমন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিয়ের চরিত্র ভেদে কিছু এদিক ওদিক হতে দেখা যায়। বড় বিয়ের নিমন্ত্রণের বেলা যেমন হয় মধ্যম বিয়ে বা ছোট বিয়েতে তেমন হয় না। সাধারণত বড় বিয়েতে নিমন্ত্রণ দু’টো পর্যায়ে করা হয়।
বিবাহিত মানুষের থেকে বৃদ্ধ বৃদ্ধা অব্দি একটা পর্যায়।
অবিবাহিত বা ছোট ছেলে-মেয়েদের বেলা অন্য আরেক পর্যায়।
এই বিয়েতে প্রতিটি বাড়ির কোনো সদস্যই যাতে বাদ না পড়ে তার জন্যে প্রতিজন সদস্য অনুপাতে বড়োদের জন্যে গোটা পান-তাম্বুল এবং ছোটদের জন্যে কাটা পান-তাম্বুল কিত্তাপাতাতে ( কৌ-পাতা) বেঁধে হাতে তুলে দেয়া হয়। বিয়েতে যিনি নিমন্ত্রণ করতে যান তাকে দেউরি সমাজে ‘চাকিয়া’ বলে। মধ্যম বিয়ে বা ছোট বিয়েতে একটা তাম্বুল-পান দিয়েই সবাইকে নিমন্ত্রন করা হয়।

..২ বিবাহ উদযাপনঃ
           দেউরিরা বিয়ের মণ্ডপ হিসেবে ঘরের চাঙের সঙ্গে আরেকখানা অস্থায়ী খোলা চাঙ জুড়ে দেন।( ঘরের মেঝে মাটি থেকে বেশ উপরে থাকে বলে এগুলোকে চাংঘরও বলে—অনুবাদক।) সেটিকে ‘মরং সজা’ বলে। বর- কনে ওঠা নামা করে বলে ঢোকার গেটখানা নিচে থেকে উপরে যাতে না দেখা যায় সেরকম করে কিত্তাপাতা দিয়ে বেঁধে দেয়। বিয়ের দিনে কিত্তাপাতা খুলে দিয়ে প্রথমে বর কনেকে সেদিক দিয়ে উঠতে দেয়া হয়। সাধারণত বরের বাড়ির লোকেরা কনের বাড়িতে মরং তৈরি করে দেবেন-- এটাই নিয়ম। অবশ্য, আজকাল আধুনিক সাজসরঞ্জামে বিয়ের মণ্ডপ তৈরি করা হচ্ছে।
সাধারণত বিয়ের আগের দিন জোরোণ (আশীর্বাদী ডালা) দেয়া সমাজের নিয়ম। আগে জোরণে মাশকলাই, হলদি, আয়না, চিরুনি, তেল , সিঁদুর দেয়া হতো। জামা কাপড় দেবার কোনো নিয়ম ছিল না। আজকাল কাপড় দেয়াটাও নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যেবেলা বর বা কনের কাছে বাঁশের ডালাতে অল্প চাল, একজোড়া তাম্বুল পান, মিঠা তেলের প্রদীপ একটা, পয়সা এবং ধূপ দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়। (একেও শরাই বলে—অনুবাদক) বিয়ের দিন ভোরেই বরের বাড়িতে বরকে আর কনের বাড়িতে কনেকে স্নান করিয়ে নেয়া হয়। ‘বেইঘরে’ ( অস্থায়ীভাবে নির্মিত স্নানঘর—অনুবাদক ) নিয়ে যাবার সময় সখিরা ছাতা মেলে ধরার নিয়ম। আগে আগে কেউ ডালা খানা নিয়ে যায়। পুরোনো কালে এই শরাই নেবার কোনো নিয়ম ছিল না। অন্য সমাজের সংস্পর্শে দেউরি সমাজেও এই নিয়ম চালু হয়েছে । বেইতে সাধারনত ঢোল-করতাল বাজিয়ে বর কনেকে বরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। বেই নির্মাণ করতে একটা শক্ত বাঁশ কেটে চারটা খুটা করা হয়। প্রতিটি খুটাতে একজোড়া তাম্বুল-পান আর চারটা কলাগাছের চারা দেয়া হয়। বাঁশের উপর কলাপাতা আর একটা ধনুক দেবার নিয়ম আছে।
          নির্দিষ্ট সময়ে ভকতদের দণ্ডবৎ করে প্রণাম জানিয়ে ঠাকুর ঘরে প্রণাম করে বরযাত্রীদল কনের বাড়িতে রওয়ানা দেয়। বড়বিয়ে হলে তিনটা ডালাতে সাজানো ভার আর টুকরি নেয় সঙ্গে। মধ্যম বিয়ে হলে দুটো, ছোট বিয়ে হলে একখানা ভার নেয়। প্রথমে ভার, তার পরে টুকরি নেয়া হয়। টুকরির পরে বরকে নিয়ে যাত্রা করেন বাকিরা।দুটো নতুন টুকরিতে ( একটা ছোট আর একটা বড়) চাল, মদ এক পাত্র, লংকা, আদা, হলুদ, তেল, লবন, শুকনো নালিতা পাতা( শুকতি), কচুশাক (পাতা), শুটকি, তাম্বুল পান, এবং একটা মোরগ ভরিয়ে নিয়ে যায়। টুকরিগুলো পিঠাপিঠি কিত্তাপাতাতে বেঁধে চাদরে (চেলেং ) ঢেকে নিয়ে যেতে হয়। এই টুকরি মা-বাবা বর্তমান এমন দু’জন মেয়ে মাথাতে করে বয়ে নিয়ে যায়। কনের বাড়ির লোকেরা বরকে বরণ করেন। ‘বড়পাথারিয়া’ তাম্বুল-পান দিয়ে বরকে মুক্ত করে আনেন। মূল তোরণের মুখে দুপক্ষের মধ্যে ‘নামতি’ যুদ্ধ একটা হয় (বিয়ের গানের খণ্ডযুদ্ধ। অনেকটাই আধুনিক অন্ত্যাক্ষরীর মতো।–অনুবাদক ।) । কনের পক্ষ নামতি হারলে তোরণে আটকাবার বাঁশ বা রশি কেটে বরপক্ষকে সভামণ্ডপে নিয়ে আসা হয়। আর বরপক্ষ হারলে তাম্বুল-পানের তাদের শরাই দিতে হয়। কনের বোন বরের পা ধুইয়ে মদ খাইয়ে বরণ করে। তারপর কনের ছোট-বড় ভাইরা বা ভগ্নিপতি বরকে পিঠে কাপড়ে করে বেঁধে তুলে সসম্মানে সমাজে বসান এনে। এরপর বর পক্ষ নির্দিষ্ট নিয়মে কনে পক্ষের সম্মানে আনা ভারগুলো উপহার দেন। বিয়েতে নিমন্ত্রিত লোকেদের সভাস্থলীতে বসতে দেয়া হয়। পুরুষ মহিলা বসবার জন্যে সভাস্থলীতে বড় কাপড়ে আড়াল দেয়া হয়। ভোজের খাবার বিলোনো শেষ হলেই বর-কনেকে সভাস্থলীতে নিয়ে আসা হয়। কনের বাপের বাড়ি থেকে যা যা উপহার দেবেন সবার সামনেই দেন। বর পক্ষ আর কনে পক্ষের দু’টো আলাদা আলাদা পানদান থাকে। কনের বাবা দেউরি পুজারী, বিয়ের অধিকারী, গণ্যমান্য আত্মীয়কুটুম্ব এবং নিমন্ত্রিত মানুষের সামনে হাঁটু ভেঙে হাতজোড় করে এই ভোজের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। সঙ্গে সঙ্গে বর-কনে উপস্থিত সবাইকে প্রণাম করে। উপস্থিত সবাই তাদের শুভমিলনের কামনা করে আশীর্বাদ দেন। বরকনে যখন মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করছে তখনি বর কনের সখিরা বরের গায়ের চাদর উঠিয়ে কনের গায়ে, আর কনের হায়ের চাদর উঠিয়ে বরের গায়ে পরিয়ে দেয় এবং দু’টো চাদরে গিঁট দিয়ে দেয়। বরকনের আশীর্বাদ নেয়া হলেই সবাই খাওয়া দাওয়া শুরু করেন। বর-কনের সখিদের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা আলাদা ঘরে করা হয়। খাওয়া দাওয়ার পর নিমন্ত্রিত ব্যক্তিরা কনেকে উপহার দেন আর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কনে কিত্তাপাতাতে বাঁধা একটা পান-তাম্বুলের পোটলা সবাইকে দিয়ে সম্মান জানায়।
          সবার খাবার হলে কনে বিদেয় দেবার পর্ব শুরু হয়। কনে প্রথমে সভাস্থলীতে রাধুনি, তার যোগালি থেকে শুরু করে বিয়েবাড়ির সমস্ত কর্মীদের প্রণাম করে মা-বাবার ঘরে গিয়ে মা-বাবাকে এবং পরিবারের বড়দের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। প্রণাম গ্রহণ করে মা-বাবা নতুন গামছা বা চাদর দিয়ে দীর্ঘায়ু কামনা করেন। এর পর কনে রান্নাঘরে গিয়ে লক্ষ্মী ( কোনো মূর্তি নয়, ধানের ছড়া ইত্যাদি মাঙ্গলিক সুতোতে বাঁধা থাকে। --অনুবাদক। ) নিয়ে সবার থেকে বিদায় মাগে আর স্বামীর বাড়ি যাত্রা করে। শেষবারের মতো সবাই মিলে কনেকে তুলে ধরে চাং থেকে নামিয়ে দেয়।
                দেউরি সমাজে বিয়ের অনুষ্ঠানে কনের প্রবেশের অনুষ্ঠানটি আচার বিচারের দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কনে বরের বাড়ি পাবার আগে থেকেই ঢোল করতাল বাজিয়ে বিহু নেচে বর-কেনেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বরের মা কাশার থালাতে পান-তাম্বুল সাজিয়ে ধূপ-ধুনা জ্বালিয়ে চাল ছিটিয়ে ছিটিয়ে গৃহপ্রবেশের জন্যে বরণ করে এগিয়ে আনেন। বরের বাড়িতে প্রবেশ করেই কনে প্রথমে ভাঁড়ারের লক্ষ্মীকে প্রণাম করে। তার পর তার পা ধুইয়ে নতুন তৈরি সিঁড়িতে সসম্মানে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে গৃহপ্রবেশ করানোটাই নিয়ম। কনের পেছনে পেছনে বর কিত্তাপাতা দিয়ে বেঁধে রাখা নতুন সিঁড়ি দিয়ে, নতুন হাতল ধরে ঘরে প্রবেশ করে। ঘরের চাঙে উঠেই দু’দিকে রাখা পেতলের কলসি দুটোতে হাত ডোবায়। কলসটির ভেতরে সোনা বা রূপা থাকে , সেগুলো কনে নিজের চাদরে তুলে নেয়। তারপর সোজা রান্নাঘরে গিয়ে ‘বরখুঁটা’তে ( রান্না ঘরের মাঝের বাঁশের প্রধান খুটা) প্রদীপ জ্বালিয়ে লক্ষ্মীকে ( মূর্তি নয়—অনুবাদক।) ছুঁয়ে প্রণাম করবার পরেই কনে বসবার জন্যে সাজিয়ে রাখা নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসে। কনে স্বামীর ঘরে প্রবেশ করবার পরেই সে বাড়িতে বিয়ে আরম্ভ হয়। বিয়ের দিনে যেমন কনের বাড়িতে হয়, তেমনি পরদিন বরের বাড়িতেওনেক ভোজের আয়োজন হয়। এই ভোজে পুরোহিত কনেকে বরে ‘গো-ভুক্ত’ করেন। উল্লেখযোগ্য যে কনের বাড়িতে কনের গোত্রচ্ছেদ করা হয়। কনে এবং তার সখি ভোজের ভাত সবাইকে বিতরণ করে। বরে বাড়িতেও সবাই খেতে শুরু করবার আগে খাবার আগে বর কনে উপস্থিত সবাইকে প্রণাম করেন আর উপস্থিত সবাই তাদের সুখী জীবনের জন্যে প্রার্থনা করে হরিধ্বনি দেন। এখানেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।
             দেউরি সমাজে মেয়ের সঙ্গে যৌতুক দাবি করতে দেখা যায় না। তবে বাড়ির কর্তা সাধ্য অনুসারে জামা কাপড়, বাসন বর্তন, তাঁত যন্ত্র ইত্যাদি দিয়ে থাকেন। আগে কনের সঙে জমিজমা, গোবাদি পশুও দিতেন। আজকাল এগুলো কেউ দেন না।

.০ গন্ধর্ব বিবাহঃ
            দেউরি সমাজে আনুষ্ঠানিক বিয়ে ছাড়াও গন্ধর্ব বিবাহ বা পালিয়ে নেয়া বিয়ের প্রচুর প্রচলন আছে। সাধারণত কোন ছেলে ও মেয়ের মনের মিল হবার পরেও যদি দু বাড়ির লোকেরা অসম্মত থাকেন বা অন্য কোন কারণে চুপি চুপি ছেলের সঙ্গে চলে যায় তবে তাকে গন্ধর্ব বা পালিয়ে নেয়া বিয়ে বলা হয়। দেউরি ভাষাতে ‘জনেনুমা বিয়া’। এই বিয়েতে কোনো অনুষ্ঠান আদি হয় না। অবশ্য, কনে বাড়িতে ঢোকার পর সেদিন বা অন্য যেকোনো দিন ছোট করে হলেও শূকর মেরে খাইয়ে আত্মীয়-পরিজন এবং প্রতিবেশীদের থেকে আশীর্বাদ নেবার চল আছে। এই অনুষ্ঠানকে ‘চুঝে লগুয়া’ বলে। লুকিয়ে চুরিয়ে যারাই বিয়ে করে তাদের এই রীতি মানতে হয়।
         দেউরি সমাজে বাল্য বিবাহের নিয়ম নেই। বিয়ের ক্ষেত্রে তারা পাত্র-পাত্রীর বয়সের জ্ঞান থাকাটা দরকারি বলে মনে করেন। বহুবিহাবের প্রচলনও নেই। সাধারণত এক স্বামী এক পত্নীই গ্রহণ করতে পারেন। সেই পত্নীর মৃত্যু হলেই শুধু অন্য বিয়ে করতে পারেন। তেমনি পত্নীও যদি স্বামীর মৃত্যুর পর অন্য স্বামী গ্রহণ করেন তাতে কোনো সামাজিক বাধা নিষেধ নেই। তবে, সেই বিয়ে আনূষ্ঠানিক হয় না। উল্লেখযোগ্য যে, দেউরি সমাজে অন্য জনগোষ্ঠীর মেয়ে বিয়ে করলেও সমাজচ্যুত করা হয় না। অবশ্য, বিয়ের পর বর-কনের গায়ে শান্তিবারি ছিটিয়ে মেয়েকে সমাজে তোলার প্রথা আছে।


উপসংহারঃ
          দেউরিদের বিবাহ পদ্ধতিতে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট চোখে পড়ে যদিও, আজকাল আধুনিকতার ছোঁয়াতে পরম্পরাগত রীতি-নীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন এসে গেছে। গ্রামাঞ্চলে যারা বাস করেন তারা যথাসম্ভব পরম্পরা মেনে চলেন। আর্থিক অসঙ্গতির জন্যে আনুষ্ঠানিক বিয়ের থেকে গন্ধর্ব বিয়েতেও আগ্রহ বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে শহুরে সমাজে যারা বসবাস করেন তারা অন্য সমাজের প্রভাবে নিজেদের আনুষ্ঠানিকতাতেও প্রচুর পরিবর্তন নিয়ে আসছেন।
--- -----


টীকা:
) গা-ধনঃ বর কনে পক্ষকে কনের মূল্য ধরে দেন।
) বোজা দিয়াঃ বরের বাড়ি থেকে কনের বাড়িকে তামুল-পানেরে কটা বাটা, এক কলসি মদ, একটা মোরগ, চাল ইত্যাদি উপহার হিসেবে দেন।
) গা-খটাঃ বিয়ের আগে বর কনের বাড়িতে কায়িক শ্রম দান করবার প্রথা।
) গো-ভুক্তঃ কনেকে বরের গোত্রে অন্তর্ভূক্ত করবার প্রথা।

গ্রন্থসূত্রঃ
) গগৈ, লীলাঃ অসমর সংস্কৃতি, বীণা লাইব্রেরী, পানবাজার, গুয়াহাটি, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৯০।
) গগৈ, লোকেশ্বরঃ অসমর লোকসংস্কৃতি, প্রকাশনদ্বয়-চাও দেবজিৎ বরা, না বন্দনা বরুয়া (গগৈ), ভূপালি, মধ্যপ্রদেশ, প্রথম প্রকাশ, ২০০৭।
) দেউরি, ষড়াননঃ দেউরী ভাষা সাহিত্য সমাজ , বীণা লাইব্রেরী, পানবাজার, গুয়াহাটি, প্রথম প্রকাশ, ২০০৭।
) দেউরি, ডম্বরুধরঃ দেউরী সংস্কৃতি, শিবসাগর, প্রথম প্রকাশ, ১৯৬৪।
) দেউরি, পদেধরঃ দেউরী সংস্কৃতির ইতিহাস, কিরণ প্রকাশন, ধেমাজি, প্রথম প্রকাশ, ২০০৮।
) পাটর, পদ্ম (সম্পা)ঃ জনজাতি সমাজ সংস্কৃতি, রিংচাং প্রকাশন, গুয়াহাটি, প্রথম প্রকাশ, ২০০৮।
) বরুয়া, বিরিঞ্চিকুমারঃ অসমর লোক সংস্কৃতি, বীণা লাইব্রেরী, পান বাজার, গুয়াহাটি, প্রথম প্রকাশন, ১৯৬১।
8) ভট্টাচার্য , প্রমোদ চন্দ্রঃ অসমর জনজাতি, অসম সাহিত্য সভার হয়ে খগেন্দ্র নারায়ণ দত্তবরুয়া, লয়ার্স বুক ষ্টল, পানবাজার, গুয়াহাটি, চতুর্থ প্রকাশ, ১৯৯১।
) রাজবংশী, পরমানন্দ(সম্পা)ঃ অসমিয়া জাতি আরু সংস্কৃতি, অসমিয়া বিভাগ, প্রাগজ্যোতিষ মহাবিদ্যালয়, গুয়াহাটি, প্রথম প্রকাশ, ২০০৩।
।বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর।

কোন মন্তব্য নেই: