“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৩

কালো মেয়ে

(c) ছবি
         ।।  বৈশালী ঘোষ।।
বাবার গর্বে গর্বিতা । বরের গর্বে গর্বিতা । ছেলের গর্বে গর্বিতা হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমিই সেই কালো মেয়ে, যার নাম হিয়া।
              ২২ শে বৈশাখ। আজ আমার জন্ম দিন। সকাল সাত টায় আমার জন্ম হয়েছিল। শুনেছি মা খুব কষ্ট পেয়েছিল আমার জন্মের সময়। আমি আমার মা,বাবার দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম ছেলের পর বাবা,মা মেয়েরই আশা করেছিলেন। আর তাদের আশার ফল হলাম আমি।
           আমার বাবার বাড়ির সবাই বেশ কালোর দিকে। দাদু ও ঠাম্মা ফর্সা না হওয়ার জন্য, ফুল ফ্যামিলি  সেই ট্রেন্ড টাই বজায় রেখেছে। দাদুর চার ছেলের বউই ফর্সা হয়েছিল। না না,ওটা দাদু মাথায় রেখে মেয়ে দেখতে যেতেন না। ওটা হয়ে যেত। তাই বড়মা, মেজমা, ছোটমা আর আমার মা চার জনই বলতে পারেন দুধে আলতায়। কিন্ত ভবিতব্য কে কি আর বদলানো যায়। তাই আমরা সব ভাই বোনই ঠিক কালো নয় কিন্ত একটা চাপা রং পেলাম।
                ও যা বলছিলাম, অনেক আশার পর আমার জন্ম। হসপিটালে নানা আত্মীয় স্বজন আমায় দেখতে এসেছিলেন। আমি খুব ফর্সা হয়েছিলাম। মা,বাবা খুব খুশি।  না, ওটা বলা উচিত হবেনা যে আমি ফর্সা বলেই ওরা খুশি হয়েছিলেন। ওরা এমনিতেই খুশি ছিলেন। দাদুর মুখ টাও নাকি বেশ খুশি খুশি ছিল বলে শুনেছি।
               আমি যখন দু'দিনের, তখন আমার এক পিসেমশাই আমায় দেখতে এলেন। এসেই তিনি আমার কান উলটে দেখলেন আর ভবিষ্যতবাণী করলেন - যতই খুশি হও এই মেয়েও ফ্যামিলি ট্রেন্ডটাই বজায় রাখবে। মানে এর রংও কিছু দিনের মধ্যেই কালোই  হবে। মার মুখটা বেশ গম্ভীর দেখাছিল। বেশ একটা অভিমানের ছায়া। আমার মেয়েকে কালো বলল।
         কিন্তু বিধির বিধান কেউ কি আর বদলাতে  পারে। আমি কিছুদিনের মধ্যেই আমার ফর্সা রং ছেড়ে কালো রং এর দিকে এগোতে লাগলাম।
         আজ আমার মুখে ভাত। মা নিজের নামের সাথে  মিলিয়ে নাম ঠিক করলেন নুপূর। দাদু নামটা শুনেই - নৈব নৈব চ্। বললেন, আমার নাতনী লোকের পায়ে থাকবে, হতেই পারে না। দাদুর উপর কথা বলার সাহস আমাদের বাড়িতে কারুর ছিল না। তাই মা মুখ টা কালো করে আর বাবার দিকে কট্ মট্ করে তাকিয়ে নিজের ইচ্ছের বলিদান দিলেন। আর আমার ছোট পিসি আমার নাম রাখল হিয়া। আমি সেই হিয়া।
           আজ আমি পাঁচ বছরের। বেশ ফুটফুটে একটা মেয়ে। আমার  বাবা আমার সব থেকে কাছের লোক। বাবা মার কাছে আমি মিস্ ইউনিভার্স। কিন্তু পাড়ার লোকের কাছে ততোটাই উল্টো । কারন, আমি যে বড্ড কালো। মা কখন ও জামা কাপড়ের রঙ আমার গায়ের রঙ এর সাথে বিচার করে কিনত না। আর সবসময় বলত – ‘কালো জগতের আলো’। কিন্তু জগত কে এই কথাটা কে বোঝাবে ?
         যে রং এর জামাই পড়তাম, সবাই বলত ‘কী যে হবে ? মেয়েটাকে কিছুতেই তো আর মানায় না ?” অনেক বার মা কে জিগ্গেস করেছি। মা আমি কেন তোমার মত দেখতে হলাম না। মা বলত তুমি বাবার মত, আর যারা বাবার মত হয় ওরা খুব ভাগ্যবতী। আর তাতেই আমি খুশি। ওই ছোট বেলা থেকেই নানা রকমের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।
        এখন আমি বেশ বড়।  বয়স টা হয়ত তেরো। স্কুলে একদিন বন্ধুদের সাথে খেলতে গেলাম মাঠে । রোদে খেলে যখন ক্লাসে ফিরলাম, তখন সবার মুখ লাল। মিস্ ক্লাসে ঢুকেই জিগ্গেস করলেন - কোথায় ছিলে? কিছু বলার আগেই বললেন কি চেহারা বানিয়েছ, রোদে পুড়ে তো একদম লাল। আর আমায় বললেন হিয়া তুমি তো পুরো বেগুনী। ওই  দিন বুঝতে পারলাম কালো মেয়েরা কখনো রোদে পুড়লে লাল হয়না, ওরা হয় বেগুনী।
          এই কালো ফর্সা  দ্বন্দ্ব নিয়ে এবার আমি ইউনিভার্সিটির শেষ ধাপে। বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু হল। আর আমার বাবা মা জীবনের আসল সত্যটা উপলব্ধি করলেন। যে বাবা মার কাছে তাদের মেয়ে মিস্ ইউনিভার্স ছিল, অন্যদের চোখে সে মুহুর্তের মধ্যে একটা কালো সাধারণ মেয়ে হয়ে যাচ্ছিল। দিন যাচ্ছে আর বাবা মার কপালেও ভাজ পড়তে শুরু করল। আমার শিক্ষা, আমার বাকি সব ভালো জিনিষ, আমার রঙ-এর কাছে হেরে যাচ্ছিল। কিন্তু মা’র কথাটাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হল যে ‘বাবার মত দেখতে হলে ভাগ্যবতী হয়’। হিয়া ও ভাগ্যবতী ছিল, ওর জীবনেও একজন এল। যার কাছে ফর্সা বা কালো কোনো মানে রাখে না। মনটাই যার কাছে বড় পাওনা।

কোন মন্তব্য নেই: