“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

মধ্যযুগ


                                                           অমিতাভ দেব চৌধুরী























লোর জাহাজ এসে লেগেছিল ভোরের বন্দরে ।
শতেক পশরা তার । কেউকেউ কিনেছিল, কেউ
ফিরিয়ে নিয়েছে মুখ । কেননা তাদের স্বপ্নে ঢেউ:
ভিড়েছে বাণিজ্যতরী ।মাঝি তার শাদা ত্বক পরে ।

বাণিজ্যতরীর থেকে কিনে নিল যে সুসমাচার
সে বলল, ও জাহাজে আলো নয়, অন্ধকার শুধু ।
'অন্ধকার যুগ' লিখে লিখে বহু ভাবচোর মধু
করল ঘরে জমা ।অন্ধযুগ করে আলোর বিচার ।

আমি জানি, ও জাহাজে আলো আর ছিল লক্ষ গান
কেন না সে যুগ জানত কথা বলতে সুরে। তাই তার
কবিতায় সুর ছিল, সুর ছিল আখ্যানেও ।দ্বার
খোলা থাকত এমনকী অনুবাদ-পৃথিবীরও--- তান,

মীড়ের আকাশ-তলে । আমরাই গেছি ভুলে গাওয়া ।
সুরহীন আমাদের সেই শুরু অন্ধকার-বাওয়া ।

(c) Picture:ছবি

সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

'উজানে'র উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত তিনসুকিয়াতে




শহিদ তর্পন দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন গোষ্ঠীর সভাপতি সুজয় রায়
প্রতিবছরের মতো এবারেও উজান সাহিত্য গোষ্ঠী,র উদ্যোগে ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হয়ে গেল তিনসুকিয়াতে। স্থানীয় দুর্গাবাড়ি চৌহিদ্দিতে বিকেল তিনটা নাগাদ শহিদ তর্পন দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন গোষ্ঠীর সভাপতি সুজয় রায়। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন অন্যান্য সদস্য সদস্যারা এবং উপস্থিত সুধীজন। সঙ্গে সদস্যরা সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী রচিত সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। শিল্পী ছিলেন রূপা  পাল, জীবন সরকার, বর্ণালী চৌধুরী এবং রতন দেব (তবলাতে)।

  

                
কুমার অজিত দত্ত
ড০ অপূর্ব ভাস্কর গগৈ
          বহুভাষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং দু’জন অতিথি বক্তার বক্তৃতা দিয়ে সাজানো হয় গোটা অনুষ্ঠান। একজন কুমার অজিত দত্ত। তিনি তিনদশকেরও বেশি সময় ধরে গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত নিয়মিত ছোট কাগজ ‘একা এবং কয়েকজনে’র অন্যতম সম্পাদক, তার উপর অসমের একজন সুপরিচিত কবি-গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক। তিনি বলেন পূর্বোত্তর তথা বাকি ভারতে ছোট কাগজের ইতিবৃত্ত এবং সেরকম কাগজের দরকারটা নিয়ে। যদিও ১৯৫৩তে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার প্রথমদিককার ছোটকাগজ ‘মরসুমী’ দিয়ে তিনসুকিয়াতে ছোট কাগজের যাত্রা শুরু তবু  স্রোতাদের কাছে এই ইতিবৃত্তগুলো ছিল নতুন। অন্যজন ড০ অপূর্ব ভাস্কর গগৈ তিনসুকিয়া মহাবিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, তাঁর আগ্রহের বিষয় ভাষা, অর্থনীতি তথা সমাজবিজ্ঞান। উজান অসমের অসমিয়া ছোট কাগজগুলোর তিনি নিয়মিত লেখক এবং সুবক্তা। তিনি এদিন মাতৃভাষাগুলো তথা ভারতীয় সমাজের বহুভাষিক চরিত্র এবং সাম্রায্যবাদের ভূমিকা নিয়ে গুরু গম্ভীর অথচ সরস বক্তব্য উত্থাপন করেন। বক্তৃতা শুরুর আগে কুমার অজিত দত্তেকে ফুলাম গামছা পরিয়ে এবং একটি সরাই উপহার দিয়ে বরণ করেন ‘উজান’ কাগজের সম্পাদিকা সবিতা দেব নাথ। এর পরে তিনি উন্মোচন  করেন এদিন প্রকাশিত শিশুদের জন্যে ‘উজানে’র বিশেষ ক্রোড়পত্র। অপূর্ব ভাস্করকে বরণ করেন সংগঠনের সহ-সভানেত্রী নিহারিকা দেবী। সংগঠনের সদস্য সুশান্ত কর স্রোতাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন বক্তাদের।

       উদ্বোধনী সঙ্গীত ছাড়াও  দু’জন শিশু শিল্পী আরো একটি সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করেন ‘আমি বাংলায় গান গাই’। শিশু শিল্পী পৌষালি কর গান করেন ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর ‘পরে রাগ করো’; অমৃত রাজখোয়া গাইলেন ‘চির চেনেহি ভাষা জননী’ সুবিখ্যাত অসমিয়া গান। জীবন সরকার দুটি লোকগান এবং অসীম দত্ত পরিবেশন করেন দু’টো গণ সঙ্গীত।  দু’টি  নাচ পরিবেশন করেন শিশু শিল্পী কাশ্মীরি দেবী, এবং স্বাগতা পাল।  অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের কবিতা ‘উদ্বাস্তু’ আবৃত্তি করে শোনান সৌমেন ব্যানার্জী। নিজের লেখা হিন্দি কবিতা   পড়ে শোনান কৃষ্ণ উপাধায়, অসমিয়া কবিতা পড়ে শোনান মালবিকা দাস হাজরিকা, তৃপ্তি দাস, টমাস সনোয়াল। বাংলা কবিতা পড়ে শোনান নীলদীপ চক্রবর্তী, নৃপেন শিকদার, পার্থসারথি দত্ত, দীপেশ শুর, মানব রতন মুখোপাধ্যায়, ভানু ভূষণ দাস প্রমুখ।

     বিকেল তিনটা থেকে শুরু হয়ে ছটাতে অনুষ্ঠানের শেষে সবাইকে ধন্যবাদ জানান সবিতা দেব নাথ। গোটা অনুষ্ঠানের সঞ্চালনাতে ছিলেন ত্রিদিব দত্ত  ভারত বন্ধের মধ্যেও শ’খানিক  স্রোতার উপস্থিতি ছিল বেশ সন্তোষজনক। শহরের মাঝখানে, কিন্তু দুর্গাবাড়ির ভেতরে নয়-- বাইরের খোলা চৌহিদ্দিতে মঞ্চ সাজানো হবার ফলে পথ চলতি অনেকে এসেও দাঁড়িয়ে পড়েন। ডিগবয় থেকে ‘উত্তরণ’ কাগজের তিন সম্পাদক --পার্থসারথি দত্ত, দীপেশ শুর, মানব রতন মুখোপাধ্যায়, এসেও আলাদা মাত্রা যোগান অনুষ্ঠানে। ফলে অনুষ্ঠানের শেষে কুমার অজিত দত্তকে ঘিরে রাত সাড়ে আটটা অব্দি লেখক, সম্পাদকদের আড্ডা ছিল তিনসুকিয়া শহরে বহু বছর পরে এক ভালো অভিজ্ঞতা। পরদিনও তিনি ছিলেন শহরে। সেদিনেও শহরের সাহিত্য কর্মীদের মধ্যে আড্ডার আবহ  প্রবাহিত হয়। আশা করা যাচ্ছে এর রেশ বহুদিন তাজা থাকবে। এবং নতুন ভাবে ভাবাবে এখানকার সাহিত্য কর্মীদের। এবারের একুশের অনুষ্ঠানের এটাই মনে হয় সব চাইতে বড় অর্জন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সব ক'টি ভিডিও এক সঙ্গে দেখতে পাবেন, একের পরে এক। ক্লিক করুনঃ
***********************************************************


                                         



~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সংবাদে 'উজানে'র অনুষ্ঠান
***************************************************************


 
দৈনিক যুগশঙ্খ, ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩

 ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
 ছোটদের জন্যে 'উজানে'র বিশেষ ক্রোড়পত্র। ক্লিক করুন, বড় করুন। সেভ করুন। পড়ুন।
*************************************************************

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রাজ্যের অন্যত্র ২১শের অনুষ্ঠানের সংবাদ
***********************************************************







শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

শাইনিং ইন্ডিয়া



         "বিড়ি জ্বালাইলে জিগর সে পিয়া..." কি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ভায়া। ঐ কন্যার জিগর থেইক্যা নাকি আগুন জ্বলে ! সেই আগুনে আবার বিড়ি ধরে ! খারাপ না ব্যাপারটা । মনটা খারাপ হইয়া গেল সকাল বেলাতেই গানটা শুনে। ‘আমার প্রিয়ার জিগরে শুধু জল ক্যানে !’
   মুম্বাইইয়ে কি মেয়েদের জিগর থিক্যা আগুন জ্বলে নাকি! আবার কলকাতা কয়, শূন্য এ বুকে...। বাংলাদেশ রেডিও আরও একটু সেন্টু সেন্টু সুরে বাজায়, ‘পাখী মোর আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়...’।
দূর আজকাল এতো সেন্টু নিয়ে ডাকলে পাখিও পালায়! শুরুটাই করতে হবে আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, দিয়ে। মানে কোন অবস্থাতেই বলা বারণ, তোমার মনের কন্ডিশান। মুখে দাড়ি থাকতে হবেই। না হলে সিকোয়েন্সটা ঠিকঠাক জমবে না। বিড়ি টাইপের কালার হতে হবে শরীরের। কিন্তু ওয়াইল্ড স্টোন রাখতে হবে। পকেটে না বুকে ধরে রাখতে হবে পাথর, বুঝলে ভায়া! পাত্থরেরও নাকি আবার গন্ধ থাকে!

          বিড়ি বেশ সেন্টিমেন্টাল টাইপের হয়। মানে জ্বলে দুমদাম করে। কিন্তু একটু না টানলেই নিভে যায়। একটু অবজ্ঞা মানেই লেপের তলে সিটিয়ে থাকা নতুন বউয়ের নাক ডাকা। সিগারেটের কিন্তু সেই অর্থে এতো সেন্টু নেই। জীবন দিয়ে জ্বলবে। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই... টাইপ। হৃদয় একদম জ্বালাইয়া ছাই কইরা তবে তবে ছাড়ব। একদম কর্পোরেট দের মতো বিহেভ। রিফাইন্ তামাকের গুন নেই। একদম খাটি নেপালি তামাকের সাথে সিগারেটের তামাকের তুলনা চলে! আমার হৃদয় ঐ নেপালি বিড়ির পাতার মতো। সর্বদা শূন্য এ বুকের মতো খাঁ খাঁ করে।

         সকাল সকাল এই গানটা কানে আসতেই কত স্বপ্ন যে দেখে ফেললাম, লেপের তলায় ! সেটা সেন্সর করা। বলা বারণ। স্যরি উসখুস কইরা কোন লাভ নেই। এমন কিছুই ঘটেনি। এটা হিন্দি ফিল্ম   জিসম পার্ট ফোর নয় ভায়া।  মনটা শান্ত থাকা ভীষণ জরুরি পরবর্তী অংশ সহ্য করতে। আজকাল কথায় কথায় গান। সোনালী গানের এই এক সুবিধে সিকোয়েন্স বুঝে বোতাম টিপলেই হলো। সব রঙ্গিন, সব উত্তর হাতের কাছে, সব কিছু চোখের সামনে একদম ফকফকা। এরবেশী বলা বারণ...।
       সেদিন আমি আমার প্রেমিকাকে বললাম আমায় সত্যিই ভালবাস! কেন ভালোবাস? শেষ দু'বছরে প্রেমের এই চতুর্থ অধ্যায়ে এটাই সবচেয়ে বড় সময়ের ইনভেস্টমেন্ট আমার। মানে গোটা দশেক বই, ক্যাডবেরি, সিনেমা, আইসক্রিম খায় না গলায় ব্যাথা আছে, আর প্রেমের অভারঅল অপারেটিং কস্ট সর্বসাকুল্যে হাজার দুয়েক টেনেটুনে। মেয়েরা ভালবাসলে সব মেনে নেয়, তাই আমাদের কপালে প্রেম জোটে। দেখি পাত্তাই দেয়না আমার কথার। কানে মোবাইল ফোনের হেডফোন গুজে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। আবার শুধোলাম, ‘সত্যি বলোনা ভালবাসো আমায় ! কেন ভালবাসো’ ! কেমন জানি একবার চোখ টানটান করে তাকিয়ে আমার ডান কানে হেডফোন গুজে দিল। আবার চোখ বন্ধ করলো। মুখে বলল, ‘চুপ শোন শুধু, কথা বলোনা...’

            ইয়ার্কি পেয়েছে, অনিন্দ্য অনিন্দ্য বলে সকাল সন্ধ্যা কাৎরাচ্ছে আমার সামনে, আর এখন আবার কানেও কালা করে দেয়ার প্রয়াস। কিছুতেই হতে দেব না। আজ জবাব চাই। হেস্তনেস্ত করবোই আজ আমি। রাগে আমি কান থেকে হেড ফোন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গাছের পাতা গুনছি। কোন ভ্রূক্ষেপ নেই তার। গাছের গায়ে একপায়ে হেলান দিয়ে থাকতে থাকতে পা ধরে গেছে। সিগারেট শেষ। চোখ আর খোলেনা আমার দু'বছরের প্রেমিকা।

           রাগে উল্টোমুখো হয়ে পালাবো ভাবছি বিড়ি টানতে। কারণ মেয়েদের সামনে আর যাই হোক বিড়ি টানা যায়না। পকেট ফুটো ধোসার টাকা মিটিয়ে। চোখ খুলেছেন তিনি কাছে না পেয়ে। মেয়েরা বড্ড বেশি ভরসা করে তাদের সঙ্গীকে। আর তাই বোধহয় মেয়েরাও প্রেমে পড়ে কোন কোন সময়। শেষে পেছন থেকে এসে বলল, এতো রেগে যাও কেন! গানটা শুনেও রেগে গেলে!
- আমি কোন গানটান শুনিনি। আমার মন ভালো নেই। যা বলার তা তো বলেই দিয়েছ, আর গান শুনে কি হবে!
- আরে শোন না, অনিন্দ্য...
- মানে তোমার নতুন প্রেমিক!! বাহ কি করে ! ইঞ্জিনীয়ার না ডাক্তার!
- আরে তোমার প্রিয়...
- হ্যাঁ, তোমার যে প্রিয়, তাকে আমাকেও গিলতে হবে ! কেন ! হোম টোম নাকি তোমার অনিন্দ্য!
- আরে শোন না... বলা বারণ... অনিন্দ্য'র গানটা শুনতে বলেছিলাম। মেয়েরা সব কথা মুখে বলতে পারেনা।
- হুম, তা বলবে তো তুমি অনিন্দ্যর গানে আমার কথার উত্তর দিচ্ছ। বেবাট টাইপ হয়ে গেলাম। হাসলে আমায় সত্যিই বেবাট টাইপ লাগে। আমি জানি । ইশ, দুমদাম মন খারাপ করে ফেললাম। তবে এটাও ঠিক, শেষ তিন অধ্যায়ে দেখেছি, চলে যাওয়ার সময় ওড়নায় নখ প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বেশ বলে যেতে পারে মুখেই, বিদায় বন্ধু, ভাগ্যে নেই, তাই তুমি নেই। কি করবো তুমি তো একটা কিছুই করে উঠতে পারোনি এখনও । না বলে এসেছি, বাড়িতে প্রচুর মানুষ। রেন কোট টাইপ ভাগ্য আমার। ভাবি, এই অধ্যায় যদি ভাগ্যে থাকতো, কি যে হতো আমার অবস্থা ! এরচেয়ে অনেক ভালো আমার এই 'চার অধ্যায়'। এই নিয়ে দশবার গেছেন উনি, আর আজ নিয়ে এগারো বার আবার এন্ট্রি নিয়েছেন। উনি এলেই আমি 'শেষের কবিতা'র পাতা চোখে দেখি। চলে গেলে পড়ি জীবনানন্দ।

আমি যে একটু পাগল টাইপের তা আমি জানি। মানে কবি কবি ভাব, কিন্তু কবিতার অভাব। কস্মিনকালেও একটি কবিতা লিখতে পারিনি। তবে সে চলে গেলে কাব্য ভর করে মাথায়। একবার লিখেছিলাম । ক্লাশ টেন এ লিখেছিলাম -
'মাথার উপর নীল আকাশ,
পায়ের নিচে দূর্বাঘাস,
তোমার আমার পেছনে বরাক বাঁশ।'
মানে, বরাক বাশের উপর বসে ছিল মিষ্টি দিদিমণি আর নতুন স্যার। এই স্যারকে দেখলেই আমার পিত্তি জ্বলে যায়। মিষ্টি দিদিমণিকে দেখলেই, আমার মন ভালো হয়ে যেত। মোটেই 'ম্যারা নাম জোঁকার টাইপের' গল্প নয়। সবকিছুতে ঐ গন্ধ না খোঁজাই ভালো ! কী সুন্দর করে হাসতেন, নরম করে কথা বলতেন। ইস্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে দিদিমণির পাশে দাড়িয়ে গান গাইতাম। কী মিষ্টি গন্ধ পেতাম। সারাটা মাস রিহার্সাল চলতো, আমরা সবাই রাজা...
       আমি ভাবতাম একবার যদি দিদিমণির হাতটা ছুঁতে পারতাম! তাই লিখে ফেলেছিলাম ঐ কাব্য। আমার এই কবিতা পড়ে আর মুখ দর্শন করেননি আমার। আমায় দেখলেই ট্যারা করে তাকাতেন। সেই প্রথম ধাক্কা। আমার প্রেমের চার অধ্যায়ের মধ্যে অবশ্য এই দিদিমণিকে আমি ধরি না হাতে। এরপর থেকে আর সেই ছন্দের চেষ্টা করিনি। বাকিটা বলা বারণ। কী করে বুঝবো বল ? তুমি আমার হৃদয়ে সঙ্গীত ফিরিয়ে দিচ্ছ ! দেখুন এই আমার বদ অভ্যাস। সুযোগ পেলেই কাব্য করি। প্রেক্টিকেল হতে হবে, জানি কন্যা, দু'চার দিন বাদে কোন ডাক্তারের বুক জ্বালাইবা তুমি সক্কাল সক্কাল। বিড়ির মতো সেন্টু সেন্টু মুখ করে।

বিড়ি নিয়ে দৌড়াচ্ছি নদী পারের দিকে (হাসির কোন কারণ নাই, এই দেশের ষাট শতাংশ মানুষ এখনও ট্রেন লাইন, ফাঁকা মাঠ আর নদীর পাড়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারেন)। এরপরেও 'সাইনিং ইন্ডিয়া' ডুবে না। আমি তাই আপাতত ভাবছি কম পয়সায় পাকা ল্যাট্রিন বানানোর ব্যাবসা করবো। ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম লোন চাইতে। দেখে বলে দিল ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, ‘ওইটা বাকিতে হইব না’। কষ্ট হবে বুঝলেন ! কোষ্ঠকাঠিন্য ব্যাবসায় ওয়ালমার্ট লগ্নী করবে না। কাগজের তিন নম্বর পেইজটা পড়বেন। বুঝলেন ! ব্যাবসার পাতা । আপনাদের মতো তরুণ ব্যাবসায়ীদের জন্য কতো বড় বাজার ! ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি চায়। কিছু গ্যারান্টি দিতে পারবেন !
- আপনি কি বিবাহিত ! আমার এই প্রশ্নে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার।
- হুম বিবাহিত।
- মেয়ে আছে ! কোন কলেজে পড়ে !
- সুরেন্দ্রনাথে ! ইংলিশ নিয়ে পড়ছে !
- হ্যাঁ তো কেন ! আমার মেয়েকে চেনেন আপনি !
- হ্যাঁ আমার প্রেমিকা । আপনি উনার বাবা। মানে আমার পরবর্তী শ্বশুর।
চিৎকার করছেন ভদ্রলোক। অবস্থা ভালো নয় বুঝতে পারছি। চা তখনো শেষ হয়নি। এক চুমুকে শেষ করলাম। নিজের মেয়ের কথা অধস্তনদের কাছে ফলাও করে বলবে না জানি। চেয়ার থেকে উঠে গিয়েও আবার বসে পড়েছেন। খুব শান্ত হয়ে বললাম, ‘আমার সঙ্গে ক্লাশ টুয়েলভ থেকে প্রেম করছে । লাস্ট টু ইয়ারে আমার সব ইনভেস্টমেন্ট আপনার ঐ মেয়ের কাছে । সেই আমার সিকিউরিটি আপাতত। চলবে’ ?
ভদ্রলোক ঘামছেন । বললেন, ‘তুমি বাড়ি এসো, পরে কথা হবে। গার্ড...’
- লোনটা দেবেন, সিকিউরিটি আমার আপনার ঘরে গচ্ছিত। সত্যি বলছি রিটার্ন পাবেই ব্যাঙ্ক।
- তুমি যাবে !
--‘না’ স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম। ‘লোনটা না পেলে আমি যাবো না। আর বের করে দিলে সবাইকে জানিয়ে যাবো, আপনি আমার পরবর্তী হবু শ্বশুর হয়েও আমাকে বিশ্বাস করেন না। আপনার মেয়ের কাছে আমার সব জমানো গচ্ছিত। এখন সে অনুপমের সঙ্গে প্রেম করছে । আমায় ছেড়ে দিয়েছে । বলেছে আমি নাকি কোন কাজের না। প্রমাণ আছে সব। চিঠি, ইনবক্সে মেসেজ, ফোন কল, ছবি...’।
- তুমি কি পাগল ! ইয়ার্কি মারছো সাত সক্কাল বেলা । কত ইনভেস্ট করেছো টু ইয়ার্সে !
- মানে এমাউন্ট টা কতো ! কেন দিয়েছ !
- টু ইয়ার্সে চারবার। তেত্রিশ লক্ষ ইন্টু চার, মানে ওয়ান ক্রোড়ের কাছাকাছি।
ভদ্রলোকের কপাল থেকে ঘাম এবার দুম করে ঝরে পড়ল আমার প্রজেক্টের উপর। ঘামছে, শুধু ঘামছে ।
- ইয়ার্কি পেয়েছ ! চুরি করো নাকি !
- হ্যাঁ চুরি করেই, আপনার ফ্ল্যাটে দু'বার। আর বন্ধুর ঘরে দু'বার।
- মানে ! আমার ঘরে তো চুরি হয়নি কোনদিন ! তুমি কি পাগল ! উন্মাদ ! যাও বেরিয়ে যাও এখুনি।
- থাক সেই হিসেব করবেন না । লোনটা সেংশান করে দিন । চলে যাচ্ছি ।
- কোনমতেই না ।
- ঠিক আছে । তাহলে ডাকাতিটা আজ সেরেই ফেলি বলুন !
- মানে ? কি ডাকাতি । ভয় দেখাচ্ছ ! গার্ড...
- মানে আজ আমরা পালাবো। আমি আর আপনার মেয়ে । আমার শেষ দুবছরের ইনভেস্টমেন্ট  আর আপনার একুশ বছরের...।
- আমি পুলিশে জানাচ্ছি ।
- জানান, আমরা লিগ্যাল মেরেজ সেরে নিয়েছি। শুধু টাকা নেই তাই লোন চাইতে এসেছি । দেখুন এটা একটা ব্যাবসা শুধু নয়, মানুষের জন্যেও কাজ হবে এতে। কত মানুষ বাঁচবে বলুন। এই যেখানে সেখানে...
- থাক। আর বলতে হবে না । আমার একুশ বছরের ইনভেস্টমেন্ট চুরি করেছ । লোনটা হয়ে যাবে। নেক্সট উইকে এসে একবার দেখা করো। এখানে নয় বাড়িতে আসবে । তোমার বাবাকে নিয়ে আসবে সঙ্গে।
- এই রে। কেন বাবাকে দিয়ে কি হবে?
- আমার মেয়ের গ্যারেন্টার।

ব্যাঙ্ক থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন দেখি রাইজিং ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপনটা সত্যিই ঝকঝক করছে। ও দাঁড়িয়েছিল নিচেই। ভয়ে চোখমুখ ফ্যাকাসে। জানতে চাইলো কি বলল বাবা !
বলা বারণ... ইন্ডিয়া শাইনিং । কিন্তু আকাশে মেঘ আজও । জানিনা কপালে কি আছে। মেঘ না রোদ্দুর ! যাই থাক থাক, তুই থাক, শূন্য এ বুকে থেকেই যা তুই ।

শুক্রবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

একুশ শতকে একুশের প্রাসঙ্গিকতা

(লেখাটি ২০১২ তে 'দৈনিক যুগশঙ্খ' পত্রিকায় প্রকাশিত। ভাসা ভাসা ভাষা-প্রেম নিয়ে বিভিন্ন সময় নিজের ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এ লেখাটিও সেভাবেই লেখা। ---মৃন্ময় দেব)

প্যারিসের জেহান রিক্টাস স্কোয়ারের একটি দেয়ালে মানবিক ঐক্যের প্রতীক স্বরূপ ইউনেস্কোর অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত বহু দেশের নিজস্ব ভাষায় ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ কথাটি লেখা রয়েছে । দেয়াল জুড়ে পরস্পর অপরিচিত ও অচেনা অক্ষরমালার এমন সহাবস্থান যেন এই কথাই বলতে চায় যে, ‘তুমি আমার ভাষা বলো আমি আনন্দকে দেখি / আমি তোমার ভাষা বলি তুমি আশ্চর্যকে দেখো’ । কিন্তু বাস্তবে  এরকম  ‘আনন্দে-আশ্চর্যে সাক্ষাৎকার’ তো দূর অস্ত , ‘আমি আমার ভাষা বলি তুমি তোমার ভাষা বলো’-গোছের সহনশীলতার পর্যায়েও পৌঁছতে পারেনি সভ্যতার বড়াই করা এ পৃথিবীর মানুষ । না, একুশ শতকের একটা দশক পাড়ি দিয়েও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে এমন আশা আমাদের পক্ষে আজো দুরাশা বইকি ! 
একুশে ফেব্রুয়ারি । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস । ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে এই দিনটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । তারপর থেকে সদস্য দেশগুলোয় সরকারি-বেসরকারি , প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক নানান উদ্যোগে নানা ভাবে ‘মাতৃভাষা দিবস’  পালিত হয়ে আসছে । ভারতবর্ষেও হচ্ছে অবশ্যই । তবে তা মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেমিনার , সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিল , কিছু সরকারি উদ্যোগ , আর পত্র-পত্রিকার এলোমেলো নিবন্ধাদিতে সীমিত থাকছে । জনসমাজে তার প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে । ভাষা-সচেতনতা বলতে যা বোঝায় তা বস্তুত আমাদের তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তদের মধ্যেও দুর্লভ । ভাসা-ভাসা ভাষা-প্রেম সম্বল করেই তাই নিয়ম-মাফিক চলে ‘একুশে’র বাৎসরিক উদযাপন । ‘শহিদের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ ! না, পারি না ; সারা বছর ভুলে থাকতে পারলেও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ দিনটিতে তা পারি না । বাঙালি অতটা আত্মবিস্মৃত জাতি নয় অবশ্যই । বরাক উপত্যকার বাঙালির কাছে ‘উনিশ’ আর ‘একুশ’ মিলেমিশে একাকার । এই পারে ‘উনিশ’, ওই পারে ‘একুশ’ – ভাষা নদীর দুই কূল জুড়ে একই ইতিহাস । 
            গোটা বিশ্বে কম বেশি ছ’হাজার ভাষা রয়েছে , যার হাজার তিনেক এ শতাব্দির শেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে । বিশেষজ্ঞদের এরকমই অভিমত । বিশ্বায়নের জাঁতাকলে অবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে প্রতিনিয়ত । অঞ্চল বিশেষে এই জটিলতার মাত্রা ও পরিধি কেবল ভিন্ন নয় , প্রায় চরমে পৌঁছে গেছে । হাতের কাছের উদাহরণ  আমাদের প্রিয় রাজ্য অসম ।  কিন্তু এরকম এক জটিল পরিস্থিতিতে , যেখানে প্রতিদিন  কোন না কোন ভাষার সলিল সমাধি ঘটছে কিংবা ঘটার উপক্রম হচ্ছে , মাতৃভাষার সুরক্ষা আদৌ সম্ভব কি না সেটাই এক কঠিন জিজ্ঞাসা । এই প্রশ্নচিহ্নের ভূমিতে দাঁড়িয়েই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের’ প্রাসঙ্গিকতা বিচার্য । মাতৃভাষার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার সম্পর্কই বা কি এবং কতটুকু সেটাও বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি । Nobel Laureate Mr. Hallor Laxness-এর মন্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য – ‘the world becomes a poorer place whenever an international language swallows up a smaller one, but the international language becomes no richer for doing so... ’ ।
মাতৃভাষা হচ্ছে চিন্তা-চেতনার আঁতুর ঘর । মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সংস্কৃতির সারস্বত বৃত্তটি । মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা তাই সমগোত্রীয় । ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ হরিহর আত্মার । সংস্কৃতির বৈচিত্র আসলে বহুরূপে বিশ্বের অবলোকন , জীবন রহস্যের বহুমাত্রিক প্রতিফলন । সংস্কৃতির সমন্বয়ই হল  বৈশ্বিক উপলব্ধির একমাত্র পথ । এই সমন্বয় যদি কাঙ্ক্ষিত হয় তাহলে ভাষার মৃত্যু প্রতিরোধ করতেই হবে । মাতৃভাষার অধিকার তারাই দাবি করতে পারে প্রতিটি ভাষাকে যারা বৃহত্তর মানব পরিবারের সম্পদ জ্ঞানে সমমর্যাদা দিতে উৎসুক । ভাষাগত বিভেদ কিংবা সংস্কৃতির সংঘাত নিঃসন্দেহে শান্তি ও মৈত্রীর পরিপন্থী । সে কারণেই ১৯৯৯ সালের উল্লিখিত অধিবেশনে Kofi  Annan সময়োচিত মন্তব্য করেছিলেন যে - ‘ the lesson of our age is that languages are not mutually exclusive, but that human beings and humanity itself are enriched by communicating in more than one language .’ ।
          বহু ভাষা ও বিবিধ সংস্কৃতির মিলনে গড়ে ওঠা সমাজ (Multilingual multicultural society) ব্যতীত মানব জাতির মুক্তি অসম্ভব । বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্রকে স্বীকার করে নিয়েই সৃষ্টি হতে পারে বিশ্বমানবের নয়া বিশ্বসংস্কৃতি । এছাড়া বিশ্বশান্তির অন্যতর সম্ভাবনা আপাতত দৃষ্টিগোচর নয় । ‘সিভিল সোসাইটি’ গুলিকে এ বিষয়ে সচেতন হয়ে কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে ।  আঞ্চলিক বৈশিষ্ট রক্ষা করার সাথে সাথে বিশ্ব-সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ গড়ে তুলতেও হবে ।  শেকড়ে থাকবে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির সংহতি , আর শাখার বিস্তারে আন্তর্জাতিকতার বোধ ।  বিশ্ব-নাগরিক হয়ে ওঠার এই প্রয়াস ব্যতীত বিশ্বশান্তির স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে । অথচ বাস্তবে ঘটছে ঠিক উল্টো । বাচনে ভাষণে যেখানে বিবিধের মাঝে মিলনের এত অসংখ্য অপরূপ বিজ্ঞাপন সেক্ষেত্রে বাস্তবে  বিরোধ কেন ? এক কথায় একেবারে সহজ উত্তর একটা দেওয়া যায় অবশ্যই , এবং সেটা একেবারে ভুল উত্তরও নয় । উত্তরটা হল – বিশ্বায়নের বিশ্বজোড়া বিভেদনীতি । যে কোন জাতির ভাষা-সংস্কৃতি যদি কেড়ে নেওয়া যায় তাহলে সেই জাতিকে পদানত করা নিতান্ত সহজ হয় । সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসাবে  এই পদ্ধতি বারে বারে যে অনুসৃত হয়েছে সে সাক্ষ্য তো ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়ানো । বিশ্বায়নের বাজারকেন্দ্রিক অভিযান তাই সংস্কৃতিহীনতার এক বাতাবরণ তৈরিতে তৎপর । প্রতিটি ভাষাই আজ , এমনকি ইংরেজিও , কোন না কোন ভাবে এই বাজার কর্তৃক আক্রান্ত । পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন ভাষা-সংস্কৃতিকে বেঁচে থাকতে হলে অতি অবশ্যই এই মুনাফা-কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । পরিবর্তে গড়ে তুলতে হবে মানুষ-কেন্দ্রিক এক নয়া বিশ্বায়নের চেতনা । এটা সম্ভব হতে পারে কেবল জাতিগুলির সামূহিক ঐক্যের ভিত্তিতে । আর , বলা বাহুল্য , সেরকমের ঐক্য গড়ে তোলার প্রাথমিক শর্তই হল পরস্পরের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা । 
কিন্তু বিশ্বায়নের তুখোড় কৌশুলিরা দুনিয়াটাকে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিতে চায় বাজার দখলের স্বার্থে । মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক মানবিক সম্পর্ককে হটিয়ে দিয়ে ওরা চায় ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক বহাল করতে ।  সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের এটাই মূল নীতি । মুশকিল হচ্ছে , আমাদের সমাজের অনেক জ্ঞানী গুণীও এই বিশ্বায়নের পালে হাওয়া দিয়ে যাচ্ছেন , চার দেয়ালের নিরাপদ ঘেরাটোপে বসে বাতানুকুল তত্ত্ব হাজির করছেন । একদিকে বিশ্বজোড়া ক্রমবর্ধমান দারিদ্র , খাদ্য সংকট , আর আরেক দিকে ভোগ-বিলাস ও অন্যায় অপচয় । বিশ্বের বিক্ষুব্ধ মানুষ শোষণ বঞ্চনার দুর্গে ঐক্যবদ্ধ বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে বসে তার জন্যই ভাষা ও ধর্মের নামে দিশাহীন জাতিগোষ্ঠী গুলিকে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার নিকৃষ্ট রাজনীতিকে হাতিয়ার করা হচ্ছে । আর অন্যদিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপনের নাটকীয় আয়োজনের মাধ্যমে মুনাফাখোর মুখগুলিকে খানিকটা মানবীয় আদল দেবার হাস্যকর প্রয়াস নজরে আসছে ।   

            তবে এও ঠিক যে , ভাষা কেন্দ্রিক বিভেদের রাজনীতি চোখে আঙুল দিয়ে এটাও দেখিয়ে দিচ্ছে যে বহুভাষিক ঐক্য ও বিবিধ সংস্কৃতির সমন্বয় বস্তুত সম্ভব । এই সম্ভাবনার উপলব্ধিটাই খুব জরুরি এসময় । ভাষার সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতির সম্পর্কটাও বুঝতে হবে ।  বুদ্ধদেব বসু বহুদিন আগে এ বিষয়ে সচেতন হতে বলেছিলেন তাঁর একটি নিবন্ধে । আধুনিক সমাজে ভাষাকে কেবলমাত্র মনের ভাব প্রকাশের উপায় বা মাধ্যম রূপে বিবেচনা করাটা যথার্থ বুদ্ধিমানের কাজ নয় । কেননা , জীবনযাপনের বর্ধিষ্ণু জটিলতা ভাষার ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে । মৌলিক ভাবগুলির বিনিময় ভাষার ব্যবহার ব্যতিরেকেও হয়তবা সম্ভব , কিন্তু ‘আমাকে ভোট দিন’ কথাটা বোঝাতে ভাষাটা চাই-ই । এই বাড়তি বোঝা কাঁধে চাপার দরুণ শুরু হল এক নয়া অধ্যায় – অন্যতর প্রয়োজনে ভাষার অ-স্বাভাবিক অ-মানবিক  ব্যবহার । প্রকৃত বিচারে ভাষার সংকটের মূল এখানেই । দ্বন্দ্বটা আসলে জনসাধারণের ভাষার জনবিরোধী ব্যবহারের প্রক্রিয়ার মধ্যে নিহিত । রাজনীতির কূট চাল এই দ্বন্দ্বকে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত করে , যার অনিবার্য ফল অর্থহীন হানাহানি , অযথা রক্তপাত । এর হাত থেকে রেহাই  পেতে হলে আমাদের ব্যাপক অর্থে ‘ভাষায় এক ভালবাসায় এক মানবতায় এক’ হতেই হবে । বিশ্বের সব ভাষার মানুষই যেন আজ নিজস্ব শব্দমালায় ‘occupy wall street’ কথাটা দেয়ালে দেয়ালে লিখে দিতে চায় ।  এই প্রেক্ষাপট মনে রেখে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত ও সঙ্কল্প যদি গৃহীত হয় তবেই তা আনুষ্ঠানিক আবেগের মঞ্চ-প্রদর্শনী না হয়ে উপযুক্ত মাত্রা লাভ করতে পারে । নতুবা উনিশের ভূমিতে একুশের চেতনা  একদিন  নূতন ঊষার সংবাদ বয়ে আনবে সে আশা  দুরাশা হয়েই থেকে যাবে!


(C) Picture:ছবি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
লেখাটা ইচ্ছে করলে এখানেও পড়তে পাবেনঃ '
Ekusher Prasongikota ' লেখা অংশে ক্লিক করুন। চলে যাবেন স্ক্রাইবডে। সেখান থেকে এটা নামিয়ে, কিম্বা না নামিয়ে কম্পিটারের পর্দা জুড়ে পড়তে পারবেন।
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!

শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ঘাস


                                       ।। লক্ষ্মণ কুমার ঘটক।।

















ঘাসের ডগায় যে শিশিরবিন্দু টলটল করে,
সে কি জানে তার অস্তিত্ব আলোর সঙ্গে জড়িত।
আলো আর শিশির সবসময় উপর থেকেই নামে,
ঘাস সবকালেই নীচে।
শিশিরবিন্দুগুলি ঘাসের খোঁজেই নামে
বসে, আদর করে, গান গায়,
তারপর আবার চলে যায় স্বজনের কাছে।
শিশিরের আদরে আদরে
ঘাস ভুলে যায়
নিজের ইতিকথা,
ভুলে যায় যে,
সম সবসময়ই নীচেই জন্মায়,
নীচেই হারিয়ে যায়।



(c) ছবিঃ Picture 

শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

হাত বাড়ালেই



                                       ।। শৈলেন দাস।।

 হাত বাড়ালেই- টেনে ধরতে পারতাম আমিও
 দুষ্টু বায়ুর মত তোর আঁচলের কোন স্পর্শের রোমান্টিকতায়
 আপ্লুত হত আঙুলে আঙুল টোকার সন্ধিঃক্ষণ।।

বৃহস্পতিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

আকরের সন্ধানে... দেড়দশক পেরিয়ে “জাতিঙ্গা” সাহিত্য, আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতির গবেষণা পত্রিকা

                                         (লেখাটি দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় ৪ ডিসেম্বর,২০০৭ সালে প্রকাশিত)                                                                                           
                                                           লিখেছেনঃ  # জিতেন্দ্র নাথ #

রাক উপত্যকায় নিয়মিত ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দীর্ঘদিন থেকে উন্নতমানের রুচিশীল যে সব সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে , এর মধ্যে অন্যতম “জাতিঙ্গা” সাহিত্য পত্রিকা । কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক তুষারকান্তি নাথ সম্পাদিত “জাতিঙ্গা” এক ব্যতিক্রমধর্মী সাহিত্য পত্রিকা । সাহিত্য, লোকসাহিত্য, লোক সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষণাধর্মী পত্রিকা ।এর আগে লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ক পত্রিকা অধ্যাপক দেবব্রত দত্ত সম্পাদিত ‘হৈড়িম্ব’ দুই-তিন সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে যায় । ফলে এ অঞ্চলের ‘জাতিঙ্গা’ প্রকাশের বিশেষ তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অতীত ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধের উপর জাতিঙ্গা যে গুরুত্ব দিয়ে থাকে তা সত্যি প্রশংসনীয়।
     
 ইদানীং সচেতন পাঠকমহলে জাতিঙ্গা নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে এক উন্নতমানের কাগজ হিসেবে। জাতিঙ্গার কলেবর ছোট হলেও প্রতিটি সংখ্যায় নতুন বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে, অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য ।উঠে আসছে নতুন বিষয় নতুন চিন্তা । জাতিঙ্গার প্রথমদিকের সংখ্যাগুলো কবিতা বিষয়ক ছিল। পরবর্তীতে চরিত্র পাল্টে যায় । ১৯৯০ সালে তুষারকান্তি নাথ সম্পাদিত ‘জাতিঙ্গা’ হাফলঙ থেকে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে । সহযোগী সম্পাদক ছিলেন কবি ও সম্পাদক পত্নী স্মৃতি পাল নাথ ।
          জাতিঙ্গা প্রকাশনার দেড়দশক অতিক্রান্ত। দীর্ঘ সতেরো বছরে ষোলটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে । ১৯৯২ সালে দ্বিতীয় সংখ্যা বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি  সম্মেলনের দ্বাদশ অধিবেশন উপলক্ষে হাফলঙ ও শিলচর থেকে একযোগে প্রকাশিত হয় ।তৃতীয় সংখ্যা সম্মেলনের ত্রয়োদশ অধিবেশন উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ।
        
              ১৯৯৩, ১৯৯৪, ও ১৯৯৫ সালে দুটি করে মোট  ছয়টি প্রকাশিত হয় । এরপর থেকে বার্ষিক হিসেবে জাতিঙ্গা প্রকাশিত হয়ে আসছে । ‘জাতিঙ্গা’ পরিচিত এক ভিন্নধর্মী সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে।লিটল ম্যাগাজিন যে এক সাহিত্যনিষ্ঠ আন্দোলন , তাতে জাতিঙ্গা সম্পাদক তুষারবাবু কৈশোর থেকে যুক্ত। এ উপত্যকার আঞ্চলিক ইতিহাস , প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় ও প্রকাশ করে আসছেন। এতে নতুন তথ্য ও চিত্র উঠে আসছে ।
              জাতিঙ্গার প্রথম সংখ্যায় নাগা, অসমিয়া, ডিমাসা,চাকমা, কার্বি,মিজো,চিনা,ককবরক কবিতার বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
                দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার বিশিষ্ট পণ্ডিত রাজমোহন নাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ১৯৯৯ সালে ‘জাতিঙ্গা’ বিশেষ সংখ্যারূপে প্রকাশিত হয় । এই সংখ্যায় প্রাচীন সমতট রাজ্যের নাথ –রাজবংশ নিয়ে রাজমোহন নাথের লেখা পুনঃমুদ্রিত হয়েছে। রাজমোহন নাথ অতীত অনুসন্ধানের অনন্য অগ্রপথিকের নাম,লিখেছেন অনুরূপা বিশ্বাস। লোকসংস্কৃতি চর্চার ধারায় রাজমোহন নাথ, লিখেছেন অমলেন্দু ভট্টাচার্য। শতাব্দীর আলোকে রাজমোহন নিয়ে আলোকপাত করেছেন অতীন দাশ । এছাড়া ,জঙ্গিয়ার গান এবং একটি লোক পুরাণ ও দিমাসাদের লুপ্ত ইতিহাস অনুসন্ধান বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন যথাক্রমে শিবতপন বসু ও তুষারতকান্তি নাথ।
       
          ১৪০১ বাংলা, সপ্তম সংখ্যা বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের পঞ্চদশ অধিবেশন উপলক্ষে প্রকাশিত । এ সংখ্যায় কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বরাক উপত্যকার দেশ পরিচয় নিয়ে লিখেছেন অনুরূপা বিশ্বাস।
         অসমের বরাক উপত্যকার ইতিহাস বিষয়ে প্রত্নলেখের সাক্ষ্য প্রমাণ বিষয়ে আলোকপাত করেন জয়ন্তভূষণ ভত্তাছারজ,কামালুদ্দিন আহমেদের প্রবন্ধ বরাক উপত্যকার প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ এবং রুকনী তীরের রাজঘাট : সম্ভাবনাময় প্রত্নস্থল নিয়ে লিখেছেন তুষারকান্তি নাথ।
       এই সংখ্যার প্রচ্ছদে ১৫৭৬ সালে মাইবাঙের রাজবাড়ির সিংহদ্বারে স্থাপিত একটি প্রস্তর স্তম্ভে উৎকীর্ণলিপি তুলে ধরা হয়েছে ।
                             জাতিঙ্গা অষ্টম সংখ্যায় পাঁচটি মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে । অমলেন্দু ভট্টাচার্যের ভুবনতীর্থ সম্পর্কিত একটি আলোচিত তথ্য ধনুকধারীর পাঁচালি । আশরাফ সিদ্দিকীর নকশিকাঁথা, শিবতপন বসুর ফকিরি গান, জীবন নাথের বাংলা কবিগান ও নাথযোগ এবং তুষারকান্তি নাথের বরাক উপত্যকার লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতিতে ‘গুয়া-পান’। নবম সংখ্যায় ছয়টি প্রবন্ধ ও চারটি কবিতা রয়েছে। প্রচ্ছদে ডিমাসা কাছাড়ি রাজাদের কীর্তি চিহ্ন রাজধানী খাসপুরের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
    
  লেখার বিষয় ও লেখকরা হলেন- সক্রিয় সাদ্রিস্য : মিজো ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর রামায়ণের প্রভাব : সুজিতকুমার ঘোষ। লোকশিল্প ও অর্থনীতি : সুকান্ত পাল। তরাইয়ের অরণ্য দেবতা শালশিরি : শিবতপন বসু । আরণ্য জনপদে লালিত ডিমাসা লোকনৃত্য : তুষারকান্তি নাথ । দশম সংখ্যার প্রচ্ছদে রয়েছে গঙ্গারিডি গবেষণা কেন্দ্র আবিষ্কৃত প্রত্নসম্পদ পাকুড়তলা ও মন্দিরতলায় প্রাপ্ত প্রাক বঙ্গলিপি উৎকীর্ণ পোড়া মাটির ফলক । এই সংখ্যায় লিখেছেন, নরোত্তম হালদার, আশরাফ সিদ্দিকী, জীবন নাথ, অনুরূপা বিশ্বাস, তুষারকান্তি নাথ, সৈয়দ শামসুল হক ও নির্মলেন্দু গুণ।
          একাদশ সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে অধ্যাপক সুভাষচন্দ্র নাথের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। ৬০ ও ৭০ এর দশকে কাবুগঞ্জ জনতা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সুভাষচন্দ্র নাথ নরসিংপুর সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় সাহিত্য,শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চা প্রচার ও প্রসারে ভগীরথের ভুমিকা পালন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয় । তাঁর সম্পাদিত ‘ত্রিধারা’ সাহিত্য পত্রিকা বের হয় । নরসিংপুরে ‘নবরত্ন সাহিত্য সভা’ গড়ে তুলেন তিনি।
  
      ত্রয়োদশ সংখ্যা পরিমলকুমার নাথের স্মৃতিতে উৎসর্গ করা হয়েছে। অনন্য ব্যক্তিত্ব পরিমলকুমার নাথ নিয়ে লিখেছেন প্রভাসচন্দ্র নাথ । দক্ষিণ –পূর্ব কাছাড়ের বৃহত্তর সোনাই-নরসিংপুর অঞ্চলে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চায় এক অগ্রণী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। পরিমলবাবু জাতিঙ্গা সম্পাদক তুষারকান্তি নাথের পিতা । এই সংখ্যায় মায়াবন্ত বিষহরি একটি ব্যতিক্রমি মনসা আখ্যান কাব্য নিয়ে লিখেছেন অমলেন্দু ভট্টাচার্য । চতুর্দশ সংখ্যায় মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য লিখেছেন, লোকনৃত্য আজ ও ব্রাত্য তালিকায় । বরাক উপত্যকার লোকসংস্কৃতি বলয়ে ওঝা নাচ নিয়ে আলোচনা করেন শিবতপন বসু । সিদ্ধষি পালকাপ্যের হস্থীস্থল বরাক উপত্যকার আরেক বিস্ময় লিখেছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী ।
        পঞ্চদশ সংখ্যার প্রচ্ছদে মনিপুরি সমাজের লাইহারাওবা নৃত্যের  ছবি ছাপানো হয়েছে। এই সংখ্যায় নরোত্তম হালদারেরে লেখা গঙ্গারিডি গবেষণা জীবন নাথের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আদি যুগ এবং দেবাশিস দাসের শিলচরে ঐতিহ্যের সন্ধান সংগ্রহে রাখার মতো ।

                                                       

                          
------------------------------------------------------------
  সংযোজনঃ
*পরবর্তী সংখ্যাগুলির বিষয় ছিল * 
১)জাতিঙ্গা ষোড়শ প্রকাশনাঃ'' চর্যাপদ পুথি আবিষ্কারের শতবর্ষ " ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ
২)জাতিঙ্গা সপ্তদশ প্রকাশনাঃ  '' প্রসঙ্গ : চর্যাপদঃ বরাক উপত্যকায় পুথিচর্চা "
৩)জাতিঙ্গা  অষ্টাদশ প্রকাশনাঃ " মিউজিয়াম ও প্রত্নতত্ত গবেষণা;মিউজিয়াম ও জনশিক্ষা "


মঙ্গলবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ভোটর গান

 (২৫ জানুয়ারী national voter day, ভাবলাম কিছু একটা লিখব কিন্তু কিছুই আসছিল না। 
অবশেষে সিলেটিতে প্রথম লেখার চেষ্টা। পুরোপুরি সিলেটি হল কিনা জানিনা।  --পঙ্কজ)

নেতা বারইছইন ভোট ভিক্ষাত    
দাদা দিদিরে কইতরা
রসাইয়া গান বান্দিছইন
হুরুত্তাইনতে নাচিতরা।

ইবার দাদায় ভোট দিতা নায়
দিদিয়েও গাইতরা অউ গান
নেতামাশয় নাছোড়বান্দা
ভোট লাগবউ তান।

বছরে বছরে ভোট দিয়া
লাব অয়না কুনতা
বেড়ায় ধান খাইলায়
দুখ কিগুয়ে হুনতা।

নেতায় কইতরা লাস্ট চান্স
দিয়া দেখিলাও তানরে
দিদিয়ে কইতরা হেসর দাও অ
মারিয়া খাইতায় হকলে।

মিঠা কথা বউত হুনছি
পাইছি হাওয়াত বউত্তা
যেতা দিবার আগে দিলাও
হেষে করমু করার যেতা।

গণতন্ত্র বাতাসে লড়ের
লাগছে টেকার খেলা
ভোট দেওয়াত একজনও নাই
টেকায় মিলে মেলা।



রবিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

শুধু নয়নলোভনই নয়, ‘ভাষা শহিদের নবপুরাণ’ চিত্তলোভনও

ভাষা শহিদের নবপুরাণ
স্মৃতি পাল নাথ
বীরাঙ্গনা প্রকাশনী
প্রকাশকাল : ১৯ মে, ২০০৮ খ্রিঃ

  লিখেছেনঃ  ড০  ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায় 

বি স্মৃতি পাল নাথের  ‘ভাষা শহিদের নবপুরাণ’ কাব্যগ্রন্থটি হাতে পেয়ে খুসিতে মন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার প্রাথমিক কারণ,তন্বী এই গ্রন্থানুটির বর্ণ ও অঙ্গবিন্যাস নয়নলোভন ও চিত্তলোভন।কয়েকদিন পর অবসর মুহূর্তে যখন অভ্যন্তরের বর্ণমালায় চোখ পড়ল ,তখন বুঝতে অসুবিধা হল না যে,ভাষা গবেষক জগন্নাথ চক্রবর্তীর লেখা শেষ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত কবি স্মৃতি পাল নাথের পরিচায়িকাটি কতখানি সত্য ও ধ্রুব । বলিষ্ঠ,পারঙ্গম লেখনী স্মৃতির ।মেধাবি এই লেখনী যখন অন্তরদাহে জ্বালাটিকে প্রকাশ করে তখন বর্ণে বর্ণে রক্ত ঝরে,সেই রক্তে বসুন্ধরা সিক্ত হয়,রক্তগোলাপ ফোটে ।গদ্য এবং পদ্য এবং গদ্য-পদ্য মেশা রচনাগুলি শুধু শব্দের পর শব্দ সাজানো নয়,বর্ণগুচ্ছের অন্তরালে সত্যসাধনের সংবাদটি কলগুঞ্জিত হয়ে ওঠে। কুড়ি পৃষ্ঠার পদবিক্ষপে যে ভুবন পরিক্রমা ঘটতে পারে তার উদাহরণ এই গ্রন্থটি। কোন আকাঙ্ক্ষায় মানুষের এই অনন্তাভিসার মৃত্তিকার পাখি চায়,আকাশ আস্বাদ। ভাষায় ওজস্বিনী কবি বলেছেন , ‘মুঠোতে জীবন নিয়ে চেতনার অভ্যুদয় চাই/ চাই সদর্প অঙ্গীকার (প্রিয় স্বদেশ,তারুণ্য আর সবুজ)। মুক্তিই কাম্য,এ মুক্তি কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক বন্ধন থেকেই মুক্তি নয়,এ মুক্তি  ‘মাথা নত না করার স্বাধীনতা’(স্বাধীনতা)। এই কবির ভাষায় ‘১৯শে মে নক্সীকাঁথা / ঘুম জাগানিয়া পাখি /সেতারের আলাপন /ধ্রুবতারার জেগে ওঠা।’ এই তো জীবন । যেখানে স্বর্গ ও মর্তে মিলনরাখি বাঁধা । যেখানে শহিদ হয় ভাই-বোন মাতৃভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা চেয়ে,যেখানে শহিদ হয় তরুণ-তরুণী কণ্ঠে স্বাদ পেতে,মাতৃভাষার স্বাদ । যে ভাষায় গহন গভীরে ডুব দিতে চায় মন-প্রাণ, সেই ভাষার অধিকার চেয়ে স্মৃতি পাল নাথ সেই শহিদের নবপুরাণ রচনার কবিতা লিখেছেন । গ্রন্থের কবিতাগুলি সার্থক কবিতা,কারণ প্রাণের কবিতা,গভীর কথা,আমাদের রক্তের কথা,সত্তার কথা,যন্ত্রনার কথা,আমাদের আনন্দের কথা,অস্তিত্বের কথা,স্বর্গীয় বেদনা নিয়ে প্রকাশ করেছেন স্মৃতি পাল নাথ । কবিতা মানেই দুঃখ,কবিতা মানেই যন্ত্রণা,যন্ত্রণা দুঃখের হ্রদে নীলপদ্মের সুবাসে কবিতা । কাব্যের প্রতিটি পৃষ্ঠায় এই বাণীটি বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। বিভিন্ন উপমা,উৎপ্রেক্ষা,ছন্দ ও অনুষঙ্গে । স্মৃতি পাল নাথ লিখেছেন –‘ ভাষার জন্য একটি উপত্যকা কাঁদে / ভালবাসার জন্য / বরাক কুশিয়ারা  বুড়িগঙ্গা/কাঁদে ভীষণভাবে/কাঁদে বঙ্গভূমি ,জননী জাহ্নবী/কাঁদে শস্যশ্যামলা বসুন্ধরা/সুরমা কুশিয়ারা মিশে যায় বঙ্গোপসাগরে/গঙ্গা ছুটে চলেছে/বরাকে ধামাইল চড়কের নাচ/জারি সারি ভাটিয়ালি উনিশে মে-র আত্মগাথা জলের বুকে ’(পৃথিবীর মাতৃভাষা)।এ যে কত বড় সত্য কথা,বরাকের মানুষ তা মর্মে মর্মে জানে।সত্য বলেই এ বড় কঠিন কথা। আর এতে বহন করে নিয়ে যাওয়ার কঠিন বেদনা,দায়িত্ব আমাদের সকলের ।
          এখানে বিভেদ নেই- না বয়সের,না জীবিকার,না জাতি ও ধর্মের । হে আমার মাতৃভাষা,তোমাকে পেয়েছি আমি তুলসীতলায়,ধ্রুবতারায়,অন্তরে-বাইরে—এই যে বই,তা যখন শিলচর রেলস্টেশনের দিকে চেয়ে নিষ্কম্প  দাঁড়িয়ে থাকে,তখন উনিশশো একষট্টি থেকে ভেসে আসা নদীর কান্নার মত কান্না শুনতে পায়,এ বড় ব্যাথার কান্না—‘নদীরা বড় কাঁদে/শহিদের মায়ের মত/বুকের মধ্যে কান্নার বোবা পাখি ডানা ঝাপটায়’(অশ্রু ও আগুনের সহজপাঠ)।এ কান্না রচে গান,উনিশে মে হয়ে ওঠে একটি নিটোল কবিতা।
           ’১৯শে মে স্বপ্নের দেশে ঘুম জাগানিয়া পাখি/১৯শে মে ভাইয়ের কপালে বোনের ফোঁটা,আমার জন্মতিথি...১৯শে ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গা মাটির পথ’/বসন্তগান, চৈত্রের শালবন আগ্নেয়গিরির অগ্নুতপাত/১৯শে মে জাগরণের পান্দুলিপি,ছন্দের পাথ/আমার স্বদেশ এবং সংবিধান/১৯শে মে তুমি,তুমিই আমার জন্মের ইতিহাস’(১৯শে মে ঘুম জাগানিয়া পাখি)।স্মৃতি পাল নাথ লিখেছেন, ‘মায়ের বুকে বহ্নিমান সন্তানের চিতা’(বহ্নিমান চিতা,আলোর লন্থন)।নবপুরাণ কথা,কবিতায় বলেছেন, ‘টুটাফাটা মানুষ জাগরণ চায়, যুদ্ধ নয়/মাতৃভাষায় কথা বলে পৃথিবী’।স্মৃতি লেখেন, ‘অন্তর্গত চেতনায় ভাষা শহিদের দেশে,ফুলেরাও কাঁদে, জ্বলে ওঠে কবিতা/ বঙ্কিম,রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,জসিম/ জীবনানন্দের ভাষা/ শরবিদ্ধ বর্ণমালা/ মেঘমালা,এ আলোর লন্থন,হাজার হাজার তার আয়ুশকাল’(আত্মপরিচয়ের বর্ণমালা)।মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য অধিকার চাইতে হয় এ কোনও সভ্য জগতের মানুষের কথা ? কিন্তু তাই ঘটেছে শিলচরে।সহজতম যে বিষয়টি সূর্যের আলোর মত বাতাসের মত সহজসুন্দর ও স্বাভাবিক তাই হয়ে উঠেছে এখানে প্রার্থনার বিষয়। এ কি সভ্যতা? এই কি রাষ্ট্রনীতি ? উনিশে মের পদতলে দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী প্রাণ চিৎকার করে বলে,সভ্যতা কি এই বর্বরতা ? অসমের বর্বর সরকার এরূপ ঘটনাই ঘটিয়ে চলেছে। তাই স্মৃতি বলেছেন, ‘এই আমার প্রথম মানুষ হয়ে বাঁচতে শেখা/অশ্রু আর আগুনের সহজপাঠ/যুদ্ধে আর রক্তে নিষেধে বেড়াজাল ভেঙে/একটি দেশের মানুষ ভাষার জন্য কাঁদে/যে সরোবরে অসংখ্য পদ্ম ফুটে আছে/গুনগুন সারে পাগলা ভ্রমর/ মাতৃভাষায় কথা বলে প্রিথিবি/ফুল ফুতছেই/উড়ে প্রজাপতি(  বহ্নিমান চিতা/ আলোর লন্থন)।কবি লেখেন, ‘যুদ্ধে আর রক্তে নিষেধের বেড়াজাল ভেঙে/ভেসে যায় অমর উনিশের ভেলা’(আত্মপরিচয়ের বর্ণমালা)।
            ভাষার জন্য কাঁদছে মানুষ, মাতৃভাষায় বলার দাবিতে কাঁদছে মানুষ। ঈশ্বর হাসছেন।এ হাসি তো হাসি নয়।এ যে কান্নার নামান্তর কারণ এখানে যে ‘উড়ছে সন্তানের চিতাভষ্ম ছাই,কারা খুঁচিয়ে তুলছে আগুন,আগুনের লেলিহান শিখা,মায়ের বুকে সন্তানের বহ্নিমান চিতা’।
           তাই বলছিলাম,এই তন্বী কাব্যটির অন্তরে অশ্রু জমাট বেঁধে আছে। কবিতা-লালিত্যে যন্ত্রণায় ও মুগ্ধতায় বাসা বেঁধেছে। আমার ভাষা শহিদের নবপুরাণ কাব্য ও তাঁর কবি স্মৃতি পাল নাথকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।