“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৪

ত্রিপুরায় এবার এত ম্যালেরিয়া কেন ?

 ( লেখাটা  দুইভাগে ' দৈনিক সংবাদ'  ১৩ এবং   ১৫ অক্টোবর, ২০১৪তে প্রকাশিত হয়---   সুদীপ নাথ)

      মশা জন্মসূত্রে ম্যালেরিয়ার জীবাণু নিয়ে জন্মায় না। শুনতে যতই অদ্ভুত শোনাক না কেন মশা মানুষের শরীর থেকেই ম্যালেরিয়ার জীবাণু শুষে নেয় এবং তা অন্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। তবে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগী থেকেই মশা সুস্থ মানুষের শরীরে জীবাণু নিয়ে যায়। এদিকে একটা মশা প্রায় পনের দিন বাঁচে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, মশা ধ্বংস করা ও মশার বাড়বাড়ন্ত ঠেকানো একদিকে যেমন প্রয়োজনীয়, ঠিক তেমনি মানুষের শরীর থেকে জীবাণু বিনাশ করাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যাদের শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু রয়েছে । এই দুটি লক্ষ্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ম্যালেরিয়া দূর করার চাবিকাঠি। নাহলে সব কিছুই শুধুমাত্র, কথার কথাই থেকে যাবে।

ডিডিটি আবিষ্কারের পর ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে যখন মানুষের বাসস্থানের ভেতরের দেয়ালে ও পশুদের আস্তানার ভেতরে ডিডিটি ছড়িয়ে ভাল ফল পাওয়া গিয়েছিল, তখন ১৯৫৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ১৯৫৬ সালে বিশ্ব ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় যে পরবর্তি ২০ বছরে ৭০ টি দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূল করার সময় সূচী রূপায়িত করা হবে। এই ভাবে ১৯৫৮ সালে প্রায় ৬০ কোটি লোককে ম্যালেরিয়া মুক্ত করতে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এই প্রকল্প চারটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছিল। প্রারম্ভিক পর্যায়ে এক বছরে ম্যালেরিয়ার অনুসন্ধান ও কর্মসূচী তৈরি করা হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়  প্রায় চার –পাঁচ বছর ধরে চলছিল। এই পর্যায়ে ম্যালেরিয়া প্রকোপদোষ্ট এলাকাগুলিতে একটি ঋতুতে দুবার করে এবং অপেক্ষাকৃত কম প্রকোপদোষ্ট এলাকায়, বছরে একবার ডিডিটি ছড়ানো হয়। এছাড়া মশার উপর বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও নানা অনুসন্ধান চালানো হয়। আর তৃতীয় পর্যায়ে, আগের পর্যায় দুটির সমস্ত তথ্যাবলী সংগ্রহ করা হয়। প্রায় দুই বছর ধরে এই পর্যায় চলে। চতুর্থ তথা শেষ পর্যায় দির্ঘ দিন ধরে চলে। ঠিক হয় এই পর্যায়ে প্রতি ১০,০০০ জনসংখ্যায় একজন করে স্বাস্থকর্মী থাকবে। প্রতি চার জন স্বাস্থ্য কর্মীর জন্যে একজন করে ম্যালেরিয়া ইনস্পেক্টর থাকবে। প্রত্যেক স্বাস্থ্য কর্মী মাসে ২,০০০ বাড়িতে যাবে। যদি কোন বাড়িতে জ্বরের রোগী থাকে তাহলে, ম্যালেরিয়া অণুজীব আছে কিনা পরীক্ষা করার জন্যে তার রক্ত সংগ্রহ করবে। সন্দেহ হলে ওষুধ দেবে। এই পর্যায়ে ম্যালেরিয়া সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় শেষ হবার মত অবস্থায় চলে আসে। শ্রীলঙ্কায় ১০০ শতাংশ ম্যালেরিয়া নির্মুল করা সম্ভব হয়। পাকিস্থান ও নেপালে ৯৯.৯ শতাংশ আর ভারতে ৯৯.৮ শতাংশ ম্যালেরিয়া নির্মূল করা হয়। কিন্তু এই পর্যায়েই সত্তরের দশকে দেখা গেল, ম্যালেরিয়া আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে এবং তা দিনকে দিন বাড়তেই লাগল। তবে এই বাড়ার হারে একটা মোটামুটি সামঞ্জস্য প্রতীয়মান হয়। অনুসন্ধানে প্রমাণিত হল ডিডিটি আর কাজ করছে না। ডিডিটি পরিত্যক্ত বলে ঘোষিত হল বিজ্ঞানীদের দ্বারা। আর ত্রিপুরায় যারা ডি ডি টি নিয়ে আটকে আছেন, তারা ভেবেও দেখেন না যে, ঝোপঝাড়েই মশার দংশন অনেক বেশী ঘরের তুলনায়।

           এমতাবস্থায়, ম্যালেরিয়া এই বছর ত্রিপুরাকে সব দিক থেকেই নাড়া দিয়েছে এবং অনেক অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। যেসব নূতন নূতন প্রশ্ন আমাদের মনে উদিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যা যা আছে, তা মোটামুটি এই রকমঃ-

১। ম্যালেরিয়া পালা করে কয়েক বছর পর পর আসছে কিনা এবং যদি তাই হয় তাহলে এর কারণ কি।

২। ম্যালেরিয়ায় এত মানুষ মারা যাচ্ছে কেন।

৩। ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ানোয় মানুষের দায়ভাগ আছে কিনা।

৪। তথাকথিত উন্নয়নের সাথে ম্যালেরিয়ার কোন সম্পর্ক আছে কিনা।

৫। এবারের ম্যালেরিয়াকে মহামারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে কিনা।

৬। ম্যালেরিয়া রোগ সেরে যাওয়ার পরও কোন সমস্যা রেখে যায় কিনা।

৭।ম্যালেরিয়া রোগ এড়াতে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী কী হতে পারে।

             এইসব প্রশ্ন এবার ত্রিপুরার জনগণের কাছে বিশেষ তাৎপর্য নিয়েই হাজির হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই নানা রকম বিচার বিশ্লেষণ জনগণের মধ্যে আরো বেশি করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। নেতা মন্ত্রীরা যার যার সুবিধা মত অবস্থান নিচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত মূখ্যমন্ত্রীও মুখ খুলেছেন। কিন্তু ঠিক এই বছর হঠাত করে এত ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব কেন ঘটল, তা নিয়ে এখনো কেউ কোন দিক নির্দেশ করে উঠতে পারেন নি, যদিও সরকারি বেসরকারি তরফে অনেক শলাপরামর্শ আর এলাকা ঘুরে ঘুরে তথ্যাদি আহরণ করা হয়েছে।

              ম্যালেরিয়ার মূলে রয়েছে এক ধরণের এক কোষী পরজীবী প্রাণী, যা মানুষ থেকে মানুষে, মশা দ্বারা বাহিত হয়ে সংক্রমন ঘটায়। মশা কিন্তু জন্মসূত্রে ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করে না এবং মশা রক্ত খেয়ে বেচে থাকে না। মশা মাংসাশী প্রাণী নয়। মশার খাদ্য শাকসব্জি আর আর ফল। একধরণের মশা মানুষের গা থেকে রক্ত শুষে নেয়, তার ডিম পাড়ার ক্ষমতা অর্জন করতেই। আর ঠিক তখনই, সেই মানুষটি রোগী হলে, তার রক্তের সাথে বীজাণু চলে যায় সেই মশার শরীরে। সেখানে সেই জীবাণুতে এক ধরণের জৈবিক পরিবর্তনের পর, সেই মশা একজন সুস্থ মানুষের দেহে আবার কামড় দিলে, সেই পরিবর্তিত বীজাণু দ্বারা সে রোগাক্রান্ত হয়। প্লাজমোডিয়াম গোত্রের প্রোটোজোয়া প্যারাসাইট এই রোগের প্রধান কারণ। মানুষের দেহে পাঁচ রকমের প্লাজমোডিয়াম প্যারাসাইট সংক্রমণ ঘটতে পারে।

          যখন একটা স্ত্রী এনোফিলিস মশা একজন সংক্রমিত মানুষকে কামড়ায়, তখন অল্প একটু রক্ত নিয়ে নেয়, যাতে থাকে ক্ষুদ্র ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট। প্রায় এক সপ্তাহ পরে যখন মশাটি আবার রক্ত খায়, তখন এই মশার লালার সঙ্গে মিশে থাকা প্যারাসাইটগুলো, যাকে সেই মশাটি কামড়াচ্ছে, সেই ব্যক্তির শরীরে ঢুকে লিভারে চলে যায়। পরে প্যারাসাইটগুলো রক্তের লাল কণিকায় বংশবৃদ্ধি করে। যার ফলে রক্তাল্পতা, জ্বর, কাঁপুনি, বমিভাব, সর্দি এবং কোমা ও মৃত্যুর মত রোগের বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

            মশার সামনের দুটি পায়ের উপরে থাকে লালা গ্রন্থি, যাতে ম্যালেরিয়ার জীবাণু থাকলে, মানুষকে দংশন করলে তা শরীরে ঢুকে লিভারে চলে যায়। মশার ডিম পাড়ার জন্যেই চাই তাজা রক্ত। মশা ৫০ থেকে ৫০০ টি ডিম পাড়ে, যা প্রথমে সাদা ও পরে কালচে দেখায়। ডিমগুলো জলে, জলজ উদ্ভিদের পাতা ও কান্ডে এবং ভেজা ও কাদা মাটিতে দেখা যায়। অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় অনেকদিন এভাবেই পড়ে থাকে। ডিম ফোটার জন্যে চাই, বেশি তাপমাত্রা আর যথেষ্ট পরিমাণে জলীয় বাষ্প। এই অনুকূল পরিবেশে, কয়েক দিনেই ডিম লার্ভায় পরিণত হয়।

          দিনের বেলায় মশারা কোথায় থাকে ? যাদের বাড়িতে বুট জুতো থাকে তাতে, বাক্স সহ সব ধরণের অন্ধকার স্থানে, গোয়ালঘরে, দেয়ালের ফাটলে, গাছের ছিদ্রে, ঝোপঝাড়ে আর জঙ্গলেই মশা দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে। বাদুর, মাকড়শা, টিকটিকি ও গিরগিটি মশা খায়। মশা এক দিনে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে যেতে পারে। এরা ঝড়ের সাথে দূর দূরান্তে চলে যায়। এরা গায়ের গন্ধ ও উত্তাপ অনুসরণ করেই আমাদের খুঁজে বের করে ও কামড়ায়।

            এনোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া ছড়ায় আর তা আছে প্রায় ৬০০ রকমের। তার মধ্যে প্রায় ৬০ রকমের এনোফিলিস মশাই ম্যালেরিয়া ছড়াতে পারে। আর ভারতে প্রধানত তিনটি প্রজাতির এনোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এগুলো হচ্ছে স্টিফেনসাই, কিউলেসিফেসিস আর ফ্লুভিয়াটিলিস। তাছাড়া রয়েছে মিনিমাস, ডাইরাস, সানডাইকাস, ফিলিপিনেনসিস ইত্যাদি। এনোফিলিস স্টিফেনসাই শহরাঞ্চলে ম্যালেরিয়ার বিস্তার ঘটায়। সানডাইকাস সমুদ্রের কাছে সূর্যালোকে নোনা জলাভূমিতে ডিম পাড়ে এবং ঘরে ও বাইরে আমাদের কামড়ায়। এনোফিলিস ফিলিপিনেনসিস মশা সমতলে জন্মায় এবং ধান ক্ষেতে আর জলজ উদ্ভিদে ডিম পাড়ে। এরা প্রধানত ঘরের মধ্যেই মানুষকে কামড়ায়। এনোফিলিস মিনিমাস আর ডাইরাস  মশার বাড় বাড়ন্ত পার্বত্য অঞ্চলে। এরা ঝর্ণার জলে বা যেকোন স্রোতস্বিনীতেই ডিম পাড়ে এবং মানুষের আবাস স্থলের কাছাকাছি বসবাস করে। ত্রিপুরাতে এনোফিলিস মিনিমাস ও ডাইরাস মশা যথেষ্ট রয়েছে। এরা বেশী উঁচুতে থাকেনা।

          ম্যালেরিয়ার জীবাণু মশার দেহে বাড়তে হলে পরিবেশের তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রির বেশি হতে হয়, আর বাতাসে যথেষ্ট পরিমাণে জলীয় বাষ্প থাকা চাই। তাই শীতকালে ম্যালেরিয়া উপদ্রব হিসেবে হাজির হয় না। আবার গরম কালে বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ে না, তাই একটানা বৃষ্টি না হয়ে এক-দুদিন পর পর বৃষ্টি আর রোদের কারণে প্রচণ্ড গরমের সময়েই মশা জন্মায় সর্বাধিক। আর ত্রিপুরায় তা একমাত্র সম্ভব মে জুন জুলাই মাসেই। তবে সব বছরেই কি কিছুদিন, এক নাগাড়ে এমন তাপ আর বৃষ্টির মেলবন্ধন ঘটে ? যে পর্যায়ে, দুদিন বৃষ্টি দুদিন অসহ্য গরম , তাও আবার বেশ কিছুদিন চলবে এই প্রক্রিয়া ? এই বছর কিন্তু ত্রিপুরায়, ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। আর এখান থেকেই রহস্য ভেদ করে এগিয়ে যেতে হবে, যা সবার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে এখনো।

           এবার ম্যালেরিয়া সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কি বলে দেখে নেয়া যাক -

“Malaria is caused by a parasite called Plasmodium, which is transmitted via the bites of infected mosquitoes. In the human body, the parasites multiply in the liver, and then infect red blood cells.

Symptoms of malaria include fever, headache, and vomiting, and usually appear between 10 and 15 days after the mosquito bite. If not treated, malaria can quickly become life-threatening by disrupting the blood supply to vital organs. In many parts of the world, the parasites have developed resistance to a number of malaria medicines.

Key interventions to control malaria include: prompt and effective treatment with artemisinin-based combination therapies; use of insecticidal nets by people at risk; and indoor residual spraying with insecticide to control the vector mosquitoes.”

       এদিকে, ত্রিপুরায় এবারের ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব মহামারী কিনা তা কে নির্ধারণ করবে ?

         এই প্রশ্ন ঘিরে অনেক মতামত শোনা যাচ্ছে।  অনেকেই নানা রকমের অভিমত দিচ্ছেন। সরকার মহামারি ঘোষণা দিতে রাজি হচ্ছে না। এমতাবস্থায় ত্রিপুরার গত কয়েক বছরের ম্যালেরিয়ার চিত্রটা একটু চোখ বুলিয়ে দেখে নেয়া যাক।

         ত্রিপুরায় ২০০৫ সালে রক্ত পরীক্ষা করে মোট ১৮,০০৮ জনের রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল। তার মধ্যে ১৪,২৬১ জন ছিল পিএফ ম্যালেরিয়ার রোগী এবং ২০০৫ সালে ম্যালেরিয়ায় মারা যায় ২০ জন রোগী। ২০০৬ সালে ২৫ জুলাই অব্দি রক্ত পরীক্ষা করে ৭,১৪৪ জনের রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল। তার মধ্যে ৫,৯২১ জন ছিল পিএফ ম্যালেরিয়ার রোগী এবং তার মধ্যে ম্যালেরিয়ায় মারা যায় ১৬ জন।

          এদিকে, ২০১০ সালে মোট ৩,৩০,৬০৮ জনের রক্ত পরীক্ষা করে ২৩,৯৩৯ জনের রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল। তার মধ্যে ২১,২৫৪ জন ছিল পিএফ ম্যালেরিয়ার রোগী এবং ২০১০ সালে ম্যালেরিয়ায় মারা যায় ১৫ জন।

         ২০১১ সালে মোট ২,৮৮,০৭৬ জনের রক্ত পরীক্ষা করে ১,৪১১ জনের রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল। তার মধ্যে ১,৩৮১ জন ছিল পিএফ ম্যালেরিয়ার রোগী এবং ২০১১ সালে ম্যালেরিয়ায় মারা যায় ১২ জন।

         ২০১২ সালে মোট ২,৬৮,১৮৯ জনের রক্ত পরীক্ষা করে ১১,৫৬৫ জনের রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল। তার মধ্যে ১০,৯১৫ জন ছিল পিএফ ম্যালেরিয়ার রোগী এবং ২০১২ সালে ম্যালেরিয়ায় মারা যায় ৭ জন।

          ২০১৩ সালে মোট ২,৫৭,৭৬০ জনের রক্ত পরীক্ষা করে ৭,৩৯৬ জনের রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল। তার মধ্যে ৬,৯৯৮ জন ছিল পিএফ ম্যালেরিয়ার রোগী এবং ২০১৩ সালে ম্যালেরিয়ায় মারা যায় ৭ জন।

           আর চলতি বছরের মে মাস অবদি, মোট ৮৪,৭০৩ জনের রক্ত পরীক্ষা করে ২,৬৫৪ জনের রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পাওয়া যায়। তার মধ্যে ২,৫৩০ জন পিএফ ম্যালেরিয়ার রোগী এবং মে মাস অব্দি ম্যালেরিয়ায় মারা যায় ২ জন রোগী। এই বছরের পরের চিত্রটা সকলেরই জানা অর্থাৎ এই প্রতিবেদন লিখা অব্দি মানে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, কত জনের রক্ত পরীক্ষা হয়েছে আর কত জন পিএফের রোগী সনাক্ত হয়েছে আর কত জন মারা গেছে এবং এখনো কি চলছে।

          এবার আমাদের প্রতিবেশী দেশের তথা আমাদের লাগোয়া অঞ্চলের চিত্রটা এক ঝলক দেখে নেয়া যাক। বর্তমানে বাংলাদেশের মাত্র ১৩টি জেলায় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে ঐ দেশের পার্বত্য তিন জেলার ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। এর সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের ৪ জেলা এবং চট্টগ্রাম জেলা ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। কক্সবাজার জেলাকে মধ্য ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যু ঘটে। ২০০৮ সালে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫৪। ২০১৩ সালে উচ্চ ও মধ্য ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৭৮৩। এ সময় ১৫টি মৃত্যুর ১২টিই ঘটে উচ্চ ও মধ্য ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায়। এসব এলাকায় দক্ষ জনশক্তির স্বল্পতা, পার্বত্য এলাকার দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থা, বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের কিছুটা অভাবকে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কর্মসূচির প্রতিবন্ধক হিসেবে মনে করছে বাংলাদেশ সরকার।

            আর, গত ছয় বছরে সিলেটে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ২০ জন। ২০০৭ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৪২১ জন, ২০০৮ সালে ৮৪১ জন, ২০০৯ সালে ৯৫০ জন, ২০১০ সালে ৮৮২ জন, ২০১১ সালে ৪৬৬ জন ও ২০১২ সালে ৪৬০ জন। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ম্যালেরিয়ায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন গোয়াইনঘাটে ২ হাজার ৩১৯ জন। আক্রান্তের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কোম্পানীগঞ্জে ৭২৫ জন ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অন্যদিকে এই রোগে সবচেয়ে কম আক্রান্ত হয়েছেন কানাইঘাটের বাসিন্দারা। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির দায়িত্বে থাকা উন্নয়ন সংস্থা সীমান্তিকর কানাইঘাট উপজেলা কর্মকর্তা আবুল হোসেন জানান, গত পাঁচ বছরে এই উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ১১০ জন।

          তাহলে এবার চলতি বছরে ত্রিপুরায় এত ব্যাপক হারে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব কেন হল সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। এবারের ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব যাকে ইংরাজিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে আউট ব্র্যাক কোথায় প্রথমে হয়েছিল ? গন্ডাছড়ায়। কেন গন্ডাছড়া না হয়ে অন্যখানে হলনা ? গন্ডাছড়া থেকে শুরু হয়ে কেন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো ? আর গত কয়েক বছরে কেন ম্যালেরিয়া এত তাণ্ডব নৃত্য দেখাতে পারেনি ? এসব প্রশ্ন সমাধান করে এগুতে পারলেই বেড়িয়ে আসবে আসল গুমর। তাই এবারের ম্যালেরিয়ার পেছনে কার্য-কারণ সম্পর্কগুলো  কী কী  তা খতিয়ে দেখতেই হয় এবং আলোচনায় আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসতেই হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বইয়েই বলা আছে যে, -

“The epidemiology of Malaria is complex and may vary considerably even within relatively small geographic areas. …….. Even in stable transmission areas, there is often an increased incidence of symptomatic malaria coinciding with increased mosquito breeding and transmission during rainy season. Malaria behaves like an epidemic disease in some areas, particularly those with unstable malaria, such as northern India, Sri Lanka, Southeast Asia, Ethiopia, Eretria, Rwanda, Burundi, southern Africa and Madagascar.” ( p/1281, Harrison’s Principles of Internal Medicine, 17th Edition) 

এখানে মূল কথাটি হল, ছোট্ট ভৌগোলিক অঞ্চলেও ম্যালেরিয়ার ব্যপকতা দেখা দিতে পারে এবং তা জটিল কারণে।

“An epidemic can develop when there are changes in environmental, economic, or social conditions, such as heavy rains following drought  or migrations (usually of refugees or workers) from a nonmalarious region to an area of high transmission; a breakdown in malaria control and prevention services can intensify epidemic conditions. This situation usually result in considerable mortality among all ages.” ( p/1281, Harrison’s Principles of Internal Medicine, 17th Edition) 
         অর্থাৎ ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব হয় প্রাকৃতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তন যেমন খরার পরেই বৃষ্টি, রিফিউজি বা শ্রমিকের স্থানান্তর ইত্যাদি কারণে ম্যালেরিয়া মহামারির আকার নিতে পারে।

The key words in the definition of an epidemic are: in excess of “expected occurrence” (Preventive and Social Medicine by Park) মানে প্রত্যাশিত হারের চেয়ে বেশি সংখ্যক রোগের ঘটনা।

“In the course of stratification exercise various problems and constraints responsible for the slow progress of malaria control have been identified. An analysis of this factors has resulted in the identification of malaria priority areas- forests, forested foot hills and hills, forest fringe areas and developmental project sides. Due to indiscriminate exploitation, forests are now more accessible and the movements of the population with low immunity into such areas result in malaria epidemics. Forest related malaria remains a serious problem causing 30% of all malaria cases.” (Ref: Preventive and Social Medicine by K.Park, 19th Edition)
         এখানে বলা হচ্ছে, অনুসন্ধানের ফলে দেখা গেছে যে, বনভূমি, পাহাড়ি এলাকা, পাহাড়ের পাদদেশ, বন সংলগ্ন এলাকা এবং যেখানে উন্নয়ন পরিকল্পনার কাজ চলছে সেগুলোই ম্যালেরিয়ার বিপজ্জন এলাকা। নির্মম ভাবে বন ধ্বংস করার ফলে কম প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে এসকল এলাকায় উঠে আসা ম্যালেরিয়ার মহামারি সৃষ্টির এক অন্যতম কারণ। বন সম্পর্কিত ম্যালেরিয়াই প্রায় ৩০% বিপজ্জনক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়।

TRIBAL MALARIA (ট্রাইবেল ম্যালেরিয়া)

Infants, young children and pregnant women have been identified as malaria high risk groups followed by mobile tribal population engaged in forest related activities. Limited health infrastructure and lack of drugs at village level are the factors responsible for high morbidity and mortality due to malaria.” (ibid) মানে চলমান ট্রাইবেল মানুষজন বন বাদাড়ের কাজে যোগদান করলে শিশু, বালক-বালিকা আর গর্ভবতি মায়েরা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হবার ঝুঁকি নিয়ে চলে। এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা যথেষ্ট না থাকলে মৃত্যু হার বেশি হয়।

MALARIA IN PROJECT AREAS: (প্রোজেক্ট এলাকার ম্যালেরিয়া)

Project areas are those areas where construction and developmental activities are taken up and temporary tropical aggregation of laborers takes place bringing in deferent trains of malaria parasite and non-immune population. This results disturbance in eco-system , prolific increase in vector breeding places and increased man-mosquito contact favoring high malaria transmission. These pockets contribute a large number of malaria cases which are highly disproportionate to the relatively small population groups inhabitating the area. One or more major vectors are in involved in malaria transmission. Limited health facilities for prompt treatment are invariably associated with Chloroquine resistant malaria parasite. Hence specific control strategy is required for such areas.” (ibid
         প্রোজেক্ট এলাকার ম্যালেরিয়া হচ্ছে সেই এলাকার যেখানে নানাহ সরকারি বেসরকারি কর্মকান্ড চলছে। যেখানে বিভিন্ন নির্মান কাজ চলছে আর চলছে রাস্তাঘাট বিল্ডিং রাবার প্রসেসিং সেন্টার কমিউনিটি হল বাজার শেড ইত্যাদি তথাকথিত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ। সেখানে চলে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে মানে সাফ করে বনায়ন আর গড়ে উঠে রাবার বা অন্য কোন বাগান। এখানে ইকো সিস্টেমকে নির্মম ভাবে পদদলিত করা হয় উন্নয়নের নামে। এবং দেখা যায় এখানেই ক্লোরোকুইন রেজিস্ট্যান্ট প্রাদুর্ভাব ঘটে বেশি। এখানে আগে থেকেই প্রচুর পরিমাণে নির্ধারিত ওষুধ মজুত রাখা সহ আগাম বিশেষ ব্যবস্থা করে রাখতে হয়।

BORDER MALARIA: (বর্ডার ম্যালেরিয়া)

These are the high malaria transmission belts along the international borders and state borders. These areas have their own problems in regard to malaria control because of mixing of population and poor administrative control.” (ibid) আন্তর্জাতিক সীমানা অঞ্চলের বিষয়টাও আলাদা করে মাথায় রাখতে হয়।

        এই সমস্ত দিক খতিয়ে দেখার পর, আর কি বলে দিতে হয় যে, তথাকথিত উন্নয়নের ফলেই মারাত্মকভাবে উর্বর পরিস্থিতি তৈরি হয়ে রয়েছিল প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আর এই বছর সকলেরই জানা আছে যে মে মাসে, গ্যাপ দিয়ে দিয়ে, পালা করে, দুই তিন দিন অন্তর দিন দুয়েক করে বৃষ্টি আর প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। যার ফলেই এবার ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব (EPIDEMIC) ঝড়ের বেগে ত্রিপুরায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু শহরে তো এলনা এই বিপদ। কারণ আর কিছুই নয়। কারণ এনোফিলিস মিনিমাস ও ডাইরাস শহরাঞ্চলের পরিবেশে বাড়তে পারেনা।

           এমতাবস্থায় যা করণীয় তা হচ্ছে, প্রকৃতির উপর অযাচিত ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করতেই হবে। লাগামহীন বন ধ্বংস করে রাবার বাগান গড়ে তোলার অপপ্রয়াস অচিরেই বন্ধ করতে হবে। প্রকৃতিকে আঘাত করার আগে বার বার ভাবতে হবে। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করা বন্ধ করতে হবে। না হলে সবাইকেই যে কোন রকম বিপদের জন্যে তৈরি থাকতে হবে। একদিকে এসব বিপদের কারণ সৃষ্টি করে যাব, আর নিজেদের ভুলের জন্যে ম্যালেরিয়া চলতে থাকবে, অন্যদিকে রোগ সারানোর জন্যে ওষুধ মজুত করে রাখা স্থায়ী সমাধান নয়। এর জন্যে চাই আত্মম্ভরিতা ত্যাগ করে সকলের পরামর্শে একটা সুসংহত স্থায়ী পরিকল্পনা যার মধ্যে থাকবে প্রাথমিক স্তর থেকেই বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কে পাঠ্য বইয়ের প্রচলন। নাহলে সব কিছুই ভেস্তে যাবে।

           আশার কথা ম্যালেরিয়ার টিকা আবিষ্কার হয়ে গেছে। আমাদের রাজ্যেও এই টিকার ব্যবহার এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তবে এই টিকা শিশু ও বালক বালিকার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এটাই বা কম কিসের, যেখানে দেখা যাচ্ছে শিশুরাই ম্যালেরিয়াতে কথায় কথায় প্রাণ হারায়।

 

কোন মন্তব্য নেই: