“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১২

বিশ শতকের অনন্য সম্পাদক মোহম্মদ নাসিরুদ্দীন এবং বাংলা সাহিত্যের ‘সওগাত যুগ’


মোহম্মদ নাসিরুদ্দীন

প্রত্যাখ্যানের অন্য এক রাজনীতির কথাঃ
             “সংস্কৃতায়ন আর আরবি-ফার্সির দিকে ভাষাকে ধাবিত করবার রাজনীতি আমাদের বহু প্রাচীন, কিন্তু একে অতিক্রম করবার একমাত্র পথ কি মিলনের সরকারি বাঁধা বুলি আওড়ানো? পারস্পারিক অপরিচয়ের সমূদ্র কি কেবল কথা আর মিলনের গান গেয়েই অতিক্রম করে যেতে পারব আমরা? নাকি এর মাধ্যমে অসচেতন ভাবে নিজেরাই এক অন্যরাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছি আমি, আমরা? মিলনের তত্ব কি এই স্থিতাবস্থাকেই, সামাজিক ভাবে আরো বৈধ করে তুলছে না? সামাজিক ভাবে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহ এবং ডিভোর্সও যদি সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, তাহলে একই ভাষার দুটি সত্তার পারস্পরিক বিচ্ছেদ এবং সেই বিচ্ছেদকে মেনে নিয়েই পারস্পরিক সহাবস্থান কেন গ্রহণযোগ্য হবে না? একজন রবীন্দ্রনাথের যদি অধিকার থাকে বৈষ্ণব পদাবলীর এবং উপনিষদের ঘরানাকে প্রেরণার উৎস হিসাবে গ্রহণ করবার, তাহলে একজন মুসলমান কবিরও অধিকার আছে কোরানকে তাঁর লেখার অন্তহীন অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করবার। তাঁকে পাঠ করতে গেলে আমাদের পাঠকদেরও অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত কোরান।” কথাগুলো লিখেছিলেন কবি-প্রবন্ধিক অমিতাভ দেব চৌধুরী তাঁর ‘কবির বাড়ি’ বইতে ‘পরিচয়হীনতার আর্ত হাওয়া’ । বরাক উপত্যকা তথা সাধারণ ভাবে বাংলা সাহিত্যে অবহেলিত মুসলমান জীবন, সাহিত্যকৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে। ভালো ‘সাহিত্য’ স্থান-কালের ঊর্ধে চলে যায় বটে, কিন্তু সাহিত্যিক যে পাঠক, সাহিত্যতাত্বিকের মতোই এই সমাজেরই রোগ-শোক নিয়ে এক জীবন্ত মানুষ এবং ‘এক অন্যরাজনীতি চালিয়ে’ যেতে দক্ষ আমরা এটা প্রায় স্বীকারই করতে চাইনা।

               দীনেশ চন্দ্র সেনের সাহিত্যের ইতিহাসের বই পত্তর আজকাল সুলভ নয়। কিন্তু তাঁকে নাকচ করে গালগল্প বেশ চালু আছে । আমার কাছে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদিত ‘ময়মনি সিংহ গীতিকা’ আছে। অনেকের ধারণা দীনেশ সেন শুধু ওই জেলা থেকেই গীতিকাব্যগুলো জুটিয়েছিলেন। আসলে তিনি জুটিয়েছিলেন গোটা পূব বাংলা থেকেই। তাতে সিলেট কাছাড়েরও অনেক গীত আছে এবং এই বহু পরিচিত বইটি ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র ছোট সংস্করণ মাত্র। সুখময় সম্পাদিত বইটির কোথাও এর প্রথম প্রকাশক –সম্পাদক দীনেশ চন্দ্র সেনের একটিও বাক্য নেই। অথচ নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন এই লিখে, “ময়মন সিংহ গীতিকাকে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত করা যায় কিনা, সে সম্বন্ধে সংশয়ের অবকাশ আছে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের সময়সীমা অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। এই গীতিকাগুলি যে তার মধ্যেই রচিত হয়েছিল, তার কোন প্রমাণ নেই।” তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি ‘নদ্যার চান’ ইত্যাদি নামের উল্লেখ করেছেন এবং দুই একটিতে সুকুমার সেন উদ্ধৃত করে ‘মেঘনাদ বধে’র ভাষার ছাপ পড়েছে উল্লেখ করেছেন এবং শেষে ক্ষিতিশ চন্দ্র মৌলিকের সম্পাদিত আরেকখানা ‘প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র জালিয়াতির নথিপত্র দিয়ে শেষে লিখে দিয়েছেন, “ সুতরাং আমরা এদের সাহিত্যরস আস্বাদন করে পরিতৃপ্ত হতে পারি, এদের নিয়ে অন্য কোনভাবে গবেষণা করবার উপায় বর্তমানে নেই ।” বইটি যখন ছাত্রজীবনে পড়েছিলাম আমাদের মুগ্ধ করলেও তাঁর এই অভিমতের জন্যে সমস্ত জিজ্ঞাসাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। অনেক পরে যখন প্রশ্ন করতে শিখেছি তখনই ভেবেছি কই এইকথাগুলোতো এই পণ্ডিতেরা কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল নিয়ে বলেন না। খনার বচনের কথাতো আম জনতাও জানেন। ভাষা দেখে কি কেউ দাবি করে এগুলো বিশ শতকের বলে? দুষ্টামিটা এইখানেই। জনপ্রিয় সাহিত্যে গায়কের মুখে মুখে লিপিকারের , সংগ্রাহকের সম্পাদকের কলমে কালের আঁচ পড়েই যায়। আর ঠিক তাই এগুলো নিয়ে গবেষণার দরকারটা বাড়ে বই কমে না। দীনেশ সেন স্পষ্ট বলেছিলেন, এই সাহিত্যগুলো বাংলাদেশে বৌদ্ধবিস্তারের সময় থেকে লেখা, গাওয়া এবং শোনা হচ্ছিল। সেন ব্রাহ্মণ্যবাদ বাংলার পশ্চিমের যেখানে যেখানে জাঁকিয়ে বসেছিল সেখানেই এই ধারা শুকিয়ে যাচ্ছিল। এগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তার বাইরের পূবের লোকেরা। বিশেষ করে পরের কালের মুসলমানেরা। কেননা তারা এসছিলেন ব্রাত্য সমাজ থেকে আর এগুলো ব্রাত্য সমাজের গান।“নব্য –ব্রাহ্মণ্য যেসকল স্থানে সেন রাজত্বে প্রবেশ করিতে পারে নাই, সেই খানেই ইহাদের প্রাচুর্য, যেহেতু এই সকল পল্লীগীতিকা সেই সকল স্থানে বহুদিন রাজত্ব করিয়াছে।” ( প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান; পৃঃ ৯৪) পশ্চিমের লোকেদের অবজ্ঞা-উপেক্ষার আঁচ তিনি জীবৎকালেই প্রবলভাবে অনুভব করেছিলেন । এবং বহুবার সেই অনুভব ব্যক্ত করেছিলেন। তার একটি এই “এই সাহিত্যের নানাদিক হিতে বিচার করিলে দেখা যাইবে যে , তাহা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সর্ব্ব-সম্প্রদায়ের অতীব উপভোগ্য।শুধু তাহাই নহে, এই নিরক্ষর চাষাদের সাহিত্য এতো বড় যে , তাহার চূড়া বড় বড় শিক্ষিত কবিদের মাথা ছাপাইয়া উঠিয়াছে, আমি লিখিয়াছি পশ্চিম বঙ্গের লোকেদের মধ্যে অনেকেই এই সাহিত্যের গুণে ও অপরাজেয় কাব্য-সৌন্দর্যে মুগ্ধ। কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ আমার প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের জন্যে, কেহ কেহ বা পূর্ববঙ্গের প্রতি বিরূপতার দরুণ এই সাহিত্যকে তাদৃশ্য আদর করেন নাই। বিদ্বিষ্ট ব্যক্তিদের কথা ছাড়িয়া দিলেও এই গীতি সাহিত্যের ভাষা তাহাদের নিকট কতকটা দুর্ব্বোধ এবং শ্রুতিকঠোর । তজ্জন্য তাঁহারা সকলে ইহার রসাস্বাদনের অধিকারী হইতে পারেন নাই।” (ঐ;পৃঃ ৯০) এই সাহিত্যগুলোতে সেকালের হিন্দু মুসলমানের যুগলমূর্তির যে ধর্মবিশ্বাস সম্পর্করহিত চরিত্র দেখে দীনেশ সেন মুগ্ধ ছিলেন সেগুলোকে ব্রাহ্মণ্যপরম্পরা কোনোকালেই সহজভাবে নেয় নি। তিনি লিখছেন,“ এক শতাব্দী পূর্ব হইতে নব্য-ব্রাহ্মণ্য ধীরে ধীরে ভৈরব নদ পার হইয়া কংশ, ধনু এবং ফুলেশ্বরীর তীরদেশে প্রবেশ লাভ করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান একত্র হইয়া যে সাহিত্যের রসাস্বাদন করিয়াছে তাহা তাহাদের মনঃপূত হয় নাই। এই গাথা সংগ্রাহকগণ আমাকে জানাইয়াছেন, ‘এই সকল গীতিকথা এবং পালাগান উচ্চশ্রেণীর হিন্দুগণ অনুমোদন করেন নাঃ তাঁহারা তাহাদের বাড়ীতে এই সকল গান গাহিতে দেন না। ইহাতে প্রাপ্ত-বয়স্কা কুমারীগণের স্বেচ্ছাবর গ্রহণের কথা আছে । ব্রাহ্মণ ও ঠাকুর দেবতার প্রতি ভক্তির কথা নাই, ইহাতে ইতর জাতির নায়কদের প্রসঙ্গ আছে। এবং জাতি নির্বিশেষে নির্বিচার বিবাহ প্রথার কথা আছে।” ( ঐ; ৮০)

                  এর পরে কি আর আমাদের নতুন করে কোন আধুনিকতার তত্ব বিলেত থেকে আমদানী করবার দরকার ছিল? সে আধুনিকতা হোক প্রাক-রাবীন্দ্রিক কিম্বা ‘কল্লোলীয়’ উত্তর-রাবীন্দ্রিক! আমরা লিখব বিশ শতকের একটি বিখ্যাত কিন্তু ভারতে উপেক্ষিত কাগজ ‘সওগাত’ নিয়ে যেটি অবিভক্ত বাংলার সাহিত্যের ‘আধুনিকতা’র ধারক ছিল। আমাদের কথা বলতে হবে সাহিত্যের ‘আধুনিকতা’ নিয়ে। কিন্তু সে কোন আধুনিকতা? কল্লোল –কালিকলম বাদ দিন, মাইকেলের যে কাব্য-নাটকগুলো পড়ে আমরা বললাম, আধুনিক সাহিত্যের কেন্দ্রে থাকবে না ঈশ্বর কিম্বা ধর্ম ---থাকবে মানুষ, থাকবে না বিশ্বাসের কুসংস্কার বরং তার বিরোধিতা---‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র গল্প জানবার পর সেই আধুনিকতা দাঁড়ায় কিসের জোরে? হয়তো কাব্যগুণে মাইকেলের ‘সোমের প্রতি তারা’ অনেক বেশি উজ্জ্বল কিন্তু ভাববস্তুর দিকে ‘মঞ্জুর মা’ পালা কোন অংশেই হেয় ছিল কিসে? কিন্তু বিলেতিরা আমাদের শেখালেন তাঁরা আসবার আগে ইতিহাসের ধর্মান্ধতার একটা যুগ দেখতেই হবে চোখে আর বিলেতি ধাঁচে তার নাম দিতে হবে ‘মধ্যযুগ’ যার থেকে আমাদের মুক্ত করেছে বিলেতি শিক্ষা। ঈশ্বরের বদলে এবারে আমাদের আস্থা জানাতে হবে সেই শিক্ষার প্রতি। তাই আমাদের সাহিত্যের ঐতিহাসিকেরাও মোটের উপর তাদের বিশ্বাস ভরসাকে সারপানি যোগায় এমন সব গ্রন্থকে নিয়ে ব্যস্ত হলেন আমাদের ইতিহাসটাকে দাঁড় করাতে। এবং ধর্মান্ধতাকে প্রতিস্থাপন করল আরো বিপজ্জকনক বিষয়--- সাম্প্রদায়িকতা। আমরা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে সংগত ভাবেই তার প্রাপ্য মর্যাদা দিলাম , কিন্তু শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জুলেখা’কে নিয়ে সন্দিহান হলাম। পূর্ব বঙ্গের সাহিত্য নিয়ে প্রথম গবেষক দীনেশ চন্দ্র সেন যাই বলুন না, আমাদের আধুনিক গবেষককে লিখতেই হবে, “... ‘রূপবতী’তে হিন্দু নারীর প্রতি মুসলমান রাজপুরুষের কুদৃষ্টি এবং তার সাংঘাতিক পরিণাম বর্ণিত হয়েছে। এই পালাগুলি মুসলিম আমলের একটি তিক্ত বিষয়ের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।”( সুখময় মুখোপাধ্যায়;ভূমিকা; ময়মন সিংহ গীতিকা;পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ; ১৯৮২; প্রকাশক ভারতী বুক স্টল) এই মুসলিম আমলেরই অন্যনাম ‘মধ্যযুগ’ কে না জানেন? দীনেশ সেন সেই সেকালেই এই যুগবিভাজন নিয়ে প্রশ্ন তুলে লিখেছেন, “এই অবজ্ঞাত সাহিত্য শিক্ষিত সম্প্রদায়ের দ্বারা উপেক্ষিত। আমরা জনাকতক শিক্ষাভিমানী লোক ইংরাজির শিক্ষানবিশী করিয়া গত অর্দ্ধ শতাব্দীর মধ্যে যে একটি অর্দ্ধ-পক্ক সাহিত্যের সৃষ্টি পূর্বক তাহারই স্পর্দ্ধায় গগন-মেদিনী কাঁপাইতেছি, তাহাতেই বঙ্গ সাহিত্যের আদিযুগ ও মধ্যযুগ পরিকল্পনা করিয়া তৃপ্তিলাভ করিতেছি, অথচ এই সাহিত্যকে কেহ কেহ ফিরিঙ্গিয়ানা দুষ্ট বিকৃত সাহিত্য মনে করিয়াছেন। ( ঐঃপৃঃ ১০০)

                    সাহেবদের অনুমোদন না পেলে কোনো কথা গ্রহণ করে না বাঙালি—এই সত্য জেনে তিনি তাঁর পক্ষে প্রচুর প্রমাণ পত্র যোগাড় করেছিলেন সাহেবদের থেকে। এমন কি র‍্যোঁমা রোলা-র থেকেও। আমাদের পূর্বোত্তরেও কোন কথা ততক্ষণ না দাঁড়ায় যদি ‘আধুনিক’ পশ্চিমের মহানাগরিক বাঙালি তাত্বিকেরা সমর্থন না যোগান। সাধারণত আমি এই ‘পশ্চিমা’দের প্রতি ভক্তির বিরোধিতা করতে গিয়েই তাদের এড়িয়ে চলি। আমাদের যে সাহিত্য-কর্মীকে নতুন জিজ্ঞসা বিব্রত করে তাদের তুলে আনি। এখানেও তাই করেছি শুরুতেই। তবু, জাতে উঠতে গেলেতো কখনো প্রথার অনুগমন করতেই হয়। দীনেশ সেনের প্রতিধ্বনী এখন সর্বত্র শোনা যাচ্ছে সজোরে নতুন করে। আমারা দেবেশ রায়ের থেকে পড়াচ্ছি তার কতকটা, “...আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে ধ্বংস করে দিয়ে সম্পূর্ণ বিদেশী একটি ইতিহাসের কার্যকারণের শৃঙ্খলা সেই ধারাবাহিকতার ওপর অস্ত্রের জোরে চাপিয়ে দেয়া হলে আমরা তাকেও সাহিত্যের ইতিহাসে ও অন্যান্য ইতিহাসে আমাদের নিজস্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যকারণের সঙ্গেই মানিয়ে নিই। যেন বা ইংরেজের ভারত জয়টাও ঘটেছে সেই মহেঞ্জদড়ীয় ও আর্য বৌদ্ধ মৌর্য ভারতের ইতিহাসেরই নিজস্ব গতিতত্বে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চৈতন্য-উদ্দীপিত বৈষ্ণব সাহিত্যের ইতিহাসের পর ইংরেজ প্ররোচিত সাহিত্যের নানা ধরণের ইতিহাসের মধ্যে যেন কোন বিচ্ছেদ নেই। যেন চৈতন্য যে মানবীয় সাহিত্যের বাস্তব অবলম্বন তাই বিকশিত হয়ে উঠল উনিশ শতকে কবিতা, নাটক, উপন্যাসের নানা নতুনত্বে। ইতিহাসের ভেতর ধারাবাহিকতা আবিষ্কারের ঝোঁকে আমরা এ কথা ভুলে যেতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে ভারত বর্ষে ইতিপূর্বে যত বিদেশি শক্তি সামরিক দাপটে এসেছে সেগুলির অব্যবহিত সাংস্কৃতিক উপাদান ভারতীয় উপাদানে পরিণত হয়েছে কয়েক শ বছর ধরে আত্তীকরণের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। মাতৃগর্ভে ভ্রুণের বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে তার হয়তো কিছুটা তুলনা চলে। কিন্তু ইংরেজের কাছে সংস্কৃতির কোন আলাদা উপকরণ ছিল না। ইংরেজের সংস্কৃতি ছিল তার সাম্রায্যনীতির অপরিহার্য অংশ আর সে কারণেই ইংরেজের পক্ষে সম্ভব ছিল না শতাব্দীব্যাপী গর্ভাধান। ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর ইংরেক সংস্কৃতির সেই আরোপকে তুলনা করা যায় ধর্ষণের সঙ্গেই মাত্র—সে ধর্ষণের ফলেও গর্ভাধান হতে পারে বটে কিন্তু সে ভ্রূণ মানবিক শারীরিক নিয়মেই কেবল বড় হয়ে উঠে না, শরীরের বিকারের নিয়মেও বেড়ে ওঠে।“ ( দেবেশ রায়; বাংলা উপন্যাস;উপন্যাস নিয়ে;দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০৩, দে’জ পাবলিশিং; পৃঃ১৫)

           জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’কে নিয়ে রসিকতা করা আজকাল খুব কম বাঙালি পাঠক সহ্য করবেন। অনেকে মনে করেন তিনিই নাগরিক বাংলার মুখ ফিরিয়েছেন ‘ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে’। তিনিও পুরো বাংলার মুখ দেখেননি , দেখেছেন যা নগর দেখিয়েছে--এই কথাতো হজমই হবে না অনেকের। দীপেন্দু চক্রবর্তী সেই রসিকতাও করে রেখেছেন বছর কয় আগে। “ বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি;--তিনি আপন মনে আওড়াচ্ছিলেন। আমি বললাম, ‘বাংলার মুখ আমিও দেখিয়াছি। তবে সে অন্যমুখ।’ তিনি অবাক হলেন, ‘বাংলার কটা মুখ?’—বলুনতো কটা হতে পারে?—আমিতো একটাই জানি।–এ জন্যেইতো সর্বনাশটি হয়েছে। বাংলার কোনো মুখই নেই। জীবনানন্দ প্রায় মুর্ছা যাচ্ছিলেন। আমি শুধরে নিয়ে বললাম, ‘মানে মুখ থাকলেও তার কোন অবেজেকটিভ অস্তিত্ব নেই। ওটা Cultural Construct ---মানে যে যেমন ভাবে পারে বাংলার মুখ বানাতে পারে। ঠিক এই অর্থেই বাংলার মুখ একটা নয় একাধিক।” ( ফুকোমুখো বাংলা” উত্তর আধুনিক আবোল-তাবোল; অনুষ্টুপ;শারদীয় ১৪০৮)

সেই ‘সংবাদ প্রভাকরে’র দি ন থেকে বেরোনো অচেনা যত কাগজের কথাঃ

           মোহম্মদ নাসিরুদ্দীনের স্বপ্ন বেশি কিছু ছিলনা। ঐ ধর্ষণ-জাত আধুনিকতারই শরিক হবারই ইচ্ছে ছিল। এবং ইচ্ছে ছিল নতুন ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্তকে সেই দিকে আকৃষ্ট করবেন। তিনি ‘সওগাত’ কাগজ করেছিলেন। তাঁর মতে এটি সূচনা করেছিল বাংলা সাহিত্যে ‘সওগাত যুগে’র। নজরুলের জীবনী পড়তে গিয়ে আমরা ‘সওগাত’ কাগজের নাম শুনেছি স্কুল জীবনেই। কিন্তু সেটি আবার কোন ‘যুগে’র প্রবর্তন করেছিল তাও আবার কল্লোল-কালিকলম-কবিতা-র মতো শুনলে আমাদের ‘আধুনিকতা’ এখনো ভীরমী খাবে! কে সে নাসিরুদ্দীন! আমরা নামই শুনিনি! তাঁর বই ‘বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগে’ তিনি লিখছেন, আধুনিকতা যেমন করে শুনতে চায় তেমন করে, “বাঙালি মুসলিম সমাজের এক অন্ধকার যুগে—যখন অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতায় আমাদের সমাজ ছিল আচ্ছন্ন; মাতৃভাষা, সাহিত্য ও শিল্প –সংস্কৃতি ছিল অবজ্ঞাত; ধর্ম ও সমাজের নামে কতকগুলি বাধা নিষেধের বেড়া জালে জড়িয়ে ছিল বাংলার মুসলমান; যে কালে অধঃপতিত বাংলার মুসলমান সভ্য সমাজে আত্ম-পরিচয় দিতেও দ্বিধাবোধ করতো—সেই অন্ধকার যুগে সাহিত্যিক বা বিত্তশালী নয় এমন একটি অখ্যাত ও অজ্ঞাত মুসলিম যুবকের আধুনিক সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে চাঞ্চল্যকর অভিযানের ঘটনাবলী প্রকাশ করার ঐতিহাসিক মূল্য আছে বলে মনে করি” ‘আধুনিকে’দের যেমন দোষ –পূর্বতন সবাইকে হেলায় উড়িয়ে দেয়া --নাসিরুদ্দীনও তাই করেছেন এই লিখে, “মাতৃভাষা, সাহিত্য ও শিল্প –সংস্কৃতি ছিল অবজ্ঞাত...” তাঁর কাগজটি প্রথম বেরোয় ১৯১৮র নভেম্বর ডিসেম্বরে, ১৩২৫এর অগ্রহায়ণে। তার প্রায় এক শতক আগে থেকেই সেই ‘সংবাদ প্রভাকরে’র দিন থেকেই বেরুচ্ছে মুসলমান সম্পাদিত বাংলা কাগজ। ১৮৩১এ প্রকাশিত’ সামাচার সভারাজেন্দ্র’, যার নামে চেনা ‘মুসলমান গন্ধে’র ছিঁটেফোটাও নেই, ছিল কোনো মুসলমান সম্পাদিত প্রথম কাগজ। ফারসি-বাংলা দ্বিভাষিক ছিল। দ্বিতীয়-তৃতীয় কাগজের নাম ‘জগদ্দুদ্দীপক ভাস্কর’ ( ১৮৪৬), ফরিদপুর দর্পণ ( ১৮৬১) পারিল বার্তাবহ (১৮৭৩)। প্রথম যে আরবি নামের কাগজটি মেলে সেটি প্রখ্যাত মীর মুসারফ হুসেনের স্ত্রীর নামে, তাঁরই সম্পাদিত, ‘আজীজন নেহার’ ( ১৮৭৪)। এর পরেরটি আবার ‘সুধাকর’ (১৮৮৯)। সম্পাদক শেখ আবদুর রহিম। এনার পৌত্র পরের কালের প্রখ্যাত লেখক আনিসুজ্জামান। এনার সঙ্গে ছিলেন সেকালের আরো তিন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব মেয়রাজ উদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন, এবং আলিয়া মাদ্রাসার সংস্কৃতের পণ্ডিত লেখক চিন্তক রেয়াজ-অল-দীন আহমদ মাশহাদী। পরে কাগজটি মিহিরের ( ১৮৯২) সঙ্গে মিলে হয়ে যায় মিহির ও সুধাকর( ১৮৯৫)। এছাড়াও রহিম সেকালে অনেক গুলো কাগজে হয় সম্পাদক নতুবা সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে জড়িয়েছিলেন। সেগুলো ছিল হাফেজ ( ১৮৯৭), মোসলেম প্রতিভা, মোসলেম হিতৈষী (১৯১১) এবং ইসলাম দর্শন ( ১৯১৬)। এগুলো যে হিন্দুদের বিরুদ্ধাচরণ করবার জন্যেই বেরুচ্ছিল তা নয়। এরকম ‘হিন্দু হিতৈষী( ১৮৬৪) নামে কাগজও বেশ পুরোনো ছিল। এবং সেকালের লেখা লেখি পড়লে দেখা যাবে হিন্দু কিম্বা মুসলমান কোন পক্ষই পরস্পরের ধর্ম দর্শন নিয়ে কম মেতেছিলেন , বেশি চিন্তা ছিল ক্ষমতাধর খৃষ্টান মিশনারীদের প্রচারের বিপক্ষে আত্মপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা। এই যে প্রতিবেশি ধর্ম-দর্শন নিয়ে আলোচনার স্বল্পতা সেগুলো বরং অন্য সমস্যা দাঁড় করাচ্ছিল। দু’পক্ষই তখন ধর্মের নতুন প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিচ্ছিলেন আর নিজেদের পরস্পরকে চেনাজগতের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। মীর মোসারফ হোসেন গো-হত্যা বিরোধী প্রচারে যোগ দিলে ‘সুধাকর’ তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সেরকম ব্যাপার ঘটছে কম। আবার মিশনারীদের প্রচারের বিরুদ্ধে কলম ধরবার সবটা তাদের সংগে কাজিয়া করবার জন্যেও নয়, গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্যেও বটে। ১৮৯৮ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত থেমে থেকে কুষ্ঠিয়া থেকে বেরুতো ‘মাসিক কোহিনুর’। এর সম্পাদনা মণ্ডলিতে অনেক হিন্দুও ছিলেন। এবং কাগজটি সম্প্রীতির পক্ষে সওয়াল করত।এরকম আরেকটি কাগজ ‘ছোলতান’ ১৯০১ থেকে বেরিয়ে থেমে থেমে অনেক দুই দশকের বেশি বেরিয়েছিল। ১৯০৩ থেকে যাত্রা শুরু করে মাসিক ‘নবনূর’ এবং ‘মোহাম্মদী’। ‘মোহাম্মদী’ আহলে হাদিস পন্থী কাগজ ছিল, কিন্তু অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছেপেছিল এবং এই ‘নবনূরে’ই আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বেগম রোকেয়া হোসেনের। ‘নবনূর’ ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধাচরণে, নারী অধিকার এবং সাধারণ শিক্ষা বিস্তার এবং বাংলাভাষার মর্যাদার প্রশ্নে গুরুত্ব আরোপ করত। ‘মোহাম্মদী’ দীর্ঘজীবি ছিল এবং বেশ বিখ্যাত হয়েছিল। ‘সওগাতে’র মতোই কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করে মাঝে মধ্যে থেমে থেমে বেরোতে থাকে। দেশভাগের পর ঢাকাতে চলে যায়। এবং মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বেরোতে থাকে।

           রোকেয়া হোসেনের নামে আমাদের প্রগতিশীল হৃদয় স্পন্দিত হয় এখনো। কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হয় যেন, ইনিতো একক চন্দ্রমা ধর্মান্ধকার আকাশে। বাকিরা ভীষণ গোঁড়া। এই নিয়ে আমরা অন্যত্র লিখব। আমরা তাঁর বড় বোনের কথাটি পর্যন্ত ভুলে যাই। যাকে তিনি তাঁর ‘মতিচূর’ গ্রন্থের ২য় খণ্ড উৎসর্গ করেছিলেন। মীর মশাররাফ হোসেন তাঁর জমিদারিতেই ম্যানেজার ছিলেন এবং ‘বিষাদ সিন্ধু’র প্রথম সংস্করণ উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর অনুদানে প্রকাশ পেত ‘আহমদী’ (১৯২৩) নামে একটি কাগজ। সম্পদনা করতেন আব্দুল হামিদখান ইউসুফজয়ী। প্রথম মহিলা সম্পাদক বেগম সুফিয়া খাতুন এর দু’বছর আগেই চট্টগ্রাম থেকে বের করতেন কাগজ ‘আন নেছা’ ( ১৯২১)। নারী কল্যাণ এদের উদ্দেশ্য ছিল। সুতরাং রোকেয়া হোসেনও হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েন নি, যেমনটা ভাবা হয়। কিন্তু এই দশকেই বেরিয়ে ১৯৫২ অব্দি টিকে ছিল মহিলা সম্পাদিত যে কাগজ তার নাম ‘বর্ষবাণী’। সম্পাদনা করতেন জাহানারা বেগম চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুধীন্দ্রনাথ, লীলা মজুমদার থেকে শুরু করে আশাপূর্ণা দেবী তাঁর সেই কাগজে নিয়মিত লিখে গেছেন। সমকালের কোন প্রখ্যাত লেখকই বাদ পড়েন নি প্রায় তাঁর কাগজের লেখক তালিকা থেকে। বছরে একবার বেরুতো ঢাউস সাইজে। পূজা বার্ষিকী যেমন হয়। আমাদের ইতিহাস তাঁর সম্পর্কে একেবারেই নীরব। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ বেরিয়েছিল ১৯১৮র এপ্রিলে ‘সওগাতে’র বেশ কয়েক মাস আগে। মুজজফর আহমদ, মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ সেকালের বাঘা বাঘা পণ্ডিত সমাজ কর্মীরা এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রচুর হিন্দু লেখকেরাও লিখতেন সেই কাগজে। আরেকটি কাগজ ছিল মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় ‘মুসলিম ভারত’। এই কাগজের প্রচ্ছদে লেখা থাকত রবীন্দ্রনাথের একটি আশীর্বাণী, “ মানব সংসারে জ্ঞানালোকের দিয়ালি উৎসব চলিতেছে। প্রত্যেক জাতি আপনার আলোটিকে বড় করিয়া জ্বালাইলে তবে সকলে মিলিয়া এই উৎসব সমাধা হইবে।” এগুলোতে হিন্দু লেখকেরা লিখতেন বটে। পড়তেনও হয়তো। কিন্তু সাধারণ হিন্দুমধ্যবিত্তদের মধ্যে মুসলমান সম্পাদকের কাগজ পাঠক পেত না। নামে ‘মুসলমান’ না থাকলেও। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এই কাগজের এক প্রধান লেখক, যিনি পরে ‘সওগাতে’ গিয়েও তাই হবেন।

             সুতরাং নাসিরুদ্দীনের এই দাবি সত্য নয় বোঝা গেল, “মাতৃভাষা, সাহিত্য ও শিল্প –সংস্কৃতি ছিল অবজ্ঞাত।” আসলে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন একেবারেই অসাহিত্যিক এক প্রেরণা থেকে। স্কুলে পড়া বয়স থেকেই বই পত্তর পড়বার প্রতি তাঁর দারুণ আগ্রহ। কিন্তু মুসলমানের সম্পাদিত কোন কাগজে ছবিছাপা না দেখে তিনি বিব্রত বোধ করতেন। তাঁর পাড়া প্রতিবেশেও গান-নাটকের উপর নিষেধাজ্ঞা তাঁকে ভাবাতো। ছবিসহ কাগজ ছাপবেন এমন একটা আগ্রহ তাঁতে চেপে বসেছিল। এই ছবিটাও আসলে আম মুসলমান জীবনের ছবি নয়। যে স্কুলে তিনি পড়তেন সেটির নাম বলে দেবে, তাঁর এই প্রেরণার কারণটি কীঃ এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন । এগুলো আসলে ধর্মসংস্কারোন্মুখ, আসরাফ –আতরাফে ঐক্যস্থাপনে উন্মুখ নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছবি। তাতে তীতুমীরের 'তরিকা-ই-মুহম্মদীয়া' এবং হাজী শরীয়তউল্লাহের 'ফারায়েজী আন্দোলন' চাপ এবং তাপ কিছুটা থেকে থাকবে। নতুন করে তখন মধ্যবিত্তদের মধ্যে আহলে হাদিস পন্থাও জনপ্রিয় হচ্ছে। টুকটাক ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে তীতুমীর বা শরীয়তউল্লাহেরা যখন অনৈশ্লামিক সংস্কার ছাড়িয়ে মুসলমান জনতাকে এবং হিন্দু নিম্নবর্ণের কৃষকদের ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের বাইরে বের করে নিয়ে যেতে চাইছেন তখন শুধু যে সামন্তশ্রেণি বা বৃটিশ প্রশাসনই এদের বিরুদ্ধে নেমে পড়েন তাই নয়, যেকোন সংস্কারকের মতোই আম মুসলমানেরও নানা প্রশ্নকে মোকাবিলা করে তাদের এগুতে হচ্ছিল। নইলে মুসলমানেরা খুব গান করতেন, বাজনা বাজাতেন, যাত্রা পালাতে যোগ দিতেন। এমন কি ছবি ছাপানো বইপত্তরেও মুসলমানরা পিছিয়ে ছিলেন না কিছুতেই। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ছিল বটতলার বই আর বটতলাই যদিও বই ব্যাবসার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল নতুন মধ্যবিত্ত সেগুলোকে লুকিয়ে পড়লেও, প্রকাশ্যে ফিরেও তাকাতেন না। বিস্তৃত এখানে লিখবার সুযোগ নেই। আমরা সেরকম একটি বইএর ছবি এখনে তুলে দিচ্ছি। মুসলমান বড় মৌলবাদী এবং ধর্মান্ধ ছিল এই ধারণাকে নাকচ করবার জন্যে এই ছবিই যথেষ্ট। এই দেবতাকে চেনা আজকের যেকোন নব্য শিক্ষিত আধুনিক সংস্কারকের পক্ষেও বড়ই কঠিন।

               সিনেমা মানুষকে ধ্বংস করে এই বোধ টিভি আসবার আগেও ব্যাপক ছিল, দুই দশক আগেও উপন্যাসের বিরুদ্ধে কানাঘুসো শোনা যেত। মেয়েরা ‘থেটার’ করলে ভ্রষ্টা হয় এই সংস্কার দেশভাগের আগেও ব্যাপক ছিল সাধারণ হিন্দু উচ্চবিত্ত সমাজেও। মুসলমানদের মধ্যেও সমস্যা ছিল তারা সংস্কার পরবর্তী সমাজকে আরব্য ওয়াহাবী ধাঁচে গড়ে তুলবেন না সাহেবী বিলেতি ধাচে, অথবা দুটোই মিশিয়ে তৃতীয় কিছু । রামমোহনীয় বেদান্ত কিম্বা বিবেকানন্দের হিন্দুপুনরুত্থানবাদ শুরু থেকেই রাজনৈতিক ভাবে বিলেতি ধাচের সংগে একটা আপস করে নিয়েছিল, ঈদকে প্রতিস্থাপিত করে বড়দিন তাই হিন্দুদের কাছে গৃহীত প্রিয় উৎসব হয়ে উঠে , --—তাতেই বেশ কিছু গুণগত ভিন্নতা দেখা গেছিল, অন্যথা ব্যাপারগুলো মুলগত ভাবে একই ছিল । ইসলামের কোন সংস্কার যে বাংলানবজাগরণের ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদা পায়নি তার একটি কারণ অবশ্যই ছিল শ্রেণিগত। এই যেমন নববর্ষের দিনটিই ছিল খাজনা আদায়ের জন্যে নির্ধারিত। সেদিন জমিদারেরা রীতিমত উৎসব তথা মেলার আয়োজন করতেন। সেই উৎসবে বিচিত্র পুজা পার্বন গীত বাদ্য মদ জুয়া ইত্যাদি হতো। একে বলা হতো ‘পুণ্যাহ’ উৎসব। যাতে হিন্দু-মুসলমান প্রজা নির্বিশেষে যোগ দিতেন। স্বাভাবিক ভাবেই খাজনা প্রশ্নে যে কৃষকেরা বিদ্রোহ গড়ে তুলবেন তাদের এই উৎসবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। এবং এক বৃহত্তর ধর্মদর্শনের মোড়ক ছাড়া এগুলো সম্ভব হতো না। তীতুমীর বা শরীয়তউল্লাহেরা এগুলোই করেছিলেন। ফলে একদিকে যেমন খাজনার চাপে অতিষ্ট হিন্দু দলিত জনতাও তাদের সঙ্গ দিল, জমিদার মাত্রেই তাদের বিরুদ্ধে গেল। এবং ধর্মান্ধ বলে দেগে দিল। যা পরের কালে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাকেও সবল করে ফেলে। এই ভাবনাগুলোই পরে উঠতি মুসলমান মধ্যবিত্তদের মধ্যেও ছড়িয়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক ছিল। এদিকে যখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদে হিন্দু মোড়ক পরানো হচ্ছে, মুসলমান তার সঙ্গে মিশে যাবেন এটা আশা করাইতো ছিল অস্বাভাবিক। যে মীর মশাররাফ হোসেন প্রথম জীবনে ‘গোজীবন’ লিখে গো-হত্যা বিরোধী প্রচারে নামছেন, তিনিও পরের জীবনে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদে’ হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। এসব কারণেই ‘মিহির এবং সুধাকরে’ যখন নাটকের বিজ্ঞাপন এবং আলোচনা বেরুচ্ছে ‘ইসলাম প্রচারক’ তার প্রবল বিরোধিতা করে আশঙ্কা করছে এরা মুসলমান পাঠককে ঘোর ‘নরকে’ নিক্ষেপ করতে চাইছে।

চাঁদপুর থেকে কলকাতাঃ 'সওগাত যুগে'র শুরুর কথাঃ

          মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীনের সমস্যা দেখা দিচ্ছিল এই নব্য-মুসলমানদের নিয়ে এটা আমরা শুরুতেই বুঝে নিলে ভালো। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়াতে লেখা পড়া আধাতে ছেড়েই তাঁকে কাজের সন্ধানে বেরুতে হয়। স্টিমার ঘাটে কিছুদিন স্টেশন মাস্টারের চাকরি করে, বিমার ব্যবসাতে যোগ দেন। সামাজিক আপত্তি ছিল বিমা ব্যবসাতে। সেগুলো অতিক্রম করেই বেশ টাকার মুখ দেখছিলেন। বিয়েও সেরে ফেলেছিলেন তখনই। এগুলো ছিল প্রস্তুতি পর্ব। কিছু টাকা জমিয়ে নিজের বাড়ির কাছে চাঁদপুরে বইএর দোকান খুলে বসেন। তাঁর মানসিকতা বুঝতে নামটি গুরুত্বপূর্ণ-- ‘ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরী’। কিন্তু মুসলমানের লেখা বই পত্তরের অভাব তাঁকে ভাবালো খুব। ‘ভালো’ বই পত্তর কিচ্ছু নেই। যা আছে সবই বটতলার পুথি পাঁজি। ব্যবসা তিন বছরের বেশি চলল না, লোকসানে বন্ধ হয়ে গেল।

              কিন্তু এই লোকসান তাঁকে আরো জেদী করে তুলল। তিনি পূব বাংলার চাঁদপুর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে গেলেনে কলকাতাতে ‘ভালো’ কাগজ করবেন বলে।এবারে, ভালো কাগজ মানে, শুরুতেই যেটি হবে সচিত্র। অনেকেই হতাশ করলেন তাঁকে ‘গুনাহ’ হবে বলে। অনেকে সঙ্গও দিলেন। তার মধ্যে ছিলেন এক মৌলানাও। ইনি আগে থেকেই ‘দ্য মুসলমানস’ নামে একটি কাগজ সম্পাদনা করতেন। শুরুতেই একটি কোম্পানি খুলে কাজ শুরু করবেন ভাবলেন। নাম দিলেন ‘মোসলেম প্রিন্টিং এণ্ড পাব্লিশিং কোং’ কিন্তু জমবার আগেই এটি ডুবে গেল। টাকা লগ্নি করবার লোক বেশি পাওয়া গেল না। ফলে কোম্পানি উঠে গেল। সোজা ব্যক্তিগত মালিকানাতে ‘সওগাত’ নামে কাগজে হাত দিলেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল পুরো মুসলমান লেখকদের কাগজ হবে, কিন্ত পাঠক হবেন হিন্দুরাও। শুরুতেই ছবির চিন্তা। মুসলমান চিত্রশিল্পী পেলেন না, যাঁকে দিয়ে ছবি আঁকাবেন। গণেশ ব্যানার্জি বলে এক শিল্পীকে দিয়ে আঁকালেন। যেমন লেখা চাইছিলেন মুসলমানদের মধ্যে তেমন বেশি পাচ্ছিলেন না। হিন্দুদের দ্বারস্থ হতে হলো। সেকালের খ্যাত নামা অনেকেই লিখলেন, তারমধ্যে ‘ভারতবর্ষে’র সম্পাদক জলধর সেন, ঐতিহাসিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মানকুমারী বসু, কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের মতো কবিরাও। বেগম রাকেয়া সেই প্রথম সংখ্যাতেই লিখলেন কবিতা ‘সওগাত’। প্রবন্ধ লিখলেন, ‘সিসিম ফাক’। কায়কোবাদ, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী এমন বেশ কজন মুসলমান লেখকেররাও লিখলেন। কিন্তু এহ বাহ্য, এই কাগজ হৈচৈ ফেলল ১৮ খানা ছবি আর কার্টুনের জন্যে। তার মধ্যে বেশ কতকগুলো মানুষের ছিল। ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখলেন অনেকে। তার মধ্যে একটি ছিল ফরিদপুরের ফরায়েজী নেতা বাদশা মিয়ার লেখা। বাদশা মিয়াকে তিনি সহজেই ‘সওগাতে’র গ্রাহক করে ফেলেন। বাদশা মিয়া লিখেছিলেন ছবি ওয়ালা কাগজ ঘরে রাখলে নামাজ পড়া যাবে না। নাশিরুদ্দীন তাঁকে চিঠি লেখেন, যদি ইংল্যাণ্ড রাজার ছবি ওয়ালা টাকা রাখা ঘরে থাকতে পারে তবে ‘সওগাত’ নয় কেন? বাদাশা মিয়া হার মানেন। প্রথম সংখ্যা আমরা আগেই লিখেছি বেরিয়েছিল ১৯১৮র নভেম্বরে। ভারতীয় চিত্রকলার মোঘল ঘরানার কথা কি তিনি জানতেন না, নজির দিলেন না কেন, আমরা জানি না।

                  কিন্তু যে সম্মানে মুসলমান পাঠক এবং সমাজ তাকে বরণ করে নিল তার তুলনাতে প্রতিরোধ ছিল সামান্যই। পরের মাসেই ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র তৃতীয় অধিবেশন বসে চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি আমন্ত্রিত হন। এই সমিতির সম্মেলনে গিয়ে তিনি এক ছবি তোলার লোক ভাড়া করলেন। কিন্তু অধিকাংশি রাজি হন না ছবি তুলতে। বলে কয়ে কয়েকজনকে রাজি করলেন। নিজেও উঠলেন শেরওয়ানি-পাজামা পরে। পরের সংখ্যা ‘সওগাতে’ সম্মেলনের প্রতিবেদন বেরুলো সেই সব ছবি সহ। এই প্রতিবেদনই তাঁর প্রথম মূদ্রিত লেখা। এমনিতে খুব একটা তিনি লিখতেন না। কাগজের সম্পাদক হিসেবেও নিজের নাম জাহির করতেন না। প্রথম দু’চারটি সংখ্যাতে সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের। নিজের পরিচয় দিতেন জেনারেল ম্যানেজার বলে। পরে সাহিত্যবিশারদ তাঁকে বলে কয়ে সম্পাদক হিসেবে নাম লেখাতে রাজি করান। দ্বিতীয় সংখ্যাতে ২৭টি লেখার মধ্যে ২২টিই ছিল হিন্দু লেখকদের। রবীন্দ্রনাথও লিখলেন একটি কবিতা। সঙ্গে ‘সওগাত’ নামে একটি গদ্য। তখন টাকা নিতেন রবীন্দ্রনাথ লেখা দিলে। কিন্তু তাঁকে উৎসাহীত করতে শুরুতে টাকা দেবার কথা বললেও পরে বিনে পয়সাতে পাঠিয়ে দেন। পরেও স্বেচ্ছাতেই লেখা পাঠিয়েছিলেন বেশ ক’বার।

           
          দু’বছর চলবার পর ১৯২১এর মার্চ-এপ্রিল সংখ্যা বেরিয়ে দেনা আর পাওনাদারদের মামলার দায়ে কাগজটি বন্ধ হয় দিন কতক। আবার বীমা ব্যবসাতে নেমে তিনি দেনা শোধ করেন, বেশ কিছু টাকাও জমিয়ে ফেলেন। আবার বেরুতে থাকে ১৯২৬এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর তথা ১৩৩৩এর আশ্বিন থেকে। এই সময়ের মধ্যে একই চিন্তার আরো বেশ কিছু কাগজ বেরিয়ে পড়ে। তাঁর মধ্যে ১৯২২এর আগষ্টে বেরুনো নজরুলের ‘ধূমকেতু’ও রয়েছে। এবারে এবারে বেশ কিছু মুসলমান লেখক তিনি জুটিয়ে নিলেন। এর মধ্যে এস ওয়াজেদ আলিও ছিলেন যিনি ১৯১৯এ ইংরেজিতে Bulletin of the Indian Rationalistic Society নামে জার্নাল বের করেছিলেন। এ ছাড়াও মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ শাহাদাৎ হোসেন প্রমুখ ছিলেন। মাস কয় পরেই ১৯২৭এর নববর্ষে বের করেন ‘বার্ষিক সওগাত’। এর প্রথম সংস্করণ দু সপ্তাহেই ফুরিয়ে যায়। তিনটি সংস্করণ বের করে পাঠক চাহিদা মেটাতে হয়েছিল। এই সময়ে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তারের প্রসঙ্গ নিয়ে ‘মোহম্মদী’ আর ‘সওগাতে’ বেশ একটা বিতর্ক কমে উঠেছিল। ধীরে ধীরে ‘সওগাত সাহিত্য মজলিশ’ নামে এক আড্ডাও গড়ে তুললেন। বসত প্রথমে ৮২ কলুটোলা স্ট্রিটে পত্রিকা দপ্তরেই প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা। ১৩টি সংখ্যা কাগজ বেরুবার পর যে দপ্তর উঠে যায় ১১ ওয়েলসলি স্ট্রিটে। সেখানে তিনি পরিবার নিয়েও উঠে আসেন। দোতলা বাড়ির নিচেই নিজস্ব ছাপাখানা খোলেন।

                     কাজি নজরুল প্রথম বছরেই জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬ সংখ্যাতে ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ নামে গল্প লিখেছিলেন । দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম সংখ্যা থেকে নজরুলই হয়ে উঠেন ‘সওগাতে’র প্রধান লেখক। সে সংখ্যাতে বেরোয় নজরুলের বিখ্যাত ‘সর্বহারা’ কবিতাটি। ইতিমধ্যে তিনি বাংলা সাহিত্য জগতে পরিচিত হয়ে উঠলেও আর্থিক সমস্যার সুরাহা করতে পারছিলেন না। স্থায়ী আবাস বলতেও ছিল না কিছু। ১৯২৭এর মার্চে এলবার্ট হলে ‘নজরুল সাহায্য রজনী’র আয়োজন করেন নাসিরুদ্দীন। তাতেও সুরাহা না হলে মাসিক দেড়শ টাকা মাইনেতে তাঁকে ‘সওগাতে’ কাজ দেন। কাজ বলতে ছিল প্রতি সংখ্যাতে লেখা এবং বিকেলে আড্ডা দেয়া। নজরুল থাকতেন নলিনী কান্ত সরকারের বাড়িতে। সেখানে থাকার অসুবিধে হলে ‘সওগাত’ দপ্তরের উপরের দুটো কামরাতে বিনা ভাড়াতে নজরুলকে থাকার ব্যবস্থাও করে দেন। নজরুলের কবিতাতে আরবি ফারসি শব্দাবলীর বাহুল্যে মনে হয় নাসিরুদ্দীনের একটি ভূমিকা আছে। নজরুলকে তিনি মুসলমান সমাজে প্রচলিত শব্দ-বাগ্বিধি ব্যবহার করে মুসলিম সমাজ এবং বিষয় নিয়েই লিখতে বলেছিলেন। নজরুল তাতে ক্ষেপে গেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, কোনো জাতি-ধর্ম নিয়ে লিখলে তা আর যাই হোক কাব্য হবে না। নাসিরুদ্দীনের পালটা যুক্তি, মুসলমানের সমাজচিত্র এবং মুখের ভাষা বাদ দিলে বাংলার গণসাহিত্য গড়ে উঠবে না কোনদিন। নজরুল রাজি হলেন, কিন্তু জানিয়ে দিলেন ধর্মের নামে কোনো ভণ্ডামী চলবে না। নাসিরুদ্দীনের তাতে আপত্তি করবার কিছু ছিল না, উলটে তিনি এই ব্যাপারে নজরুলকে নেতৃত্ব দিতেই অনুরোধ জানালেন। ধর্মের নামে ভণ্ডামী আর একটি ধর্মীয় সমাজে প্রচলিত সমাজের ভাষা-বিষয়ের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটি আমাদের ‘আধুনিক’ মন এখনো বুঝে উঠতে দ্বিধান্বিত বহু সময়। নাসিরুদ্দীন বুঝতেন, কেননা তাঁর সামাজিক এবং ( ব্যবসায়িক বলতেও অসুবিধে নেই) বাধ্যবাধকতা ছিল। নাসিরুদ্দীন মুসলমান সমাজের উত্থান চাইতেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার দায় তাঁকে কোন শত্রুও দিতে পারেন না। একেতো ‘সওগাত’এর হিন্দু লেখকের তালিকা সবসময়েই দীর্ঘ ছিল। নজরুল ছাড়াও প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখকেরাও চাকরি করেছিলেন ‘সওগাতে’। নজরুলের জোরে এমন লেখকদের আড্ডাতে আসাটাও সহজ হয়ে গেছিল অনেকটাই। নজরুল অনেক সময় লেখা না দিয়ে পালাবার ধান্দা করতেন। একবার তাঁকে কামরাতে তালাবন্দি করে লেখা আদায় করবার সরস ঘটনাও ঘটেছিল। দু’জনের সম্পর্কই এমন গভীরতার পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ১৫ ডিসেম্বর , ১৯২৯এ সেই আলবার্ট হলে নজরুলকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেই সভাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ‘কল্লোলে’র সঙ্গেও যে ‘সওগাতে’র সম্পর্ক ঘনিষ্ট ছিল তার নজির হলো সেই সভার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন ‘কল্লোল’ সম্পাদক দীনেশ চন্দ্র দাস। নেতাজি সুভাষ বসুও সেই সভাতে বক্তৃতা করেছিলেন। নজরুল আসার পরেই এপ্রিল-মে ১৯২৮থেকে ‘সওগাত’ সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। সাপ্তাহিক কাগজটিও বেশ জনপ্রিয় হচ্ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবসায়িক এবং ভাবপ্রস্থানের প্রতিদ্বন্দ্বিরাও বসে ছিলেন না। নজরুল বিরোধী একটি শিবির ছিলই এরা তখন ‘মোহাম্মদী’র কে কেন্দ্র করে সরব হতে থাকে। নজরুল এবং ‘সওগাত’কে ইসলাম বিরোধী বলে চিহ্নিত করে আক্রমণ শানায়। নজরুলের যোগ দেবার মাস কয় পরেই ১৯২৮এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংখ্যাতে ‘সওগাতে’ সম্পাদকীয় লিখে জানানো হয় তাঁরা সংস্কার আনতে চান মুসলমান সমাজে , ইসলাম ধর্মে নয়। এবং ‘মোহম্মদী’কে এই কাজে সহযোগী বলেই বর্ণনা করেন। কিন্তু ‘মোহম্মদী’ পক্ষ তাতে শান্ত হয় নি , বরং চড়া এবং প্রচুর মিথ্যা স্বরে আক্রমণ চালাতে থাকে। কয়েক সংখ্যা ধরে দুই কাগজের মধ্যে উত্তর-প্রত্যুত্তরের পালা চলেছিল। নজরুল আসার আগে অব্দি দুই কাগজ পরস্পরের বিজ্ঞাপন ছাপাত বিনামূল্যে। কিন্তু সম্পর্ক খারাপ হলে ‘মোহম্মদী’ বিজ্ঞাপনের টাকা চেয়ে মামলা করে বসে আদালতে। আদালত একতরফা ডিক্রি জারি করলে আকরম খাঁ ছেলেকে নিয়ে ‘সওগাত’ অফিসে এসে পড়েন মেশিন ক্রোক করবেন বলে। সে যাত্রা তৎক্ষণাত ধার করে টাকা দিয়ে মান বাঁচাতে হয় নাসিরুদ্দীনকে। কিন্তু এই পুরো ঘটনা ‘সওগাত’এর খ্যাতি বরং বাড়িয়েই দেয়। নজরুলের আসন ‘সওগাতে’ আরো পাকা হয়। ইনি বেশিদিন কোথাও কোনোদিনই পাকা হতেন না। ‘সওগাতে’ পাঁচ বছর চাকরি করেন। পরে রেকর্ড কোম্পানিতে যোগ দিলে চাকরিটি ছাড়েন বটে কিন্তু লিখে গেছেন এই কাগজে অসুস্থ হবার আগে অব্দি। এ কাগজে শেষ কবিতা তাঁর বেরিয়েছিল মার্চ-এপ্রিল ১৯৪২ সংখ্যাতে। মুজফফর আহমেদকে বাদ দিলে নজরুলের সবচে’ ভালো বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ী ছিলেন এই নাসিরুদ্দীনই। ১৯৭৬এ নজরুল যখন মারা যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত শোক সভাতে সংগত কারণেই সভাপতিত্ব করবার ডাক পড়েছিল মোহম্মদ নাসিরুদ্দীনের।

             ‘মোহম্মদী’ টাকা পেয়ে সাময়িক সন্ধি করে নিলেও শত্রুতা ছাড়েনি কোনদিন। প্রখ্যাত মুসলমান সংস্কারক, ‘হিস্ট্রি অব দ্য স্যারসিন্সে’র লেখক বিচারপতি আমীর আলীর মৃত্যুতে শোকসভা আয়োজন করলেও ‘মোহম্মদী’ আমন্ত্রিতদের ভয় দেখায়। ‘সওগাত’, ‘শিখা’ ইত্যাদি কাগজের লেখিকা ফজিলতুন্নেসা প্রথম মুসলমান ছাত্রী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম হয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি বিলেত যেতে চাইলে নাসিরুদ্দীন টাকাও যোগান, ‘সওগাত’ কার্যালয়ে তাঁর সংবর্ধনা সভারও আয়োজন করেন। সেখানে ‘মোহম্মদী’ গোষ্ঠী রীতিমত গুণ্ডা লেলিয়ে দেয়। পরে আবার কুৎসা রটিয়ে সেই সংবাদ ছাপে নিজেদের কাগজে। সম্ভবত এই ঘটনা তাঁকে একটি নারী সংখ্যা বের করতে প্ররোচিত করে। লেখিকারা লিখতেনই সওগাতে। বেগম রাকেয়াতো ছিলেন ই, পরের কালের বিখ্যাত লেখিকা বেগম সুফিয়া কামালকে ‘সওগাতে’র সন্তান বললে ভুল বলা হবে না। আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ১৯২৯এ বেরোয় সেই নারী সংখ্যা। নাসিরুদ্দীন তাঁর বইতে দাবি করেছেন, এটি ভারতের প্রথম কোন কাগজের মহিলা সংখ্যা। এই সংখ্যাতে ৮৩টি ছবি ছিল। তার মধ্যে অনেকগুলো নারীর। লেখিকাদের এতোটাই উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন নাসিরুদ্দীন যে দেশ ভাগের ঠিক আগেই ২০ জুলাই , ১৯৪৭এ আরেকটি আলাদা এবং ঐতিহাসিক কাগজ ‘বেগম’ বের করতে শুরু করেন। কাগজটি শুরু থেকেই ছিল সাপ্তহিক। শুরুতে সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল , পরে সম্পাদনার দায়িত্ব নেন নাসিরুদ্দীনের মেয়ে নূরজাহান বেগম। তার আগে আরো একটি বিশাল উদ্যোগ নিয়েছিলেন নাসিরুদ্দীন। ১৩৪৪এর মাঘ মাসে, ১৯৩৮এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ‘শিশু সওগাত’ বলেও আরেকখানা কাগজ বের করেন। এটিও ব্যাপক ব্যবসা সফল কাগজ ছিল। এর গ্রাহক সংখ্যা বাইশ হাজারে গিয়ে পৌঁছেছিল। কিন্তু শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে এর আজ নামটুকুও উচ্চারিত হয় না। দেশ ছেড়ে যাবার আগে অব্দি কাগজটি বের করেছিলেন নাসিরুদ্দীন। কিন্তু এর পরে আর বেরোয় নি।

কলকাতা থেকে ঢাকাঃ 'সওগাত যুগে'র বাকি ইতিহাস এবং 'বেগমে'র ইতিকথাঃ

               দেশভাগ কেন অবিভক্ত বাংলার অধিকাংশ মুসলমান বৌদ্ধিক নেতৃত্বকে পূর্বপাকিস্তান নিয়ে গেলো সে নিয়ে আলাদা আলোচনা করবার এখানে সুযোগ নেই। নজরুলকেও যেতে হয়েছিল, যেতে হয়েছিল নাসিরুদ্দীনকেও। তবে কিনা এমনিতেও তিনি পূর্ববাংলারই লোক ছিলেন। সুতরাং তাঁর পক্ষে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। ঢাকার পাটুয়াটুলির বিজয়া প্রেসের মালিকের প্রেস এবং বাড়ির সঙ্গে নিজের প্রেস এবং বাড়ি বিনিময় করেন তিনি। ১৯৫০এর মে মাসে তিনি সেখানে চলে গেলেন। কিন্তু সেখানে ঊর্দু জাতীয়তাবাদের চাপে তাঁর কাজ অনেক কঠিন হলো। দিন কতক কাগজের কাজ বন্ধ রাখলেন। বাংলা সাহিত্যের জন্যে আরো বড়ো লড়াইএর জন্যে তাঁকে প্রস্তুতি নিতে হলো। এবং তিনি নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন। ১৯৫২তে ‘সওগাত’ বেরুবে বেরুবে এমন সময় ঢাকাতে ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চলল। ‘সওগাত’ অফিসকে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠিত হলো 'পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ'। ঢাকার সাহিত্য মহলের তিনি হয়ে উঠলেন মধ্যমণি।সংসদের সভাপতি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহ্‌মদ।এটি অনেকটাই দেশভাগের আগেকার 'প্রগতি লেখক সঙ্ঘে'র মতো ব্যাপার ছিল। সম্পাদকের পরিচয় দিলেই স্পষ্ট হবে। ফয়েজ আহমেদের সঙ্গে কলকাতা থাকতেই আলাপ হয়েছিল নাসিরুদ্দীনের। পাকিস্তান আমলে তিনি বামপন্থা আশ্রয়ের দায়ে বছর সাতেক জেলও খেটেছিলেন। ষাটের দশকে একসময় বিপ্লোবত্তর চীনে গিয়েও বেশ ক’বছর কাটিয়েছিলেন। মাও ৎসে তুঙের চিন্তাধারাতেও প্রভাবিত হয়েছিলেন অনেকটা। বেইজিং বেতারে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচলনেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন । ফয়েজ আহমদে মারা যান ২০১২র ফেবুয়ারীতে। সেই সংসদের যেকোন সভাতে তখন দুই আড়াইশজনের উপস্থিতি ছিল সাধারণ কথা। বেগম সুফিয়া কামালরাতো ছিলেনই, সেকালে যাদের হাতে বাংলা ভাষা সাহিত্য এবং আন্দোলন দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশে তাদের প্রায় সবাই সমবেত হতেন সেই সংসদে। যেতেন শামসুর রহমান, শওকত ওসমান,বদরুদ্দীন ওমর, আনিসুজ্জামান, মুনীর চৌধুরী, আশরাফ সিদ্দিকী, আল মাহমুদ, আবদুল হাই প্রমুখ অনেকে।

             ১৯৫০এর ডিসেম্বর থেকে ‘বেগম’ কাগজটি বের করতে শুরু করেন। ঠিক চার বছরের মাথাতে মহিলাদের নিয়ে একটি সংস্থা ‘বেগম ক্লাব’ও গড়ে তোলেন ১৯৫৪তে। ‘সওগাত’ আবার বেরুতে শুরু করে ১৯৫৩র নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে। স্বাভাবিক ভাবেই পূর্ব-পাকিস্তানের নতুন রাজনৈতিক পরিবেশে সমস্ত প্রতিবাদী প্রগতিশীল লেখকদের মুখপত্র হয়ে উঠে ‘সওগাত’। বিখ্যাত

                'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি ...', গানটির লেখক সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা ‘সওগাতে’এরই লেখক গোষ্ঠীর অন্যতম। তিনি ‘বেগমে’ চাকরি করতেন সেই সঙ্গে চালিয়ে যেতেন পড়াশোনা। ৫২র লড়াইতে লাঠির ঘায়ে আহত হয়ে বেশ কিছুদিন হাসপাতালেও ছিলেন। তখন বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমানকে পাঠান নাসিরুদ্দীনের কাছে। এই হাসান হাফিজুর ঢাকাতে যেন কাজি নজরুলের বিকল্প হয়ে উঠলেন। হাসান হাফিজুর লেখকদের টেনে আনতেও বেশ উদ্যোগী হয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪তে 'পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ' ঢাকার কার্জন হলে প্রথম সম্মেলন আয়োজন করতে সমর্থ হয়। ‘মোহম্মদী’ সেখানেও ‘সওগাতে’র পিছু ছাড়ে নি। এবারে তাদের সঙ্গ দিল ‘আজাদ’ বলে আরো একটি কাগজ। আর লড়াইর বিষয় হলো, বাংলা ভাষা, বাংলা হরফ, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং কাজি নজরুলের উপর দখলীস্বত্ব। এবারেও মামলা হলো। অভিযোগ গুরুতর। রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ধর্মদ্রোহিতা এবং কমিউনিষ্ট হবার অভিযোগ। একরাতে পুলিশ নাসিরুদ্দীনকে তুলেও নিয়ে যায়। বাড়িতে তল্লাসী চলে। পরে হতাশ হয়ে মুক্ত করে দেয়।

                   এ পর্যন্ত এসে পাঠক নিশ্চয়ই অনুভব করেছেন যে বিপুল ব্যবসা সফল এই উদ্যমী ব্যক্তিত্ব , যিনি কাগজের সম্পাদক হিসেবেও নিজের নাম ছাপতে কুণ্ঠিত ছিলেন নিছক ব্যবসায়ী ছিলেন না। নিছক ‘আধুনিকতাবাদে’র তাত্বিক বিলাসীও ছিলেন না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বাঘা-বাঘা সব কাগজ যেমন কল্লোল-কালিকলম-কবিতা-কৃত্তিবাসের কীর্তিগাঁথাতে সরব থাকতে পারে, কিন্তু এই মেঘনা পারের এই অসম উদ্যমী ব্যক্তিত্ব যেখানেই গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পুরো সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিজে বিশেষ লেখেন নি, কিন্তু এই ত্যাগের বিনিময়ে এক বিশাল লেখক এবং পাঠককুল তিনি গড়ে তুলেছিলেন। মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজে এবং পরের কালে বাংলাদেশের বৌদ্ধিক উত্থানে গোটা বিশ শতক জুড়ে তিনি রীতিমত নেতৃত্ব দিয়ে গেছিলেন মঞ্চের পেছনে থেকে।

               স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁকে সম্মান জানাতে কুণ্ঠা বোধ করেনি। যদিও যে শহরে তিনি জীবন শুরু করে তিনটি দশক কাটিয়ে গেছিলেন সেখানকার ‘প্রগতিশীল’ বৌদ্ধিক মহলও তাঁকে মনে রাখার সামান্য দায়ও স্বীকার করে নি কোনদিন, বাকিদের আর কী কথা। স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭৫এ তাঁকে বাংলা একাডেমী পুরস্কারে সম্মানিত করে। ১৯৭৭এ অর্পণ করে একুশে পদক এবং সেদেশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিবস রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। এছাড়াও নানা সম্মানে তিনি ভূষিত হন । ১৯৭৯র ১৬ নভেম্বর তারিখে, তাঁর ৯২তম জন্মদিনের দু’দিন আগে তাঁকে জাতীয় স্তরে সংবর্ধনা দেয়া হয়। জীবিতাবস্থাতে কাউকে সংবর্ধনা দেয়ার এটিই ছিল সেদেশে প্রথম ঘটনা। পরের বছরেও জন্মদিনের দিন কতক আগে ৩ নভেম্বর 'বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ' সহ ৩৩টি মহিলা সংগঠন তাঁকে সংবর্ধনা দিতে গিয়ে ‘নারীজাগরণের অগ্রদূত’ বলে সম্মানিত করে। ১৯৮৯ সনে তাঁর জীবিতাবস্থাতেই শতবার্ষিকী পালন করে বাংলাদেশ। সেবারেও তাঁকে জাতীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়। তিনি বেঁচেছিলেন সক্রিয় ছিলেন গোটা বাংলা চতুর্দশ শতক। মারা গেছিলেন ১৯৯৪ সালের ২১শে মে,৭ই জ্যৈষ্ঠ ১৪০১। ঢাকায় । তাঁর বয়স তখন ১০৬।

এবং এক নতুন শুরুর কথাঃ

      
নূরজাহান বেগম
       যিনি গোটা জীবন মঞ্চের পেছনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন, ১৯৭৬এ তিনি চালু করেন ‘নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক’। উদ্দেশ্য একটাই--- মৃত্যুর পরেও যেন বাংলাভাষা –সাহিত্যের প্রতি তাঁর সেবা স্তব্ধ না হয়ে যায়। নিজে পাওয়া পুরস্কারগুলোর অর্থমূল্যেই চালু হয় এই পদক। 'শিরি-ফরহাদ', 'আল্লার নবী মুহম্মদ (সা.)' , 'সওগাত যুগে নজরুল ইসলাম' ইত্যাদি নামে গুটি কয় বই তিনি লিখেছিলেন। ১৯৮৫তে যখন তাঁর বয়স ৯৭ তখন গিয়ে লেখেন ১৬০৩ পৃষ্ঠার বিশালবপু গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ’। হয়তো ‘বেগম’ তখনো বেরুচ্ছে বলেই নামে ‘বেগম যুগ’ কথাটা জুড়েন নি। তাঁর মৃত্যুর পর তিনখণ্ডে বেরিয়েছে ‘নির্বাচিত বেগমঃ অর্ধশতাব্দীর সমাজচিত্র ১৯৪৭-২০০০’। ‘বেগম’ এখনো বেরোয় । সম্পাদনা এখনো করেন তাঁর কন্যা নূরজাহান বেগম। যার জীবনও কম উপন্যাসোপম নয়। বাংলাদেশের ‘নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠ চক্র’ আমাদের অসমে পরিচিত সংগঠন, তার মুখপত্র ‘বরাক নন্দিনী’ এক দশকে বেশি সময় ধরে শিলচর থেকে বেরুচ্ছে । তাই উল্লেখ করা ভালো, সেই সংগঠন ১৯৯৬ তাঁকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ব্যাক্তিত্বের সন্মান জানায়। মনে হয় না নাসিরুদ্দীন কিম্বা তাঁর অতিবৃদ্ধা সুযোগ্যা কন্যা নূরজাহান বেগমকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য মঞ্চে এতো এতো লেখিকা এবং পাঠিকাদের উত্থান সম্ভব ছিল। ভারতে তাঁকে নিয়ে খুব কম হলেও লেখালেখি হয়েছে। মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায় ১৯৯৭এর মার্চে তাঁর ‘দেবাঞ্জলি’র প্রথম সংখ্যাতে ছেপেছিলেন নাসিরুদ্দীনের একটি সাক্ষাৎকার। শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত তাঁর একটি ছোট্ট পুস্তিকাতে ‘সওগাত’কে স্মরণ করেছেন। আর জাহিরুল হাসান তাঁর ‘বাংলায় মুসলমানের আটশো বছর’ বইতে “ ‘সওগাত’ পত্রিকাই শুধু নয়, একটি আন্দোলনের নাম” নামে একটি প্রবন্ধ রেখেছেন। আমাদের বর্তমান প্রবন্ধের তথ্যপাতির বেশিটাই জাহিরুল হাসানের বই থেকে নেয়া, বাকিগুলোর উৎস নানা আন্তর্জালিক সূত্র। আন্তর্জালে ঘেটে দেখলাম ড০ দিলীপ মজুমদার ‘সওগাত, রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলিম মানস’ নামে একখানা গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন সম্প্রতি ২০১০এ। আমাদের বর্তমান রচনা তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ বাড়াবার পথে একেবারেই প্রাথমিক সংযোজন মাত্র। যদি অন্যেরাও হাত বাড়ান তবে এক স্বতন্ত্র মূল্যবোধের সঙ্গে পরিচিত হবে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য। বিশেষ করে আমরা যারা প্রান্তীয় পূর্বোত্তরের বসে কাজ করি , আমাদের জন্যে এগুলো জরুরী বিষয়। প্রেরণার স্রোত। আধুনিকতার পশ্চিমা স্রোতে অবগাহন অনেক হলো, অনেক হলো অমিতাভ যেমন লিখেছিলেন ‘এক অন্যরাজনীতি চালিয়ে’ যাওয়া, এবারে না হয় হোক ‘ঘরে ফেরার গান’।

________________
কিছু দরকারি সংযোগঃ

কোন মন্তব্য নেই: