“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২৩ মে, ২০১৪

১৯কে নিয়ে এক গুচ্ছ কবিতা
























সূর্যলোভী

ঊর্ধ্বেন্দু দাশ


শরীরে অযুত ক্ষত, সুপ্তিহীন অপমানিতের—
হৃদয়ে দুরন্ত ঝড় অগ্নিক্ষরা গতির নেশায়,
দুপায়ে শৃঙ্খল-বাঁধ হেসে ওঠে দুর্বিনীত হাসি—
ভ্রুভঙ্গে অশনি ঝরে অভিশপ্ত বিদ্যুৎ -লেখায়।
শঙ্কিত সূর্যের লোভে স্বর্গীয় পাখির সন্ততিরা
গুনেছে প্রহর শুধু, অনুক্ষণ ফেরারি আশায়,
নিশান্তে তাদের ডানা অভীপ্সার মেরুন-পতাকা
প্রহত মেঘের গায়ে মেলে দ্যায় আশ্চর্য হেলায়
বারুদের নেশা, বন্ধু, চোখে-মুখে প্রকট আমার---
এ বুকে এখনো দীপ্ত এগারোটি প্রাণের আগুন।
দম্ভিতের সপ্তরথী-চক্রান্তের বেড়াজালে আজ
বন্দী অভিমন্যু, জেনে, নিয়েছি এ শপথ দারুণ!
শোনেনি তো বেদব্যাস, এ যুগের অভিমন্যুদের
অ-নত দেহের কোষে ঝঞ্ঝাপ্লাবী শোণিতের স্বর;
জানেনি---কমলা বোন কী দুর্বার আবেগের বীজ
রেখেছে ছড়িয়ে , আজ, ক্ষুব্ধ ধমনীতে নিরন্তর!----
বৈদিক যুগের ভাষ্য, জেনো বন্ধু, অচল এখন---
বারুদের অভিজ্ঞান আমাদের কবচ-কুণ্ডল;
অযুত মৃত্যুর দ্বার পার হইয়ে, চেয়ে দ্যাখো, আজ
আমরা নিয়েছি জন্ম সূর্যলোভী স্বর্গশিশু-দল।
বিশ্বাসের তীর্থভূমি, জানি বন্ধু, প্রকম্পিত আজ---
কুচক্রীর লুব্ধ ঠোঁট ছেঁড়ে তাই অন্ত্র , আমাদের;
তবু জেনো, আশংসার দুর্নিবার কুরোশিয়ো –গান
পারেনি তা কেড়ে নিতে, অত্যাচার, রক্তলোভীদের!
আমরা বিজয়রথী, জেনো বন্ধু!—পূর্বাচল, তাই
লাল-সূর্য ঠোঁটে নিয়ে স্বর্গীয় পাখির ডিম থেকে
দিয়েছে ফিনিক্স-জন্ম, অগণিত বীর সন্ততির---
কৃশানু-স্বাক্ষর-বুকে যারা আজ ব্যাপ্ত দিকে দিকে।


১৯শে মে, ৮৫



অনুরূপা বিশ্বাস

তোমার কাছে প্রাপ্তি অনেক
            প্রাপ্য ছিল আরো বেশি
নিষ্কলঙ্ক আকাশ এবং
হা হা হাসির আগলভাঙা
            আনন্দকে খুঁজে নেবার প্রতিশ্রুতি
সব কেবলি ওলোট-পালট
সামনে ধুধু বালিয়াড়ি
উটের সারি...মরু জাহাজ
এবং খেজুর বনের কাঁটা
            জনশ্রুতি


উনিশে মে ১৯৬১ শিলচর

                         শক্তিপদ ব্রহ্মচারী

দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল, ‘এই যে ঈশান কোণ—
কোন ভাষাতে হাসে কাঁদে কান পেতে তা শোন।’

 শুনলি না? তো এবার এসে কুচক্রীদের ছা
তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা---
‘বাংলা আমার মাতৃভাষা, ঈশান বাংলা মা।”





শহীদ কমলাকে

দিলীপ কান্তি লস্কর



সময়ের কারাগারে বাস্তুবন্দী এই ভূবনের
চক্রব্যুহে বৃত্তবন্দী এই ভুবনের
            প্রাণে পণ দাও
কি ঐশ্বর্যে প্রাণ দিতে হয় তুমি
            কবিকে শেখাও
১৯শের মহিলা শহীদ।

কি করছ ওখানে তুমি? কি করছে ওরা দশটি ভাই?
জানি জেগে আছো, অমৃতে অরুচি
            প্রতীক্ষার আদ্যোপান্ত নাই।

বড় বেশি বৃষ্টি হচ্ছে বড় ঘাস জন্মাচ্ছে এখানে
উপজিব্য ফুল-বেলপাতা-অর্থ চাঁদ ও অপ্রেম।
যারা কৌরব তারা খেলে যাচ্ছে দৃঢ়পণে
            আরো দ্রুত শকুনির পাশা
নির্লজ্জ ও ক্লীব চোখে দ্রৌপদীর বস্ত্র হয়ে ঝরে বর্ণমালা
তবু কুরুক্ষেত্র ছিল, আছে, মর্যাদার রণ আছে
পাণ্ডবের কাছে।



মাতৃভাষা



                        দিলীপকান্তি লস্কর

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা
আমাদের ছায়াছবির ভাষা হিন্দি

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা
আমাদের সংগীতের ভাষা হিন্দি

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা
আমাদের আনন্দের ভাষা হিন্দি

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা
আমাদের উচ্চাশার ভাষা ইংলিশ





অবস্থান



                        দিলীপকান্তি লস্কর


আমি কোত্থেকে এসছি, তার জবাবে যখন বললামঃ
করিমগঞ্জ, আসাম
তিনি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেনঃ বাঃ, বেশ সুন্দর
বাংলা বলছেন তো!
একজন শিক্ষিত তথা সাহিত্যিকের যখন এই ধারণা, তখন
আমি আর কী বলতে পারি!
ওকে ঠিক জায়গাটা ধরিয়ে দিতে গিয়ে বললামঃ
            বাংলাভাষার পঞ্চদশ শহিদের ভূমিতে আমার বাস।
তিনি তখন এক্কেবারে আক্ষরিক অর্থেই আমাকে ভিরমি
খাইয়ে দিয়ে বললেনঃ
                        ও! বাংলাদেশ? তাই বলুন।



 সাকিন

সঞ্জয় চক্রবর্তী





এপার বাংলা ওপার বাংলার মাঝে
এক অপার বাংলা আছে।
কার্তিকের নবান্নের দেশ থেকে
অশ্বত্থ বটের পথ থেকে
পদ্মানদীর মাঝি থেকে দূরে
আমি সেই বাংলায় থাকি,
যেখানে, একুশ তত আত্মীয় নয়,
এমন-কি উনিশও।

 ২
জন্মদিনের পায়েস, বলো, কার অনুগামী হব?
বলো মাতৃদুগ্ধ, ওই যারা তড়িঘড়ি
গঙ্গাতীরে দিচ্ছে পাড়ি, ওদের বাড়ি?
এদের সঙ্গে আমার আড়ি।

তাহলে সুড়ঙ্গই ভালো, ভালো সহাবস্থান
এক হাতে বর্ণপরিচয়, অন্যহাতে তাম্বুলপান,
যখন একা, ভীষণ একা,
হাতে শুধু গীতবিতান।


অরুণ বরুণ কিরণমালা


স্বর্ণালী বিশ্বাস ভট্টাচার্য

ভাইগুলো তার পাথর হল
বোনটি একা বাড়ি---
বুকের ভেতর উনিশে মে,
একুশ ফেব্রুয়ারি।
মায়া পাথর, মায়া সাগর,
অথৈ মায়া খেলা---
অরুণ বরুণ হারিয়ে গেছে,
একলা কিরণমালা।
দুচোখে ভরে আগুন নিল
দুঠোঁট ভরে ঘৃণা—
পেরিয়ে গেল সাতাশ নদী,
মৃত্যু পরোয়ানা।





আবার এসেছে ফিরে



                        বিজয় কুমার ভট্টাচার্য

আবার এসেছে ফিরে রক্তাক্ত ঊণিশে মে
শব্দের শরীরে তাই সঘন রোমাঞ্চ নামে
বর্ণমালা ছিঁড়ে খোকা আজো বলে
            ‘এ’-য় একাগাড়ী
ভাঙ্গনের কূলে এসে
            এইবেলা ফিরে কি দাঁড়াতে পারি?
 স্বপ্নের আকাশ চোখে একদিন তারমতো
দেখেছি নীলিমা
নক্ষত্র খচিত রাত্রি ধান্যশীর্ষে হলুদ পূর্ণিমা
অবিরল বৃষ্টিপাতে মার মুখে সীতাকে শুনেছি
বাঙলার অমর কবি কৃত্তিবাস নিজেকে ভেবেছি
বর্ষায় ভরা নদী বেহুলা মান্দাসে;
বাঙলায় গল্প শোনা মার কোলে বসে---!
এরপর কারা যেন শব্দকে ভেঙ্গেছে পাথরে
সে কথা জানাতে আসে বছরে বছরে বছরে
রক্তের ঊণিশে মে একুশে ফেব্রুয়ারী
বর্ণমালা ছিঁড়ে খোকা বলে যায়
            ‘এ’-য় একাগাড়ী—
বাংলার শব্দমালা কথা বলে বৃষ্টির অক্ষরে
রূপসী বাংলার কবি
            বাংলাকে জেনেছে গভীরে
বিপন্ন বিস্ময়বোধে আমি দেখি পরবর্তী কাল
একুশের ভোরে বাংলা ঊণিশের রক্তাক্ত সকাল
আমার মায়ের চোখে দঃসহ দুঃস্বপ্ন জেগে থাকে
সম্ভাব্য সংকটে দিন
            রাত্রি কাটে ভীষণ উদ্বেগে
কালক্রমে নিভে যাচ্ছে সব আলো, দৃষ্টি অন্ধ,
মরাও নিরাপত্তাহীন---
চৈতন্যে জড়ায় সাপ অনাগত আসন্ন দুর্দিন।
শৈশবের স্তন্যপানে আমাদের
বালক সময়
জেনে গেছে প্রাত্যহিক, সেও আর বিপন্মুক্ত নয়।


ব্রহ্মপুত্রের ঝড় উঠে, নৈসর্গিক বিদ্রোহে বরাক
অস্তিত্ব বিপন্ন জেনে এ মুহূর্তে কাকে দিই ডাক


(মূল বানান রেখে দিয়েছি)






























কোন মন্তব্য নেই: