“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১২

ডুগডুগি বাজাই

শিবের গাজন কথাটা শুনলেই , আমার কেন যেন একটা উলট পালট ব্যাপার মনে হয় । মনে হয় , স্হিতাবস্থাকে পাল্টে দেওয়ার নামই গাজন । মাঝে মাঝেই যখন মেয়েকে শোনাই , “আমরা দুটি ভাই / শিবের গাজন গাই “ , তখন দুই ভাই কথাটার চেয়েও , শিবের গাজন কথাটাতেই জোর বেশি পড়ে । আর এই ছড়ার এটুকু পড়লে মনে হয় , শিবের কীর্তিগাঁথা গাওয়ার নামই গাজন । 
          শিবঠাকুরের যা চেহারা , পোষাকআশাক , চলনবলন , তাতে ভদ্রসমাজে তার তেমন প্রভাবপ্রতিপত্তি থাকার কথা নয় । বরবেশী তাকে দেখে শ্বাশুড়ি সনকাকে ঘোমটা টানতে হয় লজ্জ্বায় , কারণ জামাই নেংটা । এতদূর প্রথাবহির্ভূত যার চলন , তাকে স্বীকার করে নিতে প্রথাগত সমাজ দুটো কারণে বাধ্য হয় , এক তার প্রথাবিরোধীতা যদি বেশিরভাগ মানুষের সমর্থ পায় , অথবা সেই প্রথা বিরোধিতা সমাজকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে । 
        শিবঠাকুরের ক্ষেত্রে দেখা গেছে , প্রথম থেকে এখন অব্দি তার ভক্তরা ঠিক যাকে বলে সামাজিক ভদ্দরলোক তেমন নয় । সমাজ যাদের নিম্নবর্গ বানিয়ে রেখেছে , হাড়ী , মুচি , বাগদী , শব্দকর , মালাকর , কৈবর্ত , জেলে-মালো শ্রেণীর লোকেরা , তারাই তার ভক্ত । শিবের গাজন বা চড়কের মূল অনুষ্ঠানটা হয় চৈত্রমাসের সংক্রান্তিতে । একমাস , অর্থাৎ পুরো চৈত্রমাস মানত রেখে , গেরুয়া বা লালশালু কাপড় পড়ে শুদ্ধাচার পালন , ভিক্ষান্নে একবেলা হবিষ্যান্ন ভোজন করে জীবনধারণ করে,  একধরণের আত্মসংযম আর আত্মপীড়নের মধ্য দিয়ে গৃহীরাও সন্ন্যাসজীবন যাপন করতেন । তাদের বলা হতো ভক্তা বা সন্ন্যাসী ।এখন এই যে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করা নিম্নবর্গের মানুষ , গাজনের নাচ বা গান গাইছেন , এর সঙ্গে প্রথাবিরোধিতার একটা যোগসূত্র খোঁজার কারণ কি শিবঠাকুরের নামটাই ?
            উনিশ শতকের “কলিকাতার ইতিবৃত্ত” য়ে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত জানিয়েছেন , “ গাজনের সন্ন্যাসীদিগের মধ্যে হাড়ী , মুচি , বাগদী প্রভৃতি ইতরজাতীয় লোকেরাই বাণ ফুঁড়িত , উপবীতের ন্যায় একগোছা সুতা গলায় পরিধান করিত “,  এই উপবীতধারণ করার         ব্যাপারটাই তো সামাজিকভাবে একধরণের প্রথাভাঙা বা প্রথাবিরোধীতা । যা কোনও অর্থেই উচ্চবর্গের মানুষের কাছে স্বস্তিদায়ক ছিল না । তবু কৃচ্ছসাধনের এই একমাস ব্রাহ্মণ ছাড়া অনেকেই তাদের প্রণাম করতো , আদরের সঙ্গে ভোজন করাতো । 
         হুতোমের নকশায়ও দেখা যায় ,-“বুড়ো মূল সন্ন্যাসী কানে বিল্বপত্র গুঁজে , হাতে এক মুটো বিল্বপত্র নিয়ে , ধুঁকতে ধুঁকতে বৈঠকখানায় উপস্থিত হলো ; সে নিজে কাওরা হলেও আজ শিবত্ব পেয়েছে , বাবু তারে নমস্কার কল্লেন ; মূল সন্ন্যাসী এক পা কাদাসুদ্ধ ধোব ফরাশের উপর দিয়ে বাবুর মাতায় আশীর্ব্বাদী ফুল ছোঁয়ালেন ,--বাবু তটস্থ !” তাহলে দেখা যাচ্ছে , হাড়ী , কেওট সম্প্রদায়ের মানুষ , যারা সামাজিকভাবে নিম্নবর্গ হিসাবে পরিচিত , তারা চৈত্রমাসব্যাপী শিবের গাজন গাওয়ার মাধ্যমে , সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধাচারণ করেও , একধরণের সামাজিক মর্যাদা আদায় করে নিতেন । 
            এতসব কথা মনে এলো যদিও , মেয়েকে শোনানোর মতো নয় । আর বললেও আমার এই ছোট্ট মেয়ের এতসব বোঝার বয়সই হয় নি । তাই নিজের মনে মনেই আওড়াই , কোন দুটি ভাই , এই শিবের গাজন গাইছি ? 
          
         শিবের দুই অনুচর ,-নন্দী ভৃঙ্গী ? নাকি কার্তিক গনেশ ? ছড়াটি তো সোজাসুজি বলছে দুই ভাই শিবের গাজন গাইছে । তাদের ঠাকুমা গয়া-কাশী গেছে , তারা ডুগডুগি বাজাচ্ছে । ডুগডুগি বা ডমরু কোনও অভিজাত বাদ্যযন্ত্র নয় । শিবের বাদ্যযন্ত্র । ছোটবেলায় ডুগডুগি বাজানো দুইধরণের লোক দেখেছি । শোনপাপড়িওয়ালা আর ভালুকনাচ দেখানেওয়ালা । এদের যে কেউ ডুগডুগি বাজালেই পেছন পেছন ছুট লাগাতাম । আর এরা কেউ সামাজিকভাবে উঁচুস্তরের লোক ছিলেন না । অথচ যে দুইভাই ডুগডুগি বাজাচ্ছে , তাদের ঠাকুমা যদি গয়া-কাশী নামের তীর্থে গিয়ে থাকেন , তবে তারা যে খুব একটা নিম্নবর্গীয় কেউ নন , তা স্পষ্ট । এই দুইভাইয়ের জট ছাড়ানোর আগে , গাজনের এই প্রথা বিরোধিতার উৎসটা একটু গভীর থেকে বুঝে নেওয়া দরকার । 
          বৈদিক ভারতে অথর্ববেদের আগে শিব ঠিক ততটা আর্যীকৃত হন নি । রবং দক্ষরাজার যজ্ঞে শিবকে আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়টি , আর্যঅহমিকার চিহ্ন হয়ে থাকলো । পরবর্তী দক্ষযজ্ঞ বিনষ্টিকারী শিব এবং শিবগণ ভীতিপ্রদ ও অনিষ্টকারী হিসাবেই স্বীকৃত হয়েছিল । আজকের মতো তখনও , শিব মূলত নিম্নবর্গীয় মানুষদেরই পূজ্য ছিলেন । 
        বৈদিক সমাজের যাগযজ্ঞে ঋষিরা ইন্দ্র , মিত্রবরুণ , ব্রহ্মার উদ্দেশ্যে হোম করতেন । ঋষি ব্রাহ্মণেরা ছিলেন উচ্চবর্গীয় , বেদ গান ও শ্রবনের অধিকার ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ব্যাতিরেকে আর কারও ছিল না , অর্থাৎ বেদ যদি জ্ঞান হয় , তবে সেই জ্ঞানের আওতা থেকে বাইরে ছিলেন নিম্নবর্গীয় মানুষ । আর এটাই ছিল সামাজিক প্রথা । 
         সেই বৈদিক আমলেই , একদল ব্রাহ্মণ ঋষি এক আন্দোলনের সৃষ্টি করেছিলেন । ঋষি জরৎকারুকে মনে পড়ে ? এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়ান । পূর্বপুরুষদের অনুরোধে বংশরক্ষার জন্য বিয়েতে রাজি হলেন , কিন্তু শর্ত এই , মেয়ের নাম হতে হবে তার নামে ।  পুরাকথায় মনসা জরৎকারুর স্বামী  এই ঋষি জরৎকারু “যাযাবর”গোত্রের ব্রাহ্মণ । এদের বলা হতো “ব্রাত” । এই ভ্রাম্যমান দলের সকলকে বলা হতো “ব্রাত্য” । তাদের গাওয়া সামগানের নাম “ব্রাত্যস্তোম” । 
          এই ব্রাত্যস্তোম বা সাম গানের যে বর্ণনা পাওয়া যায় , তাতে মনে হয় , “ব্রাত্যস্তোম” হয়তো একধরণের শুদ্ধিযজ্ঞই ছিলো । প্রথা অনুযায়ী বৈদিক যজ্ঞে মাত্র একজনই যজমান থাকে , কিন্তু “ব্রাত্যস্তোম”য়ে হাজার হাজার যজমান থাকতে পারতো । সকলেই “ব্রাত্যস্তোমের পর পবিত্র হতেন এবং ঋষিদের সঙ্গে একত্রে খেতেন এবং রান্না করে খাওয়াতে পারতেন । ঋষিরা যজমানদের তিনবেদ পড়তে দিতেন । এই যে প্রথাবিরোধী একদল ব্রাহ্মণ , সমাজিক নর্মসের তোয়াক্কা না করে , চন্ডাল ব্রাহ্মণ সবাইকে সবাইকে সমান  বানিয়ে , তিন বেদ পড়ার অধিকার দিয়ে দিচ্ছেন , তা কি একধরণের উলট পালট নয় ? এই যাযাবর “ব্রাত্য” ব্রাহ্মণদের দেবতা শিব । আগে “ব্রাত্যস্তোম” যখন তখন , যে কোনও সময়ে হতো , পরে একটি নির্দিষ্টদিনে এই হোম শুরু হয় । 
           আজও চৈত্রসংক্রান্তির আগের রাতে শিবের গাজনের নাম -হোমপর্ব । ব্রাত্যস্তোমের মতোই গাজনেও চন্ডাল ব্রাহ্মণ সবাই উপবীত বা উত্তরীয় গ্রহণে সমান হয়ে যায় ।তাহলে কি সুদুর অতীতের ব্রাত্যস্তোমের স্মৃতিই কি কোনও না কোনও ভাবে থেকে গেল আজকের গাজন উৎসবেও ? যেখানে হাড়ী কেয়ট মুচী বাগদীরাও সন্ন্যাসী হয়ে একমাস সামাজিক মর্যাদা  ও  প্রভাব দেখানোর সুযোগ পেতো ? ব্রাত্যস্তোমের সেই সামাজিক নর্মসকে পাল্টে দেওয়ার প্রচেষ্টাই কি ধরে রাখে নি এতযুগ পরেও গাজনের উৎসব ? 
   সে না হয় হলো , কিন্তু শিবের গাজন গাওয়া এই দুই ভাইয়ের হদিস কীভাবে পাই ?আমরা দুই ভাই    কারা ?    খুঁজতে খুঁজতে কি আমাদের কলকেতায় যেতে হবে ? উনিশ শতকের বাংলার পথনির্দেশক মাইল ফলকটি তো কলকাতার দিকে তীরচিহ্ন দিয়ে আঁকা । সহজে দু’পয়সা রোজগারের আশায় গ্রাম থেকে দলে দলে বিভিন্ন পেশার লোক এসে ভিড় জমিয়েছিলেন কলকাতার বিভিন্ন পাড়ায় টোলায় । তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাহেবদের মুৎসুদ্দিগিরি করে হয়ে উঠেছিলেন নয়া কলকাতার বাবু । কিন্তু গ্রামীণ সংস্কৃতিকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া তখনও সম্ভব হয় নি , নগর কলকাতার পক্ষে । ফলে নাগরিক নকুবাবু ছকুবাবুরা তাদের পুরনো আত্মপরিচয়টি যেমন অস্বীকার করতে পারেন না , তেমনি নব্যধনীর নতুন পরিচয়ে “জাতির কর্তা রাজীব রায়”কে উপেক্ষা করে “অক্কুর হল দত্ত , নকুড় হল ধর” । এই দোটানায় নগর কলকাতায় যে চড়ক বা গাজন সংস্কৃতি এসেছিল , তা অবিকল গ্রামীণ নয় । আজও গ্রাম বাংলায় ঢাকের নাচ , বাধনদার কাটনদারের কথা সুর তালের খেলা থেকে দূরে , কলকাতার বাবু কালচারে জন্ম নিয়েছিল , গাজনের সঙ । আর এই সঙের দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকও থাকতেন কোনও না কোনও বাবু ।এই বাবুরা অন্তত প্রথাগত বাঙালি বর্ণ-সমাজকে তোয়াক্কা না করে , নিজেদের পছন্দমাফিক উচ্চ বর্ণে ওঠার যে তৎপরতা দেখিয়েছিলেন , তা প্রথাবদ্ধ সমাজের উপর একধরণের শিবের গাজন তো বটেই । 
        
    ধন-বলে বলীয়ান , এই নতুন সমাজ কর্তাদের পেছুটান তাদের পিতমহীদের তীর্থদর্শনে পাঠানো আর এক ধরণের আভিজাত্য প্রদর্শন অন্তত তৎকালীন হিন্দু সমাজের কাছে । আর এই কর্মটি করা মানে , নিজেদের সামাজিক প্রতিষ্ঠার পূর্ণতা । সুতরাং এখন সমাজে ডুগডুগি বাজানো বাজিকর হয়ে উঠেছে , কলকেতার নব্যধনী দুইভাই । তাদের দিকে ঈষৎ বাঁকা চোখে তাকিয়ে , উনিশ শতকের কলকাতার স্বভাবকবিত্বের তীব্র উচ্চারণ হয়ে যদি এই ছড়াটির জন্ম হয়ে থাকে , তা কি খুব অস্বাভাবিক মনে হবে ?
মেয়ে অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল , টের পাই নি । হঠাৎ বললো ,-বাবা , তোমার ঠাকুমাও কি গয়া কাশী গেছে ? 
 না রে । আমার ঠাকুমা পৃথিবী থেকেই চলে গেছে ।
 মনে মনে বললাম , তোর মেয়েকে কি তুই বলবি , তোমার ঠাকুমা বৃদ্ধাশ্রমে গেছে ?
সে আরেক কাশী । এই যুগের কাশী ।
কেন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে ? -মেয়ে বললো ।
আমি যেন ডুগডুগি না বাজাই ।
মেয়ে চোখ ছলছল করে বললো ,-আমি আর ডুগডুগি বাজাবো না । আম্মুকেও কোত্থাও যেতে দেবো না ।

(c) Picture: ৌজন্যঃ সামহোয়ারিন ব্লগ এবঅন্যান্য 

কোন মন্তব্য নেই: