“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ৯ জুন, ২০১৪

অস্তরাগ

 ।।দেবলীনা সেনগুপ্ত ।।


হেমন্তের বাতাসে কেমন যেন এক বিষণ্ণতা  ছড়িয়ে থাকে। প্রকৃতির ধূসর বাদামীতে মন-কেমন-করা ভাব।পর্ণমোচী বৃক্ষেরা পাতা ঝরিয়ে আকাশপানে শূন্যশাখা বাড়িয়ে আকুল প্রার্থনায় মগ্ন। বিকেল ছোটো হয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে হঠাৎ । নীড়ছাড়া পাখীদের দলে তাড়া লেগে যায় নীড়ে ফেরার। শহর উপান্তের এক সম্ভ্রান্ত আবাসনের বারোশো বর্গফুটের ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলার ঝুলবারান্দায় হেমন্ত –বিকেলের বিষাদ – ছোঁয়া মন নিয়ে বসেছিলেন সুপ্রতীক-সুপ্রতীক সেন। এককালের পদস্থ কর্মচারী। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত।

     আজ ভুত-চতুর্দশী।দীপাণ্বিতা বা দীপাবলী। আজকের যুগের ভাষায় ‘দেওয়ালী’। অবশ্য খতিয়ে দেখলে শব্দদুটিতে কোনো অর্থগত বিভেদ বা প্রভেদ নেই। কিন্তু সুপ্রতীকের মনে হয়,‘দীপাবলী’ শব্দটি উজ্জ্বল হলেও সকরুণ কোমল। মৃণ্ময় আকাশপ্রদীপে জ্বলা দীপাবলীর আলোয় থাকে শূন্য থেকে পূর্ণতায় উত্তরণের আভাস। অন্যদিকে ‘দেওয়ালী’ যেন শুধুই কৃত্রিম বৈদ্যুতিক আলোয় ভাসানো শ্রবণ-বিধুর শব্দদূষণের হুজুগ;যেখানে বৈভবের উচ্ছ্বাস আছে,কিন্তু অন্তরের নিবেদন নেই।অবশ্য এইসব ভাবনার হয়তো কোন যুক্তিগ্রাহ্য প্রেক্ষাপট খুঁজে পাওয়া যাবে না। হয়তো বা বয়সের প্রাচীনতাই তার মনে এইসব উদ্ভট ভাবনার উদ্রেক করে।

     তাদের আবাসনটিও আজ আলোকমালায় উজ্জ্বল। ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে চলছে নানারকম আলোকসজ্জার কারিকুরি। বাইরে থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তার নিজস্ব ঘরটিতে ফিরে তাকালেন সুপ্রতীক। দেওয়ালে ফোটোফ্রেমে মৃদু হাসিমাখা দীপাবলীর চোখ তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে।‘এ দীপাবলী শুধু আমারই’,ভাবেন সুপ্রতীক।স্ত্রীর ছবির সামনে আজ নিজে হাতেই একটি সুন্দর মাটির প্রদীপ জ্বালিয়েছেন সুপ্রতীক। ঠিক যেমনটি পছন্দ করতেন দীপাবলী।মাটির প্রদীপের স্নিগ্ধ আলোকশিখায় দীপাবলীর মুখ আরও মায়াময়, চোখে নিবিড় রহস্যের ইশারা। বড় আশ্চর্য্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন দীপাবলী । প্রায় চল্লিশ বছরের যুগ্ম জীবন-যাপনের পরও স্ত্রীকে যেন ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেন নি সুপ্রতীক। সুপ্রতীকের আদর্শ স্ত্রীর ভুমিকাটি দীপাবলী আজীবন নিখুঁত ভাবেই পালন করেছেন , কোথাও কোন ফাঁকি  ধরতে  পারেন নি সুপ্রতীক। কিন্ত কখনও কখনও দীপাবলীর বহুমুখী ব্যক্তিত্ব তার বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ত –সুপ্রতীক তার নাগাল পেতেন না। কখনও নিজেকে অসহায় মনে হত,কখনও খুব ছোট মনে হত আবার কখনও ভাঙ্গন ধরত হৃদয়ের গহনে। কিন্তু প্রতিবার প্রতিটি ঘটনার শেষেই যে সারসত্য সুপ্রতীক অন্তরে অন্তরে উপলব্ধি করতে পারতেন তা হল ,দীপাবলীই তার শেষ আশ্রয়, অন্ততঃ মানসিক ভাবে।

          প্রায় পাঁচ বছর হল দীপাবলী চলে গেছেন । অথচ এখনও প্রতিদিন তিনি নতুন করে স্ত্রীকে আবিষ্কার করে চলেছেন, স্ত্রীর দৈহিক অনুপস্থিতি তাকে যতটা দুঃখ দেয় , মানসিক সান্নিধ্য ততটাই নিবিড় হয়ে চলেছে দিন প্রতিদিন । দীপাবলীর ছবির সামনে প্রতিরাত্রে তিনি উজাড় করে দেন প্রতিটি বিষাদ,প্রতিটি যন্ত্রণা,প্রতিটি অপমান-আর ছবির দীপাবলী চোখের মৃদু হাসিতে ছড়িয়ে দেন শান্তির পরশ এখনও- অবিরত-অবিরাম। এও তো এক দাম্পত্য-ভাবেন সুপ্রতীক।

          অত্যন্ত সন্মানের সঙ্গে কর্মজীবন অতিক্রম করেছেন সুপ্রতীক। দীপাবলীও দায়িত্বশীল পদে কর্মরতা ছিলেন। কিন্তু গার্হস্থ্য ধর্ম পালনে ত্রুটি রাখেন নি। একমাত্র ছেলেকে সুযোগ্য বানিয়েছেন। দুজনের চাকরি জীবনের মিলিত পূঁজির অনেটাই খরচ করেছেন শহর প্রান্তের অভিজাত এলাকায় এই বাসগৃহটি কিনতে। ছেলের বিয়েও দিয়েছেন আন্তরিক আগ্রহে । চেনা-পরিচিত,আত্মীয়স্বজন,বন্ধুবান্ধব সবাইকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন ছেলের বিবাহোৎসবে , তার আর্থিক ব্যয়ও নিতান্ত কম ছিলনা । তা নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র চিন্তিত ছিলেন না। ছেলের বিয়ে উপলক্ষে দীপাবলীও আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিলেন । কখনও ছোট্ট মেয়ের মত সারা বাড়ী খুশি-পায়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন , আবার কখনও দশভূজা হয়ে কর্মকান্ডের তদারকি করছেন। আর সুপ্রতীকও সমস্ত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও স্ত্রীর এই নতুন উচ্ছ্বসিত উদ্ভাসিত রূপটি আড়চোখে দেখে নিজের বিয়ের দিনটিতে ফিরে ফিরে যাচ্ছিলেন।

          এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।পুত্রবধূকেও তারা কন্যাস্নেহেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মালিনী নাম্নী উচ্চশিক্ষিতা রুচিশীলা মেয়েটির মধ্যে সব থাকা সত্বেও সারল্যের অভাব ছিল।তার মনের মধ্যে থাকা সূক্ষ্ম অধিকার বোধ ক্রমশঃ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে গ্রাস করতে চাইছিল পরিবারের অন্য তিনটি সদস্যের জীবন। সুপ্রতীক অবশ্য প্রথমে তেমন বোঝেন নি। হয়তো দীপাবলীই তাকে এ সব সমস্যার থেকে আড়ালে রেখেছিলেন। কিন্তু তারপর সেই যে অফিসে একদিন ফোন বেজে উঠলো,তিনি দৌড়ে এলেন বাড়িতে, অচৈতন্য দীপাবলীকে নিয়ে ছুটলেন নার্সিং হোমে,আর তারপর শুনলেন ডাক্তারের সেই নিদারুণ নিদান-মস্তিষ্কের ভয়াবহ বিফলতায় বিপন্ন হয়েছে দীপাবলীর অসম্ভব প্রাণশক্তি সম্পন্ন  রক্তপ্রবাহ, বাকী জীবনটুকু পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেহটি নিয়েই কাটাতে হবে।

          নার্সিং হোম থেকে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ীতে ফেরার পর প্রথম সাংসারিক যুদ্ধটি লড়তে হয়েছিল সুপ্রতীককে।তিন শয্যাকক্ষ বিশিষ্ট ফ্ল্যাট বাড়ির পূর্ব-দক্ষিণ খোলা , ঝুলবারান্দাসহ ঘরটি প্রথম থেকেই তাদের স্বামী-স্ত্রীর জন্য বরাদ্দ ছিল।এবং সুপ্রতীক জানতেন এ ঘরটি দীপাবলীর বিশেষ প্রিয়।নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এ ঘরটির অন্দরসজ্জা করেছিলেন তিনি।কিন্তু নার্সিং হোম থেকে ফিরে সুপ্রতীক দেখলেন তারা কক্ষচ্যুত হয়েছেন,অপেক্ষাকৃত অপ্রশস্ত অন্য একটি কক্ষে নির্দিষ্ট হয়েছে অসুস্থ দীপাবলীর স্থান।আর এই প্রথম স্ত্রীর চোখে এক অদ্ভুত বিষণ্ণ অসহায়তা দেখলেন সুপ্রতীক।মুহূর্তের সিদ্ধান্তে কঠোর হলেন তিনি।গৃহকর্তার অধিকার ও আভিজাত্যে আদেশ দিলেন তাদের দাম্পত্যময় কক্ষটি তাদেরই ফিরিয়ে দিতে। পুত্রবধূটি নির্দেশ মেনে নিয়েছিল । কিন্তু সুপ্রতীক যখন স্ত্রীকে পরম মমতায়  বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছিলেন ,তাঁর কানে এল তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ এক নারীকন্ঠের বিদ্রূপাত্মক উচ্চারণ-‘আদিখ্যেতা...’। সুপ্রতীক স্থির করলেন, এরকম আদিখ্যেতা তিনি আরও করবেন – অন্ততঃ যতদিন পর্যন্ত দীপাবলীর জীবন রয়েছে-ততদিন।

     এরকম ঘাত প্রতিঘাত সংঘাতে কেটে যাচ্ছিল জীবন । ছোট ছোট খুশির মুহূর্তও যে তৈরী হতনা তা নয় – তবে বড় অপ্রতুল হত তাদের আয়ুষ্কাল। এরমধ্যেই সুপ্রতীক   দাদু হলেন,একটি পুত্র-সন্তানের জন্ম হল তার ছেলের ঘরে ।বছর তিনেক পরে তাঁর কর্মজীবনের পরিসমাপ্তির দিনটিও সমাগত হল ।অবসরপ্রাপ্তির দিনটিতে সন্ধেবেলায় বাড়ী ফিরলেন সহকর্মীদের দেওয়া বহুবিধ উপহার নিয়ে। বাড়ী ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই নাতি আধো আধো গলায় জিজ্ঞেস করল –
---দাদু কি এনেছ?                                 
--- প্রাইজ,
----আমাল?
---হ্যাঁ সোনা,তোমার জন্য , তোমার মা-বাবার জন্য
___আমাল ঠাম্মাল জন্য?
----হ্যাঁ তাও আসছে
----কী?
----সেটা সারপ্রাইজ,
----- কি বলনা,
     কথোপকথনের মধ্যেই ডোরবেল বেজে ওঠে। সুপ্রতীক এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেন। দুটি ছেলে প্যাকিং বাক্সে মোড়া কিছু নিয়ে ভেতরে ঢোকে। সুপ্রতীক সকলের অবাক চোখের সামনে দিয়ে তাদের নিজের ঘরটিতে নিয়ে যান।

------ এই যে এখানে রাখ, ঠিক মত লাগিয়ে দাও বিছানার পাশে, দেখ সকাল সন্ধ্যে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের আলো যেন পড়ে এমনভাবে রাখো।

          পাশেই শয্যাগতা দীপাবলীর সপ্রশ্ন দৃষ্টির সামনেই প্যাকিং বাক্সের মোড়ক সরিয়ে দৃশ্যমান হয় একটি আধুনিক নক্সার ইজিচেয়ার।ছেলে দুটি চলে যাবার পর বাক্‌শক্তিহীন দীপাবলী মৃদু কৌতূহল নিয়ে তাকান স্বামীর দিকে...

-নিয়ে এলাম তোমার জন্যে,...সুপ্রতীক বলেন...

         -আজ তো অফিস থেকে বরাবরের মত ছুটি হয়ে গেল।এখন আর কোন কাজ নেই।এই চেয়ারটিতে বসে বসে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব, আর গল্প করব...অনেক অনেক গল্প।আমি বলব, তুমি শুনবে...। তুমি তো হুইল চেয়ারেও বসতে চাও  না।এই চেয়ারটা আমি রোজ বিকেলে ব্যালকনিতে নিয়ে যাব। আর তোমাকে কোলে করে নিয়ে বসিয়ে দেব।তারপর সুর্যাস্তের রঙ মেখে পাখীদের ঘরে ফেরা দেখতে দেখতে বিকেলের চা খাব একসঙ্গে...।

          দীপাবলীর চোখের কোণে গড়িয়ে আসা অশ্রু নিবিড় মায়ায় জামার হাতায় মুছে নেন সুপ্রতীক। সেই মুহূর্তেই পর্দার ওপার থেকে কানে আসে মৃদু পদশব্দ আর এক ঈর্ষাময় অভিব্যক্তি-‘আদিখ্যেতা’।

     অতঃপর অবসরজীবনে শুধুমাত্র দুটি আকর্ষণ বিন্দুতেই কেন্দ্রীভূত হয় সুপ্রতীকের যাবতীয় কর্মচঞ্চলতা।একদিকে স্ত্রী, অন্যদিকে নাতি।দীপাবলীর অসুস্থ অসহায়তা তাকে যেমন পীড়া দেয়,অন্যদিকে সমস্ত দাম্পত্যজীবনে এই এখনই যে তিনি দীপাবলীর সম্পূর্ণ অবলম্বন হয়ে উঠতে পেরেছেন,দীপাবলীর প্রতিটি দিন-রাত,প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস যে তারই উপরে নির্ভর করে রয়েছে,এ চিন্তাও কোথায় যেন তার মনে সূক্ষ্ম সুখানুভুতি জাগিয়ে যায়।

          সেদিনও সন্ধ্যে থেকেই ঝুলবারান্দায় আরামচেয়ারটিতে স্ত্রীকে আরামপ্রদ ভঙ্গীতে বসিয়ে দিয়েছিলেন সুপ্রতীক। বেতের মোড়ায় পাশটিতে বসেছিলেন নিজে। স্ত্রীর অনড় হাত ছুঁয়ে টুকটাক কথা বলছিলেন।দীপাবলী চোখ দিয়েই উত্তর দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি স্বামীকে অনুরোধ জানালেন গান গাইতে।সুপ্রতীকের গানের অভ্যাস ছিল একসময়। কিন্তু বহুদিন তো আর চর্চা নেই। অবশ্য মাঝে মাঝে এখনও গুণ-গুণ করেন।স্ত্রীর অনুরোধে উঠে গিয়ে গীতবিতান নিয়ে এলেন।

-কোন গানটা গাইব?

স্ত্রীর ইঙ্গিত বুঝে শুরু করেন সুপ্রতীক...“জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে...”

     স্থায়ী অংশটি চোখ বুজে আন্তরিক ভাবেই গেয়ে যান। অন্তরাতে এসে থেমে গেলেন। কথা মনে নেই।দীপাবলী কথা বলতে পারলে নিশ্চয়ই ধরিয়ে দিতেন।বই খুলে দেখতে গেলেন,চোখ পড়ল স্ত্রীর দিকে।পরম সন্তোষে চোখ বুজে আছেন, মুখে মৃদু হাসি।স্ত্রীর গায়ের চাদর খানা একটু টেনে দিতে গেলেন তিনি-অমনি দীপাবলীর মাথা ঝুঁকে পড়ল তার বুকে।শান্তভাবে স্ত্রীর মাথা বুকে গ্রহণ করলেন তিনি আর উপলব্ধি করলেন সেই চরম সত্য-দীপাবলীর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়েছে।

     স্ত্রীর মৃত্যুর পর নিজে থেকেই সরে এসেছিলেন পাশের ছোট ঘরটিতে,কেননা পুত্রবধূর সঙ্গে সংঘাত বাড়িয়ে নিতে তার আর মন চায়নি। তাছাড়া যার জন্য যুদ্ধ করবেন তিনিও তো আর নেই,সুতরাং...কিন্তু সমস্যাটা এল অন্যদিক থেকে।যে মাঝবয়সী লোকটি তাদের হাটবাজার ও অন্যান্য গৃহকর্মে সাহায্য করে থাকে,তার শয্যাস্থানটি পুত্রবধূ নির্দিষ্ট করল সুপ্রতীকের ঘরের মেঝেয়।আরও একবার বিদ্রোহ করলেন সুপ্রতীক। তিনি কেমন করে বোঝাবেন, আজও প্রতিটি রাতে তিনি তার ইজিচেয়ারটিতে বসে দীপাবলীর আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠেন। কেমন করে  বোঝাবেন ওই মানুষটির শয্যা রচনা করতে হলে এই অপ্রশস্ত ঘরটিতে  ইজিচেয়ারখানা রাখার আর জায়গা হবে না,যে চেয়ারটিতে রয়ে গেছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রিয়তম শেষ স্পর্শ।

          প্রবল বাজির শব্দ আর একটি সুগভীর দীর্ঘশ্বাস সুপ্রতীককে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনলো।“প্রবীণ মানুষের জীবন আসলে দরজার কোণে দাঁড়ানো লাঠির মত।প্রয়োজনে কেউ ব্যবহার করে,নতুবা সব জায়গা থেকে জীবনকে গুটিয়ে এনে দরজার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা...শেষের প্রতীক্ষায়”-ভাবেন সুপ্রতীক। একটু একটু শীত বোধ হয় তার।দীপাবলী থাকলে মৃদু ধমক দিয়ে গায়ে হাল্‌কা চাদর দিয়ে দিতেন।শ্লথ পায়ে ঘরের ভেতর উঠে যান তিনি।আলমারীর লকার থেকে বের করে আনেন একগুচ্ছ কাগজ ও দলিল।একটি কাগজ-চাপা দিয়ে টেবিলের ওপর রাখেন সে সব। আগামীকাল থেকে তার নতুন জীবনের ঠিকানা...নবদিগন্ত বৃদ্ধাশ্রম।এ পরামর্শ ঐ ছবির দীপাবলীই তাকে দিয়েছেন।অযথা যুদ্ধে রক্তাক্ত হতে বারণ করছেন বারবার।মেনে নিয়েছেন তিনি।নিজের টুকিটাকি গুছিয়েও নিয়েছেন।আগামীকাল ছুটির দিন-পুত্র-পুত্রবধূকে সব জানিয়ে দুপুরের আগেই বেরিয়ে পড়বেন... দেওয়াল থেকে আস্তে আস্তে স্ত্রীর ছবিখানা নামিয়ে আনেন।নিষ্কলুষ প্রেমময় আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে ধরেন।তারপর ধীরে ধীরে গিয়ে বসেন ইজিচেয়ারটিতে।ফিস্‌ফিস্‌ করে বলেন...’এসো প্রিয়তমা...কাল থেকে নতুন আবাস আমাদের...।তার আগে আজ রাতে আবার আমাদের নিশিবাসর...আমাদের এ বাড়িতে...শেষবারের মত...’।

     ছবির দীপাবলী মিষ্টি হেসে ছদ্মরাগে বলে ওঠেন ‘আদিখ্যেতা’।

কোন মন্তব্য নেই: