“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৩

এলোমেলো



।। দ্বীপতনয় ঘোষ ।।

 












দী বলেছে বদলাবে পথ
বাঁকের শেষে একলা পাড়ে

বসে আছে সে মেঘলা মনে
হারিয়ে গেছে মেঘেরই দেশে

মেঘ কেটেছে রোদ উঠবে বলে
ঝড় থামবে নতুন শুরু হবে বলে

কিছু আদর জলে ধুয়ে যাবে
বাকি সব স্মৃতি হয়ে মনে ‍রয়ে যাবে।

নুড়ি পাথর



।।শৈলেন দাস।।



হাজার বছরের প্রতীক্ষার ফল
আজকের এই মূহূর্ত
আমাদের প্রথম দেখা প্রথম আলাপ
প্রথম পরিচয়।

তুমি স্থির, শান্ত
দুচোখে প্রাচীন সরোবরের স্নিগ্ধ ছায়া
আমি নিক্ষেপিত নুড়ি পাথর
অতলে ডুবে যাওয়া।

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৩

আকাশী মুগ্ধতা


।।শৈলেন দাস।।



কমুঠু আবীর আকাশে ছড়িয়ে
প্রিয়জন তোমাকে জানাই
বসন্তের অভিবাদন
ফুলে ফুলে সেজেছে পৃথিবী
আকাশী মুগ্ধতায় মজেছে মন।

রামধনু নয়, সাত রঙে রাঙানো
এই মুহূর্তে একটি জীবন।

বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০১৩

রংচটা দিন হোক রঙিন

                             ।। শৈলেন দাস।।















ফা
গুনের এই শীতল হাওয়ায়
 হৃদয়ের উষ্ণতম আবেশ
 ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীময়
 গ্লোবাল ওয়ার্মিং হোক শেষ!
 রংচটা দিন হোক রঙিন
 প্রজাপতি হোক এই মন
 উড়ে উড়ে যাক দূরের ঠিকানায়
 যেখানে আছে প্রিয়জন।
 ‌‌যত সুপ্ত আশা জাগুক আবার
 নবরূপে সেজে উঠুক জীবন
 ফুলে ফুলে আজ খেলব হোলি
 আনন্দে মাতোয়ারা হবে ভুবন।

কথায় কথায়...

                                                                                                    ।।মিফতাহ উদ-দ্বীন।।
(c)Picture:ছবি


             ছোটো খালার বিয়েতেই ঠিক হয় যে আমি সরকারি স্কুলে পড়বো। জলিল স্যার ই আব্বাকে পরামর্শটা দিলেন, আর আমি ভর্তি হয়ে গেলাম “গম্মেন্ট স্কুলে” ভালো নাম “করিমগঞ্জ সরকারি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়”, ডাক নাম “গম্মেন্ট স্কুল” অবশ্য পরামর্শ দেয়ার সময় তিনি আমার “জলিল স্যার” ছিলেন না, আমার খালু ছিলেন। সে যাই হোক, যে জন্য এই লেখাটা তার বিষয় বস্তু কিন্তু বেশ পুরনো। আর ব্যাপারটা একটা ধুঁয়ার গুলার মত ঘুরপাক খাচ্ছে মগজে আজ কয়দিন। কাল এক মহাপুরুষের থেকে শুনেছিলাম লেখা নাকি এক বিরাট ডিসচার্জ। মগজ হালকা হয়, মন প্রসন্ন হয়,আর তাই লিখতে বসা। মগজ, মনের এই অবস্থান সুচক ধারনা আবশ্য আমার একান্ত নিজের। 

           এবার আসল কথায় আসি। ঘটনার শুরু সেই ক্লাস ফাইভ থেকেই। সবে মায়ের স্কুল পাশ করেছি এখন স্কুলে যাওয়ার নতুন সঙ্গী আব্বা। তিরিশ পয়তিরিশ মিনিটের রিক্সা যাত্রার ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন ক্লাসে ঢুকার অনুমতি নিতাম, ফার্স্ট পিরিয়ডের বয়স তখন দশ মিনিট। এমন ও হতো যে ফার্স্ট পিরিওড তাঁর প্রৌড়ের শেষ প্রান্তে, শেষ বেঞ্চের বাসিন্দাদের তোড়জোড় লেগে গেছে রাম নাম সত্য করতে আর আমি হাফাতে হাফাতে বইএ ভরা ট্রাঙ্ক নিয়ে ইংরাজিতে স্যারের অনুমতি প্রার্থনা করছি। এমন খুব কমই ঘটেছে যে ছ’শ ছাত্রের সাথে আমি ও বারান্দায় দাড়িয়ে ঠিক দশটা তিরিশে জনগন মন অধিনায়কের আগমনী গান দিয়ে একটা নতুন ক্লাসের জন্ম দিয়েছি আর হর্ষ উল্লাসে নিয়ে গেছি নিজের ক্লাসে। সব দোষ ছিল আমার আব্বার, তিনি সাইকেল কিনে দিতে ভয় পেতেন আর তাই আমাকে আসতে হতো রিক্সা করে উনার সাথেই। তো আমি বেচারা মফঃস্বলের ছেলে আর বাকিরা সবাই শহরের তাই কথা বলতে একটু অসুবিধা হতো। কথা বলতে বলতে হঠাৎ মুখ ফসকে যেই কোন সিলেটি শব্দ বেরুলো সঙ্গে সঙ্গেই মুখে কুলুপ এঁটে বসা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকতো না। বাক্যটা সম্পূর্ণ করার মানসিকতাটা ও চলে যেত। আমার অসুবিধেটা সিলেটি বা ছাপার ভাষায় ছিল না, ছিল ওদের কথ্য ভাষার প্রতি। আমি সেটা বুঝতাম না। সেটা না ছিল খাঁটি সিলেটি না ছিল শুদ্ধ বাংলা। বাংলা আর সিলেটির মিশ্রণে তৈরি সে এমন এক ভাষা যা আমার বলতে একদম ইচ্ছে হতো না। তাই কথা বলতে বলতে থেমে যেতাম। পরে অবশ্য অভ্যাস হয়ে গিয়ে ছিল। কিন্তু কোনদিনই আনন্দ পাইনি ওইগুলো বলতে। আমি কিছু নমুনা দিচ্ছি, যেমন ধরুন কেউ এসে বললো, “তোরার মতন আইজ আমরার ও উপবাস” বাক্যটা কতটা শুদ্ধ বাংলায় হয়েছে তা জানিনা তবে একটুকুও সিলেটি হয় নি। সিলেটি হলে এমন হতো, “তুমরার লাখান আইজ আমরার ও উপবাস”, “রোজা” হতে পারতো “উপবাসের” জায়গায়, কিন্তু সে না হয় বাদ দিলাম, যেহেতু শব্দটা আরবিক। “চল একটু জল (‘জ’ কে একটু হালকা ভাবে উচ্চারণ করুন) খাইয়া আই” কে তো এভাবে বলা যায় “চল থুড়া পানি (‘প’ কে একটু ‘ফ’ এর মত উচ্চারণ করুন) খাইয়া আই”, “সাইকেলর চাকা ইগু গর্তত ঢুকি গেসিল” না বলে “সাইকেলর সাক্কা ইগু গাতো হামাই গেসিল” বলা যেত অনায়াসেই। এরকম আরও হাজারটা উদাহরণ আছে যা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কিন্তু শুধু ওই সিলেটি কে সিলেটির মত বলায় অনেক সময় তথাকথিত “বাংলেটি”রা (বাংলা এবং সিলেটির মিশ্রণ) খাঁটি সিলেটীদের “বাঙ্গাল” তকমা এঁটে দিত। যদিও আমাকে কেউ কোনদিন বলেনি, তবে ‘বাঙ্গাল’ শব্দটা শুনে একটা গালির মত মনে হতো। সবচেয়ে প্রধান ফারাক টা ছিল ‘জল’ আর ‘পানি’ তে, জল বলে অমুসলিম সিলেটিরা আর পানি বলে ‘বাঙ্গাল’রা। তো এরকম শব্দ আর কথার অন্তর্ঘাত নিয়ে আমার বেড়ে ওঠা। কলেজে ওঠার পর জানতে পারলাম যারা নাকি “উঠরা” তাঁদের ভাষা হচ্ছে এই “বাংলেটি”। ‘উঠরা’ শব্দ টা আমার কাছে নতুন ঠেকল, জিজ্ঞেস করলাম এটা আবার কি? শুনলাম যারা নাকি বাংলাদেশ থেকে উঠে এসেছে তাঁদের ভাষা হচ্ছে এটা। আর যারা এখানের ই ছিল তারা বলে খাঁটি সিলেটি। বাংলা নাটক সেই ছোটবেলা থেকে দেখতাম, শুনতাম। অনেক রকম বাংলা শুনেছি, কলকাতার বাংলা, ঢাকাইয়া বাংলা, চাঁটগাইয়া বাংলা, ময়মনসিংহের বাংলা, বরিশালের বাংলা, সিলেটের বাংলা। সবটাতেই একটা রস ছিল। কিন্তু সেই রস টা ভারতীয় সিলেটিদের কাছ থেকে পাইনি কখনও। জানিনা এই তফাতটার কারণ কী? কেন একই সিলেটি হয়ে মুসলিমরা পানি বলে আর অমুসলিমরা জল। 

এখন মনে পড়ে সেসব দিনগুলি। কোথায় জল আর কোথায় পানি? একাধারে ইংরাজি, হিন্দি সব ঝেড়ে যাই একটু তাজা সব্জি কেনার জন্য আর ওপাশ থেকে অনর্গল তামিল ছুটে আসে তীক্ষ্ণ বাণের মত। আমার সব্জি কে ফালা ফালা করে কেটে ওখানেই “লাবড়া” বানিয়ে দেয়। 

২৫ মার্চ, ২০১৩
মাদ্রাজ

একটি চোখ

                                     ।। শৈলেন দাস।।



















মি যেখানে দাঁড়িয়ে
 ডানে রামকৃষ্ণ সারদা মা বাঁয়ে
 মাঝখানে জগজ্জননী, আমার বাঁ দিকটায় একটু সামনে
 দক্ষিণ দিকে মুখ।
 ভক্তরা আসছে কাতারে
 কেউ দাঁড়িয়ে কেউবা বসে
 কেউ প্রণাম করছে হাঁটুগেড়ে।
 একজন মহিলা ঘাড় নোয়াতে
 নজরে পড়ল একটি চোখ।
 যেন পবিত্র জোসনায়-
 নির্মল আকাশে, চঞ্চল বাতাসে
 বিলিয়ে অনুভূতির সুখ
 নারকেল পাতার মৃদু ঝাপটায়
 আড়ালে যায় চাঁদের মুখ।

বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০১৩

আমি নাকি ভিনদেশি

।।শৈলেন দাস।।









মি বেড়ে উঠেছি বরাকের কোলে
 জন্ম নিয়ে দেখেছি যে আলো
 তা প্রতিফলিত হয়ে এসেছে
 এই বরাকেরই মাটি, ঘাস, জলে।
 বুক ভরে টেনে নিয়ে যে শীতল বাতাস
 সচল রেখেছি আমার হৃদযন্ত্র
 বছরের পর বছর ধরে
 তার নিবিড় প্রবাহ বয়ে চলেছে
 এই বারাকেরই আনাচে-কানাচে হয়ে।
 তবুও রাজনীতির কুশীলবরা
 আমার মাতৃভাষার প্রসঙ্গ টেনে
 আমার নামের পাশে বসিয়ে দেয় “ডি”
 সন্দেহ করে আমি নাকি ভিনদেশি!
 তাই আমাকে তাড়া করে দিটেনশন ক্যাম্প
 বা নোম্যানস ল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়ার ভয়।
 স্ব-ঘোষিত, স্ব-স্বীকৃত ভূমিপুত্রদের
 এই অসাংবিধানিক কারসাজি
 আমার আত্মমর্যাদায় আঘাত করে
 আমার মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হয়
 স্ত্রী-পুত্র পরিজন নিয়ে আমাকে
 প্রতিদিন ভীত, সন্ত্রস্ত থাকতে হয়।
 আজ অসহায় আমি
 অসহায় আমার জাতিসত্ত্বা
 আর আমার স্বাধীনতা
 প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়।

বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৩

ঝিল

 ।। শৈলেন দাস ।।
(c) Picture:ছবি
         আজকের দিনটা বিজুর কাছে স্পেশাল্। ঘুম থেকে উঠেই শেভিং করে, স্নান সেরে বার বার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের মুখটা দেখছে আর মনে করছে বড়দা‌র কথাটা- তোকে কিন্তু দেখতে বুম্বাদার মত লাগছে। বুম্বাদা কে?-জানতে চাইল বিজু। আরে বুম্বাদা মানে প্রসেনজিৎ, বাঙালির শেষ নায়ক--বড়দার উত্তর। হাসি পেল বিজুর, তাড়াতাড়ি শার্ট-পেন্ট পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। মনে মনে ভাবল বড়দাকে জানিয়ে গেলে কেমন হয় যে সে আজ ঝিলমিলদের বাড়িতে যাচ্ছে এবং সম্ভবত আজই নিজের মনের কথাটি ঝিলকে বলবে। বড়দা মানে সুবোধ দাস হিন্দুত্ব বাদী রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী। আগামীতে পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলকে জেতানোর দায়িত্ব সম্ভবত তার কাঁদেই পড়বে। সেদিন ঝিল বিজুদের বাড়িতে আসার পর কত গল্প করল। অথচ ঝিল যাওয়ার পর হঠাৎ বলে উঠলেন, ঝিল বোধহয় মুসলমান! বিজুর প্রতিক্রিয়া--- কী বলছ বড়দা! ঝিল ওরফে ঝিলমিল নাথ একজন হিন্দু। দেখিস সামনেই কিন্তু নির্বাচন।
             বড়দাকে একটু চিন্তিত দেখাল সেদিন। বড়দাকে আর জানানো হলনা। সাত সকালেই পার্টির কাজে কোথাও বেরিয়ে পড়েছেন, বিজু তাই ধীরে ধীরে খেয়া পার হয়ে ইণ্ডিয়াক্লাব পয়েন্ট থেকে রিক্সায় চড়ে রওয়ানা দিল ঝিলদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। জেল রোডের আপ্ টা নামলেই অম্বিকাপট্টির মুখে একটি ছোট্ট দোতলায় ঝিল ও তার বাবা-মা থাকেন। রিক্সা থেকে নেমে বিজু দেখল, যে বাড়িটার ব্যালকনি থেকে ঝিল তার জন্য অপেক্ষা করছে। সেটি বেশ মনোরম, সামনে ফুলেরবাগান, ব্যালকনিতে টবে টবে বিভিন্ন জাতের ফুল, দেওয়াল বেয়ে উঠেছে একটি পাতা বাহার। গেইট খুলে বারান্দায় উঠতেই বিজুকে স্বাগত জানাতে এল ঝিল। সাথে বেশ সুন্দরী এক মহিলা। পরনে খুব দামী একখান তাঁতের শাড়ি, হাতে মাত্র একটি করে সোনার বালা, কানে ছোট টপ। লক্ষ্যণীয় হল, কপালে সিঁদুর নেই। 
                    ঝিল বলল,--- বিজু ইনি হলেন আমার মা, বাবা বাড়িতে নেই। বেরিয়েছেন কোথাও অফিসের কাজে। সেদিন বিজু ঝিলের বেড রুম থেকে একে একে বাড়ির প্রতিটি ঘর দেখল। নিজের নতুন কম্পুটারে ঝিল কিভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় তাও শিখল। তারপর অনেক্ষণ গল্প হল ঝিলের মায়ের সাথে। বিজু খুব মন দিয়ে শুনছিল ঝিলের মায়ের কথা, তার ছোট বেলা নাকি কেটেছে বিজুদেরই গ্রামে। বিজুর বড়দাকেও তিনি চেনেন ভালোভাবেই। তবে এখন আর কোন খবরই রাখেন না সেখানের। তার মা-বাবা নাকি চলে গেছেন অন্য গ্রামে ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে ঝিলের মায়ের পরিবেশন করা মুখরোচক খাবার খেয়ে বিজু খেয়ালই করেনি বেলা কখন গড়িয়েছে এগারটায়। এমন সময় মোবাইলে বড়দার মেসেজ,--- বারটায় বাড়িতে থাকিস্, যুবমোর্চার মিটিং আছে তোকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। এদিকে ঝিলের মা বললেন,-- আজ প্রথম এসেছো বাড়িতে তাই খেয়ে যেতে হবে। বিজু তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল, আরেক দিন এসে খাব, বলেই ঝিলকে দেখাল বড়দার মেসেজ। ঝিল মাকে বুঝিয়ে বলে নীচে নেমে এল বিজুকে বিদায় জানাতে। 
            বিজু বলল,- তোমাকে কিছু বলার ছিল ঝিল এবং তা আজকেই বলল বলে ঠিক করে এসেছি। ঝিল বলল, তার আগে আমাকে কিছু জানাতে হবে তোমাকে আমার মায়ের সম্পর্কে। বিজু বলল, কী? তারপর ঝিল যা বলল তা শুনে বিজুর মাথায় শুধু বড়দার কথাগুলিই ঘুরপাক খাচ্ছিল- দেখিস সামনেই কিন্তু নির্বাচন.......... ঝিল বোধহয় ........। ঝিলকে বলল, আজ আসি আবার দেখা হবে। বারান্দায় অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল ঝিল। গ্লানি না অভিমান জাগল মনে বুঝা গেলনা। চেয়ে থকল দূর পথে যেখানে ক্রমশঃ ছোট হয়ে যাচ্ছে বিজুর অস্তিত্ব। জানতে চায়নি সে, তার মনের কথা বললনা কেন বিজু।

শুধু তোমারি জন্য

                          
                            (২)


                               












সে আছি আজ একা মনে
কতো স্মৃতি আজ ভিড়েছে এক্ষণে
তোমার পরশ জাগাত কি অনুভূতি
তোমার বিরহে আজ মরি আমি...
নয় এ শুধু কথার মেলা
নয় এ কেবলই মনের খেলা
দিলাম কতো অশ্রুজল তোমায় সঁপে
তবুও যে হেটে যাই এ পথ একা রাতে ...।।
মন এ নয় শুধু – এ যে পূজার থালা
রইলো তায় বেথার শতদলে গাঁথা অশ্রুমালা
আমার পরিচয়ের ঈষৎ এ আলাপ হতে
পরাবো তোমায় এ মালা মলিন দীপালোকে ...।।

।। অরুণিমা চক্রবর্তী।।

মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৩

শুধু তোমারি জন্য

                        (১)






 
 
 
 
 
 
বুঝিনি কেন আজো কি এই জীবন
আশার পূরণ নাকি শুধুই মরণ
আনন্দ হারায় কেন দুখের ভিড়ে
মন চলে যায় কোন স্মৃতির তীরে
কেন শুধুই চেয়ে থাকা আশায় আশায়
তোমার বিরহে আমায় অশ্রু যে ভাসায়
বাঁধতে গিয়ে কেবলই ভাঙ্গে শান্তির নীড়
মনেতে বিঁধে কোন যে আঁধারের তীর
ভেবে যাই যাবনা আর তোমার দিকে
তবুও বুক ভরে বিশ্বাস করি ভালবাসার এই
রাগ অনুরাগে ভরা রঙগুলো নয় ফিকে----- !!!

                                     ...................অরুণিমা


রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৩

বেনামী চিঠি

                                                                     ।। শুভদীপ দেব।।
(c) Picture:ছবি














রাতের পাখিটা রোজ জ্বলে,
তারাদের মত কিনা জানিনা...
যদি অন্ধকারটা আলোর মত হত
আমিও পুষতে পারতাম তাকে...
জানতে পারতাম তার জ্বলতে থাকার কুশল


শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৩

উজান আসামের গল্প

(এই প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল কান্তার ভূষণ নন্দী এবং নিপন দাস সম্পাদিত কাগজ 'যাপন কথা'র জন্যে। প্রথম বর্ষ , প্রথম সংখ্যাতে বেরুলো এর আদ্ধেক। বাকিটা ২০১৫র ডিসেম্বরে দ্বিতীয় সংখ্যাতে।)      
   মল ভোরের রোদের আলোঃ পরিতোষ তালুকদারের একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি মোটেও উজান অসমের লেখক নন। কিন্তু অসমের বাংলা লেখকদের সাধারণ মনস্তত্ব এবং সমস্যাকে ঠিক ধরেছেন এই গল্পে। আমাদের মনে হলো, ভূমিকার থেকে বেশি কাজের হতে পারে এই গল্পকথা। ছাপা হয়েছিল ‘বনফুলে’র মার্চ,’০৭। নাম ‘একটি প্রতিবাদের বিনির্মাণ কথা’। গল্পটি এরকমঃ “ গত ৯ই আগষ্ট ২০০৬ ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে কারও আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ নেই। আন্তর্জাতিক দুর্নীতি সম্মেলনে ভারত ইতিমধ্যেই শীর্ষ আসন দখল করে বসে আছে। মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসাদার (সবাই নয়) যে যেদিক দিয়ে পারছে অর্থ আহরণ করছে। সেখানে পনের টাকা দামের বই একশত পনের টাকায় কেনা হচ্ছে—এটা এমন কি ব্যাপার? যদি পনের হাজার হত তবে খবরের মতো খবর বলে মানতাম। সরকারি মুরগি যদি একদিনে তিরিশ কেজি খাবার গিলে ফেলতে পারে তবে লাইব্রেরি ডিরেক্টরও আপনাদের দেওয়া অপবাদ গপ করে গিলে ফেলতে পারেন।
         আমার জানা মতে অসমে দুটি ভাষা সরকারি ভাবে স্বীকৃত। অসমিয়া এবং বাংলা। ভারতবর্ষ বিভিন্ন ভাষাভাষী এবং বিভিন্ন ধর্মের পীঠস্থান। অসমেও উক্ত বৈশিষ্ট লক্ষণীয়। অসমীয়া, বাংলা, বড়ো এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাকে সম্মান জানিয়ে—সরকারের উচিত বিভিন্ন ভাষার বই ২৪৪টি লাইব্রেরির জন্যে ক্রয় করা। উদীয়মান লেখকেরা কেন হতাশাতে ভুগবেন না? যারা নিজের পয়সা দিয়ে বই ছাপিয়েছে তারা যদি দরখাস্ত করে তবে তাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে না। অসমিয়ায় লেখা এবং নবীন লেখকের যদি ধরাধরির কেউ থাকে তবে হয়তো ভাগ্য প্রসন্ন হতে পারে। কিন্তু বাংলা বইএর ক্ষেত্রে নৈব নৈব চ। কলকাতা থেকে নামী-দামী বাংলা বই কেনা হবে অথচ স্থানীয় কবি বা গল্পকারদের বাংলা বই কিনতে অনীহা। তাই স্থানীয় বাঙালি লেখকদের হতাশা কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। এক্ষেত্রে লাইব্রেরি অধিকর্তা যদি একটু সহানুভূতি সম্পন্ন হয়ে উদীয়মান লেখকদের পাশে এসে দাঁড়ান তবে সাহিত্যের প্রতি সাধারণের আগ্রহ ত্বরান্বিত করতে এই অসমের স্থানীয় লেখকরাই ঝাঁপিয়ে পড়বে—এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
           মন্ত্রী হেমন্ত শর্মাকে অনুরোধ করব আপনার উদার হৃদয়ের উদাত্ত আহ্বান থেকে যেমন আজ আর কেউ বঞ্চিত নয়, তেমনি স্থানীয় উদীয়মান লেখক –লেখিকারাও তা সে অসমিয়া বা বাংলা ভাষী যেই হোক, যেন বঞ্চনার শিকার না হয়—সেদিকে একটু দৃষ্টি দেবেন।” এগুলো যে গল্প নয় বুঝবেন যে কেউ। গল্পের শুরু হয়েছে এর পর। “ ‘বাবা খেতে এসো...।’ চমকে উঠে সুবিমল। চিঠিটা শেষ করে সই করতে যাবে এমন সময় মেয়ে মালার চিৎকার ভেসে এলো। আচ্ছা, মালা ঠিক সই করবার সময়েই কেন ডাকল? তবে কি সতর্ক করে দিল? সম্ভাব্য কোন বিপদ? পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবার মতো কিছু?” আমরা নিজের বক্তব্য ছেড়ে গল্পের টুকরোগুলো তুলে দিচ্ছি , কেননা, সেগুলোই কথা বলবে ভালো, “ তার শরীরটা থরথর কেঁপে উঠল অজানা একটা ভয়ে। চিঠিতে সে কী লিখেছে? একটা ভয়ার্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল খোলা চিঠির শরীরে। এমন কিছুতো নয়? একটা খবরের প্রতিবাদ মাত্র। না, এটাকে ঠিক প্রতিবাদ বলা যাবে না। খবরটা সত্যি। একটা অব্যবস্থার প্রতি বিদ্রুপ, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ। যার কষাঘাতে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে দুর্নীতির প্রাসাদটা—এমনতর আশা করাটাও সত্যিকারের মিথ্যা...তবে কিসের ভয়?...আশি শতাংশ খাটি চিঠির বাক্যাংশ। একমাত্র বানান ভুল ছাড়া। সে বেশ উৎসাহ পায়। ...চিঠি পাঠ সেরে সে উঠে পড়ে গন্তব্য খাবার টেবিল।” কিন্তু খাবার শেষে, “ হাতে ধুমায়িত সিগারেট। তার চিন্তা পুড়ছে। পুড়ে পুড়ে শোধন হচ্ছে। তারপর স্বর্ণাভ দ্যুতি নিয়ে সে উঠে আসবে তপ্ত ভাবনা ফুঁড়ে।” কিন্তু আসলে যে ঘটনাটি ঘটে। রাতের ঘুম উবে যায়। “সুবিমলের কি পতন অনিবার্য? সে কথার ভবিষ্যৎ-বাণী করবে কোন নস্ত্রাদ্রুম? চিঠি প্রকাশের পর প্রতিবাদ কেমন হবে, কি আকার নেবে, জনরোষে উত্তাল হয়ে উঠবে নগরী, সুবিমলের প্রাণ সংশয় , ঘন ঘন টেলিফোন, হুমকি হত্যা...কুয়াশা মাখা সকালের মতো ঘুম নামছে তার চোখ জুড়ে । আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল...মুখোমুখি বসিবার, জন্ম ও মৃত্যুর।...” কিন্তু ঘুমোতে পারে না আদৌ, “আবার চিঠি পড়তে আরম্ভ করে, টেবিলে ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঝুঁকে পড়ে ‘দুর্নীতি সম্মেলনে ভারত ইতিমধ্যেই শীর্ষ আসন দখল করে বসে আছে।’—সত্যিই কি তাই? কে বলেছে? কবে বলেছে? তার কিছুই জানা নেই। আর এই অসম্ভব কাজটার পরিমাপ কি করে সম্ভব? যারা করেছে, তারা কিভাবে বুঝবে কোন দেশের দুর্নীতি লোক সংখ্যার অনুপাতে সর্বোচ্চ?... তারা তো কয়েকজনের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে একটা আন্দাজ মতো রিপোর্ট তৈরি করেছে। সব দোষ নন্দ ঘোষের উপর চাপিয়ে দূর থেকে হাসছে। সুবিমলের দেশপ্রেম জেগে উঠল। এ অন্যায়, ভারি অন্যায়...সে কলম দিয়ে শব্দ ক’টা ঘচ করে কেটে দিল। লিখল আমাদের দেশে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। মনে মনে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এখন আর পাপবোধ জাগছে না।” এভাবের একে একে প্রায় সমস্ত বিপজ্জনক শব্দই কাটা হয়ে যায় চিঠির সই না করেই। এবং সব শেষে , “সুবিমল হাতের চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে নিশ্চিন্তে বালিশে মাথা ঠেকালো। দু’চোখ বন্ধ করতেই সেখানে গভীর আঁধার নেমে আসে।” এই শেষ বাক্য দুটো ঘটনার বিবরণ মাত্র নয়, যেন এ আমাদের লেখকদের ঘুম, এ আমাদের গোটা বৌদ্ধিক আকাশে ‘গভীর আঁধার নেমে আসা’র গপ্প। ইনি তো এক চিঠি ছেটেছেন, আমাদের গল্প লেখকেরা গল্প ছেটে ছেটে আর গল্প বলে কিছু রাখেন না শেষ অব্দি। কারণ, আর কিছু না এক সর্বব্যাপী ভয়। কিসের, সে ইঙ্গিত এই অব্দি যথেষ্ট আছে।
           না, পরিতোষের গল্পটি এখানে ফুরোয় নি।কারণ এটাই সে আকাশের সম্পূর্ণ ছবিতো নয়। তবে আর পরিতোষ এই গল্প লিখবেন কেন? সুতরাং সুবিমল স্বপ্ন দেখে এক অদ্ভূৎ। সেই স্বপ্নে গুয়াহাটির জজ ময়দানে বিশাল সভাতে লেখকদের সম্বর্ধনা দেয়া হবে, এখানে গোশালার নৃপেন রায়কে সাহিত্যিকের সম্মান জানানো হচ্ছে। সেই নৃপেন রায় যার বিরুদ্ধে কো-অপারেটিভ থেকে কয়েক হাজার টাকা আত্মসাত করবার অভিযোগ ছিল।” এটা স্বপ্নই । কেননা, এমন দুর্নীতিবাজ থাকতেই পারেন, লেখক হিসেবে মোটামোটি একটা পরিচয়ও থাকতেই পারে। কিন্তু জজময়দানে সরকারি সম্মানের ব্যাপারটি বাস্তবে ঘটে না, ঘটলে শুরুর চিঠির কোন গুরুত্বই থাকে না। তবু সেই সভাতে গিয়ে এসব দেখে, “গর্জে উঠে সুবিমল। না না কিছুতেই নয়। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।” এরকম না মেনে নিতে পারার যন্ত্রণা তাঁর নিদ্রা ছুটিয়ে দেয়। মনে পড়ে ব্রিটিশ ভারতে তার বাবার লড়াইর কথা। সুতরাং, “ লাফ মেরে উঠে পড়ে বিছানা থেকে। ওয়েস্ট পেপার বকস উল্টে খুঁজতে থাকে চিঠির প্রতিটি অংশ... কলম আর লেখার বোর্ডটা কোলে নিয়ে সে আবার লিখতে আরম্ভ করে ‘দুর্নীতির চাপে সমগ্র সমাজটাই পচে গলে খসে পড়তে আরম্ভ করেছে...। খোলা জানালা দিয়ে ভোর সূর্যের আলো এসে পড়েছে তার পিঠে।” এইটুকুন থাক আপাতত, আমরা লিখতে বসেছি উজান অসমের বাংলা গল্প নিয়ে। সন্ধান করব, আমাদের সেই লেখক কারা যাদের পিঠে এসে পড়ে এমন অমল ভোরের রোদের আলো।

     
      উজান মানে, কতটা উজানঃ আমাদের কথা ছিল উজান অসমের বাংলা গল্প নিয়ে লিখবার। উজান মানে ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পাড়ে শোণিতপুর, লক্ষীমপুর ধেমাজি আর দক্ষিণ পাড়ে সেই গোলাঘাট থেকে শুরু করে যোরহাট, শিবসাগর, ডিব্রুগড় হয়ে তিনসুকিয়া অব্দি। এলাকাটি অত্যন্ত বিশাল ছিল। সঠিক একটি লেখা লিখতে গেলে এই সমস্ত জেলার প্রধান শহরগুলোতে অন্তত গিয়ে নিবিষ্ট গবেষকের মতো নিবিড় অনুসন্ধান করতে হতো। কাগজপাতি, বই পত্তর তুলে আনতে হতো। আমরা সেই কাজ করিনি। আমাদের উত্তর আর দক্ষিণ পাড়ের সংযোগটি এখনো এতো জটিল এবং দীর্ঘ যে সাধারণ জনশ্রুতিতে উত্তর পাড়টাকে ‘উজানে’র বাইরেই রাখা হয়। আমরা সেপাড়ের কথা ভাবিই নি শুরুতেই। এমনিতেও তেজপুর ছাড়া আর কোথাও লেখা লেখি কিছু হয় বলে শোনা যায় না। আর শোণিতপুর তথা তেজপুরের বোধ করি আলাদা ইতিবৃত্তই লেখা যায়। তেজপুর শহরটি এমনিতেই অসমিয়াতে যেমন বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতেও শতাব্দি প্রাচীন উচ্চারিত নাম।
           দক্ষিণের যোরহাট, মরিয়ানিতে কিছু বাংলা কাগজ কখনো সখনো বেরিয়েছে, এখনো বেরোয়। অসমের প্রবীণ গুরুত্বপূর্ণ কবি গল্পকার ঊর্ধ্বেন্দু দাস যোরহাট শহরে ছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু নিয়মিত কিছু হয় বলে পুরোনো কাগজপাতি পড়ে জানা গেল না। সুতরাং আমাদের আগ্রহ হলো না। রইল বাকি ডিব্রুগড় আর তিনসুকিয়া জেলা। উজানের বাংলা সাহিত্য বললে এখনো মূলত এই দুটি শহর এবং একই নামে জেলার কথা ভেবে থাকেন। ডিব্রুগড়ে তিনটি মাত্র নাম জেনেছিলাম যারা তথ্যসূত্র হিসেবে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারতেন । হয়তো তাঁদের ধরে অন্যত্র এগুতে পারা যেতো। বয়সে প্রবীণ ক্ষিতিশ রায় কিম্বা ঊর্ধ্বেন্দু দাশের কথা জানা থাকলেও শুরুতে তাঁদের বিব্রত করিনি। রইলেন বাকি বন্ধু ‘ঈশান’ সম্পাদক শিবাজী পুরকায়স্থ। তিনি চেষ্টা করেও সময় বের করে উঠতে পারেন নি এই খাটাখাটুনির । সুতরাং অবশিষ্ট তিনসুকিয়া এবং ডিগবয়। উজান অসমের অবশিষ্ট দুই উজ্জ্বল শহরের নাম।
           কিন্তু এখানেও যাদের থেকে সাহায্য চেয়েছি, তাদের পক্ষেও সহজ ছিল না কাজটা করা। এই যেমন ‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’র সভাপতি সুজয় রায়। কাছের মানুষ। এই শহরের আদি সাময়িক কাগজ ‘লুনা’র দিন থেকে লিখছেন, নিজেও অন্যান্য কাগজ সম্পাদনা করছেন। কিন্তু জানালেন পুরোনো কাগজ হয় নেই, আর যা আছে কোথায় সে সব বের করা কঠিন। প্রথমে ডিগবয় ছিলেন এখন তিনসুকিয়া আছেন নিখিলেশ্বর চৌধুরী। এক সাহিত্যসেবী পরিবারের আদি পুরুষ বললে ভুল হয় না। নব্বুই ঊর্ধ্ব এই কবি এখনো ‘ডিগবয় কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট’ বলে একটি প্রতিষ্ঠান চালান তিনসুকিয়াতে। তাঁর সন্তান ডাক্তার নক্ষত্র বিজয় চৌধুরীও এই শহরের অন্যতম সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক। নিখিলেশ্বর চৌধুরীর ছোট ভাই নির্মল চৌধুরী ১৩৬৯এর শ্রাবণে লিখেছিলেন একখানা দুর্ধর্ষ উপন্যাস ‘ইন্দিরা ওভারব্রীজ’ । কিন্তু কারো থেকেই বিশেষ সাহায্য পাওয়া গেল না। এর জন্যে নয় যে করবেন না। নিখিলেশ্বর চৌধুরী বরং সেই পঞ্চাশের দশকে তাঁর ইন্সটিটিউটের ছাত্রেরা যে হাতে লিখে বাঁধাই করে ‘কোরক’বলে একটি কাগজ করতেন তার অক্ষত সপ্তম সংখ্যাটি দেখাতে পারলেন, কিন্তু আর কোন প্রতিশ্রুতি বিশেষ দিতে পারলেন না, তাঁকে বিব্রত করতেও মন চাইল না। ‘দৃষ্টি’ বলে একটি কাগজ সম্পাদনা করতেন গোপাল বসু । তিনসুকিয়া ডিব্রুগড়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। তাঁর বাড়িতে গিয়ে পুরোনো কাগজের ডাঁই ধুলো ঝেড়ে, হাঁচি দিয়ে নামানো গেল যদিও যা কিছু পাওয়া গেল, সেগুলোও আশার চেয়ে অনেক কম। এমন নয় যে তাঁর হাতে ছিল না বিশেষ। কিন্তু ধরে রাখাটাও সবার পক্ষে শ্রম-সময় এবং ব্যয় সাপেক্ষ এটা বোঝা গেল। ডিগবয়ের কবি চিত্রশিল্পী পার্থসারথি দত্তের সংগ্রহ বিশাল। তিনি দিলেনও অনেক কিছু। তাতে ডিব্রুগড়েরও কাগজ বেশ কিছু ছিল। কিন্তু আরো যা ছিল তা বের করতে যে শ্রম এবং সময় দরকার ছিল সেটি ছিল তাঁর কাছে দুর্লভ বস্তু। একই ঘটনা ডিগবয়ের অন্য কবি-প্রাবন্ধিক –সম্পাদক অজিত করের কাছে গিয়েও অভিজ্ঞতা হলো। ডুমডুমা কলেজের অধ্যাপিকা-গবেষিকা মন্দিরা দাস গল্পের কাজে বিশেষ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিতে পারলেন না। নামগুলো উল্লেখ করে যারা সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানানোর পাশাপাশি সমস্যাগুলোরও একটা ইঙ্গিত দিয়ে দেয়া গেল।বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের উৎসবের স্মরণিকাও আমরা সংগ্রহ করেছিলাম। সেগুলোতে ‘কবিতা’ প্রচুর পাওয়া গেলেও গল্প তেমন পাওয়া গেল না, উল্লেখ করবার মতো। আমার নিজের সংগ্রহ কিছু ছিল, কিন্তু সেগুলো দেড় দশকের বেশি পুরোনো কিছুই নয়। শেষে জ্যোতির্ময় সেনগুপ্তের দ্বারস্থ হয়ে আনানো গেল তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ‘অসমের বাংলা লিটিল ম্যাগাজিনঃ ছোটগল্প চর্চার প্রেক্ষাপট ও ক্রমবিকাশ’, যেখানে গোট অসমের হয়ে কাজটা তিনি এরকম গুটিয়েই রেখেছিলেন। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করাটা এর পরে আমাদের সহজ হয়ে গেলো।
               অনেকেই অনেক নাম বললেন, আমরা যথা সময়ে উল্লেখ করব, কিন্তু দেখাতে পারলেন না বিশেষ। এর মধ্যে নির্মল চৌধুরীর কাহিনি উল্লেখ করলে বোঝা যাবে নথি পত্র মেলে না কেন? ‘ইন্দিরা ওভারব্রীজ’ নামে একটি উপন্যাস বর্তমান লেখকের পড়া ছিল সেই আশির দশকের শুরুতে । শিলচরের বাড়িতে। স্কুল জীবনের শেষ বা কলেজ জীবনের শুরু তখন। বইটা এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আনা গেছিল, তার মলাট ছিল না । কিন্তু উপন্যাস পুরোটি ছিল। সেই উপন্যাস সে যুগেই পাঠক হিসেবে প্রবল নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রথম একটা বাংলা উপন্যাস যা কিনা কিশোর পাঠকের সঙ্গে তার নিজের প্রদেশের সংযোগটি ঘটিয়ে দিয়েছিল। বহু বই এর পরে হাত ছাড়া হয়েছে, কিন্তু সেই মলাটবিহীন উপন্যাসটি এখনো যত্নে রাখা আছে। এর পর এই তিন দশকে কোত্থাও এই বইটির কোন উল্লেখ দেখিনি। অথচ, অসমের বাংলা গল্প উপন্যাস নিয়ে পড়া হয়েছে অনেক কিছু। তাই লেখক কিম্বা প্রকাশকেরকথা নিজেও মনে রাখিনি। সেদিন হঠাৎই অজিত কর একের পর এক লেখক এবং লেখার নাম করতে করতে উচ্চারণ করেন ‘ইন্দিরা ওভারব্রীজ’। লেখক সেই নির্মল চৌধুরী। এ যেন সেই বহু যুগ পরে , বহুদিন ধরে মনে মনে খুঁজে ফেরার পর কোন পরমআত্মীয়ের সন্ধান পাওয়া। কিন্তু জানা গেল তিনি অসুস্থ। সুতরাং তাঁর সঙ্গে নয় কথা হলো তাঁর দাদা নিখিলেশ্বর চৌধুরী এবং ভাইপো নক্ষত্র বিজয় চৌধুরীর সঙ্গে। তাতে ‘উপন্যাস’টির লেখকের কাছে থাকা এক পরিছন্ন এবং সম্পূর্ণ প্রতিলিপি সংগ্রহ করা গেল। যার থেকে জানা গেল এর প্রকাশ শ্রাবণ,১৩৬৯ বাংলা অর্থাৎ ১৯৬২ ইংরেজি। আধা শতক পেরিয়ে গেছে। যা কিনা, বর্তমান অধ্যয়নের এক বড় প্রাপ্তি। সেই নিয়ে পরে অন্যত্র লিখব। কিন্তু তিনিতো প্রচুর গল্পও লিখেছিলেন সে কালে। সেগুলোর কোন হদিশ পাওয়া যাবে কিনা, জিজ্ঞেস করতেই দু’জনেই জানালেন সেগুলো কৈ কৈ আছে কেউ জানে না, অনেকগুলো হারিয়েও গেছে , নষ্ট হয়ে গেছে। যাদের জন্যে লেখা হয়, সেই পাঠককুলের কিম্বা সাহিত্যকর্মীর কিম্বা গবেষকের মমতা পেলে এই হারিয়ে যাবার ব্যাপারগুলো কিছুতেই ঘটতনা। কিন্তু , আমরা কি আর আমাদের পড়বার ঘরের তাকে বা টেবিলে ডিগবয়ের লেখকের উপন্যাস সাজিয়ে রেখে সামাজিক সম্মান অর্জনের মতো কোন বাস্তবতা আদৌ গড়েছি, না গড়তে আগ্রহী, আমাদের প্রতিবেশি অসমিয়াদের মতো? আমাদের এই সাংস্কৃতিক দুর্বলতাটি ভাববার বিষয়। আমরা নিশ্চয়ই এতো গ্রন্থবিরোধীও নই। বই পত্রিকা আমাদের ঘরেও থাকে, কিন্তু সেসব কলকাতার বাজারের জনপ্রিয় বই, ‘আনন্দবাজার’ ‘আজকাল’ ,’দেশে’ যেগুলোর বিজ্ঞাপন সহজে মেলে। ধর্মপত্রিকা বলতেও সেই ‘উদ্বোধন’ কিম্বা ‘অখন্ড সংহিতা’ যেন মধ্যবিত্ত অভিমানের প্রতীক হয়ে বসে আছে। সেই কলকাতাতেও বিকল্প চিন্তার ঢেউ তুলে বাজারে যেগুলো অজনপ্রিয় থেকে যায় অধিকাংশ পাঠক সেগুলোর সন্ধান অব্দি হয় পান না, নতুবা পেলেও আদর করবার দরকার বোধ করেন না। ‘কে হায় হৃদয় খোঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ এরকম আরো কিছু সমস্যার কথা জ্যোতির্ময় তাঁর বইএর ভূমিকা ‘কথাপ্রসঙ্গে’ লিখেছেন। যেগুলো প্রত্যাহ্বান নিতে আগ্রহী নিষ্ঠাবান গবেষককে উদ্বুদ্ধ করা উচিত , কারণ তিনি দিশা দেখিয়ে রেখেছেন। সম্ভবত সেজন্যেই তাঁরও কিছু তথ্যগত ছোটখাটো উপেক্ষা করবার মতো ত্রুটি থেকে গেছে, যেমন থাকবে আমাদেরও।আমরা শুধু উল্লেখ করব স্পষ্টতর করবার জন্যে। আশা করছি, পাঠকও ক্ষমা করবেন, নিজে জুড়বেন অভিমান করবেন না। গল্পকারদের নিয়ে লিখতে গিয়ে আমরা এখানকার ছোট কাগজ বা সাময়িক পত্রের ইতিবৃত্তটাও আলাদা করে ঝালিয়ে নেবো, যাতে গোটা পরিবেশ নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়। দেখা যাবে, প্রচুর কাগজ বেরিয়েছে এখানে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে, সব না হলেও অধিকাংশই নিজেদের ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে ‘বাইরে’ ছড়িয়ে পড়া বা ‘জনগণের জন্যে সাহিত্য’ করে সমাজের রাজনৈতিক পরিবর্তনের আশা করবার বাইরে সামগ্রিক ভাবে এখানকার সাহিত্যের এই দুর্দশা ঘোচাবার জন্যে কিছু করেছেন বলে মনে হয় না। বরং অনেকেই যে সমাদর আশা করেছিলেন, না পেয়ে সরে গেছেন সাহিত্যের জগৎ থেকেই।
           
           উজান অসমের গল্পকথা এবং কাগজ-- দেবরঞ্জন ধরঃ যদিও কথা সাহিত্যের বয়স জাতকের গল্পমালা বা ঈশপের গল্পমালার থেকেও প্রাচীন, ‘আধুনিক’ ছোট গল্পের বয়স পৃথিবী জুড়েই খুব বেশি নয়। বাংলাতে তথা ভারতে সেটির বয়স এক শতক দুই দশক মাত্র। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে সে আমরা সবাই জানি। কিন্তু উজান অসমের বাংলা গল্পের কালটা কবে থেকে ধরতে হবে? সেটিই বড় সমস্যা। আমরা কত পুরোনো নজির পাচ্ছি সেখান থেকে শুরু করলেও , আরো পিছিয়ে যে যাওয়া যাবে না এর নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। বছর কয় আগে অসমিয়া কাগজ ‘সাতসরী’র ‘রাগ-অনুরাগঃ সম্পর্কঃ অসমীয়া-বাঙ্গালী’নামে দু’খানা বিশেষ সংখ্যাতে ( ৩১ ডিসেম্বর,’০৭ এবং ৩১ আগষ্ট,’০৮) দেবরঞ্জন ধর একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘উজনীর বাঙালী সমাজ’ নামে। সেখানে সেই দেড় সহস্রাব্দ (ভুলেও শতাব্দ নয়) আগে থেকে এখানে বাংলাদেশের নানা ধর্ম-বর্ণ শ্রেণির লোকের আগমন বৃত্তান্ত থেকে শুরু করে এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের সঙ্গে এখানকার সমাজ-সাহিত্য-শিক্ষা –সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে বাঙালিরা কেমন নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন সেই বর্ণনা রয়েছে বেশ বিস্তৃত। বোধ করি ছোট হলেও এরকম এক প্রথম কাজ। বাংলা অসমিয়া নাটকে, সঙ্গীতে এমন কি সেই ১৮৮৪তে অসমিয়া প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবার কিছু পরেই ভোলানাথ চক্রবর্তীর লেখা অন্যতম পাঠ্যপুথি-বন্ধনীতে লিখেছেন, মতান্তরে প্রথম পাঠ্যপুথি-- ‘ল’রাপাঠে’র সংবাদও রয়েছে। এগুলো বেশ বিস্তৃতই আছে। কিন্তু বাংলা গদ্য-পদ্য সাহিত্যের খবর বিশেষ নেই। খুব ছোট করে নিজের করা অরুণ শর্মার অসমিয়া উপন্যাস ‘আশীর্বাদের রং’এর বাংলা অনুবাদের সংবাদ আছে, যেটি সাহিত্য একাদেমী প্রকাশ করেছিল। অথচ নিজেও গল্প লিখেছিলেন কিছু। একটু আগে শুধু আছে ‘ঊর্ধ্বেন্দু দাশ বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত কবি ও চুটি গল্পকার’। আরো দুই একজন কবির কথা আছে নাম উল্লেখ করে কিম্বা না করে। এর বেশি কিছু নেই।
         উজান অসমের গল্পকথা এবং কাগজ- জ্যোতির্ময় সেনগুপ্তঃ ১৮৭২ এ গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত ‘আসাম মিহির’কে মনে করা হয় অসমের প্রথম বাংলা কাগজ। তার পরে শিলং , ধুবড়ি ,গোয়ালপাড়া সহ ভাটি অসমে বেশ কিছু বাংলা কাগজের সন্ধান পাওয়া গেলেও উজানে তেমন কাগজের সন্ধান মেলে নি। একটি ছাড়া, সে ‘জাগরণ’ বেরিয়েছিল ১৯২৪ থেকে। যাকে আমরা ‘লিটিল ম্যাগাজিন’ বলি সেগুলো পঞ্চাশের দশকের আগে শুরু হয় নি, লিখেছেন জ্যোতির্ময় তাঁর গবেষণা বইতে। পঞ্চাশের দশকের পরে গোটা অসমে তিনি প্রায় চারশ’র উপর এমন কাগজের কথা বলে লিখছেন, এবং “ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে এ-ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল ডিব্রুগড়।” (পৃঃ২৩) তাঁর বইটি মূলত বিশ শতকের শেষ শিকি ভাগ নিয়ে হলেও, আগেকার এবং পরেরকার কিছু আভাস তিনি দিয়ে গেছেন। পঞ্চাশের দশকে দেখা যাচ্ছে উজানের দুটো কাগজের সংবাদ তিনি দিচ্ছেন, ১৯৫৫তে তিনসুকিয়ার ‘মরসুমী’ এবং ১৯৫৭তে ডিব্রুগড়ের ‘পূর্বমেঘ’। আমরা ক্ষিতিশ রায়ের (উৎসব) থেকে জেনেছি আসলে ‘পূর্বমেঘে’রও আগে ‘সীমান্তের বাঁশী’ বেরিয়েছিল ওই সময়। ১৯৫৫তে । আর অজিত কর (উৎসব) লিখছেন, মরশুমী বেরিয়েছে আসলে ১৯৫২তে । সুতরাং এটিই প্রথম। জ্যোতির্ময় লিখছেন, ষাটের দশকের ১৯৬২তে ডিব্রুগড়ে কবি-গল্পকার ক্ষিতীশ রায় এবং ঊর্ধ্বেন্দু দাস বের করেছিলেন ‘সংবর্ত’, এছাড়াও ১৯৬৯এ বেরুলো ‘দূর্বা’। পরের দশকে চাকরি সূত্রে যোরহাট গিয়ে ঊর্ধ্বেন্দু দাস বের করেছিলেন আরেকটি কাগজ ‘মজলিশ’। সে ১৯৭৫এর কথা। আশির দশকে ডিব্রুগড়, যোরহাট থেকে উল্লেখযোগ্য তেমন কাগজ বেরোয়নি জানাচ্ছেন জ্যোতির্ময় (ঐ; পৃঃ৪১)। কিন্তু ১৯৮৭তে মৃন্ময় দেব এবং সুকোমল দাসের যৌথ সম্পাদনাতে প্রকাশিত ‘গুল্মলতা’ বেরুতো, তিনি বলেছেন , ডিব্রগড় থেকে, আসলে এটি হবে ডিগবয়—লিখেছেন অজিত কর (উৎসব)। নব্বুইর দশকে কোনো নতুন কাগজের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এই সময়ের মধ্যে অসমের অন্যত্র বেশ কিছু গল্প সংকলনের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। যেমন লামডিঙের ‘দৃষ্টি’ কাগজ ১৩৯১র শারদোৎসব উপলক্ষে অসমের গল্পকারদের একটি সংকলন বের করে। এই “কালপর্বে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কোনো পত্রিকার উদ্যোগে বাংলা গল্প সংকলন এই প্রথম।” (ঐ; ৩৯) বেশকিছু অসমিয়া- বাংলা দ্বিভাষিক কাগজের সংবাদ দিচ্ছেন জ্যোতির্ময় এই পাঁচ দশকে। যেমন ‘চলোর্মি’( ১৯৫২-ডিব্রুগড়), যাত্রী (১৯৫৬-ডিগবয়), পূর্ব-পার্বতী(মরিয়নি),ভাবীকাল নাট্যপত্র(১৯৭৭-ডিব্রুগড়), ডিহং(১৯৭৮-ডিগবয়),পদক্ষেপ(১৯৮১- ডিব্রুগড়), পথিকৃৎ(১৯৮৮- ডিগবয়), গণচেতনা(১৯৯৬- ডিব্রগড়)।
            শতাব্দীর শেষ শিকি ভাগে শুধু গল্পের কাগজ বা যে কাগজগুলো গল্প ছেপেছে তেমন অনেকগুলো কাগজের সন্ধান দিয়েছেন জ্যোতির্ময়। যেমন ডিব্রুগড় থেকে ‘এখনই’(১৯৭০),বহ্নি, স্রোত(১৯৭১), দাবানল(১৯৭৪), সাংস্কৃতিকী(১৯৭৫), ভাবীকাল নাট্যপত্র(১৯৭৭), অংকুর(১৯৭৯), মানস(১৯৮১), ত্রিধারা(১৯৯৩), যুগলবন্দী(১৯৯৬); তিনসুকিয়া থেকে লুনা(১৯৭০), অতসী(১৯৭৭), প্রতীতি(১৯৮১), প্রান্তবাণী(১৯৮৪), ‘প্রান্তিক’(১৯৯১); ডিগবয় থেকে নবজাতক(১৯৭০), নবোদিত(১৯৮৩), পথিকৃৎ(১৯৮৮), নিবেদন(১৯৯২), উত্তরণ (১৯৯৩); যোরহাট থেকে মজলিশ (১৯৭৫),আকস্মিক (১৯৭৭), মা-মাটি-মানুষ(১৯৮৪)। যেমন লামডিঙের ‘দৃষ্টি’র প্রকাশিত গল্প সংকলনের কথা লিখলাম, কিন্তু উজান অসম থেকে সেরকম কোন সংবাদ নেই।
          উজান অসমের গল্পকথা এবং কাগজ-- ডিব্রুগড় নিয়ে ক্ষিতিশ রায়ঃ ২০১২তে গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত উত্তর –পূর্বাঞ্চলীয় বাংলা লিটিল ম্যাগাজিন সম্মেলনের স্মৃতিগ্রন্থ ‘উৎসবে’ ক্ষিতীশ রায়ের লেখা একটি নিবন্ধ, ‘ডিব্রুগড়ের বাংলা ছোট পত্রিকাঃএকাল সেকাল’-এ জানতে পাচ্ছি ১৯৫৫তেই ‘সীমান্তের বাঁশী’ বেরুচ্ছে ঐ শহর থেকে। চারবছর টিকে ছিল। এতে বিচিত্র বিষয়ের সঙ্গে গল্পও বেরুতো। তবে ডিব্রুগড়ের সবচে দীর্ঘস্থায়ী কাগজ ‘দুর্বা’ এবং ‘বহ্নি’ যথাক্রমে সতেরো এবং আঠারোটি সংখ্যা বেরিয়েছিল। নতুন শতকে প্রকাশিত ‘দুতী’ কাগজের কথা তিনি জানাচ্ছেন। একটি শিবাজী পুরকায়স্থ সম্পাদিত ‘ঈশান’। এটি রুচি এবং মান রাখবার প্রয়াস করে, যদিও অনিয়মিত। অন্যদিকে বিশালবপু অসিত দত্তের সম্পাদিত ‘বসুন্ধরা সম্পর্কে’ তাঁর বক্তব্য, “ ভারতের বিভিন্ন স্থানের পাঁচমিশেলি রচনা প্রকাশ করাই এর উদ্দেশ্য। অর্থের বিনিময়ে লেখা ছাপানো, জীবিত ও মৃত লেখকের পূর্বপ্রকাশিত লেখা বিনা অনুমতিতে পুনর্মুদ্রণ করা এই কাগজের বৈশিষ্ট্য।” (পৃঃ ৩০) কাগজটি আমরা দেখেছি সম্পাদকীয় যত্নের কোন পরিচয় পাইনি। ‘সাংস্কৃতিকী’ সংস্থাটি ২০০২তে ‘অরিত্র্য’ নামে একটি কাগজ বের করেছিল। ২০১০এ নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের ডিব্রুগড় শাখা ‘আনন্ত্য’ নামে আরেকটি কাগজ বের করেছিল। দুটোর কোনটিই ধারাবাহিকতা রাখতে সমর্থ হয় নি।
         উজান অসমের গল্পকথা এবং কাগজ- তিনসুকিয়া- ডিগবয় নিয়ে অজিত করঃ তিনসুকিয়া সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ‘উৎসবে’-- অজিৎ করের লেখা নিবন্ধে, “তিনসুকিয়া জেলার বাংলা ক্ষুদ্র সাহিত্যপত্রের একটি রূপরেখা।” অজিত করের নিবন্ধে জানা যাচ্ছে ১৯৫৫ নয় , ‘মরসুমী’ বেরিয়েছিল ১৯৫২থেকে। মলয় বসু সম্পাদনা করতেন। তিনি তিনসুকিয়ার ডিগবয় কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনটি সংখ্যা বের করবার পর তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। কিন্তু কাগজটি বন্ধ হয় নি। বিমলেন্দু দেব পরেও এর আরো সাতটি সংখ্যা বের করেছিলেন । কিন্তু তারও আগে ‘রূপরেখা’ নামে একটি হাতে লেখা কাগজও বেরুতো তিনসুকিয়া থেকে। ক’টি সংখ্যা বেরিয়েছিল। তেমনি ডিগবয় কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠানটি এখনো চালাচ্ছেন কবি নিখিলেশ্বর চৌধুরী। শর্টহ্যাণ্ড ইত্যাদি শেখানো হয়। কিন্তু সেখান থেকে ১৯৫৯ থেকে ‘কোরক’ নামে একটি হাতে লেখা কাগজ বেরুতো। সম্ভবত সাতটি সংখ্যা বেরিয়েছিল। (পৃঃ৬০) একটি তার এখনো সুরক্ষিত রয়েছে সেখানে। জ্যোতির্ময়ের থেকে জানা যাচ্ছে, তিনসুকিয়া থেকে ‘লুনা’১৯৭০এ বেরোয় আসলে এটি হবে ১৯৬৫। আর ১৯৭৭তে বেরোয় ‘অতসী’, ১৯৮১তে ‘প্রতীতি’, ১৯৮৪তে ‘প্রান্তবাণী’, ১৯৯১তে ‘প্রান্তিক’ ইত্যাদি কাগজ বেরুচ্ছে। কিছু ভুল আছে। আসলে লুনা বেরোয় ১৯৬৫ থেকে। আর ‘অতসী’ নয় , কাগজটির নাম ছিল ‘আতসী’। বেরিয়েছে ১৯৭২তে। কবি বিমলেন্দু দে মাইকেল বীরেশ্বর পাশা ছদ্মনামে ‘লুনা’ সম্পাদনা করেন। তাঁর সহযোগী ছিলেন সুজয় রায় এবং নারায়ণ চক্রবর্তী। ‘প্রান্তিক’পুরোনো কাগজ, বেরুতো ১৯৬৭ থেকে।সম্পাদন করেন দিলীপ দাস। এর সাতটি সংখ্যা বেরিয়েছিল। এই দিলীপ দাসই মাসিক ‘প্রান্তবাণী’বের করেছিলেন তারও আগে ১৯৬০এ। ইনিই সুজয় রায়কে সংগে নিয়ে ‘কিশোর সাহিত্য পত্রিকা’(১৯৬৪/৬৫তে) বের করেছিলেন। সুজয় রায় আবার ১৯৬৭ থেকে ৭২ অব্দি বের করেন আরেকখানা ছোটদের কাগজ ‘দিশারী’। তাঁরা তখন নিয়মিত শিশু মেলা আয়োজন করতেন। কাগজটি সেই মেলার মুখপত্র ছিল। ‘নাবিক নাট্য গোষ্ঠী’ মুখপত্র ‘কম্পাস’ সম্পাদনা করেছিলেন সুজয় রায় এবং নির্মল ঘটক সত্তরের দশকে। চারটি সংখ্যা বেরিয়েছিল তার। সুজয় রায় ও সিধু চৌধুরী ১৯৬৭থেকে ‘মৌসুমী’ নামে আরো একখানা কাগজ করেছিলেন। এই সম্পাদকদের নাম করলাম কেননা, এরা এক সময় একের পর এক কাগজ করছেন। সুজয় রায় এখনো জড়িয়ে আছেন ‘উজান’ এবং ‘প্রতীতি’ সম্পাদনার সঙ্গে।
         ‘তিনসুকিয়া সাহিত্য পত্রিকা’ নামে একটি কাগজের সংবাদ জানিয়েছেন অজিত কর। এটি সতের বছর চলেছিল। কিন্তু কবে থেকে কবে সেই তথ্য নেই। ১৯৭১ এ অঞ্জন মজুমদার বের করেছিলেন ‘পিপাসা’। এটি মনে হয় চলেনি। ‘আতসী’তাঁরই কাগজ ছিল। বের করেন এর চারটি সংখ্যা বেরিয়েছিল। ‘মুহূর্ত’(১৯৭৫),নবজাগরণ সমাচার(আশির দশক- মাসিক নাট্য পত্রিকা),‘অমৃতা’(১৯৯৪),‘প্রচারপত্র’ ‘যুবপ্রগতি’, ‘উৎসমুখ সাংস্কৃতিক সংস্থা’র একই নামে একটি মুখপত্র আরো ক’টি স্বল্পায়ু কাগজ তিনসুকিয়া থেকে বেরিয়েছে। শুধু ‘নাগরিক’(১৯৮৪)-এর এগারো /বারোটি সংখ্যা বেরিয়েছিল।
        অতি সম্প্রতি গোপাল বসু ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ অব্দি সম্পাদনা করেন ‘দৃষ্টি’। এই কাগজে বেশ কিছু ভালো গল্প কবিতা এবং সমাজবৈজ্ঞানিক লেখালেখি প্রকাশ পেয়েছিল। অশোক কর্মকারের সম্পাদনাতে ‘উজান’ বেরুচ্ছে ২০০৬ থেকে। তিনটি সংখ্যা বের করবার পর তাঁর অকাল মৃত্যু হলে হাল ধরেন সুজয় রায়, ভানু ভূষণ দাস, সবিতা দেবনাথ প্রমুখ । কাগজটি এখনো বেরুচ্ছে। তবে তিনসুকিয়ার সবচে’ দীর্ঘজীবি কাগজ বোধ করি ‘প্রতীতি’। নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের মুখপত্র হিসেবে এখন অব্দি এর ৩১টি সংখ্যা বেরিয়ে গেছে। শেষ সংখ্যাটির সম্পাদনা করেছেন সুজয় রায়। সাধারণত বাংলা নববর্ষের কাগজটির সংখ্যা বেরোয়। তিনসুকিয়া কলেজ থেকে ২০০৩ থেকে বেরুচ্ছে দ্বিভাষিক কাগজ ‘প্রজ্ঞান’ । দ্বিভাষিক হলেও ২০১১ অব্দি এর সাহিত্য বিভাগে বাংলা –হিন্দি লেখাও বেরুতো। অমিতাভ দেব চৌধুরীর উপন্যাস ‘উদাস মহল শুন্য গলি’ উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে এই কাগজেই বেরোয়। কিন্তু স্থানীয় কোনো গল্পলেখকের গল্প এতে বেরোয় নি।
         তিনসুকিয়ার মতো ডিগবয়েও বাংলা সাহিত্য চর্চার শুরু হাতে লেখা কাগজে। ডিগবয় ইণ্ডিয়া ক্লাবে নিয়মিত সাহিত্যের আসর বসত। সেই আড্ডা থেকেই ১৯৪৪এ জন্ম নেয় দ্বিভাষিক হাতেলেখা কাগজ ‘যাত্রী’ । আসরে যেগুলো পাঠ করা হতো সেগুলো থেকে নির্বাচন করেই ‘যাত্রী’তে তোলা হতো। নিখিলেশ্বর চৌধুরী, তাঁরই ছোট ভাই ‘ইন্দিরা ওভারব্রিজে’র লেখক নির্মল চৌধুরী, সাধন আদিত্য, দ্বিজেশ গুপ্ত প্রমুখ লেখকদের হাতে খড়ি এই কাগজেই। কাগজটি চলেছিল প্রায় ১৫ বছর। নির্মল চৌধুরী ষাটের দশকে বের করেছিলেন ‘নবজাতক’ পরে তাঁর নাম পালটে হয় ‘প্রান্তীয় নবজাতক’ । জ্যোতির্ময় জানাচ্ছেনঃ ডিগবয় থেকে নবজাতক(১৯৭০), ‘নবোদিত’(১৯৮৩তে), ‘পথিকৃৎ’(১৯৮৮), ‘নিবেদন’(১৯৯২),‘উত্তরণ’(১৯৯৩। আসলে হবে ১৯৯১)বেরুতো বা বেরোয়। আমরা আরো জেনেছি ‘দ্বৈপায়ন গোষ্ঠী’ ১৯৭৮এ প্রকাশ করে দ্বিমাসিক এবং দ্বিভাষিক কাগজ ‘ডিহিং’ । ১৯৭১এ ‘বহ্নি’ নামে একটি অন্যরকম কাগজ বেরিয়েছিল। এর আকার ছিল ৩x২ ইঞ্চি। মুল্য ছিল মাত্র ১০ পয়সা। এর কোন একক সম্পাদক ছিলেন না। গোষ্ঠীর সবাই মিলে সম্পাদনা করতেন। বেশ ক’টি সংখ্যা বেরিয়েছিল এর। ডিগবয় থেকে ১৯৮০তেও হাতে লেখা একটি কাগজ বেরিয়েছিল ‘জনচেতনা’ সম্পাদকের নামের জায়গাতে থাকত ‘স্বদীপ’ । এর পাঁচটি সংখ্যা বেরিয়েছিল। ‘পথিকৃৎ’ নতুন সাহিত্য পরিষদের ডিগবয় শাখার মুখপত্র। ‘গুল্মলতা’(১৯৮৭) কাগজটি বেশ প্রতিশ্রুতি নিয়ে বেরোলেও চারটি সংখ্যার বেশি এগুতে পারেনি। ‘নিবেদন’(১৯৯৯) এরও চারটি সংখ্যা বেরিয়েছিল।
          অজিত করের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে দুটি উল্লেখযোগ্য তথ্য জানা গেছিল। পরবর্তী যেকোন অনুসন্ধানের জন্যে উল্লেখ থাকা ভালো। ডিগবয়ের সাহিত্য চর্চার ইতিবৃত্তের কিছুটা নথিবদ্ধ করেছিলেন দ্বিজেশ শর্মা তাঁর ‘সরু সরু মানুহর সরু সরু কথা’ নামের পুস্তিকাতে । আমরা যেটি এখন সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি। তেমনি সুব্রত আদিত্যের লেখা একটি সুপাঠ্য উপন্যাস রয়েছে ‘কান্নার রং’ । এটিও আমাদের হাতে পাবার সুযোগ ঘটেনি।
             যে দুটো কাগজ ডিগবয় থেকে এখন নিয়মিত বেরোয় সে হলো ‘উত্তরণ’ এবং ‘ বর্ষবরণ’। ১৯৯১তে রতন বড়ুয়া শুরু করেন ‘উত্তরণ’ । শতকের শেষের দিকে তাঁর অকাল মৃত্যুতে বছর দুই বন্ধ থাকলে পার্থসারথি দত্তের সম্পাদনাতে আবার বেরুতে শুরু করে ২০০২ থেকে। এখনো প্রতি বছর বেরুচ্ছে। ‘বলাকা’ ডিগবয়ের ৪৪ বছরের পুরোনো নাট্যগোষ্ঠী। বছর তিন ধরে এরা ‘বর্ষবরণ’ নামে একটি ছোট কাগজ গল্প, কবিতা, নিবন্ধ দিয়ে সাজাচ্ছেন।
          এই কাগজগুলোর অনেকটিই এখন পাওয়া খুবই কঠিন। কেন, আগে লিখেছি। সুতরাং ভালো জানি না, কোনগুলোতে কে বা কারা গল্প লিখেছেন। আমাদের হাতের কাছে কিছু কাগজ আছে যেগুলো আমাদের ভরসা। আমরা একে একে সেগুলো ধরছি। এই কাগজগুলোকে ধরে যারা লেখক হিসেবে উঠে এসছেন তাঁরা যে সবাই এখানকার কাগজেই লিখছেন তাতো নয়। ক্রমবর্ধমান দৈনিক কাগজগুলো ছাড়াও অসম তথা বাইরের অনেক কাগজেও লিখে থাকেন। যেগুলো সংগ্রহ করা অতীব কঠিন। লেখকের থেকে না পেলে। কিছু লেখক এমনও আছেন এখন উজানে থাকেন না, অন্যত্র চলে গেছেন সেখানে লেখা লেখি করেন, বা কাগজ সম্পাদনা করেন। যেমন মৃন্ময় দেব, এখন করিমগঞ্জে থাকেন। নানা কাগজে লিখে তিনি এখন অসমের একজন গুরুত্বপূর্ণ সমাজবৈজ্ঞানিক নিবন্ধের লেখক। সম্পাদনাও করেন নানা সাময়িক কাগজ। বা তাঁরই স্ত্রী মাকুমের পূর্বনিবাসী অপর্ণা দেব করিমগঞ্জ থেকে বের করেন ‘সেবা’ নামে একটি কাগজ। সে কাগজে উজানের অনেক লেখকের লেখাও নানা সময়ে বেরিয়েছে। তেমনি ইন্দিরা নন্দি কর। ছিলেন তিনসুকিয়াতে। এখন থাকেন হোজাই। ‘আবাহন’ ছাড়াও নানা কাগজে লেখেন। এবারে আমরা গল্প এবং গল্পকারদের নিয়ে কথা বলবার মতো অবস্থাতে এসে গেছি।
         উজান অসমের গল্প এবং গল্পকার--- ডিব্রুগড়ঃ অসমের ১৫৮জন গল্পকারের একটি তালিকা তৈরি করেছেন জ্যোতির্ময় তাতে ঊর্ধ্বেন্দু দাসকে স্পষ্ট আলাদা করা যাচ্ছে। তিনি ‘মজলিশ’ বলে একটি কাগজ করতেন যোরহাট থেকে। সেই কাগজে প্রকাশিত তাঁর ‘স্বপ্নের ব্যবধান’(পৃঃ ৮৮),’আইথান’ (পৃঃ ৯২) ইত্যাদি গল্পের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। একই কাগজে অন্য আরো কয়েকজন গল্পকারের গল্পের সন্ধান পাচ্ছি, যেমন সমীরণ মহাপাত্রের ‘প্রগতি’ বেরুচ্ছে ১৩৮৬র নববর্ষ সংকলনে ৫ম বর্ষ, ১ম সংখ্যাতে; তপন দেবের ‘অক্সিজেন ও গণতন্ত্র’ বেরুচ্ছে ১৩৮২তে ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যাতে; সুস্মিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নবমীর চাঁদ’ , সুজন কুমার সামন্তের ‘জোয়ার’ (পৃঃ ৯১),নারায়ণ দাসের ‘লবণাক্ত অনুভব’, এবং শান্তনু কুমার সান্যালের ‘প্লেট’। দীপঙ্কর নাথের ‘অরুন্ধতী কি জেগে ?’ গল্পটি বেরুচ্ছে ১৩৮৩র বৈশাখ তথা ১৯৭৬ সংখ্যাতে,( পৃঃ ১২৪) এখন এরা কেউ উজানের লেখক কিনা, আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। যদিও তপন দেব, দীপঙ্কর নাথ ছাড়া বাকিদের নাম ১৫৮ জন লেখকের তলিকাতে রয়েছে।
         ঈশানের কথাঃ শুধু ডিব্রুগড় নয় গোটা উজান অসমেই নাম করবার মতো উন্নত মানের অন্যতম কাগজ বোধ করি শিবাজী পুরকায়স্থ সম্পাদিত ‘ঈশান’ । কিন্তু এই মানের জন্যে তাঁকে মনে হয় স্থানীয় লেখকদের সরিয়ে রাখার মূল্য দিতে হয়েছে অনেকটাই । যদিও তিনি প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, “ ...নবীন প্রতিভাকে পাঠকদের সামনে পেশ করা, মানুষ গড়ে তোলার প্রচ্ছন্ন বাসনা সহ নতুন পাঠক তৈরি করা ‘ঈশানে’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।” আমরা গৌতম গুহরায় কিম্বা পুণ্যশ্লোক দাসগুপ্তের মতো লেখককে পেলেও ডিব্রুগড়ের চেনা নাম সেভাবে তেমন পাচ্ছি না। অবশ্যি লেখকের ঠিকানার উল্লেখ না থাকাতে বোঝা মুস্কিল তাঁরা কোথাকার। অন্তর্বস্তু থেকে অনুমান করে নিতে হয়। ‘ঈশানে’ দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু অসমিয়া লেখক লিখছেন বাংলাতে, সেগুলো অনুবাদ বলেও উল্লেখ নেই। প্রথম সংখ্যাতে তেমনি এক উল্লেখ করবার মতো গল্প পাচ্ছি টঙ্কেশ্বর ভূঞার লেখা ‘ এক প্রবহমান প্রহেলিকা’ কার্বি পাহাড় থেকে বেরোনো নিশারি নদীর পাড়ে একটি মিশ্রবসতির গল্প। পড়ে মনে হয় গ্রামটি নগাঁও জেলার কোথাও। সে বসতির চারদিকে কার্বি, কোচ, কৈবর্ত, মুসলমান গ্রাম। এরা একসঙ্গে নদী বাঁধের জন্যে লড়াই করেন, নদীর বানে ভাসেন, একে অন্যকে বাঁচাবার জন্যে লেগে পড়েন। বানে এদের সামাজিক সম্প্রীতি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে না, কিন্তু এরই মধ্যে বিদেশি খেদার লড়াই এসে মুসলমান বসতি থেকে কাউকে কাউকে তাড়ালো। স্মৃতি কথার ঢঙ্গে গল্পটির বয়ন ভালো। সুখপাঠ্য। (পৃঃ৫৫) মধুমিতা ভট্টাচার্যের একটি অনুগল্প রয়েছে ‘শেষ বিদায়’। অন্তর্বস্তু থেকেও বুঝবার উপায় নেই লেখিকা কোথাকার। স্ত্রীর প্রতি উদাসীন স্বামীকে হত্যা করে স্মৃতিচারণে স্ত্রী তাঁর প্রতি ঊষ্মা প্রকাশ করছে। বিশেষ কোন মোচড় নেই। শেষ হয়েছে, এই কথাতে “পুনশ্চঃ তোমার মৃত্যু উপলক্ষে একটা দারুণ আইস্ক্রীম খাচ্ছি, বিশ্বাস করো দুর্দান্ত উপভোগ করছি।” (পৃঃ ৬৬)যদিও এরকম উচ্চারণ বেশ সাহসী বলেই মনে হয়।
          বসুন্ধরার কথাঃ এখনো বেরোয় এমন দুটি কাগজের একটি ‘বসুন্ধরা’র দুটি সংখ্যা আমাদের হাতে রয়েছে। ‘বসুন্ধরা সম্পর্কে’ ‘উৎসবে’ ক্ষিতীশ রায়ের মন্তব্য আমরা আগে লিখেছি। অসিত দত্ত এর সম্পাদনা করেন। আমরা কোন সংখ্যাতেই সম্পাদকীয় রুচির বা নিষ্ঠার কোন পরিচয় পাইনি। ‘ঙ্গ’ যেখানেই আছে নির্বিকার ‘ঁ’ পাওয়া যাচ্ছে। এরকম অজস্র ছাপা কিম্বা বানান ভুলের কথা ছেড়ে দিলেও মনে হয় যেন সম্পাদকের এসব নিয়ে কোন ভাবনাই নেই। আমাদের হাতে কাগজটির ৮ম এবং ১০ম সংখ্যাটি দুটো রয়েছে। দুটোই এক সঙ্গে বৈশাখ এবং আশ্বিন সংখ্যা—কী করে হয় আমরা বুঝিনি। বললেই হতো শারদ সংখ্যা। প্রথমটি ১৪১৬ এবং দ্বিতীয়টি ১৮১৮ বাংলার। প্রথমটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৮, মূল্য ১০০টাকা। দ্বিতীয়টির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১২, মূল্য ২০০টাকা। কেন? এগুলো আমরা বুঝিনি। সম্পাদকীয়র জায়গাতে প্রথমটিতে আছে ১৩ পৃষ্ঠার গুজরাটি গল্পের ইতিবৃত্ত আর দ্বিতীয়টিতে আট পৃষ্ঠার মাইকেল মধুসূদনের জীবনী। তা থাকুক, এই সময়ে ডিব্রুগড়ে বসে যিনি সাহিত্য করবেন বা পড়বেন তাঁর কাছে গুজরাটি সাহিত্যের বা মাইকেলের জীবনীর গুরুত্ব কোনভাবেই এই সম্পাদকীয় থেকে স্পষ্ট হলো না, সে ভাবনাও লেখকেই নেই।
          প্রথমটিতে অসিত দত্তের একটি গল্প রয়েছে ‘রাজা-যুদ্ধ-তৃণ-গুল্ম’। আরেকটু ঘসামাজা করলেই ‘দেশভাগ’ নিয়ে এটি এক ভালো গল্প হতে পারত। শিবপদ বাবুর সীমান্ত পেরোনোর গল্প। ধর্ম সংঘাত নিয়ে আক্ষেপ আছে, আছে সমস্ত মুসলমান এমনকি নিজের পরিবারে পালিত চাকর ইরসাদকেও বিশ্বাসঘাতক সাজানো। কিন্তু এই সত্য আড়াল পড়ে নি এই শিবপদবাবুরা নিতান্তই হিন্দু ছিলেন না, ছিলেন সম্পন্ন গৃহস্থ বা জমিদার আর শত্রুপক্ষ নিতান্ত মুসলমান ছিল না , ছিল চাকর বাকর আর প্রজা, “ আর একজন বলছেঃ কর্তার রাগ উঠথাছে। হেই ফালনা ফেরামের মুখার্জী বামনায়ও বিদেশে বইয়া জমিদারি ফলাইতে গেছিলো। আমার চাচার পোলা মহসিন গেরামের বেবাগ প্রজাগো লইয়া তার জমিদারেরে উষ্ঠাইয়া যে বিদেশের কোন গাথায় অখন উবুত হইয়া কোত কোত কইরা ফানি খাইতাছে।” এই জমিদারেরাই গল্পের তৃণ-গুল্ম এবং নিরিহ ভালো মানুষ। এখানেই অসঙ্গতি। দ্বিতীয়টিতে একটি গল্প রয়েছে ‘কাপুরুষের দিনরাত্রি’। গল্পের কথক, যার একেবারে শেষে গিয়ে নাম জানা যাচ্ছে দীপঙ্কর, সে বড্ড অগোছালো জীবন যাপন করে। সময়ের কাজটা সময়ে, সময়ের কথাটা সময়ে বলে উঠতে পারে না। এক সকালে ঘুম থেকে জেগে মনে তার প্রশ্ন দেখা দিল রাতে ঘুম হয় নি কেন ভালো? সংশয় দেখা দিল কাল কি তবে ইলোরার বিয়ে হয়ে গেছে, না কি স্বপ্ন দেখছিল? ওদিকে টেবিলে ইলোরার বিয়ের চিঠি পড়ে আছে। সুতরাং যা হোক কিছু গায়ে চাপিয়ে, খেয়ে না খেয়ে দে দৌড়। এই দৌড়ের মধ্যে ইলোরাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ। বন্ধুত্ব মান অভিমান। কিন্তু এর বেশি না এগুতে পারার গল্প। লেখক যে ইচ্ছে করলে গল্পটা দাঁড় করাতে পারতেন তা বোঝা যায় বাক্য নির্মাণে। দীপঙ্করের দেরি হয়ে গেছে। তাড়া আছে। সুতরাং পুরো গল্পের ভাষাবয়নেও সেই তাড়া । ছোট ছোট বাক্যে তাড়াটি খেলেছে বেশ। এই যেমন “ঘরটা তালা বন্ধ করি। রিক্সা নেবোনা হেটে যাবো। রিক্সাই নিই, রোদটা চড়া। এই রিক্সা রোখো।” সংলাপে আর বিবরণে তফাৎ করবারও সময় করে উঠতে পারেন নি লেখক। যথারীতি ইলোরার বাড়ি পৌঁছে দেখা গেলো সে চলে গেছে বাড়ি খালি করে। কাকে যে পরিচয় দিল ‘আমি দীপঙ্কর’ বোঝা না গেলেও এই অব্দি চলত। কিন্ত তার পরেই যখন লেখা হলো, “ আমি দীপাঙ্কর। আমি বিমল মিত্রের কড়ী দিয়ে কিনলামের দীপঙ্কর। নাঃ কোনদিন কবিগুরুর নীশিথের নায়ক হব না।” ( বানান যথাবৎ রেখে দিয়েছি—লেখক।) তখন বোঝা গেল শুধু যে ইলোরাকে নিয়ে গেছে ব্রজেন্দ্রকুমার তাই নয়, গল্পটাকেও লেখক ধরে রাখতে পারেন নি নিজের করে। পড়া গল্প ধার করে লিখতে চাইছিলেন। বিমল মিত্রের দীপু বা দীপঙ্কর দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়ের , স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠা চরিত্র। গল্পের শেষে সে পৃথিবী জুড়ে ‘মানুষে’র সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। এই গল্পের দীপঙ্কর খুব কষ্ট করে কল্পনা করলে তার ধারে কাছে যেতে পারে, নিয়ে যাবার চেষ্টা করেই লেখক তাকে নষ্ট করে ফেলেছেন। লেখকদের যেকরেই হোক পশ্চিম বাংলার সাহিত্যে মানসভ্রমণে গিয়ে রসদ কুড়োবার বিড়ম্বনার এটি এক সার্থক নজির।
            বসুন্ধরার ৮ম সংখ্যাতে অসিতাভ ঘোষের একটি গল্প পাচ্ছি ‘মিলির মুখ’ । দশমীর ভিড়ে বিকাশ নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না। পুণ্যার্থীদের ভিড়ে এক কোষ্টরোগীর তিন নয়া পয়সার বেশি ভিক্ষে জোটেনি দেখে বিকাশ বিস্মিত হয়। হঠাৎ তার অনেক দিন আগে মৃত বোন মিলির কথা মনে পড়ে। এক মুসলমান ছেলের প্রেমে পড়ে প্রতারিত মেয়ে। গল্পটিতে লেখকের বেশ একটা সামাজিক উদ্বেগের ছাপ আছে। বিকাশ মিলিকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেও সে যায় নি, ভ্রুণ হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করে। বিকাশ জেনে শুনেও কেন বাঁচাতে পারল না বোঝা যায় নি। কিন্ত সে অনেক আগের কথা। এগুলো ভাবতে ভাবতে দশমীর বিষর্জন শেষে বিকাশ ‘সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত ভাবে এবং অচিন্তিত ভাবে’ নদীর জলে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে। শেষ অব্দি গল্পটিকে পূর্বপরিকল্পিত বলেই মনে হয়, চিন্তার ছাপ বিশেষ নেই। (পৃঃ৭৮)
          ভূপেন্দ্র লাহিড়ীর একটি গল্প রয়েছে ‘এক হাজার টাকা।’ ছোট ভাইয়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে ঝগড়াঝাটিতে পেরে না উঠে জগা তার স্ত্রী মালতী আর দুই পুত্র কন্যাকে নিয়ে এসে ডিব্রুগড়ে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ঝুপড়ি গড়ে থাকে। চৌকিডিঙ্গি বাসষ্টেণ্ডের পাশে বস্তা বিছিয়ে ভিক্ষে করে জগা। ছেলে মাছবাজারের পেছনে বাদাম ভাজা বিক্রি করে। এক বিকেলে একটা অচেনা লোক জগাকে একটা পোটলা দিয়ে যায় নিজের কাছে রাখবার জন্যে। মানা করে খুলে দেখতে। দিন দুই পর এসে নিয়ে যাবে জানায়। জগাতো ভয়েই মরে। বাড়ি গিয়ে খুলে দেখে কিছু কাগজপত্র, প্রচুর টাকা আর পিস্তল। জগা-মালতীর মনে হলো অচেনা লোকটা চোরই হবে। পুলিশে যেতে কেউই সাহসী হলো না। জগা ঐ লোকটিকে দেখা দিতেও সাহসী হলো না। তার জায়গাতে গিয়ে বসল মালতী। একটি মেয়ে এসে পোটলাটা নিয়ে গেলো যাবার বেলা জানিয়ে গেলো তারা বিপ্লবী। এক হাজার টাকার একটা নোটও দিয়ে গেলো। সেই টাকাতে সামনের বৈশাখে ছেলেমেয়ের নতুন জামা হবে ভেবে প্রসন্ন হয় মালতী। গল্পের বিবরণ আর সংলাপে তফাৎ করবার জন্যে কোনো যতি চিহ্নের দরকার মনে করেন নি লেখক। (পৃঃ৮২)সমস্যা হলো বিপ্লবীদের রংরূপ আঁকবার মোটেও সাহস করেন নি লেখক। ডিব্রুগড়ের মাটিতে এদেরকে একেবারেই চেনা যায় না। মনে হচ্ছে নকশাল বিপ্লবীর কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু অসমে কোনদিনই প্রায় তাদের এমন সশস্ত্র উদ্যোগ ছিল না। এগুলো শুধু পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের নকলে চালানো যায়।
          দেবব্রত ভট্টাচার্যের গল্প রয়েছে ‘একের মা অনেকেরই’ । শুকতারা কাগজে কারো স্মৃতিতে বিষয় ভিত্তিক যে গল্প প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে সেই আদলে গড়া নীতিকথা জাতীয় গল্প। গল্পের স্থাননামগুলোও ডিব্রুগড় কেন, অসমের নয় বলেই মনে হয়--- চলে গেছে পশ্চিম বাংলাতে। কেষ্ট বলে গরীব ছেলেটির মায়ের পেটে ব্যথা। কেষ্ট এবং তার খেলার সঙ্গী ছেলে মেয়ে সবাই দরিদ্র। সবচে বড় দশম শ্রেণির ছাত্রী প্রতিমা কেষ্টকে জিজ্ঞেস করে, “—হ্যাঁরে কেষ্ট, মুখটা এমন মলিন করে বসে আছিস কেন?” এমন পড়া বই থেকে তুলে আনা ভাষাতেই গল্পটি লেখা। বানান ভুল ছাপার ভুল আছেই। সেগুলো লেখকের না সম্পাদকের বোঝা দায়। বোঝাই যায় লেখক নিজে হাত পাকাচ্ছেন। প্রতিমা খেলার সঙ্গীদের দীপাবলীতে আতশবাজী পোড়ানোটা যে খুব সুস্থ প্রথা নয় বুঝিয়ে টুঝিয়ে সেই টাকা কেষ্টর মায়ের চিকিৎসার জন্যে জোগাড় করে ফেলে। নিজের বাবা ঠাকুরদাদাদের থেকেও বেশ কিছু আদায় করে । সব মিলিয়ে হাজার পাঁচেক হয়ে যায়। সেই টাকাতে কেষ্টর মা হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রতিমার এই উদ্যোগের খবর জানাজানি হওয়াতে পাড়াপ্রতিবেশিরাও সহজেই এগিয়ে আসেন। সব জেনে ডাক্তারও পারিশ্রমিক নিলেন না প্রায় কিছুই। বরং এগারো হাজার টাকার বেশি সাশ্রয় হয়ে গেল প্রতিমার। সেই টাকাতে স্থায়ী ভাবে ‘প্রতিমার তহবিল’ গড়ে তুলল পাড়ার লোকে,যাতে আর কোনো গরীবকে বিনা চিকিৎসাতে মারা না পড়তে হয়।
      
  উজান অসমের গল্প এবং গল্পকার--- তিনসুকিয়াঃ
     মুহূর্তের কথাঃ
তিনসুকিয়ার চারটি কাগজ হাতের কাছে রয়েছে আমাদের। তার মধ্যে এখন লুপ্ত ‘মুহূর্তে’র ‘উদ্বোধনী’ সংখ্যা, ১৩৮২ বাংলাতে একটি গল্প পাচ্ছি, লিখেছেন অঞ্জন মজুমদার। সম্পাদকের সংগ্রামী আবেগকে সম্মান জানাতেই হয়। এখন প্রবাসী সম্পাদক বাবুল বিশ্বাসের ( মূল নাম নৃপেন শিকদার) সঙ্গে কথা হয়েছিল। বললেন, জরুরি অবস্থার সময় এই সংখ্যাতে ‘সংসারে যারা শুধু দিল, পেল না কিছুই...” সেই বিখ্যাত শরৎচন্দ্রের উক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে সেন্সর বোর্ডের শ্যেন দৃষ্টিতে পড়েছিলেন। ভ্রূক্ষেপ করেন নি। কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকও ছাপা হয়েছিল সেই সংখ্যাতে। কিন্তু প্রচ্ছদেই ‘উদ্ভোদনী’ শব্দটি নজরে পড়ে। এমন প্রচুর ব্যাপার আছে, যেদিকে নজর দেয়াকে তাঁরা প্রাথমিকতাতে নেন নি। এই প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে অঞ্জন মজুমদারের গল্পটিকে। যিনি আবার নিজে বেশ কিছু কাগজের সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন। এই গল্পের নিচেই তাঁর চারটি কাব্য গ্রন্থ এবং দু’টি গল্প গ্রন্থ ‘আমি এবং আমার প্রেমিকা’ আর ‘নীড়ে ফেরা পাখি’র বিজ্ঞাপন আছে। তাতে লেখা “ যে বইগুলো না পড়লে আপনাদের সাহিত্য পিপাসা অতৃপ্ত হয়ে থাকে।” খুবই ছোট গল্প ‘আটক’। গ্রামের মেয়ে সুমিতাকে দূরের স্কুলে যেতে সি-আর পি-র শিবির পেরিয়ে যেতে হয়। রোজই তারা তাকে উত্যক্ত করে, তাকিয়ে থাকে, মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। এবং একদিন সে তাদের হাতে ধর্ষিতা হলো। আটকে রাখল এরা তাকে। সুমিতার বাবা ঊর্ধ্বতনের কাছে নালিশ করেও সুবিচার পান নি। উলটে শুনতে হল, নিশ্চয়ই তাঁর মেয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। তিনি শুধু শুধু সি আর পি-র নিন্দে করছেন। দিন কতক পরে সুমিতাকে ওরা ছেড়ে দিল। বাড়ির পথে শংকরদার সঙ্গে দেখা। সুমিতা শুরুতে নীরব থাকলেও বাড়ি যেতে যেতে সব বলে দিল। শংকরদা গর্জে উঠল, “আজ রাতেই কেম্প উড়িয়ে দেবো।” কেম্পও উড়ল, শংকরদার জেলও হলো। গল্পের কথকরা জেলে প্রায়ই যেতেন দেখা করতে। জিজ্ঞেস করতেন, ‘কেমন আছেন?” শংকরদা বলতেন, “ জেলে বেশ আছি। প্রকৃত সমাজতন্ত্র এখানেই আছে। মার্কামারা নেতাদের বুলি শুনে কিন্তু সমাজতন্ত্রকে সঠিক বোঝা যায় না।” এখন আমাদের মুস্কিল হলো, বুঝতে পারি না শংকরদা সমাজতন্ত্র বুঝতে গেছিল কবে আর কার কাছে! আর সুমিতা কি তারপর সেদিন বাড়িতে গিয়ে স্নান করে শুয়ে পড়ল?

        দৃষ্টির কথাঃ দৃষ্টির ৪র্থ বর্ষ, ১ম সংখ্যাতে শীলা মজুমদারের ‘উদরান্ন’ ভালো গল্প। ইনি নিজে রেলে কাজ করতেন। এখন কলকাতা প্রবাসী। রেলের বগীর নিচে চাল চুরি করতে গিয়ে রেলে চাপা পড়া জুবেদার গল্প। আবু দুলু ভাই দুটো কোনভাবে বেঁচে যায়। লোকের ভিড় জমেছে। কিন্তু জুবেদা জল চাইলে কেউ এগিয়ে এলো না। ভাই দুটি দৌড়ে বাড়িতে খবর দিতে গিয়ে ডেরার মালিক লাখন প্রসাদকে জানায়। লাখন প্রসাদ দৌড়ে আসে বটে । কিন্তু পাশে যায় না, যদি পুলিশের মামলাতে জড়ায়। ভিড়ের সঙ্গে এইসব অবাঞ্ছিত সমাজবিরোধীদের নিয়ে আলাপ জমায়। জুবেদার মা শাকিলা এক সময় এসে পড়ে। তাকেও কাছে চাপতে দেয় না লাখন প্রসাদ। মাকে বোঝায় পুলিশে যদি মাকে ধরে নিয়ে যায় তবে বাকি দুটো সন্তানের হবেটা কী! জোর করে রিক্সা চাপিয়ে ওকে বাড়ি পাঠায়। শাকিলার বুক ফাটা আর্তনাদ জুবেদা অব্দি পৌঁছোয় না, জুবেদার ‘এট্টু পানী দ্যাও! পানী খামু! ওমা মা! পানী...” এই কাতর আবেদনও নয়। জুবেদা মারা পড়ে।
শীলা মজুমদার ছাড়া ‘দৃষ্টি’তে স্থানীয় ভালো লেখক মনে হয় আর একজনের নামই নিতে পারি, তিনি শিখা ভট্টাচার্য। ‘সময়ের স্রোত’ নিটোল ভালো লাগার সহজ গল্প। একই সংখ্যাতে। ভাষা বয়নও ত্রুটিহীন। যদিও নুতন মোচড় নেই বিশেষ। বুড়ো ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী প্রবাল আর অনুপমার সংসারের গল্প। তিনসুকিয়া শহরের ছেলের ভালো বাড়ির বাইরে টিংরাই হাবিতে ছোট সস্তা ঘর ভাড়া করে থাকেন। যযমানী করে আর পাঁজি ঠিকুজি দেখে দিন চলে। চার ছেলের পরে অনেক পুজো-পার্বণ-প্রার্থনাতে ছেলে জয়ন্ত এসছিল। ছেলেকে পড়িয়ে, যাকে বলা মানুষ করা করেছিলেন, মেয়ে চারজনকেও ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের বিয়ের পরেই সব পালটে গেল। ছেলে বৌর সংগে বনিবনা হলো না, ছেলেও মা-বাবার সঙ্গ দিল না। ভাড়া বাড়ির মালিক ঘর ঠিক করবে বলে যখন কিছুদিনের জন্যে অন্য কোথাও যেতে বললে ছেলে বলল, শ্বশুর বাড়ি গিয়ে থাকবে। মা-বাবার পোষালো না, কিন্তু সে তাদের অভিমানকে কোন গুরুত্ব দিল না। এক সন্ধ্যেবেলা বুড়ো-বুড়ির পারস্পরিক নির্ভরতা আর প্রেমের সংসারের বিবরণের মাঝে তাদের স্মৃতিচারণার মধ্যি দিয়েই পুরো গল্প বলে দিয়েছেন লেখিকা। গল্পের শেষ হচ্ছে তন্দ্রাহীন ভোরে ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রবালের এই মন্তব্যে, “ সুখ আমি কোনদিনই চাইনি অনু, সবসময় শান্তি চেয়েছিলাম। দরজা খুলে অনেকদিন পর সূর্য প্রণাম করলেন প্রবালবাবু।” লেখিকা গল্পে ঢোকে গিয়ে কোন নীতিকথা শোনান নি, যা কিনা এখানকার গল্পগুলোর এক সাধারণ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
         আরেকজন লেখকের নাম নিতে পারি । দীপেশ শূর । ডিগবয় নিবাসি। দৈনিক কাগজ এবং বিভিন্ন ছোট কাগজে লিখে বেশ পরিচিত নাম। আজকাল ‘উত্তরণ’কাগজের সম্পাদনার সংগে জড়িয়ে আছেন। এই সংখ্যা 'দৃষ্টি'তে তাঁর একখানা গল্প আছে ‘বরের বান্ধবী’। মিঠুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিউটি পার্লারে গেছে। এসময় কালু বলে একটি ছেলে এসে জানালো, মিঠুর ভাবি বর ওর বান্ধবীকে নিয়ে ওদের বাড়ি এসছে। মা ডেকে পাঠিয়েছে। স্বাভাবিক, মিঠু যাবে না। যায় নি। অনেক পরে বাড়ি ফিরলে মা জিজ্ঞেস করলেন, সময়ে এলো না কেন?, রেগে কাঁই মিঠু জানালো , বেশ করেছে-- আসেনি। এ কথা ও কথার পর জানা গেল এসছিল, মিঠুর বান্ধবী সীমা ওর বরকে নিয়ে। এর পর যা হতে পারে। গল্প লেখার দিপেশ শূরের আসে। যদিও সাধারণ সহজ হাসির সরল গল্পই লিখে থাকেন। কিন্তু ‘সব কথা শুনে সকলেরই কি হাসাহাসি’ অব্দি এগিয়ে গল্প শেষ করতে গিয়ে এই গল্পেই নয় আরো অনেক গল্পেই তিনি ঝুলিয়েছেন। আমরা পরে দেখাবো।
          বুবুনকে নিয়ে দীপেশ শূরের অনেক গল্প কবিতা আছে। ‘বুবুনের কাণ্ডকারখানা’ নামে তাঁর একখানা প্রকাশিত ছড়া সংকলনও রয়েছে। সেই বুবুন সিরিজের একটি গল্প আছে ২০০৩এ ‘দৃষ্টি’তথা ‘অপলক দৃষ্টি’তে । ‘বুবুনের সমুদ্র দেখার বায়না’। বুবুনের বাবা গেছিলেন বাঙ্গালোর। ফিরার পথে চেন্নাই গিয়ে সমুদ্র দেখে এসে বাড়িতে গল্প করলেন কি না বুবুন বায়না ধরল সেও সমুদ্র দেখবে। তাও সেদিনই। ভারি মুস্কিল। বাবা বাড়ির বাইরে বেড়াতে নিয়ে গেলে ভুলিয়ে দিতে চাইলে নালা দেখে সে জিজ্ঞেস করে এটাই কি সমুদ্র? পুকুর দেখে জিজ্ঞেস করে এটা যদি হয়। দিন কয় পরে মার্ঘেরিটা মাসির বাড়ি যাবার পথে বুড়িদিহিং দেখে জিজ্ঞেস করে এও যদি হয় সমুদ্র। এইভাবে হাজারো শিশুর জিজ্ঞাসা আর বড়দের কৌতুক নিয়ে গল্প এগোয়। শেষে বাবা কথা দিতে বাধ্য হন পরের মার্চে রেলে চাপিয়ে তিনি সবাইকে সমুদ্র দেখিয়ে আনবেন। সে রাতে ঘুমের মধ্যে সমুদ্র সমুদ্র বলে চেঁচিয়ে উঠে। গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু লেখক, আমাদের এইটুকু অব্দি না জানিয়ে স্বস্তি পেলেন না, “স্বপ্নে দেখতে পাওয়া সমুদ্রে সাঁতার কাটার কথা চিন্তা করতে করতে বুবুন আবার ঘুমিয়ে পড়ল।”
      ‘দৃষ্টি’ও এখন লুপ্ত। প্রথম সংখ্যার নাম ছিল ‘শারদ সংকলন’৯৯’ । প্রকাশকের নাম ‘দৃষ্টি পাবলিকেশন’। এই সংখ্যাতে দুটো গল্প পাচ্ছি। একটির লেখিকা সুস্মিতা মজুমদার গুয়াহাটির, অন্যটি তিনসুকিয়ার মধুমিতা দাসের লেখা ‘পুনর্মিলন’। জম্পেশ কমেডি সিনেমার আদলে লেখা গল্প। ভাবার কিছু নেই। হাসার প্রচুর আছে। দেবর রোহনের বিয়ের পাত্রি নিয়ে বৌদি দেবলীনার ঝগড়া হয়, দেবর বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এরই মধ্যে দেবলীনা ঘরের দরজাতে একটি মেয়ের প্রেম পত্র পড়ে থাকতে দেখে চিঠিটি স্বামী রাহুলের ভেবে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। পথে একটি প্রসুতী সন্তান জন্ম দিচ্ছে দেখে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার নাম দীক্ষিতা। তাকে প্রেমিক প্রতারণা করেছে। সুতরাং নবজাতককে নিয়ে দু’জনে একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। ওদিকে রোহন বাড়িতে ফেরে, কিন্তু রাহুলের ছেলেকে খোঁজে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে কাজের মেয়ে দীক্ষিতার সন্তানকে চুরি করে নিয়ে এক মস্তানের কাছে বিক্রি করে দেয়। এই নিয়ে থানা পুলিশ এবং পুনর্মিলনের গল্প। ছাপা কিম্বা বানান ভুল প্রচুর । সম্পাদনার নাম গন্ধ নেই। যেমন, ‘পরে গেলে পা ভাঙ্গবে’, ‘সন্তান বেচেঁ গেল’, ‘বাড়িতে একা একা বোড় হয়ে গেছিলাম’।
           তাঁর আরেকটি গল্প । ‘অদিতি’ । রয়েছে ৩য় বর্ষ ১ম সংখ্যাতে। সেই সহজ রসের চলচ্চিত্রের ঢং। বহুদিন পর বৃদ্ধাবাসে দেখা এককালের স্বামী-স্ত্রী অদিতি এবং বিরাজের। বিয়ের পাঁচ বছর পরেও সন্তান না হওয়াতে মায়ের চাপে বিরাজ আবার বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাওয়াতে অদিতি স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে এসছিল। ওদিকে বিরাজেরও নতুন সংসার সুখের হয় নি। সন্তান হলো ঠিকই কিন্তু মাসের শেষে স্ত্রী সব কেড়ে নেয়, তাঁর হাতে কিছুই থাকে না। জটিল সমস্যা। ঘেন্না ধরে গেছে তাই চাকরি ছেড়ে বৃদ্ধাবাসে চলে এলেন। অদিতির কাছে অভয়ের ফোন আসে। অভয়টি কে? ফোন করে কেন?—এই সব জিজ্ঞাসা মনে হয় বিরাজের মনে দেখা দিয়েছিল। জানা গেল সে অদিতির ছেলে। বিদেশে পড়াশোনা করে দেশে ফিরছে , এখন মাকে নিয়ে যাবে। বিরাজের অনুতাপ হলো, অদিতির বকলমায় লেখিকা শেকসপিয়রের একটি ভুল কোটেশন পড়ালেন, “ Life is a drama, We are actor, God is a director.” অভয় এলে অদিতি আলাপ করিয়ে দিলেন বিরাজের সঙ্গে। বিরাজকে যেতে বললেন, ওদের সঙ্গে। গেলেন না, বললেন, “...খারাপ পেও না।” ওরা চলে যেতে ধুতির কোঁচে চোখের সামান্য জল মুছলেন শুধু।
         ৩য় বর্ষ ১ম সংখ্যা, নাম ‘দৃষ্টিতে মধুমিতা দাস ছাড়াও আরো পাঁচজন লেখককে পাওয়া যাচ্ছে। সমরেন্দ্র দাস রায়, সীমা পাল, সুস্মিতা মজুমদার, সন্ধ্যা ঘোষ, মৌ চন্দ। সমরেন্দ্র দাস রায়ের ছেলেবেলা করিমগঞ্জের কোথাও কেটেছে, ছাত্র এবং পরবর্তী জীবন তিনসুকিয়াতেই। ‘দৃষ্টি’ এবং ‘উজানে’ বেশ কিছু গল্প লিখেছেন। স্মৃতিরোমন্থন তাঁর গল্পের প্রধান বিষয়। সেই কবে বরাক উপত্যকা ছেড়ে এসছেন । এখনো গ্রামনাম, পথের বিবরণগুলো স্পষ্ট উল্লেখ করতে পারেন। খানিক ঘষামাজা করলেই ভালো গল্প লিখতে পারতেন। কিন্তু সেগুলো গল্পের নামে প্রতিবেদন হয়ে পড়ে। এই যেমন এই সংখ্যাতে প্রকাশিত ‘শিবানী ফিরে এলো’ গল্পটি শুরু হয় চা-বাগানের পরিবেশে। নারানডর চা-বাগানের সুপারভাইজার তথা টিলাবাবু অজিত মিত্রের মেয়ে শিবানী এম ই স্কুলের শিক্ষিকা ছিল, স্কুলের পরে বিনা মাইনেতে শ্রমিকের ছেলেমেয়েদের পড়াতো। কারো বিপদে আপদে সদা প্রস্তুত মেয়ে। কিন্তু গল্প সেই শ্রমিক জীবন নিয়ে এগুলো না, এগুলো শিবানীর বিয়ে নিয়ে। জেঠতুতো বোনের বিয়েতে বাবার সঙ্গে তিনসুকিয়া এসে জেঠামশাইর বন্ধু শশধরবাবুর নজরে পড়ে গেল মেয়ে। নিজের ছেলের জন্যে পাত্রী খুঁজিছিলেন। বিয়ে হয়ে যায় ওর। বিয়ের পরে আবিষ্কৃত হয় স্বামী রোজ মদ খায়, শিবানীর আপত্তির কোন মর্যাদা দেয় না। রাতে বাড়ি ফেরে না। বৌ পেটায় এমন কোনো সংবাদ নেই। এরই মধ্যে একটি মেয়ে জন্মায়। বাবাকে চিঠি লিখে স্বামীর কথা জানায় মেয়ে। বাবা এসে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যান এবং “তারপর কাহিনি খুবই ছোট। কিন্তু অসীম সাহসিকতা ও প্রতিকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে ভাষ্কর। অবধারিত ভাবে শিবানীর আদালতের দুয়ারে করাঘাত ন্যায়বিচারের আশায়। মহামান্য আদালত শিবানীর সমস্ত কাহিনী শুনে সেপারেশনের আদেশ দিলেন। যথা নিয়মে পেলো ভরণ পোষণের নির্দেশ। শিবানী আজ মুক্ত—অনাচার, অবিচার, অন্ধকারাচ্ছান্ন কালো রাত্রির অবসান ঘটিয়ে মুক্ত বিহঙ্গিনীর মতো শান্তির নীড়ে ফেরার আকূল আহ্বানে।”( বানান, বয়ন পাল্টাই নি—লেখক) তিনসুকিয়া এই এক দশক আগেও প্লাইউড শিল্পের জন্যে পরিচিত ছিল। উচ্চতম আদালতের নির্দেশে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায় এই তথ্য আমাদের জানা। বহু সাধারণ শ্রমিক কাজ হারান, বাবু কর্মীরা অনেকে ক্ষতিপূরণ পেলেন, অনেকে স্থান্তরিত হলেন। ৪র্থ বর্ষ, ১ম সংখ্যা ‘দৃষ্টি’তে এই লেখকের ‘ঝড়ের পাখী’ সেরকমই এক স্থানান্তরিত কর্মী সুমিতের গল্প। কোম্পানির গোপন কারবার জানতেন তার উপর কর্মদক্ষতা ছিল বলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গুজরাটের ভুজে। সেখানে একই কোম্পানি মালয়েশিয়ার থেকে কাঠ এনে প্লাই তৈরি করে। সেখানে সময় মতো মাইনে মেলে না ছাড়া আর কোনো দুর্গতির সংবাদ জানা গেল না । তাতে বেচারা তিনসুকিয়ার বাড়ি আসতে পারে না। সেখানে ভাড়া ঘরে থাকেন ওর মা , স্ত্রী এবং এক ছেলে সন্তান। মায়ের মৃত্যুতেও আসতে পারে নি। পনের দিনের ছুটি চেয়ে পাঁচদিনের পাওয়াতে সেখানেই শ্রাদ্ধ করে। সুতরাং লেখকের আক্ষেপ “ মায়ের স্মৃতিকে সম্বল করে, কবে মিলন হবে সুমিত ও শ্যামলীর কোমল হৃদয়। কবে ফিরে পাবে তার একমাত্র সন্তান অমিতকে! কে দেবে তার উত্তর?” যে স্ত্রী-সন্তানের গল্পে কোন ভূমিকা নেই তার নামের উল্লেখও যে বাহুল্য মাত্র এতো সব লেখক ভাবেন নি। ভাবলে তিনি ভালো গল্প লিখতেন।
           ৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা দৃষ্টিতে সীমা পালের গল্প ‘অনুভূতি’ও সেই মধুমিতা দাসের মতোই একই ধাঁচে বাঁধা। গল্পের কথক মহিলা কোনো এক পাহাড়ি হাসপাতালে নার্সের কাজ করেন। সেও এক চা-বাগান। হঠৎ তাঁর সহকর্মী এবং পুরোনো বান্ধবী অনুরাধার থেকে খবর পেলেন তাদের সহপাঠিনী ‘নন্দা’ তথা সুনন্দার বর মারা গেছে। গাড়ি চেপে তাঁরা গেলেন নন্দার শ্বশুর বাড়ি। ছমাসের ছেলে কোলে বিধবা নন্দার সঙ্গে ওদের দেখা হলো। ফেরার পথে, একান্তে শাশুড়ি ওদের অনুরোধ করলেন, ওরা যেন নন্দাকে বলে যায় তাদের বনেদী বাড়ি, তাই বৈধব্যের রীতিনিয়ম মানতে যেন ভুল না করে ও। এরা কিছুই বলেনি। বাড়ির কাজের লোক ‘নরেনদা’ ওদের এগিয়ে দিতে গিয়ে জানালো ‘দাদাবাবু’ নন্দাকে খুব যত্নে রাখতেন, কিন্তু এখন বৈধব্যদশাতে যা যা করতে হয় নন্দাকে--- দেখে নরেনদার প্রাণে সয় না। কিন্তু এরও কোনো সুরাহা হলো না, ট্রেনে চেপে কথকের মনে হলো, “ নন্দাকে কোনদিন তার শ্বশুড়বাড়ী রেহাই দেবেনা কারণ অভিজিতের উত্তরসূরী বর্তমান। নন্দার জীবনটাকে তছনছ করে ওরা তার দেওয়া শিশু পুত্রকে অভিজিতের ছায়া হিসেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করবে আর নন্দা অন্ধকারে শুধু তাঁর অতীতের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করবে।” সেই সংবাদ প্রতিবেদন।
           সন্ধ্যা ঘোষ ‘দৃষ্টি’তে প্রায় নিয়মিত গল্প লিখতেন, সেই মধ্যবিত্ত সাংসারিক প্রতিবেদন। এই ৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যাতে লিখেছেন ‘বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে ...’ লেখিকার না গল্পের কথকের বোঝা দায়-- বান্ধবী সোমা বোসের বিয়ে হয়েছিল কলকাতায়। ‘অর্থশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি অলক বোসে’র সঙ্গে। পণের দায়ে ওরা ওকে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। প্রতিবেশীর হাতে দিয়ে যাওয়া এক ডায়েরি হাতে আসে কথকের। তাতে তিনি জেনে যান কিসে কী হয়। এবং গল্পের শেষ হচ্ছে, “অফিসার এসে শ্বাশুড়ী, ননদ, স্বামীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলো। জানি না বিচারের রায় কি হবে। এরকম অসংখ্য সোমাদের বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে।” পরের ৪র্থ বর্ষ ১ম সংখ্যাতে সন্ধ্যা ঘোষের ‘লজ্জা’ যথারীতি বানিয়ে তোলা গল্প। ‘তিনসুকিয়া ষ্টেশন রোড আজ জনশূণ্য’ দিয়ে গল্পের শুরু হয়েছে , কিন্তু আজ বিশেষ কিছু ঘটে নি। শহরে মন্ত্রী এসছেন, তাই এই জনশূণ্যতা চারদিকে প্রহরা। এক পাগলি দ্রুত ছুটে যাওয়া মন্ত্রীর গাড়িগুলোর সামনে এসে চেঁচায় কিনা, “সব মিথ্যে!” অনেকটা পাগলা মেহের আলির স্টাইলে। ব্যাপার কী? না বছর দশেক আগে যেতে হবে। বিবাহিতা শান্তাদের গ্রামে গিয়ে ওদেরই বাড়িতে একবার রাত্রীবাস করেছিলেন এই মন্ত্রী! আসার সময় বলে এলেন, গ্রামের উন্নতির জন্যে এক লক্ষ টাকা মঞ্জুর করলেন। কিন্তু নিয়ে আসতে হবে গিয়ে শান্তা আর ওর স্বামী প্রণবকে। সুতরাং বাকি গ্রামের লোক রইল পড়ে, টাকা আনতে গেলে শান্তা আর ওর বর। কিন্তু আর ফেরার নাম করল না। বেশ কিছুদিন পর গ্রামের কিছু লোক শহরে গেল ওদের খবর করতে। মন্ত্রীও কিছু বলতে পারলেন না। তিনি দু’দিনের মধ্যে খুঁজে পেতে নির্দেশ দিলেন। এরই মধ্যে এরা পথের পাগলি বেশে শান্তাকে আবিষ্কার করল। প্রণবের কোন হদিশ পাওয়া গেল না। গ্রামবাসীরা ‘বিস্ময়ে হতবাক’ হলো মাত্র। গল্প ফুরিয়ে গেল, লেখিকার আক্ষেপে, “কে খবর রাখে তাদের।” এই গল্পের শুরুতেও কাল্লু বলে একটি চরিত্র হঠাৎ হাজির শুধু পাগলি কে এই জিজ্ঞেস করতে, “ কিরে তুই কাঁদছিস কেন?” সমরেন্দ্র দাস রায়ের ‘ঝড়ের পাখি’তে যেমন, স্ত্রী-সন্তানের অকারণ নামোল্লেখ এখানেও তেমনি।
         ১৪১০বাংলা তথা ২০০৩এ ‘দৃষ্টি’র নাম পালটে হচ্ছে ‘অপলক দৃষ্টি’ ।মনে হয়ে নিবন্ধীকরণের দায়ে। কিন্তু নিবন্ধীকরণ হয়েছিল এমন সংবাদ নেই। এই সংখ্যাতে সন্ধ্যা ঘোষ লিখেছেন ‘ধরিত্রীর কান্না’ গুয়াহাটির নেটওয়ার্ক বাস আস্থানে শিশু বর্ণালী হত্যাকাণ্ড সেসময় সারা রাজ্যে সংবাদ শিরোনাম দখল করেছিল। সেই প্রেক্ষাপটে লেখা গল্পটিও সংবাদ প্রতিবেদনের অথবা নীতিকথার উপরে উঠেনি।
         ৩য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা দৃষ্টিতে মৌ চন্দের গল্প ‘মরীচিকা’তে বিষয়টি অভিনব। মৃদুল বোস গরীব কৃষক। চার ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় রক্তিমকে অনেক কষ্টে পড়িয়ে ডাক্তার করেছিলেন। তাকে একদিন 'বিশ্ব জাতীয়তাবাদী মুক্তি' সংগঠনের লোকেরা নিয়ে যায় নিজেদের এক সহকর্মীর চিকিৎসা করাতে। ফিরে আসবার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে তাতে রক্তিম মারা যায়। ছেলের মৃতদেহ এরা সযত্নেই বাড়ি পৌঁছে দেয়, সঙ্গে বিশ হাজার টাকা এবং একটি চিঠি। চিঠিতে পড়ে আমাদের জানতে হয় ব্যাপারটি কী? কিন্তু চিঠি শেষ হয় ‘জয় হিন্দ’ দিয়ে। তার পরেও লেখিকার এদের উপরেই এতো উষ্মা কেন কিছু বোঝা গেলো না, “এই তরতাজা রক্ত, জীবন , যৌবন, তীক্ষ্ণ প্রতিভা এসব বলি না দিয়ে যদি শ্রমে বিশ্বাসী হয় বুঝে “ডিগনিটি অব লেবার” তবেই এই রক্তের হোলি খেলা বন্ধ হবে, দেশও দূষণ মুক্ত হবে।”
          ১৪১০বাংলা তথা ২০০৩এ ‘দৃষ্টি’তথা ‘অপলক দৃষ্টি’তে একটি খুব ভালো গল্প রয়েছে ভারত ঘোষের ‘খালপারের শেয়ালটা’ এক সন্ধ্যেবেলার শ্মশানের শবপোড়ানোর সময়টুকুর সাতজনে গ্রামের পুরুষের এবং মৃতা রানির জীবনের গল্প, সাড়ে পাঁচ পৃষ্ঠাতে শেষ। একে কেন সম্পাদক উপন্যাস বলে আলাদা করলেন এটি বোঝা দায়। কিন্তু এতে কথাশিল্প সম্পর্কে আমাদের ধারণার দারিদ্য বেশ বোঝা যায়। গল্পটি কিন্তু যাকে বলে ‘প্রথম শ্রেণি’র। মনে হয় না লেখক তিনসুকিয়া বা অসমের। হলে চেনা নাম হতো। তাই বাদ দিলাম। তেমনি বাদ দিলাম সুস্মিতা মজুমদারের ‘ওড়ার ইতিহাস’। এই সংখ্যাতে সুব্রত দাসের একটি গল্প রয়েছে। বরগোলাই এক বৌভাত খেতে গিয়ে ফেরার পথে যাত্রীদের নিয়ে বাস দুর্ঘটনার মুখে পড়ে । তাতে গল্প কথকের খুড়তুতো কচি শিশু বোন বাণ্টি মারা পড়ে। তারই প্রতিবেদনে পরিণত গল্প। (পৃঃ২০)
     
   উজানের কথাঃ ‘দৃষ্টি’ এখন আর বেরোয় না, ‘দৃষ্টি’র প্রায় সবাই এখন ‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’র সঙ্গে। গোষ্ঠীর কাগজ ‘উজান’ বেরুচ্ছে। সব সংখ্যা হাতে নেই। যেক’টি আছে তার মধ্যে ২০১২তে প্রকাশিত ৭ম সংখ্যাতে এতে গল্প আছে প্রায় আটটি। এই সংখ্যাই শুরুতে নেবার কারণ হলো এ অব্দি উজানে প্রকাশিত, সবচে’ ভালো গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে এতেই । লিখেছেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। তিনি মূলত নগাঁওর মানুষ। কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন ধরে এখানে থাকেন। গল্প লেখেন বেশ , কিন্তু ছাপেন কম। গল্পটির নাম ‘ওগো পরবাসী’। কার্বি আঙলঙের এক ছোট রেল ষ্টশনের কাছে ধনশিরি নদীর পাড়ে এসে বসতি গড়েছিলেন অনুলেখাদেবী এবং তাঁর স্বামী। দেশভাগ এবং দেশান্তরের পর। মিশ্রজনগোষ্ঠীর বসতি। সে বসতি এবং আশেপাশের ভূগোল, ইতিবৃত্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন লেখক। এ অব্দি আমরা দেখলাম যেখানে লেখকরা বহু কথা বলেও কোন কথা স্পষ্ট করতে পারেন না, সেখানে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর গদ্য কোথাও বা অদ্ভূৎ সুন্দর ব্যঞ্জনার বিচ্ছুরণ ছোটায়। এই যেমন, “ মধ্যঅসমের পাহাড়-সর্বস্ব কার্বি আংলং জেলার ক্ষুদ্র এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে তাই ডিমাপুর-ডিফু- লামডিং-ই হচ্ছে বহির্জগতের পরিচিত ঠাঁই। এর বাইরে প্রসারিত হতে পারে না এদের চিন্তাধারা।” সবার সঙ্গে মায় কার্বিদের সঙ্গেও ছিল ভাবভালোবাসা। সামসিং বলে ব্যক্তিটি স্বামীর অবর্তমানে সন্তান প্রসবের সময় নার্স ডেকে এনে বাঁচিয়ে ছিল অনুলেখাদেবীর জীবন। সেই বসতিতে এখন আবার অনাস্থা আর বিচ্ছেদে হাওয়া, উগ্রপন্থীদের করের বোঝা, এবং যখন তখন উচ্ছেদের আতঙ্ক। যারা তা ছড়াচ্ছে তার মধ্যে সেই সামসিঙের ছেলে বেও রয়েছে। এবং দীর্ঘজীবনের শেষে অনুলেখা দেবীকে আরো একবার পুত্র-পৌত্রাদির হাতে ধরে রাতের অন্ধকারে পথে নামতে হলো। পেছনে পরে রইল বাড়ি ঘর। “একদা ধানশিরির অনাবিল পরিবেশ তখন অমাবস্যার কালো অন্ধকারে কালিমা লিপ্ত হয়ে হয়তো মুখ লুকিয়ে রইল।” এমন এক হৃদয় মন নাড়িয়ে দেয়া বাক্যে এসে গল্প দাঁড়িয়ে পড়ে।
         আগের বছর ২০১১তে প্রকশিত ৬ষ্ঠ সংখ্যাতেও তাঁর লেখা গল্প ‘ এবার ফেরাও মোরে’ অন্যতম ভালো গল্প। ধলেশ্বরী নদী তীরে এক কল্পিত বর্ধিষ্ণু শহরের নাম সাগরপার। সেই শহরের বেশ বিস্তৃত বর্ণনা আছে। অদরকারে নয় । লক্ষাধিক লোকের বাস এই নগরের নাগরিক, যিনি প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসর নিয়েছেন, অন্য সব বিচারেই একজন আদর্শ মানুষ--- তাঁর মনের গহনে গভীরে বাসা করে থাকা বর্ণ আর লিঙ্গবিদ্বেষের স্বরূপ উন্মোচন করবেন তিনি গল্পে। বর্ণনা টান টান পড়া যায়, কোত্থাও প্রতিবেদন হয়ে উঠে না, বাহুল্য বলে মনে হয় না। নারায়ণ বাবুর, স্ত্রী সংগীতা দেবী, বড় মেয়ে প্রতিভা, আর ছেলে সংকেতকে নিয়ে পরিবার, এমনিতে ছোট পরিবার সুখি পরিবার। তারা বড় হতে হতে শহরে কলেজ গড়ে উঠেছে, সুতরাং সন্তান দুটিকে বাইরে পাঠাতে হয় নি, বাড়িতে থেকেই পড়েছে। কিন্তু খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা সবেতেই দিদির থেকে সংকেতের অগ্রাধিকার দেখে সংকেত মেনে নিতে পারে নি, দিদি আপত্তি করেনি কোনদিন। লেখক লিখছেন, “এ এক আশ্চর্য প্রহসন। বাংলার স্ত্রীজাতি সত্যিকার অর্থেই ঈশ্বরের এক ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। এরা স্বভাবগত ভাবেই বঞ্চিত হয়ে থাকতে ভালোবাসে আজন্ম...।” সেই প্রতিভা একদিন লুকিয়ে এক অসবর্ণ বিয়ে করে বাড়ি ছাড়ে। তাকে আর কিছুতেই ঘরে তোলেন নি নারায়ণ বাবু। আত্মীয় পরিজন কারো চাপেই না, বড় চাপ আসতে থাকে সংকেতের থেকে, সেই চাপেও হার মানেন নি। সেই ক্ষোভে ছেলেও ঘর ছাড়ে। গল্পের প্রথম ভাগ এই টুকু। দ্বিতীয় ভাগে বারো বছর পর একটি ফোন আসে। সংকেতের হয়ে কেউ একজন জানতে চায়, সংকেত বাড়ি ফিরবে,যদি দুটো প্রশ্নের উত্তর মেলে। এক, তিনি কি মেয়ে প্রতিভাকে ঘরে তুলেছেন? জবাব , না। সংকেত ও প্রবাসে এক অসবর্ণ বিয়ে করেছে, তিনি কি তাকে ঘরে তুলবেন? জবাব , হ্যা। ফোন থেমে যায়। নারায়ণ বাবু আর সংগীতা দেবীর শুরু হয় নতুন আশাতে বুক বাঁধা। ছেলে আসবে। কিন্তু কেউ আসেনা। বহুদিন পর, একটি আবেগ মাখা চিঠি আসে। বাবার প্রতি একটি যথার্থ সজ্জন ছেলে যতটা সম্মান জানাতে পারে সব জানিয়ে সংকেত লেখে সে বিয়ে থা কিছুই করে নি, “প্রসঙ্গত তোমায় জানিয়ে রাখি , আমি আদৌ বিয়ে থা করিনি। হয়তো তোমারই শিক্ষায় শিক্ষিত আমিও অন্তর থেকে তোমারই মতো জেদি ও একগুঁয়ে। তাই আমিও আমার অগ্রজার প্রতি এমন অন্যায়, এমন বৈষম্য এক কথায় সহ্য করতে পারব না। অপেক্ষা করব, আরোও অপেক্ষা করব আমি। প্রয়োজনে আরোও একাধিক যুগ, অন্তত যতদিন তুমি বেঁচে থাকবে...”। চিঠি শেষে স্বামি স্ত্রী দু’জনেই কাঁদছেন। “এ কান্না কি সংকেতের ফিরে না আসায়, নাকি জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়ার চিন্তায় –বোঝা গেল না।” বুঝিয়ে দেবার এতো বড় সুযোগ খুব কম লেখকই তখন ছাড়তে পারতেন, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী পেরেছেন বলেই তিনি বড় লেখক।
           আমরা ৭ম সংখ্যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেখানে তেমনি আরেকটি ভালো গল্পের লেখক উত্তম বসু। গল্পের নাম ‘জমিদার’। মধ্যবিত্ত বাড়িতে ঠিকে ঝি ময়নার মা। সবাই তাকে এই নামেই চেনে। কেউ আলাদা কোন নামের অস্তিত্ব কল্পনাও করে নি। তার প্রথম সন্তান ময়নার বয়স যখন ১০ বা ১২ দিন, তখনি নিজের বাড়িতে তাকে দেখেন গল্পের কথক, যিনি কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন, মাঝে মধ্যে বাড়ি আসেন। এসেই দেখেন দিব্বি ময়নার মায়ের সন্তানাদির সংখ্যা ‘ভগবানের দানে’ বেড়েই চলে, ময়নার পর উয়না, রয়না, হয়না ইত্যাদি। জন্মের দিন দুই পরেই ময়নার মা কাজে যোগ দেয়। বাচ্চারে এ বাড়িতেই খেলে দৌড়ে বড় হয়। এবাড়িতে তাদের স্বরাজ। কিন্তু বাড়ির বড় বৌ বিয়ে করে আসার পর থেকেই সেই স্বরাজ খর্ব হতে শুরু করে। ‘ময়নার মা তোমার ছোট মেয়ে পায়খানা করেছে, পরিষ্কার করো।’ ইত্যাদি হুকুম আসতে থাকে। বৌ পোয়াতি হতেই বাড়ির লোকের চিন্তার শেষ নেই। ডাক্তার হাসপাতাল ইত্যাদি কত ভাবনা। ময়নার মায়ের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এগুলো মেলাতে পারেন না কথক। শিশু সৌম্যের জন্মের পরেই বাকি বাচ্চারা সৌম্যের মায়ের থেকে শুনতে থাকে ‘যা ভাগ’ পাছে নিজের ছেলের গায়ে নোংরা লাগে। সেই ছেলে দু’বছরের জন্মদিনে ধুতি পাঞ্জাবী পরানো হয়েছে। হাতে তুলে দেয়া হয়েছে পুরি থেকে ওর জন্যে ঠাকুমার নিয়ে আসা একটা লাঠি। সেই পোষাকে বাড়িময় ঘুরতে গিয়ে সে যখন ময়নাদের মুখোমুখি হলো, জমিদারের মতো ছড়িটা তুলে বলে কিনা, যা –ভাগ! “ময়নারা কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল। তারা বসে পড়ল সৌম্যের পায়ের কাছে মাথা নিচু করে। সৌম্য তার তার প্রজাদের পেয়ে গেছে যা এতোক্ষণ ঘরের চারদিকে দৌড়েও পায়নি।” শৈশব থেকে বাড়ির ভেতরে শ্রেণি নির্মাণের এক নিটোল সুন্দর সুদক্ষ গল্প ‘জমিদার’।
           এই সংখ্যাতেই মানবরতন মুখোপাধ্যায়ের ‘হিরো’ গল্পটি বেশ সরস এবং সুগঠিত। তিনি লেখেন মূলত ছোটদের গল্প। এই গল্প বড়দেরই জন্যে। যদিও তিনসুকিয়াতে পেশাদার বাংলা নাট্যদলের বৃত্তান্ত, যার নায়িকাটিও বেশ ব্যস্ত ‘হিরোয়িন’, একটু বেশি গাঁজাখুরি বলে মনে হয়। কিন্তু নায়িকা যেভাবে নিজের গল্প বলে গেলেন তাতে এসবই হজম হয়। গল্পের কথকের সঙ্গে নায়িকার আলাপ তিনসুকিয়া থেকে মোহনোবাড়ির বাসে। ভদ্রমহিলা ততদিনে রীতিমত বিবাহিতা সংসারী । বাচ্চা রয়েছে কোলে। ভদ্রলোক বিয়ে না করে গায়ে হাওয়া লাগাচ্ছেন। ভদ্রলোক মোহনবাড়ি যাবেন শুনে মহিলা আলাপ শুরুই করলেন সেখানেই তাঁর জীবনের ‘হিরো’র সঙ্গে পরিচয় হবার কথা জানিয়ে। বাকিটা বলবার আগে কোলের বাচ্চা ধরিয়ে দিলেন ভদ্রলোককে , নিজে মুখে পুরে নিলেন পান। বললেন কিনা, তিনসুকিয়ার এক নাট্যদলে নাটক করে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতেন। বাড়িতে বিয়ের চাপটাও ইত্যাদি এলেও কানে তোলেন নি। মোহনবাড়িতে এক নাটকের শেষে হঠাৎই এক ভদ্রলোক এসে বলেন কিনা, “বাইরে আপনার দাদাকে বলে এসেছি যে আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।...আপনি মেক আপ উঠিয়ে সাধারণ কাপড়ে থাকুন , আমি পনেরো মিনিট পরে আসছি।” ভদ্রমহিলা থাকবেন কি অভিনয়ের জামাকাপড় পালটে দৌড়ে গিয়ে নিজেই ডাক দিলেন, “দাদা, জলদি আয়, আমাকে একজন দেখতে এসছে।” নায়িকার হঠাৎ এই মতি বদলের কারণ হলো, “এরকম এক বীরপুরুষ যে সোজা চোখ রেখে বলতে পারে বিয়ে করবে, তাকে বিয়ে করব না তো কাকে বিয়ে করব!?” মিনিট পনের পরেই নায়িকা জিজ্ঞেস করছে, “...আপনি আমার হিরো হবেন?” হিরো বলছে, “নাও আমি তোমার হিরো হলাম।” গল্পের উপস্থাপনাতে এতো মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন লেখক যে কিছুই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় না। এমনকি তিনসুকিয়াতে যার সঙ্গে আলাপ সেই ভদ্রলোক যখন মোহনবাড়িতে নেমে যাচ্ছেন বাস থেকে তার হাতে এলাচ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমিও ঝট করে বিয়ে করে ফেল না...।নাও আমার- তোমার মোহন বাড়ি এসে গেছে। সাবধানে যেও, দুগগা-দুগগা!” ভদ্রলোক আর কিছু বলেন নি, পাঠকেরও মুখ থেকে রা বেরোবেনা, এটি নিশ্চিত।
          এর আগে ২০১০এ প্রকাশিত ৫ম সংখ্যাতে প্রকাশিত গল্পটি কিন্তু সেরকম প্রত্যাশা পুরণ করতে পারেনি। এই সংখ্যাতে গল্প যদিও রয়েছে ছ’টি, উজান অসমের লেখক আসলে তিনিই। লিখেছেন ‘একটি হাসির(?) গল্প’। নামের মধ্যেই প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে। পাঠকের মনেও সেই চিহ্ন দাগ কেটে যায়। হ্যা, গল্পের ভেতরে গল্প বলবার একটি প্রয়াস ছিল বটে। কিন্তু কোনটিই ঠিক ভালো জমে উঠে নি।
           কমল ভট্টাচার্যের মূল নিবাস উত্তর বাংলা। তিনসুকিয়াতে বছর কয় ধরে কর্মসূত্রে থেকেছেন,এবং এখানে থেকেই মনে হয় গোটা অসমেই তাঁর একটা লেখক পরিচিতি গড়ে উঠেছে। এখানকার প্রায় দৈনিকেই এবং বেশ কিছু ছোট কাগজে তিনি নিয়মিত গল্প কবিতার লেখক হয়ে উঠেছেন। তাঁর ‘আলমারি’ গল্পটি এক ছোট পরিবারের ভাব ভালোবাসা সংকটের নিটোল গল্প। একটি আলমারি কেনা নিয়ে স্বামী স্ত্রী স্বদেশ-মালবিকা হিসেব মেলাতে পারেনা কিছুতেই। সন্তানাদি নেই দম্পতির । তাই মালবিকার সামান্য দামি আলমারির বায়নাকে স্বামী স্বদেশের সঙ্গে পাঠকেরও বেমানান কিছু ঠেকে না তেমন। অফিস থেকে বকেয়া কিছু পাবার ছিল। ছিল, কিন্তু ঠিক সময়ে অফিস বিকাশবাবুর বকেয়া আগে মিটিয়ে দিল কেননা, তাঁর মা অসুস্থ। চিকিৎসা করাতে হবে। স্বদেশ তা জানায় নি মালবিকাকে। কিন্তু যখন সে কথা জানল মালবিকা, পুরোনো আলমারিটাই সামান্য গুছিয়ে এতো জায়গা বের করে ফেলল যে নতুন আলমারির দরকারটাই আপাতত নেই হয়ে গেলো। গল্পের শেষে ক্লিনিকাল রিপোর্টে জানা গেলো যে মালবিকা গর্ভবতী। সেই কথা স্বদেশ তাকে জানালো এভাবে যে ‘এবার কোন বাহানা নয় আলমারি কিনতেই হবে।এটা শুনে কিছু না বলে এক অপার অচেনা আনন্দে মালবিকা কেঁদে ফেলল......”
         আগের বছরে ৬ষ্ট সংখ্যাতে কমল ভট্টাচার্যের ‘চিরকুট’ গল্পটিও এরকম সহজ সরল হালকা হাস্যরসের প্রেমের গল্প। কিন্তু সে একক পুরুষের, যে তুলি নামে এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারে নি। যেকোন কারণেই হোক কথক লাল্টুর মনে হচ্ছে তুলি তাকে এড়িয়ে চলছে। পথে দেখা হলে কথা বলছে না। যন্ত্রণাতে তার মনে হয়, “কবি জীবনানন্দের কথা—সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। তেমনি সবাই সুখী নয় , কেউ কেউ সুখী...।” তুলির বান্ধবী প্রেরণার কাছে গিয়ে জানা গেল, যে মেয়েটিকে দেখে লাল্টুর মনে হচ্ছে তুলি বলে, সে আসলে তুলির মতো দেখতে কিন্তু তুলি নয়। তুলি অনেক দিন কলকাতা গেছে চীনে ভাষা শিখতে । তুলি কাল, লাল্টুর জন্যে একটা ই-মেল পাঠিয়েছে। সেটির প্রিন্ট নিয়ে খামে ভরে প্রেরণা দিল। বুক ভরা আশা নিয়ে লাল্টু এলোতো বটে, কিন্তু চীনে ভাষাতে লেখা চিঠির পাঠোদ্ধার করা গেল না। এক চীনেকে ধরল বটে, কিন্তু সে হচ্ছে ফিল্টার উইলসের প্যাকেটে রাখা চারমিনার সিগারেটের মতো। বাংলা ভালো লিখতে পড়তে পারে, চীনা নয়। শুনল এক সেমিনারে চীনা পণ্ডিত আসবেন , তাঁকেই গিয়ে ধরবে ঠিক করল। কিন্তু ততক্ষণে ওর খুলে রাখা প্যাণ্ট ধুতে গিয়ে মা সেই কাগজটিও ধুয়ে ফেলেছেন। ধুয়ে এসে যখন কথাটা জানালেন, “শুনে লাল্টু আকাশ থেকে পড়ল, না আকাশ তার মাথায় ভেঙে পড়ল বোঝা গেল ন।” এখানেও বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর সেই গল্পের মতো লেখক কিছু বোঝাবার ভার নিলেন না, শুধু নীরবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দিলেন লাল্টুকে।
          উজানের প্রথম যে সংখ্যাটি হাতে আছে সেটি আগষ্ট , ২০০৬এ প্রকাশিত ২য় সংখ্যা। লিখেছেন, সবিতা দে , সবিতা দেব নাথ এবং শীলা মজুমদার। সবিতা দে ‘উজানে’র প্রায় নিয়মিত লেখিকা, কিন্ত হোজাই বাসিন্দা। সুতরাং তালিকা থেকে বাদ দিতে পারি। আগে যাদের কথা লেখা হলো, তাদের বাদ দিলে উজানের অন্যতম ভালো লেখিকা শীলা মজুমদার । এই সংখ্যাতে লিখেছেন ‘খোলস ছেড়ে’। খুড়তুতো বোন গল্প বলছে তার জেঠতুতো ছোড়দি বিল্টুর, যে মা-বাবার তৃতীয় কন্যা বলে তাকে ছেলে সন্তানের মতো বড় করেছিলেন তারা। সে ছেলেদের সঙ্গে খেলে, আড্ডা দেয় এমনকি বিড়িও টানে। মেয়েলি ব্যাপার তার একেবারেই পছন্দ নয়। বিয়ে থা সংসারের কথাতো হেসেই উড়িয়ে দেয়। সেই বিলটু একদিন বাড়ি ছেড়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। খবর নিয়ে জানা গেলো যে মিউজিক ক্লাবের বন্ধু বিকাশ ভৌমিকও বেপাত্তা। সেই বিল্টু বাড়ি আসছে বলে খবর দিয়েছে তাই দিয়ে গল্পের শুরু আর বাড়ি এসে ঢুকছেতে শেষ। তার সামনে বর বিকাশ, কোলে শিশু পরণে ঢাকাই শাড়ি না হলেও সেলোয়ার কামিজ। তার আগের চেহারার সঙ্গে একেবারেই মেলানো যাচ্ছে না।
            তাঁর ২০০৭র ৩য় সংখ্যাতে প্রকাশিত গল্পটিও ভালো। নাম ‘আলোয় ফেরা’ ।এমন গল্প বাংলাতে লেখা হয়েছে প্রচুর। তবু লেখিকার মুন্সিয়ানাকে তারিফ করতেই হয়। নিতাই দাস এবং সাধনা দাসের গরিবের সংসারে ছবি আর রাজু দুই ভাই বোন। ছবি নবম শ্রেণিতে পড়ে। তার একদিন মৃগী রোগ হলো। কিন্তু কোনো চিকিৎসা হলো না। প্রতিবেশি পিসিমার চাপে গুনিন এলো। এসে বলে কিনা ভৈরবী ভর করেছে। ফলে যা হয়, বাড়ি একখানা তীর্থ হয়ে উঠল। লেখা পড়া লাটে উঠল। ছবির শ্বাসরুদ্ধ হবার জোগাড়। এক ক্লাস উপরে পড়ে তপন-- সেই শুধু ছবির সত্য বোঝে। ছবি তার কাছে আকুতি জানায় মুক্তির । সুতরাং একদিন দেখা গেল ছবি নিখোঁজ। রাজু অনেক খোঁজাখুজি করে রাতে এসে জানালো তপনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর বাবা বলেছে বাড়ি ফিরলে পিঠের ছাল তুলে দেবে। মা কান্নাকাটি জুড়েছে। সেই শুনে ছবির মাও, “কপালে করাঘাত করতে করতে শোবার ঘরে ঢোকে দরজায় খিল দিয়ে দিল” লেখিকার পরিমিতি বোধটি পাকা।
         একই সংখ্যাতে জয়ন্ত দে’র গল্প ‘অভাগী’ অসীমের বাড়ির আদরে লালিত কাজের মেয়ের গল্প। যে হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যায়। কোনো সাকিন রেখে না যাওয়া মেয়েকে যেভাবে খোঁজে বের করে অসীম সে এক ছোটখাটো গোয়েন্দা গল্পের স্বাদ দেয়। কিন্তু মেয়ে তখন মৃতা। যে ছেলেটিকে ভালো বেসে ঘর ছেড়েছিল, সে যখন জানল জবা অসীমের মেয়ে নয়, তার থেকে পণ পাবার আশা বিশেষ নেই--- গায়ে কেরোসিন ঢেলে মেরে ফেলে। বিয়ের আগে কেন প্রেমিক প্রবরটি মেয়ের সত্য পরিচয় জানলনা এমন প্রশ্ন উঁকি দেয় বটে কিন্তু অসীমের গোয়েন্দাগিরির তলায় চাপা পড়ে যায় সেই প্রশ্ন।
        ২০০৯এ প্রকাশিত ৪র্থ সংখ্যাতে চিত্ত দেবের ‘সমাধী তীরে’তে ভালো গল্পের সমস্ত রসদই ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মায়ান্মার থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসা এক বাঙালি বাবুর গল্প। গল্পটি তিনি করছেন অতি বৃদ্ধাবস্থাতে পাড়ার বৃদ্ধদের আড্ডাতে। দ্বিতীয় সংসার নিয়ে সুখী গৃহস্থ তিনি, গল্প করছেন তাঁর প্রথম সংসার নিয়ে। মায়ান্মারে ওখানকারই একটি মেয়ে তাঁর প্রেমে পড়েছিল, সন্তানও হয়েছিল একটি কিন্তু বিয়ে থা করেন নি। এতে অবশ্যি অন্যায় কিছু নেই। কেননা, ওদেশের সমাজে এগুলো চলে। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের সেই চাঁটগেয়ে ছেলেটির মতো তিনি ঠকিয়ে আসবেন বলেও তাদের ছেড়ে আসেন নি। একদিন কাজে বেরিয়েছেন, যুদ্ধের ডামাডোলে সেদিন বিকেলেই তাঁকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করল সেনাবাহিনি। এর পরে আর তিনি ফিরে যেতে পারেন নি। কিন্তু সেই নিয়ে যে কোনো আক্ষেপ বা অনুসুচনা রয়েছে তাঁর মনে গল্প পড়ে মনে হয় না, বেশ রসিয়ে সেই প্রথম প্রণয়িনীর সঙ্গে শরীরী প্রেমের বর্ণনা শোনাচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল লেখকও তাই শোনাবেন বলেই কলম ধরেছিলেন।অথচ পাঠক মনে বিপরীত এক প্রত্যাশা গড়ে উঠে যা পুরণে লেখকের কোনো প্রয়াস ছিল বলে মনে হয় না। সেখানেই গল্পটি সমস্ত সম্ভাবনা নিয়েও নষ্ট হয়ে যায়। এতেই বোঝা যায়, এখানকার অধিকাংশ লেখকের কাছেই কাহিনি ফেনিয়ে তোলার নামই গল্প। ভাব-উপস্থাপনা এবং আবেগানুভূতির সুসমঞ্জস রূপের কাছে কাহিনি বস্তুটিও যে আলাদা করে গৌণ হয়ে যেতে পারে সে ভাবনাও অনেকের নেই।
         ২০০৬এর ২য় সংখ্যার অন্য লেখিকা সবিতা দেবনাথ। তাঁর গল্প ‘ধুলায় ধুসরিত হীরা’তে কাহিনি একটি আছে। কিন্তু সেই, প্রতিবেদনের উপরে উঠেনি। ভাষাটিও বড় ‘কেতাবি নির্মাণ’ বলে ধরা পড়ে যায়। নজিরঃ “ আসামী সলজ্জ সপ্রতিভ ভঙ্গীতে অধোবদনে দণ্ডায়মানা থাকার কিছুক্ষণ পর তাদের আদেশক্রমে আসন গ্রহণ পূর্বক প্রতিপক্ষের জবাবে নীচুস্বরে নিজের নাম-পরিচয় প্রদান করে উকিলের জেরার মুখে একরকম নিশ্চুপ বসে রইল।” আসামী-আদালতের নয় গল্পটি বিয়ের পাত্রী দেখা এবং সেই নিয়ে বিড়ম্বনার। কথক মহিলার বান্ধবীকে যে পাত্রপক্ষ আভিজাত্যের জন্যে প্রত্যাখ্যান করল তারই প্রতিবেশি হয়ে আসতে হয়েছিল কথক মহিলাকে নিজের বিয়ের পর। সেই পাত্রের বিয়ে হলো বটে কলকাতার আরো বনেদী এক কন্যের সঙ্গে । সে একবছরের মধ্যেই সেই পাত্রটিকে বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিস ধরিয়ে দিল। শেষ নীতিবাক্যটি লেখিকা আগে থেকেই ভেবে নিয়েছিলেন বোঝা যায়, “ গোলটা কোথায় জানি না তবে সংঘাত যে দুই পরিবারের প্রতিপত্তির তা বলাই বাহুল্য।”
          ২০০৭এর ৩য় সংখ্যাতে এই লেখিকার ‘জীবন খাতার শেষ পৃষ্ঠা’ গল্প নয় কোনভাবেই। হাড় কিপ্টে সুপ্রিয়বাবুর কিপ্টেমির জ্বালায় না তাঁর স্ত্রীর শরীরের ব্যামো পালায়, না ছেলেমেয়ের লেখা পড়া এগোয় না মেয়ের বিয়ে হয় সেসবের বিবরণ মাত্র।
         সমরেন্দ্র দাস রায় উজানেও নিয়মিত লেখেন। ২০০৭এর ৩য় সংখ্যার ‘স্বপ্নের সমাধি’ গল্পটি দেশভাগের শিকার মানুষের দেশান্তরণ এবং বিপর্যয়ের বাস্তবানুগ চিত্র তুলে ধরেছে। কুশিয়ারকুল এম ই স্কুলের প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত যেভাবে তুলে ধরেছেন তাতে ব্যক্তিগত স্মৃতিকাহিনির মতো মনে হয়। কিন্তু প্রায় তিন প্রজন্মের গল্প এত দ্রুত তুলে ধরেছেন যে গল্প হয়ে উঠবার অবসর পায় নি। অন্নদা দিদির বাড়িতে আশ্রিত অজিত কৃষ্ণের ছেলে আশিস তাঁর নাতির মতো। লেখাপড়া শিখে ‘মানুষ’ হয়েছে। একবার দেশের বাড়ি ফিরে অন্নদা দিদির কথাতে বকুলকে বিয়ে করবে বলে রাজি হয়ে গেছে। কিন্তু দিল্লী পড়তে গিয়ে মেডিকেল সহপাঠিদের পাল্লায় নেশা ধরল এবং যথারীতি কালে মারা গেল । বকুলের প্রেম তাঁকে না পারল নেশা না মৃত্যুর থেকে বাঁচাতে। লেখক ‘কোথা প্রেম অনুপম মধু গুঞ্জরণ...’ইত্যাদি অনেক কবিতা পংক্তি তুলে বকুলের সঙ্গে পাঠককে দিয়েও হাহাকার করাতে চাইলেও পাঠক মনে সেই বোধ জাগে বলে মনে হয় না। সেরকম কোন ফাঁকই বাকি রাখেন নি।
          ২০০৯এর ৪র্থ সংখ্যাতে এই লেখকের গল্পের নাম ‘ এতো সুখ, এতো দুঃখ, এতো নির্যাতন’। নামের মতোই গল্পের প্রেক্ষাপট যথারীতি দীর্ঘ। জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি। আসল গল্প কিন্তু অত্যন্ত ছোট। সুখের সংসারে লেখাপড়া শিখে মানুষ, মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের চাকরি পাওয়া ছেলে যখন বিয়ে করল পরিবারের চেহারা পালটে গেল। বনেদী বাড়ির থেকে আসা নতুন বৌএর উৎপাতে প্রথমে বরের দিদি এবং পরে বর আত্মহত্যা করল। উচ্চাকাঙ্খা, বিষয় বাসনাগুলোকে মহিমান্বিত করতে করতে লেখক একটি মেয়েকে যখন খলনায়িকা করছেন, তখন এটি মোটেও মনে রাখেন নি যে তাকেও প্ররোচিত করছে সেই সমস্ত মহিমান্বিত অপগুণগুলোই।
        
 প্রতীতির কথাঃ ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে’র তিনসুকিয়া শাখার মুখপত্র ‘প্রতীতি’ তিনসুকিয়ার সবচে’ দীর্ঘজীবি কাগজ আগেই লিখেছি। কিন্তু দুঃখজনক ভাবেই এটা সত্য যে এঁদের কোন সম্পাদকীয় স্থির পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। বছরে একটি বেরোয়, যখন সময় হয়। পুজো বা নববর্ষে। আমাদের হাতে চারটি সংখ্যা আছে। ১৪০৭ এবং ০৯এর সংখ্যাদুটি মহালয়া সংখ্যা, ১৪১৩ এবং ১৯এর সংখ্যা দু’টি নববর্ষ। এমনও হতে পারে যে আগে পুজোতে বেরুতো, এখন নববর্ষে বেরোয়। প্রতিটির সম্পাদক আলাদা। ফলে স্থির সম্পাদকীয় পরিকল্পনা নেয়া এমনিতেই মুস্কিল। লেখাগুলো যে ক্রমে আসত, সেই ক্রমেই ছাপা হতো বা হয়। কোনো পরিকল্পিত বিষয় চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। ১৪০৯এ কোন গল্প পাই নি। ১৪০৭ এবং ১৪১৩ সংখ্যাতে শুক্লা সরকারের দু’টো গল্প পাচ্ছি। ‘নীল সন্ধ্যায়’ এবং ‘মা বাবা ভাই বোন’। দুটো গল্পেরই পাঠোদ্ধার করা বড় কঠিন। অজস্র পারিবারিক চরিত্র ক্রমাগত এসে ভিড় করছে। কে যে ঠিক কী করছে, আর কেন করছে বোঝা মুস্কিল। এমন নয় যে গল্প দুটি খুব প্রতীকী কিছু। তবু প্রচুর ফাঁক ফোকর জোড়া লাগে না। আন্দাজ করা যায়, বড় পরিবারের ভাঙ্গন আর স্মৃতিচারণের বা পুণর্মিলনের গল্প লিখতে চেয়েছেন লেখিকা। ভাষাও বেশ সবল, একটূ গোছালো এবং আত্মবিশ্বাসী হলেই ভালো লিখতে পারতেন বলে মনে হয়। যেমন “টি টি টি! পাখি ডাকছে। অজান্তে একদিন মুখ থেকে ডাক বেরল চিরা! চিরা। কি অদ্ভূৎ নাম! নিজেই উত্তর বের করে আনলেন—হৃদয় চিরানো। সত্যিইতো , কত যুগ কত বৎসরের চেনা এই ডাক-অনুভূতি মাখানো স্মৃতির পর্দায় পাখিটার নীরব আনাগোনা সময়াতীত যেন।...” (নীল সন্ধ্যায়) ।
            ১৪১৯এর সংখ্যাটিতে বেশ সম্পাদকীয় যত্নের ছাপ আছে মনে হয়।অন্তত ভারতের জাতীয় সঙ্গীত, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের শতবর্ষ এবং বিবেকানন্দের দেড় শতবর্ষের কথা মনে রেখে লেখা সাজিয়েছেন। গল্প আছে কয়েকটি , কিন্তু তিনসুকিয়ার লেখক কমল ভট্টাচার্য। ছোট্ট গল্প। ‘বাসষ্ট্যাণ্ড’ । প্রেক্ষাপট কিন্তু শিয়ালদা বাসষ্ট্যাণ্ড। সুদীপ্ত বলে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে অর্পিতা বলে একটি মেয়ে এসে আলাপ জমালো যেন কতকালের চেনা। কিন্তু সুদীপ্ত মনেই করতে পারল না, এই নিয়ে মস্করা করতেও ছাড়ল না সপ্রতিভ মেয়েটি। আপনি থেকে তুমি তে নেমে এসে বলল, ‘চল, কোথাও একটু বসি...।” সুদীপ্ত মানা করলে মেয়েটিও ছাড়বার পাত্রী নয়। হাত ধরে টানাটানি করতেই যাচ্ছিল। ঝটকা দিয়ে সুদীপ্ত সরে গেলে বলল, “এলেই পারতেন, এই লাইনে আমি প্রথম...” হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কিন্তু সুদীপ্ত বাসে উঠে পালায়।
    
     বলাকার কথাঃ ডিগবয় থেকে প্রকাশিত ‘বলাকার বর্ষবরণে’র ১৪১৬, ১৭ এবং ১৯শের তিনটি তথা ১ম,২য় এবং ৪র্থ সংখ্যা রয়েছে আমাদের হাতে। দুটি গল্প আছে তার মধ্যে একটির লেখক খেলু মজুমদার, অন্যটি অজিত করের অনুবাদে ধীরেন্দ্রনাথ বরুয়ার অসমিয়া গল্প।
         খেলু মজুমদারের ‘কুশলের কথা’ সুনিপুন হাসির গল্প। কুশল গল্প কথকের ছেলে বেলার সহপাঠি। অনেকদিন পরে দেশবাড়ি ফিরেছে, এখন সে প্রবাসে মস্ত বড় অফিসার। এসেই গল্প কথকের ফোন নম্বর বের করে জানিয়েছে দেখা করতে বাড়ি আসবে। কিন্তু মুস্কিল হলো কুশলের কোন কথারই কোনদিন ঠিক থাকত না। উলটো পালটা একটা কিছু সে ঘটাবেই। নিজে পালাবে কিন্তু সঙ্গে থাকবে যারা তাদের নির্বিকার বিড়ম্বনাতে ফেলেই দেবে। এরই বেশ কিছু বিবরণ কথক হাজির করলেন স্মৃতি থেকে । তার একটি এরকম, প্রতিবার পুজোর ছুটি শুরুর দিনে স্কুলে নাটক হতো। একবার সেরকম এক নাটক হবে কিন্তু কুশলকে কোন পার্ট দেয়া হলো না। দিলেই বিপদ । সে চেপে ধরল তাকে নাটকে নিতেই হবে। শিক্ষকের কথাতে দেয়া হলো। একটি সংলাপের ছোট্ট এক ভূমিকা প্রহরীর। তাকে বলতে হবে “সাবধান, হুঁশিয়ার, মহাবীর অর্জুন প্রস্তুত সম্মুখ সমরে!” কিন্তু সময় মতো সে অর্জুনের পরের শব্দটি কিছুতেই মনে করতে পারল না। মনে করবার চেষ্টা করে আবার কথাটার পুনরুক্তি ঘটালো। গল্পের কথক ছিলেন সেই নাটকে প্রম্পটার। পেছন থেকে বললেন, ‘বুর্বক ভালো করে বল।” কুশল সেটি শুনে সংলাপ চালালো, “সাবধান , হুশিয়ার, বুর্বক অর্জুন ভালো করে বল...।” এর পরে কিছুদিন দিব্বি সে স্কুল পালিয়ে বেড়ালো। যখন এলো , সবাই জিজ্ঞেস করলে জানালো শিমুলগুড়ি গেছিল মাকে নিয়ে বেড়াতে। এখন অফিসার কুশল পালটে গেছে বলেই বিশ্বাস করেছিলেন কথক। কিন্তু হলো না, তাঁর বাড়িতে আসবার বদলে সে কথকের প্রতিবেশির বাড়ি এসে দিব্বি দিল্লি থেকে আনা এক প্যাকেট মিষ্টি দিয়ে চলে গেল। তাও সেই প্যাকেটে মিষ্টি নয়, ছিল মুরগির ডিম। কথক সে ডিমের গল্প জেনেছিলেন পরদিন যখন প্রতিবেশি বৌদি এসে তাদের বাড়িতে এই রহস্যময় ঘটনার কথা জানাচ্ছিলেন।
          দ্বিতীয় সংখ্যাতে সূচীপত্রে আছে দুটো গল্পের কথা খেলু মজুমদারের ‘পাত্রের সন্ধানে’ আর মানব রতন মুখোপাধ্যায়ের ‘একটি ছোট দুঃখের গল্প”। কিন্তু খেলু মজুমদার স্বয়ং জানাচ্ছেন এটি তাঁর লেখা এক অসমিয়া নাটকের আংশিক অনুবাদ। আর মানবরতন শিরোনামের নিচে লিখে দিয়েছেন ‘স্মৃতিকথা’। ওদিকে এই স্মৃতিকথা তাঁর গল্প সংকলন ‘নিঃশব্দে’তেও সংকলিত হয়েছে। বস্তুতই এটি স্মৃতিকথার উপরে উঠতে পারে নি।
                ৪র্থ সংখ্যাতে লেখা মানবরতন মুখোপাধ্যায়ের গল্প, ‘ছোট লোকের খপ্পরে’। রতন বাবু কবিতা লেখেন। গেছিলেন এক সকালবেলা অজিত বাবুর বাড়িতে নতুন লেখা কবিতা পড়িয়ে হয়েছে কিনা জেনে নিতে। পাশে বসে পড়ছিল অজিতবাবুর নাতি অন্তু। অজিত বাবু সামান্য উঠে যেতেই নাতি দুষ্টুমী শুরু করল। রতন বাবু অভিবাবকত্ব ফলাতে গিয়ে বেজায় মুস্কিলে পড়লেন। সে রতনবাবুকে উঠে যেতে মানা করে গল্প শোনাবার বায়না ধরল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন সে কি একা একা বসে থাকতে ভয় পায়? সে বললে , “হ্যা।” “এতো বড়লোক হয়ে ভয় পাও কেন?” অন্তু বলে কিনা, কে বললে সে বড় লোক? সে আর আর তার অন্য ভাইরা রুপাই, বুড়োরা বয়সে ছোট । তাই ছোটলোক। দাদু তার রতনবাবুর হাতের লেখা নিয়েও সামান্য অনুযোগ জানিয়েছিলেন এই নিয়েও সে হাসাহাসি করল। অজিত বাবু ফিরে এসে কবিতাটা সামান্য ঠিক ঠাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন , নাম কি দেবে কবিতার। রতন বাবু জানালেন ‘ছোটলোক’ ।
            ২য় সংখ্যাতে স্বপ্না মজুমদারের ‘সত্যবাদী মিথ্যেবাদী’ ছোট হাল্কা মজার গল্প। বাড়ির ছোট ছেলে তপু বড্ড দুষ্ট আর দুষ্টামী লুকোতে মিথ্যে বলে। একদিন বিরক্ত মা তাকে দিয়ে ঠাকুরের সামনে দিব্যি করালেন, যেন যা বলে সব সত্য বলে। তাই হলো, এবারে তপু এমন সব সত্য বলে ফেলতে শুরু করল যে বড়দের দুষ্টামীগুলোও ওর নজরে পড়লেই সামনে চলে আসতে শুরু করল। ফলে সবাই মিলে আবার মাকে চেপে ধরল, “ মা, ঠাকুরকে বলো, তপু যেন আবার আগের মতোই থাকে।” এবারে মা কেন এও আবদার রাখতে যাবেন কারণ তার কাছেতো সব সন্তানই সমান, এমন প্রশ্ন লেখিকাকে ভাবায় নি বিশেষ।
           ৪র্থ সংখ্যাতেই অর্পিতা বিশ্বাসের ‘উপহার’ হাল্কা চালের ভাইবোনের পারিবারিক ভালোবাসার গল্প। দাদার আদরে বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পরের এক জন্মদিন। দাদা ভুল না করে ফোন করবে, জিজ্ঞেস করবে কী চাই? সে ভাবছিল কী চাইবে? বিয়ের আগের জীবনটাতো পালটে গেছে। একটা নীল মলাটের ডায়রি ছিল তার। দাদা ফোন করতে জিজ্ঞেস করল, সেই ডায়রিটি আছে কি? ডায়রি সঙ্গে সোনালি এক কলম, সঙ্গে আরো অনেক উপহার। সে উপহার গুলো পাশে রেখা সেই ডায়রি খুলে অনেকদিন পর কিছু লিখতে শুরু করে। সেরকম উল্লেখ করবার মতো কোন গল্প ‘বলাকার বর্ষবরণে’ পাওয়া গেল না। খেলু মজুমদারের ওই ‘কুশলের কথা’ ছাড়া। কবিতাই বেশি প্রকাশ পায় বলে মনে হয়। যদিও এর সম্পাদনা রুচিকে আমাদের মনে হয়েছে ‘ঈশানে’র পরেই স্থান দিতে হবে। নম্রতা এবং ভাষা শুদ্ধি নজরে পড়ে।
          উত্তরণের কথাঃ উত্তরণের চারটি সংখ্যা আমাদের হাতে পড়েছে, আশ্বিন- ১৪১০, অগ্রহায়ন-১৪১৩, ফাল্গুন ১৪১৬ এবং ফাল্গুন ১৪১৮। মাঝের কয়টি আমাদের হাতে নেই। এর প্রথম দুটি আকারে চটি, গল্প নেই। তৃতীয়টিতে খেলু মজুমদার লিখেছেন ‘বাঁকা স্রোত’, শীলা বিশ্বাসের ‘কা তব কান্তা’ , মানব রতন মুখোপাধ্যায়ের ‘অবলা’, এবং অর্পিতা বিশ্বাসের ‘সেতু। এর মধ্যে শীলা বিশ্বাসের নামের পাশে দার্জিলিঙ লেখা আছে, আমরা সেটি হিসেব থেকে বাদ দিতে পারি। গল্পটিও আহামরি কিছু নয়।
            খেলু মজুমদারের ‘বাঁকা স্রোত’ একাধারে ব্যক্তি এবং দুই ভিন্ন ভাষিক সম্প্রদায়ের প্রেম অপ্রেমের গল্প। বাপ মরা নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারের ছেলে তাপস। বাড়ি ডিব্রুগড়। সংসার মা টানেন। বাড়িতে ছোট ভাই বোন আছে। সবাই এরা স্কুলে কলেজে পড়ে, ট্যুশন করে , পরের জামা সেলাই করে এ ও দুটো পয়সা ঘরে আনে। এরই মধ্যে তাপসের ভাব নন্দিনীর সঙ্গে । নন্দিনী মেয়েটি অসমিয়া। ওদের বাড়ির অন্য কেউ বাঙালি কাউকে পছন্দ করে না, কারণটি খুব ঠুনকো। নন্দিনীর খুড়ো এক বাঙালি মেয়েকে ভালোবাসতেন, কিন্তু সে পরে এক বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করে সরে পড়ে। তাপস বেশ অহংকার নিয়েই বলল সে এমন করবে না, এটা দেখিয়ে দেবে। কিন্তু পাড়াতুতো মেসো যখন এসে জানালেন কোন এক অপিসে পাঁচহাজারি মাইনেতে চাকরি হচ্ছে তাপসের, সঙ্গে বড়বাবুর মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব। প্রথম প্রথম দ্বিধান্বিত হলেও মা-ভাই-বোনের মুখ চেয়ে রাজি হয়ে গেল। কেননা সংসারটিকে টেনে তুলবার দায় তার। কথাটা গিয়ে নন্দিনীকে জানালে যা হবার তাই হলো। সপ্তাহখানিক পরে এসে আবার মেসো জানালেন, বড়বাবুর মেয়েটি কারো সঙ্গে পালিয়ে গেছে, সুতরাং চাকরিটি পাকা কিন্তু বিয়েটা না করলেও হচ্ছে। এখন তাপস করে কি? সে স্থির করল, “হ্যা, সে আবার যাবে নন্দিনীর কাছে। একবার নয়, প্রয়োজন হলে বারবার যাবে।” কতটা কী দাঁড়াবে পাঠকের মনে সংশয় থেকেই যায়। এক সপ্তাহ যে মতি স্থির রাখতে পারে নি, সে যাবে বারবার!
           ১৪১৮র ১৯শ সংখ্যাতে খেলু মজুমদারের ‘হঠাৎ একদিন’ গল্পটি ভালো। অন্তত এখন অব্দি যেগুলোর কথা বললাম, তার মধ্যেতো বটেই। বিষয় কিছু নয়—কথায় আর কাজে দ্বিচারিতা। কিন্তু গল্পটি হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সাহিত্যের অধ্যাপক অজিতেশ ডিফু থেকে এসছিলেন উজানের এক চা-বাগানে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বক্তা হয়ে। অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, কবির থেকে আমরা শিক্ষা পাই সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর, ...সমস্ত গোঁড়ামী আর কুসংস্কার জয় করার। পরদিন যখন ফেরার পথে রেল স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন একটি ছেলে এসে আলাপ করে সেই বক্তৃতার প্রশংসা করল। কিন্তু জিজ্ঞেস করল, এগুলো কি তিনি বলবার জন্যেই বললেন, না মন থেকে। এমন অদ্ভুৎ প্রশ্নের কারণ জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তার মা বলেন, ভাষণে এমন বড় কথা অনেকেই বলেন, কাজে পরিণত করা খুবই কঠিন। কথায় কথায় ছেলেটি জানালো তার মা অজিতেশকে চেনেন। মায়ের নাম যখন জানালো রেজিনা—অজিতেশ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ছেলেটি আসছে বলে টিকিট কাটতে চলে গেল। অজিতেশ মনে মনে চলে গেলেন ডিব্রুগড়ে রেজিনার কালে। তাঁর যৌবনের প্রণয়িনী। বাবা এক আধটু আপত্তি করলেই শেষমেশ পাশে দাঁড়িয়ে গেছিলেন, কিন্তু মায়ের চাপে একদিন চোখে জল নিয়ে এসেই অজিতেশ রেজিনাকে জানিয়েছিলেন, ভুলে যাবার প্রস্তাব। মায়ের কথা ছিল, তাতে ছোট বোনের বিয়েতেও অসুবিধে হবে। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে প্রায় মৃত্যুর মুখে পড়ে যাচ্ছিলেন। সুতরাং দুই প্রেমের দ্বন্দ্ব বেঁধেছিল। মা না প্রেয়সী—রাখবেন কাকে। খানিক পরে ছেলেটি আবার বিদেয় নিতে এলো, যাবে লিডু। সেখানে ব্যবসা করে। অজিতেশ দেখলেন তাঁর হাতে বাঁধানো শ্রীকৃষ্ণের ছবি। কার জন্যে জিজ্ঞেস করে জানলেন, তার স্ত্রী গৌরীর জন্যে। সে বিয়েতেও অন্য সবাই তার বিরুদ্ধে ছিলেন, পাশে ছিলেন শুধু মা। একটিও অতিকথন নেই গল্পে। নিটোল গঠন। সেদিক থেকে বেশ প্রশংসাই করতে হয়। বিশেষ করে যে উজানের অধিকাংশ গল্পই মূলত পারিবারিক ইতিকথা। খেলু মজুমদারকে দেখা যাচ্ছে পরিবার, প্রেমের বাইরেও প্রতিবেশী দুই সমাজের প্রেম-দ্বন্দ্বের সমস্যা ভাবায়। ‘বাঁকাস্রোত’ গল্পটি স্মরণ করুন। কিন্তু মনে কি হয় না, এগুলো পূর্বনির্ধারিত সূত্রাশ্রয়ী গল্প? রেজিনার ছেলেটিতো বেশ দুটো কথা বলে চলে গেলো। কিন্তু যদি এমন হতো, তার মা হতেন অন্য কেউ আর আপত্তি জানিয়ে বিছানা নিতেন? দু’টো গল্পই আসলে পরিবার এবং সমাজের দ্বন্দ্বের গল্প, অথবা মা এবং প্রণয়িনীপ্রেমে দ্বন্দ্বের গল্প। ট্রাজেডিগুলো সেই পুরুষ চরিত্রের। যে দ্বন্দ্বের দ্বারা চালিত হয় ক্ষতবিক্ষত হয় না বিশেষ। বাইরের ধাক্কা এসে যেন প্রতিশোধ নেয়। বুঝিবা মাতৃপ্রেমের উচিত ছিল পরাজয়ের। অথচ সেই প্রেমকে বিজয়ী করেও মায়ের রক্ষণশীলতাকে পরাজিত করাই যেতো গল্পে। কিন্তু লড়বে টা কে?  মেয়েরাই বা আর প্রতিরোধ করল কৈ? তারাওতো যন্ত্রের মতো ভবিতব্যকে মেনে নিল যেন। যে জটিল লড়াইর মধ্যি দিয়ে অজিতেশ বা তাপসকে যেতে হতো —সেই সম্ভাবনাগুলো নিয়ে আসলে লেখক নিজেও ভাবেন নি বিশেষ।যেমন অজিতেশ ভাবেন নি ভাষণ দিতে গিয়ে, ঠিক কী বলছেন তিনি। ভাবলে গল্পদুটো অন্য এক মাত্রা পেতো। ‘আধুনিকতা-অনাধুনিকতা’র দ্বৈরথের বাইরে বেরিয়ে যেতো। যেমন বেরিয়ে গেছে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর ‘এবার ফিরাও মোরে।’
              ফাল্গুন ১৪১৬ সংখ্যাতে মানবরতনের গল্পটিতেও নতুন কিছু নেই। উৎপেতে তিনবোন আর শ্বশুর শাশুড়ির সংসারে বিয়ে করে এসে সে বাড়ির নতুন বৌ অবলা কী করে সবার জায়গা চিনিয়ে দিল তার গল্প। যারা বৌকে পা-টেপা দাসি করে রাখবে বলে ঠিক করেছিল তারা সবাই অবলার শাসনে মানুষ হয়ে গেল। মায় শ্বশুর অব্দি ভোরে উঠে বৌএর দেয়া চা খেয়ে পথে পায়চারি করতে বেরুতে বাধ্য হলেন। বেশি বেলা অব্দি ঘুমোবার সাধ টিকল না। উপভোগ করা যায়, বাড়তি মজা হচ্ছে এই গল্পের চরিত্রগুলোর নাম, বরের নাম পশু, শাশুড়ি পাখি, ননদেরা সব ময়না, টিয়া , পায়রা—আক্ষরিক অর্থেই চিড়িয়াখানা।
            ১৪১৮র ১৯শ সংখ্যাতে মানবরতনের ‘সেকাল-একাল ‘ বেশ দীর্ঘ হাসির গল্প। গল্পটি বেশ সুখপাঠ্য। বিকল্পনাম একটি আছে ‘সমুদ্রমন্থন।’ গল্পের ভেতরে গল্প আছে এতে। দ্বারকা, প্রয়াগ আর বৃন্দাবন তিন গাঁজাখোর। তা দ্বারকার হঠাৎ মতি হলো গাঁজা খাওয়া ছেড়ে দেবার। কেননা, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে শুতে গিয়ে এক রাতে স্বপ্নে দেখেছে এক সাধু এসে তাকে পরামর্শ দিচ্ছে গাঁজা খাওয়া ছেড়ে ধর্মগ্রন্থ পড়তে। এতে বুঝি গাঁজার থেকেও নেশা বেশি। তা বাকি দুই বন্ধু বলল, ওরাতো পড়তে জানে না, ওদের কী হবে? সে আশ্বস্ত করল, সে ওদের পড়ে শোনাবে। সুতরাং শুরু হলো নতুন নেশা। ধর্মগ্রন্থ পড়া। সেদিন পড়ছিল মহাভারতের সমুদ্রমন্থন। সমুদ্রমন্থনের চেনা সব ঘটনাই আছে । কিন্তু সে ঐ তিন গাঁজাখোর যেমন বললে বুঝতে এবং পড়তে পারে সেরকম। পড়ে যা উপলব্ধি হলো যে এরকম, “হ্যাঁ, গুরু । তখন এখনের মত চুকলিবাজিও ছিল। তা না হলে শিব-দুর্গার শান্তির সংসারে নারদ চুকলিবাজি করে কি ভাবে অশান্তি ডেকে আনল! প্রয়াগ বলল। --হ্যা, , রাগ-ক্রোধও ছিল। তা না হলে দুর্বাসা মুনি দুর্বাসা মুনি ইন্দ্রের উপর এত রাগ করলেন যে দুনিয়াকে হতলক্ষী করে ছাড়লেন। বৃন্দাবন বলল।–লোভ ছিলরে, তা না হলে মন্থন করে শুধু অমৃত আর হরিপ্রিয়াকে উঠিয়ে নিলেই কাজ মিটে যেত। দ্বারকা বলল, তা না করে ধন-দৌলত, হাতি-ঘোড়া যা পেয়েছে তাই উঠিয়ে নিয়েছে। --তা হলে তখনের সেই ঠাকুর দেবতার যুগ আর এখনের এই মানুষের যুগের কী পার্থক্য থাকল? প্রয়াগ জিজ্ঞাসা করল। --তাইতো দেখি। সব তো দেখি একই। বৃন্দাবন বলল।–একাল আর সেকাল, সব কাল একই। দ্বারকা বই বন্ধ করতে করতে বলল।”
        ‘বলাকা’তে প্রকাশিত গল্প ‘উপহারে’র মতোই,উত্তরণের ফাল্গুন ১৪১৬ সংখ্যাতে ‘সেতু’ও অর্পিতা বিশ্বাসের জন্মদিনের এবং মধ্যবিত্ত গৃহিনীর নিঃসঙ্গতার গল্প। সামান্য কাঠামো বদল ছাড়া নতুন কিছু নেই। ১৪১৮র ১৯শ সংখ্যাতে অর্পিতা বিশ্বাসের ‘রং বদলায়’ মাসিবোনঝির ভাব ভালোবাসার গল্প। বোনঝির ছেলেবেলা থেকেই মসির সঙ্গে দারুণ ভাব। নিজের জেঠতুতো দিদির বিয়েতে তাই বারে বারে মাসিকে ফোনে ডেকে নিয়ে গেছে বোনঝি মানি। ডেকেছে মানে, কাছেই মাসির মায়ের বাড়ি মানে বোনঝির মামার বাড়ি। সেখানে গেছিলেন মাসি তাই ডাকে সাড়া দিলেন। মাসি গেলেন । অনেক দিন পর বোনঝিকে সামনে থেকে দেখলেন। বিয়ে বাড়ির ঘটনাক্রমে মাসি বোনঝিকে আর তেমন কাছাকাছি পেলেন না। বুঝলেন দিনের রং পাল্টেছে, এখন তার বোনঝি বড় হয়েছে। এর বেশি কিছু নেই গল্পে।
               ‘পথিকৃৎ’এর কথাঃ ‘নতুন সাহিত্য পরিষদে’র মুখপত্র মদন মোহন চৌধুরী ও অজিত কর সম্পাদিত দ্বিভাষিক পত্রিকা ‘পথিকৃতে’র দুটো সংখ্যা রয়েছে, ডিসেম্বর, ২০০৮ এবং ২০১১। অজিত কর সেরকম লেখক যিনি নিয়মিত লিখলে বাংলা সাহিত্য সম্পদ পরিমাণে বাড়তে পারত। কিন্তু লেখেন কালে ভদ্রে, চাপে পড়ে। ছোট্ট এক গল্প লিখেছেন ‘রক্তের দাগ’ । ২০০৮এর ২৬শে সেপ্টেম্বরে মুম্বাইতে সন্ত্রাসবাদী হামলাকে প্রেক্ষাপটে রেখে। তিনসুকিয়া বরডুবির মুম্বাই প্রবাসী পরিবার নন্দিতা-অনিন্দ্য এবং তাদের বছর তিনেকের মেয়ে তিনুর গল্প। বাড়িতে বিধবা মা আর ছোটভাই অরুণাভ। অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয় না, ওদিকে মায়ের ঘনঘন তাগাদা নাতিনিকে দেখতে চান। তাই বাড়ি ফেরার আনন্দে ছোটখাটো ব্যবসায়ী পরিবারটি রেলে চেপেছে। ভিড় প্ল্যাটফর্ম। পাঁচ বছর মুম্বাই শহরে থেকেও নন্দিতার অচিন দেশের ভয় কাটে নি। রেল স্টেশনেও অনিন্দ্যকে কাছ থেকে সরতে দিচ্ছিল না। ‘...নন্দিতার এই ভয়টুকু সে উপভোগ করে।’ মেয়েকে জিজ্ঞেস করে ঠাম্মার জন্যে কী নিয়ে যাবে? মেয়ের উত্তর চিপ্স। এই চিপ্স কিনতে গিয়েই আর ফেরা হয় নি অনিন্দ্যের। মুহূর্তে ষ্টেশন চত্ত্বর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। নন্দিতা পাগলের মতো মৃত মানুষের ভিড়ে খুঁজতে থাকে অনিন্দ্যকে। না পেয়ে মেয়ের হাত ধরে বাইরে যেখানে ছোটছোট দোকানের সারি সেখানে এসে দেখে ‘অনিন্দ্যের বুক ফুটো হয়ে লাল তাজা রক্ত বেরিয়ে আসছে’ হাতে তখনো ধরা আছে একটা চিপসের প্যাকেট। মেয়ে “তিনু ভয়ে কাঁপছে, সব কিছু বুঝে উঠতে পারে নি। অনিন্দ্যের দিকে তাকিয়ে বলল-‘বাবা , প্যাকেটটার গায়ে এতো রক্ত কেন?’ ” পরিমিতি বোধের ব্যঞ্জনা এই বোধ অব্দি পৌঁছে দেয় নিশ্চয়--এতো শুধু প্যাকেট নয়, গোটা পরিবার, বাড়িতে পথ চেয়ে থাকা বিধবা মা, গোটা স্টেশন তথা দেশের গায়ে রক্তের দাগ। কিন্তু যে দ্রুতিতে গল্প এগুচ্ছিল, তাতে এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি, এতো বড় স্টেশনে সামান্য এক চিপ্সের প্যাকেট খুঁজতে গিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল কেন অনিন্দ্যকে?
           ‘পথিকৃৎ’এর পরের সংখ্যাতেও একটিই বাংলা গল্প , সেই অজিত করের। নাম ‘সন্তান’। এ পর্যন্ত যে গল্পগুলোর কথা আমরা লিখে এলাম এই গল্প তার থেকে আলাদা এবং এই একটি গল্পের জন্যে তাঁকে উজানের অন্যতম সেরা গল্পের লেখক বলতে ইচ্ছে করে। কেন ব্যাপারটি খুলে বলি। আমরা অনেকগুলো হাসির গল্পের কথা লিখেছি, মোটের উপরেরগুলো চেনা ধাঁচে লেখা, যেখানেই লেখক ধাচের বাইরে বেরিয়েছেন সেখানেই আর রস বাঁচিয়ে এগোতে পারেন নি, যেমন মানবরতনের ‘একটি হাসির(?) গল্প”, কিম্বা খেলু মজুমদারের ‘বাঁকাস্রোতে’র তাপসের শেষের প্রতিশ্রুতি কোন বিশ্বাস জাগায় না। সমরেন্দ্র রায় বা এমন অনেকে জীবনের হতাশার গল্প বলেছেন এবং যে মূল্যবোধগুলো গল্পের ভেতর থেকে পাঠক চেতনাকে নাড়িয়ে দেবার কথা ছিল, সেগুলো তাঁরা বাইরে থেকে আরোপ করতে গিয়ে সব মাটি করেছেন, গল্পকার হয়ে উঠেছেন নীতিবেত্তা। বিদ্যুৎ চক্রবর্তী সেদিক থেকে পাকা লেখক বটে। তার উপর তাঁকেই দেখি অসমের সমাজের বিশেষ করে বাঙালির মৌলিক একটি রাজনৈতিক প্রশ্নকে গল্পে তুলে আনতে সাহসী হয়েছেন। কিন্তু এই সবগুলোই কোননা কোনভাবে সমাজের সমালোচনা মাত্র। অজিত করের থেকেও এটাই আশা করা যেতো,এমনতেও তিনি একটি বিশেষ বামপন্থী দলের সাহিত্য শাখা নতুন সাহিত্য পরিষদের সদস্য। এই সংগঠনের মুখপত্রেই আমরা গল্প দুটো পড়লাম। কিন্তু গল্পদুটোর সুর আশ্চর্যরকমে অন্যরকম। সংক্ষেপে বলি, কেন? সেই যে ব্রিটিশ বিদ্যালয় পরিদর্শক এবং অধ্যাপক, অবশ্যি কবি এবং সমালোচক বলেই বিখ্যাত, ম্যাথু আর্নল্ড ইংরেজিতে বলে বসলেন, কবিতা হচ্ছে 'criticism of life' ----কথাটা কার আমরা না জেনে খুব উদ্ধৃতি দিয়ে গেলাম। বিশেষ করে বিশশতকে যখন ইংরেজি স্লোগান' Art for life Shake' কথাটা খুব জনপ্রিয় হচ্ছে তখন ভিক্টোরীয় যুগের এই সমালোচকের উক্তিটি খুব হিট। খুব কষে সামাজিক অসঙ্গতির সমালোচনা করে উঠতে না পারলে আমরা ঠিক সাহিত্য হয়ে উঠল বলে মনে করিনা। দু'লাইন লিখতে বসেই কেউ কেউ বেশ নীতিবাগিশও হয়ে পড়েন। ভাবখানা এই যেন সমাজকে 'মানুষ' করেই ছাড়বেন। অথবা সমাজতন্ত্র এনেই ছাড়বেন। এই যেমন ‘মুহূর্তে’ প্রকাশিত অঞ্জন মজুমদারের গল্পে। সেরকম লিখতে পারলেই মোটামোটি হয়ে যেত ‘জনগণের জন্যে সাহিত্য’। জনগণের আদৌ কোনো সাহিত্য বোধ বাড়ল কিনা সেই নিয়ে কেউ ভাবতেন না। অজিত করের থেকে সেরকম গল্প আশা করাই যেতে পারে। পেলে যে মন্দ কিছু হতো বলছি না। 'পথিকৃৎ' কাগজটিও সাহিত্য পরিষদেরই মুখপত্র। কিন্তু আমার মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু কথা। 'জীবন মানে সংগ্রাম' এই তত্বের তিনি বিরোধিতা করতেন। শিল্প এবং জীবন মাত্রেই তাঁর কাছে 'লীলা' মাত্র। তাঁর সাহিত্য চিন্তাকেও বলা যেতে পারে 'লীলাবাদী সাহিত্য তত্ব' অনেকে বলেনও। কেন, লীলা কেন? কারণ সংগ্রামেই জীবনের শেষ নয়, সংগ্রামটা লোকে করে কিছু অর্জনের জন্যে। সেই অর্জনকে বাদ দিয়ে জীবনের কোন মানে হয় না। পূর্ণতা পায় না। সাহিত্য সেই পূর্ণতার কথা বলে। তাই দেখবেন, তাঁর রথের রশিতেও এতো এত বিপ্লবের পরেও এক 'কবি' এসে সব হিসেব গোলমেলে করে দেন। অজিত কর রবীন্দ্রনাথের লীলাবাদী সাহিত্যতত্ব মানবেন কিনা জানিনা, তাছাড়া আমার বলবার মানেও এই নয় যে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য করবার কোন নির্দেশিকা সূত্র দিয়ে গেছেন। তবু অজিত করের গল্পটি জীবনের সমালোচনাতে শেষ হয় নি। সব অলিগলি পেরিয়ে মানবিক ভালোবাসাগুলো যেন নিজের পথটা ঠিক বের করেই নেয় তাঁর গল্পে। আমরা মোটেও নিছক 'নরনারী'র ভালোবাসার কথা বলছি না, সে নিশ্চয় ধরেই ফেলেছেন আপনারা। যাকে আপনি খুব ঘৃণা করতে চাইবেন, তিনি তাঁরই হৃদয়ের গভীরে ভালোবাসার বীজ পুতে, কেমন সে ডানাডালপালা মেলছে তার রহস্য দেখাবেন আপনাকে। অন্তত ‘সন্তান’ গল্পেতো তাই করলেন। এমন কি মুম্বাই বোমা বিস্ফোরণকে বিষয় করে গল্প 'রক্তের দাগে'ও শেষে আপনার মনে হবে, আহা! নাতনি তার দেশের বাড়িতে ঠাম্মার জন্যে চিপ্স নিয়ে যাবে, সেটিতে রক্তের দাগ? কারণ, এই পারিবারিক ভালোবাসার কথাই গল্পে ওজনে ভারি। সন্ত্রাসবাদটা যেন হঠাৎ পথের দুর্ঘটনা। একটা কিছু করতে হবে , কিন্তু সে ওই ভালোবাসাকে বাঁচিতে দিতে!
          সুবল-বাদল দুই ভাই।মা- বাবা মারা গেছেন খুব ছোট বেলা। দাদা সুবলই বাদলকে কোলে কাঁখে বড় করেছে।বৌদিকে সে ভালোবাসত মায়ের মতো। কিন্তু বৌ ময়না তাদের সঙ্গে বাদলকে ভাগ করতে চাইল না। তাকে পেয়ে বসল ঈর্ষাতে। বাবার তৈরি তিরিশ বছর আগেকার বাড়িটা ঠিকঠাক করবার সাধ্যি ছিল না, এদ্দিন। এখন যদিও বা বাদল কাজটা করতে পারে,বৌ ময়না আপত্তি জানিয়ে রেখেছে। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই সে চুলো আলাদা করতে বাধ্য হয়েছে। এমন রূপকের ব্যবহার উজানের গল্পে তেমন সুলভ নয় “ময়না গরীবের ঘরের মেয়ে—অভাবের টানাপোড়নে তার জীবনের গাথুনি সহজে নড়বড়ে হয়ে ওঠার কথা নয়, কিন্তু অভাবের ফাঁসটা আলগা হয়ে উঠলে, মানুষ যেমন হাতপা ছড়িয়ে বসতে চায়, ময়নাও এখন একটা পাকাবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের মানুষের সঙ্গে হাল্কা কথায় সময় কাটাতে চায়। কিন্তু তার সেই স্বপ্নটাকে কাঁকড়া বিছেরমতো চিমটি কেটে এগোনের সব পথ বন্ধ করে দিচ্ছে তার ভাসুর সুবলের সংসার। অনেকবার বাদলকে বলেছে, ‘ঘরটা ভেঙ্গে ইট গাথুনিতে ঘর তোল।’” বাদল এই নিয়ে দাদার সঙ্গে কথা বলে নেবার কথা বললে ময়না তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। কথানেই বার্তা নেই বড় জালের সঙ্গে এই নিয়ে দুটো ঝগড়া সে গায়ে পড়েই করে আসে। “হয়তো তখন দিদির বড় বা মেজো ছেলেটাকে চেপে ধরে রৌদ্রে বসে সারা গায়ে তেল মেখে দেয় আর বকবক করে। মাঝে মাঝে দিদিকে ডেকে এনে দু’চার কথা শুনিয়ে দুটো পদ কিছু খেতেও দেয়।” সেই ভাসুরের ছোট নবজাতক ছেলেকে নিয়েও জালকে একদিন শুনিয়ে দিয়েছিল দুটো কথা। এতো বয়সেও সন্তানের সখ কেন? তার নিজের কিন্তু ব্যথা একটা আছেই, সন্তানাদি হবে না বলে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে। সেই জানে বলেই দিদি বলে, “ও ময়না, ভাবিস না, একটু বড় হলে তোকে দিয়ে দেব।” সেই শিশু কঠিন রোগে পড়ে। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে ফুসফুসে একটা ফুটো আছে। অপারেশনে সারবে কিন্তু অনেক টাকা লাগবে। দাদা বিধায়ককে গিয়ে ধরলে আশ্বাস একটা পেল কিন্তু তাতে সময় লাগবে। শেষে সুবল এসে বাদলের প্রায় পায়ে ধরল, ওর ভাগের জমিটা যেন সে কিনে নেয়, ছেলেটাকে বাঁচায় যেন। বাদলও টাকার ব্যবস্থা করছিল না তা নয়, কিন্তু এমন প্রস্তাবের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। দুই ভাইতে কথা হচ্ছিল তখন চোখে জল নিয়ে বেরিয়ে এসে ময়না জিজ্ঞেস করে, “কত টাকা লাগবে দাদা!” দাদা যখন অনেক টাকার কথা বললেন, তার পালটা জবাব, “আমাদের ছেলে হলে কি তা খরচা করতাম না?” বৌয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বাদল আশ্বস্ত করে “...ছেলেটা বাঁচবে, ভয় পেও না।”
             
     বাকি কথাঃ এখান কার লেখকেরা এখানেই লেখেন তেমনতো নয়। দৈনিক কাগজেও লেখেন, বাইরের অনেক ছোট কাগজেও লেখেন। যেগুলো সংগ্রহ করা বাস্তবিকই কঠিন। তেমনি উল্টোটাও আছে, অনেকে বাইরে চলে গেছেন এবং সেখানে থেকে লিখে চলেছেন। যেমন শীলা মজুমদারের কথা লিখছিলাম তমনি রয়েছেন মন্দিরা নন্দি কর। বিয়ের সুত্রে তিনি এখন হোজাই নিবাসী। এবং নিজেদের কাগজ ‘অবগাহনে’ নিত্য লেখেন। তেমনি কিছু লেখা আমাদের হাতে এসছে।
             খেলু মজুমদারের গল্পগুলো যেন ঘুরে ফিরে কিছু বাঁধা বৃত্তে ঘোরাফেরা করে। সেই মধ্যবিত্ত নরনারীর প্রেম মিলন কিম্বা বিচ্ছেদ বিরহ এবং অনুশোচনার গল্প। বিচ্ছেদের কারণগুলো হিসেবে তিনি সামাজিক সংঘাতগুলোকে স্পর্শ করেন, কোথাও বিত্ত, কোথাও বা জাতধর্ম নিয়ে পারিবারিক চাপ। নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুর থেকে প্রকাশিত ‘পূর্বাদ্রি’ কাগজের ১৪১২ সনের শারদ সংকলনে তাঁর গল্প ‘ধূষর পৃথিবী’ সেরকমই এক গল্প। অনেক কাল পরে ডিব্রুগড়ে বিচ্ছিন্ন নবনীতা নীলাদ্রির দেখা শিলঙ শহরে। নীলাদ্রি সেখানে হাসপাতালে চোখের ডাক্তার । বিয়ের বয়সী ছেলের মা নবনীতা সেখানে গেছে চোখ দেখাতে। বহুদিন পর দু’জনে হঠাৎ দেখা। পুরোনো প্রসঙ্গ। নবনীতার দিক থেকে ভুল ভাঙ্গা এবং তখন আর কিছু করবার না থাকা ইত্যাদি। গল্পের বিষয়। ১৪১৪ বাংলার একই কাগজের শারদ সংকলনের গল্প ‘ দরজা খোলার সময়’এর বিষয়ও সেরকমই। আগে আমরা তাঁর ‘বাঁকা স্রোত’গল্পের কথা লিখেছি। ওখানে মেয়েটি অসমিয়া, ছেলেটি বাঙালি। এখানে মেয়েটি শ্রীলা বাঙালি, ছেলেটি বরুণ অসমিয়া । বাকি গল্পের আদলে খুব তফাৎ নেই।এখানেও দু’জনের আলাপ বই বিনিময় দিয়ে। স্থানটি শুধু ডিব্রুগড়ের বদলে গুয়াহাটি। তবে কিনা, ‘জেলা লাইব্রেরি’, গুয়াহাটি গ্রন্থমেলা, নবকান্ত বড়ুয়ার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ঐতিহাসিক সুজিৎচৌধুরীর নামোল্লেখ থেকে শুরু করে গল্পটিকে এক বাস্তব প্রেক্ষাপটে দাঁড় করাবার প্রয়াস আছে।দুই গল্পেই অসমিয়া পরিবারটির বাঙালি সম্পর্কে অবিশ্বাস রয়েছে। প্রথমটিতে কারণ হলো নন্দিনীর খুড়োকে প্রেমে প্রবঞ্চনা করেছিল এক বাঙালি মেয়ে। কিন্তু এখানে কারণটি আরো বেশি সামাজিক তথা রাজনৈতিক।বরুণের বিবাহিত দাদা অরুণ নগাঁওয়ের কাছে ভাতৃঘাতী দাঙ্গাতে বাঙালিদের হাতে মারা যায়।সেই থেকে বাড়িতে কেউ বাঙালি দেখতে পারে না। শ্রীলার পরিবারও অসম আন্দলনের আগে গোরেশ্বরে দাঙ্গাতে আক্রান্ত হয়েছিল।তারও দাদাকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল।কিন্তু তাঁর প্রতিটি গল্পে মেয়েদের বেশ প্রত্যয়ী এবং দৃঢ়চেতা দেখা যায়। এই গল্পেও শ্রীলা সোজা গিয়ে হাজির হয় বরুণের বাড়িতে। বরুণ এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না।শ্রীলা সেই বৌদির সঙ্গেও দেখা করতে চায় যার ব্যথার শরিক হতে এ বাড়িতে বাঙালির প্রবেশ নিষেধ। শেষে সেই বৌদি নিজেই তাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে যায়। এই দাঙ্গাগুলোর প্রসঙ্গে এই গল্পে অসমের ইতিহাস অসমিয়া বাঙালির সম্পর্কে বেশ খানিকটাই টেনে এক ঐতিহাসিক বিস্তার দিয়েছেন লেখক। সেদিক থেকে এটি ব্যতিক্রমী গল্প।
          ‘পূর্বাদ্রির’ ১৪১৮ সনের শারদ সংখ্যাতে মানবরতন মুখোপাধ্যায়ের গল্প রয়েছে ‘জ্বালা’। মানবরতনের গল্প। হাস্যরসে ভরে তোলেন তিনি গল্প। চরিত্রগুলোর নাম নিয়ে মজা করাও তাঁর গল্পের এক বিশেষ ধরণ। এবং সম্ভব হলে প্রায় গল্পই হয়ে উঠবে নীতিকথা। এটিও ব্যতিক্রম নয়। গল্পের মেয়েটির নাম উজ্জ্বলা, নিন্দুকেরা বুঝি আড়ালে ডাকে ‘জ্বালা’।
       ‘পূর্বাদ্রি’ র ১৪১২ সনের শারদ সংকলনে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর একটি গল্প পাচ্ছি ‘কমলি’। এই কাগজে তিনি নিয়মিত লেখেন এটা আঁচ করা যাচ্ছে সেই সংখ্যাতেই প্রকাশিত খেলু মজুমদারের একটি চিঠির থেকে। শহরের বাজারে এক বোমা বিস্ফোরণে বিচ্ছিন্ন বাবা এবং মেয়ের অনেক বছর পরে আবার মিলন এবং বিচ্ছেদের গল্প। নিতান্ত কাহিনি উপস্থিত করেন নি লেখক, বেশ মুন্সিয়ানাতে গল্প সৃজন করেছেন। কিছুই বোঝা যায় না ঠিক কিসের খোঁজে যাটোর্ধ এক ভদ্রলোক এসে হাজির হন একটি আধা শহরে। যেখানে তিরিশ বছর আগে তিনি এসছিলেন বা ছিলেন এটা বোঝা যাচ্ছে। অচেনা লোকের আথিত্য নেবেন এটা জানাচ্ছেন। নিলেন এক দরিদ্র ঠেলা চালক নিতাই দাসের বাড়িতে । যে থাকে শহর থেকে খানিক দূরে এক বসতির সীমান্তে। সঙ্গে তার মেয়ে কমলি। মেয়ে ধরে নিল, ইনি তাদের বাড়িতে কদিন থাকবেন, গ্রাম জীবন নিয়ে কিছু লিখবেন। মেয়েকে নিরক্ষর করে রাখেনি নিতাই। মেয়ে লেখালেখির মর্ম বোঝে। সেই ঘর সামলায়, আর অবসরে কথককে পাড়া বেড়িয়ে দেখায়। গল্পে গল্পে একদিন নিতাই জানায় তার স্ত্রীর গর্ভে অনেক চিকিৎসা, অনেক মানতের পরেও সন্তান আসে নি। কমলি কে এক বোমা বিস্ফোরণে পাওয়া। বাবা-মেয়ে সওয়ারি নিয়ে যাচ্ছিল বাজার রোডের দিকে। বাবা মেয়েকে তার জিম্মাতে রেখে গেছিলেন কিছু একটা কিনে আনতে। তখনি বিস্ফোরণ। কার্ফু। পুলিশের মার। কমলিকে নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হয় নিতাই নিজের বাড়িতে। তখন তার বয়স চার। গল্প শুনতে শুনতে কথকে চোখে জল। এই বাবার নতুন বাবার থেকে মেয়েকে সে নিয়ে যেতে চায়নি। নীরবে চলে গেছিল আতিথ্য ছেড়ে। পড়ে মনে হয় একটি অমানবিক বিস্ফোরণ রক্তপাত ঘটায়, রক্তের সম্পর্ককে ছিন্ন করে আরেকটি সম্পর্ককে গড়ে তোলে যার ভিত্তিটা কেবলই মানবিক। শুধু একটি ত্রুটির কথা লক্ষ্য না করলে নজরে পড়ে না। কথক তিরিশ বছর পরে আসে সেই স্মৃতির শহরে। নিতাই দাস গান করে ‘হরি দিনতো গেল সন্ধ্যা হলো...।’ মেয়ে যখন জিজ্ঞেস করে হঠাৎ এ গান কেন, বাবা বলে তিরিশ বছর আগে যদি হয় সকাল এখন তবে সন্ধ্যে বটে। তার মানে কমলির বয়স হওয়া উচিত চৌত্রিশ। রীতিমত আই বুড়ি। যৌবন যায় যায়, যার বিয়ে সংসার নিয়ে বাবার উদ্বেগ থাকার কথা ছিল। সেরকম কিছু গল্পে নেই। পড়ে মনে হয় কমলি নিতান্তই কিশোরী কন্যা। বেশি বয়স নয় ওর। তিরিশ সংখ্যাটিকে ছেড়ে দিলে গল্পটি অনবদ্য। অনেকটাই যেন সেই অজিত করের ‘রক্তের দাগ’ গল্পের উত্তর কথন।
         হোজাইর ‘অবগাহনে’ প্রকাশিত মন্দিরা নন্দী করের লেখা ‘কানাইলাল’ সেরকমই এক মানবিক সম্পর্কের গল্প। তিনশ টাকা মাইনেতে কানাইলাল এক চায়ের দোকানে কাজ করে, মালিক যেমন তেমন বাবাটি আরো ভালোমানুষ। ওর প্রাপ্য মাইনের একটিও টাকা ওর হাতে তুলে না দিয়ে মাস ফুরোতেই এসে নিয়ে যায়। সামান্য এ টুপি কিনবার আব্দার করতে বাবা জবাব দেয়, “এ্যাঁ, লাটসাহেবি! ভাইবোনেরা ঘরে না খেয়ে মরছে, আর তুমি টুপি মাথায় বাবুগিরি ফলাবে!” একেবারেই মিথ্যে অপবাদ। মা-ভাই বোনের প্রতি ওর দরদ বাবার চাইতে সামান্য বেশি বৈ কম নয়। কারণ একবার পৌষপার্বণে বাড়ি গেলে ফেরার পথে যখন ছোট্ট বোন একটি পুতুলের বায়না ধরল ফিরে এসে একটি দিনের জন্যেও সে তা ভোলে নি। পাশের অফিসগুলোতে চা দিত সে। বাবুদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয় গেছিল ভালোই। কেউ গালি গালাজ করত, কেউ ঠাট্টা মস্করা , তো অনেকে ভালোই বাসত। অনেকেই তাকে ‘ছোকরা’ বা ‘পোয়ালি’ বলে এই নিয়ে তার আক্ষেপের কথা মাকে বলেছিল বাড়ি গিয়ে। আবার এক বাবু তাকে বকশিশে পাওয়া বাড়তি টাকাগুলো জমিয়ে রাখবার বুদ্ধি দিলেন। তিনি জিম্মা নিলেন, এক দু’টাকা পেলেই তাঁর কাছে জমা দিত সে। সেই বাবু হঠাৎ একদিন বদলি হয়ে গেলেন। সে একদিন অফিসে এসে জানল হঠাৎই । আগেরদিনও কিছু জানান নি তিনি। হতাশাতে ভেঙ্গে পড়েছিল সে। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে কান্নাতে ভেসে যাবার উপায় নেই। রাতে দোকান বন্ধ করবার আগে মালিক বলেন, তিনি ভুলেই গেছেন ‘মজুমদার স্যার’ কানাইর জন্যে একটি খাম দিয়ে গেছিলেন। সে ভাবল চিঠি বুঝি। পড়বে কী করে! খুলে দেখে দুটো কড়কড়ে একশ টাকার নোট। যা জমেছিল, তার থেকে পরিমাণে বেশি। “খামটা সে তার বুকে লেপ্টে ধরে। আবেগে আবার তার চোখ জলে ভরে উঠে।
         অনেক লেখকই গল্পের সংকলন করেছেন উজান অসমে। তার মধ্যে ঊর্ধ্বেন্দু দাসও রয়েছেন। আমরা সেগুলোর প্রায় কোনটাই সংগ্রহ করতে পারিনি। হাতে পেয়েছি মাত্র তিনটি । মানবরতন মুখার্জীর ‘নিঃশব্দে’, খেলু মজুমদারের ‘কৃষ্ণচূড়ার ফুল’ এবং অর্পিতা বিশ্বাসের অতি সাম্প্রতিক ‘রাত শেষের আলো’। মানব রতনের ‘বরযাত্রী’ এবং খেলু মজুমদারের ‘ব্রহ্মপুত্র , তুমি সাক্ষী’ নামে আগে প্রকাশিত আরো দুটি সংকলনের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে ভূমিকাতেই। তিনটি গল্প সংকলনে চোখ বুলোলেই বোঝা যাবে যে গুটি কয় বাংলা দৈনিক ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বেরোয় সেই অধুনা লুপ্ত ‘সময় প্রবাহ’ , এখনকার ‘যুগশঙ্খ’ , ‘সকাল বেলা’ ইত্যাদি কাগজ এখানকার লেখক গড়ে তুলতে বেশ একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। এবং ছোট কাগজের থেকে এই দৈনিকগুলোতে লেখা প্রকাশ পাওয়াটাকে লেখকেরা বেশ শ্লাঘার সঙ্গে উল্লেখ করছেন ভূমিকাতে নতুবা লেখার সঙ্গে। বোঝাই যায় ছোট কাগজে যদিও এঁরা লেখেন বা সম্পাদনাও করেন, তাকে ভিত্তি করে এক নির্দিষ্ট ভাবনাবীজকে কেন্দ্র করে রীতিমতো এক ভাবান্দোলন গড়ে তোলার যে প্রবৃত্তি অন্যত্র দেখা যায়, এখানে তা তেমন সবল নয়। এঁদের কাগজগুলোও আসলে নিজেদের এবং চেনা লেখকদের লেখার সংকলন মাত্র হয়ে থাকে । যেমন সাধারণত হয়ে থাকে দৈনিক কাগজে। অসমে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের প্রচারে প্রসারে দৈনিক কাগজের সমস্ত সদর্থক ভূমিকার কথা স্মরণে রেখেও এই কথাকে কী করে অস্বীকার করা যাবে যে দৈনিক কাগজের সাহিত্যের পাতার থাকে মাপা পরিসর। সেই পরিসর তাকে যে করেই হোক, ভরাতে হয়, অথবা উপচে পড়লে ছেটে ভার কমাতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই কাগজের জন্যে সাহিত্য ছাপা হয়, সেখানে সাহিত্যের জন্যে কাগজ নয়। তাই একে নিয়ে শ্লাঘাবোধকে যদি একটা মাপকাঠি হিসেবে ধরতে হয় বলতেই হবে তাকে অতিক্রম করে ‘সাহিত্যবোধে’ পৌঁছুবার কথা এখনো কম লেখকই ভাবছেন।
                শুধু মাত্র লেখা এবং পরিবেশনের জোরে যে গল্প পাঠকের কাছে পৌঁছুতে পারে সেই আত্মবিশ্বাসের খামতি বড় ভাবে নজরে আসে। নতুবা খেলু মজুমদারের গল্প সংকলনের শেষে তাঁর এবং তাঁকে নিয়ে অন্যের নানা কাগজে লেখা চিঠি পত্রের এক গুচ্ছ সংকলনও কেন জুড়ে দেয়া হবে প্রায় পঁচিশ পৃষ্ঠা জুড়ে। তেমনি, মানব রতনের সংকলনটির নাম শুধু ‘নিঃশব্দ’ নয় সঙ্গে বড় করে লেখা ‘ ১ ডজন ছোটদের গল্প ও বড়দের কবিতা( সংকলন)’ প্রচ্ছদেই লেখকের মৌলিক ভাবনার খামতি নজরে আসে। ‘ডজন’ভাবনাটি রীতিমত জনপ্রিয় বাণিজ্যিক প্রকাশনার থেকে নেয়া, যদিও বাস্তব হলো তাঁর বইটি নিয়ে কোন বাণিজ্য হয় নি, হবেও না। তেমনি ‘সংকলন’ কথাটির উল্লেখ একেবারেই বাহুল্য এবং বন্ধনীটি একেবারেই দৃষ্টিকটু। কবিতা এবং গল্পকে এক সংগে জুড়বে যে সংকলন তার নামে থাকা উচিত ছিল বলে মনে হয় ‘নির্বাচিত রচনা সংকলন বা সংগ্রহ ’ শুধু। তেমনি দৃষ্টিকটু প্রতিটি শিরোনামের নিচে বন্ধনীতে কবে কোন কাগজে প্রকাশ পেয়েছিল সেই উল্লেখ। অথচ একজন পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবার কথা লেখার দিন ক্ষণ, প্রকাশের নয়। তাও সেটি লেখার শেষে থাকলেই যথেষ্ট। শুরুতে এভাবে থাকলে মনে হয় যেন লেখক সেই কাগজের ছাপার জোরে পাঠককে ইঙ্গিত করছেন লেখাটা ভালো , পড়ে ফেলা উচিত। অনেকটা বিজ্ঞাপনের মতো, যে কাজটি আসলে করে এবং করবার কথা বাণিজ্যিক প্রকাশনা গোষ্ঠীর, লেখকের নয়। লেখক কী করেন তার এক আদর্শ নমুনা পেলাম রাজ্যের এক সুপরিচিত এবং দক্ষ গল্পকার কুমারত অজিত দত্তের গল্প সংকলন 'অ্যাণ্টি-ন্যাশনেল এবং অন্যান্য ' বইতে। তিনি উৎসর্গ করেছেন তাদের 'যারা খ্যাতির পেছনে ছোটেন না ' লেখকরা যতই ঘোষনা করুন তাঁর লেখা পড়ে অনেকেই ফোন টোন করেছেন কোথাও একটা আত্ববিশ্বাসের অভাবতো দৃষ্টি এড়ায় না। তার জন্যে দোষও দেয়া যায় না। বহু বিজ্ঞ সমালোচককে দেখি 'ভালো' কাগজে যখন এখানকার লেখকদের নিয়ে সমালোচনা লেখেন, তাদের অজ্ঞতা নিয়ে বেশ কড়া স্বরে তিরস্কার করে বসেন। তাদেরও ভাবখানা এই, মশাই 'মূলস্রোতের' বই পত্তর পড়েন না বুঝি! আমরা দেখিয়েছি, পড়াটা ঠিকই হয়। কিন্তু সমস্যাটি অন্যত্র। সামাজিক, এবং রাজনৈতিক। অসম আন্দোলনের আগে পরের কার ঘাতপ্রতিঘাতের কথা, বলতে গেলে অনেক বলতে হবে--আমরা পরিসরের কথা ভেবে বলছিনা। ভাষাটির প্রতি প্রশাসনিক বা শাসকদের উপেক্ষার ইঙ্গিত শুরুতেই আছে। বাকি যে কথা থাকে, এখানে বেরোয় আর কতগুলো সাহিত্যের কাগজ? যেগুলো বেরোয় সেগুলোর মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কও নিবিড় নয় যে ভাবনার আদানেপ্রদানে একটা সাহিত্যের বোধ তথা পাঠককুল গড়ে তোলা যাতে পারে। লেখালেখির বাইরে যারাই টুকটাক বাংলা বই পত্র পড়েন তাঁরা ভিন প্রদেশের মহানাগরিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচারে আচ্ছন্ন। সেখানকারও সত্যিকার সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠান বা প্রকাশনাগুলোর সংগে সেই পাঠকের সংযোগ প্রায় নেই বললেই চলে, যে সমস্যা প্রতিবেশী অসমিয়া সমাজের পাঠকের নেই। তিনি জানেন, তিনসুকিয়ার থেকে প্রকাশিত একটি বই বা পত্রিকাও অসমিয়া সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ হতেই পারে। সুতরাং কোনো বাণিজ্যিক ঝিলিক ছাড়াই তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন। কিন্তু এখানকার বাংলা সাহিত্যের সেই সুবিধে নেই। ঊর্ধ্বেন্দু দাশের একটি কবিতায় আছে, ““...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো/স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি/ হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ.../তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—/সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে /তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়;/হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল/ ফুলের মশাল!” এই 'সামান্য মাটির ছোঁয়া; নেই বলেই ঊর্ধ্বেন্দু দাসের মতো কবিকে এখানকার অনেক কবি লেখকেরাই চেনেন না, সাধারণ পাঠকতো দূর। কিম্বা ‘ইন্দিরা ওভারব্রীজে’র মতো উপন্যাস কে ভুলে যাবার অপরাধ তাঁর জেলার লোকেরাই করেন । আর সব কিছু যদি বা বাদও দিই, সেই পঞ্চাশ বছর আগে প্রকাশিত উপন্যাসটির গদ্যের সমুন্নত সৌরভ এখনো এখানকার অতি অল্প লেখকের মধ্যে পাওয়া যাবে। আমরা এই নিয়ে পরে আলাদা করে কখনো লিখব, আপাত নজির একটা নজির দিইঃ
“আজ কী বার মা? শনি কি মঙ্গল?
কুলপতির কাছে বারের প্রশ্ন এই প্রথম শুনল মিতি। সাল, তারিখ, বার, ক্ষণ এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে সে কুলপতিকে কোন দিন দেখেনি। মিতিও ওসবের ধার ধারে না। যে জীবন সূর্যোদয়ের উদ্যমে নূতনত্ব পায় না, সূর্যাস্তেও বিরতি নেই যে চলার , সে জীবনে সময়ের প্রশ্ন অবান্তর।
কি হইলো? তুমিও জানো না?
কুলপতির কণ্ঠস্বরে বিস্ময় ও হতাশা।
কি হলো, হঠাৎ মিতি হেসে উঠল। কিন্তু এ হাসি শান্ত, নিঃশব্দ হাসি নয়। চপল চঞ্চল ব্যাকুল হাসি। বার বার মাথা নেড়ে অস্থির ভাবে মিতি বলে, না, না, আমিও জানি না, এক্কেরে জানি না। না।
কথাগুলো বলতেই হঠাৎ থেমে যায় মিতি। এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে কুলপতির দিকে।
অতীতের স্মৃতি মিতির কাছে ধোঁয়াটে। কেমন এক আচ্ছন্নতা তার জীবনের পরিসরকে তারই কাছে আড়াল করে রেখেছে। মাঝে মাঝে তন্দ্রার মধ্যে নিজেকে সে খুঁজে ফিরেছে; কিন্তু বারবার সে আবেশ ভেঙ্গে গেছে। সামনে পেছনে দেখেছে শুধু পুরু ঠাসা থামগুলোকে। আর কাছে কাছে রয়েছে কুলপতি। ঐ দূরের কারখানার নির্বাক চিমনীর মতো মিতির আকাশে নির্বাক কুলপতি জেগে রয়েছে।”(অসমের বিস্মৃত উপন্যাস ‘ইন্দিরা ওভারব্রীজ’ থেকে ; শ্রাবণ ১৩৬৯)
          আমাদের এখাককার অধিকাংশ লেখকদের জীবনেও মনে হয়, “ সূর্যোদয়ের উদ্যমে নূতনত্ব পায় না, সূর্যাস্তেও বিরতি নেই যে চলার , সে জীবনে সময়ের প্রশ্ন অবান্তর।” অনেকের কাছে দুর্বোধ্যও ঠেকতে পারে। আমরা পরিতোষ তালুকদারের গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, নির্মল চৌধুরী দিয়ে শেষ করলাম। স্থান-কালের এমন গভীর বোধের বিস্তারও এক জটিল সাংস্কৃতিক সংগ্রামের নাম।