“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

একুশ শতকে একুশের প্রাসঙ্গিকতা

(লেখাটি ২০১২ তে 'দৈনিক যুগশঙ্খ' পত্রিকায় প্রকাশিত। ভাসা ভাসা ভাষা-প্রেম নিয়ে বিভিন্ন সময় নিজের ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এ লেখাটিও সেভাবেই লেখা। ---মৃন্ময় দেব)

প্যারিসের জেহান রিক্টাস স্কোয়ারের একটি দেয়ালে মানবিক ঐক্যের প্রতীক স্বরূপ ইউনেস্কোর অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূত বহু দেশের নিজস্ব ভাষায় ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ কথাটি লেখা রয়েছে । দেয়াল জুড়ে পরস্পর অপরিচিত ও অচেনা অক্ষরমালার এমন সহাবস্থান যেন এই কথাই বলতে চায় যে, ‘তুমি আমার ভাষা বলো আমি আনন্দকে দেখি / আমি তোমার ভাষা বলি তুমি আশ্চর্যকে দেখো’ । কিন্তু বাস্তবে  এরকম  ‘আনন্দে-আশ্চর্যে সাক্ষাৎকার’ তো দূর অস্ত , ‘আমি আমার ভাষা বলি তুমি তোমার ভাষা বলো’-গোছের সহনশীলতার পর্যায়েও পৌঁছতে পারেনি সভ্যতার বড়াই করা এ পৃথিবীর মানুষ । না, একুশ শতকের একটা দশক পাড়ি দিয়েও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে এমন আশা আমাদের পক্ষে আজো দুরাশা বইকি ! 
একুশে ফেব্রুয়ারি । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস । ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে এই দিনটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । তারপর থেকে সদস্য দেশগুলোয় সরকারি-বেসরকারি , প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক নানান উদ্যোগে নানা ভাবে ‘মাতৃভাষা দিবস’  পালিত হয়ে আসছে । ভারতবর্ষেও হচ্ছে অবশ্যই । তবে তা মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেমিনার , সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিল , কিছু সরকারি উদ্যোগ , আর পত্র-পত্রিকার এলোমেলো নিবন্ধাদিতে সীমিত থাকছে । জনসমাজে তার প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে । ভাষা-সচেতনতা বলতে যা বোঝায় তা বস্তুত আমাদের তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তদের মধ্যেও দুর্লভ । ভাসা-ভাসা ভাষা-প্রেম সম্বল করেই তাই নিয়ম-মাফিক চলে ‘একুশে’র বাৎসরিক উদযাপন । ‘শহিদের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ ! না, পারি না ; সারা বছর ভুলে থাকতে পারলেও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ দিনটিতে তা পারি না । বাঙালি অতটা আত্মবিস্মৃত জাতি নয় অবশ্যই । বরাক উপত্যকার বাঙালির কাছে ‘উনিশ’ আর ‘একুশ’ মিলেমিশে একাকার । এই পারে ‘উনিশ’, ওই পারে ‘একুশ’ – ভাষা নদীর দুই কূল জুড়ে একই ইতিহাস । 
            গোটা বিশ্বে কম বেশি ছ’হাজার ভাষা রয়েছে , যার হাজার তিনেক এ শতাব্দির শেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে । বিশেষজ্ঞদের এরকমই অভিমত । বিশ্বায়নের জাঁতাকলে অবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে প্রতিনিয়ত । অঞ্চল বিশেষে এই জটিলতার মাত্রা ও পরিধি কেবল ভিন্ন নয় , প্রায় চরমে পৌঁছে গেছে । হাতের কাছের উদাহরণ  আমাদের প্রিয় রাজ্য অসম ।  কিন্তু এরকম এক জটিল পরিস্থিতিতে , যেখানে প্রতিদিন  কোন না কোন ভাষার সলিল সমাধি ঘটছে কিংবা ঘটার উপক্রম হচ্ছে , মাতৃভাষার সুরক্ষা আদৌ সম্ভব কি না সেটাই এক কঠিন জিজ্ঞাসা । এই প্রশ্নচিহ্নের ভূমিতে দাঁড়িয়েই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের’ প্রাসঙ্গিকতা বিচার্য । মাতৃভাষার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার সম্পর্কই বা কি এবং কতটুকু সেটাও বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি । Nobel Laureate Mr. Hallor Laxness-এর মন্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য – ‘the world becomes a poorer place whenever an international language swallows up a smaller one, but the international language becomes no richer for doing so... ’ ।
মাতৃভাষা হচ্ছে চিন্তা-চেতনার আঁতুর ঘর । মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সংস্কৃতির সারস্বত বৃত্তটি । মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা তাই সমগোত্রীয় । ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ হরিহর আত্মার । সংস্কৃতির বৈচিত্র আসলে বহুরূপে বিশ্বের অবলোকন , জীবন রহস্যের বহুমাত্রিক প্রতিফলন । সংস্কৃতির সমন্বয়ই হল  বৈশ্বিক উপলব্ধির একমাত্র পথ । এই সমন্বয় যদি কাঙ্ক্ষিত হয় তাহলে ভাষার মৃত্যু প্রতিরোধ করতেই হবে । মাতৃভাষার অধিকার তারাই দাবি করতে পারে প্রতিটি ভাষাকে যারা বৃহত্তর মানব পরিবারের সম্পদ জ্ঞানে সমমর্যাদা দিতে উৎসুক । ভাষাগত বিভেদ কিংবা সংস্কৃতির সংঘাত নিঃসন্দেহে শান্তি ও মৈত্রীর পরিপন্থী । সে কারণেই ১৯৯৯ সালের উল্লিখিত অধিবেশনে Kofi  Annan সময়োচিত মন্তব্য করেছিলেন যে - ‘ the lesson of our age is that languages are not mutually exclusive, but that human beings and humanity itself are enriched by communicating in more than one language .’ ।
          বহু ভাষা ও বিবিধ সংস্কৃতির মিলনে গড়ে ওঠা সমাজ (Multilingual multicultural society) ব্যতীত মানব জাতির মুক্তি অসম্ভব । বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্রকে স্বীকার করে নিয়েই সৃষ্টি হতে পারে বিশ্বমানবের নয়া বিশ্বসংস্কৃতি । এছাড়া বিশ্বশান্তির অন্যতর সম্ভাবনা আপাতত দৃষ্টিগোচর নয় । ‘সিভিল সোসাইটি’ গুলিকে এ বিষয়ে সচেতন হয়ে কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে ।  আঞ্চলিক বৈশিষ্ট রক্ষা করার সাথে সাথে বিশ্ব-সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ গড়ে তুলতেও হবে ।  শেকড়ে থাকবে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির সংহতি , আর শাখার বিস্তারে আন্তর্জাতিকতার বোধ ।  বিশ্ব-নাগরিক হয়ে ওঠার এই প্রয়াস ব্যতীত বিশ্বশান্তির স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে । অথচ বাস্তবে ঘটছে ঠিক উল্টো । বাচনে ভাষণে যেখানে বিবিধের মাঝে মিলনের এত অসংখ্য অপরূপ বিজ্ঞাপন সেক্ষেত্রে বাস্তবে  বিরোধ কেন ? এক কথায় একেবারে সহজ উত্তর একটা দেওয়া যায় অবশ্যই , এবং সেটা একেবারে ভুল উত্তরও নয় । উত্তরটা হল – বিশ্বায়নের বিশ্বজোড়া বিভেদনীতি । যে কোন জাতির ভাষা-সংস্কৃতি যদি কেড়ে নেওয়া যায় তাহলে সেই জাতিকে পদানত করা নিতান্ত সহজ হয় । সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসাবে  এই পদ্ধতি বারে বারে যে অনুসৃত হয়েছে সে সাক্ষ্য তো ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়ানো । বিশ্বায়নের বাজারকেন্দ্রিক অভিযান তাই সংস্কৃতিহীনতার এক বাতাবরণ তৈরিতে তৎপর । প্রতিটি ভাষাই আজ , এমনকি ইংরেজিও , কোন না কোন ভাবে এই বাজার কর্তৃক আক্রান্ত । পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন ভাষা-সংস্কৃতিকে বেঁচে থাকতে হলে অতি অবশ্যই এই মুনাফা-কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । পরিবর্তে গড়ে তুলতে হবে মানুষ-কেন্দ্রিক এক নয়া বিশ্বায়নের চেতনা । এটা সম্ভব হতে পারে কেবল জাতিগুলির সামূহিক ঐক্যের ভিত্তিতে । আর , বলা বাহুল্য , সেরকমের ঐক্য গড়ে তোলার প্রাথমিক শর্তই হল পরস্পরের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা । 
কিন্তু বিশ্বায়নের তুখোড় কৌশুলিরা দুনিয়াটাকে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিতে চায় বাজার দখলের স্বার্থে । মানুষের সঙ্গে মানুষের স্বাভাবিক মানবিক সম্পর্ককে হটিয়ে দিয়ে ওরা চায় ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক বহাল করতে ।  সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের এটাই মূল নীতি । মুশকিল হচ্ছে , আমাদের সমাজের অনেক জ্ঞানী গুণীও এই বিশ্বায়নের পালে হাওয়া দিয়ে যাচ্ছেন , চার দেয়ালের নিরাপদ ঘেরাটোপে বসে বাতানুকুল তত্ত্ব হাজির করছেন । একদিকে বিশ্বজোড়া ক্রমবর্ধমান দারিদ্র , খাদ্য সংকট , আর আরেক দিকে ভোগ-বিলাস ও অন্যায় অপচয় । বিশ্বের বিক্ষুব্ধ মানুষ শোষণ বঞ্চনার দুর্গে ঐক্যবদ্ধ বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে বসে তার জন্যই ভাষা ও ধর্মের নামে দিশাহীন জাতিগোষ্ঠী গুলিকে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার নিকৃষ্ট রাজনীতিকে হাতিয়ার করা হচ্ছে । আর অন্যদিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপনের নাটকীয় আয়োজনের মাধ্যমে মুনাফাখোর মুখগুলিকে খানিকটা মানবীয় আদল দেবার হাস্যকর প্রয়াস নজরে আসছে ।   

            তবে এও ঠিক যে , ভাষা কেন্দ্রিক বিভেদের রাজনীতি চোখে আঙুল দিয়ে এটাও দেখিয়ে দিচ্ছে যে বহুভাষিক ঐক্য ও বিবিধ সংস্কৃতির সমন্বয় বস্তুত সম্ভব । এই সম্ভাবনার উপলব্ধিটাই খুব জরুরি এসময় । ভাষার সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতির সম্পর্কটাও বুঝতে হবে ।  বুদ্ধদেব বসু বহুদিন আগে এ বিষয়ে সচেতন হতে বলেছিলেন তাঁর একটি নিবন্ধে । আধুনিক সমাজে ভাষাকে কেবলমাত্র মনের ভাব প্রকাশের উপায় বা মাধ্যম রূপে বিবেচনা করাটা যথার্থ বুদ্ধিমানের কাজ নয় । কেননা , জীবনযাপনের বর্ধিষ্ণু জটিলতা ভাষার ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে । মৌলিক ভাবগুলির বিনিময় ভাষার ব্যবহার ব্যতিরেকেও হয়তবা সম্ভব , কিন্তু ‘আমাকে ভোট দিন’ কথাটা বোঝাতে ভাষাটা চাই-ই । এই বাড়তি বোঝা কাঁধে চাপার দরুণ শুরু হল এক নয়া অধ্যায় – অন্যতর প্রয়োজনে ভাষার অ-স্বাভাবিক অ-মানবিক  ব্যবহার । প্রকৃত বিচারে ভাষার সংকটের মূল এখানেই । দ্বন্দ্বটা আসলে জনসাধারণের ভাষার জনবিরোধী ব্যবহারের প্রক্রিয়ার মধ্যে নিহিত । রাজনীতির কূট চাল এই দ্বন্দ্বকে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত করে , যার অনিবার্য ফল অর্থহীন হানাহানি , অযথা রক্তপাত । এর হাত থেকে রেহাই  পেতে হলে আমাদের ব্যাপক অর্থে ‘ভাষায় এক ভালবাসায় এক মানবতায় এক’ হতেই হবে । বিশ্বের সব ভাষার মানুষই যেন আজ নিজস্ব শব্দমালায় ‘occupy wall street’ কথাটা দেয়ালে দেয়ালে লিখে দিতে চায় ।  এই প্রেক্ষাপট মনে রেখে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত ও সঙ্কল্প যদি গৃহীত হয় তবেই তা আনুষ্ঠানিক আবেগের মঞ্চ-প্রদর্শনী না হয়ে উপযুক্ত মাত্রা লাভ করতে পারে । নতুবা উনিশের ভূমিতে একুশের চেতনা  একদিন  নূতন ঊষার সংবাদ বয়ে আনবে সে আশা  দুরাশা হয়েই থেকে যাবে!


(C) Picture:ছবি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
লেখাটা ইচ্ছে করলে এখানেও পড়তে পাবেনঃ '
Ekusher Prasongikota ' লেখা অংশে ক্লিক করুন। চলে যাবেন স্ক্রাইবডে। সেখান থেকে এটা নামিয়ে, কিম্বা না নামিয়ে কম্পিটারের পর্দা জুড়ে পড়তে পারবেন।
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!

কোন মন্তব্য নেই: