“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

“ঝরাপাতার ঝাঁপি” - গনেশ দে’কে শেষ প্রণাম


।।  সপ্তর্ষি বিশ্বাস ।।

                                                                                                        
                                                                                                                                                               



ঝরাপাতার ঝাঁপি
 
[ তুয়া, নোয়া, জোনাক ও মাসী’কে -]
চোখ বুঁজলেই একটি বাড়ি ভেসে উঠছে চোখে -
রইলো বাড়ি, মানুষটি নেই, ফোনের মুখে মুখে
খবর রটে, ছড়িয়ে পরে দাবানলের মতো –
চাঁদের ওপিঠ আগ্‌লে রাখে চাঁদের মুখের ক্ষত ...

একটি কোঠায় একটি মানুষ জান্‌লা খুলে রেখে
শোকের কথা সুখের ভাষায় রাখতো একা লিখে –
জীবন জোড়া ঝরাপাতায় ভরাতো তার ঝাঁপি –
হারিয়ে গেছে যেসব পাতা খুঁজতে যাবো না’কি

সেই বনেতে – যে পথ দিয়ে আসবে না কেউ আর –
একটি নতুন তারার আলোয় কাঁপবে অন্ধকার
পিদিম হাতে অনেক রাতে কুড়িয়ে নিয়ে কথা –
আখর জুড়ে রইবে জেগে সবাক নীরবতা।।



অ-শোক
 
[ স্মরণঃ গণেশ দে ]
 
শোক, যেন কুয়াশার মতো
ধীরে ধীরে নেমে এসে
ঢেকে দেয় শূন্যতার সব অলী গলী,
চিতার আগুন নিব্‌লে
টের পেতে ধূ ধূ  সেই শূন্য বালুচর
চলে যায় দিন, মাস, কখনো বছর...

শোকের আড়ালে তুমি
ক্রমে ক্রমে পূর্ণ অবয়ব –
মধ্যরাতে অকস্মাৎ টের পাই চুপে –
তুমি আছো, পুড়ে গেছে ‘শব’।।



গণেশ দে’র শেষ কথা গুলি


‘প্রণাম...’
‘কারে? দুর্গাপূজা প্রায় আরো এক মাস পরে’
‘প্রণাম।
ছুটো, বড়ো স-ব’রে প্রণাম’ ...







সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

'কলি’র অবতারদিগের বিষয়ে দু'ছত্র

                                                               ।।সপ্তর্ষি বিশ্বাস।।

১।

              র্ম এবং ঈশ্বর-বিশ্বাস যে সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু তা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখেনা। কোনোদিনই রাখেনি প্রকৃত প্রস্তাবে। ‘ধর্ম’ সর্বদাই পালন করেছে, আজো করছে নানা “প্রয়োজনীয়” ভূমিকা – কখনো রাজার, কখনো মন্ত্রীর, কখনো সেইসব “প্রয়োজন” এর চাকার গুঁড়িয়ে যাওয়া মানুষও তার কথা, ব্যথা নিয়ে এসেছে “ধর্ম” প্রাঙ্গনে । কখনো ঐ “ধর্ম” সামাজিক উপকার করেছে, কখনো অপকার। কাজেই ঐ “ধর্ম” কে দিয়ে ‘ভালো’-‘মন্দ’ দুইটি কাজই যাঁরা করিয়ে নিতে গেছেন তাঁদের প্রয়োজন পড়েছে যুক্তির, তর্কের। যেমন ‘বিধবা বিবাহ’কে আইনসিদ্ধ করতে গিয়ে যুক্তি তর্কের পথে যেতে হয়েছে বিদ্যাসাগর মহাশয়’কে। কিন্তু বিদ্যাসাগর কদাপি ‘দেব দর্শন’ পেয়েছেন বলে দাবী করেননি। কদাপি ঐ পথে হেঁটেছেন বলেও জানা নেই। একই ভাবে ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতারা যখন ‘ঈশ্বর এক না বহু’ নিয়ে তত্ত্ব ও তর্ক জুড়েছেন তখনো নিজস্ব ঈশ্বর বিশ্বাসের চেয়ে ‘ধর্ম’ নামক প্রতিষ্ঠানই পেয়েছে প্রাধান্য। ঐ প্রাধান্যের পেছনেও সমাজ ও যুগের দাবী এবং তার সাপেক্ষে রামমোহন থেকে রাজনারায়ণ বসু – সবারি সামাজিক উন্নয়ন-ইচ্ছার তাড়নাটিও ছিল। কিন্তু নিজস্ব ঈশ্বর-বিশ্বাসের কাহিনী কি ঠিক একই রকম? মনে হয়না। রামপ্রসাদ সেন’কে আমরা কি দেখেছি কেশব সেন’এর ভূমিকায়? লালন কে? হাসন্‌ রাজা’কে? হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে লালন বা হাসন রাজা’র মতো যাঁরা নিজস্ব বিশ্বাস নিয়েও সাধারন লোকের আওতার ভেতরেই ছিলেন তাঁদের কে সেই সাধারন মাষুষদের দুঃখের পাশে দাঁড়াতে হয়েছে – যেমন লালন গিয়েছিলেন জমিদারের কাছে প্রজা সাধারনের হয়ে দরবার করতে। দাঁড়িয়েছিলেন ঠাকুর পরিবারের বিপক্ষে কাঙ্গাল হরিনাথকে সহায়তা করতে।  কিন্তু তার সঙ্গে ‘ধর্ম’ নামক প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে সমাজের ভালো বা মন্দ করবার অভিপ্রায়ের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং ‘ঈশ্বর’ জিনিসটিকে যদি সাদামাটা ভাবে মানবমনের শুভ আলোকের প্রতীক বলে ধরে নিই তাহলে লালনের বা তাঁর মতো আরো অনেক ‘বিশ্বাসী’র সামাজিক আন্দোলনে জড়িয়ে পরার অর্থ পাওয়া যায় সহজেই আর সেই জড়িয়ে পড়া তত্ত্বতাড়িত নয় কদাপি। কিন্তু যে মানুষ বা মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের ‘বিশ্বাসী’ বলে দাবী করে, দাবী করে ঈশ্বরই তাদের কানে কানে বলে যান, রোজ, ছাতে, যে কি কি করতে হবে, লিখতে হবে – ইত্যাদি, সেরকম একদল মানুষ যখন ২০১৩ সালে এসে প্রমাণ করতে চায় যে বর্ণাশ্রম শুধু যুক্তিপূর্ণই ছিল না অদ্যাপি তার প্রয়োজন রয়ে গেছে অথবা বলতে চায় যে বৌদ্ধ ধর্ম মূলতঃ নিজের মুক্তি নিয়ে মেতে থাকার ধর্ম – ইত্যাদি তখন সন্দিহান হয়ে উঠতে বাধ্য হই।

     
    ব্রাহ্ম ধর্মের ইতিহাসের একটা সময় রাজনারায়ণ বসু হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কয়েকটি বক্তৃতা করেছিলেন।

          হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বক্তৃতা দিতে স্বামী বিবেকানন্দ গিয়েছিলেন শিকাগো। ঠিক। তবে ব্রাহ্ম ধর্মের ঐ সময়টাতে  ঝাঁকে ঝাঁকে বাঙ্গালীর ট্যাঁশ ফিরিঙ্গিয়ানা আটকাতে ব্রাহ্ম ধর্মের ঐ ভূমিকাটি ছিল সামাজিক প্রয়োজন। বিবেকানন্দের শিকাগো যাওয়া ও হিন্দুধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা যতোনা ‘হিন্দু ধর্ম’ টির জন্য প্রয়োজনীয় ছিল তার চেয়েও বেশী প্রয়োজনীয় ছিল পরাধীন ভারতবর্ষের জন্য। ঐ বক্তৃতায়, ঐ ব্যক্তিত্বে সারা বিশ্ব ‘ভারত’ নামক দেশটিকে নতুন করে দেখেছিল। ভেবেছিল তার পরাধীনতা নিয়ে। যে কোনো কারনেই হোক নিবেদিতা’র মতো মহিলা এসে আপনাকে নিযুক্ত করেছিলেন ভারতীয়দের সেবায়। এতদ্‌ভিন্ন বিবেকানন্দের ঐ শিকাগোযাত্রা আর ঐ বক্তৃতা আমার কাছে কোনো অর্থ রাখেনা। আজ, এই গ্লোবালাইজ্‌ড্‌ যুগে যদি কোনো মানুষ বিবেকানন্দের চেয়েও বেশী কৃচ্ছ সাদন করে এন্টার্কটিকায় কোনো ধর্মমহাসভায় গিয়ে একরম একটি বক্তৃতা করে তাকে নিয়ে আমি এক লহমা সময়ও নষ্ট করবোনা ।

          এখানে এ’ও বলে রাখা দরকার যে, শ্রীরামকৃষ্ণ বা চৈতন্যদেবেরা যেভাবে ‘ঈশ্বর’কে দেখেছেন বলে দাবী করেছেন ব্রাহ্মরা তা করেননি। অন্ততঃ যাঁর কথা বল্লাম সেই রাজনারায়ণ বসু’ত করেননি। বিবেকানন্দ  করেছেন। হ্যাঁ, নিজস্ব ঈশ্বর-বিশ্বাস আর ‘ধর্ম’ নামক প্রাতিষ্ঠানিকতাকে মিলিয়ে দেওয়ার পথে তিনিও এক পথিকৃৎ বটে। কিন্তু সেই বিবেকানন্দই সারা ভারত চষে বেড়িয়েছেন। অস্পৃশ্যতার প্রতিবাদ ও প্রতিকার করার উদ্যম নিয়েছেন নিজের মতো করে। তাই তাঁকে  ‘স্বঘোষিত’  God-man বলা যাবেনা আর তা ছাড়া তাঁর সময়েও দু লাইন মেক্‌লে পড়ে আর দুই বোতল শেরী গিলে বাঙ্গালীর ট্যাঁশ্‌ ফিরিঙ্গি হয়ে যাওয়ার বাস্তবতা বিদ্যমান ছিল। ফলে যেকোনো অছিলায় বাঙ্গালীকে, ভারতীয়দেরকে ঐ খপ্পড় থেকে বাঁচানোর চেষ্টার নিরিখে বিবেকানন্দের কার্য্য কলাপের একটা চলনসই অর্থ পাওয়া যায়। তবে বিবেকানন্দ নিয়ে কথা বেশী না বাড়ানোই ভালো কেননা তাঁর কথিত প্রতি পঞ্চম বাক্য তাঁর প্রথম বাক্যের বিরোধিতা করে। তিনি’ত এ’ও বলেছেন ঈশ্বর লাভের প্রয়োজনে তাঁকে যদি মানুষ খুনও করতে হয় তিনি তা করতে প্রস্তুত ( তিনি বলেছেন আর নিজ বিশ্বাসের মূল্যে মারতে এবং মরতে পারায় প্রকৃৎ হিম্মৎ তো দেখিয়েছে সত্তরের সেই ছেলেমেয়েরা – কিন্তু তারা বিবেকানন্দ বা নিবেদিতা উপাধিপ্রাপ্ত হয়নি)।

             অন্তিম প্রস্তাবে বলতে চাইছি যে যাঁরা “ধর্ম”কে দিয়ে কিছু একটা করিয়ে নিতে চেয়েছেন, আজো চান – কেশব সেন থেকে আদ্‌বানী, সোনিয়া বা হালের মোদী – এঁদের নিয়ে এই আলোচনা নয়। আলোচনা সেই মানুষটিকে নিয়ে যার সঙ্গে অপর্ণার মৃত্যুর পরের বিবাগী অপুর দেখা হয়েছিল অমরকন্টকে – যে মানুষ রেঁঢ়ির তেলের বাতি জ্বেলে, একা একা তুলসীদাসী  রামায়ণ পড়তো আর স্বপাকে মোটা রুটি খেতো সেই আজবলাল ঝা’ নামের  মানুষটিকে নিয়ে বা অপুরই বাল্যকালে দেখা নরোত্তম গোঁসাই’কে নিয়ে। তাঁদের বিশ্বাসের জন্য কোনো তত্ত্ব, তথ্য কিছুরি প্রয়োজন ছিলোনা। আজো যাঁরা তাঁর মতো প্রকৃতার্থেই বিশ্বাসী তাঁদের দরকার নেই লোক ডেকে তর্ক করে জানান দেওয়ার যে ঈশ্বর এক না বহু, ঈশ্বর রাম না রহিম। কিন্তু হালের সমস্যা অন্য। হালের যে একদল বুদ্ধিমান বাঙ্গালী নিজেদের সেই ‘আজবলাল ঝা’ বা ‘নরোত্তম গোঁসাই’ বলে জানান দিয়ে মাঠে নেমেছেন ,আপাতঃভাবে তাঁদের কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই ( সামাজিক লক্ষ্যও আছে বলে বোঝা যায়না) তবু তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসের সমর্থনে যুক্তি খোঁজেন, যুক্তি দেখান । এভাবে যুক্তি দেখাতে গিয়ে, তাঁদেরো যে সমর্থক আছে বাজারে জানাতে গিয়ে আজ কবর খুঁড়ে তুলে আনেন জনৈক কেন্টিশ্‌ কুমারস্বামীর বক্তৃতাকে, কাল নরক থেকে ডেকে আনছেন মাদক ও মেয়ে পাচারের অভিযোগে একদা দেশ ছেড়ে পালানো সেই ‘মহান’ ‘ওশো’কে! পাতার পরে পাতা ঐসব মানুষের লেখার অনুবাদ ও প্রচারে  ( অনায়াস প্রচারে, সভা ডেকে বলবার সাহস ও যোগ্যতার অভাবে ফেস্‌বুকের পাতা ভরাচ্ছেন ) কাটছে তাঁদের দিন।  এঁরা বিজ্ঞানের সমস্ত কিছুর আদ্য শ্রাদ্ধ করেন অথচ কেউ নন বনবাসী! এঁরা কেন  মানুষের অন্তর্গত বিশ্বাসের জায়গাটির সঙ্গে ‘ধর্ম’ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় গুলিয়ে দেওয়ার কাজে কোমড় বেঁধে নেমেছেন? আরো বিপজ্জনক হচ্ছে তাঁদের উদ্দেশ্যটি যা’ই হোক্‌  তাঁদের এই প্রচারের ফলে যা হচ্ছে তা হলো আসারাম’হেন কীটেদের পা রাখার জায়গাটি হতে চলেছে মজবুত। ‘নীচু জাত’এর মানুষদের জন্য যারা আলাদা শ্মশানের দাবী তুলছে বা যারা ‘নীচু জাত’ এর লোক জাতীয় পতাকা তুল্লে গিয়ে খুন খারাবা করছে – সেইসব রাজনৈতিক ও সামাজিক শয়তানদের সমর্থনের ভূমি হচ্ছে শক্ত। - আরো যেটা হচ্ছে এঁদের এই রকমের বেলেল্লাপনা দেখে দেখে আমার মতো মানুষ ‘বিশ্বাস’ – নিজের অন্তর্গত শুভের প্রতি – যদি তাকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি ‘জীবনদেবতা’ – সেই দেবতারো প্রতি বিশ্বাস তো হারাচ্ছেই – অবস্থা এমনি হচ্ছে যে যদি কোনোদিন কোনো সত্য ‘আজবলাল ঝা’ বা ‘নরোত্তম দাস’এর সন্ধান মেলে তাহলেও লোকে তাদেরকে চিনবেনা, চিনতে চাইবে না। বরং ঘৃণা করবে।

২।

               যদিও আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি জাতিভেদ, সতীদাহ – ইত্যাদি’র জন্ম ও বিকাশ সমস্তই বিশেষ একদল মানুষের স্বার্থে তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে যে সময়ে সেগুলির আমদানী হয়েছিল – জাতিভেদ, সতীদাহ – ইত্যাদি – সেই সময়ের সাপেক্ষে এগুলি ছিল ‘ঠিক’ তথাপি আমাদের বুঝে দেখতে হবে, ক্রমে, সমাজের ক্রম বিকাশের স্তরে স্তরে সেই জিনিসগুলি ঠিক কি ভূমিকা পালন করেছে বা আজই তাদের ভূমিকা ঠিক কি? আরো বড় কথা হলো ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী’ এই কথা প্রমাণবা প্রচারের জন্য ঐ সমস্ত বর্বরতাকে সমর্থনের বা ওশো হেন ধুরন্ধরের অনুবাদ ও উদ্ধৃতির যে কোনো প্রয়োজন নেই তা ঐ ‘আজবলাল ঝা’ বা ‘নরোত্তম দাস’এ প্রমাণিত। ‘ওশো’ র যে বইগুলি বাজারে চলছে সেগুলির থেকে মুনাফা বানাচ্ছে তাদের প্রকাশক। সেই বইগুলি লিখছে, বেনামে, হয় এমন কিছু মানুষ যারা পন্ডিত, যারা বুদ্ধিমান কিন্তু ‘বাজার’ যাদের চেনেনা নয় বাজারের নামী লেখকেরা, বেনামে। বেশী পয়সার জন্য। - এ’ই প্রাথমিক সত্য গুলিকে এড়িয়ে গিয়ে এই মানুষগুলি কি চাইছে ঠিক? এরা নিজেরাই কি তবে বাঙ্গালীর কাছে ওশো’ বেচার ‘পেইড্‌ দালাল’? না’কি এরাই ‘নিও নাজি’র ভারতীয় সংস্করণ?

              এদের নিয়ে আমার কিছু বলবার ছিলনা যদি এরা নিজেদের ‘ঈশ্বরের বরপুত্র’ বলে নিজেরাই ঘোষণা না করত। এটা করায় যা হচ্ছে একদল দুর্বল মস্তিষ্ক ‘বিশ্বাসী’ এদের ধুয়া ধরছে যে ধুয়া’র ধোঁয়ায় এরা সমর্থন করে বসছে তাদের প্রচারিত মতামতকে - জাতিভেদ, সতীদাহসহ এরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সমস্ত অন্ধকারকে আনয়ন করছে নিজের গহনে যার সুযোগ নিচ্ছে ‘ধর্ম’কে সামনে রেখে যারাই রাজনীতি করে তারা সকলেই ( ভারতবর্ষে ‘প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম’কে ব্যবহার নাকরে রাজনীতি করে এমন কোনো দল কোনোদিন ছিলনা)।  এতে যা হচ্ছে তা হল সৎ ও সরল বিশ্বাস যা থেকে লালনের মতো মানুষের জন্ম বা তাঁকে চিনে নেওয়ার চোখটি সৃষ্ট হওয়ার কথা ছিল তার সম্ভাবনা যাচ্ছে বিলীন হয়ে।

              অন্তিমে বলতে চাই, যে,  ‘স্বঘোষিত বিশ্বাসী’রা বিশ্বাসী নয় আদতে। হয় তাদের নিজেদের বিশ্বাসের ভিত্‌টা এতোটাই দুর্বল যে তাকে খাড়া রাখতে দরকার পরে ওশো’র, আশারামের। নতুবা এরা কোনো না কোনো কুচক্রী গোষ্ঠীর ‘পেইড্‌ দালাল’।

মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

এনক্রিপ্ট

।। শুভদীপ দেব।।


রোদ পোহাতে পোহাতে জানতাম
এই রোদ আর
গায়ে লাগবেনা !
মিস ফিলিং হয়ে যাওয়া বৃষ্টির জল যেমন জানে,
মাকাল মরুভূমির দিকে...
যেতে নেই !
স্থানিক সূর্য,
মেঘে ঢেকে গেলে...
কান্নায় চটকে যেত পাখিদের কাজল,
কেননা পাখিরাও জানত,
করুণ ডানা ঝলসে গেলে,
হাসি উঠবে কার কার !
এভাবেই চলতঃ মুলতঃ
শুভ,আমার আর পৃথিবীর
ড্রাগন এনালাইসিস !



ডায়েরি

Debayan Tarafdar
  ।।দেবায়ন তরফদার।।

বিশিষ্ট কোনো বৈজ্ঞানিক 
অনেক গবেষণার পর ....জানতে পারলেন 
সময় একটা ধাঁধা ..

তারপর বিজ্ঞাপন ...বিজ্ঞান ছাপিয়ে এগিয়ে গেল ..
আটকা পড়ল নথিপত্র ,পুঁথি ..কযেকটা কলমও...
ভোর বেলা বেজে ওঠা  "সারে জাঁহা সে আচ্ছা..."
clock work মেনে চললো  .


e যতই  mc2
হোক না কেন
আপেক্ষিক এই পৃথিবী তে  
অঙ্কটা  মেলানো কঠিন

বৈজ্ঞানিক গত হলেন ..
রান্নার উনুনে পুড়ল অনেক রুটি  ..
অনেক সাদ্দাম,কাসাব,মুম্বাই,ইস্রায়েল ..
surreal TV show...."কউন বনেগা ...."
etc

সময়টা  ধাঁধালো হলো ঠিকই ..
তবু চকলেট খেতে খেতে সব্বাই তা গেল ভুলে...

শুভাদীপ দেব বললো .
"পথে ফিরে এস ..."

সময়টা মাঝে মাঝে কানে কানে ফিসফিস করে ...

বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করে ...
একটা কবিতা লিখব ভাবছি ...

সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

চিত্রশিল্পী এবং ভাস্কর মুকুন্দ দেবনাথের জন্মদিনে

          
৯৭২থেকে ৮২ এই আটবছর আমার বাল্য কৈশোর কেটেছিল শিলচর চণ্ডীচরণ রোডে নালার ওপারে এক ভাড়া  বাড়িতে। পাঠশালা, স্কুল জীবনে পার করে কলেজে পা দেয়া সেই বাড়িতে থেকেই । কাছেই থাকতেন চিত্রশিল্পী মুকুন্দ দেবনাথ। দূর থেকে দেখতাম। লোকের মুখে গল্প শুনতাম । প্রাণোচ্ছ্বল তরতাজা লম্বাটে তরুণ তিনি তখন। তাঁর সবুজ পাঞ্জাবী, সাদা ট্রাউজার আমাকে এতো টানতো যে এক সময় আমি নিজেও এক জোড়া তেমন সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম। স্কুল ডিঙিয়ে ধীরে ধীরে আলাপ হয়। এই পাড়াতেই ক্লাব ছিল 'শান্তসেনা' সেখানে খুব কাছাকাছি পরিচয়ের সুযোগ হয়। আসতেন তিনি মাঝে মধ্যে। পাবলিক স্কুল উচ্চতর মাধ্যমিকের স্বীকৃতি পেলে পরে এক অনুষ্ঠানে প্রথম তাঁর পাশে বসবার সুযোগ যেদিন পেয়েছিলাম আর কথা হচ্ছিল, হাতে যেন চাঁদ পেয়েছিলাম। চাঁদই বটে। কবি গল্পকার, গাইয়ে বাজিয়ে অনেককে চিনতাম শহরের। ছবি আঁকিয়ে একজনই মুকুন্দ দেবনাথ। পরে তাঁর বাড়ির ভেতরে গিয়ে ছড়ানো ছেটানো ছবি দেখবার সৌভাগ্য অনেকদিনই হয়েছিল। তখনতো আর গ্যালারিতে প্রদর্শনী হতো না । এখন যেমন সন্দীপনেরা  রীতিমত এক চিত্রশিল্প আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তখন সেসব ছিল না। সেই মুকুন্দ দেবনাথকে আজ সকালে এভাবে ছবিতে দেখে প্রথমে চিনতেই পারিনি। মন খারাপ হয়ে গেছিল, দেখে যে নিজের জন্মদিনের কেকটা নিজে কাটতে পারছেন না। আবার ভালো লাগছে যে ছাত্রেরা এবং বাড়ির লোকে জন্মদিনটি মনে রেখেছেন।


              শিলচরের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের চিত্রশিল্পের শিক্ষক ছিলেন মুকুন্দ দেবনাথ। ২০০২ সালে অবসর নেন। সেই হিসেবে শনিবার ৭সেপ্টেম্বর,১৩  তাঁর ৭২বা ৭৩তম জন্মদিন হবে। এমন কিছু বয়স হয় নি, আরো বহুদিন দাপটে চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু ২০০৯ প্যারালাইসিস হয়ে তাঁকে অক্ষম এবং চলৎশক্তিহীন করে ফেলে। তাঁর দেবনাথ আর্ট স্কুল এখনো আছে। চালান তাঁর সুযোগ্যা কন্যা ডালিয়া দেবনাথ। ছবিতে তাঁকেই দেখা যাচ্ছে হাত ধরে বাবার জন্মদিনের কেক কেটে দিচ্ছেন। তিনি হয়তো কিছুই বলেন নি, কিন্তু কোত্থাও কি একটুকু আনন্দের বান ডাকে নি?   শুধু ছাত্ররাই নয়, অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাদের অভিবাবকেরাও। সংবাদ পড়ে যা জেনেছি, তাঁর স্ত্রী সেদিনের অনুষ্ঠানে চোখের জলে সোনাঝরা সেদিনের গল্প শুনিয়েছিলেন। মনে হলো, আমরাও শরিক হই এই উৎসবে। তাঁর স্মৃতি এবং কীর্তিকে সামান্য হলেও ছড়িয়ে দেয়া শুরু করি আন্তর্জালে। ঈশানের পুঞ্জমেঘ ফেসবুক গ্রুপে  সেটি শুরু, সেই প্রক্রিয়াতেই তাঁর উত্তরসুরি সন্দীপন দত্ত পুরকায়স্থ কিছু ছবি আর ভাস্কর্য দেখালো তাঁর । সেগুলোও এখানে ছড়িয়ে দিচ্ছি নিচে। আশা করছি, তিনি সুস্থ হোন, নিজের চোখে দেখুন, এখন শহর শিলচরে ছবি আঁকিয়েরা কেমন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আশীর্বাদ করুন তাদের নিজ হাতে। 
মনসামঙ্গল; তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলোর একটি। শক্তপদ ব্রহ্মচারীর একই নামের কবিতার চিত্রায়ন।কবিতাটি এখানে পাবেন। ক্লিক করুন
TITLE- CARD PLAYERS



রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

'উৎসর্গ-চতুর্থ বন্ধুকেঃ একটি ছোট ছবি।


(C)ছবি
  'উৎসর্গ-চতুর্থ বন্ধুকে'...
প্রদীপ মজুমদারের কবিতা অবলম্বনে  ছোটছবি।
 অনুপ্রেরনাঃ মহাজাতক।
 অভিনয়ঃ সাগরনিল দাম,
 আবহঃ তাপস ধর।
 দৃশ্যায়ন,আবৃত্তি ও নির্দেশনাঃ শুভদীপ দেব.






দেখুনঃ উৎসর্গ-চতুর্থ বন্ধুকে..A poetry for meditation.......

ভ্রমণের কবিতা



 ( বিজয় কুমার ভট্টাচার্য শিলচরে থাকেন। পেশায় সাংবাদিক, নেশায় কবি। আন্তর্জালে নেই বলে পড়া হয় না, তার কবিতা। এই কবিতাটি ঈশানের পূঞ্জমেঘের আবেগকে প্রকাশ করে বলে এখানে তুলে দিলাম। একাধিক বাংলা কবিতার বই রয়েছে তাঁর । সেই আশির দশকের শুরু থেকে প্রকাশ পাচ্ছে। এই কবিতাটি  'অসংলগ্ন ছিন্ন কথামালা..' বই থেকে নেয়া





















লো না তোমাকে নিয়ে একবার ঘুরে আসি
এসেছে সময়, মনোময়, শুনো দূর
দূরান্তের বাঁশি।
সবাই তো নৌকা বায় ভাটিয়াল স্রোতে
আমরা উজানে যাবো
গোয়ালপাড়ার গানে গানে,
ঠিকানা হারাবো মাঝপথে।
দূরের পাহাড় বুঝি কামনার নীলাচল
এখনো অভিশাপের মোরগ ডাকে
পাথরের চোখে ঝরে
জল।
কে কোথায় করেছে নির্মাণ, অলৌকিক জলযান,
স্বর্গের সিঁড়ি
তোমাকে নিয়েই যাবো, যেখানে পাগলাদিয়া,
লোহিত, সুবনশিরি।
মেঘে মেঘে মেঘালয়, আবৃত তুষারে
স্নান সেরে নিতে পারো তুমি
বিডন , বিশপ শাওয়ারে।
এখানেই হিমালয় অরণ্যের নানাকথা কয়,
পাইনের বনে ঝড় তোলে জয়ন্তিয়া নারীর প্রণয়।
পাহাড়ের চূঁড়ো ভেঙ্গে দ্যাখো, হেঁটে যাচ্ছে
মিজোরামের যুবতী
হরিণীর মতো ক্ষিপ্রতায়
কী দারুণ গতি!
গির্জাঘরের থেকে ভেসে আসে
মেষ পালকের গান
যিশু বলেছেন, আমিই জীবন ও পুনরুত্থান
চারপাশে ছড়িয়ে দ্যাখো অসতরাগ
জোরাম নদীর।
সে কোথায় যায়? নাগা ভূমিডিমাপুর,
নাকি কোহিমায়?
আমরাও যেতে পারি বহুদূর
দক্ষিণের প্রান্তসীমায়।
অরুণাচলের পথে কী সুন্দর সূর্যোদয় হয়
পলকে দেখতে পারি
খুব বেশি যাবে না সময়।
কতো দূর মণিপুর, চিত্রাঙ্গদা, অর্জুনের দেশ?
তুমি হতে পারো রথের সারথি
তোমাকে মানায় রাজপুরুষের বেশ।
খুব বেশি দূরে নয় সীমা ত্রিপুরার,
গোমাতীর মতো আছে নদী,
আছে রাজবাড়ি আর খিরকিদুয়ার।
রবিঠাকুরের বিসর্জন নাটকের পটভূমি
সেখানে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখতে চাই
কী রকম তুমি!
পাশেই উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা
উনিশের মতো একুশের শহিদেরা শুয়ে আছে
স্মৃতিসৌধ ফুলে ফুলে ঢাকা।
তুমিই আমার একান্ত গোপন
অনুভবের কবিতা
যেতে যদি রাজি থাকো
চলো না, অর্পিতা।


বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

অভিমান


।। রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ ।।

 
(c)ছবি


তন টাকাটা চুরি করলো । তুমি কিছু বলবে না ?
-কী বলবো ? নিয়েছে তো তর ভাই । ভাইয়ের টাকা ভাই নিয়েছে । এতে বলার কী আছে ।
 

-বাহ । জিজ্ঞেস না করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গেল । মদ গাঁজা খেয়ে অতগুলো টাকা উড়িয়ে দেবে । টাকাগুলো যে রান্নাঘরটা মেরামত করবার জন্য বেশি সুদে এনেছি । সে দিকে খেয়াল আছে ?
 

-আহ! বেশি বকবক করিস না । এখান থেকে সরে পড় । 

সুশীল আর কথা বাড়াল না । বুঝল এ সব কথা মাকে বলে লাভ নেই । সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো ।
 

ঘড়ির কাটায় তখন ১০ টা । সুশীলের ছোট বোন রত্না বললো , মা তুমি বীনা দোষে দাদাকে বকলে । রতনের দোষ । অতগুলো টাকা চুরি করলো । তুমি কিছু বললে না ।
 

-কী বলবো, বল ? সুশীল শান্ত ছেলে । মা বকলে কিছু বলবে না । চুপ করে থাকবে । আর রতন জানোয়ারটা কে কিছু বললে তো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছাড়বে ।
 

-তাই বলে সবসময় ...

ভোরের আলো চারধারে ছড়িয়ে পড়েছে । সুশীল রাতে বাড়ি ফিরেনি । সুশীলের অপেক্ষায় মা সারারাত উঠোনে পায়চারি করে কাটিয়ে দেয় ।সারা মুখে চিন্তার ছাপ । ছেলেটা না খেয়ে সারারাত কোথায় ছিল এসব চিন্তা তাকে জর্জরিত করছিল । এমন সময় সুশীলের বন্ধু শৈলেন দ্রুত দৌড়ে বাড়িতে ডুকলো । হাঁপাতে হাঁপাতে বললো ,-- মাসিমা, দ্রুত আমবাগানে চলুন ।
--কেন,হঠাৎ আমবাগানে ? কী হল ?
সুশীল আমবাগানে ফাঁসি দিয়েছে ।

সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সামজিক অস্থিরতা

                                                  ।।অরূপ বৈশ্য ।।

দৈনিক যুগশঙ্খের ২৩ আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত


ম্পূর্ণ বৃত্ত

সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথা আজকাল আর কেউ অস্বীকার করেন না। কিন্তু আমরা বিষয়টিকে যত সরলভাবে দেখি, বিষয়টি তার চেয়ে ঢের গভীর ও জটিল। রাজনীতির অবক্ষয়ের মডেল বোঝাতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ শামির আমিন লিখেছেন – যারা রাজনীতি বোঝে তারা রাজনীতিতে যোগ দেয় না, যারা বোঝে না তারা দাপিয়ে বেড়ায়। এই জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা একটু হালকা চালেই করা যাক। এই নিবন্ধকারের দু’চারটে হালকাচালে লেখা যুগশঙ্খের পাতায় ছেপে বেড়িয়েছে। কাছাড়ের জয়পুরের নিবাসী অশীতিপর বৃদ্ধ দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েও সামাজিক কাজে লিপ্ত আমার এক মামা এই লেখাগুলো পড়ে আমাকে বলেছেন – “তুই বড় কঠিন বাংলা লেখচ”। তাঁর কথার অন্তর্নিহিত অর্থের উত্তরে একথাই বলা যায় যে বাস্তব পরিস্থিতিতে আজ এত জটিলতা যে তার সহজ সরল ব্যাখাতেও খানিকটা জটিলতা থেকে যায়। আমার এই মামার কথা এখানে উল্লেখ করলাম এক ভিন্ন উদ্দেশ্যে। তিনি কংগ্রেস নেতা প্রয়াত মহীতোষ পুরকায়স্থের সম্পর্কে ভাই এবং নিজেও কংগ্রেস করতেন। শাসক শ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলোতে এধরনের সৎ, নিষ্ঠাবান ও গরিব-দরদি নেতা-কর্মী আজ বিরল প্রজাতি হিসেবেই গণ্য হয়। তাই প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে শাসকীয় রাজনীতিতে ও রাষ্ট্র পরিচালনায় কী এমন ঘটল যে মূল্যবোধের সংজ্ঞাই পালটে গেল? রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে শাসকীয় রাজনীতির সৎ, নিষ্ঠাবান ও গরিব-দরদি নেতা-কর্মীদের প্রায় সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্তি ঘটেছে। অনেকের মতে এ এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি – বৃত্ত আসলে সম্পূর্ণ হয়েছে – কেন্দ্রাতিগ শক্তির ঠেলায় বৃত ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়াও অবশ্যম্ভাবী।

আধুনিক ও সেকেলে চিন্তা

              নেহরু ও গান্ধির উন্নয়ন চিন্তার দ্বৈরথ আজ অপ্রাসঙ্গিক। তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার স্তালিনীয় শিল্পোন্নয়নের আদলে নেহেরুর চিন্তা ও গান্ধির গ্রাম-স্বরাজের উন্নয়ন-চিন্তা বাস্তব প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কার্যকারিতা হারিয়েছে। নেহেরুর চিন্তায় বিড়লাদের মত তৎকালীন ভারতীয় বৃহৎ পুঁজিপতিদের আকাঙ্খারও প্রতিফলন ঘঠেছিল। আধুনিক পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় সামগ্রি যেমন তেল, বিদ্যুত, স্টিল, কয়লা ইত্যাদির উৎপাদন এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্য-যোগাযোগ ইত্যাদি সামাজিক ও পরিষেবামূলক ক্ষেত্র সরকারি মালিকানায় রাখার প্রস্তাব বিড়লাদের বোম্বে-ক্লাবের ছিল, কারণ সেই সময়ের পুঁজিপতিরা এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ছিল না। সুতরাং নেহেরুর উন্নয়ন চিন্তায় পুঁজির সাথে কোন দ্বন্দ্ব ছিল না, বরঞ্চ এই চিন্তায় পুঁজিপতিদের প্রভাব ছিল। নেহেরুর মডেলে উন্নয়ন ছিল বিদেশি আধুনিক প্রযুক্তির আমদানি নির্ভর, অন্যদিকে আধুনিকতার মানদণ্ডে গান্ধির চিন্তা ছিল সেকেলে এবং জাত-বর্ণভিত্তিক শ্রম-বিভাজনের ধর্মীয় রীতিভিত্তিক তথাকথিত স্বনির্ভর গ্রামের ধারণা-প্রসূত। এই উভয় ধারণাতেই কৃষির উদ্বৃত্ত আয় থেকে শিল্প-বিকাশের কোন পথের সন্ধান ছিল না। নানাধরনের পণ্য সামগ্রির বহির্বাণিজ্যিক চাপে গ্রামে একধরনের আধুনিকতার ছোঁয়া লাগল বটে, কিন্তু গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও স্বনির্ভর অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদা ও উৎপাদন-কাঠামো তৈরিতে এই ধারণা ব্যর্থ হল। এই ব্যর্থতা নেহেরু ও গান্ধি উভয়ের ধারণাকেই অসার প্রমাণিত করে ছাড়ল। এবং এর সাথেই অসার হয়ে গেল এই উভয় ধারণাতেই আদর্শগতভাবে নিহিত থাকা সামাজিক কল্যাণের ধারণাও। সুতরাং প্রয়োজন দেখা দিল এক নতুন নীতি ও আদর্শকে আঁকড়ে ধরা।

ধনপতির হাঁড়ি ও গরিবের লোহার চালের বাটি

          নেহেরুর উন্নয়ন ও জনকল্যাণের ধারণা উবে গেলেও একটা বৈশিষ্ট আরও তীব্র আকারে মানুষের মননকে গ্রাস করে নিল। সেই বৈশিষ্ট্য হল আমেরিকা-ইউরোপের অনুসরণ, অনুকরণ ও তাদের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি। বিশ্বব্যাপী নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সাথে সেই আদর্শ একেবারে খাপে খাপে মিলে গেল। রাজনীতিবিদ-প্রযুক্তিবিদ-আমলা সবাই পাশ্চাত্যের চোখধাঁধানো নগরসভ্যতার মানদণ্ড অনুসরণ করতে গিয়ে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় না রেখে তাদের নীতি ও প্রযুক্তি প্রয়োগে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের এই প্রয়োগশালায় যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তার যোগান সুনিশ্চিত করতে সেই দেশগুলির নিয়ন্ত্রিত ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, আই-এম-এফের মত সংস্থা বা সেই দেশের বৃহদাকারের পুঁজি-মালিকদের কাছে ধার নিতে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাজির হতে হল। অর্থের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে ক্ষমতা – সুতরাং ধারের অর্থ যত বাড়তে থাকে নিজ দেশের ক্ষমতার লাগামও তার সাথে পাল্লা দিয়ে যেতে থাকে দেশের চৌহদ্দির বাইরে – সমুদ্রের ওপারে বহুদূরে। স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে যে ধনপতিরা রাষ্ট্রের সহায়তায় উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজত, আম্বানীদের মত সেই ধনপতিরা ফুলেফেঁপে অনেক বড় হয়েছে, তাদের মুনাফার হাঁড়ি পূর্ণ হয়েছে, এখন নতুন হাঁড়ি চাই। তারা সরাসরি এখন বিদেশি কোম্পানীদের হাত ধরে যাত্রা করতে পারে মালয়-সিংহল-নেপাল-আফ্রিকা ইত্যাদি অভিমুখে। অর্থ ও ক্ষমতা যাদের, আদর্শের মালিকানাও তাদের কাছে। তারাই শিক্ষা-মিডিয়া সহ মতামত তৈরির সমস্ত মূল প্রতিষ্ঠানের মালিক। তারা যাকে প্রকৃত মূল্যবোধ বলে বিবেচনা করবে তার পক্ষে শিক্ষিতশ্রেণির বৌদ্ধিক সায় আদায় করে নেওয়ার জন্য মগজ-ধোলাইয়ের কোন কসরতই বাকি থাকবে না। এভাবে শাসনের পক্ষে শাসিতের মত আদায় করে নিতে পারার পরিস্থিতিই গ্রামশিয়ান হ্যাগিমনি সূত্রে আধিপত্যের প্রথম ধাপ। উন্নয়নের মানদণ্ডটাই যখন বদলে গেছে তখন শপিং-মল গড়ে উঠতে লক্ষ টাকার কেলেঙ্কারি বা বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগে বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলতে কয়লা খনির বরাত নেওয়ার পেছনে কোটি কোটি টাকার তছরূপ নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলে তারা নিশ্চিতভাবে উন্নয়ন বিরোধী হিসেবে বিবেচিত হয়। বেড়াল সাদা হোক বা লাল – ইঁদুর ধরলেই হল (মাও পরবর্তী চিনের সরকারি মন্ত্র)। প্রকৃতি ভারসাম্য হারাক – আরো অনেক উত্তরাখণ্ড হোক – গরিব পেটে মরুক বা পিঠে মরুক – না জুটুক ‘লোহার চালের বাটি’ (চিনা উপমা),  তাতে কী এসে যায়, উন্নয়ন হলেই হল। কারণ অর্থ ও ক্ষমতার মালিকরা এই ফরমানই জারি করেছে – তা আমাদের মানতে হবে। নাহলে তারা আমাদের দেশে বিনিয়োগ করবে না।

ডানে-বামে পাশাপাশি

                  শাসক শ্রেণির দল হিসেবে যারা পরিচিত, তাদের থেকে খানিকটা দূরে ( বিপরীত মেরুতে নয়) যে সব বামপন্থী দলরা তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে, তাদের এই বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ নিয়ে নীতিগত কোন আপত্তি নেই। তাদের একটাই আপত্তি – এই পুঁজি যাতে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ না হয়, সরাসরি শিল্পদ্যোগে আসে। সরাসরি বিনিয়োগে হয়ত সামান্য কিছু কর্মসংস্থান হয়, কিছু এলাকায় বিদ্যুৎবাতি জ্বলে, কারখানাকে কেন্দ্র করে কিছু রাস্তাঘাট হয়, এই রাস্তায় উপরতলার কর্মীদের নানাবিধ গাড়ি চলে। কিন্তু যা হয় না তা হলো – দারিদ্রদূরীকরণ, মজুরদের ন্যূনতম মজুরির সংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা, লাখ লাখ পেন্সনারদের বেঁচে থাকার গ্যারান্টি, গণ-ক্ষমতায়ন ইত্যাদি। এই অসংখ্য না-হওয়ার তালিকার শেষে যে বিষয়টি গম্ভীর সামজিক ব্যাধির জন্ম দেওয়ার জন্য একমাত্র হওয়ার তালিকায় যুক্ত হয় তা হল – অসাম্য বৃদ্ধি। কারণ এই বিনিয়োগ থেকে অতি-মুনাফা করাটাই যখন লক্ষ্য, তখন বিনিয়োগ আসে ‘সেজ’-এলাকাতেই যেখানে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানীদের জন্য এদেশীয় সমস্ত আইন অচল এবং তাদেরকে আনতে হয় জামাই আদর করে সরকারি অর্থ ব্যয়ে নানাবিধ ছাড় দিয়ে।

টানাপোড়েনের জটিল অঙ্ক

                 হওয়া, না-হওয়ার এই তালিকা বানাতে বানাতে পুঁজি-মালিকরা যাতে অপ্রতিরোধ্য গতিতে অগ্রসর হতে পারে – তারজন্যই শ্রমের সংগঠিত ইউনিয়নকে ভেঙে দেওয়া তাদের প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে দেখা দেয়। বেসকারিকরণ ও ক্যাজুয়েলাইজেশনের ধাক্কায় আমাদের পাবলিক সেক্টরগুলোর সংগঠিত ইউনিয়নগুলি মুখ থুবরে পড়েছে – এই ইউনিয়নগুলি এখন শুধুমাত্র ট্রান্সফার-পোস্টিং-এর জন্য ম্যানেজমেন্টের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যম। শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি এই বাস্তবতাকে মেনে নিলেও মেনে নিতে নারাজ নতুন শ্রমিকশ্রেণি যারা ন্যূনতম মজুরি পায় না, যাদের ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়া হয় না। মেনে নিতে নারাজ গরিব আম-জনতা যাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান-রুটি-রুজি-পুষ্টির সংস্থান হয় না। তাই বিদ্রোহ মারুতি-সুজুকি বা বাজাজ কোম্পানীর কারখানা চত্বরে – বিদ্রোহ চা-বাগানে, তাই যে কোন সুযোগে বিদ্রোহে অংশগ্রহণ মেহনতি আমজনতার। এই টানাপোড়েনে সবহারাদের বিফলতা অনেক, আবার সফলতার পাল্লা ভারি হওয়ার সংকেতও অনেক। মারুতি-সুজুকিতে ইউনিয়নের অধিকার আদায়, কাজ-খাদ্যের বিষয়কে মৌলিক আইনি অধিকার করে নেওয়া, জমি অধিগ্রহণে গ্রামসভার মতামতে গুরুত্ত্ব আরোপ ইত্যাদি সফলতার সূচক। দুর্ভিক্ষপীড়িত হিসেবে খ্যাত ওড়িষ্যার কালাহাণ্ডি জেলার লাঞ্জিগড়ে ও ঝারসুগুদা জেলায় মাইনিং প্রজেক্ট খুলেছে বেদান্ত গ্রুপের বেদান্ত এল্যুমিনিয়াম কোম্পানী। সেখানকার আদিবাসীরা তাদের বসতজমি বলপূর্বক কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে জোর লড়াই করে আদায় করে নিয়েছে জমি-অধিগ্রহণে গ্রামসভার অনুমতির আইনি অধিকার। পুঁজি ও ক্ষমতা উদার-অর্থনীতির উন্নয়নের পক্ষে এদের সমর্থন আদায় করে নেবে, না সংগঠিত শ্রমশক্তি নতুন মতাদর্শের ধারক হয়ে উঠবে তা দেখার জন্য আমাদেরকে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। সংগঠিত এই শক্তি যতদিন না সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানোর মত শক্তি সঞ্চয় করে নেবে, ততদিন মাল্টিপ্লেক্স-শপিং মল-হাই স্যালারি ইত্যাদিকেই যারা উন্নয়ন বলে বিবেচনা করে এবং এসব ঠিকঠাক চললে অন্যক্ষেত্রে যারা দুর্নীতিকেই নীতি হিসেবে গণ্য করে তাদের আনুগত্য পাবে উদার-অর্থনীতির প্রবক্তারা, ততদিন অর্থনৈতিক স্বশাসনের ধারণা অর্থহীন হয়েই থাকবে। পরিস্থিতি এরকমই এক জটিল অঙ্কে কষা। তাই আমার মামাকে বলতেই হয় – “বাংলাটা তুই বড় কঠিন লেখচ”।