“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৩

প্রসঙ্গ জাতীয় সঙ্গীতে ‘কামরূপ’ এবং ‘জাতীয়তাবাদে’র রবীন্দ্রনাথ

                        (লেখাটি এই প্রসঙ্গে আরো কিছু লেখার সঙ্গে ২২ ডিসেম্বর্‌ ২০১৩র 'সাময়িক প্রসঙ্গে' প্রকাশিত)
    

            বাংলাদেশের জাতীয় কবি যে নজরুল ইসলাম এই তথ্য যে কোন বাঙালি জানেন, কিন্তু ভারতের জাতীয় কবির নাম জিজ্ঞেস করলে সেই বাঙালিই ভাবতে বসবেন। ভারতের বাঙালিই এটা মনে রাখেন না, বাকিদের কা কথা! এটা একটা প্রমাণ যে ভারতীয়দের ‘জাতীয়তা’ বড় নির্ভেজাল নয়। দুই দশক আগেও সিনেমা শেষে হলে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ বাজত, বহু বেসরকারি অনুষ্ঠানাদিরও শেষে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ বাজত, আজকাল বহু সরকারী অনুষ্ঠানেরও উদ্বোধনী বা সমাপ্তী সঙ্গীত নয় এই গান। সেখানে অসম বিধান সভাতে যদি এই গানে ‘কামরূপ’ শব্দ ঢোকানো নিয়ে প্রস্তাব আসে আর বিতর্ক হয়, তবে অসমের বাঙালি –অসমিয়ার বাইরে যে কেউ মাথা ঘামাবেন এমনটা মনে হয় না। শুধু প্রবোধ চন্দ্র সেনের প্রস্তাব মতো ‘অসম’ ঢুকিয়ে কাব্যের এবং সমাজের ছন্দ রক্ষা যদি করাও যায়, তবে অন্যেরাও সেরকম ছন্দ রক্ষার দাবি নিয়ে ময়দানে নামবেন বলে এর আগেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি, ভবিষ্যতেও নেয়া কঠিন হবে বলে প্রশান্ত চক্রবর্তী তাঁর সম্প্রতি লেখা নিবন্ধে দাবি করেছেন। তাই এই নিয়ে বিতর্ক বিতর্কেই থাকবে। হেরফের কিছু হবে বলে আতঙ্কের কোনো কারণ দেখি না। আর ভারতে জাতীয়তা জিনিসটা যে বেশ ভেজালে ভরা তার বড় নজিরতো দিন কয় আগে সরকারি ভাবে অসমের জাতীয় সঙ্গীতকে স্বীকৃতি দেয়া। এটিও অসমেই প্রথম ঘটেছে তাও নয়, অনেক প্রদেশের বহু আগে থেকেই সরকারি ভাবে স্বীকৃত নিজস্ব গান আছে। আমরা বাকিরা জানি না তার কারণ, না আমরা সেই সব প্রাদেশিক ‘জাতি’র মানুষ, না আমরা নির্ভেজাল ‘ভারতীয় জাতি’। একটা জোড়া তাপ্পি  দিয়ে আছি আর কি। আমরা নিজের আঁতে ঘা না লাগলে কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমিও ঘামাই না। ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে ‘কামরূপ’ শব্দ ঢোকে গেলেও আমার কিচ্ছু যায় আসে না, না ঢোকলেও কিছু না। বাকি ভারতীয়ের মতোই। আর কিছু বাঙালি আহত বোধ করবেন বলেই যে আমিও করব—--তার পক্ষেও কোনো প্রবল যুক্তি মাথাতে আসছে না, কারণ গানটিতো আর বাঙালির ‘জাতীয় সঙ্গীত’ নয় , ভারতের ‘জাতীয় সঙ্গীত।’

     তবে এই সুযোগে রাজনীতি যখন হচ্ছেই, রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি নিয়ে দু’টো কথা লিখবার মোহ ছাড়া কঠিন। ‘জাতি’ , 'জাতীয়তা’ , ‘জাতি রাষ্ট্র’ নিয়ে দুনিয়ার সব দেশে বিবাদ কাজিয়া লেগেই থাকে। সে যে কী ভীষণ বর্বরতা এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন গোটা জীবন আর সতর্ক করে গেছেন ভারতীয়দের। এই জাতীয়তাবাদেরইতো চূড়ান্ত প্রকাশ দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে তিনি দেখেছিলেন। আর নিরলস লড়েওছিলেন  জীবনের শেষভাগে ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে । তিনি তাই  লিখে গেছেন, ‘পরকে আপন করবার প্রতিভা’ ঝেড়ে যেন পশ্চিমকে অনুকরণ না করে ভারত, অভিশাপ নামবে। বাংলাদেশের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেও এই চার দশকে এই নিয়ে কোনো মীমাংসাতে যেতে পারে নি, রক্ত ঝরিয়েই চলেছে। স্মরণ করুন গানটির রচনা কালের কথা। রাজবন্দনা করবার উদ্যোগটা ছিল ‘জাতীয় কংগ্রেসে’র, রবীন্দ্রনাথের তাতে সায় সম্মতি কিছুই ছিল না। অথচ, পরদিনই কাগজে সত্যমিথ্যা মিলিয়ে বদনাম কিনা বেরুলো রবীন্দ্রনাথের। ব্যাপার কী? এটা হতে পারল কেন? কারণ , ১৯০৫এর পরে তিনি ক্রমেই উগ্রস্বদেশীয়ানা, উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছিলেন। এবং এর বিপদ বোঝাতে গিয়ে তিনি বারে বারে পশ্চিমা জাতীয়তাবাদের বর্বরতার নজিরই টানছিলেন। তাতেই চরমপন্থীদল ধরে নিচ্ছিলেন তিনি দেশদ্রোহী, বৃটিশের স্তাবক। জাতীয়তাবাদকে বাঁচাতে তাঁকে আরো বেশি ‘স্তাবক’ প্রমাণ করো। কোনো যুক্তি বুদ্ধির ধার কেই বা ধারে। প্রশান্ত একটা যুক্তি তুলে ধরলেন বটে, সরকার সেগুলো ব্যবহারও করলেন। এখন, তাঁর বিরুদ্ধে ‘বঙালি হৈ ‘কামরূপ’ শব্দর বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্র’ করবার অভিযোগ উঠলেও উঠতে পারে।এঁদের জন্যে ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা’ কিম্বা ‘বন্দেমাতরম’গানই ঠিক ছিল। লক্ষ্য করে দেখুন, দুটো গানেই সত্যের কোন বালাই নেই, আবেগ প্রচুর আছে। যিনি লিখলেন ‘সারে যাহাসে আচ্ছা’, তাঁর বিড়ম্বনা দেখুন, তিনি পাকিস্তানের জাতীয় কবি। আর যারা এই গান করেনও প্রবল ‘প্রেমে’ তাঁরাও মনে মনে জানেন যে বিলেত কিম্বা আমেরিকাই আসলে দুনিয়ার সবচে’ ‘আচ্ছা’ দেশ। আর ‘সুজলাং সুফলাঙে’র কথা কী বলব? যে উপন্যাস থেকে নেয়া হয়েছে সেটির শুরুতেই আছে এক মন্বন্তরের গল্প। আর আপনি যখন আজ গাইবেন গানটি তখনো হয়তো দেশের কোথাও না কোথাও কোন কৃষক ঋণভারে আত্মহত্যা করবেন কিম্বা শ্রমিক মরবেন না খেয়ে। 

     শ্রমিকের না খেয়ে মরবার ঘটনাটি ঘটে পুঁজির কেন্দ্রীভবনের জন্যে, সেই পুঁজির স্বার্থেই দরকার পড়ে এক প্রবল কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের। ‘জাতীয়তা’ সেই রাষ্ট্রের দর্শন। জাতিরাষ্ট্র এক ‘পুঁজিবাদী’ নির্মাণ। পুঁজিবাদের আগে ‘জাতীয়’ বলে কিছু ছিল না। এর পরেও ‘জাতীয়’ বলে কিছু থাকবে না। রবীন্দ্রনাথ শুধু এভাবে বিষয়টি দেখেন নি, মনে হয়েছে এই সব পশ্চিমা ব্যামো, ভারতীয়রা শুধু অনুকরণ করছেন। যারা ‘কামরূপ’ শব্দটি ঢোকাতে চাইছেন, তাদেরও ব্যামোটি কিন্তু সেই একই, তারা বিষ দিয়ে বিষক্ষয় করতে চাইছেন মাত্র। এগুলো হতে থাকবে। কারণ দেশে অসম বিকাশ আছে, আর তার বিরুদ্ধে সংগত ক্ষোভও আছে। সেই ক্ষোভকে কেউ কাজে লাগাবে না, এ হতে পারে! প্রশান্ত ‘হিমাচল’ শব্দের মানে বুঝিয়েছেন, কারো মগজে ঢোকবে না । কারণ স্বার্থের কথা আছে।
     রবীন্দ্রনাথ ‘কংগ্রেস’ নামের আগে ‘জাতীয়’ শব্দ জোড়া নিয়ে বিদ্রূপ করেছিলেন, তাঁর গানের আগে ‘জাতীয়’ শব্দ জুড়ে দেয়াটা ঠিক হয় নি। আকস্মিক ভাবে স্বাধীনতার পরে পরেই জাতিসংঘের এক অনুষ্ঠানে ভারতের এক গান চাই বলে চেয়ে পাঠালে নেহরু সরকার এই গানটিই পাঠিয়ে দেয়। আর সেখানে বহুল প্রশংসিত হলে গানটি থেকে যায় মাত্র। এই গানে, একটি চিরদিনের বৈচিত্রময় ভারতের কথা আছে, তেমনি আছে ভবিষ্যত ভারতের স্বপ্নের কথা । সেই স্বপ্নই ‘জনগণমনঅধিনায়ক ভারতভাগ্যবিধাতা’ ইনি আদৌ কোন সর্বশক্তিমান একেশ্বর নন, ক্ষমতাসীন রাজাতো ননই।তিনি বৈচিত্রের মধ্যে ‘জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক’ মাত্র। রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’ তত্ত্বও পাঠক এই সঙ্গে ঝালিয়ে নিতে পারেন। সেই স্বপ্নের কাছেই জানানো একটি প্রার্থনা আছে গানে , “তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে” এই আশিসটি না পেলে কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের কোন দেশেরই মুক্তি নেই। এমন কি যে নেপাল, কিম্বা শ্রীলঙ্কার হয়তো কোন মাথা ব্যথা নেই এই গানটি নিয়ে তারও রাজনীতি এই মুহূর্তে ঘোরপাক খাচ্ছে এই গানের মর্মকথাকে কেন্দ্র করে। নেপালেতো বটেই।এই কথার মধ্যে সবাইকে ‘একাকার করে ফেলবার’ সম্প্রসারণবাদের সন্ধান করে লাভ নেই। নেপাল  কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘হিমাচলে’রই একটি বহুভাষার, বহু ধর্মের, বহু বর্ণের এবং নৃগোষ্ঠীর দেশ ।
   
  গানটির বাদ পড়া অংশে আছে, “জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!” এই জনগণপথপরিচয়টি একদিন সত্য হবে এই উপমহাদেশে, হতেই হবে। তার আগে আমরা যেন প্রস্তুত থাকি ‘কামরূপ’ শব্দের দাবিটি উঠে কেন বারে বারে এর সত্য সন্ধানে। এই সত্য আছে, গানের বাইরে। ‘জাতীয় সঙ্গীতে’র ‘জাতীয় কবি’ হয়ে উঠবার পরে কিন্তু উত্তরভারতে এক ‘হিন্দি-হিন্দু রবীন্দ্রনাথে’র নির্মাণের একটি প্রক্রিয়াও প্রবল হয়। নজির হিসেবে অমরচিত্র কথাতে উপস্থাপিত রবীন্দ্রনাথের দিকে কেউ তাকাতে পারেন, বিপরীতে আন্তর্জাতিকতাবাদী এই মানুষটিকে ‘বাঙালির রবীন্দ্রনাথ’ বানাবার কি কম প্রয়াস হয়েছে কিছু? প্রতি বছরই তো হচ্ছে। তবে, কামরূপ শব্দ ঢুকিয়ে ‘অসমিয়া রবীন্দ্রনাথে’র নির্মাণ কেউ করতে চাইবে না কেন! পরস্পরকে ‘ষঢ়যন্ত্রকারী’ বললে চলবে? তবে আর রবীন্দ্রনাথ যে লিখলেন, “অন্যের মধ্যে প্রবেশ করিবার শক্তি এবং অন্যকে সম্পূর্ণ আপনার করিয়া লইবার ইন্দ্রজাল ইহাই প্রতিভার নিজস্ব” --- সেই প্রতিভারও দেখছি পতন ঘটবে।

কোন মন্তব্য নেই: