“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৩

সৌরভ কুমার চলিহাঃএকটি গ্রহান্তর


।। সপ্তর্ষি বিশ্বাস।। 

(সৌরভ কুমার চলিহা অসমিয়া কথা সাহিত্যের অন্যতম স্তম্ভ। ১৮৩০শে দরং জেলার মঙ্গলদৈতে তাঁর জন্ম। বাবা কালীরাম মেধিও ছিলেন সুখ্যাত সাহিত্যিক এবং বৈয়াকরণিক। মায়ের নাম ছিল স্বর্ণলতা মেধি। অসমিয়া সাহিত্যে বিশ শতকের মাঝামাঝি 'বাঁহী', 'রামধেনু' সাময়িক পত্রের নামে এক একটি যুগ চিহ্নিত। বাংলা কল্লোল,কালিকলমের মতো। তাঁর প্রথম গল্প 'পাঞ্জাব সীমান্তের সহযাত্রী'। দ্বিতীয়টি 'কালমাক্স' বেরোয় বাঁহীতে। রামধেনুর আয়োজিত গল্প প্রতিযোগিতাতে 'অশান্ত ইলেক্ট্রন' প্রথম পুরস্কার লাভ করে। এবং তাঁকে আধুনিক অসমিয়া গল্পের দিকনির্ণায়কে পরিণত করে। 'অশান্ত ইলেক্ট্রন' নামে তাঁর প্রথম গল্প সংকলন বেরোয় ১৯৬২তে। সৌরভ চলিহা তাঁর ছদ্ম নাম। জীবিতাবস্থাতে অতি অল্প মানুষই তাঁকে মূল নামে জানতেন, সে ছিল সুরেন্দ্র নাথ মেধি। পেশাগত ভাবে তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী, অসম অভিযান্ত্রিক মহাবিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেন, ১৯৮৮তে। তাঁর দুটি বিজ্ঞান গ্রন্থও আছে এই নামেঃচিন্তার বেগ কিমান এবং মহাকাশত প্ৰাণর সন্ধান ।
        
            মনে হয় না, এই অধ্যাপকটিই যে সৌরভ চলিহা, তাঁর সহকর্মীরাও জানতেন। সৌরভ চলিহাতে জীবিতাবস্থাতে দেখেছেনও অতি অল্প ব্যক্তি। কোথাও তাঁর ছবি ছাপানো হলেও হতো পেছন ফেরা। ১৯৭৪এ প্রকাশিত তাঁর 'গোলাম' সংকলনের জন্যে সাহিত্য একাদেমী পুরস্কার পেলেও তিনি সেটি নিতে যান নি, একাদেমী তাঁকে টাকাটা পোষ্ট করেছিল বটে। কিন্তু পদক বা মানপত্র কোনটাই পাঠায় নি। তিনিও পাবার জন্যে ব্যগ্র হননি। ২০১১র ২৫ জুন গুয়াহাটির এক হাসপাতালে এই অসামান্য লেখকের মৃত্য হয়। তাঁর জীবিতাবস্থাতেই তাঁর অনুরাগীরা গড়ে তুলেছিলেন "Saurav Kumar Chaliha Fan Society" প্রখ্যাত অসমিয়া চলচ্ছিত্র নির্মাতা এবং সমালোচক আলতাফ মজিদ এবং সহযোগীরা। তাঁদের উদ্যোগে তাঁর জীবনের অজানা তথ্যগুলো এখন সামনে আসছে। মজিদ কিছু তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেছেন সৌরভ কুমার চালিহার জীবন ও কর্ম নিয়ে। তাঁর গল্প একাধিক ভারতীয় ভাষাতে ইতিমধ্যে অনুদিত হয়েছে। বাংলা ভাষাতে অন্যতম অনুবাদক দেবাশিস তরফদারের সম্মান জুটেছিল বিশেষ অতিথি হয়ে বক্তৃতা করবার যখন ফ্যান সোসাইটি সৌরভ চালিহার নামে ওয়েবসাইট খোলেন। সেই সাইটে পড়তে পাবেন তাঁর আরো অনেক গল্প, মূলে এবং অনুবাদে।)






সৌজন্য
কটি মাঠ। উপবৃত্তাকার। দুদিকে গোল পোষ্ট। মধ্যে সৈন্য সজ্জা। কে কোথায় দাঁড়াবে -  সেন্টার, ফরোয়ার্ড, স্টপার, গোল কিপার ... এক বিশেষ জ্যামিতিক নক্সা। বল গতিশীল হওয়ার আগে। বল যে মুহূর্তে গড়িয়ে গেলো অমনি বল নিয়ে কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়ির সঙ্গে সঙ্গে হাঁক ‘এগিয়ে যাও’, ‘পাশ্‌ করে দাও অমুককে ...’ ‘এই দাঁড়াও দাঁড়াও তুমি অমুকের সঙ্গে ডিফেন্সে...’  ... সাদা চোখেও ধরা পরে যে এই সব চীৎকারের সঙ্গে সঙ্গে মুহুর্মুহু পাল্টে যাচ্ছে ঐ জ্যামিতিক নক্সা। ঠিক। কিন্তু এই সৈন্যদের কেন এভাবে সাজানো হলো, একটা নক্সা ভেঙ্গে আরেক নক্সায় গিয়ে ঠিক কী লাভ হলো তা সহজে ধরা যায়না গোলটি বা একটি মারাত্মক গোল প্রেচেষ্টার আগে। ঠিক ধরা যায়না কখনোই তবে গোল হয়ে গেলে বা গোলের চেষ্টার পরে হয়তো আন্দাজ করা যায় কিছুটা। কিন্তু পুরোটা নয়। তবে একথা জানেন সকল দর্শকই, যে, এই সমস্ত সৈন্যসজ্জা, হাঁকাহাঁকি আর পরিকল্পিত ভাবে সৈন্যদের জ্যামিতিক নক্সা মুহুর্মুহু বদলের আড়ালে থেকে যায় অধিনায়কের একটিই উদ্দেশ্য –বিরুদ্ধ পক্ষের পোস্টের ভেতর বলটিকে ঢুকিয়ে দেওয়া। পাঠকের অনুভুতিকে বিপরীত পক্ষের গোলপোস্টের সঙ্গে তুলনা করলে প্রতিজন প্রকৃত শিল্পীই যে চেষ্টা নেন তা মনেহয় এই, যে, অন্তিমে পাঠকমানসকে উদ্দীপ্ত করতে এমন এক আলোকে যার ছটায় প্রকৃতপাঠকজন তাঁর আমূল অস্তিত্বকে দেখতে পাবেন এক নতুন আলোয় – ঐ দেখতে পাওয়ার পরের মুহুর্ত্ত থেকেই সেই আলো মিশে যাবে তাঁর মনোজ মশালের আলোর সঙ্গে – যা জ্বালিয়ে রেখে তাঁর পথচলা। ঐ আলোয় যা দেখবেন পাঠক সে সমস্ত কিছুই আগেও তিনি দেখেছেন বহুবার – তাঁর সেই পুরোনো আসবাব, নতুন পাজামা, দেওয়ালের স্যাঁতাপরা দাগ... তবু ঐ সমস্তকেই মনেহবে নতুন ঐ আলোকচ্ছটায়।   ঐভাবে পাঠকমর্মে ঐ দীপ্তি ছড়াতে গিয়ে তাঁর যে পরিকল্পনা তাও বদ্‌লে বদ্‌লে যাবে, অবশ্যই, বলটি মাঠে গড়িয়ে যাওয়ার পরেই। তবু পাঠক ঠিক টের পাবেননা গোলটি কখন হবে, কিভাবে হবে ...   

        এই কথাগুলি আবার মনে এলো দেবাশিস তরফদার অনুদিত সৌরভ কুমার চলিহার গল্পের সংকলন ‘বীণা কুটির’ মাস দুয়ের ব্যবধানে ফিরে পড়তে বসে।  কথাগুলি প্রথমে যাঁর লেখা পড়তে পড়তে মনে এসেছিল, তাঁর নাম জেম্‌স্‌ জয়েস্‌। তাঁর যে গ্রন্থ মনে এনেছিল কথাগুলিকে তার নাম ‘ডাব্‌লিনার্স’।  তবে এই মনে পড়ার আবডালে দুইটি গ্রন্থের ও দুইজন লেখকের মধ্যেও যে আবছা যোগাযোগ তা মূলতঃ তাঁদের  সফল পরিবেশ সৃষ্টিরি বাহাদুরিতেরবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ থেকে বিমল কর’ এর ‘জননী’ হয়ে, জয়েস্‌, সিমোনো, চেস্টারটন্‌ পেরিয়ে সৌরভ চলিহা এই সত্য ফিরে প্রমাণ করলেন। কিন্তু এতদ্‌ভিন্ন ডাব্‌লিনার্স যে স্থবিরতার কথা বলে সৌরভ চলিহা তার বিপরীত চক্রবালের দিকেই রাখেন অন্তিম ইঙ্গিত।
   
       সৌরভ কুমার চলিহা’র ‘বীণা কুটির’ গ্রন্থের গল্পগুলি তাঁর চারটি গল্পগ্রন্থ থেকে বেছে নিয়েছেন দেবাশিস তরফদার। পর পর সাজিয়েছেন নিজের মতো করে। ফলে গল্প গুলির অনুক্রম পাঠক মর্মে যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে (যে পাঠকজনেরা অনুক্রমের ব্যঞ্জনায় বিশ্বাসী) তার কৃতিত্ব দেবাশিস তরফদারেরি পাওনা।
           ‘বীণা কুটির’ এ গল্প সংখ্যা মোট বারোটি। এক নিঝ্‌ঝুম নীল দুপুরের ছায়ায় ‘দুপুরবেলা’ নামের গল্পটি দিয়ে আরম্ভ এই গ্রন্থের। গ্রন্থের আরো অনেক গল্পের মতোই ‘দুপুরবেলা’ এই নামের পরিধিতে তথাকথিত অর্থে কোনো গল্প নেই আবার তা নয় অত্যাধুনিক নিরীক্ষামূলক উৎকট “গল্পহীনতা” বা “না-গল্প”ও । আছে একটি দুপুর। ফ্ল্যাটের আক্রমণে অধুনাবিলুপ্ত যে মধ্যবিত্ত পাড়া তারই  এক নির্জন দুপুর বেশ কিছুদিন পরে দেখা হওয়া দুই মহিলার নিতান্ত আটপৌরে আলাপচারিতা যেন এই দুপুরের “প্লট” আর আবডালে ঘনিয়ে দুপুর যেন “সাব্‌ প্লট”। - যেন খেলার আরম্ভে। তারপরই বল গড়ায় মাঠে। বদ্‌লে যেতে থাকে সৈন্য সজ্জা, পরিকল্পনা। সব শেষে এসে টের পাওয়া যায় ঐ দুই মহিলার নিতান্ত আটপৌরে আলাপচারিতাই আসলে “সাব্‌ প্লট্‌”। মূল প্লট ঐ দুপুর। অলস, চিরন্তন দুপুর ...
     এই গল্পটি যেন পালন করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে আলাপের ভূমিকা। যেন জানান দেয় এই লেখক কখনো খুব জোরে কিছু বলেননা। যা জোর করে বলার তা জোরের সঙ্গে বল্লেও জোরে বলা তাঁর বিষয় নয়। টের পাওয়া যায় এই লেখকের প্রতিটি বাক্য যতোদূর বলে তার চেয়েও বেশীর দিকে, দূরের দিকে যায় নির্দেশ করে।
         ঐ দূরে কে আছে, কী আছে? – ক্রমে টের পাওয়া যায় আছে এক গ্রহান্তর যা আমাদের পরিচিত এই পৃথিবীর মতো হলেও সেখানের প্রতিটি বাসিন্দা, রাস্তাঘাট, গাছপালা যাপন করে এমন এক জীবন যা কবিতার বিন্দুবতীর মতোই সত্য না হয়েও বেশী সত্য – ঠিক যেমন জয়েসের ডাব্‌লিনার্সের ‘ডাবলিন’ যা ডাব্‌লিন হয়েও যেন ডাবলিন নয় আবার ডাব্‌লিন না হয়েও ডাব্‌লিন । জীবনানন্দের ভাষা ধার করে বলতে হয়, ‘পৃথিবীর সব নদীর সব জলকে সড়িয়ে দিয়ে নতুন জল’এর কল্পনার মতো। তাই তাঁর গল্পগুলিকে আমি স্থাপন করতে পারিনা সরাসরি এই পৃথিবীতে, তাই আমাকে তাঁর গল্প গুলিকে নিয়ে পাড়ি দিতে হয় এক গ্রহান্তরে যেখানকার আকাশ, জল, বাতাস, মানুষ সমস্ত পৃথিবীর আকাশ, জল, বাতাস, মানুষদের মতো হলেও তা পৃথিবী নয় ...
             ‘ডাব্‌লিনার্স’ এর প্রথম গল্প ‘সিস্টার্স’ অন্তিমে যদিও ইঙ্গিত রেখে যায় বয়ঃসন্ধি মগ্ন বালকের যৌনতার থেকে আরম্ভ করে ‘পাপ’ শব্দটির খৃষ্টান সংজ্ঞার অন্তর্গত দ্বন্দ্ব অবধি তথাপি সদ্য মৃত বৃদ্ধের বাড়ির সান্ধ্য পরবেশ যেভাবে অঙ্কিত হয় তাতে পাঠক হিসেবে আমরাও যেন সশরীরে ঢুকে পড়ি সেখানে। কিন্তু ঢুকে পড়ার পরে আমাদের ভূমিকা কেবলি দর্শকের –যেনবা যে  বালক এই গল্পের দ্রষ্টা তারি মতন আমরা ঐ গৃহটিকে নয়, সমগ্র ডাব্‌লিন্‌’কেই দেখছি জানালা দিয়ে, সেই অর্থে লেখকের ‘ফার্ষ্ট হ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্স্‌’ও যেন এক রকমের ভয়ূরিজম্‌। - প্রায় আবহ নির্মীত ‘বীণা কুটির’এ’ও। এখানেও আমরা দর্শক। অনেক ক্ষেত্রে এই লেখকের ‘ফার্ষ্ট হ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্স্‌’ও যেন এক রকমের ভয়ূরিজম্‌ ...। হ্যাঁ, ‘বীণা কুটির’ এর প্রথম গল্প হিসেবে ‘দুপুরবেলা’কে বেছে নিয়ে অনুবাদক দেবাশিস তরফদারও যেন চান সংকলনটির চরিত্রের কথা আমাদের জানান দিতে। যেন বলতে চান, এইভাবেই একটি আবহ -এই গল্পে যা নিঝ্‌ঝুম দুপুরের, ধু ধু নীলের  - তা’ই ক্রমে তোমাকে গ্রাস করে নেবে, হে পাঠক, এই গল্পের অন্তিমেও যেমন তুমি এসে দাঁড়াবে সংখ্যাতীত পরিণতির ইঙ্গিতের মুখোমুখি, গোটা বইটি জুড়েই এমন ... তোমাকে বার বার ভাবতে হবে ‘বাসন্তিকা’ গল্পে কেন এতো রবীন্দ্রনাথ... ‘বারকারোল’ এ কেন ছোট্ট শহরের বাসিন্দা প্রনবের মর্মে এতো স্পেন ... ভাবতে হবে, তবে এগুলিকে প্রতীক না ভেবে, ‘অব্‌জেক্‌টিভ কোরিলেটিভ্‌’ না ভেবে অন্য কোনো ইঙ্গিত, বরং ‘প্রতিমা’ ভেবে এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয়...
               ‘বারকারোল’ গল্পটির আবহও মধ্যবিত্ত পাড়া। সেই পাড়ায় সন্ধ্যা, রাত্রি। পাড়ার বিয়েবাড়িতে বেশী রাতে বর আসা। অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই শোভাযাত্রা দেখা পড়শী মহিলার... ঐ গল্পের মৃত বালিকা আইজনী, আইজনীর গল্পের খাতার সন্ধ্যার সঙ্গে প্রণবের সন্ধ্যা, প্রণবের মর্মে ইতালীয়ান বারকারোল সঙ্গীতের মতো বেজে চলা অন্তঃসলিলা সৃষ্টি পিপাসা সমস্ত মিলেই গল্পটি আমার প্রিয় হলেও যেখানে আমি সম্পূর্ন হারিয়ে যাই সেখানে বেশী রাতে, বাড়িতে প্রণবের মা একা, প্রণবের অপেক্ষায় ... ‘অনেক রাত অবধি সেদিন মায়ের ঘুম এল না, বারান্দায় বসে মা রাতের শব্দগুলি শুনলেন। রাস্তায় লোকজন কমে গেছে, বাড়ির সামনের লাইট-পোস্টটার বাল্ব থেকে অল্প আলো এসে পড়েছে বারান্দার এক কোনে, মাঝে মাঝে দেরী করে বাড়ি ফেরা দু-একজনের জুতোর শব্দ, কোথাও কুকুর ডাকছে মাঝে মাঝে, একেকটা একাকী মোটরগাড়ির ক্রমশ বিলীয়মান ধ্বনি। উপেনবাবুদের বাড়িতে কেউ রঙ্গরস করছে, অস্পষ্ট হাসির রোল...’  এই রাত্রি কি শুধু গৌহাটির? সেন্ট্‌ লুইস্‌ বা ক্যালিফোর্নিয়ার কোনো শহরতলীর রাত্রি কি এ নয়? এই গল্পে “আইজনী” মৃত। তবু “আইজনী”কে ঘিরেই আবর্তিত কাহিনীটি।
            ...হ্যাঁ, এখানেও জয়েসকে মনেপড়ে। মনেপড়ে বহুদিন পূর্বে মৃত এক যুবককে ঘিরে “দি ডেড্‌” গল্পের অন্তিম আবর্তন। কিন্তু, আগে যেমন বলেছি, জয়েসের “দি ডেড্‌” যদিও অন্তিমে জীবনের স্থবিরতার দিগন্ত যায় পার হয়ে তথাপি ছুঁয়ে যায় উচ্চবিত্ত জীবনের প্রতিটি “মৃত” অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, সেখানে চলিহা’র “বারবাকোল” থেকে যায় দূরের থেকে ভেসে আসা গানের মূর্চ্ছনার মতোই। অধরা
            মনেপড়ে  সেই জয়েসের ‘ইউলিসিস্‌’ও যেখানে শব্দ, অর্থাৎ ধ্বনিকে ঘিরেই সেই বিপুলাকৃতি উপন্যাসের এগিয়ে যাওয়া। শব্দ আর ধ্বনির প্রতি সৌরভ কুমার চলিহা’র এই ‘অব্‌সেশন’ থেকেই ‘বেটোফেন’ আর ‘আওয়াজ’ গল্প দুটিতেও শব্দ আর ধ্বনি পালন করে এক বিশেষ ভূমিকা। বধির বিটোফেনের বাহিরের ধ্বনিকে হারানোর আপাত যন্ত্রণার গহনে একটি গল্পে সৌরভ চলিহা আমাদের শ্রবণকে ফিরিয়ে দেন সেই ভিতরের দিকে যে ভিতরের দোরে কান পেতেই একমাত্র শোনাযায় ‘গোপনবাসী’র প্রকৃত কান্না-হাসিকে। ঠিক পরের গল্পেও দেখি বিরক্তিকর ধ্বনির থেকে মুক্তি পাওয়ার বহিরংগ প্রয়াস বিকৃত করে প্রিয়, পরিচিত ধ্বনিগুলিকেও। তা টের পেয়েই গল্পের প্রোটাগোনিষ্ট যখন নিজ মর্মের দিকে তাকায় তখনি ছোটো ছোটো ঘণ্টায় সুরেলা সঙ্গীত দুলিয়ে ছুটেযায় সেই ঘোড়ার গাড়িটি যা আগেও তাদের জীবনের কিছু কিছু বাঁক পেরোনোর আবহ। এই ঘোড়ার গলার ঘন্টার ধ্বনিতেই ‘আওয়াজ’ গল্পে লাগে রূপকথিকার সেই মেজাজ যে মেজাজের ছায়া ‘ডক্টর জিভাগো’
 “       আওয়াজ” গল্পের পাশাপাশি “আচ্ছন্ন” নামক গল্পটি নিয়ে বলতে চাই। বলতে চাই এই হেতু যে এখানেও রূপকথিকার বিরল পৃথিবী রচিত হয় কিন্তু সেই পৃথিবী “আওয়াজ” এর পৃথিবীর মতো নয়। সেই পৃথিবী জুড়ে  থাকে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরের একটি মধ্যবিত্ত পাড়া, ইস্টিশান, ক্যান্টিন, রেডিও স্টেশান ... এ সমস্ত থাকলেও এরা যেন তেল রঙের ছবি। জল রঙের মতো করে এদের একের রঙ অপরের সঙ্গে মিলে যায়না আবার একে ছোঁয়া যায়না ভাষ্কর্যের মতো করে। এই পৃথিবীর একমাত্র বাসিন্দা শুধু ‘আচ্ছন্ন’ গল্পের গল্পকার-প্রোটাগোনিষ্ট নিজেই আর তাই সে ‘আচ্ছন্ন’ । সে আসছে হারাতে হারাতে। গল্পের শুরুতেই । সেই হারিয়ে যাওয়ার অনুষঙ্গে সে বলেঃ ‘ হাজারটা ঘটনা আমার মনে পড়ল, হাজারটা মুখভঙ্গি ও ভ্রূভঙ্গি আমার মনে পড়লো, হাজার সংলাপ, হাজার গল্পের খোরাক, ঘর ও বারান্দা, প্রভাত ও সন্ধ্যা, রৌদ্র ও বৃষ্টি, বিনিদ্র রজনী, সহস্র মিলন ও বিচ্ছেদের নাট্যের খোরাক –এবং এই সমস্ত কিছুকে বাদ দিয়ে আমি শুধু বলছি যে আজ সন্ধ্যায় আমার জীবন শূন্য হয়ে গেলো, আমার অন্তর বিদীর্ণ হয়ে গেলো, এবং আমি বুঝতে পারছি যে কেউ সে কথা বিশ্বাস করবে না। ... আমি আমার কলমটার দিকে তাকালাম, কতো চিঠি সে লিখেছে, কত মনের কথা, কত অনুভুতি,কত সুন্দরভাবে সূক্ষভাবে প্রকাশ করেছে ... কিন্তু তার পেছনে একটা প্রেরণা ছিল, পটভূমিতে  একটা চালিকা শক্তি ছিল...’  - আজ সেই চালিকা শক্তি, সেই প্রেমাস্পদা নেই। তাই এই কলমও যেন মনেহচ্ছে আর সক্ষম হবেনা প্রকাশ করতে কোনো ‘অনুভুতি’, ‘সুন্দরভাবে’, ‘সূক্ষভাবে’- আগের মতন। কিন্তু তার পরেই আমরা দেখি, যে, আরোও একবার সে গিয়ে বসেছে রেডিও স্টেশানের মাইক্রোফোনের কাছে অর্থাৎ তার কলম তার কথা শুনেছে, সক্ষম হয়েছে প্রকাশ করতে তার ‘অনুভুতি’, ‘সুন্দরভাবে’, ‘সূক্ষভাবে’- আগের মতন। অর্থাৎ যাওয়ার পথে যে গিয়েছে তারি পিছু পিছু এসেছে নূতন। সেই নূতনকে সে টের পাচ্ছেনা। তাই গল্পের শেষে সে যখন আবিষ্কার করে, যে, এইবার কলমটিও হারিয়েছে, তখন আবার সে অনুভব করছে ‘আমার অন্তর বিদীর্ণ হয়ে গেছে’... তথাপি কলমের পরিবর্তে তার হাতে উঠেছে পকেটে রাখা পেন্সিল। হ্যাঁ, এইবার এই পেন্সিল নেমে সেই হারানো কলমের শূন্যস্থান। সে আবার লিখবে। আবারো এসে বসবে, এইভাবেই, মাইক্রোফোনের সামনে। কিন্তু তার চেতন-মন যেহেতু এই হারানোতেই ‘আচ্ছন্ন’ তাই সে ছুঁতে পারছেনা বিশ্ব নিয়মের এই সূত্রটিকে... না’কি তা ছুঁয়েই সে “আচ্ছন্ন” হয়ে আছে?  এই নিস্পত্তির দায় পাঠকের হাতে ন্যস্ত করে চলিহা চলেযান অন্য গল্পে ...
        ‘বাসন্তিকা’ গল্পের প্রোটাগোনিষ্ট এক যুবক গবেষক যার ধারনা অন্য অনেক ভালো চাকরীর প্রলোভন ছেড়ে সে এই গবেষণায় জড়িয়ে পড়ার হেতু সে তার এই বাসস্থানটি -যেটি একটি মেস্‌ বাড়ির একটি ছোটো কোঠা, অন্ধকার, ভিড়ে গিজ গিজ, চীৎকার চেঁচামেচির পীঠস্থান –ছেড়ে যেতে চায়না। ছেড়ে যেতে চায়না তার হেতু, তার নিজের ধারনায়, এই মেসের উল্টো দিকের বাড়িটিতে, যা এরকমই -অন্ধকার, ভিড়ে গিজ গিজ, চীৎকার চেঁচামেচির আরেক পীঠস্থান – সেখানে বাস করা একটি মেয়ে। অথচ সেই মেয়ের সঙ্গে না আছে তার পরিচয়, না জানে মেয়েটির নাম। শুধু জানে মেয়েটি জীবন যুদ্ধে হয়রান। চাকরী করে। তারপর টিউশান। অসুস্থ মা কিংবা দিদিমাকে সামলায়, আছে ছোটো ছোটো ভাইবোন (?) ... এই মেয়েকে ঘিরেই তার বসন্তকল্পনা। পক্ষান্তরে জয়েসের এরাবি’র খুদে প্রোটাগোনিষ্ট’এর আবহ এইঃ ‘নর্থ রিচমন্ড রোড । এক নিঝুম কানা গলী। ক্রিস্টান ব্রাদার্স ইস্কুল যখন ছুটি হলে তখনি কয়েক মিনিটের জন্য জাগতো গলীটা। গলীর শেষে এক ফালি চৌকো জমি। একলা একা তাতে এক দোতলা বাড়ি। পরিত্যক্ত।  বাদ বাকি বাড়ি গুলোর দৃষ্টি শীতল। চোখ বাদামী। নিজ নিজ আভিজাত্যের গল্প আগ্‌লে তারা তাকিয়ে থাকতো একে অন্যের মুখের দিকে। ( অনুবাদ বর্তমান লেখকের) সে’ও তাকিয়ে দেখতো পড়শী বালিকাকে। মর্মে তারো বসন্তের দূতী ঐ বালিকা।  - এই সামঞ্জস্য নিয়ে আরম্ভ হয়ে ‘এরাবি’র শেষে আমরা দেখি প্রেমিকমনের ‘ভেনিটি’র সংজ্ঞা যা ভেঙ্গে যায়, অবশেষে, এরাবি’র মেলা থেকে ‘কিছুনা কিছু তোমার জন্য আনবোই’ প্রেমিকের এই স্পর্ধিত উচ্চারণের পরাজয়ে আর ‘বাসন্তিকা’র শেষে আমরা দেখি  নিজের গবেষণার কাজে মন প্রাণ দিয়ে অতঃপর সফল হয়ে ( যে সফলতা, প্রোটাগোনিষ্ট জানে, বড় জোর কোনো জার্ণালের ফুটনোটে অমুক গবেষকের ‘দল’ বলে উল্লিখিত হওয়া ভিন্ন কিছুই নয়) সে ভুলেই যায় যে তার ঐ মেয়েটি কখন ঐ বাড়ি ছেড়ে চলেই গিয়েছে আর তখনি বসন্ত এসেছে তার মর্মে এই যে ভালবাসা যা “সম্মুখ পানে চলিতে জানে”, “চালাতে জানে” তারি ইঙ্গিত হয়ে এই গল্পে বার বার রবীন্দ্রসঙ্গীতের আনাগোনা...
           সমস্ত বড় লেখকের মতোই সৌরভ চলিহার গল্পেরো অনেক স্তর। আমি বল্লাম শুধু একটি স্তরের কথা। বাকি স্তরগুলি পাঠকের নিজ পাঠের মূল্যে আবিষ্কৃত হওয়ার জন্য রেখে দিচ্ছি শুধু এই টুকু বলে যে ঐ মেস্‌বাড়ির লোডশেডিং এর সন্ধ্যাটি, আহা, যেন অনন্তের একটি খন্ড আর বাঁশরিয়া কানাইবাবু... মনেপড়ে বিমল কর’এর ‘জোনাকি’।
        সৌরভ চলিহার কিছু গল্প ঘটে   যায় গল্পের চরিত্রের অন্তর্জগতেও। যেনবা আয়নার ভিতরে আয়না, যেনবা ছোটবেলার জ্বরশয্যার পাশে সেই বার্লির শিশি যাতে আঁকা একটি শিশু, তার হাতে বার্লির শিশি, আবার ঐ ছবিটিতেও আঁকা একটি শিশু, তার হাতে বার্লির শিশি ... এমনি এক কাহিনী ‘ইরা’ যার আরম্ভেই ইরা’র সোনার আঙ্গটি হারিয়ে যাওয়ার খবর মোটা দেহ ও মোটা মাথা সম্পন্ন ইরা’র দাদা জানান দেয় নিজের এক বন্ধুকে। বন্ধুর কাছে তার দাবী যেহেতু বন্ধুও ইরা’কে দেখে নিজের বোনেরি মতন তাই ইরার চিঠির উত্তরে কী লেখা যায় তা ঐ বন্ধু যেন তাকে বলেদেয়। এইবার নির্মিত হতে থাকে ‘ইরা’। নির্মিত হতে থাকে ঐ ‘বন্ধু’র মর্মে। এই যে নির্মিত হওয়া, ইরা’র, এ যেন এক স্থূল, অনুভুতিহীন গ্রহের আকাশে নির্মাণ ‘প্রেম’ এই শব্দটির। পাঠক, এই ‘প্রেম’এর গল্পের অনুষঙ্গে আমার মনে আসে ডাব্‌লিনার্সের এক মারাত্মক অপ্রেমের গল্প যা আগাগোড়া নির্মীত প্রেমের গল্পেরি আদলে... পাঠক, দুটি গল্পই আপনাকে পড়ে দেখতে অনুরোধ করি...
         এই ‘বীণা কুটীর’এ’ই পেলাম আমার দ্বিতীয় প্রিয়তম প্রেমের গল্পটিও। এর নাম ‘ভ্রমণ বিরতি’। এখানে আমরা দেখলাম যে শহরের ভিড় আর অসুন্দরের আবহ প্রোটাগোনিষ্টের মর্মে কেবলি উদ্রেক করতো বিতৃষ্ণার, যে গল্পের আরম্ভের আবহ বুনুয়েলের ‘দ্যাট্‌ অব্‌স্‌কিওর অব্‌জেক্ট্‌ অব ডিজায়ার’ ছবির আরম্ভের আবহের মতোই একটি বিস্ফোরন দিয়ে, সেই শহরি, মাত্র দুদিনে, তার মনে মনে ভালবাসার মেয়েটির তাকে একবার বলেফেলা ‘লক্ষীটি’ শব্দে কিকরে হয়ে ওঠে সবুজ, করুণ ...
     ‘বীণা কুটীর’ এর প্রতিটি গল্প দাবী রাখে আলোচনার। ইচ্ছে হয় ‘ওরাও পাহাড় বেয়ে উঠলো’ গল্পটিকে সম্পূর্ণ উধৃত করে দিতে, বলতে “হারাল” গল্পটির কথা যেখানে প্রকৃত হারানোর সঙ্গে মর্মে চির সঞ্চিত হয়ে থাকার প্রক্রিয়াটি কাহিনীর এক মূল অক্ষ, তার কথা। সেই গল্পের আরম্ভ এভাবেঃ ‘মহম্মদ রফি বা মুকেশ, আজ আর ঠিক মনেপড়ে না। গানটির কথাগুলিও আজ আর মনে নেই, শুধু তার শুরুর বাজনাটা মাঝে মাঝে কখনো মনের মধ্যে গু্নগুন করে বেজে ওঠে অকস্মাৎ, অপ্রত্যাশিত, নানা জায়গায়’। -একেই কী বলে হারিয়ে যাওয়া, না কি, এ চিরন্তন হয়ে জেগে থাকা? মর্মে? জানিনা। প্রথম পাঠে, তার পরের দুই-তিন পাঠেও জানিনা। আরো অনেকবার পড়বো। ঠিক। তারপরেও জানবো কি’না জানিনা।


বীণা কুটিরঃ সৌরভ কুমার চলিহা
ভাষান্তরঃ দেবাশিস তরফদার
প্রথম প্রকাশঃ ২০১১

২৭ মার্চ্চ – ১২ অগাস্ট ২০১৩
বেঙ্গালোর


1 টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

এই গল্প সংকলন বর্তমানে সুলভ? কোনোভাবে যদি কেউ হদিশ দিতে পারেন তাহলে কৃতজ্ঞ থাকব।