“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১৫

জানুয়ারি থেকে আসামে চা শ্রমিকদের রেশন বন্ধ হবে



   ।। দেবর্ষি দাস।।
সামের মানুষের মধ্যে  রাজনৈতিক চাপান উতোর এমন একটা বিষয় নিয়ে চলছে যার মর্মবস্তু অনেকটা রহস্যাবৃত। রাজ্যের শাসকদল কংগ্রেস অভিযোগ করেছে ভাজপা ইংরেজদের থেকেও বড় বিশ্বাসঘাতক। ইংরেজদের পত্তন করা চা শিল্পই বিতর্কের কেন্দ্রে অবস্থিত।
          এই বছরের ১লা জানুয়ারি থেকে চা বাগানের মজুরদের রেশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চা বাগানের রেশনব্যবস্থা বেশ পুরনো। মূলত চাল আর গম (আটা) ৫৫ পয়সা প্রতিকিলো দরে দেওয়া হয়ে থাকে। রেশন শুরু হয়েছিল প্রথম Essential Supplies (Temporary Powers) Act, 1946 ও পরে Essential Commodities Act, 1955 (ECA)-এর মারফত। প্রতি মাসে প্রায় ১২.৬ হাজার মেট্রিক টন শস্য এই খাতে বিতরণ করা হয় – ৫ হাজার টন গম, ৭.৬ হাজার টন চাল। খবরে প্রকাশ ১৯ লাখ চা মজুর পরিবার রেশনের সুবিধা পেয়ে থাকে। কেন্দ্র সরকার FCI (Food Corporation of India)-এর মারফত আসামের চা শ্রমিকদের জন্য এক বিশেষ ব্যবস্থায় খাদ্যশস্য পাঠায়। জানুয়ারি থেকে আর পাঠাবে না।
           কংগ্রেস বলছে কেন্দ্রের খাদ্য ও গণবন্টন মন্ত্রক বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসামের জনাকয়েক ভাজপা সাংসদ উল্টো দাবি করেছেন, বন্ধ করার প্রস্তাব আসলে রাজ্য সরকারেরই ছিল, কেন্দ্র প্রস্তাবকে বলবৎ করছে মাত্র। রাজ্য সরকার নাকি চা শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ বন্ধ করে তাদের জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের (NFSA) আওতায় আনার প্রস্তাব কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছিল। কংগ্রেস জবাব দিয়েছে রাজ্য সরকার খাদ্য নিরাপত্তা আইনের বিপক্ষে নয়। তবে মজুরদের জন্য ১২.৬ হাজার টন খাদ্যের বিশেষ ব্যবস্থা জারি রাখার অনুরোধ রাজ্য সরকার করেছিল। সেই অনুরোধে কেন্দ্র গা করে নি – কেন্দ্র সরকারের পাঠানো চিঠি বলছে শ্রমিকদের শস্তা খাদ্যের ব্যবস্থা করার দায় চা বাগান মালিকের।
           কথাটা একেবারে ভুল নয়। আসামে চা বাগানে মজুরির হার দক্ষিণ ভারতের বাগানের থেকে কম। কারণ এখানে মালিকের কম দামে খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী শ্রমিককে দেওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যায় মালিক তা না করে উল্টো শ্রমিকের মজুরির এক অংশ পকেটস্থ করছে। কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির বিবৃতি অনুযায়ী চুরির হিসেব এই রকমঃ আইনত আসামে ন্যুনতম মজুরির হার দিনপ্রতি ১৬৯ টাকা। মজুরকে দেওয়া হয় ৭৫ কেটে ৯৪ টাকা। মালিক সস্তা দরে সরকারের থেকে রেশন কেনে, তার খরচ পড়ে ৩.৬০ টাকা প্রতিদিন (চাল আর আটা যথাক্রমে ৮.৩০ ও ৬.১০ টাকা প্রতিকেজি দরে সরকারের থেকে কেনে; ১২ দিনের কাজের জন্য চাল ও আটা প্রায় ৩ কেজি করে দেওয়া হয়)। অর্থাৎ মালিক প্রতিদিন প্রতি মজুরের বেতন থেকে ৭১.৪০ টাকা পকেটস্থ করছে। পরিমাণটা খুব কম নয়। অবশ্য কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি কিছু খরচ ধরে নি। ছাতা, স্যান্ডেল, চিকিৎসা, ডিপেন্ডেন্টদের জন্য রেশন – এই খরচগুলো মালিকের দেওয়ার কথা। কিন্তু সব ধরলেও চুরির পরিমাণ বেশ মোটাই থেকে যাবে অনুমান। সংক্ষেপে বললে, মালিক রেশন ইত্যাদি দেওয়ার নামে মজুরের থেকে যত টাকা নিচ্ছে ততটা খরচ তাকে করতে হয় না। অথচ, সরকার সস্তা রেশন বন্ধ করলে মালিক বাজার থেকে কিনে রেশন চালু রাখবে এরকম সম্ভাবনা নেই। কারণ বোধহয় বাজারের থেকে খাদ্য কিনতে গেলে বেশি দাম দিতে হবে। FCI-এর ভর্তুকিওয়ালা চাল গম পাওয়া যাবে না, মালিকের মুনাফা কমে যাবে।
           তো, বাগানমালিক FCI থেকে APL (above poverty line) দরে খাবার কিনে মজুরদের ৫৫ পয়সা দরে বেচছিল। অন্তত মালিকের তাই করার কথা ছিল। কেন মাঝেমাঝেই চা মজুরদের অনাহারে মরার খবর পাওয়া যায় তার জবার এই দায়িত্বের মধ্যে পাওয়া যাবে না।
            লক্ষ্যণীয়, বর্তমান ব্যবস্থার (ECA) বদলে খাদ্য নিরাপত্তা আইনের (NFSA) আওতায় এলে রেশনের পরিমান কমে যাবে, আবার রেশনের দর বেড়ে যাবে। দুদিক থেকেই লোকশান। হিসেবটা এইরকমঃ NFSA-তে এক কেজি চাল বা গমের জন্য ৩ টাকা দিতে হবে। ECA -তে দিতে হয় ৫৫ পয়সা। পরিমাণের দিক থেকে দেখলে, পাঁচজনের শ্রমিক পরিবার NFSA -তে ২৫ কেজি চাল/গম পাবে (NFSA -তে জনপ্রতি বরাদ্দ ৫ কেজি চাল/গম প্রতিমাস)। অথচ ECA-তে পাঁচজনের পরিবারের (২ মজুর ও ৩ প্রাপ্তবয়স্ক ডিপেন্ডেন্ট) প্রাপ্য ৫৫.৩৬ কেজি (ECA অনুযায়ী শ্রমিকদের ৩.২২ কেজি ও প্রাপ্তবয়স্ক ডিপেন্ডেন্টের ২.৪৪ কেজি প্রতি সপ্তাহ প্রাপ্য; ৪*(৩.২৬*২+২.৪৪*৩) = ৫৫.৩৬)।   
          অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে NFSA বলবৎ হলে মজুরদের রেশন ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এই অবস্থায় রাজ্য সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে বা ভেবেছে তা এখনও রহস্যে আবৃত। সব কিছুর অন্তঃস্থলে রয়েছে এক সহজ প্রশ্ন। NFSA-এর রেশনকে ECA-র রেশনের পরিবর্তে কেন ধরা হচ্ছে? দ্বিতীয়টা মালিকের দায়িত্ব, প্রথমটা সরকারের। মালিকের দায়িত্বকে সরকারের দায়িত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপন করা এক বহু পুরাতন খেলা। খেলা ফুরোলে দেখা যায় আমজনতার ট্যাক্সোর কড়িতে মালিকের পেট আরো স্ফীতকায় হয়ে উঠেছে।
          এ তো গেল রাজ্য সরকার। কেন্দ্র সরকার কেন FCI যোগান বন্ধ করতে গোঁ ধরে বসে আছে সে আরেক রহস্য। দ্বিমত নেই শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার দায়িত্ব মালিকের। কিন্তু মালিককে তার দায়িত্ব স্মরণ করানোর কাজে কংগ্রেসের রাজ্য সরকার বা ভাজপার কেন্দ্র সরকার, কারোই কস্মিনকালে আগ্রহ দেখা যায় নি। হরেদরে সস্তা খাদ্য আসছে FCI-এর গুদাম থেকে, অর্থাৎ সরকারি পয়সাতে। যখন সেই যোগান বন্ধ হতে যাচ্ছে মজুরের রেশন মার খাবে, মালিকের কেশাগ্র বঙ্কিম হবে না। হুট করে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে, আর মালিকের কী করা উচিত উপদেশ বিতরণ করার বদলে, কেন্দ্র সরকার বিভিন্ন পক্ষের (অবশ্যই মালিক ও মজুরপক্ষ) সাথে আলোচনায় বসে সমাধান সূত্র বার করার চেষ্টা করতে পারত। আসলে শ্রমিকের অধিকার কর্তন করাতে কংগ্রেসে ভাজপায় বিশেষ মতভেদ নেই।
          এই মুহূর্তে ওপরের ঘটনাবলী কংগ্রেসকে ঘ্যানঘ্যান করার সুযোগ দিয়ে দিয়েছেঃ NFSA লাগু করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা কেন্দ্র সরকার এখনো দেয় নি। মানে, জানুয়ারি থেকে ECA বাদ দিন, NFSA-এর রেশনও পাওয়া যাবে না।
         এক কাজিয়াভরা বিধানসভা নির্বাচন ২০১৬ সালে হতে চলেছে। ধার্মিক মেরুকরণ সম্প্রতি রাজ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছে যার ফায়দা ভাজপা লুটছে, কংগ্রেস জমি হারাচ্ছে। চা মজুরদের রেশনের ইস্যুতে কিন্তু বিবিধের মধ্যে মহান মিলনের দৃষ্টান্ত দুই পার্টি রেখেছে। ________________________________________________________________ প্রবন্ধের ইংরিজি সংস্করণ সংহতি ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে । বাংলা সংস্করণ গুরুচন্ডালি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই: