“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

এ ‘গান’এ ভুবন ভরিয়ে দেবে?





।। সপ্তর্ষি বিশ্বাস ।।

১।

        শীতের রাত। মফস্বল শহরে শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। তবু সারা শহর ঘুড়ে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা। ভাত খেয়ে যখন মুখ ধুতে গেছি তখন সাড়ে এগারো, পৌনে বারো। মফস্বলেরো এক প্রান্তে আমার বাড়ি। পেছনে খাল। ঐ পারে গ্রাম। নদীর অবয়ব ঢেকে আছে কুয়াশায়। ১৯৯১-৯২ সাল। শিলচরে থাকি। হোস্টেলে। সম্ভবতঃ ক্রিস্‌মাসের ছুটিতে ওই বাড়ি আসা। পেছনের বারান্দা থেকে নেমে গিয়ে নীচু জলের কলে মুখ ধোয়া। মুখ ধুতে ধুতেই কুয়াশাবাহিত সুর ভেসে এলো কানে। থম্‌কে গেলাম। আসার পথে কোথাও মাইক বাজতে দেখিনি। এতো রাতে তাহলে কে বাজাচ্ছে গান? ‘দিল হুম্‌ হুম্‌ করে ...’ – ঠায় দাঁড়িয়ে শুনলাম। ভেসে এলো আব্‌ছা করতালির ধ্বনিও। সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হলো শিববাড়ি রোডে আজ অর্কেস্ট্রা। কে একজন নাগা না মনিপুরি আসবে শুনেছিলাম। এই গান কি ঐ খান থেকেই আসছে ভেসে? ভাবতে ভাবতে শোনা গেলো পুরুষকন্ঠঃ ‘ম্যাঁয় শায়ের বদ্‌নাম, ম্যাঁয় চলা, ম্যায় চলা...’ – ঐ খানে দাঁড়িয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম যেতেই হবে ঐ অর্কেস্ট্রাতে। দেখতেই হবে কে এই গায়ক, কে এই গায়িকা...মা’বাবার বকাঝকায় কান না দিয়ে বন্ধু বুড়ু দাসের সাইকেল ধার করে হানা দিলাম অকুস্থলে।

           
(C)ছবি
       মফস্বলের অর্কেস্ট্রা, তখন যেমন হতো, তেমনি। বাঁশে বাঁধা স্টেইজ। একদল ছোকড়া বসেছে গীটার, ড্রাম আরো কিসব নিয়ে। মাইকের সামনে দাঁড়ানো দুইজন পুরুষ-মহিলা। পাহাড়ি চোখ মুখ। মুখে পাহাড়িয়া হাসির সরলতা। জানলাম এঁর নাম চেং-কং-কাবুই। রোগা ঐ মহিলাটি তাঁর বোন। তাঁরা আবার ধরলেন গান। মূলতঃ কিশোরকুমারের গানই। কিছু কিছু রফির। মহিলা একচেটিয়া লতা’র গান গাইলেন। শেষমেস মাতাল উদ্যোক্তাদের হল্লায় বাধ্য হলেন কিছু কলি যুগের গান গাইতেও। মনে মনে তাঁদেরকে প্রণাম করে সাইকেল চালিয়ে দিলাম ঘরমুখো। আমারো তখন ‘দিল্‌ হুম্‌ হুম্‌ করে ...’

                       পরে আর একবার হাইলাকান্দি বাজারে, এমনি এক অর্কেস্ট্রায় তাঁদের গান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।জানিনা আজো তাঁরা আছেন কি’না। জানিনা এখনো এঁরা গান করেন কি’না। তবে এটা জানি যে ‘ফক্‌’ সং’কে সঙ বানিয়ে শিলচরের ছেলেরা কলকাতায় বেশ ভালো লাইন করেছে। সিডি করছে। টিভি করছে। আসলে যা করছে তাহলো ফক্‌ কে ‘আ-কার’ লাগিয়ে ডিস্কো করছে। গেরুয়া পাঞ্জাবী পরে, লম্বা চুল রেখে ‘বাউল’ হয়েযাচ্ছে ক্যামেরার সামনে। আরেকদল নানান চ্যানেলের ‘চ্যালেঞ্জ’ প্রোগ্রামে নেচে কুঁদে, আঞ্চলিক সুড়সুড়িতে ‘এসএম্‌এস্‌’ জোগাড় করে হয়ে যাচ্ছে ‘স্টার’।-এদেরকে সবাই চেনে। চিনবে। এ’ই তো যুগের হাওয়া। এই যুগে কে মনে রাখবে চেং-কং-কাবুই’দের যাঁদের মর্মে প্রকৃতই ছিল সঙ্গীত কিন্তু অর্থাভাবে সঠিক চর্চার পথে যাওয়া হলোনা তাঁদের। পেটের ধান্দায় প্রতিভাকে বেচতে হলো পূজা কিমিটির পেটমোটা, মাথামোটা উদ্যোক্তাদের কাছে। আচ্ছা সুজিত বেগীকে মনে আছে কারো? ...      হ্যাঁ, এঁরা অন্যের গান গাইতেন। ঠিক। কিন্তু তাতেও টের পাওয়া যেতো তাঁদের চর্চার গভীরতা, মর্মের হেউঢেউ। সেতো আরো কতো দাড়ি-দাদা’ই হেমন্ত’র গায়কী টুকে এখন ছিল্পী। কুমার শানু ‘স্টার’। হায়! ...
             এখন একটা চ্যানেল্‌ যদি অনুষ্ঠান করে ‘আজ সকালের আমন্ত্রণে’ তো আরেকটা করে ‘কাল বিকেলে গড়ের মাঠে’। বিছানায় শুয়ে কানে আসে ঐ ‘আমন্ত্রিত’দের কথা ও সুর। কিন্তু এতাবৎ এমন হলোনা যে ঐ ভেসে আসা টুকরো কথায়, গানে বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে পাশের কোঠায় গিয়ে দেখা কে বলছে, কে গাইছে! হ্যাঁ, বাচ্চা ছেলেমেয়ের অনুষ্ঠানগুলোর একটা দুটো গান কানে ধাক্কা দেয়। ঠিক। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে টের পাই ঐ যন্ত্রনা – ঐ শিশুগুলির অপমৃত্যুর। সেদিন পুরোনো একটা সাক্ষাৎকার শুনছিলাম। আশা ভোঁসলে’র। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সলিল চৌধুরি। সলিল বলছিলেন “তোমরা চারজন, লতা, তুমি, হৃদয়নাথ, ঊষা – ভারতীয় সঙ্গীতের চার স্তম্ভ। কিন্তু তোমরা তো শৈশবেই পিতৃহীন। বিধবা মা’র দায়িত্ব, পরিবার চালানো, ছোট ভাইবোনদের দেখে রাখা – এ সমস্তের পরেও তোমরা যে এখানে উঠে এলে, অনেকে হয়তো বলবে যে ভাগ্যগুণে, কিন্তু আমি অনুভব করতে পারি এর আবডালে তোমাদের সাধনার, সততার, ভালবাসার আকূলতা ...’ ... এই কথাড় টানে আশা তাঁদের শৈশবের অনেককথা বলেছিলেন। সবশেষে বল্লেনঃ ‘ আজ মনেহয় বাবা ( স্বনামধন্য শিল্পী দীননাথ মঙ্গেশকার) ছিলেননা বলেই আমরা এতোটা দূর এগিয়ে আসতে পেরেছি। বাবা থাকলে হয়তো যা হতো তা হলো দীননাথজী’র মেয়ে বলে পাত্তাটা আরো সহজে পেয়ে যেতাম আর তাতে সাধনার পথটি হতো ব্যাহত...’

   যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে তিনি আশা ভোঁসলে, যিনি নিচ্ছেন তিনি সলিল চৌধুরি। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার আছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নেওয়া। এমনি হতো তখন। পরের দিকে বেনোজল ঢুকতে আরম্ভ হয়েছিল। যেমন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার কি এর সুবীর সাহা’ নিয়েছিলো। ফলে যথেষ্ট বাজে বকা’র ব্যাপার ছিল তাতে। কিন্তু হালে তো অবস্থা আরো সঙ্গীন। কে’যে সাক্ষাৎকার নিচ্ছে আর কে’যে দিচ্ছে তা’ই বোঝা দায়। তার মধ্যে যে মঞ্চসজ্জা, যে পোশাক - ‘শিল্পী’, ‘যন্ত্রী’ থেকে যে ‘এন্‌কর্‌’ সব্বার যা হাবভাব! এইসব দেখলে কে বিশ্বাস করবে যে গান, সঙ্গীত এক নিবিড় সাধনার ধন? প্রকৃত শিল্পী আসলে একেকজন সন্ন্যাসী?

২।

 
(C)ছবি
      আসলে যা হচ্ছে তা হলো ‘ভালো গান’ যে’ই করতে পারে সে’ই যে ‘গায়ক’ নয়, তিনটে জুতসই অন্ত্যমিল যে লাগাতে পারে বা ‘বীর্য্য পতনের মতো সরকার পতন হয়’ গোছের ‘স্মার্ট’ কিছু লাইন যে ‘ম্যানেজ’ করে নিতে পারে সে’ই যে ‘কবি’ নয় – এই সত্যটা ভুলতে চলেছি আমরা। ভুলতে যে চলেছি তার দায় কিন্তু ‘ছা-রে-ঘা-মা’র বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গুলির নয়। তারা বাণিজ্যে নেমেছে। তারা যে কোনো মূল্যে বাণিজ্যই করবে। তারা তাই বাজারে দেবে যা বাজার চায়। আবার এই ‘চাওয়া’র চাহিদাকেও তারাই আনবে বাজারে। ব্যাপারটা একটু সহজে বোঝানো যায় “কবি” শ্রীমৎ জয় গো’ এবং ‘ফুর্তির হাট’ কর্তৃক তাকে বিক্রি করার কায়দাটা বিশ্লেষন করলে। তখন শক্তি মারা গেছেন বা যাচ্ছেন। সুনীলের হাওয়া কমে আসছে। তাই তাদের একটি কুশ পুত্তলিকা চাই যাকে পুড়িয়ে তারা ভিড় জমিয়ে চানাচুর বেচবে। ‘ফুর্তির হাট’ প্রথমে টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে আনলো তাদের শিবিরে। তারপর যে টাকা ওকে দিচ্ছে তা উঠিয়ে নিতে ওকে পুরস্কার, ওর নামে সংখ্যা করার হিড়িক তুলে আম্‌ জনতার কাছে তাকেই ‘সমকালের রবি’ বানিয়ে দিয়ে তার অখাদ্য কুখাদ্য বই বেচে তুলেনিলো নিজেদের মুনাফা।

         এটাই কসরত্‌। চ্যানেল্‌ গুলোও তা’ই করছে। ‘এই অনুষ্ঠানে সাট্টিফিকিট পেলে তুমি প্লে-বেক্‌ সিঙ্গার হবে’। ব্যস্‌। আম্‌ জনতার হয়ে গেলো। এই যে আম্‌ জনতা তার না আছে সামন্ত-আভিজাত্যের বোধ, না আছে অভিজাত-আত্মমর্যাদা, না’ত সে টের পাচ্ছে যে সে আসলে অতি নগণ্য এক পেটি বুর্জোয়া। তার মনে হচ্ছে ঐ আলো, ঐ মঞ্চ, ঐ প্রচার তাকে তা দেবে সে যা চায়। পক্ষান্তরে সে জানেই না যে সে ঠিক কি চায়। অতএব মা-বাপেরা ছেলে মেয়েদের নিয়ে ‘ইন্ডিয়া হেস্‌ টেলেন্ট’ থেকে ‘ছারেধামা’ সর্বত্র ধামা ধরে চলেছেন।

      এদিকে আবার একটা সময় ছিল যখন সামন্ততান্ত্রিক বিচারে যারা অভিজাত তাদেরি অনেকে নব্য বুর্জোয়া হয়ে বাণিজ্যে আসছিলেন। ফলে তাদের সহজাত আভিজাত্য তাঁদের কে এক্কেবারে যা’তা করতে বাধা দিচ্ছিলো। ‘দেশ’ পত্রিকার ক্রম বিবর্তন দেখলেই তা সহজে বোঝা যায়। কিন্তু এই যে সময় এখন পুঁজি তাদের কাছে যাদের আমরা দেখেছি তারাশংকর-সত্যজিতের জলসা ঘরে। লোহার ব্যবসা করে ধনী হয়ে এখন জাতে ওঠার জন্যে বাঈজী নাচাচ্ছে। ইদানীংকার তারা চ্যানেলের ঘটনাটি কি তারি সাক্ষ্য দেয়না? – ফলে যারা ব্যবসা করতে নেমেছে তারাও যেমন এবং যেহেতু লুম্পেন্‌ তাই তাদের বিক্রির অন্তঃশ্বাসও সেই ‘লুম্পেন্সি’। আর জনতা, সে’ও ত আজ এই উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থার নিরিখে নিজের অবস্থানের বিচার করার চেয়ে সেই অবস্থানকে গোপন করে ‘অভিজাত’ সাজতে ব্যস্ত, ফলতঃ যা হওয়ার তা’ই হচ্ছে। যারা হয়তো পরের প্রজন্মের ভীমসেন যোশি হতে পারতো, হতে পারতো লতা-আশা-কিশোর তাদের একদল অভাবে পড়ে চেং-কং-কাবুই হয়ে যাবে বিলুপ্ত হয়ে আর যাদের পেটের ব্যবস্থা আছে তারা ‘ছারেগাধা’ করে তেরাত্তিরের ‘স্টার’ হয়ে ছিবড়ে হয়ে হারিয়ে যাবে ডাস্টবীনে।

হ্যাঁ, এ’ই আমাদের ভবিষ্যত।

   

কোন মন্তব্য নেই: