“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

আকরের সন্ধানে... দেড়দশক পেরিয়ে “জাতিঙ্গা” সাহিত্য, আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতির গবেষণা পত্রিকা

                                         (লেখাটি দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় ৪ ডিসেম্বর,২০০৭ সালে প্রকাশিত)                                                                                           
                                                           লিখেছেনঃ  # জিতেন্দ্র নাথ #

রাক উপত্যকায় নিয়মিত ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দীর্ঘদিন থেকে উন্নতমানের রুচিশীল যে সব সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে , এর মধ্যে অন্যতম “জাতিঙ্গা” সাহিত্য পত্রিকা । কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক তুষারকান্তি নাথ সম্পাদিত “জাতিঙ্গা” এক ব্যতিক্রমধর্মী সাহিত্য পত্রিকা । সাহিত্য, লোকসাহিত্য, লোক সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষণাধর্মী পত্রিকা ।এর আগে লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ক পত্রিকা অধ্যাপক দেবব্রত দত্ত সম্পাদিত ‘হৈড়িম্ব’ দুই-তিন সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে যায় । ফলে এ অঞ্চলের ‘জাতিঙ্গা’ প্রকাশের বিশেষ তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অতীত ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধের উপর জাতিঙ্গা যে গুরুত্ব দিয়ে থাকে তা সত্যি প্রশংসনীয়।
     
 ইদানীং সচেতন পাঠকমহলে জাতিঙ্গা নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে এক উন্নতমানের কাগজ হিসেবে। জাতিঙ্গার কলেবর ছোট হলেও প্রতিটি সংখ্যায় নতুন বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে, অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য ।উঠে আসছে নতুন বিষয় নতুন চিন্তা । জাতিঙ্গার প্রথমদিকের সংখ্যাগুলো কবিতা বিষয়ক ছিল। পরবর্তীতে চরিত্র পাল্টে যায় । ১৯৯০ সালে তুষারকান্তি নাথ সম্পাদিত ‘জাতিঙ্গা’ হাফলঙ থেকে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে । সহযোগী সম্পাদক ছিলেন কবি ও সম্পাদক পত্নী স্মৃতি পাল নাথ ।
          জাতিঙ্গা প্রকাশনার দেড়দশক অতিক্রান্ত। দীর্ঘ সতেরো বছরে ষোলটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে । ১৯৯২ সালে দ্বিতীয় সংখ্যা বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি  সম্মেলনের দ্বাদশ অধিবেশন উপলক্ষে হাফলঙ ও শিলচর থেকে একযোগে প্রকাশিত হয় ।তৃতীয় সংখ্যা সম্মেলনের ত্রয়োদশ অধিবেশন উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ।
        
              ১৯৯৩, ১৯৯৪, ও ১৯৯৫ সালে দুটি করে মোট  ছয়টি প্রকাশিত হয় । এরপর থেকে বার্ষিক হিসেবে জাতিঙ্গা প্রকাশিত হয়ে আসছে । ‘জাতিঙ্গা’ পরিচিত এক ভিন্নধর্মী সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে।লিটল ম্যাগাজিন যে এক সাহিত্যনিষ্ঠ আন্দোলন , তাতে জাতিঙ্গা সম্পাদক তুষারবাবু কৈশোর থেকে যুক্ত। এ উপত্যকার আঞ্চলিক ইতিহাস , প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় ও প্রকাশ করে আসছেন। এতে নতুন তথ্য ও চিত্র উঠে আসছে ।
              জাতিঙ্গার প্রথম সংখ্যায় নাগা, অসমিয়া, ডিমাসা,চাকমা, কার্বি,মিজো,চিনা,ককবরক কবিতার বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
                দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার বিশিষ্ট পণ্ডিত রাজমোহন নাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ১৯৯৯ সালে ‘জাতিঙ্গা’ বিশেষ সংখ্যারূপে প্রকাশিত হয় । এই সংখ্যায় প্রাচীন সমতট রাজ্যের নাথ –রাজবংশ নিয়ে রাজমোহন নাথের লেখা পুনঃমুদ্রিত হয়েছে। রাজমোহন নাথ অতীত অনুসন্ধানের অনন্য অগ্রপথিকের নাম,লিখেছেন অনুরূপা বিশ্বাস। লোকসংস্কৃতি চর্চার ধারায় রাজমোহন নাথ, লিখেছেন অমলেন্দু ভট্টাচার্য। শতাব্দীর আলোকে রাজমোহন নিয়ে আলোকপাত করেছেন অতীন দাশ । এছাড়া ,জঙ্গিয়ার গান এবং একটি লোক পুরাণ ও দিমাসাদের লুপ্ত ইতিহাস অনুসন্ধান বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন যথাক্রমে শিবতপন বসু ও তুষারতকান্তি নাথ।
       
          ১৪০১ বাংলা, সপ্তম সংখ্যা বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের পঞ্চদশ অধিবেশন উপলক্ষে প্রকাশিত । এ সংখ্যায় কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বরাক উপত্যকার দেশ পরিচয় নিয়ে লিখেছেন অনুরূপা বিশ্বাস।
         অসমের বরাক উপত্যকার ইতিহাস বিষয়ে প্রত্নলেখের সাক্ষ্য প্রমাণ বিষয়ে আলোকপাত করেন জয়ন্তভূষণ ভত্তাছারজ,কামালুদ্দিন আহমেদের প্রবন্ধ বরাক উপত্যকার প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ এবং রুকনী তীরের রাজঘাট : সম্ভাবনাময় প্রত্নস্থল নিয়ে লিখেছেন তুষারকান্তি নাথ।
       এই সংখ্যার প্রচ্ছদে ১৫৭৬ সালে মাইবাঙের রাজবাড়ির সিংহদ্বারে স্থাপিত একটি প্রস্তর স্তম্ভে উৎকীর্ণলিপি তুলে ধরা হয়েছে ।
                             জাতিঙ্গা অষ্টম সংখ্যায় পাঁচটি মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে । অমলেন্দু ভট্টাচার্যের ভুবনতীর্থ সম্পর্কিত একটি আলোচিত তথ্য ধনুকধারীর পাঁচালি । আশরাফ সিদ্দিকীর নকশিকাঁথা, শিবতপন বসুর ফকিরি গান, জীবন নাথের বাংলা কবিগান ও নাথযোগ এবং তুষারকান্তি নাথের বরাক উপত্যকার লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতিতে ‘গুয়া-পান’। নবম সংখ্যায় ছয়টি প্রবন্ধ ও চারটি কবিতা রয়েছে। প্রচ্ছদে ডিমাসা কাছাড়ি রাজাদের কীর্তি চিহ্ন রাজধানী খাসপুরের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
    
  লেখার বিষয় ও লেখকরা হলেন- সক্রিয় সাদ্রিস্য : মিজো ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর রামায়ণের প্রভাব : সুজিতকুমার ঘোষ। লোকশিল্প ও অর্থনীতি : সুকান্ত পাল। তরাইয়ের অরণ্য দেবতা শালশিরি : শিবতপন বসু । আরণ্য জনপদে লালিত ডিমাসা লোকনৃত্য : তুষারকান্তি নাথ । দশম সংখ্যার প্রচ্ছদে রয়েছে গঙ্গারিডি গবেষণা কেন্দ্র আবিষ্কৃত প্রত্নসম্পদ পাকুড়তলা ও মন্দিরতলায় প্রাপ্ত প্রাক বঙ্গলিপি উৎকীর্ণ পোড়া মাটির ফলক । এই সংখ্যায় লিখেছেন, নরোত্তম হালদার, আশরাফ সিদ্দিকী, জীবন নাথ, অনুরূপা বিশ্বাস, তুষারকান্তি নাথ, সৈয়দ শামসুল হক ও নির্মলেন্দু গুণ।
          একাদশ সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে অধ্যাপক সুভাষচন্দ্র নাথের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। ৬০ ও ৭০ এর দশকে কাবুগঞ্জ জনতা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সুভাষচন্দ্র নাথ নরসিংপুর সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় সাহিত্য,শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চা প্রচার ও প্রসারে ভগীরথের ভুমিকা পালন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয় । তাঁর সম্পাদিত ‘ত্রিধারা’ সাহিত্য পত্রিকা বের হয় । নরসিংপুরে ‘নবরত্ন সাহিত্য সভা’ গড়ে তুলেন তিনি।
  
      ত্রয়োদশ সংখ্যা পরিমলকুমার নাথের স্মৃতিতে উৎসর্গ করা হয়েছে। অনন্য ব্যক্তিত্ব পরিমলকুমার নাথ নিয়ে লিখেছেন প্রভাসচন্দ্র নাথ । দক্ষিণ –পূর্ব কাছাড়ের বৃহত্তর সোনাই-নরসিংপুর অঞ্চলে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চায় এক অগ্রণী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। পরিমলবাবু জাতিঙ্গা সম্পাদক তুষারকান্তি নাথের পিতা । এই সংখ্যায় মায়াবন্ত বিষহরি একটি ব্যতিক্রমি মনসা আখ্যান কাব্য নিয়ে লিখেছেন অমলেন্দু ভট্টাচার্য । চতুর্দশ সংখ্যায় মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য লিখেছেন, লোকনৃত্য আজ ও ব্রাত্য তালিকায় । বরাক উপত্যকার লোকসংস্কৃতি বলয়ে ওঝা নাচ নিয়ে আলোচনা করেন শিবতপন বসু । সিদ্ধষি পালকাপ্যের হস্থীস্থল বরাক উপত্যকার আরেক বিস্ময় লিখেছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী ।
        পঞ্চদশ সংখ্যার প্রচ্ছদে মনিপুরি সমাজের লাইহারাওবা নৃত্যের  ছবি ছাপানো হয়েছে। এই সংখ্যায় নরোত্তম হালদারেরে লেখা গঙ্গারিডি গবেষণা জীবন নাথের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আদি যুগ এবং দেবাশিস দাসের শিলচরে ঐতিহ্যের সন্ধান সংগ্রহে রাখার মতো ।

                                                       

                          
------------------------------------------------------------
  সংযোজনঃ
*পরবর্তী সংখ্যাগুলির বিষয় ছিল * 
১)জাতিঙ্গা ষোড়শ প্রকাশনাঃ'' চর্যাপদ পুথি আবিষ্কারের শতবর্ষ " ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ
২)জাতিঙ্গা সপ্তদশ প্রকাশনাঃ  '' প্রসঙ্গ : চর্যাপদঃ বরাক উপত্যকায় পুথিচর্চা "
৩)জাতিঙ্গা  অষ্টাদশ প্রকাশনাঃ " মিউজিয়াম ও প্রত্নতত্ত গবেষণা;মিউজিয়াম ও জনশিক্ষা "


কোন মন্তব্য নেই: