“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৫ মে, ২০১৪

বাজার

    (কথাশিল্পী রণবীর পুরকায়স্থ (জন্ম: ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯,আসামের সাবেক কাছাড় জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত লালখিরা গ্রামে। শৈশবের কিছুদিন চা বাগানে , কিছুদিন লোয়াইরপুয়া গ্রামে, তারপর শিলচর শহরে। শিক্ষা:- অভয়াচরণ ভট্টাচার্য পাঠশালা, কাছাড় হাইস্কুল, কাছাড় কলেজ থেকে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে  এম.কম. ।কর্মজীবন:- ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার আধিকারিক হিসেবে কলকাতা থেকে অবসর। লেখক বর্তমানে কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। লেখালেখি:- চারটে গল্প গ্রন্থ, দুটো উপন্যাস। বর্তমান গল্পটি বেরিয়েছিল গুয়াহাটির ‘পূর্বদেশ’ গল্প পত্রে। ভালো লাগল বলে তুলে রাখলামঃ সুব্রতা মজুমদার )
     রমুজকান্দি বাজারের জাতই আলাদা ।  নতুন জেলা হাইলাকান্দির একমাত্র রবিবারের হাট । বরাক, কুশিয়ারা, ধলেশ্বরীর যখন একটিমাত্র জেলা তখনও করমুজকান্দিই ছিল একমাত্র রবিবারের বাজার ।

     এই কাছেই, জানকীর বাজারে সারা শনিবার রাতভোর বাজার হয় । দুপুর থেকে হাঞ্জারাত পর্যন্ত সব হাটের যেমন , শনিবারি বাজারেরও আলাদা কিছু নেই। শুধু চেনা পসরার বিকিকিনির সাথে ‘থিথি থরর হই’ অবিরাম শুনতে শুনতে একসময় বাজারের মাঠ শুধু গরুতেই ছেয়ে যায়। বসে গরুর বাজার । গরুর বাজার, না চোরের বাজার, ঠগের হাট । তেলগুড় খাইয়ে একপোয়া দুধআলি গাইকে পাঁচসেরি করে দেয় বেঁচে । নাক কান ছিঁড়ে , ব্যাঙ্কের নথ খুলে চোরাই গরু বেচে দেয় খোলাোখুলি । রাতভোর বাজারে পুলিশের তৎপরতা থাকে ভাল, আদায়ও হয় ভাল ।

       সকাল দশটায় পুলিশের গাড়ি থেকে নামতে নামতে কনস্টেবল বাবুল মিয়া হাই তুলে। দুই হাত উপরে উঠিয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বলে,

---   হারা রাইত ঘুম নাই আইজ্ঞা। তেও কই, করমুজি বাজারর জাতঅউ আলেদা ।

              হাইলাকান্দি আর লালা শহরের ঠিক মধ্যবিন্দুতে করমুজি বাজার । সরকারি পরিবহনও রবিবার সকাল বিকাল দুই খেপ বেশি বাস চালায় । বাজারের কথা মাথায় রেখেই । বাজারের সামনে তো অন্যদিন দুমিনিটের থামা। বাজারবারে পনের মিনিট পাক্কা! বেশিও হয়ে যায় কখনও। মণির কাকার এক গেলাস মাগনা চায়ের লোভে দেরি করে দেয় ড্রাইভার । শিলকুড়ির রামুর সিঙাড়া যেমন বিশুদ্ধতায় বিখ্যাত, কাকার চাও তেমন। কাকা নিজের হাতে গেলাস গরম জলে ধুয়ে এক এক কাপ করে না ফুটিয়ে চা করে । কাপের মাপে ছোট গেলাসে এক টাকার চা । মণির কাকার চা খেতে শহুরে মানুষের ভিড়ই হয় বেশি ।

     সব বাসগাড়িই কাকার দোকানের সামনে এসে থামে । তেপথি মোড়ে থামলে প্যাসেঞ্জার হয় বেশি । বাজারবারে বেশি সময় থেমে থাকায় কেউ খুব অখুশি নয় । বাজারি, বেপারি , ড্রাইভার, কনডাক্টার, হেন্ডিমেন  আর সরকারি নিগম সবাই খুশি ।

     চিঁড়ে চ্যাপ্টা ভিড় , উৎকট গাত্রগন্ধ , আর বাসে উঠেই ‘ছারতায় না নিবা’ হাঁকেই রবিবারি বাজারের শেষ মজা । ঐ হাঁক যেন  হে আল্লা বা হরিস্মরণ । কেউ কিছু মনে করে না । ড্রাইভার কন্ডাক্টরও যাত্রীয় জয়যাত্রার আদুরে সম্ভাষণ বলে মেনে নেয় । কথক তো হেঁকেই নির্বিকার , কোমরে প্যাঁচানো খুতির অবস্থান দেখে রডে হাত বাড়ায় , হাতে বাঙ থাকলে সিটের নীচে চালান করার চেষ্টা করে , বাজারি মানুষের গালাগাল খায় , সহ –বেপারির সহানুভূতিও পায় ।

      --- অতাউ ইখানোর মজা , আমার বাড়ি তো স্যার আলগাপুরো, দেখি। ঘুমঘোরে ‘দেখি’ কথাটা আলগা করে বলে বাবুল কনস্টেবল ।

       আলগাপুর, সরসপুর, মোহনপুর ,কুচিলা এমনকি বাঘবাহার , আইরংমারা থেকেও দল বেঁধে মানুষ বাজার বাহার দেখতে আসে । দলে দলে রঙ বেরঙের সোয়েটার চাদর জড়ানো মানুষজন । এরা সবাই ক্রেতা নয় শীতকালের মর্নিং  রাইডার এদিকের লালা রাজ্যেশ্বরপুর ওদিকের হাইলাকান্দির মধ্যবিত্তরা দুরকম বাসে, অটো, স্কুটার, বন্ধুর বাইকে , উচ্চবিত্তরা নিজের গাড়িতে , গাড়ি ওয়ালা চাকুরেরা অফিসের গাড়িতে ।

     অন্য প্রান্তিক শহর লালা থেকে আসে হাটের মুখ্য বেপারিরা । ছোট এবং বড় ব্যবসায়ী । তুলারাম সিপানি, করমচান্দ সুরানা , ভবানীচরণ এরা আসেন ধোপদুরস্ত ধুতি শার্টের উপর ময়লা বুঝার উপায় নেই তুষ চাপিয়ে, সরকারি বাসে । হাজি সাহেব আর লাতু মিয়া মাটিতেলের ডিপুআলা, কাটলিছড়ার বাসে । তাদের হাতে থাকে সাধারণ সুতি কাপড়ের থলে , দামী বেসাতির জিনিষ কিছুই নেই, আছে শুধু কাগজপত্র । তাগাদার কাজে লাগে

     গরিব গুর্বোরাও হাটের লোভ ছাড়তে পারে না ওরাও আসে । ওদের জন্য ও আছে নানা প্রলোভন । করমুজি বাজারের যে জাতই আলাদা । এখানে আসতে তাই দাদনদার মহাজনেরা ভোলেন না।

     পাশের সব চা বাগানেই শনিবারে হপ্তা । মানে তলব দিন । কুচুর মুচুর হাড়িয়া মাড়িয়া খেয়েও যা বাঁচে তা নিয়ে রবিবারের মজা ও হলো, দু'পয়সার সওদা হলো, মহাজনরা তো বুঝে শুনে বাকিও দেয় । চাষিদের ও তেমন কিছু না থাকলে গান্ধিপোকায় খাওয়া আধপচা লাউ দুটো নিয়েই বাজারে চলে আসে । বাজারে বাসে আট আনার এক গেলাস সিদ্ধ চা , চার আনার টুস বিস্কুট , একটা খাওয়ার একটা খাওয়ানোর মোট দুটো বিলাসি বিড়ি চাইই চাই ।

      মহাজনেরা জানেন, খাতককে চোখে চোখে রাখতে হয় । আদায় আশু না হলেও চলে। গরিবরা তাদের শত্রু ভাবে না । চাষিদের  কুলি – কামিনদের সারা বছরের , পরবের প্রয়োজন মেটাতে এঁরা সদা প্রস্তুত । বাচ্চাদের রঙিন জামা, বৌ বেটিদের বেলাউজ , আর গামছা ধুতি , লুঙি , অসময়ের নগদ টাকা সবই এরা পায় । ধান উঠলে বা বোনাস পেয়ে আদায় না করলে বকুনিও খায় কষে । আবারও পায় । সব মহাজনদেরই কল্পতরু দোকান আছে বাজারে । কর্মচারী চালায়, বেছে বেছে বাকি দেয় । শহরে আড়ত আছে সবার । লাতুমিয়ার তো কেরোসিনের ডিলারশিপও আছে । বাজারে তারা সবার সুখ দুঃখের শরিক হতেই আসেন । গরিবের ভগবান ফেরেস্তারা চেনেন ও সবাইকে বালবাচ্চা সমেত ।

--- মানুষ খারাপ নায় স্যার । এরা জুলুম করে না । আমরার কুনু কেইছ নাই । বাবুল মিয়া হাতের ডাণ্ডা মুছতে মুছতে বিশেষজ্ঞের মন্তব্য করে ।

   এইসব ভগবান ফেরেস্তাদের পাশাপাশি গাদাগাদি হয়ে গরুর গাড়িতে ছোট ব্যবসায়ীদেরও পসরা আসে। বাজার সাজিয়ে বসলে শুরু হয় প্রতিযোগিতা । বাকি সময় তো ‘চল থি থি’র তালে সারে সারে দল বেঁধে চলা । মঙ্গলচণ্ডীপুরের আশে পাশে লালা, কৃষ্ণপুর , কয়া, কাটলিছড়া , নতুনবাজার ,মণিপুর, রাজ্যেশ্বরপুর , ঝাঁপিরবন্দ , গাগলা-ছড়ার হাট ছন্তরেই বেপারিদের সব বেসাতি , শীত গরম বর্ষায় তেরপাল বাঁধা হয়ে রাতের পর রাত এক বাজার থেকে অন্য বাজারে ঘুরেই চলেছে ।

    ‘হের থি থি’র শব্দে নতুন গাড়ির সারি এসে থামে আজান ডাকের ভোরে । দোকান দখল আর সাজানোর হুড়োহুড়ি লেগে যায় । তখন আর সারা রাতের আত্মীয় স্রীদামদাকে দাদা মনে হয় না, এক খেলার শত্রুতায় মেতে যায় সবাই ।

     গরুগুলিও চরে খেতে যায় । দল চেনে তারাও । বেড়া ভেঙে ক্ষেতে ঢুকলেও দল বেঁধে ঢুকবে । খোয়াড়ওয়ালা রামচন্দ্র সাউ সব কটাকে চেনে । ধরে না, বন্দোবস্ত আছে বলে ।

 --- আমরারও আছে স্যার। বন্দোবস্ত ।

     উর্দিপরা কনস্টেবল বাবুল মিয়ার সরলতায় উদ্বিগ্ন এ এস আই চক্রধর হাতের লাঠি জিপের বডিতে টং টং করে । বলে,

--- ওবা ইন্তাজ , চলো বাজার ঘুরিয়া আই , বাবুল চল রে বা । নন্দী সাবে গাড়িত থাকি খেয়াল রাখইন ।

    তিন পুলিশ বাজারের দিকে যায় । বাবুল যাওয়ার আগে বলে যায়,

   --- বুঝইন  অউত্ত তো স্যার। আমরার এরিয়াত পড়ে ।

  ড্রাইভার এন্তাজ আলি, এএসআই চক্রধর দাশ আর বাবুল মিয়া , এই পুলিশের টিম । ব্যাঙ্ক ম্যানেজার মহাজন নন্দী এদের বুঝবার চেষ্টা করে । সেই ভোর আটটায় স্টার্ট দিয়েছে , কৃষ্ণপুর, কয়া, নতুনবাজার , আয়নারখাল ঘুরে ধুলো উড়িয়ে সকাল দশটায় করমুজি বাজারে এসেছে । সারা রাস্তা কনস্টেবল বাবুল মিয়া একটানা কথা বলে গেছে তার মতো । মহাজন নন্দী ও নিজের মতো সাজিয়েছে এই হাট আর হাট নিয়ে সব বৃত্তান্ত ।

       সরল কনস্টেবল ভেবেছে নতুন ম্যানেজার শহুরে মানুষ, গ্রাম চেনে না , জানানো গেল । মহাজন দশ বছর আগে এই তল্লাটে ,একই শাখায় , ভিন্ন পদে কাজ করে গেছে । সব কিছুই তার বড় চেনা , তবু বার বার নতুন লাগে। সব নতুন, দৃশ্যে আকারে ঘ্রাণে ।

       এএসআই চক্রধর কী তাকে গাড়ির জিম্মায় রেখে গেল। ধুর! পুলিশের গাড়ির আবার  কিসের তত্বাবধান ।

      মহাজন গাড়ি ছেড়ে আয়নাখাল বাগানের দিকে যায় । ফ্যাক্টরির গেট থেকে বাজার শুরু। আঁটি বাঁধা লাইশাক, ধনিয়াপাতা , আলুপাতা, পালইশাক, হেলাইঞ্চার আঁটি , ভাগা করে ঠুনমানকুনির সঙ্গে চার টাকা হালির আদাজামির কয়েকটা নিয়ে বাগানের কিশোরী তার লাজুক পশরায় এক দামের গোঁ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর । ক্রেতারাও দরদাম না করে কিনবে না বলে ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে।                                      

       পাশেই কৃষ্ণপুরের বিখ্যাত ফুলকপির ঢেরি হুড়োহুড়িতে উধাও হয়ে যাচ্ছে। জানুয়ারির প্রথম রবিবার , উত্তরায়ণের বাকি কদিন । লালমূলো একটু কুলীন , সাদামূলো মুখ দেখিয়েছে । মেড়ামেড়ির পর একমাত্র সাদাই চলবে ফুরিয়ে যাওয়ার আগের কটা দিন ।

       আলু পেঁয়াজ ছাড়িয়ে চালের বাজারে নতুন বৈচিত্র , বিরইন চাল কেনে শহুরেরা । হাকরাইতের জন্য বেছে বেছে চুঙাও কেনা হয় এখান থেকে । যত কচি তত গন্ধ । সেদ্ধ ভাত খাওয়ার জন্য ভাজা সর্ষের তেল কেনে হুঙ্গিয়া হুঙ্গিয়া।

       ভার, টুকরি ভর্তি করে কমলা রঙের গুয়া আসছে , যা ঘা আর ভি র হিসেবে বিক্রি হচ্ছে আর মস্ত মস্ত বস্তায় ঢুকছে ।

      মশলাপাতিতে এক টাকার সর্ষের তেল , চার আনার লবণ , দশ পয়সার গোটা হলুদের খদ্দেরই বেশি ।

      লইটকা, টেংরা , কেচকি আর ইচার শুটকির সঙ্গে হাঁড়িতে সিদল নিয়ে পাশাপাশি কয়েকজন দোকানি হাঁকছে, বাংলাদেশি হিদল বাবু ।

       সিদল শুটকির দোকানের একপাশে মুড়ির লাড্ডু , চিড়ার লাড্ডু , গুড়, চিটা , তামাকের দোকান । তামাকের গন্ধ অনেক দূর পর্যন্ত যায় ।

       পিতলের ডাবা , কাঠের ও রাবারের নলে একটি ফারসি হুক্কা ছিল দাদুর, বাবাও খেয়েছে কিছুদিন, এখন কেউ খায় না । মাঝে মাঝে মহাজন রবারের নল টায় গন্ধ শোঁকে, শৈশবকে ডাকে। শৈশব জবাব দেয় ‘ গুড় গুড় গুড়র’ ।

       খাম্বিরা তামাকের অহংকারী গন্ধ মহাজনকে আবিষ্ট করে রাখে অনেকক্ষণ। এত বেশি কেজো হয়ে গেছে জীবন , মহাজন অবাক হয় , ভাবে এক বছর হল পোস্টিং পেয়েছে , কোথাও বেরোয় নি । কত পরিচিত এলাকা তার ।

       ছোটবেলায় আয়নারখাল বাগানে এসে থেকেছে । ভুলু মামার বাড়ি গেছে ভিসিংসায় । বড় মামার বাইণ্ডার ছিল ভুলু মামা , ভুলু মিয়া । সে সব তো বড় হয়ে জেনেছে । সে জানত ভুলুমামা বড়মামারই এক ভাই। জানত না ভুলু মামাকে কেন কলাই করা থালায় আর এনামেল গ্লাসে একা একা ভাত খেতে দেওয়া হয় । ওর বাসন ওকেই ধুয়ে রাখতে হয় ।

      হাইলাকান্দির শৈশব ভিসিংসায় বেড়াতে যাওয়ার মতো , বিশ্বনাথ টকিজে নীলাচলে মহাপ্রভু দেখা , ধলেশ্বরী নামের স্বল্পতোয়া নদীটিকে শুধু নামের গুণে ভাল লাগা, আর ছোটমামার পাঠশালা , কখনও দেখে নি তবুও নিশ্চিন্তপুর পাঠশালাটি বড় প্রিয় ছিল তার ।

        হার্বাটগঞ্জ বাজার । বিকেলের বাজার দেখা শুরু হয় পুলের রেলিং এ উঠে, বাজারময় সাদা মাথার মেলা । তকি মাথায় মুসলমান হাটুরের সংখ্যাই বেশি ছিল তখন । মাছ মাংস ওজন করে কিনত না কেউ । ছোট মাছের ভাগা আর বড় বলতে তো রুই কাতলার পেটি আর গজের চাকা । ছিল তুষের উপর বসানো সাদা সাদা বড় হাঁসের ডিম আর ছোট মেটে রঙের মুরগির ডিম , দেশিই সব । হিন্দুবাড়িতে তখন সরাসরি মুরগি বা মুরগির ডিম কেনার রেওয়াজ ছিল না । উঠনের লুকনো কোণে ভুলুমামার তদারকি আর বাসন বর্তনের যোগানে বড় মামা রান্না করতেন, মুরগির ঝোল আর কলাপাতায় ভাত । সে এক মোচ্ছব হতো ।

  --- স্যার, ছাওয়াত গিয়া বইন , আমরা অখনঅউ আইয়ার, সাইকেল দেখলেউ স্যার... ।

    বাকিটা ইশারায় বুঝিয়ে দেয় । শুধু এই কথাটি বলার জন্য বাবুল মিয়ার উদয় ও অন্তর্ধান ।

    মহাজন ছায়া খোঁজে । জিপটার কাছাকাছি ফিরে এসেছে আবার । সামনেই নেপাল মাস্টরের চায়ের দোকান। বাঁশের নড়বড়ে বেঞ্চি দুটো দোকানের দুপাশে । মহাজন তারই একটিতে বসে ফাৎনায় মনোনিবেশ করে , হারানো সাইকেল খোঁজে ।

     পুলিশও খুব মজা করছে সেই সকাল থেকে । এন্তাজ আলি যে এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে দেবে ভাবতে পারে নি মহাজন । কাণ্ড তো কী একটা সাইকেল চুরির তদন্তে গোটা মহকুমা তোলপাড় করে তুলে এক বেলায় ।

--- ওই বেটার সাইকেল দেখইন স্যার ।

       নেপাল মাস্টর বলে। নেপাল মাস্টর চা-ওয়ালাও জেনে গেছে তার সাইকেল হারানোর গল্প । চায়ের কাপ হাতে মহাজন সাইকেল আরোহীকে দেখে । তার নয়, এক মণিপুরি হাটুরের নিজের বাহন । উৎসুক নেপাল হোটেলওয়ালাকে হতাশ করে মহাজন ।

    সাইকেলের কথা আর ভাবতে চাইছে না মহাজন, আলাদা জাতের এই বাজারটা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে ।

   --- আইচ্ছা মাস্টর ইখানো মাছর বাজার বয় না ।

  মহাজনের কথার জবাবে মাথা নাড়ে নেপাল । তারপর ভুড়ুৎ করে নাক ঝেড়ে লুঙিতে মুখ মুছে নেপাল জ্ঞননিষ্ঠের মতো জানায় ,

   --- না স্যার, মাছ ইখানো কে কিনত , সব তো বাগানর কুলি আর গাউর লেংটা লুংটা মানুষ । অই ডালাত করি ইচা পুটি মকার ভাগা লইয়া বই রইছে দুই একজন । বাজার তো হইল হউ , আপনারা যার টানে আইন ।

    --- মুরগি নি।

    --- না স্যার, ই বাজারর জাত অউ আলাদা । ই বাজারর জাত অইল তার পাঠা আর ছাগল । যাইন না ,দেখিয়া আইন । দেখলেউ কিনার হাউস অইব ।

     যাবে বলে এগোয় । ইতিমধ্যে একটা লোক মরা মুরগি একটা, কেজি দেড়একের হবে , নেপালের রান্না ঘরের সন্তর্পণে রেখে দেয় । একটা লেনদেনও হয় । মহাজন দেখে হোটেলওয়ালা লোকটাকে একটা পাঁচ টাকার নোট দেয় ।

    গ্রাম দরিদ্রের সব স্নেহের পুত্তলি, ছাগশিশুতে ছেয়ে আছে বাজারের বড় অংশ । সাদা, কালো আর পিংলা রঙের মুখ্যত । একজনকে চিনতে পারে মহাজন, ধনু মিয়া, আরটিও লোনি । ট্রাক নিয়েছে ছমাস হলো , শোধ দেয়নি একটি কিস্তিও । কুচিলা থেকে এসেছে বোনের বিয়ের পাঁঠা ছাগল কিনতে । .

    --- ইখানো খুব সস্তা স্যার , কিনঅইন না একটা ।

    --- কিনতাম তো বা, তে নিমু কেমনে ?

   --- আপনার তো পুলিশর গাড়ি অউ আছে । তারা না নিলে আমি পউছাই দিয়া আইমু নে । মকবুলদা, স্যারর লাগি একটা কচি দেখি দেও । জান নি

তাইন কে ।

 --- ওবা ধনু ।

--- না স্যারে, ইতা ঠগ হাবুগুলি । একটু ডর দেখানি লাগে । একটু কম নিব । এমনেউ দাম বেশি নায় , আশি টেকার উপরে দিবা না । মাছও খুব দাম আইজ কাইল । জানইন নি স্যার , ই বাজারর নাম আমার এক বুজুর্গর নামে । ঠাকুরদার দাদু, করমুজ মিয়া ।

    ধান্দাবাজ ছেলেটির হাত থেকে ছাড়া পেতেই উল্টো দিকের গাছতলার একটি কালো নধর বাচ্চা পাঁঠা নেড়ে চেড়ে দেখে মহাজন । তখনই , তার ঘাড়ের উপর শ্বাস ফেলে এক ধূসর জিনস প্যান্ট জ্যাকেট পরিহিত সুপুরুষ । যার মুখশ্রীর খুঁত তার সামনের পাটির দুটো দাঁতে ফাঁকা জমি । মুচকি হাসিতে নিজের পরিচয় দেয় রোদ চশমা হাতের মানুষটি ।

    --- মিস্টার এফ এ বড়ভূইঞা , এএসইবির এসডিও, এলিয়াস ফকির আহমেদ ওরফে রুপাই মিয়া আর্টিস্ট । আর আপনে, মানে তুই । তুই একটা কালা পাঠা ।

       অবাক আনন্দের অভিব্যক্তি মহাজনের । বন্ধুকে দেখে । বন্ধু বলে,

 --- তুইন বেটা মাজন , করমুজিত তর কিতা কারবার ।

      রুপাই জানে না মহাজন আবার বদলি হয়ে মঙ্গলচণ্ডীপুর চলে এসেছে । এরকম তো হয় না একই জায়গায় দুই টার্মে খুব কম বদলি হয় । মহাজন জানায় সব বৃত্তান্ত বন্ধুকে । এক বন্ধুর হাতে কাঁঠাল পাতার কিতা আর আর একজনের হাতে ছাগল বাচ্চার গলায় বাঁধা দড়ি ।

     ধনুমিয়া মহাজনের হাত থেকে কৃষ্ণবর্ণ ছাগ শিশুটিকে উদ্ধার করে । বলে,

    --- স্যার বাড়ি পৌছাই দিয়া আইয়ার ।

 --- আরে কিতা মাতো বা । দরদাম করলাম না , কিনলাম না , বাড়িত দিয়া আইতায় কিতা ! আর তুমি যাইবায় একদিকে আমি যাইমু উল্টা ।

    মহাজনকে আশ্বস্ত করে অবিশ্বস্ত আরটিও লোনি ছোকরা জানায় ,

   --- ইতা ভাবইন না যে স্যার , আপনার গাড়ি তো রইছে আমার কাছে ।

   মহাজন বুঝে অকৃতজ্ঞ ব্যাঙ্কঋণী তার বন্ধকের গাড়ি স্যারের উপকারে লাগাতে চায় । তাই বলে,

   --- হি নায় অইব , দাম ফুরাও ।

  --- ইতা অই যাইব স্যার, একলগে অতটাইন কিনিয়ার ।

  --- কেনে আমারটা মাগনা নি ।

   মহাজনকে বিরক্ত হতে দেখে ফকির আহমেদ ইঞ্জিনিয়ার পাশ থেকে বন্ধুকে সমঝোতার শর্ত দেয় বলে,

 --- পছন্দ অইলে কিনিলা , পৌছানির প্রবলেম অইত নায়, অনুকূল তরে পৌছাই দিয়া আইব নে পাঠার লগে ।

  --- অনুকূল কে বে ।

  --- আমার ড্রাইভার ।

   --- আর তুই যাইতে নায় ? তে আর পাঠা কিনলাম কেনে ।

   --- তবা তবা । তর ইতা ছেদ মারা গোস্ত খাইমু নি আমি ।

  --- আইচ্ছা অইব নে , অখন রায়ট লাগাইছ না । আইবায় তো বা বড়ো ভুইয়া ।

    মহাজন নন্দী চরাচর লুপ্ত অবস্থায় বন্ধুর মুখের দুটো দাঁতহীন গহ্বরের দিকে তাকিয়ে শুনে খাম্বিরা তামাকের ডাক । দাদুর ফারসি হুক্কার জলভর্তি ডাবায় উথাল পাথাল মন্দ্রধ্বনির ডাক শুনে ‘গুড় গুড় গুড়র’ ।

   পুলিশ, পুলিশের গাড়ি , হারানো সাইকেল , চক্রাকারে ঘুরে আসা ধুলোউড়ি পথ, মরা মুরগি, কচি পাঁঠা সবই এক অপ্রতিম প্রভায় দেবদেহে যেন লীন হয়ে যাচ্ছে । যে ছিল তার বাল্যসখা , বন্ধু থেকে ক্রমশ নিয়েছে ব্যাপ্তি । বাঙালির ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে বারো ভুইয়ার এক ভুইয়া হয়ে ।

   --- বড়ো ভুইয়া কইয়া ইয়ার্কি মারিও না , আমরার ধমনীত বারো ভুইঞার রক্ত বর রে মাজন ।

     সদঅর্থেই অনেক ফুটানি দাপদাপিয়ে বেড়ায় রুপাই । দুটো দাঁতহীন গহ্বরও তার এক সত্য গোঁয়ার্তুমির ওয়ারিশান ।

    বছর দশেক আগে , বয়স তখন দশ বছরের ছোট । তিরিশ ছোঁয়া এক বিপজ্জনক কাল । ধর্মে সইবে না এমন কাজ করতে গিয়ে, সখের চিত্রকর তার দুটো , সামনের পাটির দাঁত হারালো । কী সব ছবি ।  একটায় ,

      ঘরের মেয়ে বউ হয়ে বেঘরে যাচ্ছে , এক খাঁচা থেকে অন্য খাঁচায় পাঠানোর ট্র্যান্সফার ফী বা দালালি ফী নিচ্ছে ধর্মীয় নেতা ।

       দুই খানদানি তেল ঘিএ লুতুপুতু ভুঁড়ির মাঝখানে শীর্ণকায় নামাজির চেপ্টে যাওয়ার দলিল ।

       সোনাই শহরে এমন প্রদর্শনী শুধু রুপাই মিয়াই করতে পারে দাঁত খোয়ানোর জন্য । ছুটির দিনে মহাজন নন্দীকে পাঁঠা কেনায় উৎসাহিত করে রুপাই মিয়া ওরফে ফকির আহমেদ বড় ভুইঞা , তার ডাকাবুকো বাল্যবন্ধু বলে , সরকারি আলো নিগমে চাকরি করে । বলে, অন্ধকার মেরে আলোর উৎস রক্ষা করাই কাজ । বলে, আঁধার মহিষকে কটাতে গিয়ে নিজেও কাটা পড়তে পারি কোনদিন, তো ক্যা । মহাজন বন্ধুর এসব গোঁয়ার্তুমির কথায় ভয় পায় । বন্ধুর জন্য গর্বও হয় আবার ভয়ও হয় । তাই ঘোর লাগা বোকা বন্ধু বেমুতালিক একটা প্রশ্ন করে বসে ,

 --- আইচ্ছা বেটা, অইছে । অখন দাত দুইটা বান্দাইলা । বান্দাইতে না নি ।

মহাজন জানে দাঁত না বাঁধানোতেই রুপাই মিয়ার বরফুটানি ।

অগূঢ় কথাটা বলে ফেলে স্বভূমে ফিরে আসে মহাজন । ধনুমিয়াকে উপেক্ষা করে সরাসরি পাঁঠার মালিককে বলে,

--- কতত দিবায় কইলাও । কালা বাইচ্চা ইটা । একশ , এক কতা, দিলাও ।  

পাঁঠার মালিকানা নিয়ে বন্ধুর দিকে ফেরে , বলে,

--- দেখ ফকির , তোর লাগি ধনী মাজন বেটার অতটাইন টেকা গেল , অখন তোর অনুকূল মহারাজ রে দিয়া গাড়িত উঠা আর চল মঙ্গলচণ্ডীপুর ।

 মহাজনের দরাদরিতে কাজ হয় না ।

  পাঁঠার দাম দিতে হয় দেড় শো টাকাই ।

 কথা ঠিক হয় অনুকূল ও তার প্রভু বিকেলের আগেই মঙ্গলচণ্ডীপুর পৌঁছবে । কারণ এসডিও সাহেবের বিভাগে আলোর বিতরণ নিয়ে ভজকট সামলাতে দুপুর গড়িয়ে যাবে ।

 স্থির হয়, পাঁঠা যাবে পুলিশের গাড়িতে ।

 পুলিশ বাহিনিও মহাজনকে পাঁঠা কিনতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে । চক্রধর বলে,

--- কিনলা নি ।

 মহাজনের সম্মতি পেয়ে পাঠাওলাকে ধমকায় এএসআই । বলে,

  --- নতুন মানুষ পাইয়া খুব ঠগাইলে বেটা । পাঠা ছাগল বেচার লাইসেন আছে নি তোর, দেখা ।

লোকটি জোড় হাত করে বলে,

 --- তুলা দিছি বাবু

--- হুঁ । যা গাড়িত উঠাইয়া দিয়া আয়, বালা করি বান্দিছ । মেনেজার বাবু চলঅইন ।

 --- যাইন , আইয়ার , বন্ধুরে তো নিমন্ত্রণ করলাম , বাড়ির ঠিকানা তো দেওন লাগব ।

এতক্ষণের রসিক মানুষটি পুলিশ দেখে রসের ধারায় ঘন হয়, হয় তির্যক । বলে,

 --- তুই যা, আমি বার করি লাইমু । ছোট শহরো দারোগারে চিনে চুরে আর ড্রাইভারে । কিন্তু হক্কলে চিনে পোস্টমাস্টর, ষ্টেশনমাস্টর আর হেড মাস্টর রে , ব্যাঙ্ক মাস্টররে ও চিনে ।

  --- না রে বা আমার খুব লো প্রফাইল । এক বছরর তো ডেরাডাণ্ডা । আগে আছলাম মেছো । অখন সংসারী মাইনষর কোয়ার্টার অইছে ।

   ---লো না হাই তো দেখিয়ার । পুলিশ লইয়া ঘুররে এক পাশশ টেকার সাইকেলর লাগি।

   --- ব্যাঙ্কর সাইকেল বেটা ।

  --- বুঝছি , অখন দেখবে নে চোররে তো ধরত নায়, খামকা কুনু নিরপরাধরে ধরব । দেখিছ ছাইকেল পাইতে নায় ।

  --- ইতা বাদ দে পাইলে পাইলাম নাইলে না । রেকর্ড রইল পুলিশর লগে তো ঘুরলাম । অখন ক কেমনে আইবে আমার বাড়িত ।

  --- চিনি নি কুনু , বার করিলাইমু ।

--- পারতে নায়, তিন রকমের পথ আছে ।

 --- ক, এক নম্বর ।

--- চন্দ্রপুর দিয়া ঢুকি যাইছ । মসজিদর ধারে দি রাস্তা ।

--- দুই নম্বর।

--- ষ্টেশন পার অইয়া , মাধব মন্দিরের সামনে ব্যাঙ্ক , কাচা রাস্তা পার অই যাওন লাগব । পার্কিং পাইবে ব্যাঙ্কর সামনে ।

--- তিন।

--- ই এক আতান্তরি পথ । পটাপট যাওয়া যায় । লেভেল ক্রুশিং দিয়া দুই মিনিটর হাটাপথ । কলেজ পার অইলেউ কবরখানা কালীবাড়ি । দুই কমিটিয়ে মারামারি , তুই ভুলেও যাইছ না । তুই গেলউ রায়ট লাগাই দিবে ।

 --- তে তো যাইমু ।

রুপাই মিয়া একদিকে , পুলিশের গাড়ি আমলার দিকে ধূলো উড়িয়ে বাজার ছাড়ে।

পাঁঠা চেঁচায় বাবুল মিয়া বলে,

--- বেশি না স্যার , তিন কেজির বেশি অইত নায় গোস্ত । দাম কমউ নিছে দেড়শো নানি । চক্রধর বলে,

 --- ইঞ্জিনিয়ার আপনার বন্ধু ।

--- অয় দেখলা তো । আপনারেও চিনঅইন ।

--- চিনন লাগে । রুপাই মিয়া ই জিলার বড় বিপজ্জনক ব্যক্তিত্ব , কনটিনজেণ্ট লায়বেলিটি  । আসামি নায়, আবার যে কুনু সময় ... আপনার বাল্য বন্ধু তো, কইন না কেনে ?

--- কিতা কইতাম ।

--- ইন্তাজ,  একটু  আস্তে যাও চাইন বা ।

  আমালার পুলের কাছে এসে চক্রধর গাড়ি থামাতে বলে। কয়েকটা সাইকেল জড়ো করা এক জায়গায় ।

 --- দেখি লাইন, এর মাঝে আসে নি আপনার । আমরা একটু আই গিয়া , ইনকাম আছে ।

    বাবুল মিয়া যাওয়ার আগে মহাজনকে জানিয়ে যায় বার্তা । ভিডিও শো হচ্ছে ভেতরে, বাইরে সাইকেল রেখে গেছে। কাঁচা ঘরটায় যেখানে শো হচ্ছে ঢুকে যায় তিনজনে ।

    গোটা পনের সাইকেল , একটা একটা করে দেখে মহাজন, আর পুলিশ বাহিনির উপর কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হয় । কৃষ্ণপুর, নতুনবাজার, কয়া হয়ে এত ঘুরে , কাঁচা পাকা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে শুধু ব্যাঙ্ক এর এক সাইকেলের জন্য এত করল । সাইকেলটা ব্যাঙ্কের হলে কী হয় , নিয়ে তো বেরিয়েছিল মহাজন ।

    রবিবার এত ভোরে ব্যাঙ্ক এর সাইকেল নিয়ে কেন বেরুবে , ম্যানেজারের সাইকেলের কী দরকার । ওর কাছ থেকেই তো উশুল করবে ব্যাঙ্ক । করলেও, কতই বা দাম , এর জন্য পুলিশ এত করবে ।

   এন্তাজ ড্রাইভার মহাজনের উপর খুব কৃতজ্ঞ , ওর বাবার কিছু টাকা ছিল শিলচর  শাখায়, হেয়ারশিপ সার্টিফিকেটের ঝামেলায় টাকা পাচ্ছে না, মহাজন ব্যবস্থা একটা করে দিয়েছে । টাকা পেয়েও যাবে এন্তাজ ।

    বাবুল মিয়া মহাজনকে বলে,

  --- চলঅইন স্যার , ইখানো পাওয়া যাইত নায় , ইখানো দিনর বেলা অন্য

লীলা ।

--- বাবুল ।

চক্রধর  ধমকের ডাক দেয় ।

চক্রধর গম্ভীর মানুষ। বলে,

--- পাওয়া যাইত না কেনে , অত সাইকেল ইখানো, একটা উঠাই লাও বাবুল ।

--- না না । আপনারা অত করছইন ।

 --- আমরা আর কিতা, করছে ইন্তাজে । গগৈ দারোগায় কইলে কিতা অইব , এন্তাজেরে কিতা জাদু করছইন, হে গাড়ি বার না করলে অইল না নে । পুলিশ এক সাইকেলর লাগি অততা করে না ।

      ব্যাঙ্ক এর সামনে গাড়ি থামায় ইন্তাজ আলি ।

      কালা দাঁড়িয়েছিল মাধবমন্দিরের সামনে । মহাজনকে দেখে দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে আসে ওপার থেকে । বলে,

  --- সাইকেল পাওয়া গেছে আইজ্ঞা ।

      হারানো প্রাপ্তির খুশিতে কালার কণ্ঠে হাঁপ ।

     মহাজনের গলায়ও । খুশি উৎসুক হয়ে বলে,

 --- কই পাওয়া গেল বে ।

 --- আপনেউ রাখি আইছলা সুবুদদার চা-র দুকানো । আমি গিয়া আনছি ।

 --- বালা করচছ , অউ নে ।

 মহাজন কালাকে খুশির বখশিস দিতে পকেটে হাত দেয় ।

 --- কিতা কররা স্যার ।

তিনজন  পুলিশ কর্মীই একসাথে বাধা দেয় মহাজনকে । চক্রধর ছোট দারোগা বলে,

 --- ইগু কিগু কইন চাইন ।

 --- হে কালা , ব্যাঙ্কর জমাদারর পুয়া , আমার বাড়িত কাম করে ।

 --- হি তো বুঝলাম । বাবুল চিনরায় নি বা ।

এবার বাবুলের পালা । বলে,

--- অয় স্যার ইগুঅউত্ত একবার তিনদিন আছিল হাজতো । বিধুবাবুর বাড়িত চুরি করছিল ।

  নিশ্চিন্ত হয়ে চক্রধর ফরমান দেয়,

 --- উঠ উঠ , উঠাও ইগুরে ।

        অসহায় মহাজন তার ভাল পুলিশ দলকে অনুনয় করে ,

 --- দেখইন চক্রধর বাবু , হে অখন বালা অই গেছে , আমার বাড়িত থাকে তো , সব সময় দেখি , হে চুরি করছে না , ছাড়ি দেইন ।

 --- ইতারে আপনে চিনঅইন না স্যার , হাড়ে হাড়ে বদমাইশ , পুলিশরে একটু কাম করতে দেইন না ।

   পুলিশ বাহিনি হঠাৎই তৎপর হয়ে ওঠে ।

--- আমি জামিন চাইলে দিবা নি। ছেলেটা আমার লাগ... প্লিজ চক্রধর বাবু ।

  মহাজন ছোট দারোগার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে ।

 --- কইরা যখন, ঠিক আছে , একটু লাড়ি চাড়ি ছাড়ি দিমু , ভাবঅইন না যেন।

ছাড়ি দিমু একবার বাবুল আইয়া আপনার একটা সই লই যাইব ।

চক্রধরের আদালতের রায় পাল্টায় না ।

পাঁঠা নামে, কালা ওঠে ।

কোন মন্তব্য নেই: