“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০১৪

ঘরে ফেরার দিন


                                             কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ


 


দোপাটির গোছ খুলে অঢেল চুলের রাশ কবরীর প্রান্তে ছড়িয়ে,
জলের ঝালর –ঘেরা চোখের তারার হাসি থরো-থরো ওষ্ঠে ঝরিয়ে,
শিমূল-ঝরার দিনে পাহাড়তলির ঘন আলতায় পা-দুটি ডুবিয়ে
সম্রাজ্ঞীর মহিমায় ভাস্বর তোমার ছবি কতকাল ভুলতে পারিনি!---

শিমূল ঝরার দিন অতঃপর পৃথিবীতে বারবার এসে, চলে গ্যাছে—
নির্জন বনস্থলী, ঝরনার সিম্ফনি, বলাকার ডানায় কেঁপেছে;
অরণ্যের চন্দ্রাতপে সূর্যের আলপনা-গায়ে দেহাতিরা ঘরে ফিরে গ্যাছে—
নাহর ছায়ায় হেঁটে কখন বিকেল এলঃ তুমি আর ফিরেও ডাকোনি।–

 তোমার উঠোন জুড়ে আমার সতর্কপদ বিকেলের রোদের ক্রমণ,--
 চৈত্রের বিবর্ণদিন ; বিশীর্ণ প্রপাত ঘিরে ঝরঝর জলের পতন
 অদূরে বিচিত্র-সাজ পার্বতী-রমণীর ভারনত শিলাবতরণ—
 মেঘে মেঘে বেলা যায়, আমার অপূর্ণ ঘট ভরা তবু হয়েতো ওঠেনি!_
 সম্মুখে আঁধার রাত, দুর্গম চড়াই –পথ হেঁটে তবে তোমার সীমানা—
 মা, তুমি নিশ্চিত জেনো, সোনালী সূর্যোদয়ে পৌঁছবো ঘরের ঠিকানা।



 ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আরো কিছু কবিতার সঙ্গে এই কবিতার আবৃত্তি এখানে শোনা যাবেঃ
)

বুধবার, ১২ মার্চ, ২০১৪

বসন্তস্মর

(C)ছবি
























।। অমিতাভ দেব চৌধুরী ।।

খনো এই রাতে হৃদয় জুড়ে মেঘ
বেলা যে পড়ে এল ও সখি !
আমার গান আর তোমার নিঃশ্বাস
কেউ কি শুনেছিল বলো দেখি !

যারা তা শুনেছিল সবাই চলে গেছে
এ দোলে ফাল্গুন খাঁ খাঁ তাই
পুরনো রং থেকে শব্দটুকু এনে
তোমার কথা বলেে যেতে চাই ।

যে চিঠি লিখতাম সে চিঠি কেউ আর
ভিজিয়ে দ্বিপ্রহ্‌র, লেখে না ।
অতীত তবু আজ ছায়ার মতো ঘোরে
অতীত বুঝি শুধু কান্না ?

আবার দোল এল নতুন দোল এক
শরীর আজো দেখি চমকায় ।
পুরনো বাতিদা্ন, নতুন বাতিওলা
রং তো গায়ে লাগে্‌, না ছায়ায় ?

রবিবার, ৯ মার্চ, ২০১৪

ফুল্লরার দুঃখকষ্ট

(বিজয়কুমার ভট্টাচার্য তিন দশকের বেশি সময় জুড়ে কবিতা লেখেন। থাকেন শিলচরে। বাংলাসাহিত্যে স্নাতকোত্তর এই কবি শিলচরের সুপরিচিত সাংবাদিকও। মূলত ১৯শে মের ভাষা আন্দোলন এবং অসমে বাঙালি অস্মিতার বৃত্তে ঘোরে বলে এই কবির কবিতা বরাক উপত্যকার বাইরে খুব একটা পরিচিতি পেতে পারে নি।  পাঁচালির ছন্দে তাঁর  অনায়াস দখল। এই কবিতাটি আশা করছি সবার ভালো লাগবে। নিয়েছি তিন দশক আগে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতার বই 'পুড়ে পুড়ে স্বর্ণ হোক সম্মিলিত পাপ' থেকে। কবিতাটি বাছাই করা হয়েছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে তিনসুকিয়া আসামে 'উজান সাহিত্য গোষ্ঠী' আয়োজিত আবৃত্তি প্রতিযোগিতার জন্যে। সেখানে যে ক'জন আবৃত্তি করেছেন প্রত্যেকটি শোনা যাবে নিচের ভিডিও তালিকাতে একের পরে এক অন্য আরো কিছু কবিতার সঙ্গে)





সারাদিন খোয়া গেল সূর্য অস্তাচলে
একটি পাখিও নেই শিকারের জালে
ঘরে আছে প্রিয়তমা ফুল্লরা রমণী
উনানে চাপায় হাঁড়ি পদশব্দ শুনি,

কোথায় মুকুন্দরাম মন্বন্তর দেখে
তোমার আখ্যান আজো পড়ে থাকে লোকে
বর্ষণমুখর ঝড় রাতের আন্ধারে
মানুষ অজ্ঞাতে যায় ভিটে মাটি ছেড়ে

তবুও তরুণ রক্তে ডিহিং লোহিত
জল ঝড় নাহি মানে খর হাওয়া শীত
ডেরা বাধেঃ রুটি রুজি, তারো ঘরে বউ
ফুল্লরার দুঃখকষ্ট জেনেছে কি কেউ

আমার ধনুক ভাঙ্গা গুণীনের গুণ
অরণ্য জুড়িয়া ক্রোধে জ্বালায় আগুন
পশুপাখি মৃতপ্রায় অথবা বিলীন
রিক্ত  হস্তে ফিরি ঘরে এভাবেই দিন

যায় মাস, বর্ষ, যায় বর্ষান্তরে
সহস্র ফুল্লরা কাঁদে লাচাড়ী পয়ারে
কে বিদেশী যাও নায়ে পূর্বস্রোতমুখী
আমারে তুলিয়া লও আজন্মের দুখী

পিদিম নেভানো রাত, ভোরে সূর্য ওঠে
দুশ্চিন্তার রেখাচিত্র অংকিত ললাটে
অমঙ্গলে সন্ধ্যা নামে পাখি ঘরে আসে
ফুল্লরার শবদেহ নদীজলে ভাসে

ডেরা বাঁধা মানুষের ঘরবাড়ী পোড়া
অঘোর শাওনে দেখো গাঙে ভাসে মরা
কোথায় মুকুন্দরাম চারণের কবি
অকাল সন্ধ্যায় আঁকো কবিতায় ছবি

আহা, এই ভিটে মাটি ধন ধান্যে ভরা
বাঁচতে চেয়েছে এক দুঃখিনী ফুল্লরা


মমতার চিঠি




কবি রমানাথ ভট্টাচার্য
 (গেল শতকের অসমিয়া কবিতার অন্যতম বিখ্যাত, বহু পঠিত কবিতা হেম বরুয়ার এই মমতার চিঠি। মূল অসমিয়া শুরু হয়েছিল এভাবে...

মৰমৰ,
এয়া মম এডাল জ্বলাই লৈছোঁ। আজি বহুত দিনৰ
মূৰত তোমালৈ চিঠি লিখোঁ বুলি। বাহিৰৰ উৰুঙা বতাহ  জাকে
মমডাল আহি কোবাইছেহি...চাওঁ খিৰিকিখন জপাই
দিওঁ...।


এমন বেশ কিছু খ্যাতিমান অসমিয়া কবিতার অনুবাদ করেছিলেন অসম তথা পূর্বোত্তরের বাংলা ভাষার অন্যতম কবি রমানাথ ভট্টাচার্য। আধুনিক অসমীয়া কবিতা নামে অনুবাদ গ্রন্থটি প্রকাশ করে গুয়াহাটির অসম প্রকাশন পরিষদ,  ১৯৯২তে। তারই প্রথম অনুবাদ কবিতাটি ঈশানের পুঞ্জমেঘের পাঠকদের জন্যে তুলে দিলাম। কবি রমানাথ এখন থাকেন মুম্বাইতে। কিন্তু অসমকে তিনি ভোলেন নি। অসমের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ সম্প্রতি সেখানে গড়ে তোলেছেন রমানাথ ভট্টাচার্য ফাউণ্ডেশন। সেই সংস্থা প্রতিবছর গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠান করে সম্মান জানিয়ে থাকে অসম তথা পূর্বোত্তরের দুই সাহিত্যিক প্রতিভাকে। একজন তার অসমিয়া হন তো আর জন বাঙালি। এবারে যেমন ৯ মার্চ, ২০১৪ সম্মান জানাবেন অসমিয়া কবি হীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ত্রিপুরার অন্যতম প্রবীন কবি স্বপন সেনগুপ্তকে। সেই নিয়ে সংবাদও এই কবিতার সঙ্গে রইল। সেই সঙ্গে দৈনিক যুগশঙ্খে প্রকাশিত রমানাথের একটিসাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার পড়লেই বোঝা যাবে কোন পরিবেশে তাঁর বাংলা কবিতাগুলো অসমে তেমন পরিচিত নয়, অথচ অসমিয়া অনুবাদ কবিতাগুলোর সঙ্গে বর্তমান ব্লগারের পরিচয় ঘটেছিল সেই নব্বুইতেই। সেখান থেকে তাই কবিতাটি তুলে দেয়া। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। --সুশান্ত কর )



If you are coming down through the narrows of the river Kiang
Please let me know beforehand,
And I will come out to meet you
            As far as Cho-fu sa.
                                    Ezra Paound

প্রিয়তম,
একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলাম। আজ অনেক দিন পর তোমাকে
চিঠি লিখছি। বাইরের দমকা হাওয়া মোমবাতি নিবিয়ে দিতে
চাইছে। ...যাক গে, জানালাটা বন্ধ করে দিই। ...
সাত বছর আগের কথা তোমার মনে
পড়ে? আমরা যে নতুন জীবন
শুরু করেছিলাম। ...সেই অজানা নেশা আমাকে খুব করে
পেয়ে বসেছিল।
সেদিন ছিল কার্তিকের কুয়াশা ছড়ানো কোমল সকাল।
উঠোন আবৃত ছিল ঝরে-পড়া শেফালি ফুলে। আর সন্ধে বেলা,
তোমাদের বাড়িতে প্রথম আসার দিনে, আকাশের
মেঘের মোহনা থেকে হলদে রঙের চাঁদ নৌকা হ’য়ে আমাকে যে
ডেকেছিল তারার দেশে। ...
আমার পরনে লাল শাড়ি দেখে তুমি
কেন অমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছিলে?
আমার কীরকম লেগেছিল, জানো? তুমি যেন কোন দূর
বিদেশের স্বপ্নাতুর আলোর মানুষ। আর আমি? আমি যেন
ঝরে-পড়া এক শেফালি ফুল।
সেদিন মনের সাগরে ভেঙে-পড়া ঢেউ আর
জেগে ওঠা ঢেউ অসংখ্য কম্পন তুলেছিল। তোমার বুঝি
ওসব কথা মনে নেই?
বাবা যে চিঠিতে লিখেছিলেনঃ “মা, তুই নতুন
বাড়িতে হেসে খেলে থাকিস।”
ওসব সাত বছর আগের কথা। আমার যে সব কিছুই
 পুরানের গল্প মনে হয়। ... জৈষ্ঠ মাসে বাবার
বাৎসরিক হয়ে গেল। বাবুল এখন বড় হয়েছে।
ওর উপর পাটীতে ডালিমদানার মতো ছোট ছোট
দাঁত উঠেছে। ও আমাকে ছেড়ে একটুও
থাকতে পারে না। ( এক এক সময় ওমন রাগ হয়,
তুমি না নেই, তাই।)

ও আমার সাদা থানপরা বেশ এরকম বিস্মিত হয়ে
দেখে কেন? জন্ম থেকেই এই বেশ ওর
পরিচিত, --সে জন্যই কি? শোনো , বাবুল এখন বড়
হয়েছে? ( আরেকটু বড় হলে ইস্কুলে
দেবো। ও ইস্কুলে চলে গেলে
আমার বুকটা খাঁ খাঁ করবে, প্রিয়!)
আর কি লিখবো। বিশেষ কিছু বলার নেই। প্রতিশ্রুতি দাও,
তুমি যেদিন ফিরে আসবে, আমাকে আগে থেকেই জানিয়ে দেবে।
আমি ভোগদৈ নদী-দিয়ে ভেসে গিয়ে লুইতের বুক থেকে তোমাকে
ডাকবো,--তুমি যেদিন
ফিরে আসবে। আমাকে আগের থেকে জানাতে ভুলো না।
ভালোবাসা নিও। ইতি
           তোমার মমতা

পুনঃ এবার মাঘ বিহুর ‘মেজি’র আগুন খুব
লাল হয়ে জ্বলেছিল। ...আমাদের বুড়িমার নতুন ছাগলী
দুটি বাচ্চা দিয়েছে। একটি নিখুঁত সাদা।
অন্যটি চিতল। 
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
দৈনিক যুগশঙ্খ
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
দৈনিক যুগশঙ্খ, রবিবারের বৈঠক













শুক্রবার, ৭ মার্চ, ২০১৪

সামাজিক আন্দোলনের সমস্যা ও বিকল্প ভাবনা

।। অরূপ বৈশ্য।।

বামপন্থী দুর্বলতা

 
       বামপন্থী পরিচয়ে এখন আর কেউ গর্ববোধ করেন না। উল্টোদিক দিক থেকে বলা যায় যে সচেতন নাগরিক এখন আর বামপন্থীদের মেহনতি মানুষের বন্ধু হিসেবে ভাবেন না। এটা একধরণের নেতির নেতি (Negation of negation)। কেন এমনটা হলো? এই প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল এবং এর উত্তর-সন্ধান এই নিবন্ধের বিষয়বস্তুও নয়। তথাপি এনিয়ে দুটি সামান্য কথা বলে নেওয়া ভাল। পরষ্পর সম্পৃক্ত দুটি কথার একটি বিষয়গত, অন্যটি বিষয়ীগত। ১৮৯১ থকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী শ্রমিক সংগঠন ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে বিশাল রূপ ধারণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা থেকে সামাজিক বিপ্লবের যুগ শুরু হয় ও লেনিনীয় সূত্রায়ন মেনে রুশ বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই ঘটনাপ্রবাহ যে বামপন্থী আবেগের জন্ম দিয়েছিল তা আশির দশক থেকে ম্রিয়মাণ হতে শুরু করে। পুঁজির বিশ্বায়নের যে নতুন নিয়ম আশির দশক থেকে শুরু হয়েছে একে অনুধাবন করতে করতেই বামপন্থীদের বহু সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায় এবং ফলে নতুন পরিস্থিতিতে রণকৌশল নির্মাণে ব্যার্থ হয়। অন্যদিকে ষাট-সত্তর দশকে যে আমাদের দেশে সামাজিক আন্দোলগুলো বিকশিত হয় তাকে চালু ব্যবস্থা যেমনি আত্মস্থ করে নেয়, ঠিক তেমনি বামপন্থীরাও একে রাষ্ট্র ও দলের মধ্যে আত্মস্থ করে সামাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার প্রাণশক্তি কেড়ে নেয়।

এক যাত্রায় ভিন্ন ফল

            প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণার পর থেকে পূবের বিভিন্ন দেশে সামাজিক আন্দোলনগুলি সমাজ-বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়েছে। এই পর্যায় প্রথমে রাশিয়া থেকে শুরু হয়ে সর্বশেষ ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের বিজয় দিয়ে শেষ হয়। সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষিত ১৮৯১ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত লাগাতার কাজের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকশ্রেণির বিশাল সংগঠন এবং পূবের দেশগুলিতে ব্যাপক কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। এই দুই সামাজিক শ্রেণির ঐক্যের প্রশ্ন ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই উপরুক্ত সমাজ-বিপ্লবগুলি সংঠিত হয়। ভারতবর্ষেও এই পর্যায়ে চৌরিচেরা, তেভাগা, তেলেঙ্গানার মত কৃষক বিদ্রোহগুলি সংগঠিত হয়, কিন্তু উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলন কোনো সমাজ-বিপ্লব সংগঠিত করতে ব্যার্থ হয়। এই ব্যার্থতার পেছনে বহুবিধ কারণের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক কারণকে চিহ্নিত করা যায়। দুই শত বছর ধরে ব্রিটিশদের গড়ে তোলা এক ব্যাপক নিপীড়ক রাষ্ট্রের উপস্থিতি, শ্রমিকশ্রেণির বদলে ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণির হাতে জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে যাওয়া যে নেতৃত্ব সমাজ-বিপ্লব ছাড়াই দেশের ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে বেশি আগ্রহী ছিলেন, কৃষক আন্দোলনগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারতীয় জাতি-বর্ণ ব্যাবস্থায় নির্ধারিত সীমানা অতিক্রম করতে ব্যার্থ হওয়া ও শিক্ষিত-শ্রেণির বর্ণবাদী মানসিকতার বিশেষ কোন পরিবর্তন না হওয়া। যে সামগ্রিক পরিস্থিতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজ-বিপ্লবগুলি সংগঠিত হয়েছিল সেই পরিস্থিতির ও সামাজিক আন্দোলনগুলির এখন বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের স্বরূপ সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বিলম্বের ফলে অতীত সমাজ-বিপ্লবের সুফলগুলিও একে একে মুখ থুবড়ে পড়েছে। পরাজয় থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রচেষ্টাকে ছাড়িয়ে গেছে পরাজয়ের গ্লানিতে সমাজ-বিপ্লবের প্রবক্তাদের মুখ লুকোনোর প্রচেষ্টা। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে নতুন রূপের সামাজিক আন্দোলনগুলি আবারও নতুন করে ভাবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে মুখ লুকিয়ে থাকা পরাজিত এই সমাজ-বিপ্লবীদের।

নতুন পরিস্থিতির স্বরূপ

           উপনিবেশিক শাসনে ভারতীয় শিল্পোদ্যোগগুলিকে ধ্বংস করা হয়েছিল। আমাদের বস্ত্রশিল্পকে শুধুমাত্র বাণিজ্যনীতির বাধা তৈরি করেই ধ্বংস করা হলো না, উৎপাদনের সাথে তাঁতশিল্পের শ্রমিকদের আঙুল কেটে ফেলারও নজির সৃষ্টি করেছিল বৃটিশ প্রশাসন। কৃষির উদ্বৃত্ত থেকে যে কৃষক-উদ্যোগপতি গড়ে উঠছিল তার বুনিয়াদটা ভেঙে দেওয়াই ভারতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য উপনিবেশিক শাসনের মূল চাবিকাঠি ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে মিশ্র-অর্থনীতির মাধ্যমে পরিকল্পনা খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করে পরিকাঠামো নির্মাণ ও শিল্পপণ্যের আমদানি কমিয়ে আনার জন্য ব্যক্তিগত খণ্ডে শিল্পায়নের উপর গুরুত্ত্ব আরোপ করা হল, কিন্তু এরজন্য আমদানি করতে হল ভারি যন্ত্রপাতি। শিল্পায়নের জন্য সহজ সর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হলো। সরকারি ব্যয় করার জন্য আয়ের মূল উৎস হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও আয়ের উপর প্রত্যক্ষ কর, ঋণের উপর সুদ ও ভোগ্যপণ্য বিক্রয়ের উপর পরোক্ষ কর। যেহেতু প্রত্যক্ষ কর ব্যাক্তিগত মুনাফার একটি অংশ এবং সেই মুনাফা তৈরি হয় শ্রমের উদ্বৃত্ত থেকে এবং পরোক্ষ কর তৈরি হয় উপভোক্তার ভোগের থেকে, সুতরাং সরকারি আয়ের মূল অংশই আসে শ্রমজীবী মানুষের থেকে। এই শ্রমজীবী মানুষই মোট জনসংখ্যার প্রায় আশি ভাগ এবং তারা গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার সাথে যুক্ত। অথচ কৃষিনীতিই এই মিশ্র অর্থনীতির পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয়ে রইল। ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের জমি মালিকানা দেওয়ার ও আয় বৃদ্ধির জন্য কোন ভূমিনীতি গ্রহণ করা হল না। রান্না করা খাবারের উপর যদি পারিবারিক অর্থনীতি নির্ভরশীল হয়, তাহলে যেমনি রান্নাঘরের আর কোন অস্তিত্ত্ব থাকে না, ঠিক তেমনি কৃষি উন্নয়নের প্রশ্নটির যদি মীমাংসা হয় কৃষির বাইরের নীতি দিয়ে, তাহলে কৃষি উন্নয়ণ বিঘ্নিত হয়। ফলে গরিষ্ঠাংশ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়, কমে যায় ভোগ্যসামগ্রীর উপর ব্যয় এবং তারসাথে সরকারের পরোক্ষ কর আদায়ের পরিমাণও। সম্পদশালী মানুষের উপর প্রত্যক্ষ করের মাত্রা ও ব্যাপ্তি যেহেতু বাড়ানোর বদলে কমিয়ে আনা হয়, তাই টান পড়ে সরকারি আয়ের ভাঁড়ারে। আয়-ব্যায়ের হিসাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে সরকারকে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়িক ব্যাংক থেকে ধার নিতে হয়, কিন্তু সুদ মেটাতে ব্যয়ও তার সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি ঘটে। সুতরাং এই ভারসাম্যের যাঁতাকল থেকে বেরিয় আসতে ব্যয় সংকোচনের নীতি ও সমস্ত কিছুকে বেসরকারীকরণের নীতি নেওয়া হয়। ১৯৯১ সালে গৃহীত নতুন অর্থনীতি এই পরনির্ভরশীল অর্থনীতিরই পরিণতি, যেখানে কৃষির উদ্বৃত্ত থেকে শিল্পায়ন নয়, বিকাশের জন্য নির্ভর করা হয় ধার ও বিদেশি ব্যক্তিগত পুঁজির অনুপ্রবেশের উপর। এই ব্যক্তি পুঁজিই জন্ম দিচ্ছে অবাধ দুর্নীতির, বাণিজ্য ও সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য অবাধ জমি দখলের জন্য উচ্ছেদ ও পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জমি মালিকানা দেওয়া ও সরকারি উদ্যোগে কৃষিতে জলসেচের ব্যবস্থা করার নীতি মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হয়, সরকারি ব্যয় ও ঋণ সংকোচনের ফলে তারাই কৃষিতে লাভজনক বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয় যাদের বৃহৎ জমি মালিকানা ও ট্রেক্টর-পাওয়ার টিলার-পাম্প সেট লাগানোর স্বচ্ছলতা আছে ও কৃষি ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা আছে। বাকী গরিষ্ঠাংশ ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা হয়ে পড়ছে সস্তা দিনমজুর। গরিষ্ঠাংশ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। বিনিয়োগ আসছে ফাটকা বাজারে, রপ্তানীযোগ্য পণ্য উৎপাদনের জন্য জমি মালিকানা নেওয়ার খাতে ও শহরের নাগরিকদের জন্য পরিষেবামূলক খাতে। নতুন টেকনলজির উপর নির্ভরশীল এই পরিষেবা খাতে বিনিয়োগ বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে শহরের যেখানে জন্ম নিচ্ছে নতুন মধ্যশ্রেণির এবং যেখানে সস্তা কাজের খোঁজে চলে আসছে গ্রামীণ কৃষিজীবীরা। বছরের এক সামান্য সময় কৃষি কাজে গতর খাটিয়ে যারা দুবেলা খাওয়ার জোটায় তারাও বাকী সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে দিনমজুরের কাজের সন্ধান করতে বাধ্য হয়। যেসব পুরুষরা কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে যায় তাদের পরিবারের মহিলারা যৎসামান্য মজুরিতে কৃষি কাজে লিপ্ত হয়। গ্রামীণ কৃষি এরকম এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন যেখানে কৃষকেরা প্রতিনিয়ত সস্তা শ্রমিকে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই বিপর্যয় গোটা অর্থনীতির বিপর্যয় ডেকে আনছে এবং ফলে পরিষেবামূলক শিল্পে যুক্ত নতুন মধ্যশ্রেণিও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। এই পরিস্থিতি জন্ম দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক আন্দোলনের।

বরাকের আঞ্চলিক উন্নয়ণ ও সামাজিক আন্দোলন
         
      বরাকের আঞ্চলিক উন্নয়ণের প্রশ্ন উত্থাপন হলেই, বুদ্ধিজীবী মহল থেকে একই ভাঙা রেকর্ড বাজতে থাকে। সরকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে আমাদের দেয়নি, উন্নয়ণমূলক প্রকল্প গড়ে তুলতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না করে বরাককে বঞ্চিত করা হচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু সরকারি উন্নয়ণ মডেলে বরাকের আসল অর্থনীতি যে ফোঁপরা হয়ে যাচ্ছে এদিকে কারুর নজর নেই। মেঘালয়ের কয়লা খনির ইদুঁর গর্তে ঢুকে যে শ্রমিকরা মারা যায়, ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরে যারা সস্তায় কাজ নিতে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে যায়, কাজের সন্ধানে অত্যন্ত অমানবীয় সর্তে যারা ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয়, যারা ইট-বালি-পাথরের কঠোর কাজে কোন সামাজিক সুরক্ষা ছাড়াই যোগ দেয়, যাদের প্রতিদিন কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হয় তারা একদা বরাকের কৃষির প্রন্তিক, ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন কৃষক। এদের সামাজিক পরিচিতিও একেবারেই স্পষ্ট – যারা যত বেশি কঠোর শ্রম ও যত কম মজুরি কাঠামোর সাথে যুক্ত তারা অবধারিতভাবে সামাজিক মর্যাদার সিঁড়িতে সবচাইতে নিচের দিকের সম্প্রদায়ভুক্ত। অথচ কৃষি আয়ের উদ্বৃত্ত দিয়েই ক্ষুদ্র শিল্প ও এর সাথে যুক্ত শ্রমিক এবং অভ্যন্তরিণ পরিকাঠামোর উন্নতি সাধন করা যেত। ক্যানেল ইরিগেশনের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, কিন্তু সবগুলি আজ অচল। বেশিরভাগ কৃষি জমিই সেচের আওতার বাইরে। ভূমিবন্টন ও পাট্টা দেওয়ার বাগারম্বরই সার, প্রকৃত কৃষকদের জমির মালিকানা নেই - ভূমিহীনদের ভূমি দেওয়ার কোন বালাই নেই। এনরেগার কাজ, যার হাজিরা আগামী ১ এপ্রিল থেকে ১৬৭ টাকা হচ্ছে, সেই প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে দূরবস্থা প্রকল্প রূপায়ণকারীদের সদিচ্ছাকেই প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির এক বিভৎস চেহারা বরাকের আমজনতা তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যক্ষ করছেন, যে শ্রেণি নিজের সমাজের ও অঞ্চলের উন্নয়ণের কথাও ভুলে যায়। সেই আত্মবিস্মৃত ও আত্নসম্মানবোধহীন শ্রেণি যাদের লোভাতুর চোখ গৃহস্থের ভাঁড়ারে, আর নতজানু হয়ে করতল উপরতলার চরণতলে। এই শ্রেণিরই প্রতিবিম্ব আমরা দেখতে পাই সেই বৌদ্ধিক মহলে যারা ভাষা ও আঞ্চলিক প্রেমে গদগদ, শহিদের স্মৃতিতে চক্ষু সদা ভারাক্রান্ত, অথচ বরাকের প্রকৃত উন্নয়ণে প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে ও জনমানসে আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করতে চূড়ান্ত অনীহা। আসলে যে মধ্যশ্রেণিটি জীবনীশক্তিহীন, আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে ফেলেছে, দেশপ্রেমকে মানুষের জন্য প্রেম নয় ধর্মীয় ও সংকীর্ণ স্বার্থের প্রেমের গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলেছে তাদের মেকী বাগাড়ম্বর বরাকের বিভিন্নধরনের সামাজিক আন্দোলনে প্রাণশক্তি সঞ্চার করতে অপারগ। গ্রামীণ ও অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠিত করে এবং এই শক্তির উপর ভিত্তি করে বরাকের আন্দোলনে নতুন দিশা ও প্রাণসঞ্চার করা সম্ভব। আর সেজন্য প্রয়োজন বাস্তবকে বোঝার এক কঠোর বৌদ্ধিক ও সাংগঠনিক চর্চা। এটাই আজকের সময়ের বামপন্থা।

      

সামাজিক আন্দোলনের সমস্যা ও সমাধান

       
     বিগত বছরগুলিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দিকে দিকে সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, তথ্য জানার অধিকার, মানবাধিকার, ভাষার অধিকার, জাতি-বর্ণগত অধিকার, জমির অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সর্বশেষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন মাত্রার ও বিভিন্ন পরিসরের আন্দোলন পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু জনমতের চাপে খানিকটা পিছু হটে সার্বিকভাবে উদার অর্থনীতি বা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের নীতির মধ্যেই এগুলিকে আত্মস্থ করে ফেলা হচ্ছে। দুর্নীতি বিরোধী আম-আদমির উত্থানও যে বিশ্বায়নের নীতির গণ্ডি অতিক্রম করে এগোবে না তার ঘোষণা আগাম দিয়ে রেখেছে এবং এটাই অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারণ আধুনিক শ্রমিকশ্রেনির সাথে ব্যাপক শহুরে ও গ্রামীণ অসংগঠিত শ্রমিক এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষিজীবীদের সচেতন ঐক্যই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নকে প্রতিহত করতে পারে। এবং একাজটি করতে হয় ব্যাক্তিগত মিডিয়া প্রচারের মোহ পরিত্যাগ করেই। বিশ্বপুঁজিবাদ ভীষণ সংকটের মধ্যে পড়েছে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বিভিন্ন স্থানিক যুদ্ধের পরাজয়ের অভিজ্ঞাতা থেকে রণকৌশলগতভাবে পিছু হটছে, সামাজিক আন্দোলনগুলো ব্যাপক ঐক্যের ভিত প্রস্তুত করে রেখেছে। কিন্তু যে বামপন্থা গণতন্ত্র ও শ্রমিকশ্রেণির ক্ষমতা এই দুয়ের মেলবন্ধন ঘটাতে পারে তারাই আজ বিপর্যস্ত ও সুবিধাবাদী অবস্থানে রয়েছে। এক নতুন বামপন্থী উত্থানই সামাজিক আন্দোলনের সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে ‘চুঙ্গা ফুঁ’ বলে একটা কথার প্রচলন রয়েছে। যেখানেই আওয়াজ দেওয়ার জন্য মাইক সাজিয়ে রাখা আছে, সেখানে গিয়েই নিজের মুখ দেখানোর জন্য একটা ‘ফুঁ’ দিতে ব্যস্ত এখন তথাকথিত বামপন্থী ‘চুঙ্গা ফুঁ’রা। এই মুখোসের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখা তথাকথিত বামপন্থীদের কঠোর সমালোচন করেই নতুন বামপন্থা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে ও সামাজিক আন্দোলনকে সমাজ-বিপ্লবের দিশা দিতে পারে।

বুধবার, ৫ মার্চ, ২০১৪

পূর্বোত্তর ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কিছু সংবাদ


    ১শে ফেব্রুয়ারি,০১৪, শুক্রবার ছিল  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যি দিয়ে গোটা পূর্বোত্তরে বিভিন্ন জায়গাতে দিনটি পালিত হলো। তার মধ্যে ঈশানের পুঞ্জমেঘ ফেসবুক গ্রুপে কয়েকটির সম্পর্কেই শুধু জানা গেছে। আমরা সেগুলো এখানে নানা ভাবে তুলে রাখছি। তিনসুকিয়াতে  ‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’র অনুষ্ঠানের সঙ্গে বর্তমান ব্লগার নিজে জড়িত বলে এর কথা টাইপেই লেখা যাবে। বাকিগুলো রইল ছবিতে। তিনসুকিয়াতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করে এসছে উজান তার জন্ম লগ্ন থেকেই । গেলবার থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, বিশেষ বক্তৃতানুষ্ঠান। এবারেও   বিকেল ২.৩০ মিনিটে দুর্গাবাড়ি পূজা মণ্ডপে বহুভাষিক কবিতা পাঠ, সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে  আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হলো। আলোচনা সভাতে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেনঃ নাগাল্যাণ্ডের একমাত্র বাংলা সাময়িক পূর্বাদ্রির সম্পাদক ডিমাপুরের কবি-প্রাবন্ধিক  অধ্যাপক দেবাশিস দত্ত, তাঁর বলবার বিষয় ছিলঃ  ‘১৯শে মে, ২১শে ফেব্রুয়ারি এবং উত্তরাধিকার’। বক্তৃতার কিছুটা নিচে ভিডিও প্লেলিস্টে রয়েছে। কিছুটা আঁচ করতে পারবেন, পরের রবিবারে প্রকাশিত তাঁর একটি লেখা থেকে। এখানে ছবিতে রইল।  আর ছিলেন তিনসুকিয়ার সৌমারজ্যোতি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সাংস্কৃতিক কর্মী মৃদুলা চলিহা শর্মা । তিনি বললেন, ‘ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ৰ পাঠ্যক্রমত মাতৃভাষাৰ গুৰুত্ব।’ নিয়ে। তাঁর বক্তব্যেরও খানিকটা নিচে ভিডিও প্লেলিস্টে শোনা যাবে।

            অনুষ্ঠানের সূচনাতে গোষ্ঠীর সভাপতি এবং উপস্থিত সবাই অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদ বেদিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে , ফুল ছড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান। সেই সঙ্গে রূপা পাল, জীবন সরকার, বনশ্রী দত্ত, বর্ণালী চৌধুরী প্রমুখ গোষ্ঠীর শিল্পীরা গেয়ে উঠেন 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি', এর পরেই পূরবী বরঠাকুরের নেতৃত্বে সৌমারজ্যোতি বিদ্যালয়ের শিক্ষক -শিক্ষিকা এবং ছাত্রছাত্রীরা গান করেন "চিৰ চনেহী মোৰ ভাষা জননী" 
 
               দুর্গাবাড়ি মণ্ডপের খোলা প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠান হওয়াতে পথচলতি অনেকেও দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। এ ছাড়াও তিনসুকিয়ার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক -শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। ডিগবয় থেকেও এসে উপস্থিত হন 'বলাকা'র সম্পাদক এবং সুলেখক অজিত কর, 'উত্তরণে'র সম্পাদকদ্বয় এবং সুলেখক পার্থসারথি দত্ত, মানব রতন মুখোপাধ্যায়। এঁরা তো নিজের লেখা কবিতা পড়েনই , এছাড়াও    অনুষ্ঠানে কবিতা পড়েন নীলদ্বীপ চক্রবর্তী, কমল শর্মা প্রমুখ অনেকে। অনুষ্ঠান সূচীটি হাতের কাছে নেই বলে বিস্তৃত লেখা গেল না। উজানের শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে গান করেন। এ ছাড়াও অনুষ্ঠানে গান করেন অমৃত রাজখোয়া এবং  শিশু শিল্পী পৌষালি কর প্রমুখ।
             অনুষ্ঠানের শেষে ১৬ ফেব্রুয়ারি, রোববারে দিনভর অনুষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতার পুরস্কার তোলে দেয়া হয় প্রতিযোগীদের হাতে।
           এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে এবারে আয়োজিত চিত্রাঙ্কন থেকে আবৃত্তি প্রতিযোগিতাতে একটি প্রয়াস ছিল যাতে শিশু কিশোরেরা অধুনা বিস্মৃত বাংলা-অসমিয়া ধ্রূপদী শিশু সাহিত্যগুলো খানিক মেলে ধরে বা সেগুলোর সম্পর্কে কৌতূহলি হয়। তেমনি অসমের বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য নিয়ে বিশেষ আগ্রহ জাগাবার কথা মনে রেখে আবৃত্তি প্রতিযোগিতাতে অসমিয়া কবিদের পাশে রাখা হয়েছিল শুধুই অসমের বাঙালি কবিদের কবিতা। তেমনি পুরস্কার হিসেবেও প্রমাণ পত্রের সঙ্গে সবার হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল অসমে প্রকাশিত সব অসমিয়া এবং বাংলা বই পত্র।   গোটা অনুষ্ঠান পরিকল্পনা এখানেও দেখা যেতে পারে।
পুরস্কৃতদের তালিকাটি এরকমঃ


২১শে উপলক্ষে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ফলাফল

চিত্রাঙ্কনঃ

ক-বিভাগ
১) আদ্রিজা পাল
২) অনিন্দিতা রক্ষিত
৩) প্রীতিশ পরাসর

খ-বিভাগ

১) সন্দীপন রায়
২) আদ্রিজায়া পাল
৩) দীপাঞ্জন পাল

গ-বিভাগ

১) স্নেহা ভৌমিক
২) রাজাধিরাজ চক্রবর্তী
৩) স্নেহাশিস দত্ত

ঘ-বিভাগ

১) অঙ্কিতা ভট্টাচার্য
২) অপরূপা দাশ
৩) পারমিতা দেব


হাতের লেখাঃ

ক-বিভাগ
১) বিশেষ পুরস্কারঃ সুপ্রিয়া দে

খ-বিভাগ
১) কল্যাণী উরাঙ
২) আমন ভাওয়াল
৩) বিশ্বজিৎ বাইলুঙ





প্রবন্ধ রচনা
ক-বিভাগ

১) বিশেষ পুরস্কারঃ নন্দিনী দাশ

খ-বিভাগ

১) অঙ্কিতা ভট্টাচার্য
২) অদিতি দাশ
৩) সঞ্জীবনী দে

আবৃত্তি

ক-বিভাগঃ

১) অঙ্কিতা বারই
২) অস্মিতা রায়
২) বিনায়ক সেনগুপ্ত
৩) সুজাতা ভৌমিক

খ-বিভাগ

১) পৌষালি কর
২) সায়ঙ্কি দাশ
২) পৌলমি ব্যানার্জী
৩) অদিতি দাশ

গ-বিভাগ

১) বিশেষ পুরস্কারঃ শতাব্দী গাঙ্গুলি

ঘ-বিভাগ

১) বর্ণালী চৌধুরী
২) ডালিয়া দাশ
৩) মুনমুন চৌধুরী

 

অনুষ্ঠানের ভিডিও গুলো দেখা যাবে এখানে, একের পরে একঃ







অনুষ্ঠানের ছবি গুলো দেখা যাবে এখানে, একের পরে একঃ




~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত ব্যাতিক্রম মাসডো আয়োজিত অনুষ্ঠানের কিছু দৃশ্য এবং সংবাদ ছবিতেঃ (নিচের সব ছবিতে দু'বার ক্লিক করলেই বড়ো হয়ে যাবে, এবং পড়া যাবে। )





~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
শিলচরে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানগুলোর কিছু ছবিঃ






~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বারইগ্রাম, করিমগঞ্জে  অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানগুলোর কিছু ছবিঃ







~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কৈলাশহর , ত্রিপুরাতে  অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানগুলোর কিছু ছবিঃ