“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

শুধু নয়নলোভনই নয়, ‘ভাষা শহিদের নবপুরাণ’ চিত্তলোভনও

ভাষা শহিদের নবপুরাণ
স্মৃতি পাল নাথ
বীরাঙ্গনা প্রকাশনী
প্রকাশকাল : ১৯ মে, ২০০৮ খ্রিঃ

  লিখেছেনঃ  ড০  ভক্তিমাধব চট্টোপাধ্যায় 

বি স্মৃতি পাল নাথের  ‘ভাষা শহিদের নবপুরাণ’ কাব্যগ্রন্থটি হাতে পেয়ে খুসিতে মন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার প্রাথমিক কারণ,তন্বী এই গ্রন্থানুটির বর্ণ ও অঙ্গবিন্যাস নয়নলোভন ও চিত্তলোভন।কয়েকদিন পর অবসর মুহূর্তে যখন অভ্যন্তরের বর্ণমালায় চোখ পড়ল ,তখন বুঝতে অসুবিধা হল না যে,ভাষা গবেষক জগন্নাথ চক্রবর্তীর লেখা শেষ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত কবি স্মৃতি পাল নাথের পরিচায়িকাটি কতখানি সত্য ও ধ্রুব । বলিষ্ঠ,পারঙ্গম লেখনী স্মৃতির ।মেধাবি এই লেখনী যখন অন্তরদাহে জ্বালাটিকে প্রকাশ করে তখন বর্ণে বর্ণে রক্ত ঝরে,সেই রক্তে বসুন্ধরা সিক্ত হয়,রক্তগোলাপ ফোটে ।গদ্য এবং পদ্য এবং গদ্য-পদ্য মেশা রচনাগুলি শুধু শব্দের পর শব্দ সাজানো নয়,বর্ণগুচ্ছের অন্তরালে সত্যসাধনের সংবাদটি কলগুঞ্জিত হয়ে ওঠে। কুড়ি পৃষ্ঠার পদবিক্ষপে যে ভুবন পরিক্রমা ঘটতে পারে তার উদাহরণ এই গ্রন্থটি। কোন আকাঙ্ক্ষায় মানুষের এই অনন্তাভিসার মৃত্তিকার পাখি চায়,আকাশ আস্বাদ। ভাষায় ওজস্বিনী কবি বলেছেন , ‘মুঠোতে জীবন নিয়ে চেতনার অভ্যুদয় চাই/ চাই সদর্প অঙ্গীকার (প্রিয় স্বদেশ,তারুণ্য আর সবুজ)। মুক্তিই কাম্য,এ মুক্তি কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক বন্ধন থেকেই মুক্তি নয়,এ মুক্তি  ‘মাথা নত না করার স্বাধীনতা’(স্বাধীনতা)। এই কবির ভাষায় ‘১৯শে মে নক্সীকাঁথা / ঘুম জাগানিয়া পাখি /সেতারের আলাপন /ধ্রুবতারার জেগে ওঠা।’ এই তো জীবন । যেখানে স্বর্গ ও মর্তে মিলনরাখি বাঁধা । যেখানে শহিদ হয় ভাই-বোন মাতৃভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা চেয়ে,যেখানে শহিদ হয় তরুণ-তরুণী কণ্ঠে স্বাদ পেতে,মাতৃভাষার স্বাদ । যে ভাষায় গহন গভীরে ডুব দিতে চায় মন-প্রাণ, সেই ভাষার অধিকার চেয়ে স্মৃতি পাল নাথ সেই শহিদের নবপুরাণ রচনার কবিতা লিখেছেন । গ্রন্থের কবিতাগুলি সার্থক কবিতা,কারণ প্রাণের কবিতা,গভীর কথা,আমাদের রক্তের কথা,সত্তার কথা,যন্ত্রনার কথা,আমাদের আনন্দের কথা,অস্তিত্বের কথা,স্বর্গীয় বেদনা নিয়ে প্রকাশ করেছেন স্মৃতি পাল নাথ । কবিতা মানেই দুঃখ,কবিতা মানেই যন্ত্রণা,যন্ত্রণা দুঃখের হ্রদে নীলপদ্মের সুবাসে কবিতা । কাব্যের প্রতিটি পৃষ্ঠায় এই বাণীটি বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। বিভিন্ন উপমা,উৎপ্রেক্ষা,ছন্দ ও অনুষঙ্গে । স্মৃতি পাল নাথ লিখেছেন –‘ ভাষার জন্য একটি উপত্যকা কাঁদে / ভালবাসার জন্য / বরাক কুশিয়ারা  বুড়িগঙ্গা/কাঁদে ভীষণভাবে/কাঁদে বঙ্গভূমি ,জননী জাহ্নবী/কাঁদে শস্যশ্যামলা বসুন্ধরা/সুরমা কুশিয়ারা মিশে যায় বঙ্গোপসাগরে/গঙ্গা ছুটে চলেছে/বরাকে ধামাইল চড়কের নাচ/জারি সারি ভাটিয়ালি উনিশে মে-র আত্মগাথা জলের বুকে ’(পৃথিবীর মাতৃভাষা)।এ যে কত বড় সত্য কথা,বরাকের মানুষ তা মর্মে মর্মে জানে।সত্য বলেই এ বড় কঠিন কথা। আর এতে বহন করে নিয়ে যাওয়ার কঠিন বেদনা,দায়িত্ব আমাদের সকলের ।
          এখানে বিভেদ নেই- না বয়সের,না জীবিকার,না জাতি ও ধর্মের । হে আমার মাতৃভাষা,তোমাকে পেয়েছি আমি তুলসীতলায়,ধ্রুবতারায়,অন্তরে-বাইরে—এই যে বই,তা যখন শিলচর রেলস্টেশনের দিকে চেয়ে নিষ্কম্প  দাঁড়িয়ে থাকে,তখন উনিশশো একষট্টি থেকে ভেসে আসা নদীর কান্নার মত কান্না শুনতে পায়,এ বড় ব্যাথার কান্না—‘নদীরা বড় কাঁদে/শহিদের মায়ের মত/বুকের মধ্যে কান্নার বোবা পাখি ডানা ঝাপটায়’(অশ্রু ও আগুনের সহজপাঠ)।এ কান্না রচে গান,উনিশে মে হয়ে ওঠে একটি নিটোল কবিতা।
           ’১৯শে মে স্বপ্নের দেশে ঘুম জাগানিয়া পাখি/১৯শে মে ভাইয়ের কপালে বোনের ফোঁটা,আমার জন্মতিথি...১৯শে ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গা মাটির পথ’/বসন্তগান, চৈত্রের শালবন আগ্নেয়গিরির অগ্নুতপাত/১৯শে মে জাগরণের পান্দুলিপি,ছন্দের পাথ/আমার স্বদেশ এবং সংবিধান/১৯শে মে তুমি,তুমিই আমার জন্মের ইতিহাস’(১৯শে মে ঘুম জাগানিয়া পাখি)।স্মৃতি পাল নাথ লিখেছেন, ‘মায়ের বুকে বহ্নিমান সন্তানের চিতা’(বহ্নিমান চিতা,আলোর লন্থন)।নবপুরাণ কথা,কবিতায় বলেছেন, ‘টুটাফাটা মানুষ জাগরণ চায়, যুদ্ধ নয়/মাতৃভাষায় কথা বলে পৃথিবী’।স্মৃতি লেখেন, ‘অন্তর্গত চেতনায় ভাষা শহিদের দেশে,ফুলেরাও কাঁদে, জ্বলে ওঠে কবিতা/ বঙ্কিম,রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,জসিম/ জীবনানন্দের ভাষা/ শরবিদ্ধ বর্ণমালা/ মেঘমালা,এ আলোর লন্থন,হাজার হাজার তার আয়ুশকাল’(আত্মপরিচয়ের বর্ণমালা)।মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য অধিকার চাইতে হয় এ কোনও সভ্য জগতের মানুষের কথা ? কিন্তু তাই ঘটেছে শিলচরে।সহজতম যে বিষয়টি সূর্যের আলোর মত বাতাসের মত সহজসুন্দর ও স্বাভাবিক তাই হয়ে উঠেছে এখানে প্রার্থনার বিষয়। এ কি সভ্যতা? এই কি রাষ্ট্রনীতি ? উনিশে মের পদতলে দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী প্রাণ চিৎকার করে বলে,সভ্যতা কি এই বর্বরতা ? অসমের বর্বর সরকার এরূপ ঘটনাই ঘটিয়ে চলেছে। তাই স্মৃতি বলেছেন, ‘এই আমার প্রথম মানুষ হয়ে বাঁচতে শেখা/অশ্রু আর আগুনের সহজপাঠ/যুদ্ধে আর রক্তে নিষেধে বেড়াজাল ভেঙে/একটি দেশের মানুষ ভাষার জন্য কাঁদে/যে সরোবরে অসংখ্য পদ্ম ফুটে আছে/গুনগুন সারে পাগলা ভ্রমর/ মাতৃভাষায় কথা বলে প্রিথিবি/ফুল ফুতছেই/উড়ে প্রজাপতি(  বহ্নিমান চিতা/ আলোর লন্থন)।কবি লেখেন, ‘যুদ্ধে আর রক্তে নিষেধের বেড়াজাল ভেঙে/ভেসে যায় অমর উনিশের ভেলা’(আত্মপরিচয়ের বর্ণমালা)।
            ভাষার জন্য কাঁদছে মানুষ, মাতৃভাষায় বলার দাবিতে কাঁদছে মানুষ। ঈশ্বর হাসছেন।এ হাসি তো হাসি নয়।এ যে কান্নার নামান্তর কারণ এখানে যে ‘উড়ছে সন্তানের চিতাভষ্ম ছাই,কারা খুঁচিয়ে তুলছে আগুন,আগুনের লেলিহান শিখা,মায়ের বুকে সন্তানের বহ্নিমান চিতা’।
           তাই বলছিলাম,এই তন্বী কাব্যটির অন্তরে অশ্রু জমাট বেঁধে আছে। কবিতা-লালিত্যে যন্ত্রণায় ও মুগ্ধতায় বাসা বেঁধেছে। আমার ভাষা শহিদের নবপুরাণ কাব্য ও তাঁর কবি স্মৃতি পাল নাথকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।

কোন মন্তব্য নেই: