“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

গোপন কথাটি রবে না গোপনে

                ।।  সুদীপ নাথ।।
(লেখাটি এখানেও আছে দেখুন।)
নেকেই বলেন, আমাদের মন নাকি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। উনবিংশ শতাব্দি অব্দি অনেকেই মনে করতেন, মন বলতে যা কিছু বোঝায়, তার সব কিছুই জন্মসূত্রে পাওয়া বিষয়। তখন তারা ধারণা করতেন, মনের কোন বিচার বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।  তখনকার ধারণাগুলো সবই ছিল অনুমান নির্ভর। যুগে যুগে বহু মনিষী, মনের অস্তিত্ব ও তার কার্যকলাপ নিয়ে অক্লান্ত গবেষণা করেছেন। কিন্তু শারীর বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে, মানব মনের হদিশ করতে তারা বার বার ব্যর্থ হয়েছেন। মানব শরীরের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপের সাথে মানব মনের সম্পর্ক খুঁজে পেতে হয়রান হয়েছেন। বিশেষত প্রাণীর ঘিলু তথা মস্তিষ্কের জটিল ক্রিয়াকলাপ, তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের করায়ত্ত না থাকার ফলে, শরীর ও মস্তিষ্ক ভিত্তিক মনোবিদ্যা তখনো গড়ে উঠতে পারেনি। তখনও মনোবিদ্যা আলাদা কোন বিষয় হিসেবে গণ্য হত না। দর্শন শাশ্ত্রেরই একটা উপশাখা হিসেবে গণ্য হত। সেই কারণে মনোবিদ্যার বিশেষ কোন গুরুত্ব ছিলনা। দর্শন শাশ্ত্রের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকার কারণে, মানুষের মন নিয়ে সকলেই, যার যার নিজের মত করে, যা খুশি বলার রাস্তা খোলা ছিলো।

      তখন পর্যন্ত সকলেই, নিজের মন দিয়েই অন্যের মন বোঝার চেষ্টা করতেন । তখন দর্শন শাস্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল, সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু বোঝা ও ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা। কবি সাহিত্যিকেরা, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেই মনের দ্বন্দ্ব খুঁজে বেড়াতেন। তখন জার্মান দেশই ছিল মনোবিদ্যা চর্চার প্রাণকেন্দ্র।

  এদিকে, ১৯০৩ খৃষ্টাব্দে সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Frayed), The Interpretation of Dreams এবং Psychopathology of Everyday Life নামে দুটি বই লিখে পরিচিত হন। এই বই দুটি থেকে জানা যায় যে তিনি মানসিক রোগগ্রস্ত মনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে স্বাভাবিক মনের ঠিকানা খুঁজতে প্রয়াসী হয়েছেন। ১৯০৫ সালে ফ্রয়েড যৌনমানস সম্পর্কে এক বইয়ে যৌনতার ক্রমবিবর্তন সম্পর্কিত এক তত্ত্ব প্রকাশ করেন। এই তত্ত্বের মূল কথাটি ছিল সর্বরতিবাদ। এই তত্ত্ব অনুসারে শৈশবের সবকিছু ইচ্ছা এবং আচরণই যৌনতা ভিত্তিক। ফ্রয়েডের এই তত্ত্ব লিবিডো তত্ত্ব নামে পরিচিত। তিনি আরও একটা তত্ত্ব খাড়া করে তার নাম দিয়েছিলেন ঈডিপাস কমপ্লেক্স। এই তত্ত্ব অনুসারে মাতার প্রতি পুত্রের মনে কামেচ্ছা জাগে এবং এই কামেচ্ছা নিবারনে পিতাকে সে তার পথের কাঁটা হিসেবে গন্য করে। একই ভাবে, কন্যারাও মাতাকে তাদের পথের অন্তরায় ভাবে। ফ্রয়েড ধারণা করেন এই সমস্ত তত্ত্ব দিয়েই সমাজ ও মানুষের জীবনের সমস্তকিছুই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তখন দার্শনিকদের বেশিরভাগই আমাদের মননক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে ভাববাদের আশ্রয় নিতেন, কল্পনার আশ্রয় নিতেন। ফ্রয়েড কিন্তু সেদিক থেকে একধাপ এগিয়ে নৃবিদ্যা, পৌরাণিক কাহিনী ইত্যাদির আশ্রয় নিয়েছেন। ফ্রয়েড প্রকৃতি-বিজ্ঞানের সাহায্য নেন নি। অথচ তখনই প্রকৃতি বিজ্ঞান অনেক কিছুই আবিষ্কার করে ফেলেছে। ফ্রয়েড মনে করতেন মানুষ সহজাত হিংস্র প্রবৃত্তি নিয়েই জন্মায় এবং তা সভ্যতার চাপে অবদমিত হয়ে থাকে। সময় সুযোগ মত তা মানুষকে হিংসাশ্রয়ী ধ্বংসাত্মক কাজ করতে উৎসাহিত করে।

                 তিনি আনস্টাইনকে এক চিঠিতে, এই তত্ত্ব জানিয়ে এক বিশাল চিঠি লিখেছিলেন । তিনি ঐ চিঠিতে আনস্টাইনকে লিখেছিলেন, এই তত্ত্ব অনুসারে, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী, যুদ্ধ হবেই। এই তত্ত্ব, সাম্রাজ্যবাদীদের খুব মনপছন্দ্‌ হয়ে উঠেছিল। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর ব্যক্তি চেতনার প্রসারে, সাম্রাজ্যবাদ যখন বুদ্ধিজীবীদের  সমালোচনায় কোণঠাসা, ঠিক তখনই ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে তারা লুফে নিয়েছিল। যুদ্ধ উদ্দেশ্য মাত্রই বাজার দখল – এই ধারণা থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করে, সাম্রাজ্যবাদীরা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে উর্ধ্বে তুলে ধরে, তার জয়গান শুরু করে দিল। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তত্ত্বকে চাপিয়ে দেয়া হল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ভারতে এই তত্ত্ব বাধ্যতামূলক করে টেক্সট্‌ বইয়ে অন্তর্ভূক্ত করে নিল।

            এখনো ভারতের সমস্ত  স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, এই তত্ত্ব বয়ে নিয়ে চলছে। কোনও বুদ্ধিজীবী টু শব্দটিও করছেন না, যা ভাবলে অবাক হতে হয়। অথচ ঐ সময়ের আগেই এই আজগুবি তত্ত্ব বিজ্ঞানের কষ্টি পাথরে যাচাই হয়ে বিজ্ঞানী মহল থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান এই তত্ত্বের উপর আর নির্ভর করে না।


                ক্ষুদ্র পরিসরে এখানে ফ্রয়েডিয় তত্ত্বের অসারত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বিস্তৃত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। মোটকথা, ফ্রয়েড যৌনতাকে আশ্রয় করে তত্ত্ব বানিয়েছিলেন, অথচ যৌনতার উৎস খুঁজতে সামান্যতম চেষ্টাও করেননি। যৌনতার এনাটমি ও ফিজিওলজি নিয়ে চিন্তাও করেননি। যৌনতাকে মনন ক্রিয়ার পশ্চাৎপট  (back ground) বিষয় হিসেবেই ধরে নিয়ে এগিয়ে গেছেন। মানসিক ক্রিয়ার অধঃস্তর (material substratum) অর্থাৎ মস্তিষ্ককেই বাদ দিয়ে, মনকে বুঝতে চেষ্টা করে গেছেন ফ্রয়েড সাহেব। ফ্রয়েডের কয়েকজন উত্তরসূরি, এই তত্ত্ব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও, বিশেষ কোন নূতন দিক নির্দেশ করতে পারেননি।

              এদিকে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই জারের সহায়তায়, রাশিয়ার একদল বিজ্ঞানী, গবেষণাগারে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে, কালজয়ী শর্তাধীন পরাবর্ত তত্ত্ব (Theory of Conditioned Reflex) আবিষ্কার করেন। এই বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে ছিলেন নোবেন জয়ী ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ। ল্যাবরেটরিতে, হাতে কলমে পরিক্ষার পর পরীক্ষা চালিয়ে যান। শর্তাধীন পরাবর্ত ভিত্তিক মনোবিদ্যার শুরু তখন থেকেই। তারপর পাভলভের নেতৃত্বে একের পর এক, অজানা তথ্য আবিষ্কার হতে থাকে।

               সংবেদন, প্রত্যক্ষণ, স্মৃতি, চিন্তা, স্বপ্ন, প্রক্ষোভ(emotion), ঐচ্ছিক নির্বাচন ইত্যাদি মনন ক্রিয়ার, বস্তুনির্ভর অধঃস্তরের (material substratum) সন্ধান এইসব গবেষণা থেকেই পাওয়া যায়। মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ তরঙ্গ ও জৈব রসায়নের, যেমন হরমোন ইত্যাদির ক্রমবর্ধমান আবিষ্কার, পাভলভের এই তত্ত্বকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। অনুমান নির্ভর অন্তর্দর্শন ভিত্তিক মনস্তত্ত্বের দিন, তখনই ফুরিয়ে যায়।

               পাভলভই মনোবিদ্যাকে দর্শনের গণ্ডির বাইরে বের করে এনে, বিজ্ঞান নির্ভর মনোবিদ্যা চর্চার সোপানটি স্থাপন করেন। পাভলভের এই তত্ত্ব নির্ভর করে, প্রমাণিত হয়েছে মানুষের সবকিছু ধ্যানধারণার উদ্ভব ঘটে, মস্তিষ্কে বাইরের জগতের ঘটনা এবং বস্তুর ধর্ম ও পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিফলন থেকে। আর চেতনা হচ্ছে অতীব জটিল বস্তু-মস্তিস্কের বিশেষ প্রক্রিয়া। বাস্তব বহির্জগতের প্রতিফলনই, বাস্তব মস্তিষ্কে চেতনার প্রতিফলন ঘটায়।

                বহির্বাস্তবের সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্র এবং জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে [পাঁচটি ইন্দ্রিয় হচ্ছে, শ্রবণেন্দ্রিয় (কান), দর্শনেন্দ্রিয় (চোখ), ঘ্রাণেন্দ্রিয় (নাক), স্বাদেন্দ্রিয় (জিভ) আর স্পর্শেন্দ্রিয় (চামড়া)], সম্পর্ক রক্ষার কাজই হচ্ছে স্বজ্ঞান প্রক্রিয়া বা চেতনা । চেতনা সংবেদনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে বহির্বাস্তবের প্রতিফলন। আর এ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে কালজয়ী ‘প্রতিফলন তত্ত্ব’ যা The Theory of Reflection নামে সমাদৃত।

           এই প্রতিফলন তত্ত্বের (Theory of Reflection) উপর নির্ভর করেই বিজ্ঞানীরা কয়েকটি মৌলিক সূত্রও উপস্থাপিত করেন। মানুষ যখন প্রথম সামাজিক জীবে রূপান্তরিত হয়, তখন মানুষের মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটেছিল। সমাজ ব্যবস্থার  বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে, মানব মনে আরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। সামাজিক ক্রিয়া-কান্ডের সাথে মানুষের মনেরও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে। এখানেই ফ্রয়েডের মনগড়া তত্ত্ব দূরে হঠে গেছে। ফ্রয়েড ভেবেও দেখেননি যে, পরিবার প্রথার বিবর্তনের ধাপগুলো কিভাবে ঘটেছে। এ পর্যন্ত কয়েক ধরণের পরিবারের রূপ আমরা দেখেছি। আর তিনি বর্তমানের অতি প্রকট, এক-পতিপত্নী পারিবারিক রূপটির বাইরে কিছুই জানতেন না, বা দেখতে চেষ্টাও করেন নি। আর বর্তমানের এই এক পতিপত্নী পারিবারিক রূপটিও যে ইতিমধ্যেই ভাঙ্গতে শুরু করেছে, এটা সকলে দেখতেই পাচ্ছেন। ভবিষ্যতে পিতার খোঁজ থাকবে কিনা কে বলতে পারে। আর যে পুত্রের পিতা, বর্তমান সমাজে বাইরে থাকে, পুত্রের জন্মের সময় থেকে, সেই পুত্র যখন কেবল মাত্র মা অথবা, মা ও প্রতিপালিকার সংস্পর্শে বড় হয়, কিংবা শুধুমাত্র প্রতিপালিকার সংস্পর্শে বা হোস্টেলে বড় হয়, তাদের ক্ষেত্রে লিবিডো তত্ত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? আর যে শিশুর মা জন্মক্ষণে মারা যান বা পিতা সন্তানকে গর্ভে রেখে মারা যান, সেই শিশুদের কি হবে? অথবা এইসব শিশুরা, যখন তাদের দাদু দিদিমারা প্রতিপালকের স্থানে থাকেন, তাদেরই বা লিবিডো তত্ত্বের কি ঘটবে? সমাজের পরিবর্তন ফ্রয়েড সাহেব দেখেন নি। তিনি মনে করতেন বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা আগেও ছিল, এবং তা সনাতন।


              বাস্তব জীবনের প্রত্যক্ষণ থেকে মানুষ ভাবনাচিন্তার বিষয় (content) যোগাড় করে। এসব প্রকৃতি আর সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আর আমাদের ক্ষেত্রে, সমস্ত প্রত্যক্ষণের সহায়তায় নূতন নূতন সংকেতের উপর একটা বিমূর্ত রূপ অনুভূত হতে থাকে। এইভাবেই গড়ে উঠে ধারণা। আর তাকে সাধারণীকরণ করার মাধ্যমে তা হয়ে উঠে বিমূর্ত। মস্তিস্ক, বাইরের পরিবর্তনের সাথে সক্রিয় এবং পরিবর্তনশীল সম্পর্ক স্থাপন করে, প্রতিনিয়ত আমাদের অভিযোজনে সাহায্য করছে। তারই নাম স্বজ্ঞান ক্রিয়া।

             অতীতের কোন প্রত্যক্ষণ যখন আমাদের মস্তিষ্কে অনুভুতি জাগায়, তখন তাকে বলা হয় চিন্তা। তা যুক্ত হতে পারে চলমান প্রত্যক্ষণের সাথেও। অতীতের অনেকগুলো ধারণা থেকেও আমরা নতুন নতুন ধারণা সৃষ্টি করতে পারি। এই পুরনো ধারণার উপর নির্ভর করে, নূতন ধারণা সৃষ্টি করাকে বলা হয় কল্পনা।

               মনের মধ্যে একবার ধারণা তৈরি হয়ে গেলে, খুশিমতো একটার সঙ্গে একটা জুড়ে দিয়ে কিম্ভূত কিমাকার অনেক ধারণা তৈরি করাও সম্ভব। জীন, পরী, দৈত্য, এমনকি ঈশ্বরও আমাদের মনে এভাবেই সৃষ্টি হয়, সম্পূর্ণ কল্পনার উপর দাঁড়িয়েই। উচ্চমার্গের মননক্রিয়া তথা ধারণা এবং চিন্তা (concept and thought) যেমন ভ্রান্তি দূর করতে পারে, ঠিক তেমনই আবার ভ্রান্তি তৈরিও করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসবের মূলে আছে বস্তু।

           প্রত্যক্ষণ, ধারণা, চিন্তা এবং চেতনা আমাদের কার্যকলাপ এবং বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ থেকেই জন্মায়। আবার অতীতের  ধারণা, চিন্তা এবং চেতনা আমাদের কার্যকলাপ এবং জীবনক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে এবং সর্বোপরি জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহন করে।

                মনস্তত্ত্ব শুধুমাত্র জীববিদ্যার বিষয় নয়। তা সামজিক-ঐতিহাসিক বিদ্যার সাথেও সম্পর্কিত। মানবমন গুণগতভাবে পশুমন থেকে স্বতন্ত্র। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুধুমাত্র আমাদের মানসিকতারই বিবর্তন ঘটে না, মনন ক্রিয়ার নিয়মেরও পরিবর্তন ঘটে চলে এবং তা সর্বদা একটা চলমান প্রক্রিয়া।

         শর্তাধীন পরাবর্ত তথা Conditioned Reflex-এর দৌলতেই আমরা আমাদের চৈতন্যের উন্মেষ ঘটাতে পেরেছি। এই শর্তাধীন পরাবর্ত আবার শর্তহীন পরাবর্ত অর্থাৎ জন্মগত রিফ্লেক্সের উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠে। নূতন নূতন শর্তাধীন পরাবর্ত যেমন গড়ে উঠে, আবার সেগুলো ভেঙ্গেও যেতে পারে। এই ভাঙ্গা গড়া সবসময় চলতে থাকে।

                তাই বলে, মানুষের আচরণের মূলে, নির্জ্ঞান বা ছোট বেলার অবদমিত কামনা বাসনার কোনও ভূমিকাই নেই। চেতনা অপরিস্ফুট থাকতে পারে, তার ব্যাপ্তি ও বিস্তার সম্বন্ধে সবকিছু জ্ঞান আমাদের না থাকতে পারে, কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রত্যক্ষনের সাহচর্যে, প্রয়োজনীয় চৈতন্যের সম্যক উন্মেষ ঘটানো সম্ভব।

সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৩

‘আম-আদমি’ – যুক্তি তর্কের প্রারম্ভ বিন্দু


।। অরূপ বৈশ্য ।।
(একটি সংক্ষিপ্ত নোট)
আম-আদমির সংজ্ঞা
ম-আদমি – শব্দ দ্বয়ের মধ্যে একটা মাটির টান রয়েছে। অতি-ব্যবহারে ক্লিশে না হওয়া পর্যন্ত একে আম-নাগরিকের দৈনন্দিন পরিভাষায় যুক্ত করার কৃতিত্ব নিশ্চয়ই শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির একাংশের। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এটি সংজ্ঞাবিহীন, ততক্ষণ পর্যন্ত এসম্পর্কে ধারণা সংজ্ঞাহীন। চিনদেশে ১৯৪৯-এর গণবিপ্লবে পিপল অর্থে গণ শব্দটির একটা সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। সেই সংজ্ঞা অনুসারে শ্রমিক – কৃষক ঐক্যকে মূল খুঁটি হিসেবে ধরে যাদের বাণিজ্যিক ও উৎপাদনের মালিকানার অস্তিত্বকে সুনিশ্চিত করার একমাত্র উপায় জাতীয় ও দেশের স্বার্থকে সুরক্ষিত করা তাদেরকে মিত্র শক্তি হিসেবে রাখা হয়েছিল, এর বাইরে বিভিন্ন ভাষাভাষির বৈচিত্র্যকে জনগোষ্ঠীর সাধারণ ধারণার আওতায় আনা হয়েছিল। ভারতবর্ষের মত বৈচিত্র্যময় ও জাতবর্ণে বিভাজিত সমাজে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ ও একচেটিয়া লুন্ঠনের যুগে প্রাকৃতিক ব্যবহারিক মূল্যকে পুঁজির সামাজিক ব্যবহারিক মূল্যে বলপূর্বক রূপান্তরের মাধ্যমে পরিবেশ-বিপর্যয়ের ফলে আম-আদমির পৃথক পৃথক ধারণাকে একটি সুসমঞ্জস্য সাধারণ ধারণা-কাঠামোয় সংযোজিত করা জরুরি। তা করা যায় যদি শ্রমিক, গরিব-ক্ষুদ্র-মাঝারি কৃষকদের জাতি-বর্ণগত পরিচিতি এবং পরিবেশ-বিপর্যয়ে সরাসরি জানমালে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীগত পরিচিতির একটা সুসমঞ্জস্য পরিসংখ্যান বয়ান করা যায়। কিন্তু আম-আদমির এই ধারণায় প্রধান ও নেতৃত্বদায়ী ভূমিকায় রাখা হয় শ্রমিক শ্রেণিকে যার স্বার্থ শেষ বিচারে সমস্ত জনগণের স্বার্থের সাথে মিলে যায়। ‘শ্রমিকদেরই নেতৃত্ব’ এই কথার মানে এই নয় যে তার কোন নায়ক ও তাঁর পার্ষদ থাকবে না। নিশ্চয়ই থাকবে, কিন্তু কেমন হবে সে নায়ক? জন লেননের গান A working class hero is something to beতা বলে দেয়। এজন্যই সম্ভবত লেননের মতো সংবেদনশীল গায়ক নিহত হন ঘাতকের বুলেটের আঘাতে। কিন্তু সংজ্ঞাবিহীন আম-আদমির কোন ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে কোটিপতি আরবপতিদের স্বার্থের তল্পিবাহকদের অনুপ্রবেশ ঘটে আম-আদমি সেজে হিরো হয়ে উঠবে তা বলা বেজায় দুষ্কর। তবে দল-সংগঠন ও আম-আদমির মধ্যে সম্পর্ক কী হবে তার একটা অভিনব প্রয়োগ আমরা এবার দিল্লির রামলিলা ময়দান থেকে যাত্রা শুরু করে নির্বাচনের ময়দান পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করেছি। তাত্বিক কনসেপ্টের দিক থেকে এই প্রক্রিয়া নতুন নয়, বরঞ্চ ফরাসি বিপ্লব ও গ্রামসি তত্বে বিকশিত ধারণা থেকে এ প্রক্রিয়া এখনো বহু যোজন দূরে। দিল্লির এই প্রয়োগ কী রূপ ধারণ করে এনিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা যেতেই পারে। কিন্তু এই গোটা প্রকরণে সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের যে কথন আমাদের সামনে হাজির করা হচ্ছে, তা পশ্চিমের উন্নত দেশের ইতিহাসে আধুনিক সমাজ গঠনের সময়কার ধারণায় প্রভাবান্বিত। সিভিল সোসাইটির কনসেপ্টকে আমাদের মত পিছিয়ে পড়া পর-নির্ভরশীল দেশের প্রেক্ষাপটে পুনর্নির্মাণ করা জরুরি বলেই মনে হয়।

সুশীল সমাজ ও আম-আদমির আন্তঃসম্পর্ক
          ভারতবর্ষে সিভিল সোসাইটি অ্যাক্টিভিজম বা নাগরিক সমাজের তৎপরতা নিয়ে কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী আমাদের যা বোঝাতে চান, তার এক বিপরীত বাস্তব নমুনা এখানে তুলে ধরছি। সম্প্রতি মুম্বাইর পস এলাকা ওরলির পেপসি কোলা চত্বরে অবৈধভাবে নির্মিত বহুতল দালানের ফ্ল্যাট বাড়িগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সাময়িকভাবে রদ করে সুপ্রিম কোর্ট এক রায় দেয়। এই দালান ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি ও আইন-বহির্ভুত প্রতিবাদ মিডিয়ার মাধ্যমে গোটা দেশের নজর কাড়ে এবং মুম্বাই মিউনিসিপাল কর্পোরেশন ও প্রশাসন এই ফ্ল্যাট বাড়ির আবাসিক ও তাদের সহমর্মী বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতি অত্যন্ত মানবিক আচরণ করে। বিভিন্ন মহল থেকে এই আবাসিকরা যে সহমর্মিতা ও সহযোগিতা পাচ্ছেন তাতে এটা আশা করা যায় তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়বেন। এই আবাসিকদের কী পরিচয়? তারা মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত যাদের মাসিক আয় লাখের হিসেবে করতে হয় এবং ভারতবর্ষের মত দেশে এই শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা এখন এতটা শক্তিশালী যে তারা যে কোন সরকারের মতামত ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবান্বিত করতে পারেন। এদেরকে রুষ্ট না করে এক নতুন ব্যবস্থা কায়েম করার কথা এখন শাসক শ্রেণিকেও ভাবতে হচ্ছে এবং তাই সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে মোর্চা খুলতে ব্যস্ত, যদিও কীভাবে নিজেদের কৃতকর্মের দাগ মিটিয়ে এই মোর্চা সামলানো যায় সেব্যাপারে প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতিবাজরা পথ খোঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু মুম্বাইর এই আবাসিক এবং তাদের ন্যায্য স্বার্থকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসতে সাহায্যকারী মিডিয়ার অর্থবহ মৌনতা আমাদের সামনে তখনই এক বৈপরীত্যকে সামনে নিয়ে আসে, যখন লাখ লাখ বস্তিবাসী উচ্ছেদ হন ও পুনর্বাসনের দাবিতে আন্দোলন করেন। অথচ তাদের রক্ত জল করা শ্রমের বিনিময়েই মুম্বাই নগরি গড়ে উঠে।  শুধুমাত্র ২০০৪ সালেই মুম্বাই নগরির ৭০ হাজার ঝুপরির উপর দিয়ে বুলডোজার চলেছে, প্রায় ৩ লাখ লোক গৃহহীন হয়েছেন, শীত ও রোগের প্রকোপে বহু শিশু মৃত্যুবরণ করেছে। এধরনের অভিযান প্রায়শই চলতে থাকে। কিন্তু ফ্ল্যাট বাড়ির আবাসিকদের মত নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন নীরব থাকায় এদের দুর্দশা মিডিয়ার ফোকাসেরও বাইরে থাকে। তাদের চোখ এদৃশ্য দেখতে অস্বীকার করে, কারণ মুম্বাইকে সাংঘাই বানানোর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে তাদের কাছে এ এক প্রয়োজনীয় অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই বিবেচনা এমনই নিষ্ঠুর যে মুম্বাই নগরিকে সাংঘাই বানানোর দায়িত্বে থাকা আমেরিকান সাব-প্রাইম সংকটের খলনায়ক আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানী ‘গোল্ডম্যান সাচ’ আমাদের সস্তা শ্রম ও সম্পদ শোষণ করে অতি-মুনাফা কামিয়ে নিলেও তাদের তথাকথিত দেশাত্ববোধে আঁচড় লাগে না। একটি হিসাবে দেখা গেছে, ভারতবর্ষে সস্তা শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য নির্মাণ-ব্যয় লণ্ডনের চেয়ে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ কম। গোল্ডম্যান সাচ, যে কোম্পানী মুম্বাই ও ব্যাঙালুরের হাউসিং-কনস্ট্রাকশনের সাথে যুক্ত, ১.৯ বিলিয়ন ডলার নির্মাণ-ব্যয় কমানোর ব্যবস্থা নিয়ে ২০১২-এর শুধুমাত্র তৃতীয় কোয়ার্টারেই ১.৫ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে। এই ব্যয় কমানোর প্রক্রিয়ায় নিশ্চিতভাবে শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠনের মাধ্যমে স্টিমরোলার চলেছে শ্রমজীবী মানুষের উপর। সুতরাং মধবিত্ত মনোজগতের এই ফ্রেমওয়ার্ক থেকে না বেরিয়ে নাগরিক সমাজের সক্রিয়তার মাধ্যমে আমাদের ইপ্সিত সুশীল সমাজের কল্পনা অলীক থেকে যায়। তাই সিভিল সোসাইটির সংজ্ঞায় আমাদের মত দেশে এক ভিন্নতর মাত্রা সংযোজিত করা জরুরি যাতে সুশীল সমাজের সক্রিয়তার প্রগতিশীল ভূমিকা নির্ধারণ করা যায় এবং এই সুশীল সমাজের সাথে আম-আদমির আন্তঃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায়।
            
আম-আদমির চাহিদা ও পরষ্পর বিপরীত মডেল
আম-আদমি চায় রুটি-রুজি-উন্নয়ন। কিন্তু এরজন্য অর্থ কোত্থেকে আসবে? এনিয়ে দুটি মত রয়েছে। একদলের মতে আয় বৃদ্ধি হলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যয় বৃদ্ধি করা যাবে এবং তার সুফল চুইয়ে চুইয়ে নিচের তলায় আম আদমির কাছে যাবে। এই মতের প্রবক্তাদের কাছে আয়-ব্যয়ের পন্থা-পদ্ধতি নিয়ে রাষ্ট্র বা জনগণের মাথা না ঘামালেও চলবে – বাজার তার নিজস্ব নিয়মে এই কাজটি করে দেবে। বাজারের মাথা হয়ে যে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট দুনিয়া বসে আছে তাদের আয় বৃদ্ধি হলেই আম-আদমির জন্য প্রয়োজনীয় বাকী কাজ স্বাভাবিক নিয়মেই হয়ে যাবে, রাষ্ট্র কেন এব্যাপারে মাথা ঘামাবে? সুতরাং রাষ্ট্রের দায়িত্ত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা ও দুর্নীতি দমন করা। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। কর্পোরেট দুনিয়ার বড় বড় মালিক ও তাদের রাজনৈতিক-সামাজিক ও বৌদ্ধিক সাগরেদদের আয় বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে অসাম্য ও বৈষম্য। দারিদ্র্য, বুভুক্ষা, অনাহার, অশিক্ষা, বেকারত্ব বৃদ্ধি তাদের আয় বৃদ্ধির সাথে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এই বাস্তব বাজারের নিয়মের প্রবক্তাদের বাধ্য করেছে আরেকটি দাওয়াই আবিষ্কারে। সেই দাওয়াইটির গালভরা নাম হলো ‘কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব’ (Corporate Social Responsibility)। ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানী তো মুনাফা করার জন্যই নেমেছে, আর শ্রমিকদের স্বার্থ দেখে তো আর মুনাফা হয় না। কিন্তু বাজারে তো চাহিদাও তৈরি করতে হয়। তাই এই প্রবক্তারা জনগণের কথা, আম-আমদির কথা ভাবেন – তাই তাঁরা কোম্পানীগুলোর দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন। অর্থাৎ একচেটিয়া কোম্পানীগুলো শ্রম-শোষণ করে যত খুশি মুনাফা করুক – কিন্তু সামাজিক কাজে কিছু দান-দক্ষিণাও করুক। সরাসরি সামাজিক কাজ করে ভূপালের গণ-হত্যাকারী আমেরিকান ডাও-ক্যামিকেলের মত কোম্পানীদের ভাবমূর্তিতেও কিছু হোয়াইট-ওয়াশের কাজ করা যায়, তাদের দান-দক্ষিণার মধুভাণ্ডের অর্থপ্রাপক এনজিও ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের হয়ে মিডিয়া দুনিয়াকে আকৃষ্ট করার মত স্মার্ট ও তুখোর ভাষণ দিয়ে বেড়াতে পারেন। লোক ঠকিয়ে ব্যবসা করে দেবালয়ের ভিখারিদের থালায় পয়সা ছিটিয়ে রাগ ভৈরবির সুর সৃষ্টির প্রয়াস করার মতই ব্যাপার – প্রতিটি থালায় ট্যুং-টাং আওয়াজ উঠলেই পাশের দর্শকরা বলে উঠে – আহা দেখছ না কি উদার দিল!
              অন্যদিকে দ্বিতীয় প্রবক্তারা বলছেন – অর্থের সংকুলান করতে হলে রাষ্ট্রের উদ্যোগে একটি জাতীয় শিল্পনীতি থাকতে হবে, সরকারি উদ্যোগে কর্মসংস্থান করতে হবে যাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা বাড়ে। ভ্যানেজুয়েলার সাভেজ যেমনটি করেছিলেন ঠিক তেমনি আয়ের সমস্ত উৎসকে সরকারিকরণ করে তার থেকে আয়কে জনগণের জীবনধারণের মানন্নোয়নে লাগাতে হবে। একথা শুনে প্রথম ধারণার প্রবক্তারা অপত্তি তোলেন এই বলে যে সরকারি খণ্ড মানেই তো দুর্নীতি, অদক্ষ পরিচালনা ও বকলমে বৃহৎ প্রভাবশালী ব্যবসায়িক চক্রকে মদত দেওয়া। এই অভিযোগগুলি ফেলনা নয়। কিন্তু তারা রোগের এই লক্ষণগুলি দূর করতে আগ্রহী নন, বরঞ্চ এই অজুহাতে গামলার স্নানের জলের সাথে বাচ্চাকেও ছুড়ে ফেলে দিতে চান।

দুর্নীতির প্রতিষেধক ও আম-আদমির রাজনীতি

            রোগের এই লক্ষণগুলিকে দূর করার একমাত্র মহৌষধ হলো রাষ্ট্রের সবকটিকে অঙ্গকে জনগণের নিয়ন্ত্রণে আনার কাঠামোগত ব্যবস্থা করা। এই নিয়ন্ত্রণে আনার অনেকগুলি পন্থার মধ্যে একটি নিশ্চিতভাবে লোকপাল আইন, তবে এটি সর্বরোগের প্রতিষেধক নয় - তার সাথে আরও অনেক কাঠামোগত ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। কিন্তু আমাদের উত্থাপন করতে হবে তার চাইতেও মৌলিক প্রশ্ন। এশিয়ান ডেভেলাপমেন্ট ব্যাঙ্কের লোনের সর্ত হিসেবে জারি হয়েছে বিদ্যুৎ আইন ২০০৫। এখন ব্যক্তিগত খণ্ডকে অডিটের অধীনে এনে দুর্নীতিমুক্ত করে বিদ্যুৎ দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে হয়ত খানিকটা প্রভাব ফেলা যায়। কিন্তু প্রশ্ন তো তোলাই উচিত যে এভাবে বিদ্যুৎ দরের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ কী করে কায়েম করা সম্ভব? আম আদমির মুখে দুবেলা খাওয়ার তুলে দেওয়ার জন্য সর্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা জরুরি। এই লক্ষ্যে সামান্য অগ্রসর হয়ে জারি করা হয়েছে খাদ্য সুরক্ষা আইন। কিন্তু আমাদের সরকার আমাদের দেশের জনগণের জন্য কতটুকু ভর্তুকি দিতে পারবে তা ঠিক হয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) যার তেত্রিশটি সদস্য-রাষ্ট্রের মধ্যে ভারতবর্ষও একটি। এক্ষেত্রে এই সংস্থার নিয়ম ও আইন মেনে চলতে ভারত সরকার বাধ্য। এই নিয়ম ও আইনগুলি পশ্চিমী দেশের অনুকূলে ও নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিমের দেশগুলি চায় না ভারতবর্ষের মত দেশগুলি কৃষিক্ষেত্রে কোনধরনের ভর্তুকি দিক, যদিও তারা নিজেদের দেশে কৃষিক্ষেত্রে বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি বজায় রেখে তাদের অনুকূলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম ও আইনকে তৈরি করে। তাই আমাদের দেশের মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য এই প্রশ্নটি উত্থাপন করা জরুরি যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম ও আইন ভারতবর্ষের মত দেশের অনুকূলে পরিবর্তন না করে এদেশের মানুষের খাদ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা কি সম্ভব? এধরনের প্রশ্ন এদেশের সাধারণ মানুষ আজ না হোক কাল উত্থাপন করবে এবং এই প্রশ্নগুলি যখন উত্থাপন হবে তখনই রাজনীতি হয়ে উঠবে আম-আদমির রাজনীতি। 

রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৩

প্রসঙ্গ জাতীয় সঙ্গীতে ‘কামরূপ’ এবং ‘জাতীয়তাবাদে’র রবীন্দ্রনাথ

                        (লেখাটি এই প্রসঙ্গে আরো কিছু লেখার সঙ্গে ২২ ডিসেম্বর্‌ ২০১৩র 'সাময়িক প্রসঙ্গে' প্রকাশিত)
    

            বাংলাদেশের জাতীয় কবি যে নজরুল ইসলাম এই তথ্য যে কোন বাঙালি জানেন, কিন্তু ভারতের জাতীয় কবির নাম জিজ্ঞেস করলে সেই বাঙালিই ভাবতে বসবেন। ভারতের বাঙালিই এটা মনে রাখেন না, বাকিদের কা কথা! এটা একটা প্রমাণ যে ভারতীয়দের ‘জাতীয়তা’ বড় নির্ভেজাল নয়। দুই দশক আগেও সিনেমা শেষে হলে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ বাজত, বহু বেসরকারি অনুষ্ঠানাদিরও শেষে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ বাজত, আজকাল বহু সরকারী অনুষ্ঠানেরও উদ্বোধনী বা সমাপ্তী সঙ্গীত নয় এই গান। সেখানে অসম বিধান সভাতে যদি এই গানে ‘কামরূপ’ শব্দ ঢোকানো নিয়ে প্রস্তাব আসে আর বিতর্ক হয়, তবে অসমের বাঙালি –অসমিয়ার বাইরে যে কেউ মাথা ঘামাবেন এমনটা মনে হয় না। শুধু প্রবোধ চন্দ্র সেনের প্রস্তাব মতো ‘অসম’ ঢুকিয়ে কাব্যের এবং সমাজের ছন্দ রক্ষা যদি করাও যায়, তবে অন্যেরাও সেরকম ছন্দ রক্ষার দাবি নিয়ে ময়দানে নামবেন বলে এর আগেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি, ভবিষ্যতেও নেয়া কঠিন হবে বলে প্রশান্ত চক্রবর্তী তাঁর সম্প্রতি লেখা নিবন্ধে দাবি করেছেন। তাই এই নিয়ে বিতর্ক বিতর্কেই থাকবে। হেরফের কিছু হবে বলে আতঙ্কের কোনো কারণ দেখি না। আর ভারতে জাতীয়তা জিনিসটা যে বেশ ভেজালে ভরা তার বড় নজিরতো দিন কয় আগে সরকারি ভাবে অসমের জাতীয় সঙ্গীতকে স্বীকৃতি দেয়া। এটিও অসমেই প্রথম ঘটেছে তাও নয়, অনেক প্রদেশের বহু আগে থেকেই সরকারি ভাবে স্বীকৃত নিজস্ব গান আছে। আমরা বাকিরা জানি না তার কারণ, না আমরা সেই সব প্রাদেশিক ‘জাতি’র মানুষ, না আমরা নির্ভেজাল ‘ভারতীয় জাতি’। একটা জোড়া তাপ্পি  দিয়ে আছি আর কি। আমরা নিজের আঁতে ঘা না লাগলে কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমিও ঘামাই না। ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে ‘কামরূপ’ শব্দ ঢোকে গেলেও আমার কিচ্ছু যায় আসে না, না ঢোকলেও কিছু না। বাকি ভারতীয়ের মতোই। আর কিছু বাঙালি আহত বোধ করবেন বলেই যে আমিও করব—--তার পক্ষেও কোনো প্রবল যুক্তি মাথাতে আসছে না, কারণ গানটিতো আর বাঙালির ‘জাতীয় সঙ্গীত’ নয় , ভারতের ‘জাতীয় সঙ্গীত।’

     তবে এই সুযোগে রাজনীতি যখন হচ্ছেই, রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি নিয়ে দু’টো কথা লিখবার মোহ ছাড়া কঠিন। ‘জাতি’ , 'জাতীয়তা’ , ‘জাতি রাষ্ট্র’ নিয়ে দুনিয়ার সব দেশে বিবাদ কাজিয়া লেগেই থাকে। সে যে কী ভীষণ বর্বরতা এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন গোটা জীবন আর সতর্ক করে গেছেন ভারতীয়দের। এই জাতীয়তাবাদেরইতো চূড়ান্ত প্রকাশ দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে তিনি দেখেছিলেন। আর নিরলস লড়েওছিলেন  জীবনের শেষভাগে ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে । তিনি তাই  লিখে গেছেন, ‘পরকে আপন করবার প্রতিভা’ ঝেড়ে যেন পশ্চিমকে অনুকরণ না করে ভারত, অভিশাপ নামবে। বাংলাদেশের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেও এই চার দশকে এই নিয়ে কোনো মীমাংসাতে যেতে পারে নি, রক্ত ঝরিয়েই চলেছে। স্মরণ করুন গানটির রচনা কালের কথা। রাজবন্দনা করবার উদ্যোগটা ছিল ‘জাতীয় কংগ্রেসে’র, রবীন্দ্রনাথের তাতে সায় সম্মতি কিছুই ছিল না। অথচ, পরদিনই কাগজে সত্যমিথ্যা মিলিয়ে বদনাম কিনা বেরুলো রবীন্দ্রনাথের। ব্যাপার কী? এটা হতে পারল কেন? কারণ , ১৯০৫এর পরে তিনি ক্রমেই উগ্রস্বদেশীয়ানা, উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছিলেন। এবং এর বিপদ বোঝাতে গিয়ে তিনি বারে বারে পশ্চিমা জাতীয়তাবাদের বর্বরতার নজিরই টানছিলেন। তাতেই চরমপন্থীদল ধরে নিচ্ছিলেন তিনি দেশদ্রোহী, বৃটিশের স্তাবক। জাতীয়তাবাদকে বাঁচাতে তাঁকে আরো বেশি ‘স্তাবক’ প্রমাণ করো। কোনো যুক্তি বুদ্ধির ধার কেই বা ধারে। প্রশান্ত একটা যুক্তি তুলে ধরলেন বটে, সরকার সেগুলো ব্যবহারও করলেন। এখন, তাঁর বিরুদ্ধে ‘বঙালি হৈ ‘কামরূপ’ শব্দর বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্র’ করবার অভিযোগ উঠলেও উঠতে পারে।এঁদের জন্যে ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা’ কিম্বা ‘বন্দেমাতরম’গানই ঠিক ছিল। লক্ষ্য করে দেখুন, দুটো গানেই সত্যের কোন বালাই নেই, আবেগ প্রচুর আছে। যিনি লিখলেন ‘সারে যাহাসে আচ্ছা’, তাঁর বিড়ম্বনা দেখুন, তিনি পাকিস্তানের জাতীয় কবি। আর যারা এই গান করেনও প্রবল ‘প্রেমে’ তাঁরাও মনে মনে জানেন যে বিলেত কিম্বা আমেরিকাই আসলে দুনিয়ার সবচে’ ‘আচ্ছা’ দেশ। আর ‘সুজলাং সুফলাঙে’র কথা কী বলব? যে উপন্যাস থেকে নেয়া হয়েছে সেটির শুরুতেই আছে এক মন্বন্তরের গল্প। আর আপনি যখন আজ গাইবেন গানটি তখনো হয়তো দেশের কোথাও না কোথাও কোন কৃষক ঋণভারে আত্মহত্যা করবেন কিম্বা শ্রমিক মরবেন না খেয়ে। 

     শ্রমিকের না খেয়ে মরবার ঘটনাটি ঘটে পুঁজির কেন্দ্রীভবনের জন্যে, সেই পুঁজির স্বার্থেই দরকার পড়ে এক প্রবল কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের। ‘জাতীয়তা’ সেই রাষ্ট্রের দর্শন। জাতিরাষ্ট্র এক ‘পুঁজিবাদী’ নির্মাণ। পুঁজিবাদের আগে ‘জাতীয়’ বলে কিছু ছিল না। এর পরেও ‘জাতীয়’ বলে কিছু থাকবে না। রবীন্দ্রনাথ শুধু এভাবে বিষয়টি দেখেন নি, মনে হয়েছে এই সব পশ্চিমা ব্যামো, ভারতীয়রা শুধু অনুকরণ করছেন। যারা ‘কামরূপ’ শব্দটি ঢোকাতে চাইছেন, তাদেরও ব্যামোটি কিন্তু সেই একই, তারা বিষ দিয়ে বিষক্ষয় করতে চাইছেন মাত্র। এগুলো হতে থাকবে। কারণ দেশে অসম বিকাশ আছে, আর তার বিরুদ্ধে সংগত ক্ষোভও আছে। সেই ক্ষোভকে কেউ কাজে লাগাবে না, এ হতে পারে! প্রশান্ত ‘হিমাচল’ শব্দের মানে বুঝিয়েছেন, কারো মগজে ঢোকবে না । কারণ স্বার্থের কথা আছে।
     রবীন্দ্রনাথ ‘কংগ্রেস’ নামের আগে ‘জাতীয়’ শব্দ জোড়া নিয়ে বিদ্রূপ করেছিলেন, তাঁর গানের আগে ‘জাতীয়’ শব্দ জুড়ে দেয়াটা ঠিক হয় নি। আকস্মিক ভাবে স্বাধীনতার পরে পরেই জাতিসংঘের এক অনুষ্ঠানে ভারতের এক গান চাই বলে চেয়ে পাঠালে নেহরু সরকার এই গানটিই পাঠিয়ে দেয়। আর সেখানে বহুল প্রশংসিত হলে গানটি থেকে যায় মাত্র। এই গানে, একটি চিরদিনের বৈচিত্রময় ভারতের কথা আছে, তেমনি আছে ভবিষ্যত ভারতের স্বপ্নের কথা । সেই স্বপ্নই ‘জনগণমনঅধিনায়ক ভারতভাগ্যবিধাতা’ ইনি আদৌ কোন সর্বশক্তিমান একেশ্বর নন, ক্ষমতাসীন রাজাতো ননই।তিনি বৈচিত্রের মধ্যে ‘জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক’ মাত্র। রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’ তত্ত্বও পাঠক এই সঙ্গে ঝালিয়ে নিতে পারেন। সেই স্বপ্নের কাছেই জানানো একটি প্রার্থনা আছে গানে , “তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে” এই আশিসটি না পেলে কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের কোন দেশেরই মুক্তি নেই। এমন কি যে নেপাল, কিম্বা শ্রীলঙ্কার হয়তো কোন মাথা ব্যথা নেই এই গানটি নিয়ে তারও রাজনীতি এই মুহূর্তে ঘোরপাক খাচ্ছে এই গানের মর্মকথাকে কেন্দ্র করে। নেপালেতো বটেই।এই কথার মধ্যে সবাইকে ‘একাকার করে ফেলবার’ সম্প্রসারণবাদের সন্ধান করে লাভ নেই। নেপাল  কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘হিমাচলে’রই একটি বহুভাষার, বহু ধর্মের, বহু বর্ণের এবং নৃগোষ্ঠীর দেশ ।
   
  গানটির বাদ পড়া অংশে আছে, “জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!” এই জনগণপথপরিচয়টি একদিন সত্য হবে এই উপমহাদেশে, হতেই হবে। তার আগে আমরা যেন প্রস্তুত থাকি ‘কামরূপ’ শব্দের দাবিটি উঠে কেন বারে বারে এর সত্য সন্ধানে। এই সত্য আছে, গানের বাইরে। ‘জাতীয় সঙ্গীতে’র ‘জাতীয় কবি’ হয়ে উঠবার পরে কিন্তু উত্তরভারতে এক ‘হিন্দি-হিন্দু রবীন্দ্রনাথে’র নির্মাণের একটি প্রক্রিয়াও প্রবল হয়। নজির হিসেবে অমরচিত্র কথাতে উপস্থাপিত রবীন্দ্রনাথের দিকে কেউ তাকাতে পারেন, বিপরীতে আন্তর্জাতিকতাবাদী এই মানুষটিকে ‘বাঙালির রবীন্দ্রনাথ’ বানাবার কি কম প্রয়াস হয়েছে কিছু? প্রতি বছরই তো হচ্ছে। তবে, কামরূপ শব্দ ঢুকিয়ে ‘অসমিয়া রবীন্দ্রনাথে’র নির্মাণ কেউ করতে চাইবে না কেন! পরস্পরকে ‘ষঢ়যন্ত্রকারী’ বললে চলবে? তবে আর রবীন্দ্রনাথ যে লিখলেন, “অন্যের মধ্যে প্রবেশ করিবার শক্তি এবং অন্যকে সম্পূর্ণ আপনার করিয়া লইবার ইন্দ্রজাল ইহাই প্রতিভার নিজস্ব” --- সেই প্রতিভারও দেখছি পতন ঘটবে।

মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩

বিদিত কাকু / সুদীপ নাথ

(C)ছবি
 সুদীপ নাথ

খেলার শিবিরে সন্ধ্যাবেলা সবাই যখন খেতে বসেছিল, বান্টি তখন বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছিল । বাড়ির কাছেই জেলা ভিত্তিক খেলার শিবির শুরু হয়েছে গরমের ছুটিতে আজই। বান্টি শিবিরে যোগ দিতেই এসেছিল।
        সে চলে যাচ্ছিলো তাড়াহুড়ো করে, পেছন দিকে না তাকিয়ে। কেমন যেন ভয় ভয় করছিল তার, তাকে না আবার ফিরতে বাধ্য করা হয় । শিবিরের সীমানা ছাড়ার পরই মাত্র, বান্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছে।
      সুদীর্ঘ দেবদারু, বুড়ো বটগাছ আর সরু সরু সুপুরি গাছগুলো যেন তীব্র নিন্দার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো তার দিকে।
       বান্টি কিন্তু একাই বাড়ি আসছিলো না,  মা মমতাও তার সঙ্গেই ছিল। মমতা থেমে থেমেই বান্টিকে বোঝাচ্ছিলো আর বলছিলো-
-- দ্যাখ্‌ , খেলার শিবির এক সমুদ্র, তুই ছেড়ে চলে যাচ্ছিস, পরে তো তোর নিজেরই আফসোস হবে, পস্তাবি কিন্তু, চল আবার।  মমতা বিষণ্ণ মনে কথাগুলো বলে চলে।
-- না, মামণি,  আমি বাড়িই যাব। আমি বাড়িতেই থাকবো, তোমার সঙ্গে আর বাবার সঙ্গে।  মাকে মিনতি করে বান্টি।
--ঠিক আছে, ঠিক আছে। এক কথা বার বার বলতে হবেনা তোর। ক্লান্ত হয়ে মা বললেন, চল, আমরা বাড়িতেই তো যাচ্ছি ।
       চারদিকে পাখির কলকাকলি। কিন্তু, বান্টির কানে তা ঢুকছিল না । তার চোখ চারপাশের সৌন্দর্য এড়িয়ে চলছিল। সে মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করেই হাঁটছিল চোখের জল মুছতে মুছতে। ক্বচিৎ থামছিলও।
      --মা-মণি, আমি এখন কত সুখী! ওখানে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। ওখানে থাকলে আমার খুবই মন খারাপ হোত। তুমি আমাকে একটুকুও বুঝতে  পারছো না। মায়ের দিকে না তাকিয়েই চলছিলো  বান্টি।
মমতা ধীরে মাথা নাড়ে। বান্টি যদি তার মনের ভিতর একটুও উঁকি দিতে পারতো, তবে বান্টি দেখতে পেতো যে, সে নিজের ছেলের সঙ্গে নিজেই কেঁদে ফেলতে প্রস্তুত।  আরও আধ ঘণ্টা পর ওরা বাড়ি ফিরবে, তখন বান্টির বাবা শৌণ্ডিরের সঙ্গে দেখা হবে। বান্টির এই অপ্রত্যাশিত  খেলার জীবনের পরিসমাপ্তি দেখে, বান্টির বাবা কী ভাববে ?
         মমতা যেন শৌণ্ডিরের কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে -  ‘এই হচ্ছে তোমার শিক্ষার ফল ! ছেলে নয়, যেন মেয়ে মানুষ করছ। এসব হচ্ছেটা কি ? যেন ও এখনও দুধের শিশু। ওকে বাড়িতে নিয়ে আসার দরকারটা কী ছিল ? আর তুমিই বা কেন ক্যাম্পে গিয়েছিলে শুনি ? ওর কিছুই হত না । দুয়েক দিন কেঁদে কেঁদে ঠিক হয়ে যেতো । পুরুষ মানুষকে আরো কত কিছুতেই অভ্যস্ত হতে হয়। তুমি তো দেখছি ওকে ন্যাকা বানিয়েই ছাড়বে।’বাড়ি ফিরলে আবারো তাদের মধ্যে সেই একই কথাবার্তা শুরু হবেঃ- মমতা ছেলেকে লাই দেয়। তার সমস্ত দোষ ক্ষমা করে দেয়, নিজের আদর আর করুণা দিয়ে বান্টিকে কেবল দুর্বলই করে তুলছে মমতা। সেজন্যেই নাকি বান্টির চরিত্রটাও পুরুষের মত হচ্ছেনা।
           মমতা ভেবেই চলে। অনেকেই তো বলে, বাবাকে কড়া হতেই হবে। অপরাধ করলে বাবা কিশোর ছেলেকে শাস্তি দেবেন, নয়ত ছেলের মধ্যে দায়িত্বহীনতা বাসা বাঁধবে। কিন্তু অনুশোচনা ছাড়া কেবল শাস্তিতে কোনও কাজ হয়না। শিশু যদি দোষ না বুঝে ও তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে না চায়, তাহলে শাস্তি তাকে কিছুই শেখাবে না বরং তাকে আরও চটিয়ে তুলবে। শৌণ্ডির যদি স্বৈরাচারী হতো, খুব বেশি কঠোর হতো, যারা নিজেকে ছাড়া আর কাউকে গ্রাহ্য করেনা, তাহলে সমস্ত বিষয়গুলো সঙ্গে সঙ্গেই স্পস্ট হয়ে যেতো মমতার কাছে। কিন্তু ও তো মনেপ্রাণেই বান্টির মঙ্গল কামনা করে সবসময়। সেও চায় বান্টি মানুষের মতো মানুষ হোক, পুরুষের মতো পুরুষ হয়ে উঠুক। আর তাই মমতা এখন দুশ্চিন্তায় ভোগছে। শৌণ্ডিরের কথায় সবসময়ই যে সত্যতা রয়েছে তা মমতা লক্ষ্য করেছে।
          এখন মমতার মনে পড়ছে, সেই অন্তহীন পারিবারিক সংঘর্ষগুলোর কথা, যা দেখা দিতো বান্টির জীবনের যেকোনও প্রশ্নকে ঘিরে। সংঘর্ষগুলো সাধারনত বাঁধতো খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েই! ‘শীতের সন্ধ্যায় বান্টি পা ধোচ্ছে - শৌণ্ডির চাইছে বান্টি যেন অবশ্যই ঠান্ডা জল দিয়ে পা ধোয়, কারণ একজন পুরুষকে তো ছোটবেলা থেকেই মজবুত হয়ে উঠতে হবে। কিন্তু মমতা ঠিক উল্টোটা চিন্তা করেঃ- ‘কি করে ছেলেটাকে এই ঠান্ডায় বরফের মত ঠান্ডা জলে পা ধুতে দেয়া যায়, যেখানে বান্টি এমনিতেই বছরে চার পাঁচ বার স্বর্দি জ্বরে ভোগে। বান্টি যখন স্কুলে যাওয়ার জন্যে তৈরী হয়, তখন মমতা ছোটে তাকে সাহায্য করতে’, কিন্তু শৌণ্ডির তাকে থামিয়ে দেয় আর বলে, ‘কতদিন আর ওকে এভাবে সাহায্য করবে? ‘আর আহ্লাদের কাজ নেই; বয়েস তো দশ বছর পার হয়েই গেলো, ও এখন নিজেই নিজের কাজগুলো করুক, ওকেই ওর সব করতে দাও, নিজের শার্ট পেন্ট নিজেই ইস্ত্রি করুক, কাপড়চোপড় জুতো মোজা টাই সব নিজেই পরুক’।
             বান্টি কী করে তার জামাকাপড়ই বা ধোবে আর ইস্ত্রিই বা কীভাবে করবে, ভেবেই পায়না মমতা। ওকে স্কুলেই বা কি করে একা পাঠাবে, এইসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে, আলো আবছায় নির্জন রাস্তায় হাঁটতে থাকে মমতা বান্টির এক হাত শক্ত মুঠোয় ধরে রেখে। বার বার শৌণ্ডিরের মুখটা ভেসে উঠে তার মনের আয়নায়।   
       মমতা চলতে চলতে ভাবছে, বান্টিকে স্কুলে পৌঁছে না দিয়ে এলে ও কী করে একা একা স্কুলে যাবে, বেচারা সারা দিন না খেয়েই কাটাবে, সব সময় পাশে না থাকলে ও কাপড়চোপড় নোংরা করে ফেলবে। ও তো একেবারেই ছোট, যেখানে বড়রাই সবসময় নিজেদের দেখভাল করতে পারেনা, সেখানে ...।
            নিত্যনৈমত্তিক ঝগড়ার আরও একটা বড় কারণ রয়েছে। বান্টি তার ঘরের দরজা রাতে খোলা রেখে শুতে চায়। তাতে তার সহজে ঘুম আসে, সে বড়দের গলার চাপা আওয়াজ শুনতে পায় এবং নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে। আর শৌণ্ডির বলে, এ নাকি বিলাসিতা! ক্ষেপে গিয়ে বলে, ‘দরজা বন্ধ করে ঘুমা তো, তাহলে তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে’। আর মমতা ভাবে, বাবা তো দেখতে পাচ্ছেনা যে ছেলেটা কত একা, সে ঘুমানোর সময়ও মা বাবার সঙ্গ চায়। এতে খারাপের কি আছে? এইসব তুচ্ছ ব্যাপারেও কেন যে ছেলেটিকে সরাসরি না বলে দেয়া হয় !
            আর বান্টির প্রতি মায়ের স্নেহ নিয়ে কত কথাই না শুনা যায়। মা কাজ থেকে এলে বান্টি মমতার কাছে ছুটে যায়, মাকে চুমু দেয়, জড়িয়ে ধরে, কারণ মা সারাদিন কাছে ছিলনা বলে তার   মনে দুঃখ জমে আছে, মন কাঁদছে।
        কিংবা ও যখন পড়ছে, মা কাছে এসে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, পাশে বসে থাকে, আর বান্টি পড়া তৈরি করে। আর তখনই শৌণ্ডির এসে বলতে শুরু করেঃ ‘তুমি ওকে এতো আদর দিয়ে দিয়ে তো দেখছি একেবারে তুলোর মত নরম করে ফেলছ। পুরুষের এতো স্নেহ-মমতার  দরকার নেই ! ওর সঙ্গে কিন্তু তোমার রুক্ষতা, কঠোরতা আরো বাড়িয়ে তুলতে হবে, আরও আরও সংযমী হতেই হবে। নইলে ও মানুষ হবেনা বলে দিচ্ছি’ ।
           মমতা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা, ছেলেটিকে একটু বেশি আদর ও চুমু দিলে ক্ষতি কি ! মমতা মনে করে ছেলের সঙ্গে তো এরকম আচরণই দরকার। ওর গালে একটু চুমু দিলে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে, ও খুব খুশিই হয়। তখন আনন্দে বান্টির মনটা ভরে উঠে, ও শান্ত হয় আর মন দিয়ে কাজ করে।  তখন সব কাজই ভালো এগোয়। মমতা আরো ভাবে, এই শিশুটিকে কি করেই বা এইসব অতি সাধারণ আদর, মনোযোগ, আন্তরিকতা আর স্নেহমমতা থেকে বঞ্চিত করা যায়!
          তা সত্ত্বেও মায়ের মন বাধা আর কঠোরতা সইতে পারেনা। ছেলেটার জন্যেও কষ্ট হয়। একদিকে তার স্বামী শৌণ্ডির, আর অপরদিকে একমাত্র ছেলে বান্টি। দুজনের জন্যই মমতার দুচোখ বেয়ে নামে দুই অশ্রুধারা। মমতা এগিয়ে চলে।  
         ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বিদিত কাকুর কথাগুলো মমতার মনে পড়ে যায় । যাদের কাছে মমতা মনের সব কথা বলতে পারত, তাদের সবাই বলত, কি করে বলি, কে সঠিক ! কোনও সুহৃদই কোনও সমাধান দিতে পারছিল না। কেউ বলত শৌণ্ডির ঠিকই করছে, আবার কেউ বা বলত, মা তো এমন আদর দেবেই। এখানেই শেষ নয়, কত সব বিশ্রী কথা বলে বান্টির কোমল মনে আঘাত দিতো। অনেকেই বান্টিকে জিজ্ঞেস করত, ‘কি বান্টি, তোমাকে কে বেশি ভালবাসে, মা ? না বাবা’। বিদিত কাকুর সামনে কোনও একদিন এমন কথা তার সায়ন মামাকে বলতে দেখেছিলো মমতা, একটি ছোট্ট মেয়েকে। আর যায় কোথায়। বিদিত কাকু অমনি সায়ন মামাকে এক হাত নিলো। শিশু কেন, যেকোনো সন্তানের কাছেই মা  বাবা সমান। বিশেষত শিশুদের এই প্রশ্নটা করা শুধুমাত্র বোকামিই নয়, অত্যন্ত অন্যায়ও বটে। বিদিত কাকুর খপ্পর থেকে সায়ন মামা আর বেরোতে পারেনি। বিদিত কাকু শিশুদের প্রতি কোনও অন্যায় অবিচার সইতে পারেন না। আর এ নিয়ে সবসময় প্রখর নজরদারি জারি রাখেন। ওনার শিশু-মনোবিজ্ঞানে কোনও ডিগ্রি নেই সত্যি, কিন্তু অজস্র বইয়ে ঠাসাঠাসি ওনার বাড়ির লাইব্রেরিটা।  সায়ন মামাকে তার পর থেকেই, মমতা প্রায়ই দেখত, বিদিত কাকুর থেকে শিশু-মনোবিজ্ঞানের বই নিয়ে যেতে। বিদিত কাকু শিশু সাহিত্যের অনেক হাবিজাবি বই, শিশুদের পড়াতে বারণও করতে দেখেছে মমতা। কিন্তু অতশত বুঝতে পারতনা সে। মনে মনে ভাবতো, শিশুদের নিয়ে আবার অতশত চুলচেড়া ভাবার মত কি আছে !
               দ্বিধা দ্বন্দের দোলায় দুলতে দুলতে একদিন বিদিত কাকুর সাথে দেখাই করে ফেলেছিলো মমতা। তাদের মধ্যে অনেক কথাই হয়েছিল বান্টি আর শৌণ্ডিরকে নিয়ে আর নিজের কার্যকলাপ নিয়ে।  বিদিত কাকুকে সবই খুলে বলেছিল মমতা। ঘটনাটা সবার কাছে এমন দাঁড়িয়েছিলো – শৌণ্ডিরও ঠিক, মমতাও ঠিক; বাবাও ঠিক, মা’ও ঠিক ! ছেলের সঙ্গে সবসময় লোহার মত  শক্ত ও কঠোর হতে হবে , এই প্রশ্নে মমতা কিন্তু শৌণ্ডিরের সঙ্গে কিছুতেই একমত হতে পারেনি। অথচ ওদেরই পরিচিত কোন এক পরিবারে ছেলেকে ‘লৌহ’ পুরুষ করে তুলছেন তার বাবা । সে চমৎকার খেলোয়াড়, তার সাহসও প্রচুর । তার জীবনের গতি সুস্পষ্ট এবং পরিস্কার ।
          নিজের চিন্তাধারা, আর কার্যকলাপে সেই ছেলেটি অটল, দোদুল্যমানতা কী জিনিস তা সে জানেই না । কিন্তু ছেলেটির সঙ্গিসাথীরা বলে যে, ছেলেটি খুবই রুক্ষ । ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সে নিষ্ঠুর ব্যবহার করে  এবং কাউকেই সে গ্রাহ্য করেনা । এটাও মমতার পছন্দ হয়না । আবার খারাপ ভাবতেও কষ্ট হয়।
          কিন্তু এটাও সত্যি, বাপের প্রতি বান্টির যতটুকু না টান, তার থেকে অনেক বেশি ভয় । শৌণ্ডিরকে  বাঘের মতো ভয় করে বান্টি । এমনকি রাস্তায় চলার সময়, বাপের সঙ্গে আসন্ন সাক্ষাতের কথাটি ভাবতেই সে ভয়ে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে যায় । বাড়িতে ছেলে বড় হচ্ছে , বাপের প্রতি তার বেশি টান থাকবার কথা, সে এখন আর কচি শিশুটি নয়। মায়ের সামনে তার আর শৌণ্ডিরের পুরুষের সংহতি থাকা দরকার ।
              কিন্তু সব কিছুই যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে । সে এখন বাপের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে, বাবার সঙ্গে সে খোলাখুলি কথা বলতে পারেনা । কিন্তু মায়ের সঙ্গে আছে তার প্রকৃত , আন্তরিক এবং মৈত্রীপূর্ণ সংহতি । সে সর্বান্তঃকরণে মাকে ভালোবাসে, নিজের সমস্ত দুর্বলতা নিয়েও সে মায়ের কাছে এসে যখন তখন হাজির হয়। বিকাল বেলা মায়ের অপেক্ষায় বসে থাকে, কখন মা কাজ থেকে ফিরবে । মা বাড়ি ফিরলে বান্টি সমস্তকিছু মাকে খুলে বলে। কারণ সে জানে মা’র কাছে সহানুভূতি ও সমর্থন মিলবে।
             বিদিত কাকু বলে চলে মমতাকে। কেন আমরা এমনটি ভাববো যে করুণা মানুষকে অবনমিত করে। ঠিক উল্টোটাওতো ঘটে। করুণা মানুষকে রক্ষা করে, মানুষকে বাঁচতে সাহায্য করে । আর মানুষ করুণা দেখায়, করুণা তাকে মানবিক গুণে মহীয়ান করে তুলে। আর শিশুদের প্রতি করুণা, বিশেষত মায়ের করুণা, সম্ভবত পৃথিবীতে সবচেয়ে সঙ্গত বিষয়। যে সমস্ত পুরুষ নিজের স্ত্রীদের এই গুণটি দম্ভভরে উপেক্ষা করে, তাদের কোনও মতেই সমর্থন করা যায়না।   
             জীবনে এবং সাহিত্যে এমন অনেক ঘটনার নজীর রয়েছে, যেখানে সন্তানের প্রতি মায়ের ঠিক স্নেহপূর্ণ ও সোহাগভরা সম্পর্কে , মা এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে অপূর্ব ও পারস্পরিক সমঝোতাপূর্ণ সম্পর্কের মঙ্গল জনক ভিত্তি গড়ে দিয়েছে । উল্টো দিকে, বাপের অত্যধিক শুষ্কতা এবং কঠোরতা,  কেবল উদাসীনতা আর অনাত্মীয়তারই জন্ম দিয়েছে । কোমলতা আর দরদ, শিশুর মধ্যে এই বিশ্বাস জাগায় যে, সে প্রয়োজনীয় সহানুভূতি পাবে । নম্র এবং আন্তরীক সম্পর্ক তাকে মেলামেশা করতে এবং আস্থা পোষণ করতে উদ্বুদ্ধ করে । আর, চির-কঠোরতা শিশুকে ভীত করে ও দূরে সরিয়ে দেয় ।
      এমনটাও অবশ্য ঘটে যে, ছেলেমেয়েরা মিলেমিশে খেলার শিবিরে থাকতে পারেনা । তাদের কারো সাথে হয়তো বন্ধুত্ব হলনা, কারণ স্বভাবের দিক থেকে সে আত্মবদ্ধ, হৈ-হল্লা পছন্দ করেনা, দৈনন্দিন জীবনের কঠোর নিয়মে সে অভ্যস্ত নয়।
      তবে, মমতা বান্টির ব্যাপারে এখন যেমনটা বুঝতে পারলো, আসলে তা ছিল, সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। জীবনে প্রথম বারের মত ছেলেটিকে খেলার শিবিরে পাঠানো হয়েছিল। সে তাতে অভ্যস্ত ছিলোনা ।  সেকারণে সঙ্গে সঙ্গেই তার মন মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিলো আর নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করেছিলো। বান্টি একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়েছিল।
     কিন্তু মমতার মন ভার হয়ে আছে । বান্টি প্রথম বারের মত অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গেই একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছে। সে শেষ পর্যন্ত বাধাবিপত্তি অনুভব করেনি, তা অতিক্রমও করতে পারেনি। মমতা বস্তুতপক্ষে সমস্যার বেঠিক সমাধানে ছেলেকে সমর্থন জুগিয়েছে। ছেলেকে শেষ অবধি ব্যাপারটি বুঝতে দেয়নি। এই সমস্ত কিছু মানুষের মনকে শক্ত করে না, দুর্বলই তিলে তিলে করে তুলে। 
     এতদিনে মা একটা কাজের কাজ অর্থাৎ সঠিক কাজ করলো। বিদিত কাকুর সঙ্গে দেখা করে। কারণ, কোনও ব্যাপার-সেপারই সঙ্কট জনক অর্থাৎ চরম অবস্থা অবধি টেনে নিয়ে যাওয়া উচিৎ নয়। মমতা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরছে যে, তার ছেলে কত সঙ্কট জনক অবস্থায় এসেছে।
     বিদিত কাকুর আলাপচারিতায় মমতা বুঝতে পারলো , এই প্রথম বুঝতে পারলো যে, মা এবং বাবা, মমতা এবং শৌণ্ডির, দুজনকেই তাদের ছেলের প্রতি তাদের আচরণ পাল্টাতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
     শৌণ্ডির তার রুক্ষতা, শুষ্কতা এবং কঠোরতা অনেকাংশে সীমিত করবে, মমতাও তার করুণা এবং অত্যধিক কোমলতা অনেকাংশে সীমিত করবে। বিদিত কাকু শৌণ্ডিরকে আর মমতাকে বিষয়ের গভীরতার সন্ধান দিলেন। দুজনেই দেখা করেছিলেন তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে যায় দুজনে।
     বিদিত কাকু বলে চলে, প্রাচীন ভারতীয় প্রবচনে অকারণে বলা হয়নি- ‘পাঁচ বছর অবধি ছেলেকে রাজা ভাববে, পাঁচ থেকে পনের বছর অবধি তাকে গোলাম ভাববে, আর পনেরো-র পর থেকে তাকে বন্ধু ভাববে’।
     কিশোর আর বালক ছেলেদের সঙ্গে নিজের সমস্ত পারস্পরিক সম্পর্কগুলোতে যুক্তি মেনে চলা এবং অটল থাকা খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু সন্তানের উন্নত ভবিষ্যতের প্রত্যাশী প্রতিটি মা-বাবাকে কম-বেশি ত্যাগ স্বীকার করেই এই কঠিন কাজটি আয়ত্ত করতে হবে।

( শেষ )

সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

গুচ্ছ কবিতা



















। ধ্রুবজ্যোতি মজুমদার ।।



 পাহাড়ে একটি দিন 
                                               

পাহাড়ী বেপথু বাঁকে সর্পিল যাত্রায়
ঝিকঝাক তালে যবে দুলছিলো চিত্তখানি
যৌবনাদীপ্ত উগ্র উন্মাদনার শিঁস
প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসছিলো
বড়াইলের চূড়া ছুঁয়ে-
সর্বহারা আর্তনাদ রূপে।

হাসি আর কান্নার মধ্যে জোড় লড়াই
আমাতে অধিকার ফলানোর জোড় চেষ্টায় ব্রতী
আমি তখন দোঁহের ধরা ছোয়ার বাইরে
জন্ম-মৃত্যুর ঊর্দ্ধে;
সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে অনেক উপড়
সৃষ্টিসুখ আর ধ্বংসের সন্ধিস্থানে।।

প্রকৃতি মোহিনীর বেশে মায়াডালি নিয়ে দাঁড়ায়
আমার মন্থন শেষ না হতেই এত আয়োজন!
মনে পড়ে ঊর্বশী মেনকাদের কথা
যত সব ছলনার গাঁথা;
আধুনিক সংস্করণে ওরা আজও আছে
বিশ্বামিত্রও হয়ত কোথাও কোনও এক গোপন কোণে!!

সেই খোঁজের তন্ময়তায় বুঝতেই পারিনি-
পাশের সীটের আধুনিকা মেনকার উপস্থিতি,
সুন্দরের পূজারী কবিমন আমার- সহসাই যেনো দার্শনিক
সুন্দরতার কদাকার দিকটি উন্মোচিত হচ্ছিলো ইতিহাসের হাত ধরে,
তারই ফাঁকে একবার ভিতরের বিশ্বামিত্রের প্ররোচনায়
আড়চোখে দেখে নিলাম- আধুনিকা মেনকা পানে।

কিন্তু এ কী দেখলাম!!
চতুর্দশী আননে এক বিঢ়াট প্রশ্নচিহ্ন,
ওর এযাবৎ অর্জিত পরিসংখ্যান তালগোল পাকিয়ে,
এক আশ্চর্য্য চাহনি আমার অন্থস্থল ভেদের ব্যর্থ প্রচেষ্টায়;
মুচকি হেসে বিশ্বামিত্র আবার ধ্যানস্থ হলো,
সারাটা যাত্রাপথ জুড়ে ব্যর্থ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে মেনকা
………….. একগুচ্ছ প্রশ্ন আর সংশয় নিয়ে- নেমেছিলো মাহুর ষ্টেশনে।।
                                                                                                (২২.১১.২০১৩ ইং)
~~~০০০~~~
                আড়ালে আবডালে

ওরা আমাকে প্রভেদ বোঝায়---
ঘৃণা আর ভালোবাসার, প্রাকৃত আর ছলনার !
ওরা যারা আজকের নব-প্রজন্ম,
কেউ কেউ উপদেশ দেয় ত্যাগ আর মহানুভবতার !!

আমি আমার প্রথম ভাগের দিনগুলি স্মরণ করি
একান্ত বাধ্য ছাত্রের মতো- নেই ভুল শুদ্ধের বাছ-বিচার
নেই কোনো দ্বিরুক্তি; নিবিষ্ট চিত্তে করি শ্রবণ,
ওরা শিখিয়ে তৃপ্ত হয়,ওদের হাসি আমাকে দেয় প্রশান্তি অপার।।

ওরা শাসন ও করে – হেয় ভরে কভু বা করে উপহাস
আমার হাপড়ে পোড়া মন হাসে ওদের অজ্ঞতার উপর,
চোখ বুজে ভাবি- পরগৃহলক্ষ্মী রূপী আমার প্রেমের দেবীটিকে
“ত্যাগের” থিওরী এক্সপার্টরা কি রাখে সেই খবর ??


~~~০০০~~~


          আত্মসঙ্গী


আজ সহসা আমার আকাশ মেঘশূণ্য
সমস্ত জলকণা অকাল বর্ষণে কোথায় যেনো দিলো পাড়ি,
আমি নির্মেঘ নভোতলে দাঁড়িয়ে-
হতবাকের মতো – খুঁজিতেছি চিহ্ন তার ই।

কিন্তু এ কী!! যতসব হিজিবিজি সংখ্যা ঘুরপাক খায়-
আমার চারপাশ ঘিরে, দিন-পক্ষ-মাস-যুগের ছড়াছড়ি,
কালচক্র  ভাসে চোখে, সেকেন্ড মিনিট নয়
এ যেনো- যুগ-শতাব্দী আর জন্মান্তরের বিশাল ঘড়ি!!

দুর্জ্ঞেয় সব তত্ত্বরাশি এক অপত্য স্নেহে
ছায়াছবির মতো তুলে ধরছে-তার মর্মার্থ-মঞ্জরী,
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি মোহাবিষ্টের মতো দেখলাম-
আমার এযাবৎ প্রত্যেকটি জন্ম-বৃত্তান্ত লহরী।

দেখলাম চির যাযাবর জীবন, এক বুক অফুরন্ত প্রেম,
দেখলাম তোমার উপস্থিতি,আমার জীবনগুচ্ছের প্রান্ত ধরি।
দেখলাম করুণ সব পরিণতি,
আমার নিরন্তর পরাজয়,আবার নতুন স্বপ্নের ফুলঝুড়ি।।

একসময় দৈবদৃষ্টি গেলো ছেড়ে-
অসাড় পৃথিবীতে আমার পুঞ্জীভূত হচ্ছিলো বারি,
উদ্গীরণ হতে হতে থমকে গেলো-
পরমত্তত্বের শান্তিছিটায়_ সুপ্ত আগ্নেয়গিরি।

সত্য দর্শনে সিদ্ধ হলো-অশান্ত আহত মন
তোমার ভূমিকাটা পরিষ্কার হলো,বিষাদ গেলো ছাড়ি,
বুঝলাম-অপ্রাপ্ত আছো বলেইতো চলছে জীবনচক্র,
বেঁচে আছি মোরা আত্মসঙ্গী হয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী---
…………………………… জন্ম-জন্মান্তর দিচ্ছি পাড়ি।।



                চারণভূমিতে

 "স্মৃতি' সে তো ছায়া থেকেও আপন
আঁধারেও অচ্ছেদ্য সঙ্গী,
প্রাণ যেন মুহুর্মুহু রূপান্তরিত হয়েই চলছে
কঠিন তরল আর বায়বীয়ের চক্রাবর্তে।

অশালীন সব শব্দগুচ্ছরা
প্রতিনিয়ত জন্মায়- কুণ্ডলীনির জঠরে,
তাতে সার জল যোগান দিতে
অক্লান্ত পরিশ্রম করছে সমাজ।

দায়বদ্ধতা শব্দের অর্থ জানা নেই
নিছক সময় কাটাতেই খেলি শব্দের হিজিবিজি,
আশ্চর্য্য!! প্রত্যেকটি শব্দ-বাক্যের নেপথ্যে ফুটে উঠে
সেই অনাদি নিষ্ঠুরতার- পাষাণী প্রতিবিম্ব!!

~~~০০০~~~


যান্ত্রিক চাল


লতে হয়,
বাধ্যতামূলক যান্ত্রিকচালে।
যারা আমার চলার পথে
ব্যস্ত পাথর আর কাঁটা সাজাতে;
ঈষৎ হাসির সাথে
বলতে হয় ওদেরকে ও
ভালো আছি।।

প্রত্যুত্তর প্রতিদানের ভাষা
চিরকালেই ছিলো মূল্যহীন,
গূঢ় সত্যতো শৈশবেই বুঝেছি-
ভেজা চোখ হোক অথবা হাস্যজ্জ্বল মুখ
নিজ ওজন বয়ে চলাটাই তো শেষ কথা,
তবে কেনোই বা একটি
মিথ্যে কৃত্রিম সুখদায়ী উত্তরের আশা করা ?!

এই বসুন্ধরা এখন আর
মনুষ্যত্বের বাসোপযোগী নয়,
যান্ত্রিক সভ্যতায় “প্রোগ্রামিং” এর বড্ড দাপট,
“টারগেট” এ পৌছার জন্য প্রয়োজন শুধু
উপযুক্ত “কমান্ড” ইনপুট।
বাকি সবকিছুই নেহাৎ বাড়তি ভেজাল,
সেই ধাঁচেই হয়ত বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি
নইলে কি আর বলতে পারতাম-
“ভালো আছি” ; বেশ আছি ?!?!


~~~০০০~~~

কুশিয়ারাতে এখন ঢল নেমেছে


(C)ছবি



















মূল অসমিয়াঃ সঞ্জীব গোহাঞিবরুয়া 
অনুবাদঃ সুশান্ত কর

কুশিয়ারাতে  এখন  ঢল নেমেছে
ডাঁট সবুজ  ঢল।
ঢলে ভেসে এসেছে কতকগুলো সবুজ গান ।
একটা গান, দুটো গান,
তোমার গান,আমার  গান।
সমস্বরে গাওয়া জীবনের  গান।
সবুজ দেখার জন্যে নদী পাড়ে আরেকদল মানুষের দৌড় ঝাঁপ।
এঁরা  কবিতাতে   ছন্দ সন্ধানী  অভিযাত্রী।
এখন এসেছে  কুশিয়ারাতে  সুর  ধরবে বলে ।
কবিতা আর  গান একাকার করবে বলে।
কুশিয়ারাতে জেলেরা গান গায় ; ইলিশ মাছের  গাঁথা।
জকিগঞ্জের মাইকে  আজানের  শব্দ; মিশন পাড়াতে শঙ্খ ।
সবইতো সবুজ ; এক বিস্তৃত সবুজ ।
সবুজের পাড়  ভাঙে কয়েকটি বিকেলের  শালিক।
কুশিয়ারাতে  ঢল নেমেছে ;
সবুজ ঢল। 

~~~০০০~~~
মূল অসমীয়াঃ
সঞ্জীৱ গোহাঞিবৰুৱা

কুশিয়াৰাত এতিয়া ঢল আহিছে


কুশিয়াৰাত এতিয়া ঢল আহিছে।
ডাঠ সেউজীয়া ঢল।
ঢলত ভাহি আহিছে কেতবোৰ সেউজীয়া গান।
এটা গান, দুটা গান,
তোমাৰ গান, মোৰ গান।
সমস্বৰে গোৱা জীৱনৰ গান।
সেউজীয়া চাবলৈ নৈ পাৰত আন এদল মানুহৰ হেতা-ওপৰা।
তেওঁলোক কবিতাত ছন্দ বিচৰা অভিযাত্রী।
এতিয়া আহিছে কুশিয়াৰাত সুৰ ধৰিবলৈ।
কবিতা আৰু গান একাকাৰ কৰিবলৈ।
কুশিয়াৰাত মাছমৰিয়াই গীত গায়; ইলিশ মাছৰ গাথা।
জকীগঞ্জৰ মাইকত আজানৰ শব্দ; মিছন পাৰাত শংখ।
সবেইটো সেউজীয়া; এক বিস্তৃত সেউজীয়া।
সেউজিয়াৰ পাৰ ভাঙে কেইটামান আবেলিৰ শালিকাই।
কুশিয়াৰাত ঢল আহিছে;
সেউজীয়া ঢল।

~~~০০০~~~~
 
আরেকটি অনুবাদ দাঁড় করিয়েছেন সপ্তর্ষি বিশ্বাস।



কুশিয়ারাতে ঢল নেমেছে

কুশিয়ারাতে ঢল নেমেছে
সবুজ ঢল।
ভেসে আসছে গান

একটা গান, দুটো গান,
তোমার গান,আমার গান।
সবুজ গান ।
সবাই মিলে গাইতে থাকা গান।
সবুজ দেখার টানে নদী পাড়ে এসেছে আরেকদল -
অভিযাত্রী, ছন্দ সন্ধানী ।
সুরকে ছুঁয়ে দিতে
ছুঁয়ে দিতে শব্দে, ছন্দে, গানে
এরা এসেছে এ নদীর কিনারে।
জেলেরা গান গায় কুশিয়ারাতে ইলিশ মাছের গাথা।
জকিগঞ্জের মাইকে আজানের শব্দ; মিশন পাড়াতে শঙ্খ ।
সবুজ ; এক বিস্তারিত সবুজ ।
সবুজের পাড় ভাঙে বিকেলের কয়টি শালিক।
কুশিয়ারাতে ঢল নেমেছে ;
সবুজ ঢল।





( ‘প্রকাশ’, ডিসেম্বর, ২০১৩ সংখ্যার থেকে)