“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৩

বরাক উপত্যকায় কৈবর্ত সমাজের সামগ্রিক উত্তরণ ঘটবে কখন?


(c)ছবি
কৈবর্ত একটি সংঘবদ্ধ জাতি। ওদের সামাজিক পরিকাঠামো খুবই দৃঢ় এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ। ওরা যেখানেই যায় অন্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে নিজেরা দলবদ্ধভাবে বাস করে। চারিত্রিক দিক দিয়ে তাদের সততা এবং সারল্য প্রশ্নাতীত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এইসব গুণাবলী থাকা একটি সমাজের গুরুত্ব বা মর্যাদা দল মত নির্বিশেষে সবার কাছে অপরিসীম হওয়ার কথা। সেই অনুযায়ী এই সমাজের সার্বিক উন্নয়ণ হওয়া ছিল বাঞ্চনীয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব প্রতিপত্তি যথেষ্ট থাকার কথা এই সমাজের। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
             সময়ের দাবি মত যেখানে সবাই একসাথে মিলেমিশে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের প্রতিফলন ঘটানোর কথা সেখানে কেবল মাত্র কৈবর্তদের একক সমাজ হিসাবে সংঘবদ্ধ অবস্থান অন্যান্য সমাজের কাছে কিছুটা ঈর্ষা এবং অনেকটাই অগ্রহণযোগ্য ব্যাপার স্যাপার। তাছাড়া সামাজিক সংকটের মূহূর্তে কৈবর্ত সমাজ যেভাবে একজোট হয়ে যায় তাতে অনেকেই পরাজিত হয়ে এই সমাজের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে এবং কলে-কৌশলে এদের দৃঢ় সামাজিক পরিকাঠামোটাকেই ধ্বংস করতে চায়। তাই অতি গোপনে বঞ্চনার সুনিপুণ রুপরেখা তৈরি করে চাতুর্যের সাথে তা কার্যকর করা হয়। সহজ সরল কৈবর্ত সমাজ সে সব কদাচিৎ টের পায়! তাছাড়া দীর্ঘদিন এক জায়গায় একসাথে বসবাস করার ফলে তাদের নিজেদের মধ্যেও খেয়া-খেয়ি, রেষারেষির একটা চোরাস্রোত সব সময় প্রবাহমান থাকে ফলস্বরূপ মাঝেমাঝে তারা ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’ করে, সমাজের বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয় এবং ঐক্যের বাঁধন খান খান হয়ে যায়।
            ইতিহাসের পাতা খুললেই আমরা দেখতে পাই সুচতুর শাসকশ্রেণী অতি সন্তর্পনে কৈবর্ত জাতির দৃঢ়, মজবুত মেরুদণ্ডকে ধীরে ধীরে দুর্বলকরে দিতে তাদের বঞ্চিত করেছে শিক্ষার আলো থেকে, সংস্কার করেনি তাদের বাসভূমির যোগাযোগ ব্যবস্থার বরং দিনে দিনে কৈবর্ত জাতির জীবন ধারণের মানকে নরক সদৃশ করে তুলতে গ্রহণ করেছে যাবতীয় কর্মসূচীর। সুশিক্ষিত মেধাবী এবং সুযোগ্য কৈবর্তদের উঠে আসার পথকে দুর্গম করে তোলা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তো এক লাফে বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গোড়াতেই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে কৈবর্ত সমাজের তরুণ প্রতিভা। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি পেরিয়েও ‘সেই ট্রেডিশন সমানে চলেছে’।    কৈবর্ত জাতিকৈবর্ত জাতি কখন বুঝবে এইকথা??
            বর্তমান দিনে বরাক উপত্যকার কৈবর্ত সমাজ অধ্যুষিত এলাকাগুলি যেমন- কাঠিগড়া, চাতলা, বক্রিহাওর, শনবিল, পুটিছড়া, মালিনীবিল, তপোবননগর, রংপুর, তাপাং, কালিবাড়িচর প্রভৃতিকে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে রাখা হয়েছে অমানবিকভাবে। অধিকাংশ এলাকাতেই নেই প্রাথমিক বিদ্যালয়। কোন কোন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু-একটি বিদ্যালয় থাকলেও সে সবের হাল হকিকত খোঁজ করার মানসিকতা নেই কোন সরকারি কর্মকর্তার। কোন অজ্ঞাত কারণে এই এলাকাগুলিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগও নেওয়া হয়নি অথচ সমগ্র আসামে শিক্ষাক্ষেত্রে চলছে আমূল সংস্কার। স্বাস্থ্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে এমনভাবে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে যে সাধারণ রোগে ভোগলেও সদর হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে এই এলাকাগুলির মানুষকে ‘যমের দোয়ার’ দেখতে হয়। সহজেই অনুমেয় কী হয় রোগির যখন মূমূর্ষূ অবস্থা। তাছাড়া ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অপ্রতুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম কৈবর্ত সমাজ বঞ্চিত হয়ে আছে উচ্চশিক্ষা লাভ থেকে ফলস্বরূপ সরকারি চাকুরিয়ানের সংখ্যা অতি নগণ্য এই সমাজে। তাই বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প বা সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত কৈবর্ত সমাজ। সমগ্র দেশে যখন গ্রামীণ বৈদ্যুতিকরণ প্রকল্প শুরু হয়েছে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তখন কৈবর্ত সমাজ অধ্যূষিত বরাকের অঞ্চলগুলি সুর্যাস্তের সাথে সাথে টুপ করে অন্ধকারে ডুবে যায় । টিনের কৌঠায় মহার্ঘ্য কেরোসিন তেল ভরে ছেঁড়া কাপড়ের সলতে পাঁকিয়ে বর্তিকা বানিয়ে কৈবর্ত মায়েরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত ক্ষীণ উজ্জ্বলতর করার প্রয়াস করে করে ক্লান্ত হয়ে যায়। বিশুদ্ধ পানীয় জল এই এলাকাগুলিতে সরবরাহ করা হয় ‘আকাল বৃষ্টি’র ন্যায়। কৈবর্ত জাতি কখন বুঝবে এইকথা?
             শিক্ষার মাধ্যমে কৈবর্ত সমাজের সমষ্টিগত মুক্তির পথ প্রায় বন্ধ, কারণ কৈবর্ত সমাজ অধ্যূষিত এলাকাগুলির স্কুলগুলিকে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে কোন অদৃষ্ট হাতের ইশারায়। কৈবর্ত সমাজের যারা ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষা লাভ করে অগ্রসর হয়েছে তারা সমাজের পাশে না দাঁড়িয়ে আত্মগোপন করেছে একান্তভাবেই বাঁচার তাগিদে অথবা শাসকশ্রেণী কর্তৃক কৈবর্ত সমাজকে দাবিয়ে রাখার গোপন অভিসন্ধি বুঝতে পেরে ওরা সরে গেছে বৃহত্তর সমাজ ছেড়ে আপন সন্তান-সন্ততির মঙ্গল কামনায়। অতএব কৈবর্ত সমাজের সামগ্রিক উত্তোরণের জন্য একমাত্র রাজনৈতিক পথটাই খোলা। গণতন্ত্রে গুণের চেয়ে সংখ্যাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। বরাক উপত্যকার দুটি লোকসভা সমষ্টিতে কৈবর্ত সমাজের ভোটার সংখ্যা নেহাত কম নয়। করিমগঞ্জে তো কী-ফ্যাক্টর। তাছাড়া শিলচর, আলগাপুর, কাঠিগড়া, রাতাবাড়ি প্রমুখ বিধানসভা সমষ্টিগুলির প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ে কৈবর্ত ভোটারদের একটাপ্রভাব থেকেই যায়। দলব্ধভাবে বসবাস করার মত যদি সম্মিলিতভাবে কেবল মাত্র একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিয়ে সেই দলের আস্থা অর্জন করা যায় তাহলে মন থেকে না চাইলেও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে হলেও কোন কোন নেতা বা নেত্রী প্রতিনিয়ত ব্রতী হবে কৈবর্ত সমাজের সার্বিক মঙ্গল কামনায়। প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বদলে উন্নয়ণের স্বার্থে সুযোগ্য ব্যক্তিত্বের পাশে একজোট হয়ে দাঁড়ালে কৈবর্ত জাতির নরকযন্ত্রণা ভোগ কিছু লাঘব হওয়ারই কথা। তবে এক্ষেত্রে কৈবর্ত সমাজকে পা ফেলতে হবে সতর্কতার সাথে, কারো একনিষ্ট সমর্থক হলেও যেন ক্রীড়নক না হয় গোটা সমাজ। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনা করে চলতে হবে, একপেশে সঠিক সিদ্ধান্ত সব সময় মঙ্গলজনক নাও হতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই: