“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৩

স্মরণঃ রমাপদ ভট্টাচার্য


।। সপ্তর্ষি বিশ্বাস ।।

   তাঁকে নিয়ে খুব বেশী কিছু বলা যাবে কি? জানিনা। মাঝারি একটি ভিটেয় একজন উঁচা-লম্বা মানুষ ইস্কুলে আর বাড়িতে ছাত্র পড়িয়ে গেলেন – কত বৎসর? মৃত্যুকালে বয়স যদি আশির মতো হয় তবে – পঞ্চাশেরো বেশী বছর ধরে... তারপর হারিয়ে গেলেন মহা অন্ধকারে, মহা নীলে ...
         ‘তোর মতো আমারো আসিল্‌ গল্পের বই পড়ার স্বভাব। রবি ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ পড়তে পড়তে রাইত হইযাইত। বাবায় গাইলাইতা। লেন্টন্‌ লইয়া যাইতাম গিয়া পড়ার টেবিলের তলে। তে বেড়ার ফাঁক দিয়া আলো কম বুঝা যাইত ...’ পড়তে যেতাম তাঁর কাছে। কেলাস সেভেন-এইট থেকে টেন্‌ অব্দি। পরেও গেছি কিছু জানবার, বুঝবার হলেই। জেনেছি, বুঝেছি আর শুনেছি তাঁর কথা। গল্প। ছাত্র পড়ানোর কোঠাটিতে কখনো। কখনো ভেতরের কোঠায়। তিনি যে ইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন আমি ঐ ইস্কুলের ছাত্র ছিলাম না। তাঁর বাড়িতে গিয়ে পড়তাম। তাঁকে দেখতাম ঠিক সাড়ে ন’টায় হেঁটে যাচ্ছেন। অথবা সকালে তাঁর হেঁটে যাওয়া ঘোষণা করত সকাল সাড়ে ন’টা। হেঁটেই যেতে দেখেছি সর্বদা। কদাচিৎ রিক্সায়। লঙ্গাই রোড থেকে নীলমনি ইস্কুল। সেই কুশিয়ারার পাড়ে। চিত্রবাণী সিনেমা পেরিয়ে। হাতে লম্বা, কালো ছাতা। কখনো মেলা। কখনো মুড়ে নিয়ে লাঠির মতন হাতে করে চলা। শাদা ধুতি, শাদা পাঞ্জাবী। চোখে চশমা। উন্নতনাসা। গৌরবর্ণ। সেই চলাই মর্মে জাগায় সম্ভ্রম।
       আমাদের বাড়ি পার হয়ে লঙ্গাই বাজারের দিকে গেছে যে রাস্তা ঐ রাস্তা ধরে এগোলে বাঁদিকে সেই বাড়ি – যা’তে ছিল আমাদের পাড়ার একমাত্র তালগাছ, তার উল্টো দিকের গলিতে স্যারের বাড়ি। ছোটো পুকুর ছিল একটা। তার সামনে শাক সব্জীর সামান্য বাগান। বাড়ির পেছনে ধূ ধূ মাঠ। উঠানের সামনের দিকে আমাদের পড়বার কোঠা। বিকালেই যেতাম বেশী। অংক পড়েছি তাঁর কাছে। পড়েছি সংস্কৃত। ব্যাকরণ। পড়তে পড়তে সন্ধ্যা ঘনাতো। শান্তুদাদের বাড়ির সুপারী গাছের ছায়ায় অন্ধকার জমাট বাঁধতো।স্যার পড়িয়ে যেতেন। মনেপড়ে ক্লাস সেভেনে সমান্তরাল সরল রেখার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন। ‘দুইটা রেখা, পাশাপাশি চলে। সমান দূরত্বে। কিন্তু মেলেনা কোনোদিন’ – একটু থেমে ‘মেলে। অসীমের কোথাও গিয়ে মিলে যায়’ ...মনেপড়ে সেই “মাঘ পন্ডিত কথা”র সেই শ্লোকের ব্যাখ্যা – যখন ভোর হচ্ছে, যখন কলি থেকে জেগে উঠছে ফুল ... হায়, মূল শ্লোকটা আজ মনেনেই –তবু যেন কানে বাজে রমাপদ ভট্টাচার্যের স্বর ...
          স্যারের মা ছিলেন অসুস্থ। শয্যাশায়ী। দীর্ঘকাল। স্ত্রী’ও ছিলেন অসুস্থ। ফলে মূলতঃ স্যারকেই করতে হতো মা’র শুশ্রূষা। মা’র মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই সম্ভবতঃ স্যারেও স্ত্রী’ও হন শয্যাশায়ী। তবু স্যারকে বিরক্ত বা রাগত দেখেছি বলে মনেপড়েনা। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে হেসে কথা বলেই শিখিয়ে নিতেন ণ’ত্ব-ষ’ত্ব বিধান, বাচ্য পরিবর্তন, কারক-বিভক্তি নির্ণয়। মূল সংস্কৃতে পড়েছিলেন রামায়ণ, মহাভারত। গল্প বলতেন তার। - জীবনের একটা সময়ে, হয়তো মধ্যবিত্ত সমাজ-নিয়মেই, যার সঙ্গেই দেখা হতো, সকলেই জানতে চাইত ‘কী চাকরি করি’, ‘কত বেতন’ – ইত্যাদি। কিন্তু এই স্যার, রমাপদ ভট্টাচার্য, দেখা হলেই বলতেনঃ ‘কী পড়ছিস্‌? কি লিখছিস্‌?” আমার লেখা প্রকাশিত হতো যেসব কাগজে জোগাড় করতেন। পরে আমিও কাগজ জমিয়ে রাখতাম তাঁকে দেওয়ার জন্য। কয়েক বছর আগে আমার প্রথম মুদ্রিত কবিতা সংকলনটি দিতে গিয়েছিলাম তাঁকে। আহ্‌, সে’কি আনন্দ। তাঁর চোখে জল। আর আমি ...
ঠিক হলো আমাদের উপনয়ন হবে। আমি তখন নাইন কেলাসে। ভাই এইটে। আমার আর আমার ছোটো ভাইএর। শুনলাম সেই উপনয়ন প্রক্রিয়াতে নাকি ‘গুরু’টির পায়ে মাথা ঠেকিয়ে ‘ওঁ ভূর্বস্ব...’ শিখতে হয়। জানিনা আমার মাথা আসলেই কত উঁচু তবু তাকে স্বেচ্ছায় যার তার পায়ে নামাতে না দেওয়ার মতো অহং আমার ছিল সেই বাল্যকাল থেকেই। কাজেই বাবাকে বল্লাম স্যারের সঙ্গে কথা বলে দেখতে। তিনি যদি ঐ “দীক্ষা” দিতে রাজি হন তাহলেই এসব হবে। নাহলে নয়। সানন্দে রাজি হলেন স্যার। দীক্ষা নিলাম তাঁর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে। সেই দীক্ষার কতোটা মূল্য দিতে পেরেছি কেজানে তবু স্যারের পায়ে মাথা রেখে ঐ সময়টুকু পেয়েছিলাম যে আশ্চর্য বোধের স্পর্শ তা আজো যেন টের পাই ।
       উপবীত, উপনয়ন ঘিরে আমার কোনো বিশ্বাস অদ্যাপি নেই। তাই দায়ও নেই কিছু। শুধু দায়, মনে হয়, আছে সেই “গুরু”টির প্রতি যাঁর পায়ে হাত দিয়ে নিয়েছিলাম সেই দীক্ষা যে দীক্ষার বীজ নিহিত স্যারের তাঁর মাকে করা, স্ত্রীকে করা নিরলস সেবায়।   সেই দীক্ষার বীজ নিহিত সমস্ত কিছুর পরেও তাঁর হাসিতে, তাঁর পাঠমনস্কতায়...সেইথেকে আমার বিয়ে থেকে আমার ছেলের মুখেভাত – সবকিছুতেই স্যারের কাছে বায়না ধরেছি পৌরহিত্য করার। শুধু স্নেহবশে স্যার এসেছেন। পালন করেছেন আপন ভূমিকা।
     সেই স্যার, রমাপদ ভট্টাচার্য, ‘রমা বাবু’ নামে সুপরিচিত। নীলমনি ইস্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। সারা শহরের সমস্ত ইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা তাঁর বাড়িতে এসেছে পড়তে। অনেক কৃতী ছাত্রছাত্রীর শিক্ষক তিনি। –চলে গেলেন। খবর পেলাম দূর শহরে বসে। জানলাম আমার আরেকটি আশ্রয়স্থল  গেলো উৎপাটিত হয়ে।
সোজন্যঃ  দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ
             জানলাম শুধু আমার নয় বর্তমান প্রজন্ম হারালো একটি উদাহরনকে – আদর্শ শিক্ষকের, আদর্শ মানুষের। মনেপড়ে ক্লাস সেভেনে সমান্তরাল সরল রেখার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন। ‘দুইটা রেখা, পাশাপাশি চলে। সমান দূরত্বে। কিন্তু মেলেনা কোনোদিন’ – একটু থেমে ‘মেলে। অসীমের কোথাও গিয়ে মিলে যায়’... আজ, দূর স্যারের সেই বসতবাড়ি থেকে, তাঁর চিতা থেকে বহূ দূরের শহরের মধ্যরাতে বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে ভাবি তবে কি সত্যি কোনোদিন, অসীমে, ঐ গম্যমান সরল রেখাটিরি মত, স্যারের সঙ্গে আবার দেখা হবে কোনোদিন? আবার কোনোদিন স্যার বলবেন কি সেই গল্পঃ          ‘তোর মতো আমারো আসিল্‌ গল্পের বই পড়ার স্বভাব। রবি ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ পড়তে পড়তে রাইত হইযাইত। বাবায় গাইলাইতা। লেন্টন্‌ লইয়া যাইতাম গিয়া পড়ার টেবিলের তলে। তে বেড়ার ফাঁক দিয়া আলো কম বুঝা যাইত ...’ ...
জানিনা







পুলটিস

।। রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ।।  
















মাটির ভাঁজে ভাঙছে
                  জ্যোৎস্নার মুখ
ব্যাকটিরিয়ার নাভিতে জড়িয়ে
আদিম হাওয়া ।

মেঘের সঞ্চয় ডালপালার প্রতারণা 

বিষাদের ধোঁয়া বিশ্বাসের    
                   রন্ধ্রে  রন্ধ্রে ।

স্মৃতিতে মেখে নেই পুলটিস

বিকেলের আড্ডায়

তুমি ধূসর ভাবনা ।  

বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৩

লতিয়ে আসে

   (অসমিয়া কবিতার সুপ্রসিদ্ধ কবি  হীরেন ভট্টচার্য বাংলাতেও কবিতা লিখতেন। তাঁর দু'খানা বাংলা কাব্যগ্রন্থও রয়েছে। একটি ' শিকড় থেকে পাতা অব্দি', অন্যটি 'বৃষ্টি পড়ে অঝোরে' । প্রথমটি নিজের কবিতার নিজে করা অনুবাদ ,দ্বিতীয়টিকে তিনি বলেছেন সুর না দেয়া গান। কিছু কিছু অসমিয়া ভাষার ছাপ থেকে গেছে। এই নিয়ে তিনি নিজেও সচেতন ছিলেন। কিন্তু মনে হয় না তাতে ক্ষতি বিশেষ হয়েছে। বরং বাংলা কবিতার ভাষাবৈচিত্র  তাতে বেড়েছে বলেই মনে হয়। খুব ভালো ছবি আঁকতেন তিনি। সেই আঁকিয়ে হীরেন ভট্টচার্য তুলিতে যতটা তার চাইতে বেশি মনে হয় শব্দে ছিলেন সাবলীল। প্রথম বইটি থেকে এই কবিতা কি আসলেই একটি ছবি নয়?)


(C)ছবি
















মা-র মুখের ভাষা আমার ঠোঁটে লতিয়ে আসছে,
বাতাসে উড়ে আসা শস্যশালী গন্ধ আমি যেন ছুঁয়ে দেখব,
একেক সময় মানুষ বড়োই ভালোবাসা- আকুল হয়ে পড়ে
ভাষাই শুশ্রূষা করে মানুষের মন, ভাষার একটি চুমুতে
ঝরঝর করে বয়ে আসে ভালোবাসার যমুনা...।

২০০৫

~~~~~~~~~~~০০০~~~~~~~~~
একই কবিতার অসমিয়া রূপঃ
~~~~~~~~~~~০০০~~~~~~~~~
লতা বগাই আহে

আইৰ মুখৰ ভাষা মোৰ ওঁঠেৰে লতা বগাই আহিছে,
বতাহেৰে উৰি অহা শস্যশালী গোন্ধ মই যেন চুই চাম,
একোটা সময়ত বৰ মৰম আকলুৱা হৈ পৰে---
ভাষাই শুশ্রূষা কৰে মানুহৰ মন, ভাষাৰ চুমা এটাতে
চৌ-চৌ কৰে বৈ আহে ভাল পোৱাৰ যমুনা...

( হীৰেন ভট্টাচার্যৰ কবিতাঃ১৯৫৭-২০১০)

মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৩

হারপিস

(C) ছবি













।। রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ ।।



কাশের পিঠে রামধনুর হারপিস
মাসকাবারি দৃশ্যগুলো জমাট
খুচরো যৌনতায় ।


মাতলামো ধ্বনিতে যান্ত্রিক ত্রুটি
প্রবাসী রাতে মৈথুন কায়দায়
তাকিয়ে অভিমানী চাঁদ । 

রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৩

মন তোর এতো ভাবনা কেনে?---রামপ্রসাদী গান



















ন তোর এতো ভাবনা কেনে?
একবার কালী বলে বস রে ধ্যানে।।
জাঁক-জমকে করলে পূজা অহংকার হয় মনে মনে।
তুমি লুকিয়ে তাঁরে করবে পূজা, জানবে না রে জগজ্জনে।।
ধাতু-পাষাণ মাটির মূর্তি, কাজ কি রে তোর যে গঠনে?
তুমি মনোময় প্রতিমা করি, বসাও হৃদিপদ্মাসনে।।
আলোচাল আর পাকা কলা, কাজ কি রে তোর আয়োজনে?
তুমি ভক্তি সুধা খাইয়ে তাঁরে, তৃপ্ত কর আপন মনে।।
ঝাড়লণ্ঠন বাতির আলো, কাজ কি রে তোর সে রৌশনে?
তুমি মনোময় মাণিক্য জ্বেলে দেও না, জ্বলুক নিশিদিনে।।
মেষ-ছাগল -মহিষাদি কাজ কিরে তোর বলিদানে?
তুমি 'জয় কালী' 'জয় কালী' বলে, বলি দেও ষড়রিপুগণে।।
প্রসাদ বলে, ঢাকঢোল কাজ কিরে তোর সে বাজনে?
তুমি 'জয় কালী'  বলি দেও করতালি, মন রাখো সেই শ্রীচরণে।।

গুড়াকেশ

।।রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ ।।





















রাবর একগুঁয়ে আলোয়

                 নেশাড়ু ছায়া ।

যে বৃক্ষটি অনন্ত গুড়াকেশ
সংলাপ পাতায় পাতায়
আহ্নিক হাওয়ায় লিখে রাখে আত্মজীবনী 
মৃত্যুসূত্রে নাগরিক স্যাটেলাইটে
                     নেমে আসে স্বপ্নদোষ ।

হাসির সংস্করণ শেষে মজবুত

                 আয়ুর মানচিত্র ।

টু, দ্য গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া

টু,
দ্য গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া
একদিন অর্থনীতির মতো
সরু হয়ে যাবে
তোমার পুরুষাঙ্গ।

গান্ধি মাথার কদর কমে গেছে
হালফিলের আর্থ যুদ্ধে

চীনারা জানেনা অসমিয়া
গামছার প্রকৌশল।

অন্যথায়, এতদিনে
বিক্রি হয়ে যেত অরুণাচল।

সিন্ধু প্রদেশের যাবতীয়
প্রজাপতিদের বিক্রি করে দাও,
রেশম পোকাদের নীলাম ডাকো
হোয়াইট হাউসে
রাষ্ট্রীয় শোক হবে

গজরাজ ব্যর্থ উড়ানে

টু,
দ্য গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া,

জতুগৃহের চিতাভষ্মে
পঞ্চপাণ্ডবের শব খোঁজার
পালা এবার শেষ হোক

জাপানী ইন্দ্রবর্ধক যন্ত্রের
প্রচার বন্ধ হোক মিডিয়ায়
একদিন সরু হয়ে যাবে
বিষুব রেখা

সেদিন অপ্রসবা থাকবে এই দেশ

এবং সেদিন...
প্রসব করবে
কফিন বন্দী
নন্দিনীরা

শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৩

পুদিনা স্বর্গ



।। রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ ।।














নির্মিত আলোয় গুটিকতক ব্যর্থতা
অব্যাহতি নেই স্বাভাবিক প্রয়োজনে
ফৌত বিদ্যেগুলো লিখে রাখি
                         কুটিল মেঘে ।

ফ্যাচফ্যাচ বেলায় ভূষণ্ডি মনে
সেটে আছে অলৌকিক কলঙ্ক ।
মুখচোরা বৃক্ষটি সাজতে থাকে
ওপাড়ের মাধ্যাকর্ষণ মেখে ।


গ্রাহ্য হয় না সাতসমুদ্র ঘাম
মানবিক বৈঠা টেনে
ঝকঝকে হাতের তালুতে বিজোড় বিজ্ঞপ্তি
সমস্ত দেনা জমতে থাকে চোখে চোখে ।

বিচ্ছেদ শুধু বয়সের ইন্দ্রজাল
ব্রাত্য পাখিরা ব্যালকনিতে
                  পেতে রাখে মৃত্যু ।

নালায়ক বায়নায় মরচে পড়ছে
পিন্ডারি আদিম স্মৃতি
ইদানিং গোলাকার পিরিচে
সারি সারি প্রতারকের উল্লাস ।

প্রতিটি দরজায় আভিনয়
শিরঃপীড়া কয়েক রাতের,
মেয়াদি নয় পুদিনা স্বর্গ ।
    

বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৩

প্রেম

।। রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ ।।


(C)ছবি

  












মজ বাক্যে শ্বাস ফেলে
মেঘের গায়ে লিখি
শেষ সুইসাইড নোট ।

মাঠে বালিকার প্রেম ঘর্ষণে
দৃষ্টিমান কমে প্রতারনায় ।

তবু শূদ্র-চাঁদে ধার করা কলঙ্কে
শিশিরের গন্ধ গুছিয়ে

ভাঙতে থাকি রাতের জরায়ু ।

ভালবাসার একটুকু ছোঁয়া পেতে





মি বুঝিনা
ভালবাসা এত সুন্দর কিনা
ঐশ্বরীয় কোন কাজ
না মোক্ষ লাভের পথ, নাকি
প্রাত্যহিক জীবনের কোন তুচ্ছ ব্যাপার।
তবু মাঝে মাঝে
দমকা হাওয়ায় ঝরা পাতাগুলো
কারো সমাধি থেকে সরে গেলে, মনে হয়
চিরকালের জন্য কেউ বুক পেতে আছে
ভালবাসার একটুকু ছোঁয়া পেতে।

আশা















সে এক নতুন দিনে-
আকাশের চাঁদ এল
পৃথিবীতে নেমে,
আলো ছড়ালো জীবনে আমার
দেখে তার দু'নয়নে।

আশাহীন দিনে অতি সন্তর্পণে
কাছে এল সে আপন মনে
আঁধারে আলো মিশে
সুখ এল এই জীবনে।

আজও-
ভাবি আনমনে বসে বিজনে
কখন সে দু'বাহু ছড়ায়ে
সুখের পরশ দিয়ে
জড়াবে এই জীবনে।

নির্বাণ - একটি আত্মহত্যার উপকথন

পৌলমি: একটি কবিতার দৃশ্যকল্প

                                          ।।অরুনাভ চ্যাটার্জীর ছবি।।
গোলাপি গন্ধটার সাথে কতশত গান গাওয়া বাকি পড়ে থাকে।এখন ও আমাদের কানে প্রশম শুনিয়ে রাখে নিরাকার আশ্রয়,স্নান সেরে সুস্থ হওয়া উদ্দীপনার নবরত্ন শীত,খাজকাটা যাদুঘরের হিস্ট্রির বই...
তবুও আমাকে স্তব্ধ করতে পারেনা মায়াঘন কথাদের চুম...
কেননা,পরিক্ষায় পাশ করা ভাল ছেলেটার মত আমিয়ো জড়াতে চেয়েছিলাম হাসি...
কায়ানাত ভরা ভীতবায়ু দেয়াল ধরে দৃপ্ত স্বরে বলে উঠেছিল...
না!.....

মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০১৩

শ্রাবণের সেই সন্ধ্যে বেলায়






'তুমি কি আমাকে ভালবাস?'
এ কথাই সে জানতে চেয়েছিল
শ্রাবণের সেই সন্ধ্যে বেলায়।

আমি কিছু বলার আগেই
ঝরঝর করে বৃষ্টি নামল...

'ব্যালকনিতে দাঁড়াতে এলেই
দেখতে পেতাম সেই ছেলেটা
অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে
এক পলকের পেতে দেখা।
মাঝে মাঝে মাঝ রাতে
ভাবতাম কেন এমন হবে
শুধুই তাকে সঙ্গ দিতে
কেন তুমি চলে আসবে
এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায়?'

আকাশে তখন বিদ্যুৎ চমকালো।

চলে যাবার আগ বেলায়
বলল সে চাপা গলায়-
'ভুল সময়ে হাল ছেড়ে
দ্বিচারিণী করলে আমায়।'

বৃষ্টিটা একটু জোড়ালো হল
শুধু শরীর নয় মনকেও সিক্ত করল
শ্রাবণের সেই সন্ধ্যে বেলায়।

সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৩

সম্পর্কঃ পথ বেছে নেবার দায়টাও আমাদেরই ...


।।সুশান্ত কর।।        


('সম্পর্ক' এই মূল বিষয়কে নিয়ে দৈনিক যুগশঙ্খ  ( পৃঃ ৭ থেকে ১০)'রবিবারের বৈঠকের বিশেষ সংখ্যা করে ১৮ আগস্ট, ২০১৩। অন্য সাতজনের সঙ্গে আমার এই লেখাটি প্রকাশ পায়। আমার ইউনিকোডে লেখাটির সঙ্গে ছবিতে এখানে রইল বাকি সব ক'টা।ছবিতে ক্লিক করে নামিয়ে বড় করে ইচ্ছে করলে সেগুলোও পড়তে পারেন।)

  “একমাসে অপহৃত ১৬ জনঃ বাঙালিদের নিরাপত্তার দাবিতে উত্তাল চিরাং” এই শিরোনামে একটি সংবাদ বেরিয়েছে দৈনিক যুগশঙ্খে ১৪ আগষ্ট। পাশেই একটি ছবি চিরাং জেলাশাসকের কার্যালয়ের সামনে একটি বাঙালি ছাত্রযুব সংগঠন ধর্ণা দিচ্ছে।  সংগঠনটি গেল মাস খানিক ধরে ভাটি অসম তথা বডোল্যাণ্ডে এক নাগাড়ে একই প্রশ্নে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে চলেছে। সমাজ রাজনীতি সম্পর্কে উৎসাহী যে কোন ব্যক্তির কাছে এই তথ্য কৌতুহল জাগানো উচিত । তার উপর যে ছবির কথা বললাম, সেটিতে এদের দাবী দাওয়া লেখা দেখলাম, বিশুদ্ধ বাংলা ভাষাতে। একই সংগঠন যখন উজান অসমে ব্যানার লেখে , তখন লেখে অসমিয়াতে। বাংলা লিখলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হবে, তা নয়; অনেকেই লেখে। কিন্তু এরা লেখেন না। ভাটি অসমে তারাও লেখেন।  বিশেষ করে গোটা অসমেই যেখানে বাঙালি, বিশেষ করে হিন্দু বাঙালি প্রতিবাদী-রাজনীতির বন্ধ্যাত্ব চলছে---তখন এমন সংবাদ পেলে, আজকাল অন্য অনেকে যেমন করে, আমিও এগুলো আন্তর্জালে ছড়াই, বিশুদ্ধ বাংলাভাষাতে , বাংলা হরফে সংলাপ বিনিময় করে এর সামাজিক অর্থ বোঝার চেষ্টা করি। আমি  আন্তর্জালে যুগশঙ্খের ডিব্রুগড় সংস্করণ  খুলে  দেখলাম, ওখানে ছবিটি রঙিন এবং অনেক বেশি বাঙ্ময়। কেন জানি, মনে হলো এই সংবাদ গোটা অসমের মানুষ জানলে উৎসাহী হবেন। দেখিতো, অন্য সংস্করণগুলোতে আছে কিনা। শিলচর সংস্করণে পেলাম না। তাতে দোষের কিছু নেই। যেকোন কাগজ তার স্থান বাঁচাবার জন্যে এটা করে। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে। সব সংবাদ বা লেখালেখি সব সংস্করণে দেয় না। যেমন বডো ছাত্র সংস্থার আসাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা পৃথক বডোল্যাণ্ডের দাবিতে শিলচরে মিছিল করেছে আগের দিন, সেই সংবাদও ডিব্রুগড় সংস্করণে আছে, কিন্তু শিলচর সংস্করণে নেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রশ্ন মনে জাগল, বিটিএডিতে এই যে লাগাতার অপহরণ হচ্ছে এর বিরুদ্ধে  কি শিলচরে বা করিমগঞ্জে  একটি ‘পথচলা’ আশা করতে পারি? বডোল্যাণ্ডের দাবীতে যদি হতে পারে, তবে সেই আন্দোলনের শিকার যারা হচ্ছেন তাদের হয়ে হবে না কেন!
    
     
                  হবে কি করে! জানলে তবে তো! সে থাক! গোটা রাজ্যে এখানে ওখানে পৃথক রাজ্যের দাবি উঠলেও বরাক উপত্যকাতে তেমন তীব্র নয়, কিন্তু ব্রডগ্যাজের দাবিতে একটি সংগ্রাম সম্প্রতি বেশ বেগ পেতে শুরু করেছে।  সেই সংগ্রামে অংশভাগীরা এসে দিসপুর লাস্ট গেটে ধর্ণা দিচ্ছেন, এমনটা কল্পনা করতে পারি?  বা তাদের সমর্থনে সমাবেশ হচ্ছে তিনসুকিয়াতে! খুব কষ্ট করেও পারি না। দায় কার! কে আটকেছে? বঞ্চনা আছে, প্রতারণাও আছে—কিন্তু প্রতিবাদের ভাষাকেও নিজ ভূমির বাইরে ছড়িয়ে দিতে বাঙালিকে আটকেছে কে? এই দেশ যে গণতান্ত্রিক একখানা দেশ এই নিয়ে তো বাঙালিই গর্ব করে সবার চাইতে বেশি! যখন অন্য বহু জনগোষ্ঠিগত সংগঠন স্বাধীনতা দিবস বা প্রজাতান্ত্রিক দিবস বর্জনের আওয়াজ তোলে, তখন বাঙালিইতো ব্যস্ত হয় সবার চাইতে বেশি দিনটি পালন করবে বলে। তবে এ কোন স্বৈরাচার, বাঙালির প্রতিবাদের ভাষাকেও রুদ্ধ করে! প্রশ্নগুলোতো ভাববারই বিষয় বটে।            
                       আবাল্য বড় হয়েছি বরাক উপত্যকাতে। আবাল্য শুনেছি সে উপত্যকা বঞ্চিত বড়। বড় হয়ে কাজের সূত্রে ব্রহ্মপুত্রে নিবাস। তাও উজান অসমে। শিল্প সমৃদ্ধ জেলাশহর গুলোর একটিতে। এসে থেকেই শুনেছি এখানকার লোকেরা বুঝি সবচে’ বেশি রাজস্ব দেন সরকারকে। দেবেন হয়তো, চা আছে, তেল-কয়লা আছে। কিন্তু একটিও তো শহর পাইনি শিলচরের মতো! যখন ফিরে গিয়ে বলেছি, বহু বন্ধুকে যে গুয়াহাটি রাজধানীকে বাদ দিলে,  তুলনায় শিলচরের মতো আর একটি উন্নত শহর নেই  গোটা অসমে—দেখেছি কেউ বিশ্বাস করেন না। কিম্বা যখন কাউকে বলেছি, ব্রডগ্যাজ রেলওয়ের মতো গেল এগারো বছর ধরে ধেমাজি ডিব্রুগড় জেলাকে সংযুক্ত করবার জন্যে দীর্ঘতম সেতুটি এখনো হচ্ছে না। সুতরাং খুব জরুরি নয় যে ব্রডগ্যাজ হচ্ছে না শুধুই দিসপুরের অবজ্ঞার জন্যে, আরো কারক থাকতে পারে, যেগুলো বগীবিলকেও বিলম্বিত করে-- দেখি রসিকতা করে বন্ধুরা বলেন, “তবে তুই অসমিয়া হয়েই গেছিস!” তারা কি আর  বিশ্বাস করবেন যদি বলি, যে ধেমাজি বলে উজান অসমে একটি জেলা রয়েছে যার সঙ্গে শুধু শিলচরের অদূরে দুধপাতিল বা বড়খলারই তুলনা চলে। এতো কাছে, কিন্তু বহু দূর। ইলশে গুড়ি বৃষ্টিতেও ওখানে বন্যা নামে! সেখানকার লোকজনকেই মন্ত্রীরা পরামর্শ দেন কলাগাছের ভেলায় জীবন যাপন রপ্ত করুন!  সে জেলায় কিন্তু বাঙালিও বাস করেন। তারা অসমিয়া হয়ে যান নি! গলায় ফুলাম গামছা বেঁধেও তারা কণ্ঠ ছেড়ে গান করেন বাংলা ভাষায় –হোক সে গান মনসা ভাসান!
   
                তো আমাকে অসমিয়ারা অসমিয়া করুন না করুন, পুরোনো বন্ধুরা তাই করেছেন! অসমিয়া হয়ে যাওয়া ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই! আবাল্য যে আখ্যান এই উপত্যকার সম্পর্কে শুনে শুনে বড় হয়েছি, তার অনেকগুলোই আমাকে ঝাড়াই বাছাই করতে হয়েছে, আর নিত্যদিন হচ্ছে। বলব না সুখে আছি, কিন্তু অসুখটা তা নয় ---যা সেই বন্ধুরা বলেন!
                   
           আমি সাহিত্যের ছাত্র। সামান্য লেখালেখিও করি। জেনে উৎসাহিত বোধ করি যে সেই পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদের দিন থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের দিন অব্দি এই উপত্যকার বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চাতে এক উজ্জ্বল পূর্বাধিকার ছিল। মাঝে অসম আন্দোলন ইত্যাদি কারণে কিছু ভাটা পড়েছিল বটে, কিন্তু এখনতো গেল এক দশকে আবার জোয়ার বইছে—ধুবড়ি থেকে সদিয়া অজস্র ছোট কাগজ বেরুচ্ছে। একাধিক দৈনিক কাগজ বেরুচ্ছে, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর বাইরেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হচ্ছে। এমন কি গুয়াহাটি শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একাধিক বাংলা প্রকাশনা সংস্থা। সেগুলোর মধ্যে ভিকি প্রকাশনীর তো গোটা অসমেই কোন বিকল্প নেই! আর এই কাজগুলো যারা করছেন তাদের সিংহভাগ নিশ্চয়ই এই উপত্যকারই মূল নিবাসীরা করছেন। কিন্তু একটা ভালো অংশ কিন্তু, সেই সব লোক যারা বরাক উপত্যকার থেকে এখানে প্রব্রজিত। আমারই মতো। কিম্বা পদ্মনাথ থেকে, রাজমোহন নাথ, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো। এদের প্রত্যেকেরই কিন্তু আজকাল  এক ব্যথা— এই উপত্যকা তাদের বরণ করে নিলেও মূলভূমি যে বরাক উপত্যকা সে কিন্তু দেখতে শুরু করে সন্দেহের চোখে। সে সন্দেহ ‘অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদে’র শরিক হবার!
     
    
সেদিন ‘দলছুট’ বলে শিলচরের গানের দল গুয়াহাটির জেলা গ্রন্থাগারে গান গেয়ে গেলেন। আয়োজন করেছিল ‘ব্যাতিক্রম মাসডো’। অনুষ্ঠানের নাম ছিল, ‘সম্পর্ক’! গান ছাড়াও ছোট্ট এক আলোচনা চক্র হয়ে গেছিল। তাতে অনেকের সঙ্গে এসছিলেন শিলচরের ভাষা শহীদ স্টেশন দাবী সমিতির সম্পাদক রাজীব কর। রাজীব আমার পুরোনো বন্ধু। অনেক দিন ধরেই আশা করছিলাম সে তাদের লড়াইকে এই উপত্যকাতেও ছড়িয়ে দেবে। লড়াই না হোক, অন্তত একটা জনমত গড়ে তোলবার কাজতো হতেই পারে। কে বাধা দিয়েছে! এই নিয়ে দু’জনে প্রায়ই কথাও হয়েছে। ফোনে কিম্বা শিলচর গেলে। দেখলাম , সম্প্রতি সে সেটি শুরু করেছে। সঙ্গ দিচ্ছে ‘ব্যতিক্রম মাসডো’।  এই প্রক্রিয়ারই এক অগ্রপদক্ষেপ এই ‘সম্পর্ক’ অনুষ্ঠান। পরদিন একই গানের দল নিয়ে একই আয়োজকেরা গেলেন লামডিঙে। এবং দুই জায়গাতেই শোনালেন তাদের নিজেদের গান। অসমের একটি গানের দল নিজেদের বাঁধা গান গাইছে এটা নিজেওতো একটা বড় সংবাদ। এই উপত্যকার মানুষ সেটি জানতেন না! শুধু জানলেনই না, লামডিঙে তারা শাখা স্থাপন করে গেলেন শিলচরের জনপ্রিয় সংগঠন ‘সন্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চে’র। শাখা কিনা জানি না। কিন্তু যদি আলাদা  সংগঠনও হয়, কিন্তু নামটিতো নিজেই কিছু বার্তা বহন করে! আর করে বলেই একই নামে সম্প্রতি আরেকটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল বরাক উপত্যকারই অন্য প্রধান শহর করিমগঞ্জে। সেই দলছুটের অনুষ্ঠানের সংবাদ কিন্তু বেরুলো এই উপত্যকার বাংলা অসমিয়া সমস্ত কাগজে বেশ গুরুত্ব দিয়ে!  অনেকগুলো ছবি দেখলাম আন্তর্জালেও। তার মধ্যে একটি এই যে তাঁরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের গলায় অসমিয়া গামছা। অভিজ্ঞতা বলে, এই ছবি বরাক উপত্যকাতে পৌঁছুলে আর ভাবুকজনে দেখলে-- গামছাতে গলা বাঁধা দেবার দায়ে তাদেরকেও ভর্ৎসনা করবেন, কিন্তু তারা যে কী গান শুনিয়ে হল ভর্তি মানুষজনকে মুগ্ধ করে গেলেন , সে কথা  কানেও তুলবেন না।
   
         কেন ! এই পথে সম্পর্ক হতে পারে না? সিলেটের পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ কিম্বা হেমাঙ্গ বিশ্বাস কি এই পথে ব্রহ্মপুত্র বিজয় করেন নি! গেছিলেন বটে তারা অভিমানে কাশি কিম্বা কলকাতা চলে। কিন্তু ভালোবাসাবাসিতো ছাড়েন নি। প্রথমজন কলকাতা যানই নি, দ্বিতীয় জন সেখানে গিয়েই গাইলেন, “ডানা ভাইঙা পরলাম আমি কইলকাতার’ উপর।    
             
           ব্রহ্মপুত্রের পথ যাতে না ফুরোয় কাশি কিম্বা কলকাতায় সে পথ নিশ্চয় সন্ধান করতে হবে। সংঘাতও অনিবার্য হবে কখনো কখনো। কিন্তু সেই সংঘাতও কি হবে না অপরিবর্তনীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে বৃহত্তর প্রেমের জন্যে? সেই প্রেমের সন্ধান করতেই আমাদের কোন  কবি এখন লিখে ফেলেনঃ “মিলিদি, গঙ্গাপারের ছেলে, শোন/গাঢ় সিঁদুরের ভিতর গভীর বাতাসের ধ্বনি/চিরকাল বাজাবে তার অমোঘ খঞ্জনি/একা নির্জন ঘরে বিষণ্ণ একা থাকা ভালো।” ( আমি একা নির্জন ঘরে; সঞ্জয় চক্রবর্তী) মিলিদির কথা কী ছিল? “মিলিদি প্রায়ই বলে ফোনে,/বল, ঠিক কোন কারণে, তুই পড়ে আছিস ওখানে।/গড়িমসি ছাড়, এক্ষুণি উড়ে চলে আয়/আমাদের কোলকাতায়।/হাসবি, নাচবি, গাইবি, কাঁদবি,/এমন কি মরবিও বাংলায়” এই মিলিদিরা কি হতে পারেন  কোনভাবেই আমাদের কোন ‘মুক্তিদূত?” অথচ এখনো অসমের বহু মধ্যবিত্ত স্বপ্ন দেখেন তাঁরা খোলা আকাশের নিচে উড়বার জন্যে সেই ‘কইলকাতা’ মহানগরেই পাড়ি দেবেন। তাকে ‘মুক্তদুনিয়া’ বলে  গল্প লেখেন করিমগঞ্জের কোন গল্প লেখক। এই ভাবনাইতো এক বড় কারণ যে এই দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখেনা, আশা জাগায় না মধ্যবিত্ত বাঙালি। শিলচরে মিছিল হয় “বডোল্যাণ্ড” নিয়ে, কিন্তু দিসপুর কাঁপে না ব্রডগ্যাজের দাবীতেও!   পথ হাঁটেনা কেউ এসে ভাষা শহীদ স্টেশনের দাবীতে!

 
               না হয় আমরা গলায় গামছা বাঁধি, আপনারা বাঁধেন না—কিন্তু গানতো করি একই ভাষায়? না হয় আপনারা আসাম বলেন, ‘অসম’ বললে বিরক্ত হন---আমরা দুটোই বলি, কিন্তু যখন বলি ‘অসম’ তখন উচ্চারণেতো থাকিই বিশুদ্ধ বাঙালি। না হয় আমরা ভুলে গেছি ধানের মাঠ, চিনেছি ‘পথার’ কিন্তু খাইতো এখনো সেই একই চালের পিঠে! আমাদের কি থাকতে নেই কোনো সম্পর্ক? হতে নেই, কোন বার্তালাপ? সে আমরা বুঝি বরাক উপত্যকাতে অসমীয়া মানে কিন্তু মূলত প্রশাসক। যেমন বৃটিশ ভারতের গোটা পূর্বোত্তরে বাঙালির ছিল পরিচয়। এখনো তাঁরা অনেকে যখন দিল্লীর বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করেন, সেই উষ্মার তাপে পুড়ে বাঙালি শরীর।  কিন্তু আপনারাওতো বুঝবেন আমাদের এই বাস্তবতা যে ----আমাদের যখন  নিষিদ্ধ বাঙালি সংগঠনগুলো কখনোবা শ্মশানে পাঠায়,  তখন কাঁধ দিতে এসে চোখের জল ফেলে আবাল্য বন্ধুটি। হাসপাতালে যাবার বেলা খবর না দিলে যে বন্ধুটি  নৌকো করে ছুটে এসে  বলে, ‘মোক কিয় মাতি নে পঠালি ও!” আমরা সেই বন্ধুদের  দূরে  ঠেলি  কি করে!  কী করে ভাঙি ‘হারাধন-রঙমনে’র পুরোনো সখ্য!
      
            সেই বার্তালাপে খুলে যাবে না জানি কোন স্বর্গদ্বার।   আমাদের খুঁজে নিতে হবে আরো বহু বহু প্রশ্নের উত্তর। আমাদের যেমন আছে প্রাচীন কামরূপের , কামতাপুরের, কাছাড়ি রাজ্যের ইতিহাস , তেমনি আছে দেশভাগ আর সিলেট ভাগের, ভাষা আন্দোলনের  উত্তরাধিকার---এখনো বাঙালি বললে আমরা এই উপত্যকাতে বুঝি শুধুই বাঙালি হিন্দু। এখনো আমাদের যারা ছোটখাটো দোকান চালান ভূষিমালের কিম্বা ওষুধপাতির, হাল ঠেলেন, কাপড় বুনেন, ইটের পরে ইট সাজিয়ে পরের জন্যে বাড়ি করেন কিন্তু কলকাতা যাওয়া তো দূর-- ডিটেনশন কেম্পে  যাবার দুস্বপ্নে রাতের পরে রাত কাটান, উগ্রপন্থীর হাতে অপহৃত না হবার স্বপ্ন দেখেন-- সেই সব সঞ্জিৎ মণ্ডল , সুবল দেবনাথদের সমাজকে ভালো করে চেনাই হয় নি আমাদের। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বৌদ্ধিক সমাজের!  চিনব কী করে! ভালোবেসে দেশটাকে নিজের বলে স্বীকার করলে তবে তো! একের পাশে অন্যে দাঁড়াবার সাহস গোটালে তবে তো! আমরা কি দাঁড়াবো, না এক নতুন অস্পৃশ্যতার সূত্র ধরে সরে যাবো পরস্পর থেকে দূর! আমাদের কি দিন আসবে না,  যখন সঞ্জয় চক্রবর্তীরই মতো  সবাই উচ্চারণ করতে পারবঃ
 ভয় নেই আর,বালক
দুরু দুরু বক্ষে আর
দাঁড়ানো নেই কোন বৃক্ষের আড়ালে
যাও তোমারই দেশ
যেখানে খুশি। (কুয়াশালিপি)

না, যদি পারি তবে নিশ্চিত আমাদের পরিচয় হবে এক হতাশ বিপন্ন প্রজাতি! পথ বেছে নেবার দায়টাও আমাদেরই !

                                    
 

  

রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৩

হাতি পাঁদে পুঁ পুঁ...

।।মিফতাহ উদ্দীন।।
গেলো পনেরো তারিখ আমার আরেকটা হ্যাপি বাড্ডে গেলো। জন্মভুমি ছেষট্টিতে পা রাখলেন আর আমি তাঁর ঠিক অর্ধেকে। একটা সময় ব্যাপারটা বেশ উৎফুল্লের মনে হতো, এখন ঠিক তেমন হয় না তবে ইঞ্জিরির "ফুল" এর মত মনে হয়। ব্যস এই যা। আমার এক বন্ধু বলে আমার নাকি ট্রেঞ্জিশন চলছে, বিয়ে করেছি কিনা তাই। তবে আমি আমার এই বয়স বাড়া বা বুড়ো হওয়া নিয়ে মোটেই চিন্তিত নই। আমি আমার নিজের মাঝে কোন গেলো গেলো রব শুনতে ও পাইনা দেখতে ও পাইনা।

   
ছবি সৌজন্যঃ
        কিন্তু গোলটা বাঁধে যখন আমার সাথে সাথে অবশিষ্ট পৃথিবী টা ও তাল মিলিয়ে চলে। আর গেলো গেলো রব ফোবিয়ায় আক্রান্ত হই তখনি যখন কোন বিশিষ্ট দিন যোগ হয়ে যায় পৃথিবীর ওই তালের সাথে। সেরকমই একটা দিন গেলো গত পরশু। আমার এক খালাতো বোনের বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ের কথা বার্তা চলছে, তারিখ ঠিক হয়ে গেছে এসব শুনে আসছিলাম, ব্যাপারটা আর বাকি সবার মত স্বাভাবিকই লাগছিলো কিন্তু যেই বিয়ে হয়ে গেলো ব্যাস ব্যাপারটা স্বাভাবিক থেকে সরে একটু অন্য রকম লাগতে লাগলো। মাকে ফোন করে বললাম “ওর বিয়ে হয়ে গেলো, যে কিনা ওই সেদিনই নতুন সেলাই করা ইউনিফর্মে নার্সারিতে যাচ্ছিল...ভাই বোনের সবার ছোটো ছিল বলে ওর আদরের ভাগটা ছিল বাকিদের থেকে বেশি, সেই এক রত্তি মেয়ে যার কিনা বিয়ে হয়ে গেলো, তোমরা বিয়ে দিয়ে দিলে?” মা, ছেলের এই অতি ইমোশনাল দীর্ঘ সংলাপে শুধুমাত্র মাত্র একটা সংক্ষিপ্ত “হুম” বলে ফোনটা আরেক খালাকে দিয়ে বিয়ে বাড়ির ঝামেলায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন, আমি আর আমার সংলাপের পুনরাবৃত্তি না করে ছোটো খালাকে শুধু বললাম “ওদের আসলে ইঞ্জেকশন দিয়ে বয়স টা আটকে দেবার দরকার”, খালা এক পান হাসি দিয়ে বললেন, “ধুর তা কি করা যায়?” আমি আমার এই দ্বিতীয় সংলাপের ওজন টা ঠিক মাপার আগেই ব্যস্ত হয়ে যাই অফিসের কাজে। খালাকে বলি, পরে ফোন করবো।

                আর তারপর যখন অফিস নেই, ঘরে বসে, তখন আবার ভাবি এ নিয়ে। ওর বিয়ে হয়ে গেলো, নতুন ঘর, নতুন মানুষ, নতুন সংসার। নতুন এক আত্মীয়তা। দুটো পরিবারই একে অপরের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মা চলে আসবেন, চলে যাবেন বাকি খালারাও। কিছুদিন পর নতুন মুখ, নতুন খুশি, নতুন ব্যস্ততা। এভাবেই যারা যার একটা সংসার এর সৃষ্টি। নতুনের সৃষ্টির সাথে পুরোনের দূরত্ব যাবে বেড়ে।

          আশ্চর্য হই আমি, একের পর এক বিশেষ দিন এভাবেই যোগ হতে থাকে, আমার ভ্যাবাচ্যাকা সংলাপে শুধু আমিই আক্রান্ত হই। আর তারপর ভাবি কিসের হ্যাপি বাড্ডে, আসলে তো প্রতিটা মুহূর্তই একটা জন্ম আর প্রতিটা মুহূর্তই একটা মৃত্যু। সাধারণ গনিতে একটা মুহূর্তের আয়ু মাত্র এক সেকেন্ড, লক্ষ লক্ষ মুহূর্তের জন্ম হচ্ছে আর লক্ষ লক্ষ মুহূর্তের মৃত্যু। প্রতিটা মুহূর্তই মৃত্যুর জন্য জন্ম নিচ্ছে। আর আমি এই জন্ম মৃত্যুর খেলায় মাঝে মাঝেই আক্রান্ত হই গেলো গেলো ফোবিয়ায়...

মাদ্রাজ,
১৮ই আগস্ট, ২০১৩

বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৩

স্বাধীনতা দিবস


















৫ আগস্ট , ১৯৯২
লাল কেল্লার প্রাকার থেকে ভাষণ দিলেন
প্রধানমন্ত্রী পি বি নরসিমা রাও।
তিনি বিয়াল্লিশের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন
প্রথমেই।
তারপরেই পাড়লেন
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কথা।
নয়া অর্থনীতির কথা
তিনি আরো একবার বোঝালেন খুব সাবলীল ভাষায়।
সিকিউরিটি স্ক্যামের প্রতি
তিনি যে কী চরম
তা স্মরণ করিয়ে দিতে ভুল করেন নি।
তারপরেই তিনি অসমের কথা পাড়লেন,
জানালেন যে
স্রোতের বিরুদ্ধে রয়েছে এখন
মাত্র গুটি কয়।
কাশ্মীরের কথা
যখন তিনি বলতে যাবেন
পাকিস্তানকে গালাগাল করতে গিয়ে
তিনি খুব ক্লান্ত বোধ করছিলেন।
তবু তাঁর গণতন্ত্রপ্রিয়তার কথা,
সময় হলেই নির্বাচন করিয়ে নেবার কথা
আমাদের জানালেন।
পাঞ্জাবের কথা বলতে গিয়ে,
অনেক্ষণ ধরে হাততালি পাচ্ছিলেন না—
একটুই জোরের সাথেই মনে করিয়ে দিলেন,
কত বছর পর
তার সরকার সেখানে নির্বাচন করিয়েছে।
সন্ত্রাস বলতে গেলে
এখন সেখানে নেই।
যে গুতি কয় মানুষ
সেখানে রোজ মরে
সফলতার তুলনায়
সে সংখ্যা খুব কম—
এই কথাটা তিনি যখন বোঝাতে যাবেন,
তার চোখ তখন
সামনে বসা শ্রোতাদের দিকে।
শ্রোতাদের হাতের দিকে।
হন্যি হয়ে খুঁজে ফিরছিল—
কোন্ হাতে তালি বাজছে না।
সে  হাতগুলোর সংখ্যা
খুব কম।
কিন্তু ঐ কম হাতগুলোকে
যে তার কী ভীষন ভয়
তাই আমরা আঁচ করছিলাম,
যখন দেখছিলাম
স্বাধীনতা দিবসে
তিনি নিজেকে বন্দি করে রেখেছেন
এক কাঁচের ঘরে।
তাঁর সামনে পেছনে
ডানে-বায়ে,
উপরে নিচে
প্রহরী অগুনতি।
গোটা মাঠ ঘিরে অন্ততঃ
হাজার কয়েক।
এমন কি আকাশেও ফিরছে স্টেনগান হাতে।

আমাদের খুব কষ্ট হলো—
গুটি কয় মানুষ,
এখনো এই দেশ আর তার নেতাকে
বুঝতেই পারলো না!

বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৩

কাব্যচর্চায় ভাব ও বিষয়ঘটিত সমমেল ঘটে যাওয়া পুরাতন


( আমরা পূর্বোত্তরের  ৩১জন লেখক /পাঠক  মিলে চিঠিটা লিখেছিলাম। আজ প্রকাশ পেয়েছে দৈনিক যুগশঙ্খে। তিনটা সংস্করণেই। তার জন্যে সম্পাদককে ধন্যবাদ। কিন্তু আমাদের তালিকা অধিকাংশকে বাদ দেয়াতে গুরুত্ব কিছুটা কমল বলে আমার অভিমত। তবু প্রকাশিত চিঠি, এবং  যে কবিতা দু'টিকে  নিয়ে বিতর্ক  সেগুলো  এবং প্রাসঙ্গিক আরো একটি এখানে রইলঃ --সুশান্ত কর  )

প্রতি
সম্পাদক
দৈনিক যুগশঙ্খ                                        তারিখঃ ১০-০৮-১৩
মহাশয়,
দৈনিক যুগশঙ্খ
দৈনিক যুগশঙ্খ অসম থেকে প্রকাশিত বাংলা দৈনিক। গত ১৪ জুলাই, ২০১৩ রবিবারের বৈঠকে ত্রিপুরা তথা পুর্বোত্তরের সুপরিচিত প্রবীণ কবি পীযূষ রাউতের একটি কবিতা ‘কবিতা তোর জন্যে’ আমরা অনেকেই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। সবাই তখনো  পড়িনি, কেননা হয় আমরা অসম নিবাসী হয়েও প্রবাসী অথবা পূর্বোত্তরের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর বাসিন্দা। সাহিত্য সেবা করি। কেউ লিখি, কেউ পড়ি। এবং সবাই পূর্বোত্তরের বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ। আমরা বাকিরা কবিতা পড়তে পেলাম যখন ২রা আগস্ট পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে গুয়াহাটির মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায় সেই কবিতাকে নকল কবিতা বলে, কবির বিরুদ্ধে কুম্ভিলক বৃত্তির অভিযোগ আনলেন। প্রথমে চিঠিটি গুয়াহাটি এবং ডিব্রুগড় সংস্করণে প্রকাশ পায়, দিন দুই পরে শিলচর সংস্করণে। এই চিঠির নায্যতা নিয়ে তখন প্রশ্ন তোলেন ফেসবুকের পূর্বোত্তরসংক্রান্ত একটি গোষ্ঠীতে (যেটি বিশেষ করেই পূর্বোত্তরের বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যেরপ্রচার প্রসার এবং বিকাশের কথা মাথায় রেখে পরিচালিত হয়) এক সদস্য। আমরা যারা ব্যক্তি  কবি পীযূষ রাউত এবং তাঁর  কবিতার সঙ্গে বহুদিন ধরে পরিচিত আমাদের কাছে শুরুতেই এই অভিযোগ অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। মূল কবিতাটি যখন বাকিরাও সেখানে পড়লেন  সবাই এক বাক্যে শ্রীমতী  মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগের বিরোধিতা  করলেন,  তাঁর কাব্য পাঠের নিষ্ঠার মাত্রা এবং পরিসীমা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, কিন্তু সবশেষ বাক্যটির ব্যবহারের ধরণে সবাই অপমানিত এবং আহত বোধ         করলেন আমরা ‘রবিবারের বৈঠকে’র বর্তমান সম্পাদক সৌমেন ভারতীয়ার কাছেও কৃতজ্ঞ যে তিনিও আমাদের সেখানকার আলোচনাতে যোগ দিয়ে একই প্রশ্ন তুলেছেন। সেখানকার আলোচনার সূত্রেই আমাদের এই সম্মিলিত প্রতিবাদ পত্র। আশা করছি আপনি প্রকাশ করে বাধিত করবেন।
                একজন কবির কবিতা নিয়ে যেকোনো পাঠক বা পাঠিকা প্রশ্ন তুলতেই পারেন। অসম তথা পূর্বোত্তরের কাগজগুলোতে যেখানে সাহিত্য সংক্রান্ত চিঠি পত্র বেরোয়ই না বা আলোচনা হয়ই না—সেখানে এমন এক চিঠি এবং সেই সূত্র ধরে কোনো আলোচনা এগোলে আমাদের উৎসাহিত বোধ করাই উচিৎ ছিল। আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি পীযূষ রাউতের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র কুম্ভিলকবৃত্তির অভিযোগ উত্থাপন করলেও আমরা হয়তো কাকে বলে সাহিত্যের চুরি, কাকে নয় –এই নিয়েও এক সুস্থ বৌদ্ধিক বিতর্কে  যোগ দিতেই পারতাম। কিন্তু আমাদের সামূহিক অনুভূতিকে আঘাত দিয়েছে চিঠির একটি বাক্য, যেখানে তিনি  শ্রীরাউতকে উপদেশ দিয়েছেন এই বলে যে, ‘ সব কাজই সাবধানে করতে হয় কারণ সুনীলপাগলরা সারা বিশ্বেই তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন’
           এই নীতিবাক্যটি উচ্চারিত না হলে এই চিঠি নিয়ে বলার কিছুই থাকত না। শ্রী পীযূষ রাউত একজন কবি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিছুকাল কবি থাকার পর আরও বহু কিছু হয়েছেন। ফলে তাঁর উপাসকের সংখ্যাও বিপুল। উপাসিকারও। শ্রীরাউত  এত কিছু হননি, তিনি ত্রিপুরার ধর্মনগর  ও অসমের শিলচরে বসে অর্ধশতাব্দীকাল শুধু কাব্যরচনাই করেছেন। উপাসক-উপাসিকা কম হলেও আমাদের মতো গুণগ্রাহীর সংখ্যা কম নয়, যারা পীযূষ রাউতকে কাব্যসূত্রে জানেন, এবং ভালোবাসেন। এযাবৎকালে আমাদের কখনো মনে হয়নি, অপর কোনও কবির বিশ্বব্যাপী ফ্যানফেয়ারের কথা মাথায় রেখে তাঁর কোনও সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। তার উপর ‘সুনীল পাগল’ হতে গেলে খুব একটা যে কবিতা পড়তে হবে তাও নয়।
            শ্রীমতী মুখোপাধ্যায়ের এই চিঠিটি, কো্নো একক ব্যক্তির  রচিত নয় বলে মনে হয়। আমাদের পূর্বোত্তরের বাঙালিদের একটি হীন মানসিকতা শুধু প্রকট হয়েছে তাঁর পত্রমাধ্যমে। মিডিয়াবাহিত সুনীলপাগলামো জাতীয় কিছু উন্মার্গ ধারণাকে তাঁরা শ্লাঘনীয় মনে করেন। আপন কাব্যপাঠকে কবিবিশেষের আরাধনাকার্য হিসেবে প্রচার করতে আহ্লাদিত হন। এবং এই সবই পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে। এদিকে নিজের ভূমিতে যে উৎকৃষ্ট কাব্যচর্চা হয়, তাঁরা তার খবরও রাখেন না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েদের একটি পরিকাঠামোগত সুবিধে রয়েছে যার দৌলতে আমরা বিশ্বজুড়েই  কবিতাপরিচয়হীনদের মধ্যেও বহু ‘সুনীল পাগল’ পেয়েই যাই , আমাদের বহু নিষ্ঠাবান কবি লেখক সেই একই পরিকাঠামোগত অসুবিধের জন্যেই বহু নিষ্ঠাবান পাঠকের কাছেও ঠিক সময়মতো গিয়ে পৌঁছুতে পারেন না। বাংলা ভাষার এ এক দারুণ সংকটশ্রীমতী মুখোপাধ্যায় শুধু তাতে আক্রান্ত।  যিনি পীযূষ রাউতকে ‘সুনীল পাগলামো’র দোহাই দিয়ে এহেন উপদেশ দিতে পারেন, তিনি আমাদের যে কোনো লেখক সম্পর্কে একই কাজ করতে পারেন। বস্তুত যে সামাজিক সংযোগ-গোষ্ঠীতে আমরা আলোচনাটি করছিলাম, সেখানেই এক ‘বোদ্ধা’কে দেখলাম শ্রীমতী মুখোপাধ্যায়ের সমর্থনে কলম ধরে পিযূষ রাউৎকে ‘নবীন কবি’ বলে ঠাউরালেন। সেই বোদ্ধা এবং শ্রীমতী মুখোপাধ্যায় কিন্তু দু’জনেই পীযূষ রাউতেরই  স্বভূমির পাঠক। মনে হয় তাঁরা মনে করেন এখানে সবাই ‘নবীন’ এবং  ‘নকলনবীস’ কেউ লেখালেখি কাকে বলে জানেন না, তাদের উপদেশ দেয়া চলে।
            কাব্যচর্চায় ভাব ও বিষয়ঘটিত সমমেল ঘটে যাওয়া পুরাতন। একই ভাবনায় জারিত হয়ে বিজ্ঞান গবেষণাতেও প্রায় একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে বহু বিজ্ঞানীদের মৈত্রেয়ী দেবীদের বালখিল্যের শিকার হতে হয়েছে। এতে তেমন কিছু হয় না, তাঁদের কৃতির সম্মানহ্রাস হয় নারবি ঠাকুরের ‘গোরা’ হোক, কি জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’, শক্তি চট্টপাধ্যায়ের ‘অবনী বাড়ি আছো’ আজও পাঠককে মোহিত করে। শুধু সেইসব পক্ব সমালোচকেরা, যারা এইসব সৃষ্টিতে অন্যের কৃতিচ্ছায়া আবিষ্কার করেছিলেন, হাস্যকর সমালোচনা করেছিলেন, তারা আজ অপ্রাসঙ্গিক। কাল এমনই শক্তিধর। অসম তথা পূর্বোত্তরের আরো একজন স্বনামখ্যাত প্রবীণ কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাস আরো বহু আগেই তাঁর ‘শরশয্যা’ কাব্যগ্রন্থেহুবহু ‘শুধু কবিতার জন্যে’ এই নামে আরো একটি অসাধারণ দীর্ঘ কবিতা লিখে রেখেছেন , অনেকেই আমরা পড়ে মুগ্ধ হয়ে বসেও আছি। আমরা নিশ্চিত  শ্রীমতি মুখোপাধ্যায় ঊর্ধ্বেন্দু দাসের নাম এই চিঠি পড়ে প্রথম জানবেনতিনি এবং তাঁর মতো বহু পাঠক ‘একটি ঘাসের শিষের ‘পরে একটি শিশির বিন্দু’  এখনো ভালো করে দেখেন নি। তাঁরা যাতে দেখেন, আমাদের সাহিত্যের খবর নেন, এবং সম্মানের সঙ্গে কথা বলেন এই চিঠি তাই লেখা হলো।  
          সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবি পীযূষ রাউতের বিশেষ বন্ধু বলে জানি। তাঁর বিখ্যাত সৌজন্যের কথাও শোনা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জীবিত থাকলে শ্রীমতী মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়দের সুনীলপাগলামো থেকে বরখাস্ত করতেন, কেন যেন মনে হয়, সেটা নিশ্চিত।
ইতি।  

পল্লব ভট্টাচার্য, আগরতলা; অশোক দেব, উদয়পুর; প্রবুদ্ধ সুন্দর কর, আগরতলা; রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ, আগরতলা; স্বাতী ইন্দু, আগরতলা;  সঞ্জয় চক্রবর্তী, গুয়াহাটি; জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত, গুয়াহাটি; সঞ্জয় ভট্টাচার্য, গুয়াহাটি; রণবীর পুরকায়স্থ, কলকাতা; জাকির হুসেন, কলকাতা; শ্যামল ভট্টাচার্য, কলকাতা;দেবোপম পুরকায়স্থ, কলকাতা;প্রীতিভাজন ব্যক্তি কলকাতা;   মৃন্ময় দেব , করিমগঞ্জ; সর্বজিৎ দাস, করিমগঞ্জ; পঙ্কজ ভট্টাচার্য , পাথারকান্দি; অমিতাভ দেবচৌধুরী, শিলচর; দেবাশিস ভট্টাচার্য, শিলচর, রূপরাজ ভট্টাচার্য , শিলচর; চন্দ্রানী পুরকায়স্থ, শিলচর; শৈলেন দাস,শিলচর;  শেখোয়াৎ মজুমদার, শিলচর; শতদল আচার্য, শিলচর; রাজেশ শর্মা, শিলচর; তিলক পুরকায়স্থ,শিলচর; সুব্রতা মজুমদার, দেওয়ান; অমিতাভ সেনগুপ্ত, লামডিং; মিফতাহ-উদ্দীন ,চেন্নাই; প্রণত কুমার নাথ, পেকানবারু, ইন্দোনশিয়া; মধুমিতা সেনগুপ্ত, তিনসুকিয়া এবং সুশান্ত কর, তিনসুকিয়া।

 ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


পীযুষ রাউতের মূল কবিতাঃ 





















সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মূল কবিতাঃ 

শুধু কবিতার জন্য
 
শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা
ভূবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;
শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু
কবিতার জন্য এত রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, মুধু কবিতার
জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।


শুধু কবিতার জন্যে
তিনটি স্লোগান কারা গেঁথে দিয়ে গেল, কাল
মধ্যরাতে দেয়ালে আমারঃ
‘শুধু কবিতার জন্যে বেঁচে থাকা সম্ভব।’—

‘শুধু কবিতার জন্যে তোমার অস্তিত্ব অর্থবহ।’
‘শুধু কবিতার জন্যে দেহের পতনও তুমি
হেলায় নস্যাৎ করতে পারো।’—

এবার দেয়াল ভেঙে ফেলাটুকু বাকি-ই যা---
তাবৎ ভাষ্য আর তত্ত্বের পচন থেকে ভালোভাবে বাঁচতে হলে,
এবং বাঁচাতে হলে সবটুকু স্বকীয়তা---
কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ এবং মাৎসর্যের তাপ,
স্বপ্নাতুর অস্তিত্বের স্পর্ধিত বিলাস,--
কবিতার উৎসে এসে স্থির-চিত্তে বসতে হবে,
নগ্ন পদ; নতশির---
রক্তছোপ বাস ছেড়ে জন্মের পথম ত্রিবেণীতে।

শুধু কবিতার জন্যে বেঁচে থাকা চলতে পারে শতেক জীবন---
শুধু কবিতার জন্যে হত্যা করা যেতে পারে সহস্র জীবন---
শুধু কবিতার জন্যে কেড়ে নেওয়া চলে রোজ ভিখিরির উঞ্ছ-রোজগার,-
কবিতার জন্যে ফের মায়ের হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে, প্রেমিকার পদতলে
দেওয়া যেতে পারে উপহার।---

কবিতার জন্যে আজো শেয়ার বাজারে রোদ ধুলোর চেয়েও কমদামি,
কবিতার জন্যে আজো বিশ্বাসঘাতিনী নারী সোনার থেকেও লোভনীয়,
কবিতার জন্যে, দেখো , ঈশ্বরবিহীন দেউলে অভিজাত মাতামাতি চলে—
শুধু কবিতার জন্যে রক্তাক্ত ললাট মুছে , অশ্রু চেটে, প্রিয়াকেও
প্রতিপক্ষ প্রেমিকের হাতে সঁপা চলে।–

কবিতার জন্যে কেউ চেয়েছে সবৎসা ধেনু, রমণী ও ভূমি;
কবিতার জন্যে কেউ চেয়েছে অক্ষয় কীর্তি, অনন্ত জীবন;
শুধু কবিতার জন্যে স্বচ্ছা-নির্বাসনে কেউ হয়েছে শহীদ,-
কবিতার জন্যে ফের অস্তিত্বের দৃপ্ত ঘোষণায়
যৌবন-বাউল কেউ অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছে।...

কবিতার জন্যে আজো মধুময় মরুৎ , সলিল—
কবিতার জন্যে আজো মধুময় অস্তোদয়-সূর্যের অয়ন;
শুধু কবিতার জন্যে মধুময় এ ধরণী, এ –জীবন এবং মরণ, --
শুধু কবিতার জন্যে সাগরে স্তম্ভন, মেঘে অশনি –দহন। ...
কবিতার জন্যে শুধু শিশুর মুখের হাসি এত অনুপম,
কবিতার জন্যে শুধু নারীর দুচোখ জুড়ে রহস্য অপার---
কবিতা হয়েছে, তাই সৃষ্টি হলো স্বর্গ ও নরক;
কবিতা হয়েছে তাই জন্ম নিল দেবতা , দানব;--
শুধু কবিতার জন্যে ঈশ্বরের ভাবমূর্তি এত জ্যোতির্ময়ঃ
কবিতার জন্যে ফের প্লাবনের তোরে বসে যুগে যুগে ঈশ্বরের
স্খলনকে ক্ষমা করে এসেছে মানব। ...

কবিতা লিখেছি আমি ঘাম, রক্ত, পাপ, ব্যাধি, পতন ও মৃত্যুর ছায়ায়;
কবিতা লিখেছি আমি অর্ধাশন –উপবাস-অপমান-নির্যাতন সয়ে;--
মাতাল-দাঁতাল হয়ে , উন্মত্ত ধীমান শান্ত তীব্র উদাসীন
সম্ভ্রান্ত ক্ষুধার্ত ক্রুদ্ধ অতৃপ্ত ধার্মিক সৎ মগ্নও চতুর
ভূতগ্রস্ত ভয়ংকর আত্মনাশী একদল স্বপ্ন-বিলাসীর
সাগ্নিক মিছিলে মিশে , নারীর স্ফুরিত ওষ্ঠ,
স্তনাগ্র, সরোম ঊরু,
যোনি খুঁড়ে খুঁড়ে
কবিতার ধমনিতে এনেছি লোহিত ঊষ্ণ –শোনিতের সফেন প্রবাহ। ...

শুধু কবিতার জন্যে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় অপার –জীবন,--
শুধু কবিতার জন্যে আটকে রাখতে ইচ্ছে হয় আসন্ন –মরণঃ

মেষ –পালকের গানে বহুরাত পৃথিবী জেগেছে---

মেষ-পালকের গানে বহুদিন পৃথিবী ঘুমোবে।

( কাব্য গ্রন্থঃ শরসয্যা)
 

এবং যে মূল চিঠি নিয়ে এই প্রতিবাদঃ