“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩

মাসিমা (সিরিজ ৩)

।।দ্বীপতনয় ঘোষ।। 

(c)ছবি


















মাসিমা প্লীজ ভুল বুঝবেন না
ধর্মতলার মোড়ে ওভাবে ডিম পারবেন না।

মাসিমা শুভ আর আগের মত নয়
কনভারসের ফিতে আলগা দিয়ে সিকিউলার হয় হঠাৎ
কবিতার প্রতি স্তবকে তার বন্দী হয় কিছু অনুভব
আবার কখনো প্রিয়তমাকে ভালোবেসে
ঠুনকো স্যানিটারি গিফটে হলুদ নিওস্প্রিণ্ট লাগায় লজ্জায়।

মাসিমা ভুল বুঝলেন?
শুভর প্রতিটা দিন কাটে ভালোবেসে
ঝুলে থাকা কালপুরুষের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে
অন্ধ অক্ষম চোখের কালো চশমায় গ্রাস করে নিজের পৃথিবী
শুভর মাথায় ঘোরে কিছু অবান্তর বাস্তব
E= MC²  বা অংকের ইন্টিগ্রেশন ডেরিভেটিভ গুলো মাথায় না ঢুকলেও
শুভ কিন্তু ভালো কবিতা লেখে।   

বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৩

কালো মেয়ে

(c) ছবি
         ।।  বৈশালী ঘোষ।।
বাবার গর্বে গর্বিতা । বরের গর্বে গর্বিতা । ছেলের গর্বে গর্বিতা হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমিই সেই কালো মেয়ে, যার নাম হিয়া।
              ২২ শে বৈশাখ। আজ আমার জন্ম দিন। সকাল সাত টায় আমার জন্ম হয়েছিল। শুনেছি মা খুব কষ্ট পেয়েছিল আমার জন্মের সময়। আমি আমার মা,বাবার দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম ছেলের পর বাবা,মা মেয়েরই আশা করেছিলেন। আর তাদের আশার ফল হলাম আমি।
           আমার বাবার বাড়ির সবাই বেশ কালোর দিকে। দাদু ও ঠাম্মা ফর্সা না হওয়ার জন্য, ফুল ফ্যামিলি  সেই ট্রেন্ড টাই বজায় রেখেছে। দাদুর চার ছেলের বউই ফর্সা হয়েছিল। না না,ওটা দাদু মাথায় রেখে মেয়ে দেখতে যেতেন না। ওটা হয়ে যেত। তাই বড়মা, মেজমা, ছোটমা আর আমার মা চার জনই বলতে পারেন দুধে আলতায়। কিন্ত ভবিতব্য কে কি আর বদলানো যায়। তাই আমরা সব ভাই বোনই ঠিক কালো নয় কিন্ত একটা চাপা রং পেলাম।
                ও যা বলছিলাম, অনেক আশার পর আমার জন্ম। হসপিটালে নানা আত্মীয় স্বজন আমায় দেখতে এসেছিলেন। আমি খুব ফর্সা হয়েছিলাম। মা,বাবা খুব খুশি।  না, ওটা বলা উচিত হবেনা যে আমি ফর্সা বলেই ওরা খুশি হয়েছিলেন। ওরা এমনিতেই খুশি ছিলেন। দাদুর মুখ টাও নাকি বেশ খুশি খুশি ছিল বলে শুনেছি।
               আমি যখন দু'দিনের, তখন আমার এক পিসেমশাই আমায় দেখতে এলেন। এসেই তিনি আমার কান উলটে দেখলেন আর ভবিষ্যতবাণী করলেন - যতই খুশি হও এই মেয়েও ফ্যামিলি ট্রেন্ডটাই বজায় রাখবে। মানে এর রংও কিছু দিনের মধ্যেই কালোই  হবে। মার মুখটা বেশ গম্ভীর দেখাছিল। বেশ একটা অভিমানের ছায়া। আমার মেয়েকে কালো বলল।
         কিন্তু বিধির বিধান কেউ কি আর বদলাতে  পারে। আমি কিছুদিনের মধ্যেই আমার ফর্সা রং ছেড়ে কালো রং এর দিকে এগোতে লাগলাম।
         আজ আমার মুখে ভাত। মা নিজের নামের সাথে  মিলিয়ে নাম ঠিক করলেন নুপূর। দাদু নামটা শুনেই - নৈব নৈব চ্। বললেন, আমার নাতনী লোকের পায়ে থাকবে, হতেই পারে না। দাদুর উপর কথা বলার সাহস আমাদের বাড়িতে কারুর ছিল না। তাই মা মুখ টা কালো করে আর বাবার দিকে কট্ মট্ করে তাকিয়ে নিজের ইচ্ছের বলিদান দিলেন। আর আমার ছোট পিসি আমার নাম রাখল হিয়া। আমি সেই হিয়া।
           আজ আমি পাঁচ বছরের। বেশ ফুটফুটে একটা মেয়ে। আমার  বাবা আমার সব থেকে কাছের লোক। বাবা মার কাছে আমি মিস্ ইউনিভার্স। কিন্তু পাড়ার লোকের কাছে ততোটাই উল্টো । কারন, আমি যে বড্ড কালো। মা কখন ও জামা কাপড়ের রঙ আমার গায়ের রঙ এর সাথে বিচার করে কিনত না। আর সবসময় বলত – ‘কালো জগতের আলো’। কিন্তু জগত কে এই কথাটা কে বোঝাবে ?
         যে রং এর জামাই পড়তাম, সবাই বলত ‘কী যে হবে ? মেয়েটাকে কিছুতেই তো আর মানায় না ?” অনেক বার মা কে জিগ্গেস করেছি। মা আমি কেন তোমার মত দেখতে হলাম না। মা বলত তুমি বাবার মত, আর যারা বাবার মত হয় ওরা খুব ভাগ্যবতী। আর তাতেই আমি খুশি। ওই ছোট বেলা থেকেই নানা রকমের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।
        এখন আমি বেশ বড়।  বয়স টা হয়ত তেরো। স্কুলে একদিন বন্ধুদের সাথে খেলতে গেলাম মাঠে । রোদে খেলে যখন ক্লাসে ফিরলাম, তখন সবার মুখ লাল। মিস্ ক্লাসে ঢুকেই জিগ্গেস করলেন - কোথায় ছিলে? কিছু বলার আগেই বললেন কি চেহারা বানিয়েছ, রোদে পুড়ে তো একদম লাল। আর আমায় বললেন হিয়া তুমি তো পুরো বেগুনী। ওই  দিন বুঝতে পারলাম কালো মেয়েরা কখনো রোদে পুড়লে লাল হয়না, ওরা হয় বেগুনী।
          এই কালো ফর্সা  দ্বন্দ্ব নিয়ে এবার আমি ইউনিভার্সিটির শেষ ধাপে। বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু হল। আর আমার বাবা মা জীবনের আসল সত্যটা উপলব্ধি করলেন। যে বাবা মার কাছে তাদের মেয়ে মিস্ ইউনিভার্স ছিল, অন্যদের চোখে সে মুহুর্তের মধ্যে একটা কালো সাধারণ মেয়ে হয়ে যাচ্ছিল। দিন যাচ্ছে আর বাবা মার কপালেও ভাজ পড়তে শুরু করল। আমার শিক্ষা, আমার বাকি সব ভালো জিনিষ, আমার রঙ-এর কাছে হেরে যাচ্ছিল। কিন্তু মা’র কথাটাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হল যে ‘বাবার মত দেখতে হলে ভাগ্যবতী হয়’। হিয়া ও ভাগ্যবতী ছিল, ওর জীবনেও একজন এল। যার কাছে ফর্সা বা কালো কোনো মানে রাখে না। মনটাই যার কাছে বড় পাওনা।

রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৩

আবার এসেছি ফিরে



বার এসেছি ফিরে এই কুশিয়ারার তীরে
স্মৃতিমাখা রজনীর রজনীগন্ধা হয়ে,
হাসনাহেনার মত গন্ধ ছড়ায়ে চারিদিকে -
ভোরের দিবাকর হয়ে সোনালি আভা দিয়ে
আবার এসেছি এই খাল, বিল, হাওর ভালবেসে;
হয়তো এসেছি বুরো ধানের মিষ্টি-কাঁচা গন্ধের টানে
কিংবা রাখাল ছেলের বুকফাটা গান শুনব বলে
এসেছি আবার অম্বুবিম্বসম ক্ষণিকের বিরহ কাটিয়ে
বাংলা মায়ের সবুজ শ্যামল রূপ দেখব ভেবে।
কাক, কোকিল, শালিক, পেঁচা, বক আর মাছরাঙা -
দেখব কেমন আছে ওরা এই ভবে,
অথবা রুই, কাতলা, বোয়াল, চিংড়ি আর কই পুঁটি -
কীভাবে সেজেছে ওরা ধনীর খাবার পাতে
সুস্বাদু রেসিপির গন্ধে দালান যাবে ভরে,
ক্ষুধার্ত পথিকের মত আমারও জিভে হয়তো আসবে জল;
অথবা দেখব নাক টিপে বাবুরা যাচ্ছে চলে
কোন পথধারে পর্ণকুটিরে
পচা সিদল-শুকটির গন্ধ পেয়ে।
অথবা দেখব হতাশার বুকে
শুয়ে আছে ভগ্ন ফুটপাতে
অর্ধনগ্ন কোন কঙ্কালসার রিক্সাওয়ালা -
বস্তিতে তার অভাবের সংসার নিভৃতে কাঁদে।
তাইতো আশার প্রদীপ নিয়ে এসেছি আবার
এই নিভৃত নিকুঞ্জ মাঝে তব কাছে।

একটি সড়কের কাহিনি

।।ড০ কফিল আহমেদ চৌধুরী ।।
কটি সড়ক,
সেই বহুকাল থেকে
অনন্ত স্বপ্ন নিয়ে
আর পাঁচটা সড়কের মত —  
পাহাড়ের গা বেয়ে,
ধুসর মাঠের বুক চিরে
চলতে চলতে ভীষণ ক্লান্ত।
শরীরে তার অজস্র ক্ষত,
ক্ষয়িষ্ণু বুকের পাঁজর
মড়মড় করে ভাঙছে অবিরত;
অথচ বয়ে চলেছে
হাজারো গাড়ির কনভয় —
সে তো নিছক চার বা ছয় চাকা নয়,
চাকার কারাভ্যান, অগুনতি চাকা!
নির্মম যাতনার ভা্র বয়ে যায় একা।

পাহাড়ে কখন যে চলবে রেল
নেই তার ঠিকানা;
পরিবহন লবি, আর নেতাদের ঝুলি, 
কোথা যাবে চলি
এই এক দুর্ভাবনা;
মাঝে মাঝে কয় তবু
ব্যথিত পথিক সুহৃদ —
“এই কেন হাল তোমার হে সড়ক সাথি?
কে আছে আজি দেবে তব ঘায়ে মলম মাখি?”

প্রখর রোদে ধু ধু বুকে
উঠে যবে ধুলোর ঝড়
কুড়ির যুবক ষাটের বুড়ো হয়ে বাড়ি ফিরে;
নতুবা,
ডোবা ভেবে ডুব দিতে যায় বালিহাঁস
এক পশলা বৃষ্টিতে।
তাইতো,
বিলাপ করি কহে অভাগা সড়ক
“শুনছো সকলে, বাঁচতে দাও মোরে
নরক হয়ে নয়, সড়ক হিসেবে”। 

 




বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৩

দুই মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ এবং মতুয়া ধর্মান্দোলন নিয়ে একটি প্রাথমিক পাঠ।



         
                                                                      ।। সুশান্ত কর ।।
    
        জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।/ ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।”—কথাটি হরিচাঁদ ঠাকুরের। শুনে যে কারোরই মনে হবে এতো বিবেকানন্দের সেই বিখ্যাত ‘জীবে প্রেম করে যেই জন...’ কথাটির প্রতিধ্বনি। বিবেকানন্দের কথাগুলো যখন ছেপে বেরুচ্ছে এই কথাগুলোও একই সময়ে ছেপে বেরিয়েছে। আছে তারকচন্দ্র সরকারের লেখা ‘শ্রী শ্রী হরিলীলামৃত’ বইতে। যে গুরু হরিচাঁদের জীবনী বইটি, তিনি নিজে কথাটি বলুন বা নাই বলুন, কথাটি তাঁর নামেই চলে। বইটি ছেপে বেরিয়েছে ১৯১৬তে। ‘মতুয়া ধর্মাবলম্বী’দের বাইরে বাকি ভারতীয়তো দূরই, সাধারণ বাঙালি যে হরিচাঁদের এই কথাগুলো জানেন না বিশেষ, তাতে একটা কথাতো স্পষ্ট হয়েই যায় বিবেকানন্দ যতই ভারতবাসীকে ধমকে দিয়ে বলুন, “হে ভারত, ... এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা-এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে?” যতই আহ্বান জানান , “বলমূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই,...” আমরা এর জন্যে বিবেকান্দকে মহীয়ান করে মধ্যবিত্তের নায়ক বানিয়ে দিলাম, ‘ভারতবর্ষ’কে নিয়ে গৌরব করতেও শিখলাম, যাদের তিনি ভাই বলে কাছে টেনে নিতে বললেন, তাদের আদৌ কাছে টেনে নিলাম না। হ্যাঁ, কেউ হয়তো ছায়া মাড়ালাম, ছোঁয়াটা খেলাম, বিপদে আপদে সহায় সম্বল নিয়ে পাশেও দাঁড়ালাম আর গর্ব করে ‘জাত মানিনা’ বলে প্রচারও করে গেলাম। কিন্তু হরিচাঁদ, গুরুচাঁদের মতো কেউ যখন সত্যি কেউ সমস্ত কাপুরুষতা দূর করে মনুষ্যত্ব্ব অর্জনের জন্যে মাথাতুলে দাঁড়াতে চাইলেন বাকিদের থেকে পেলেন শুধু প্রবল উপেক্ষা । ভারতীয় জাতীয়তার আদর্শে তাঁদের নায়কের সম্মান জুটল না। স্কুল কলেজের মহাপুরুষের জীবনীতেও তাঁরা রইলেন ব্রাত্য। অথচ উনিশ শতকে কলকাতা শহরের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধেভোগীরা যখন বিচিত্র ধর্মসংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন, বাকি বাংলাদেশে সুবিধে বঞ্চিত হিন্দু দলিত এবং মুসলমান প্রজারাও ওয়াহাবী, তারিখ এ মুহম্মদীয়া ,ফারায়েজি, বলাহাড়ি, কর্তাভজা, মতুয়া ইত্যাদি নানা নামে বিচিত্র সব ধর্মসংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন যেগুলো অচিরেই এক একটি রাজনৈতিক আন্দোলনেরও চেহারা নিচ্ছিল। এগুলোর মধ্যে মতুয়া একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ধর্মসংস্কার আন্দোলন যা এখনো ভারতবর্ষে এবং বাংলাদেশে সজীব এবং সক্রিয়।
      
অবিভক্ত বাংলাদেশের পূববাংলা অংশে সবচে বড় জনগোষ্ঠীটির নাম নমশূদ্র। অনেকে বলেন, পূব বাংলার ধর্মান্তরিত মুসলমানদেরও অধিকাংশ আদতে এই নমশূদ্র জনগোষ্ঠীরই ছিলেন। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে গোটা বাংলাতে এরা দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী ছিলেন। বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মন সিংহ, যশোর, আর খুলনা এই ক’টি জেলাতেই ৭৫শতাংশ নমশূদ্র মানুষ বাস করতেন । এছাড়াও অন্যান্য জেলাতে , মায়, সিলেটেও নমশূদ্র বসতি নিতান্ত ফেলনা ছিল না। ১৯১১র আদমসুমারিতেই প্রথম বহু সংগ্রামের পর এদের প্রচলিত জাতিনাম ‘চণ্ডাল’ মুছে যায়। এর আগে অব্দি এরা এই নামেই পরিচিত ছিলেন। এবং বাকি বাঙালি হিন্দুরা এদের অস্পৃশ্য বলে মনে করতেন, বা এখনো মনে করে থাকেন । স্মার্তকার রঘুনন্দনের নির্দেশে এদের সঙ্গে বিবাহাদিতো দূর, পংক্তিভোজনও এড়িয়ে চলত উঁচুবর্ণের বাঙালি। ১৯১১র আদমসুমারি অব্দি দেখা গেছে নমশূদ্রদের ৭৮ শতাংশ মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি। এবং এই কৃষিজীবিদের মাত্র ১.১৫ শতাংশ মানুষ নিজেরা খাজনা পেতেন। তারমানে মোটের উপরে এরা শ্রেণি এবং বর্ণ দু’দিক থেকেই ছিলেন দলিত। যে জমিদারদের অধীনে প্রজা হয়ে থাকতেন তাদের অধিকাংশই বর্ণহিন্দু, সামান্য কিছু সৈয়দ মুসলমান । শেখর বন্দ্যোপাধায় লিখেছেন, “ বাংলার কৃষিসমাজে বড় যে বিভেদ তা হলো ‘খাজনাভোগী’ এবং ‘খাজনা প্রদানকারী’দের মধ্যে, এই এই ক্ষেত্রে তা নিখুঁতভাবে মিলে গিয়েছিল জাতিভেদের সঙ্গে। এই বিভেদ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলত নানাধরণের অত্যাচারের ফলে। তারমধ্যে ছিল মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ, বেআইনী কর আদায়, খাজনার বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি সহজ নগদ খাজনার বদলে উঁচুহারে খাজনা আদায় করা।” এর মধ্যেও একটি ছোট গোষ্ঠী নিশ্চয়ই নানা ছোটখাটো ব্যবসা এবং মহাজনী কারবার ইত্যাদি করে সামাজিক মর্যাদার উপরের স্তরে উঠেছিলেন। “তবে ১৯১১সালে এই বর্ধিষ্ণু গোষ্ঠী গোটা নমশূদ্র জাতির জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম ছিলেন” এই শ্রেণিটি সংখ্যার দিক থেকেও কম ছিলেন, বাকি মহাজন শ্রেণি বন্ধুদের থেকেও অতি দুর্বল ছিলেন। সবচে’ বড় কথা “...সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়ে ছিলেন এতো নিচের দিকে , যে তাঁরাও উঁচুজাতের ভদ্রলোকের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম ভাবতে পারতেন না।” তখনকার নানা ধরণের কৃষক বিদ্রোহ এবং ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে এদের পরিচয় ঘটছিল। কিন্তু বিশ শতকের গোড়াতে যাদের নেতৃত্বে বাংলাভাগের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে উঠছিল এবং সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ রূপ পাচ্ছিল, শ্রেণি এবং বর্ণ দু’দিককার স্বার্থেই এরা তার সঙ্গে কোন ধরণের আত্মীয়তা খোঁজে পান নিফলে কলকাতা কেন্দ্রিক যেসব ধর্মসংস্কার আন্দোলন সেগুলোর প্রতিও কোনদিনই এরা আকর্ষণ বোধ করেন নি। বিবেকানন্দ , অরবিন্দ এদের নেতা হয়ে উঠতে পারেন নি কিছুতেই, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশব সেনদের তো প্রশ্নই উঠে না।
           চাইলেই যে অন্ত্যজ জাতবর্ণের শ্রেণিগতভাবে উপরের লোকেরা বর্ণগতভাবে উপরের লোকজনের কাছাকাছি আসতে পারেন না, এর নজির দিতে গিয়ে শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ১৮৭২-৭৩, এই সময়ে এক বিশিষ্ট নমশূদ্র গ্রামীণ নেতার মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উঁচুজাতের লোকেরা আসতে অস্বীকার করেন। তার প্রতিবাদে ফরিদপুর –বাখরগঞ্জ এলাকার সমস্ত নমশূদ্ররা এই উঁচুজাতের সঙ্গে সমস্ত সামাজিক , অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করেন। এই লড়াই প্রায় ছ’মাস চলে। এই লড়াইএর সফলতা কিম্বা বিফলতাই তাঁদের উদ্বুদ্ধ করে নতুন ধর্মসম্প্রদায়ে নিজেদের সংগঠিত করতে। যার নাম ‘মতুয়া।’ এই ধর্মীয় লড়াই এক সময়ে এর প্রবর্তকের পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে আরো এগিয়ে যায় এবং ক্রমেই এক স্পষ্ট রাজনৈতিক রূপ পেতে থাকে। সেই রূপ পূর্ণতা পায় ১৯১২তে Bengal Namasudra Association গঠনের মধ্যি দিয়ে। যা ক্রমে গিয়ে নানা বাঁকে এবং ফাঁকে আম্বেদকারের নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় দলিত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়েছিল। এবং এখনো জড়িয়ে আছে। সেই ইতিবৃত্ত অন্য। আপাতত শুধু একটি তথ্যের উল্লেখ করব যে ১৯১১র আদমসুমারির পরে ১৯৩৬ অব্দি এই ‘শূদ্র’ শব্দটি বাদ দেবার জন্যেও অনেকে লড়েছিলেন। সফল হয়েছিলেন বলে কোন তথ্য আমাদের হাতে নেই। শেখর অবশ্যি ফরিদপুর জেলার গ্রামীণ নেতার নাম করেন নি। নাম করেননি গুরুচাঁদের বাবা হরিচাঁদের। মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক তিনিই । এবং সে আরো আগের ঘটনা। সুতরাং শেখর ঠিক কার মায়ের শ্রাদ্ধের ঘটনা লিখেছেন আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।
               ১৮১২সনের ১১ মার্চ এখনকার বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার ওঢ়াকান্দির পাশে সাফলিডাঙ্গা গ্রামে জন্ম নেন হরিচাঁদ ঠাকুর। তাঁর বাবার নাম ছিল যশোবন্ত ঠাকুর, মা অন্নপূর্ণা। পাঁচ সন্তানের তিনি দ্বিতীয়। তিনি ‘হরিনামে মুক্তি’ কথাটা বাকি বৈষ্ণবদের মতো প্রচার করলেন বটে কিন্তু সেই মুক্তিতত্ত্ব বাকি সহজিয়া বৈষ্ণবদের থেকেও সহজ। ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব’দের থেকে একেবারেই ভিন্ন। তাই এর নামও ভিন্ন। হরিনামে মাতোয়ারা—এমন এক ধারণার থেকে ধর্মসম্প্রদায়টির নাম হলো ‘মতুয়া’বর্ণগত ভাবে এঁরা মূলত বাঙালি দলিত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোক, যদিও মতুয়া ধর্মে অন্যান্য বর্ণের লোকেরাও অনেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন । মতুয়া ধর্মের মূল কথাগুলো বোঝা খুব কঠিন নয়। বৌদ্ধধর্মের অষ্টাঙ্গিক মার্গের আদলে হরিচাঁদেরও ছিল দ্বাদশ আজ্ঞাঃ ১) সদা সত্য কথা বলা ২) পরস্ত্রীকে মাতৃজ্ঞান করা ৩) পিতা মাতাকে ভক্তি করা ৪) জগতকে প্রেমদান করা। ৫) পবিত্র চরিত্র ব্যাক্তির প্রতি জাতিভেদ না করা ৬) কারো ধর্ম নিন্দা না করা ৭) বাহ্য অঙ্গে সাধু সাজ ত্যাগ করা ৮) শ্রীহরি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা। ৯) ষড় রিপুর থেকে সাবধান থাকা ১০) হাতে কাজ মুখে নাম করা। ১১) দৈনিক প্রার্থনা করা।১২) ঈশ্বরে আত্ম দান করা সম্প্রতি এই ধর্মনিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে , তর্ক বিতর্কও হচ্ছে ‘মতুয়া’ সমাজের বাইরেও, ভেতরেতো বটেই। কিন্তু হরিচাঁদের জীবৎকালে লিখিতভাবে কোন ধর্মাদেশ দাঁড় করাবার চেষ্টা ছিল না। তারক সরকারের ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ বইটি লেখা হলেও প্রকাশের অনুমতি দেন নি হরিচাঁদ । বস্তুত পছন্দও করেন নি। সুতরাং তাঁর ধর্মমত ছড়িয়েছিল লোকের মুখে মুখে, স্মৃতিতে, গানে, কীর্তন আসরে। বৈদিক অবতারতত্ত্ব, পাপ পুণ্য, স্বর্গ নরক, আচার বিচার কিছুতেই আস্থা রাখতেন না তারা। এমনকি যে ‘হরি’নামের কথা বলা হচ্ছে তিনিও বৈষ্ণব হরির থেকে ভিন্নঅনেকের মতে মতুয়া ধর্ম আসলে বাংলাদেশের প্রাক-বৈদিক বৌদ্ধধর্মের পুনরুত্থিত, পুণর্নির্মিত রূপ। একত্রে অনেকে মিলে নাম করলে প্রেমবোধ জাগে তাই এই নাম নেয়া। শ্রী শ্রী হরিলীলামৃতে’ও আছে, “বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য/ যশোবন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ।”
            ১৮৩৩ নাগাদ প্রায় একুশ বছর বয়সে হরিচাঁদ স্থানীয় জমিদার এবং ব্রাহ্মণ্যশাসকদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে জন্মগ্রাম ছেড়ে ওড়াকান্দি চলে আসেন। জমিদারদের দরিদ্র কৃষক লুণ্ঠনের ব্যাপারটিতো তিনি জানতেনই। কিন্তু এখানে এসেই তিনি উপলব্ধি করেন কলকাতার জমিদারদের বিলাসবৈভবের রহস্য। মাত্র তিনমাসের খোরাকি দিয়ে এরা গোটা বছর কৃষকের ঘাম ঝরিয়ে নিত। বেগার খাটাতো। এমনকি দাসের বাজারে কেনাবেচাও করে দিত গরীব চাষাদের। ১৮৪৬ নাগাদ এই দাসব্যবসা বন্ধ করে ফেলা ছিল মতুয়াদের প্রথম বড় সাফল্য। ‘শাস্তিবিক্রি’ নামে একটি অদ্ভূৎ প্রথা চালু ছিল বাংলাদেশে বাবু জমিদারেররা খুন-রাহাজানির মামলাতে জড়ালে দলিত অন্ত্যজ লোকেদের লোভ কিম্বা ভয় দেখিয়ে নিজের কাঁধে দায় নিয়ে বাবুদের বাঁচিয়ে দিতে বাধ্য করা হতো। হরিচাঁদের নেতৃত্বে এই কুপ্রথা এবং সেই সঙ্গে নরবলির বিরুদ্ধে প্রচার আন্দোলন শুরু হয়। লেখাই বাহুল্য যে নরবলির শিকার হতেন এই নমশূদ্রদের মতো দলিতেরাই। ফলে আশপাশের বিভিন্ন জেলাতে মতুয়াদের কথা ছড়িয়ে পড়ে।
    
      ধর্ম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করবার ব্যাপারটি একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন এবং তা এর জন্যেই যে সামন্তসমাজে দু’টিকে আলাদা করে দেখাই কঠিন । যে মধ্যবিত্তরা শরৎচন্দের ‘মহেশ’ গল্পটি পড়েছেন তারা দেখেছেন কীভাবে জমিদারের জমির লোভের প্রকাশ ব্রাহ্মণের শাস্ত্রের দোহাই হয়ে প্রকাশ পায়। তাই একুশশতকের কিছু শহুরে মধ্যবিত্ত যখন নির্বিচারের এই সব দলিতদের রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে ধর্মের বিচ্ছেদ আশা করেন, তখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসলেই তারা সামন্তপ্রভুদের স্বার্থকে সুরক্ষা দেন তখনকারতো বটেই এখনো, বহু দলিত-আদিবাসী আন্দোলন থেকে তাই রাজনৈতিক কর্মসূচী এবং ধর্মের বিকাশকে স্বতন্ত্র করে দেখা এক কঠিন কাজ। লালন ফকিরকেও জমিদার শাসনের বিরুদ্ধে লাঠি নিতে হয়ে ছিল , তাও আবার যে সে নয়-- একেবারে বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের বিরুদ্ধে। লালন ফকিরের গানগুলোতে সহজিয়া দেহতত্ত্ব আবিষ্কার করে আজকের বহু মধ্যবিত্ত মুগ্ধতার মধ্যে কিছু সত্য নিশ্চয় আছে, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’ –র মতো গানের মধ্যে জাতবর্ণ বিরোধিতার তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সন্ধানের মধ্যেও মিথ্যা কিছু নেই। কিন্তু এর মধ্যে আটকে থাকাটি হচ্ছে এক চূড়ান্ত মধ্যবিত্ত ভণ্ডামীকেউ ব্যক্তিগতভাবে জাত না মানাবার দাবি করলেই জাত সংসার থেকে বিদেয় নেয় না। কথা হলো তার বিরুদ্ধে কোন সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছে কিনা। চাইলেই সেই প্রতিরোধের বাস্তবতা সর্বত্র নাও থাকতে পারে, তখন গ্রামীণ কৃষক সমাজে দেখা দেন লালনের মতো ব্যক্তিত্ব তিনি প্রতিবাদী, কিন্তু নিষ্ক্রিয় প্রতিবাদী। উল্টোদিক থেকে এমন প্রতিরোধ গড়ে উঠার সম্ভাবনা মাত্রকে নিরাকরণ করবার প্রয়াস চিরদিনই ছিল উচ্চবর্ণের দিক থেকে। দলিতদের উত্থান বিবেকানন্দকেও বিচলিত করছিল, কিন্তু তাঁর সমস্যা ছিল অন্যদিক থেকে। এগুলোকে তিনি সর্বভারতীয় জাতীয়তা নির্মাণের বাধা হিসেবে দেখছিলেন। তাই একদিকে যেমন উঁচু বর্ণের লোকদের ডেকে বলছেন, বলো চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই! অন্যদিক থেকে এই প্রশ্নও করছেন ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠা দেখে এতো ঈর্ষান্বিত হবার কি আছে? সংস্কৃত গ্রন্থাদি পড়ে তাদের টেক্কা দিলেই হলো। তিনি আশা করছেন, মৎসজীবির কাছে গিয়ে কেউ বেদান্ত ব্যাখ্যা করলেই সবার ভেতরে একই ঈশ্বর দেখে মৎসজীবি মুগ্ধ হয়ে যাবে।কিন্তু এই কথাটি যে মৎসজীবির থেকে বেদান্তবাদী পণ্ডিত এবং তাঁদের অনুগামী শাসকশ্রেণির লোকেদের বেশি করে বোঝা দরকার, এবং না বুঝলে তার বিরুদ্ধে রীতিমত সংগঠিত প্রতিবাদটি দরকার এই সত্য বিবেকানন্দ বুঝতে চেয়েছেন বলে মনে হয় না। বরং এমন প্রতিবাদে কোন লাভ হবার নয় বলেই তিনি মত ব্যক্ত করেছেন, বৃটিশভারত বর্ণব্যবস্থাটিকে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলেছে বলে প্রশংসাও করছেন। যখন কিনা, বিনয় ঘোষের মতো মার্ক্সবাদী সমাজবিজ্ঞানীরা ১৯৭৮এ এসেও বৃটিশ ভারতে জাতবর্ণব্যবস্থা বিলীন হয়ে যাবে বলে স্বয়ং কার্ল মার্ক্সের অনুমানকেও নাকচ করে এক নতুন অধ্যায় জুড়ছেন তাঁর তিন দশক আগের লেখা ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্রন্থে । হরিচাঁদ এবং তাঁর পরে গুরুচাঁদ সেই সংগঠিত প্রতিবাদের পথ ধরেছিলেন বলেই তাদের ধর্ম রাজনীতির চেহারা নিচ্ছিল, রাজনীতি ধর্মের। সেই প্রতিবাদের পথ ধরেছিলেন বলেই, বাকি বাঙালি সমাজ তাদের সম্পর্কে লালন করেছে এক আশ্চর্য নীরবতার নীতি।
           সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন বলেই, হরিচাঁদ কাউকে সন্ন্যাস নিতে বা তীর্থে যেতে মানা করেন। ‘শ্রী শ্রী হরিলীলামৃতে’ লেখা হচ্ছে, “সংসারে থেকে যার হয় ভাবোদয়। সেই সে পরম সাধু জানিবে নিশ্চয়।” সংসার এবং মানুষের বাইরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলা হচ্ছে, “যে যাহারে ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর/ভক্তিযোগে সেই তার স্বয়ং অবতার” কিম্বা, “বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর/যে যাহারে উদ্ধার করে সে তাহার ঈশ্বরসুতরাং কোন দীক্ষাও নেই, নেই গুরু গোঁসাই, “দীক্ষা নাই করিবে না তীর্থ পর্যটন।/ মুক্তি স্পৃহাশূণ্য নাই সাধন ভজন।।” গুরু গোঁসাই সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে হরিচাঁদের উক্তি, “ কোথায় ব্রাহ্মণ দেখো কোথায় বৈষ্ণব।/ স্বার্থবশে অর্থলোভী যত ভণ্ড সব।।” গুরু গোঁসাইদের শাস্ত্রানুশাসনকে অমান্য করে তাঁর চরম অবস্থান, “ কুক্কুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই।/ বেদাবিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই।।” এগুলো শুধু ব্রাহ্মণেরাই সহ্য করবেন না এমনতো নয়, গোটা সামন্তসমাজের শাসন মানিয়ে নেবার প্রাথমিক সর্ত এগুলো। স্বাভাবিক ভাবেই নিন্দা, অপপ্রচার, লাঠিয়াল দিয়ে পেটানো, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, পুকুরে বিষ দেয়া, জোরে মাঠের ধান কেটে নিয়ে চলে যাওয়া এবং সর্বোপরি সামাজিক বয়কট হলো মতুয়াদের শায়েস্তা করবার জন্যে সামন্তশ্রেণির হাতিয়ার। বিপরীতে বাধ্য হয়ে লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তুলতে হয়েছিল মতুয়াদের। এর সঙ্গে ছিল নীলকর সাহেব এবং নায়েব গোমস্তাদের অত্যাচার। একবারতো এমন কিছু নায়েব এবং সাহেবদের নীলের কড়াইতে ফেলে সেদ্ধ করে ফেলেন এই লাঠিয়ালরা। সংকটে দীর্ণ মতুয়াদের বিয়ে শ্রাদ্ধে ব্যয় কমাতে নির্দেশ দিলেন হরিচাঁদ, “ বিবাহ শ্রাদ্ধেতে সবে কর ব্যয় হ্রাস।/ শক্তির চালনা, সবে রাখো বারমাস।।” উৎপাদন ব্যবস্থার উপর চাষীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়েও ভেবেছিলেন তিনি, “মন দিয়ে কৃষি কর, পূজ মাটি মায়।/ মনে রেখো বেঁচে আছ মাটির কৃপায়।।” চাষাদের আত্মমর্যাদাবোধ এবং আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াতে বছরে তিনবার ফসল ফলাতে উদ্বুদ্ধ করলেন, “ সর্বকার্য হতে শ্রেষ্ঠ কৃষি কার্য হয়।/ ত্রিফলা না করা আমাদের ভাল নয়।।” উদবৃত্ত অর্থকে ব্যবসায়ে খাটিয়ে ধনলাভে উৎসাহিত করতে নিজে শিখে অন্যকে শেখাতে শুরু করলেন, দরকারে অনেককে টাকা ধার দিতেও শুরু করলেন, “ নিজহাতে ব্যবসা করেন হরিচাঁদ/বাণিজ্য প্রণালী শিক্ষা সবে কৈল দান।।”
     
      পুত্র গুরুচাঁদকে উত্তর দায়িত্ব সমঝে দিয়ে ১৮৭৮এ হরিচাঁদ মারা যান। গুরুচাঁদের জন্ম ওড়াকান্দিতে ১৮৪৪এ তিনি মারা যান ১৯৩৭এ বাবা-ছেলের জীবৎ কাল ১২৫ বছর থেকে হরিচাঁদের ছেলেবেলার প্রথম একুশ বছর বাদ দিলেও বলা চলে উনিশ-বিশ শতকের একশত বছর জুড়ে মতুয়া ধর্মান্দোলন ছিল বাংলার অন্যতম প্রধান ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। যদি ব্রাহ্ম ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের কথা মনে রাখি, তবে এতো দীর্ঘ নির্বিরোধ জীবন সেই ধর্মের ছিল না। এতো বিশাল সামাজিক সমর্থনও ছিল না ব্রাহ্মধর্মের তারপরেও ব্রাহ্মদের চিনি, মতুয়াদের না
            দায়িত্ব নিয়েই গুরুচাঁদ শিক্ষা বিস্তারে মন দিলেন। নিজের বাড়িতে পাঠশালা খুলে শুরু করলেন। তাঁর সম্পর্কে জানবার নির্ভরযোগ্য প্রথমবইটি লেখেন মহানন্দ হালদার, নাম শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত’ এটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৩এগুরুচাঁদ সবাইকে নির্দেশ দিলেন, “সবাকারে বলি আমি যদি মানো মোরে।/ অবিদ্বান পুত্র যেন নাহি থাকে ঘরে।।” এই শিক্ষান্দোলনের পাশে তিনি বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে কাছে টেনে নেন। “নম সাহা তেলি মালি আর কুম্ভকার।/ কাপালি মাহিষ্য দাস চামার কামার। পোদ আসে তাঁতি আসে আসে মালাকার।/ কতই মুসলমান আসে ঠিক নাহি তার।।” মেয়েদের জন্যেও সমানে আলাদা উদ্যোগ নেন, “ নারী শিক্ষার তরে প্রভু আপন আলয় শান্তি সত্যভামা নামে স্কুল গড়ি দেয়।।” রবীন্দ্রনাথ যেমন শ্রীনিকেতনের প্রথম দিককার দিন গুলোতে বৃটিশ কৃষিবিজ্ঞানী এবং সমাজসেবি লিওনার্ড এলমহার্ষ্টকে নিয়ে এসছিলেন, গুরুচাঁদ তেমনি এক অস্ট্রেলিয় মিশনারি ডাঃ সি.এস.মিডকে সঙ্গে পেয়ে যানদরিদ্র অন্ত্যজদের মধ্যে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ছড়াবার ব্যাপারে এই ভদ্রলোক ছিলেন আন্তরিক। তাঁর বিরুদ্ধে খৃষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করবার অপপ্রচার ছিল, কিন্তু স্বপক্ষে সাক্ষী বেশি নেই। বরং ১৯০৬ থেকে গুরুচাঁদের সঙ্গে আলাপ এবং বন্ধুত্বের পরে থেকে সেই সম্পর্ক ছিল অটুট। শুধু তাই নয়, ১৯০৮এ ওড়াকান্দিতে এই দু’জনের প্রচেষ্টাতে যে উচ্চ ইংরাজি স্কুল যাত্রা শুরু করে শতাব্দ প্রাচীন সেই স্কুলের নাম ‘ওড়াকান্দি মিড হাইস্কুল’ রেখে মতুয়ারা তাঁকে স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মিড অভিজ্ঞ মানুষ, তার উপর সরকারি মহলে তাঁর খাতির ছিল। গুরুচাঁদ বুঝেছিলেন তিনি যে কাজ করতে যাচ্ছেন তাতে দু’টোরই সমান দরকার। তাঁর সেই বোধে ত্রুটি ছিল না, ঘটনাক্রম তা প্রমাণ করেছে। নারী-পুরুষদের জন্যে আলাদা স্বাস্থ্যকেন্দ্রও গড়ে উঠতে শুরু করল ওড়াকান্দি এবং আশপাশের এলাকাতে। একই সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে চলে বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ বিরোধী প্রচার আন্দোলন। তখন থেকেই নমশূদ্র শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের জন্যে সরাকারি চাকরিতে ভাগীদারির দাবি উঠতে থাকলে অনেকেই মনুর বিধান শুনিয়ে আটকে দিচ্ছিলেন। ১৯০৭এ সরকার প্রথম আইন করে অন্ত্যজ এবং মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের ছেলে শশীভূষণ ঠাকুর সাবরেজিস্টার পদে যোগ দিতে পারেন । এর আগে নানা ভাবে চেষ্টা করেও তিনি কোন চাকরি পেতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। ১৯০৮এ কুমুদ বিহারি মল্লিক ডেপুটি রেজিস্টার পরে এবং তারিনী বল সরকারি ডাক্তার হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন।
          ‘চণ্ডাল’রা সরকারি চাকরিতে আসছেন, পঞ্চায়েত পুরসভাতে যোগ দেবার সম্ভাবনা বাড়ছে এই ব্যাপারটি উঁচু বর্ণের লোকেরা ভালোভাবে নিচ্ছিলেন না। স্বাভাবিক ভাবেই মনুর বিধান ডিঙিয়ে সাহেবদের প্রশ্রয়ে অন্ত্যজ বর্ণের মানুষের ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় মর্যাদাতে উন্নীত হবার আকাঙ্খা দাবিও বাড়তে থাকে। জয়া চ্যাটার্জী লিখেছেন, ১৯১১তে আদমশুমারি কর্তৃপক্ষের কাছে এমন দাবি জানিয়ে এতো সব জনগোষ্ঠী স্মারকপত্র জমা দেন যে সব মিলিয়ে এগুলো ওজনে দাঁড়িয়েছিল এক মণের বেশি। নমঃশূদ্ররা তখন নিজেদের কায়স্থ বলে দাবি করলে কায়স্থরা সেটির বিরোধিতা করেন। তাতে কায়স্থদের সামাজিক ভাবে বয়কট করেন নমঃশূদ্ররা। গোয়ালারা নিজেদের বৈশ্য বলে দাবি করলে সভ্রান্ত হিন্দুরা অনেকে গোয়ালাদের ছেড়ে মুসলমানদের থেকে দুধ কিনে খেতে শুরু করেন। ১০ ডাঃ মিডকে পাশে নিয়ে তখন অন্তত চণ্ডাল’দের জন্যে ‘নমঃশূদ্র’ নামটি আদায় করে নিতে সমর্থ হন গুরুচাঁদ।
          যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল একেবারেই ধর্মসংস্কার এবং কৃষকবিদ্রোহের রূপে সেটি তখন রীতিমত আইনী রাজনৈতিক সংগ্রামের দিকে এগুতে শুরু করে। গুরুচাঁদ অনুভব করেন, “ যে জাতির দল নেই/সেই জাতির বল নেই/ যে জাতির রাজা নেই/ সে জাতি তাজা নেই।” তাঁর আহ্বান, “বিদ্যা যদি পাও কাহারে ডরাও/ কার দ্বারে চাও ভিক্ষা।/ রাজশক্তি পাবে বেদনা ঘুচিবে/ কালে হবে সে পরীক্ষা।” সে রাজনীতি গুরুচাঁদের মৃত্যু অব্দি পরিচালিত হয়েছিল একেবারেই কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জাতীয় আন্দোলনের বিরুদ্ধে। বরং ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে শুরু থেকেই তাদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল এরই ধারাবাহিকতাতে কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন তেভাগা আন্দোলনেরও বড় সমর্থন ভিত্তিটিই ছিলেন এই নমশূদ্ররা বাকি বড় অংশটি রাজবংশী কৃষক।
         ১৯৩৭ গুরুচাঁদের মৃত্যুর আগে পরে মতুয়া ধর্মান্দোলনের যেমন নানা মতভেদ দেখা দিতে শুরু করে তেমনি রাজনৈতিক মত এবং পথও নানা শাখাতে বিভাজিত হয়ে যায়। যে বিভাজন এখনো সমানে সক্রিয়। কিন্তু তারপরেও এটা ঠিক যে গুরুচাঁদের এই উদ্যোগের ফলেই ১৯৩৭এর নির্বাচনে বাংলা থেকে ৩২জন প্রতিনিধি নানা পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর থেকে নির্বাচিত হলে তাঁর মধ্যে ১২জনই ছিলেন নমশূদ্র সম্প্রদায়ের। তাঁদের মধ্যে কয়েকটি নাম ইতিহাস প্রসিদ্ধ—যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, বিরাট চন্দ্র মণ্ডল, প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর প্রমুখ। আম্বেদকারের নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় দলিত আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িয়েছিলেন অনেকে। তাদেরই সমর্থনে আম্বেদকর গণপরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১১ স্বাধীনতার আগের শেষ দশকে যে বিচিত্র রাজনৈতিক ডামাডোলে বাংলাদেশ প্রবেশ করে, তাতে নমশূদ্র সমাজের আগেকার ঐক্য রাখাটাও কঠিন ছিল। তার উপরে শিক্ষিত শ্রেণিটির সংখ্যা বাড়তে থাকাতে তাঁদের অনেকে সাংবিধানিক রাজনীতিতে বেশি করে জড়াতে গিয়ে বাকি কৃষকজনতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সেই নেতৃত্বের কেউ মুসলিম লীগ, কেউ জাতীয় কংগ্রেস এবং অনেকে হিন্দু মহাসভারও ঘনিষ্ট হয়ে পড়েন। বিশেষ করে গুরুচাঁদের পৌত্র প্রমথ ঠাকুরর ভূমিকা তখন থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে। সেটি হতে পারে অধ্যয়নের এক স্বতন্ত্র অধ্যায়। কিন্তু যে দুর্বিপাকের কথাটি না বললেই নয়, তা এই যে হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়া বড় অংশটি আশা করেছিলেন বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, খুলনা ইত্যাদি পূব বাংলার নমশূদ্র অধ্যুষিত জেলাগুলো পশ্চিম বাংলাতে চলে যাবে। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রথমে শরৎ বসু, ফজলুল হকের প্রস্তাবিত ‘অখণ্ড বাংলা’র প্রস্তাবের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন । পরে মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তানের প্রস্তাবের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন । দু’পক্ষই প্রবঞ্চিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানে প্রবঞ্চিত হয়ে পঞ্চাশের গণহত্যার পরে লিয়াকৎ আলি খানের মন্ত্রীসভার থেকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পদত্যাগ এবং ভারতে চলে আসা মাঝেমধ্যে বেশ চর্চিত হয়। বস্তুত দু’দেশের শাসক শ্রেণিই বাধ্য করে নমশূদ্রদের বড় অংশকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে আসতে এবং বাকি বর্ণহিন্দুরা যখন ভারতে নিজের ব্যবস্থা যা হোক একটা করে নিতে সমর্থ হয়েছেন নমশূদ্রদের কিন্তু বাসাবাটির সন্ধানে ছড়িয়ে পড়তে হয়েছে সাগরে আন্দামান থেকে পাহাড়ে উত্তরাখণ্ড অব্দি গোটা ভারতে। অসমেও এসছেন বিশাল সংখ্যক নমশূদ্র মানুষ। সিলেট ভাগের সময়েই এই নমশূদ্রদের অবস্থান ছিল দ্বিধাজড়িত। অনেকেই সিলেট ভাগের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এক দশক আগেও ১৯৩৭-৩৮এ সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমাতে শিমুলঘর গ্রামে বর্ণহিন্দুদের উপস্থিতিতে শুধুমাত্র জুতো পরবার অধিকার আদায়ের জন্যে এক বড়সড় লড়াইতে নামতে হয়েছিল নমশূদ্রদের। যা পরে হিংসাত্মক রূপ নিয়েছিল। ১২ সিলেট গণভোটের সময়ে তাৎক্ষণিক ভাবে পংক্তিভোজনে বসে সেই দলিতদের মন জয় করতে নেমেছিলেন বর্ণহিন্দু নেতৃত্ব। সিলেট ভাগের দায় যারা এক তরফা অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদীদের উপরে চাপান তাঁরা নিজেদের এই দায়কে নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করেন না। এখনো জল জমির অধিকারের সঙ্গে নাগরিক অধিকার, সংরক্ষণ এবং ভাষা সংস্কৃতির জন্যে নমশূদ্রদের লড়ে যেতে হচ্ছে শুধু অসমেই নয়, গোটা ভারতেই অসমে ডি-ভোটার তাদেরকেই বেশি হতে হয়। মরিচঝাঁপির কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে নমশূদ্রদেরই। দেশভাগ এবং বাংলার সবচে’ বড় দলিত জনগোষ্ঠী এই নমশূদ্রদের দেশময় ছড়িয়ে পড়া একটি অন্যতম কারণ যে দেশভাগের আগে বাঙালি সমাজে গড়ে উঠা দলিত আন্দোলন পরবর্তী দশকগুলোতে বেশ চাপা পড়ে গেছিল।
        
         মতুয়া ধর্মান্দোলনে এখন অনেক বিভাজনঅনেকেই হতাশ হয়ে সরাসরি আম্বেদকরের শুরু করা নববৌদ্ধ ধর্মান্দোলনের দিকে ঝুঁকছেন। মতুয়াদের বড় দুই ভাগের একটি শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া মিশনেঅধীনে পরিচালিত হয় এর প্রধান কেন্দ্রটি এখনো বাংলাদেশের ওড়াকান্দিতেই রয়েছে। গুরুচাঁদের পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৌত্র শ্রীপতিপ্রসন্ন ঠাকুর পরম্পরা হয়ে মিশনের নেতৃত্ব এখন রয়েছে পদ্মনাভ ঠাকুরের হাতে। ১৩ শ্রীপতি প্রসন্নের সঙ্গে বিবাদ বাঁধে অপর পৌত্র প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের। তিনি গুরুচাঁদের মৃত্যুর পরে প্রথমে রামদিয়াতে চলে এসে ১৯৪০এ মতুয়া মহাসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রধান কেন্দ্র এখন রয়েছে পশ্চিম বাংলার উত্তর চব্বিশ পরগণার ঠাকুর নগরে। নেতৃত্বে রয়েছেন প্রমথ রঞ্জনের স্ত্রী বীনাপাণি দেবী, যাকে মতুয়ারা ‘বড়মা’ বলে সম্মান করে থাকেন। দু’টো সংগঠনেরই এখন দেশে বিদেশে প্রচুর শাখা রয়েছে।
          ওড়াকান্দির মিশন গুরুচাঁদের জীবিতাবস্থাতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি কতটা তাঁর ইচ্ছেতে এবং কতটা তাঁর পুত্র-পৌত্রেরা চাপ দিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন সেই নিয়ে সন্দেহ আছে। মিশনের সাইটেই অসীম কুমার রায়ের একটি দলিলে লেখা আছে, “শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর প্রস্তাবটি শুনে বলেন এটি করার সময় এখনও হয়নি১৪ ভারতের মতুয়া সঙ্ঘের কাজকর্ম বড়মার অনুগামীদের রাজনৈতিক সারশূন্য ‘উৎসবপ্রীতি’ নিয়ে মতুয়ারাই নানাভাবে প্রশ্ন তুলে থাকেন । বাংলাদেশের মিশনের কাজকর্ম দেখলেও মনে হয় না তাঁরা হরিচাঁদ গুরুচাঁদের আদর্শে আর ততটা টিকে আছেন। মতুয়াদের ব্রাহ্মণ্য ‘সনাতন’ ধর্মের একটি অংশে পরিণত করবার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণ করেছেন। হরিচাঁদ-গুরুচাঁদকে ‘ভগবান’ তুল্য মনে করছেন, ছেলের দেহে বাবার অলৈকিক নিবাসের তত্ত্বে বিশ্বাস ছড়াচ্ছেন, গুরুচাঁদকে ‘শিব’ বলে প্রচার করছেন –এইসবের পরে আর আমরা উপরে মতুয়া হরিচাঁদের যে দ্বাদশ আজ্ঞার কথা জেনে এলাম সেগুলোর কোন মানে থাকে না। মিশন নিয়ে গুরুচাঁদের উপরে পারিবারিক চাপ সৃষ্টির কথা আমরা অহেতুক বলিনি। দেখা যাচ্ছে, সমস্ত ব্রাহ্মণ্য পরম্পরার বিরোধী ব্যক্তিত্ব গুরুচাঁদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রচলন করছেন তাঁর পুত্র পৌত্রেরা এবং সঙ্গে জুটছেন সমাজের প্রভাবশালী ভক্তেরা। অর্থাৎ নিজের পরিবার এবং সমাজের ভেতরেও ব্রাহ্মণ্য অভ্যাসের বিরুদ্ধে তাঁকে লড়তে হচ্ছে নিজের আদর্শকে দাঁড় করাতে গিয়ে। যে দুর্গাপুজা হতো মূলত উঁচু বর্ণের জমিদার জোতদার সরকারি আমলাদের বাড়িতে, সেই পুজো নিজের বাড়িতে করে সামাজিক মর্যাদা বাড়াবার কথা ভাবছেন নতুন আমলাতন্ত্রের শরিক হতে উন্মুখ ছেলেরা। উঁচু বর্ণের বাড়ির পুজোতে অন্ত্যজদের প্রবেশ জুটত না, সুতরাং নিজেরা পুজো করে জবাব দেবেন এই ছিল ইচ্ছে। তার উপর শশীভূষণের চার মেয়ের পরে এক ছেলে প্রমথ রঞ্জন জন্মান।সেই আনন্দে তিনি বাড়িতে দুর্গাপুজোর অনুমতি চাইলে প্রথমে গুরুচাঁদ তা দেন নি। ছেলে অনশন শুরু করলে এবং আরো নানাজনকে দিয়ে চাপে ফেললে বাবা অনুমতি দেন এবং ১৯০২তে প্রথম ওড়াকান্দির বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়। কল্পতরু ভট্টাচার্য বলে এক ব্রাহ্মণ এসে সেই পুজোর দায়িত্বও নিয়ে নেন। তিনি বুঝি চণ্ডীর আদেশ পেয়েছেন স্বপ্নে। ১৫ এই কথা আবার সগৌরবে লেখেন ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত’ প্রণেতা তারকচন্দ্র সরকার। এই ঘটনা দেখায় কোন পথে ব্রাহ্মণ্যবাদ আপসে নামে প্রতিবাদী একটি পন্থার সঙ্গে। ডাঃ মিডের সঙ্গে আলাপের পরে ক’বছর আবার বন্ধ থাকে এই পুজো। কিন্তু আবার পারিবারিক চাপ বাড়ে , “দশভূজা পূজা মোরা করি পুনরায়। , দেবী পূজা হলে তাতে সর্বশক্তি হয়। ” গুরুচাঁদ , “ প্রভু বলে এই কার্য আমি না করিব।/ মরণের ভয়ে শেষে দেবতা ডাকিব।।” কিন্তু চাপের কাছে তাঁকে নতি স্বীকার করতে হয়। ১৯১৪ থেকে আবার পুজো চালু হয়। পুজোর তিনদিন তিনি বাড়িতে থাকতেন না, পুজোর কোন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন না।
            বস্তুর সরলরৈখিক কোন আন্দোলন হতেও পারে না। সেই বৌদ্ধ ধর্মের দিন থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী সমস্ত ধর্মান্দোলন প্রয়াসেই ভারতে দেখা গেছে তাকে ভেতর থেকেও ব্রাহ্মণ্য ধারার সঙ্গে লড়তে হয়েছে। এবং শেষ অব্দি ব্রাহ্মণ্যধারা তাকে গ্রাস করেছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনেও দেখা গেছে নিত্যানন্দ পত্নী জাহ্নবা দেবী রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তির প্রতিষ্ঠা করে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ‘স্বকীয়া-বৈধী’ অভিমতের কাছে আত্মসমর্পণ করলে পরে তাঁর আত্মজ রামচন্দ্র সরে দাঁড়ান মায়ের থেকে। মায়ের গুরু পরম্পরার উত্তরাধিকার বহন করেন সৎ-পুত্র বীরভদ্র। মতুয়া ধর্মে এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল হরিচাঁদের জীবিতাবস্থাতেই। যে ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত’ গ্রন্থটিকে এখন বহু মতুয়া তাঁদের আদি ধর্মগ্রন্থ বলে শ্রদ্ধার সঙ্গে পাঠ এবং অনুসরণ করে থাকেন, সেটি লিখতে মানা করেছিলেন স্বয়ং হরিচাঁদই। কথাটি এই গ্রন্থেই আছে। তারক চন্দ্র সরকারকে কবি নিযুক্ত করে এই গ্রন্থটির পরিকল্পনা আসলে করেছিলেন অন্য দুই ধর্মগুরু মৃত্যঞ্জয় বিশ্বাস এবং দশরথ বিশ্বাস। তাঁরা যখন নিজেরাই খানিক লিখে হরিচাঁদকে পড়িয়ে অনুমোদন আনতে যান, তিনি মানা করে বলেন, “...লীলাগীতি লেখা এবে উচিৎ না হয়।।/ ক্ষান্ত কর লেখালেখি বাহ্য সমাচার।/ অন্তরের মাঝে রাখো আসন আমার।।” একজন যথার্থ বৌদ্ধ-বাউল সহজীয়া পরম্পরার গুরুর মতো নির্দেশ ছিল। জেদ ধরেলে হরিচাঁদ উষ্মা প্রকাশ করেন এই ভাষাতে, “ মহাপ্রভু বলে জান এ কর্ম্মে পুরস্কার।/ কুষ্ঠ ব্যাধি হবে চেষ্টা করিলে আবার।।” এই ঘটনাতে মৃত্যুঞ্জয়-দশরথ জুটি ভয় পান নি, বইটির অষ্টম সংস্করণের ভূমিকাতে আছে মৃত্যঞ্জয় বুঝি এই অভিশাপকে সাদরে গ্রহণ করেন, “সেতো আমার জীবনের লীলাগীতি লেখার পরম পুরস্কার।” ১৬ কিন্তু কবি তারক চন্দ্র সরকার ভয় পেয়ে গেছিলেন। তিনি আধখানা লেখা পাণ্ডুলিপি লুকিয়ে রাখেনপরে যখন শেষ করেন তখন এক ব্রাহ্মণ্য গল্প জুড়ে দেন, সেই পাণ্ডুলিপি বুঝি সরিয়ে ফেলেছিলেন দেবী সরস্বতী হরিচাঁদের মৃত্যুর পরে আবার সেই সরস্বতী স্বপ্নে এসে তাঁকে পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে যান, সেই সঙ্গে গ্রন্থ শেষ করবার জন্যে হরিচাঁদের ইচ্ছে জানিয়ে যান। তাতেও ‘মূঢ়মতি’ তারক খুব উৎসাহ দেখান না লেখা শেষ করতে। শেষে মৃত্যুঞ্জয়-দশরথদের সহযোগী গোলক গোঁসাই এসে জানান, “ স্বপনেতে কেহ যদি পুঁথি করে দান/ সেজন পণ্ডিত হয় পুরাণে প্রমাণ।” আরো জানান, তারকনাথের প্রতি ব্রাহ্মণদের সমর্থন আছে, “ ইতিনায় ভট্টাচার্য পাড়া হয় গান।/ সুকবি বলে তোরে দিয়াছে আখ্যান।” এতো সবেও যখন তারকনাথ সাহসী হন না, তখন গোলক গোঁসাই এক ভোর রাতে রীতিমত নৃসিংহ রূপে এসে তারকনাথের বুকে নখ ঢুকিয়ে শাসিয়ে দিলেন, “ ...বলে তোরে নখে চিরি করি খান খান।/ নৈলে ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত’ পুঁথি আন।।” বোঝা যায়, ইতিমধ্যে মতুয়া ধর্মের জনপ্রিয়তাকে মূলধন করে যারা আখের গোছাতে চাইছিলেন তাঁরা এর রাজনৈতিক সারবস্তুকে বিসর্জন দিয়ে একেবারেই ব্রাহ্মণ্যধারার গুরু হয়ে বসতে উদ্গ্রীব ছিলেন । তাঁরাই প্রবল চাপে এই গ্রন্থ লেখান। আজ অনেক মতুয়া ধর্মাবলম্বী বুদ্ধিজীবিরা একে ‘স্বগোষ্ঠীর প্রতি অমার্জনীয় অপরাধ বলে’ মনে করছেন। এবং নতুন করে ভাবছেন। ১৭ এতো গেল ভেতর থেকে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ চাপের কথা।
          
বড়মাঃবীণাপাণি দেবী
  কিন্তু বাইরে থেকে যে চাপ ছিল, সেটি আরো ভীষণ এবং আরো লজ্জার। হরিচাঁদের জীবিতাবস্থাতে বইটি ছাপার মুখ দেখেনি। তিনি মারা যান ১৯১৪তে। ১৯১৬তে বইটি ছাপান তাঁর কবিয়াল শিষ্য হরিবর সরকার। সম্প্রতি ২০১০এ ডা
: মণীন্দ্রনাথ বিশ্বাসহরি-গুরুচাঁদ চেতনামঞ্চের উদ্যোগে’ হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত’ নামে একটি বই লিখে বের করেছেন সেখানে জানা যাচ্ছে, ‘শ্রীশ্রী হরিলীলামৃতপ্রকাশে গুরুচাঁদেরও আপত্তি ছিল, ছেলে শশীভূষণ ঠাকুরের চাপে সম্মতি দেন। “গুরুচাঁদ সম্মুখেতে আনা হলপুঁথি ।/শশীবাবু প্রতি পাতা দেখে পাতি পাতি ।।/গুরুচাঁদে পড়ে পড়ে শুনাল এ গ্রন্থ ।/গ্রন্থের বন্দনা থেকে একেবারে অন্ত ।।/পড়া শুনে গুরুচাঁদ ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস ।/কিছু কিছু ভাব তত্ত্বে হইল হতাশ ।।... লেখা যায় যাহা ইচ্ছা সাদা কাগজেতে ।/কালি লেখা কাগজেতে লেখে কিবা মতে ।।/সেই মত ভুল তত্ত্ব শেখে যদি জাতি ।/কোনদিনও কাটিবে না এ আঁধার রাতি ।।/ঠিক তত্ত্ব বুঝানো তো হবে বড় দায় ।/আমি সারা হই ভেবে সেই আশঙ্কায়।।” বইটিতে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের ‘মতুয়া’ তত্ত্ব ছিল না তা নয়, কিন্তু আদিঅন্ত ‘বৈদিক অলীক গল্পে’র মিশেল রয়েছে। তার উপর সমস্যা হলো তখন অব্দি যদিও ‘নমশূদ্র সুরিৎ’ এর মতো বহু সাময়িক কাগজ বেরুচ্ছে নানা কেন্দ্র থেকে, তারকচন্দ্রের মতো সম্মানিত কবি ছিলেন না সমাজে । সুতরাং ভবিষ্যত লেখকেরা এর থেকে সত্যিকার কাঠামো একটা দাঁড় করিয়ে দেবেন এই আশাতে গুরুচাঁদ সম্মতি দিয়ে দেন। বাপ-ছেলেতে কথা হয় এরকমঃ “শশী বলে গ্রন্থে বাবা ধোঁয়া যদি রয় ।/গুরুচাঁদ বলে অগ্নি খুঁজিবে নিশ্চয় ।।/শশী বলে থাকে থাক কিছু জল অংশ ।/গুরুচাঁদ বলে ছেঁকে খাবে রাজহংস।।১৮ বইটির প্রকাশিকা অনিতা বিশ্বাস তারক চন্দ্রের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা নিয়েই লিখছেন, প্রবল দারিদ্র্যে তাঁর শৈশব কেটেছে। কবিয়াল পরিবারে জন্মেছেন। বৈদিক কথিকা পাঠ আর গান করেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তার উপর নবদ্বীপের বৈষ্ণবদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। হরিচাঁদের সঙ্গে পরিচয়ের পরেই তাঁর মধ্যে যে বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব শুরু হয় তার ছাপ রয়েছে বইটির পাতায় পাতায়। এই দ্বন্দ্বের জন্যেই বইটি লিখতে তাঁর এতো দ্বিধা ছিল। কিন্তু মূল পাণ্ডুলিপির উপরে কলম চালাতে হয়েছিল সম্পাদক হরিবর সরকারকেও। শ্রীগোপাল বলে এক ভক্ত টাকার যোগান ধরলে হরিবর সরকার কলকাতার প্রেসে প্রেসে ঘোরেন বইটি ছাপাবার জন্যে। কিন্তু কেউই রাজি হয় না। অনেকে এর ‘বেদ-ব্রাহ্মণ সম্মত’ সংস্কার করে আনতে পরামর্শ দেন। “কোলকাতা প্রতি প্রেসে করে অনুরোধ ।/সর্বস্থানে পান তিনি সম প্রতিরোধ ।।/প্রচারে বৈদিক শাস্ত্র ছিল যে সমিতি ।/বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা সপ্তসতী স্মৃতি ।।/ইহাদের ছাড়পত্র আগে প্রয়োজন ।/তবেই করিবে প্রেস এ গ্রন্থ মুদ্রণ ।।” সমিতিটির নাম লেখেননি ডাঃ মনীন্দ্রনাথ বিশ্বাস । কিন্তু তাঁরা অনুমতি দেন নি, “...নিষেধাজ্ঞা জারি করে গ্রন্থ ছাপিবারে ।।/চিহ্নিত করিল গ্রন্থে বহু জায়গার ।/বলে আগে এই সকলি কর সংস্কার ।।/বৌদ্ধতত্ত্ব বুদ্ধকথা না থাকে পুঁথিতে ।/অবৈদিক ভাবধারা হইবে মুছিতে ।।” বিবেকানন্দ বলছিলেন, শূদ্রদের সংস্কৃত অধ্যয়নে মানা করেছে কে! তাঁর মৃত্যুর পরেও ‘নবজাগৃত’ মহানগর কলকাতার ছাপাখানাগুলোর বাস্তবে ছিল এমনি অবস্থান। বিপাকে পড়ে হরিবর গেলেন শ্রীগোপালের সঙ্গে শলা করতে। আম ছাড়া আমসত্ব কী করে তৈরি করবেন তিনি? শ্রীগোপাল টাকা দিতে পারেন, কিন্তু তাঁরও অবদমিত সামাজিক অবস্থান বোঝা যায়, এই উক্তিতে, “পড়িয়াছি হেন ফাঁদে উপায় তো নাই ।।/কিছু কিছু জায়গায় কর সংস্কার ।/দৃষ্টিমাত্রে দৃষ্ট হয় হেন দরকার ।।/স্থুলের ভাবভঙ্গি রাখিও বৈদিক ।/সূক্ষ্মভাবে ঠিক রেখো অবৈদিক দিক ।।/ভাবীকালে সত্য ঠিক খুঁজিবে পাঠক ।/জাতি মাঝে জন্ম লবে তাত্ত্বিক রচক ।।” ১৯ সুতরাং যা দাঁড়ালো, “...লীলামৃতে বহুস্থান সংস্কার করে।।/অলীকের গল্প যাহা গ্রন্থে দেখা দিল /পরিস্থিতি চাপে সব প্রক্ষিপ্ত হইল।।এতো সব করবার পরেও যে প্রেস এক বইটি ছেপেছিল তার ম্যানেজার তাঁদের থেকে কুড়ি টাকা ঘুস নিয়েছিল। সত্যি সত্যি শ্রীগোপাল এই সূক্ষ্মভাবে ‘অবৈদিক দিক’ ঠিক রাখার কথাগুলোই বলেছিলেন কিনা, আজ আর আমাদের জানবার উপায় নেই। কিন্তু একুশ শতকে এসেও যখন একজন নবীন ‘তাত্ত্বিক রচকে’র কলমে এই কথাগুলো পড়ি, তখন মনেতো হয়ই আমাদের ‘অন্ধকার মধ্যযুগে’র বিরুদ্ধে যত ধিক্কার , ‘আলোকিত আধুনিকতা’ নিয়ে যত বড়াই কিম্বা তাত্ত্বিক কচকচানি সবই আসলে পশ্চিমা আদলে নিজেদের স্বার্থে নির্মিত এক কৃত্রিম আখ্যান। যে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রয়োজন হাজার বছর আগেকার বৌদ্ধ কবিদের চর্যাপদের ভাষাকে ‘সান্ধ্যভাষা’ করে ফেলতে বাধ্য করেছিল, তার থেকে স্থানে এবং কালে খুব বেশি একটা এগোইনি আমরা। বাংলার তথা ভারতের ‘নবজাগরণে’র দর্প আমাদের মানায় না।

গ্রন্থসূত্রঃ

১) শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়; উন্নয়ন, বিভাজন ও জাতিঃ বাংলায় নমশূদ্র আন্দোলন, ১৮৭২-১৯৪৭; জাতি,বর্ণ ও বাঙালি সমাজ; সম্পাদনাঃ শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিত দাশগুপ্ত; পৃঃ১২৭।
২) শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়; ঐ;পৃঃ ১২৯।
৩) ঐ ।
৪) ঐ।
৫) অনিতা বিশ্বাস, প্রকাশিকার কথা;"হরিচাঁদতত্ত্বামৃত";ডা: মণীন্দ্রনাথবিশ্বাস; পৃঃXIII;
৬) সমুদ্র বিশ্বাস; গ্রামবাংলার জাগরণে মতুয়া আন্দোলন; চেতনা লহর; এপ্রিল-ডিসেম্বর, ২০১৩ যুগ্মসংখ্যা, সম্পাদক, অনন্ত আচার্য, কলকাতা, পৃঃ ১৩৭ ।
৭) The Future Of India; ; Lectures from Colombo to Almora; Complete-Works ; Volume 3/
৮) Vedanta In Its Application ToIndian Life ;ঐ।
৯) সমুদ্র বিশ্বাস; গ্রামবাংলার জাগরণে মতুয়া আন্দোলন; চেতনা লহর;ঐ; পৃঃ ১৩৯।
১০) জয়া চ্যাটার্জী;হিন্দু ঐক্য এবং মুসলমান স্বেচ্ছাচার, বাংলা ভাগ হলো; দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড; ঢাকা; পৃঃ ২২৬
১১ ) সমুদ্র বিশ্বাস;ঐ; পৃঃ ১৪১;
১২) শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়; ঐ;পৃঃ ১৪০)
১৩) শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া মিশন;
 
১৪) শ্রীশ্রী হরি-গুরুচাঁদ মতুয়া মিশনের সঠিক ইতিহাস;ঐ।
১৫) সমুদ্র বিশ্বাস ; ঐ ; পৃঃ ১৩৩ ।
১৬) দুলাল কৃষ্ণ বিশ্বাস; ‘শ্রী শ্রী হরিলীলামৃত’ এক ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক প্রয়াসঃ প্রসঙ্গ হরিচাঁদ ঠাকুরের নিষেধাজ্ঞা।;চেতনা লহর, এপ্রিল-ডিসেম্বর, ২০১৩; সম্পাদকঃঅনন্ত আচার্য; কলকাতা; পৃঃ ৮৯
১৭) ঐ; ১০৮।
১৮) হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত;ডা: মণীন্দ্রনাথ বিশ্বাস;পৃঃ ২৪০-৪১; 
১৯)ঐ;পৃঃ২৪২-৪৫;