“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৩

মুজফফরনগরের সংঘাত - একটি ভিন্ন দৃষ্টকোণ

 ( লেখাটি ৩ নভেম্বর, ২০১৩ সংখ্যা সাময়িক প্রসঙ্গে বেরিয়েছে)
  
সংঘাতের বৈশিষ্ট্য
মাদের নিজ রাজ্য আসামের পশ্চিম প্রান্তে জনগোষ্ঠীগত অশান্তি লেগেই আছে। সেখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে উত্তর প্রদেশের পশ্চিম প্রান্তের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে মনোনিবেশ করা নিয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করতে পারেন। তাই মুজফফরনগরের ঘটনাপ্রবাহের যথাযথ গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এর একটা ব্যাখ্যা শুরুতেই দেওয়া জরুরি। উত্তর প্রদেশের পশ্চিম প্রান্তের মুজাফফরনগর সহ অন্যান্য জেলা ‘সুগার বেল্ট’ বা চিনিকলের শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিগণিত, শুধুমাত্র মুজফফরনগর জেলাতেই ১১টি চিনিকল রয়েছে। অন্যদিকে নিম্ন আসাম হিসেবে পরিচিত আসামের পশ্চিমাঞ্চল অনুন্নত কৃষিপ্রধান অঞ্চল। সামন্তীয় এবং অর্ধ-জনজাতীয় পরিচিতির সম্পর্কে আবদ্ধ গোষ্ঠীগত চেতনার প্রাধান্যকে ব্যবহার করে সংকীর্ণ স্বার্থের যে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা সম্ভব, শিল্পাঞ্চলের সামাজিক সম্পর্কে সেই ফাটল সৃষ্টি করা সহজ নয় বলেই চালু ধারণা রয়েছে। অথচ সেখানেই এমন এক বড় মাপের সংঘাত হল যে প্রায় ৫০ জন নিহত ও প্রায় ৫০ হাজার লোককে গৃহহীন হয়ে ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিতে হল। নিহত ও গৃহহীন লোকেদের প্রায় সবাই যে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত তা সরকারি-বেসরকারি সব সূত্রের ভাষ্য থেকেই স্পষ্ট। মিরাট, ভাগলপুর, ভিওয়ান্দি ইত্যাদি অঞ্চলের মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার সাথে এই দাঙ্গার কিছু চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে। কারণ উল্লিখিত অঞ্চলগুলিতে যে বিশেষ পারিবারিক ও ক্ষুদ্র শিল্প ধীরে ধীরে প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কারখানায় বিকশিত হচ্ছিল সেগুলিতে মালিক ও শ্রমিক উভয়ই ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। অন্যদিকে মুজফফরনগর ও পার্শ্ববর্তী জেলায় মুসলিমরা মূলত দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক। সাধারণত কোনো জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণের পেছনে নির্দ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে অবদমিত করে রাখা একটি সচেতন বা অচেতন উদ্দেশ্য হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে। ভিন্ন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় নিম্ন আসামের অ-বড়ো জনগোষ্ঠীরাও এধরনেরই আক্রমণের সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রতিটি জনগোষ্ঠীগত সংঘাতের আলাদা আলাদা স্থানিক বৈশিষ্ট্য ও কারণ থাকে, কিন্তু সবগুলিই ঘটে এক বিশেষ সময়ের সামগ্রিক আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবে। স্থানিক না সামগ্রিক কারণ কোনটা প্রাধান্যকারী অবস্থায় রয়েছে তা আমাদের বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করতে হয়। মুজফফরনগরের সংঘর্ষের ঘটনায় মুসলিম শ্রমজীবী মানুষকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে নেওয়ার পেছনে বিশ্বায়ন তথা আশির দশক থেকে চালু নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি যে বিত্তপুঁজি নিয়ন্ত্রিত বাজারশক্তির দৈত্যকে বোতল থেকে বের করে এনেছে তার প্রভাব প্রধান্যকারী ভূমিকায় রয়েছে। এই নতুন দিকটি যা এই দাঙ্গার মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে তার একটা ব্যাখ্যা তুলে ধরার জন্যই এই নিবন্ধের অবতারণা।

ঘটনার সূত্রপাত ও জনগোষ্ঠীগত ঐক্য
        ঘটনার সূত্রপাত ঘটে ভিন সম্প্রদায়ের এক মেয়েকে কুরুচিপূর্ণ যৌন-মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। ২০১৪-এর নির্বাচনকে সামনে রেখে জনগোষ্ঠীগত সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগাতে এই ঘটনাকে একটি পরিপূর্ণ সাম্প্রদায়িক সংঘাতে রূপান্তরের জন্য রঙ-বেরঙের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কেউ কেউ নীরবে অপেক্ষা করতে থাকে, আবার অনেকে তাতে সরাসরি ইন্ধন যোগায়। অথচ দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিং-এর মৃত্যুকাল অর্থাৎ ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তাঁর নেতৃত্বে জাঠ ও মুসলিমদের এক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। নির্বাচনী দৃষ্টিকোণ থেকে এই ঐক্য উভয় সম্প্রদায়ের জন্যই লাভদায়ক ছিল। ইউপি’র পশিমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ৩৩% এবং ফলে চৌধুরী চরণ সিং-এর নেতৃত্বে এই ঐক্যে জাঠদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি যেমনি অনেকগুণ বেড়েছিল, ঠিক তেমনি এই ঐক্যের জেরেই ২০১২-এর বিধানসভা নির্বাচনে ২৬ জন মুসলিম প্রার্থী জয়লাভ করেছিল। ২০০৬-এর সাচার কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী নির্মাণ শিল্পে, কারখানা ও বাণিজ্যে শ্রমিক হিসেবে মুসলিমদের অংশীদারি কৃষিক্ষেত্র থেকে অনেক বেশি। ফল বাগান ও ফলের ব্যবসায় অ-শ্রমিক মুসলিমদের একাধিপত্য রয়েছে। অন্যদিকে অবিসি জাঠ সম্প্রদায় মূলত জমির মালিক ও আখ চাষি। মুজফফরনগরের ঘটনা মুসলিম-জাঠ ঐক্যেই শুধু ফাটল ধরায় নি, মেহনতি মানুষের এক নতুন ঐক্যের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

শ্রমজীবীদের ঐক্য ও জনগোষ্ঠীগত দূরত্ব
          বিগত দিনগুলিতে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং বিভিন্ন নতুন সার্ভিস ও কনস্ট্রাকশন সেক্টরে দক্ষ  ও অদক্ষ শ্রমিকের নিয়োগের ফলে মুসলিম শ্রমিকদের শ্রেণিগত ক্ষমতা খানিকটা বৃদ্ধি ঘটে। অন্যদিকে চিনি উৎপাদনের কারখানায় দেখা দেওয়া মন্দার শিকার হয় জাঠ চাষিরা। চিনিকল মালিকদের থেকে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা চাষীদের প্রাপ্য। এই অর্থ অনাদায়ে জাঠ জমিমালিক ও চাষিদের বাস্তব অবস্থার অবনতি ঘটে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার তুলনামূলক বিচারে জাঠদের অবস্থান মুসলিমদের চেয়ে অনেক উন্নত হলেও, বিগত বছরগুলিতে উভয় সম্প্রদায়ের আর্থিক স্বচ্ছলতার বিপরীতমুখী গতি জাঠদের মধ্যে এক মনোবিকারের জন্ম দেয়। দুই সম্প্রদায়ের আর্থিক অবস্থানের ফারাক কমে আসার বাস্তব প্রেক্ষিতে পুরোনো নির্বাচনী ঐক্যকে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যের এক নতুন মাত্রা দেওয়া যেত। কিন্তু প্রগতিশীল শক্তির অনুপস্থিতিতে বিষয়ীগত এই বাস্তবতাকে প্রগতিশীল আন্দোলনের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, বরঞ্চ মনস্তাত্ত্বিক চাপের পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে পুরোনো ঐক্যকে ভেঙে দিতে সমর্থ হল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি।

চিনি উৎপাদন ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষির বাণিজ্যিকিকরণ
           ১৮২০ সালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ভারতে প্রথম চিনি উৎপাদন চালু করে। বেনারসের হলুদ চিনি ইংল্যাণ্ডের কারখানায় পরিশোধিত করে কোম্পানী বাজারজাত করত। কিন্তু ১৮৪৬ সালের ব্রিটিশ শুল্ক নীতির বলি হয়ে ব্রিটিশ কারখনার রসদ হিসেবে ভারতীয় চিনি প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকতে পারে না এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘চিনির ভাণ্ড’ হয়ে ওঠার ভারতীয় স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। বিশ শতিকার দ্বিতীয়ার্ধে রপ্তানীনির্ভর চিনিশিল্প আবার বিকশিত হতে আরম্ভ করে। উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে চিনি উৎপাদনের জন্য আখ চাষ জমিদার ও বণিক শ্রেণির অধীনে চাষীদের দূরবস্থার বৃদ্ধি ঘটায় ও সামন্তীয় শ্রেণি সম্পর্কের ঐতিহ্যকে শক্তিশালী করে, কিন্তু নতুন বাজার ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমাঞ্চলের অবিসি জাঠ জমি-মালিক তথা চাষীরা প্রভূত উন্নতি সাধন করে। জাত-বর্ণে বিভাজিত ভারতীয় সমাজে জমির মালিকানা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা উচ্চবর্ণ হিন্দুদের করায়ত্ত থাকলেও তারা নিজেরা জমির চাষ করে না, অন্যদিকে অবিসি জমির মালিকরা নিজেরাই সরাসরি চাষাবাদের সাথে যুক্ত। ফলে বাণিজ্যিক আখ চাষের মাধ্যমে পশ্চিম উত্তর প্রদেশে শ্রেণি সম্পর্কের অনেকখানি পরিবর্তন ঘটায়। ১৮৭০ সালের মধ্যেই চামার বাঁধা-শ্রমিকরা নিজেদের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে তাদের নিজেদের গ্রামে বা বাইরে কার খামারে কাজ করবে তা তারা নিজেরা নির্ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। ১৮৮২ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী চামার সম্প্রদায়ের শ্রমিকরা পূর্ণ হাজিরা দাবি করতে শুরু করে। কৃষি কাঠামোর এই পরিবর্তনই আরও বিকশিত হয়ে মণ্ডল ও দলিত রাজনীতির ভিত্তি তৈরি করে এবং কৃষির এই শিল্পায়ন মুসলিম-জাঠ ঐক্যেরও ভিত্তি হিসেবে এতাবৎ কাজ করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় বাধ সাধে এই শতকের আশির দশক থেকে চালু নতুন আর্থিক নীতি ও তথাকথিত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া।

অবাধ বাণিজ্য নীতি ও সুগার ইণ্ডাস্ট্রি
        স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে চিনির উৎপাদনের সামগ্রিক বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। পরিকল্পনা পর্যায়ে চিনিকলের সংখ্যা ও চিনির উৎপাদনের পরিমাণ ১৯৫১-৫৬ সালে ১৩৮ ও ১৯.৩৪ লাখ টন থেকে বেড়ে ২০০৩-০৪ সালে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৬১ ও ১৭০ লাখ টন। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী আইন, ১৯৫৫ অনুসারে চিনি উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। কিন্তু বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার উদার আর্থিক নীতির অঙ্গ হিসেবে ১৯৯৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ভারত সরকার চিনি শিল্পকে লাইসেন্স-মুক্ত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া জারি করে। রপ্তানীর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু রপ্তানী বাস্তবে ২০০১-০২ সালে ১৩৬০ মেট্রিক টন থেকে ২০০৪-০৫ সালে কমে দাঁড়ায় মাত্র ২০ মেট্রিক টন এবং বিশ্ব বাণিজ্যিক লবির চাপে এই একই পর্যায়ে আমদানী ৪৩৮ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮০০ মেট্রিক টনে। এবছরের জানুয়ারী পর্যন্ত ৬.২৬ মেট্রিক টন আমদানী হয়েছে এবং আরও ১.৯ লাখ মেট্রিক টন বন্দরে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। ভারতবর্ষের সব অঞ্চলের চিনি উৎপাদকদের মালিক-সংস্থা আমদানী শুল্ক বৃদ্ধি করে চিনি আমদানী কমিয়ে আনার জন্য চাপ দিয়ে চলেছে। সরকার লেভি-সেলের মাধ্যমে রেশনে কম দামে চিনি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ চিনি দেশীয় চিনি উৎপাদকদের থেকে সংগ্রহ করে বাকী চিনি খোলা বাজারে বিক্রয় করার সুবিধা করে দিতে আমদানী কমিয়ে আনতে পারত। কিন্তু ২০০১ সালের মধ্যেই ভারত সরকার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নির্দেশিত কৃষি নীতিতে সম্পূর্ণ যুক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে অবাধ বাণিজ্য নীতি থেকে সরে আসতে পারছে না। রঙ্গরাজন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরও শিথিল করার তোড়জোড় চলছে। এই কমিটির রেভিন্যু শেয়ারিং ফর্মুলা চাষীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তাতে কৃষিপণ্যের বাজারদর আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রিত যোগান-চাহিদার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এই নীতি আসলে পরিচালিত হচ্ছে কারগিল, জামিকভ, উইলমার, মিত্রাপল ইত্যাদি বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থাকে ভারতীয় চিনি বাণিজ্যে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে।

প্রতিক্রিয়াশীল প্রত্যাঘাত
          বিশ্বায়নের অঙ্গ হিসেবে নতুন বাণিজ্য নীতির ফলে চিনি শিল্পে দেখা দেওয়া সংকটের অজুহাতে উত্তরপ্রদেশের আখ চাষিদের প্রদেয় ৩০০০ কোটি বকেয়া দিচ্ছে না মিলমালিকরা। ২০১১-১২ সালের ১৮,২০০ কোটি টাকার তুলনায় ২০১২-১৩ সালে ২২,৪৬২ কোটি টাকার আখ কিনেছে উত্তরপ্রদেশের মিলমালিকরা। ইতিমধ্যে ৮ টি মিলের মালিকরা ২০১৩-১৪ সালে মিল না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মুসলিম শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক উচ্ছেদের ফলে তাদের মধ্যে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে তাতে যদি তারা ত্রাণ শিবির থেকে অতি-সত্বর নিজ গ্রামে ফেরত যেতে না চায় তাহলে তা মিল-মালিকদের কাছে কার্যত আশীর্বাদ হিসেবেই বিবেচিত হবে, কারণ এক্ষেত্রে গোদামের চিনির স্টক খালি করার জন্য মিল বন্ধ রাখতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। আর যদি এই উদ্বাস্তুরা নিজ গ্রামে ফিরেও আসে, তাহলেও ন্যায্য মজুরি প্রদানের জন্য একজোট হওয়ার সাহস পাবে না। অন্যদিকে শ্রমজীবী মানুষের অনৈক্যের জন্য ছোট ও মাঝারি জাঠ চাষিরাও আখের ন্যায্য মূল্যের জন্য লড়ার বস্তুগত ও মানসিক সাহস সঞ্চয় করতে পারবে না। এমতাবস্থায় বৃহৎ জমি মালিকরা নতুন পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্যিক চাষের চেয়ে ‘অ্যাবসল্যুট গ্রাউন্ড রেন্ট’ বা জমির খাজনার মাধ্যমে সুনিশ্চিত আয়ের জন্য সামন্তীয় সম্পর্কের দিকে পশ্চাদগমন করাকেই শ্রেয় মনে করবে এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই খাপ-পঞ্চায়েতের মত পশ্চাদগামী শক্তিগুলো পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠার এক যোগসূত্র পাওয়া যায়। বৃহৎ বহুজাতিক বাণিজ্যিক বেপারি ও খাজনা বা সুদি ও ফাটকা লগ্নিকারী বৃহৎ পুঁজির জন্য এই পরিস্থিতিই সবচাইতে লাভজনক। আখচাষ, চিনি উৎপাদন ও বাণিজ্যে এই প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদগামী শক্তির এই নতুন সমীকরণ গড়ে উঠার জন্যই প্রয়োজন ছিল মুসলিম শ্রমিক ও জাঠ আখচাষিদের ঐক্য ভেঙে দেওয়া, যাতে অত্যন্ত কম মজুরিতে শ্রমিক খাটিয়ে আখচাষ ও চিনিকলের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে দেওয়া যায়। শ্রমজীবী মানুষের প্রগতিশীল ঐক্য বিরোধী এই শক্তিই মুজফফরনগরের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মুল চালিকাশক্তি, যে সংঘাত পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানিকভাবে চালিকাশক্তির এই সফলতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাই হচ্ছে আজকের গণতন্ত্রের প্রধান বিপদ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারাই এই পশ্চাদগামী শক্তির সুযোগ্য বাহক হবে যারা উদারবাদী আর্থিক নীতিকে জোরেসোরে এগিয়ে নিতে চাইবে এবং শ্রমজীবী মানুষের ক্ষমতা বৃদ্ধির উপযোগী আর্থ-সামাজিক সুরক্ষার নীতি একে একে বাতিল করতে উদ্যত হবে।

ক্ষমতায়ন ও নতুন বিকল্প
          বিশ্বায়নের উদারবাদী অর্থনীতি ও শ্রমজীবী মানুষেরর টানাপোড়েনের মধ্যেই কিছু কিছু পদক্ষেপ শ্রমজীবী মানুষের প্রশ্বাস নেওয়ার খোলা জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে। এনরেগা, খাদ্য সুরক্ষা, বীমা প্রকল্প ইত্যাদি এধরনেরই যৎসামান্য কিছু স্বস্তির জায়গা। এই প্রকল্পগুলি যদি বাস্তবে রূপায়ণ হয়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর প্রকৃত হিতাধিকারীদের মধ্যে পৌঁছে এবং রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের মত বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশগুলি কার্যকরী করে জনগোষ্ঠীগত বঞ্চনার খানিকটা অবসান করা হয় তাহলে উদার-আর্থিক নীতির প্রবক্তাদের ক্ষোভিত করলেও শ্রমজীবী মানুষরা কিছুটা বস্তুগত ও মানসিক শক্তি সঞ্চয় করবে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির করাল থাবা গোটা পরিস্থিতিকে যেভাবে গ্রাস করছে তাতে বর্তমান জনগোষ্ঠীগত নেতৃত্বকে দিয়ে এই কাজটুকুও হবে কিনা তা সন্দেহের আবর্তে।

         কিন্তু আমাদের একথা মনে রাখতে হবে যে এই উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো রূপায়ণ হলেও শক্তির ভারসাম্য থেকে যাবে প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে। রাষ্ট্র, রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নতুন গণতান্ত্রিক ভারসাম্য গড়ে তুলতে আমাদের যেতে হবে এমন এক নতুন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যা নতুন তত্ত্বায়নের সূত্রপাত ঘটায়, উল্টোদিকে আমাদের যেতে হবে এমন এক নতুন তত্ত্বের মধ্য দিয়ে যা নতুন অনুশীলনের জন্ম দেয় যেখানে গোটা শ্রমজীবী শ্রেণি নীতি নির্ধারণের বিতর্কে অংশ নিতে শুরু করে এবং তা এক স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করে।   

কোন মন্তব্য নেই: