“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ৫ জুন, ২০১৪

কেন?

(C)Image: ছবি
।।দেবলীনা সেনগুপ্ত ।।

          তখন গোধূলি।শেষ বিকেলের সূর্য আকাশে আগুন জ্বালিয়ে শরাইঘাট সেতুর ওপারে লুইতের বুকে লাল রঙ গুলে আস্তে আস্তে লুকিয়ে পড়ছিল। ভরলুমুখের লুইতপারের শঙ্করদেব উদ্যানে দাঁড়িয়ে সেদিকে নির্নিমেষ তাকিয়েছিল নীলাব্দ। শেষ অক্টোবরের  নদীতীরের সান্ধ্য হাওয়ায় শীতের শিহরণ।তা সত্ত্বেও নীলাব্দের গরম লাগছিল-এ উত্তাপ তার বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা অনন্ত শোকাগ্নির।

     -‘বর ধুনীয়া নহয়?’

    সামান্য চমকে তাকাল নীলাব্দ। এক বর্ষীয়ান শিল্পী লুইত তীরে বসে ক্যানভাসে তুলি বুলিয়ে ফুটিয়ে তুলছে অস্ত- সূর্যের আগুন।

  -‘লুইতর বুকুত বেলি মার গইছে। রঙচুয়া আকাশর মাজত রঙা বেলি যেন বিজয়া দশমীর দিনা সেন্দুর খেলি অহা কোনোবা রাঙলী তিরোতা।ইমান উজ্জ্বল আরু কোমল...’

    নীলাব্দ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।প্রকৃতির সৌন্দর্যে মন্ত্রমুগ্ধ শিল্পীকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠতে পারে না –‘না, আকাশের আগুনের মধ্যে আমি শুধু দেখতে পাই দাউদাউ প্রজ্জ্বলিত চিতা- নির্মম, নিষ্করুণ, আগ্রাসী- যা এক্ মুহূর্তে আমার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ অস্তিত্ত্বকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।’

     নির্বাক নীলাব্দ সরে যায় সেখান থেকে।শিল্পী মানুষটির শৈল্পিক চেতনে হয়ত ধরা পড়ে নীলাব্দের প্রত্যুত্তরহীন মানসিক চঞ্চলতা।এক মুহূর্ত নীলাব্দের ফেলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে নিজের রঙের আর সৃষ্টির জগতের মধ্যে মগ্ন হয়ে যান তিনি।

    ধীর পায়ে হেঁটে এসে নীলাব্দ বসে পড়ে পার্কের বেঞ্চে। লুইতের জলে অস্তরাগের আবহে ঘরে ফেরা পাখীদের কলকাকলি তার কাছে অগ্নিদহ মানুষের আর্তনাদের মত মনে হয়। মনে মনে দুহাতে কান চেপে ধরে সে। কর্ণকুহরের বধিরতা সেই মুহূর্তে তার একমাত্র অভিপ্রেত হয়ে ওঠে। অন্তর্দাহের বাষ্প ঘনীভুত হয়ে দৃষ্টিকে ঝাপসা করে তোলে কিন্তু তরল জল হয়ে গ’লে পড়তে পারে না। শুধু তীব্র জ্বলন অনুভুত হয় দুচোখে।

         প্রায় ছমাস পরে প্রবাসের ছাত্রাবাস থেকে গতকালই গুয়াহাটির বাড়ীতে এসে পৌঁছেছে সে। পিতৃ – মাতৃর চতুর্থ  বার্ষিক প্রয়াণ দিবসের শ্রাদ্ধশান্তির কর্তব্য সম্পাদন করতেই কদিনের জন্য তার বাড়ীতে আসা।শ্রাদ্ধ-পর্ব শেষ হতে হতে দ্বিপ্রহর গড়িয়ে গিয়েছিল। আত্মীয়-স্বজনেরা সন্ধ্যায়  নাম- কীর্তন প্রসঙ্গের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু নীলাব্দের তীব্র আপত্তিতে তা নাকচ হয়ে যায়। ভারাক্রান্ত হৃদয়ের অশ্রু দিয়ে তো সে যথাসাধ্য তর্পণ সম্পূর্ণ করেছে সেই হতভাগ্য জনক-জননীর, যারা তীব্র পৈশাচিক উন্মাদনার শিকার হয়ে, নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করে অকালে, অসময়ে, হৃদয়- মনের সমস্ত অপ্রাপ্তি আর অশান্তি নিয়ে, একমাত্র সন্তান কে অসহায় অনাথ অবস্থায় ফেলে রেখে ইহজগত ছেড়ে যেতে বাধ্য  হয়েছিল। কোন চিৎকৃত শব্দমুখর পরিবেশ সেই অতৃপ্ত  বিদেহী আত্মাদের শান্তি – বিধান করতে পারবে না বলেই তার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই শ্রাদ্ধবাসরে পুরোহিতের সুউচ্চ মন্ত্রোচ্চারণও তার অসহনীয় লাগছিল – অবান্তর অর্থহীন বোধ হচ্ছিল সমস্ত নীতি-প্রথা-নিয়ম। তীব্র এক হাহাকার তার বুক ফাটিয়ে গলা চিরে একটিমাত্র শব্দ নিয়ে আছড়ে পড়তে চাইছিল- কেন ? কেন ? কেন ?

     গুয়াহাটির ব্যস্ততম অঞ্চল গণেশগুড়ির বিধায়ক আবাসের পেছনে একটি ছোটো আসাম টাইপ ভাড়া বাসায় নিশ্চিন্তে কৈশোর অতিবাহিত করছিল নীলাব্দ মা বাবার সঙ্গে। বাবা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আধিকারিক। মা গৃহবধূ – হাস্য মুখী, সদাতৃপ্ত, মায়াময় । ছোটো থেকেই অন্তর্মুখী স্বভাবের নীলাব্দ ছিল মা – অন্ত প্রাণ । বাড়ী থেকে বেরোনোর সময় আর বাড়ীতে ফিরে এসে মায়ের মুখ না দেখলে সে নিতান্তই অস্থির হয়ে উঠত। রাতেও মায়ের পাশটিতে শুতে না পারলে তার নিশ্চিন্তের ঘুম হতো না ।এ নিয়ে কম হাসি বিদ্রূপ সহ্য করতে হয়নি তাকে ।কিন্তু সে নাছোড়। মা নইলে তার পড়াশোনা, সাজসজ্জা, পোশাক –আশাক কিছুই মনোমত হত না। আবার রান্না ও গৃহকর্মে সে ছিল মায়ের সহকারী ও সাথী। এসবই চার বছর আগের কথা। তার বাবা ব্যাঙ্ক থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে একটি বাড়ী তৈরি করছিলেন। নীলাব্দ তখন বারো ক্লাসের ছাত্র। পুজোর মুখে বাড়ীর কাজ প্রায় শেষ। নতুন বাড়ীর গৃহপ্রবেশ, অন্দরসজ্জা ইত্যাদি নিয়ে নিত্যনতুন জল্পনা কল্পনা ছিল তাদের তিনজনের প্রাত্যহিক জীবনের এক সুখবিলাস। নীলাব্দের বারো ক্লাসের  পরীক্ষা যেহেতু ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে অনুস্থিত হওয়ার কথা তাই তার মা চাইছিলেন ডিসেম্বরের বড়দিনের আগেই গৃহপ্রবেশের পূজাকর্ম সম্পন্ন করে ফেলতে।তাহলে পরবর্তী দুমাসে বাকী কাজ শেষ করে ছেলের পরীক্ষার পরে পরেই তারা নতুন স্বগৃহে স্থানান্তরিত হতে পারবেন। সেই মতে আলাপ আলোচনা করে ২ রা ডিসেম্বর গৃহপ্রবেশের দিন ধার্য হয়েছিল।

    উৎসবের মরশুমে সময় যেন দ্বিগুণ গতিতে দৌড়য়। দুর্গাপূজা, কালীপূজা সব শেষ। সেদিন ছিল ৩০ শে অক্টোবর। ভাইফোঁটা। নীলাব্দের একমাত্র মামা শিলচর থেকে এসে পৌঁছবেন বিকেলে,বোনের কাছে ফোঁটা নিতে। নীলাব্দের মা তাই মহাব্যস্ত। সকাল সকাল গৃহকর্ম সেরে দশটা নাগাদ তৈরি হয়ে নিলেন স্বামীর সঙ্গে বেরোনর জন্য।স্বামীর অফিস যাওয়ার পথে দুজনে গনেশগুরি থেকে দাদার জন্য ভাইফোঁটার উপহার, নতুন বাড়ীর জন্য পর্দা ও সোফার কাপড় এবং কিছু টুকিটাকি বাজার সেরে ফেলবেন,সেরকমই ইচ্ছে। নীলাব্দ ও সঙ্গ ধরতে চাইছিল।কিন্তু স্কুটারে তিনজন বসার অসুবিধে, তাছাড়া তার আসন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে মা তাকে নিরস্ত করেছিলেন। বাধ্য ছেলে নীলাব্দ মেনে নিয়েছিল মায়ের যুক্তি। ঠিকই তো , পূজোর ডামাডোলে কদিন পড়াশোনাতে ঢিলে পড়েছে।তারপর আজ তো সন্ধে থেকেই মামার সঙ্গে খোসগল্প হবে,আবার দুদিন পরেই গৃহপ্রবেশের পুজা...... না এইফাঁকে পড়োশোনা এগিয়ে রাখাই ভাল।

         মা-বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর সদর বন্ধ করে পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের জগতে তলিয়ে যায় মনোযোগী ছাত্র নীলাব্দ। ফিজিক্স,কেমিস্ট্রি,অংক,ইংরাজীর পাতায় পাতায় নিবিষ্ট হয়ে পড়ে। অকস্মাৎ এক তীব্র কান ফাটানো শব্দে আমূল কেঁপে ওঠে সে। ক্ষণিকের বিমুঢ়তা কাটিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ভয়াল শব্দটির কার্য – কারণ ও উৎসস্থল। সদর খুলে বাইরে আসে।চোখে পড়ে কিছু বিভ্রান্ত ও উদভ্রান্ত মুখ।ছুটপায়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠে সে।সেখান থেকে শুধু দেখা যায় গল্ গলিয়ে ওঠা কালো ধোঁয়া আর আগুনের হল্কা। মৃদু কোলাহল,আর্তনাদের শব্দ বুঝে উঠতে চেস্টা করে সে। সব কিছু ছাপিয়ে আচমকা বেজে ওঠে অগ্নিনির্বাপক গাড়ীর বিপদ ঘণ্টা আর পুলিশের তীক্ষ্ণ বাঁশি। আরও একবার আমূল কম্পিত হয় সে। আতঙ্ক আর আশঙ্কা তাকে ছাদ থেকে ঠেলে পাঠায় নিজের ঘরে। কাঁপা  হাতে সেলফোনের মধ্য দিয়ে পৌঁছে যেতে চায় মায়ের কাছে,বাবার কাছে, কিন্তু না... শতবারের চেষ্টাতেও সংযোগ ঘটাতে পারে না প্রিয় ও পরিচিত নম্বর দুটিতে।

        দ্রুতহাতে টেলিভিশন চালায় সে এবং তারপরেই ব্রেকিং নিউজ দেখে স্তম্ভিত বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে বিপন্ন ও অসহায় কৈশোর।তার মন জনক জননীর কাছে ছুটে যেতে চায়। পরক্ষণেই তাঁদের উদ্বিগ্ন মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে তার মানসপটে। তাঁরা যে বাড়ীতে ফিরে এসে একমাত্র সন্তানকে না দেখতে পেলে অত্যন্ত আশঙ্কিত হয়ে উঠবেন। নিজেকে ঘরের ভেতর বন্দী রাখাই স্থির করে সে এবং অতঃপর টেলিভিশনের রিমোট ও সেলফোনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে তার আঙ্গুল-জনক জননীর কুশল সংবাদের আশঙ্কায়........

    এভাবেই কেটে যায় বহু পল অনুপল। ঠিক কতক্ষণ পরে তার মনে নেই, প্রতিবেশী যুবকের সশব্দ উপস্থিতি তাকে চকিত করে তোলে। এবং তার পরেই সে পায় সেই নিদারুণ সংবাদ- গণেশগুরিতে বিস্ফোরিত বোমায় সে পিতৃহীন হয়েছে এবং তার মাকে গুরতর আহত ও আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসালয়ে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তার সমস্ত অনুভূতি যেন বোধশূন্য হয়ে যায়। মস্তিষ্কের কোষে  কোষে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে ছড়িয়ে পরে একটাই শব্দ- কেন ? কেন ? কেন ?

           একে একে নিকট  আত্মীয়জন, পরিচিত প্রতিবেশীতে ভরে ওঠে তাদের ছোটো দু-কামরার বাসাবাড়িটি। এত লোকের মাঝে থেকেও এক নিঃসঙ্গ দ্বীপের মত বোধ করে সে। তারপর যন্ত্রচালিতের মত তাকে নিজকর্তব্য করে যেতে হয়। পুলিশ-প্রশাসন-আইনের নিরাপত্তাজনিত অসংখ্য নিয়মাবলী ও নির্দেশ অনুসরণ করতে হয় তাকে, চরম নিরাপত্তাহীনতায় পুড়ে ঝলসে যাওয়া পিতৃদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের টুকরোগুলিকে ফিরে পেতে, তার সৎকার কার্য সম্পন্ন করতে। এসব শেষ করার পরেই সে সময় পায় এবং তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তার মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের কাছে। I.C.U  র ছোট্ট জানালা দিয়ে নীলাব্দ দেখতে পায় বহু যন্ত্র সংলগ্ন মায়ের নিথর দেহটি- সেখানে প্রাণের স্পন্দন আছে  কি নেই বুঝে উঠতে পারে না তার ক্লান্ত, শ্রান্ত মস্তিষ্ক। চারপাশে দু চোখ বুলিয়ে  কি যেন খোঁজে সে। হয়ত একটু  আশ্রয়, একটু আশ্বাস। পরমুহূর্তেই দুচোখে প্লাবন নামে। অশ্রু হয়ে গলে গলে পড়ে তরল আগুন, বাবার জন্যে,মায়ের জন্যে অথবা নিজের জন্যে! অনেকক্ষণ কান্নার পর যখন সে বুঝতে পারে কোনো প্রিয় পরিচিত কোমল স্নেহস্পর্শ তার কান্না মোছাতে এগিয়ে আসবে না, নিজে নিজেই মুছে নেয় গালের ওপর গড়িয়ে আসা অশ্রুজল।আত্মীয়েরা তাকে জানায়,উন্নতমানের চিকিৎসার জন্য তার মাকে দিল্লী নিয়ে যাওয়া হবে এবং সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে  তার মনে হয় আজ রাতে তাকে শূন্য শয্যায় মাকে ছাড়া একাই শুতে হবে।

          পরদিন এম্বুলেন্সে বসে বিমানবন্দর পর্যন্ত মায়ের সঙ্গী হয় নীলাব্দ।এরমধ্যে একটিবার মায়ের জ্ঞান ফিরে এসেছিল এবং আকুল চোখে তাকিয়েছিলেন নীলাব্দের দিকে। ঠোঁটও কেঁপেছিল কিন্তু শব্দ ফোটেনি। মাকে নিয়ে বিমান আকাশে ভাসার পর তার মনে হল মা ফিরে এলে জেনে নিতে হবে না-বলা-কথা কটি।

          চতুর্থদিনে পিতৃশ্রাদ্ধের আসনে বসে যখন নীলাব্দ হাতের আঙুলে কুশের আংটি পরছে, তক্ষুনি সেলফোনের বার্তাবহ তরঙ্গ তার জন্য নিয়ে এল দুর্ভাগ্যের চরমতম অভিঘাতটি- মাতৃহারা হয়ে এ জন্মের মত অনাথ হয়ে গেছে সে।সংজ্ঞা হারিয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়বার আগে অস্ফুট উচ্চারণে তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে একটাই শব্দ- কেন ?

            চোখের কোণের জমাট অশ্রু জামার হাতায় মুছে নেয় নীলাব্দ। একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অন্তরের মর্মমূল থেকে। ‘আসলে আমরা প্রত্যেকেই শুধু নিজেকেই ভালবাসি,’ ভাবে নীলাব্দ... ‘ আর নিজের প্রতি সেই ভালবাসাকে সুরক্ষিত রাখতেই আমরা আরও কিছু সম্পর্ক, আরও কিছু ভালবাসা গড়ে তুলি’।
 
(C)Image:ছবি

           নয়ত যে মা-বাবা বিহীন  অস্তিত্ব তার সুদূর কষ্টকল্পনাতেও ছিল না, তাঁদের বিহনে  চার-চারটি বছর তো সে আপাতঃ স্বাভাবিক ভাবেই কাটিয়ে দিল। আজ বিকেলের দিকে নিজের অজান্তেই গণেশগুরির সেই বিস্ফোরণ স্থলটিতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল নীলাব্দ। গুয়াহাটীতে এলেই এই ঘাতক জায়গাটি তাকে যেন এক অমোঘ আকর্ষণে টানতে থাকে। আজ সেখানে হাজির হওয়ার পরই এক তীব্র কশাঘাতে নির্বাক হয়ে যায় সে। সেখানে তখন পালিত হচ্ছিল বিস্ফোরণে নিহত ব্যক্তিদের  জন্য ‘শোকসভা’। কিছু গুরুগম্ভীর বক্তৃতা , কিছু ভজন-নাম-কীর্তন,তার মাঝেই নিহতদের পরিবারবর্গের উচ্চকিত ক্রন্দন, দূরদর্শনের পর্দায় শোকপ্রকাশের সরাসরি সম্প্রচারণ, উচ্চমানের ক্যামেরা লেন্সে পিতৃহীন বা পতিহীনের চোখের জলের ব্যতিক্রমী ছবি...তাকে বিস্ময়বিমূঢ় করে দেয়।তীব্র ঘৃণাময় এক বিবমিষা উঠে আসে তার পাকস্থলীর ভিতর থেকে ,সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে দিয়ে।উচ্চ শব্দে বমন করে সে। হঠাৎ করে বোধ হয় বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার মত অক্সিজেনের অভাব।সেখান থেকে পালাতে চায় সে। নিজের অজান্তেই বাসে উঠে পড়ে এবং বাসটি ভরলুমুখে এসে পৌঁছালে নেমে পড়ে নীলাব্দ। প্রবেশ করে নদীতীর সংলগ্ন উদ্যানটিতে, যেখানে বহুদিন বহু উজ্জ্বল সন্ধ্যা কাটিয়েছে সে মা-বাবার সঙ্গে....।

         ‘হেলো ইয়াংম্যান,তুমি নোযোয়া নেকি? এন্ধার হৈ গ’ল....’

            নীলাব্দ দেখে সেই শিল্পী তার পাশে দাঁড়িয়ে- একহাতে রঙের প্যালেট, অন্যহাতে ব্রহ্মপুত্রের বুকে সূর্যাস্তের সদ্যসমাপ্ত ছবি। মুহূর্তের মধ্যে নীলাব্দের মাথায় যেন আগুন জ্বলে যায়। রঙের প্যালেটের কালো রঙে আঙ্গুল ডুবিয়ে ছবিটির ওপরে এঁকে দেয় একটি বীভৎস কালো প্রশ্নচিহ্ণ। তারপর ছুটে বেরিয়ে যায় পার্ক থেকে।

        বর্ষীয়ান মানুষটি ক্ষণকালের জন্য হতবাক হয়ে যান। তারপর মৃদু হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের ফাঁকে।

    ‘ইয়েস ইয়াংম্যান, ইউ আর রাইট। মই মাত্র কল্পনার রঙ হে আঁকিছিলোঁ। তুমি তার ওপর ত বাস্তবর ক’লা প্রশ্ন আঁকি মোর সৃষ্টিক অমূল্য করি দিলা...থ্যাঙ্ক ইউ ওয়ান্স আগেইন’।

 ধোঁয়াটে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে লুইতের বুকে তখন নেমে এসেছে জমাট কালো অন্ধকার, তার অমোঘ নিরুত্তর প্রশ্ন নিয়ে... ‘ বুঢ়া লুইত তুমি, বুঢ়া লুইত বোয়া কিয়?’ 

কোন মন্তব্য নেই: