“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

নৈবেদ্য


।। মনোজিৎ দত্ত।।


















তো
মেঘ মেঘ চোখ
বৃষ্টি বৃষ্টি কথা
রোদ রোদ হাসি ...


আমার
গান পায় - কবিতা পায়
ক্ষিদে পায় - ঘুম পায় ...

কোনো কোনো ঘুম
শেষ ঘুম হয় ... তবুও ...

বৃহস্পতিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

'উজান সাহিত্য গোঠী' তিনসুকিয়াতে পালন করল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’




                     ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ শনিবার ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উপলক্ষে এবারও উজান সাহিত্য গোষ্ঠী বিভিন্ন অনুষ্ঠানসূচীর মধ্যদিয়ে এই দিনটি শ্রদ্ধার সাথে পালন করে।  বিকেল আড়াইটা থেকে  দুর্গাবাড়ি পূজা মণ্ডপে বহুভাষিক স্বরচিত কবিতা পাঠ, আলোচনা সভা এবং সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান  পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে উজানের সভাপতি সুজয় রায় ভাষা শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন, সঙ্গে জীবন সরকার, বর্ণালী সেনগুপ্ত, বর্ণালী চৌধুরী এবং অন্যান্য উজানের সদস্যরা গেয়ে উঠেন ২১শের গান ‘আমার ভায়ের রক্ত রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি’প্রদীপ জ্বালিয়ে মূল অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন  তিনসুকিয়ার প্রবীণ কবি নিখিলেশ্বর চৌধুরীসভাতে তখন শিল্পী কামিনী গোঁহাই এবং তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা গাইছিলেন ‘অসম সঙ্গীত’ ‘চির চেনেহি মোর ভাষা জননী’  এই নিয়ে তৃতীয় বছর এই অনুষ্ঠানে বিশেষ বক্তৃতানুষ্ঠানের আয়োজন করল উজান। এবারে আমন্ত্রিত বক্তা দু’জনের একজন ছিলেন কটন মহাবিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক এবং নাইন্থ কলাম কাগজের সম্পাদক প্রসূন বর্মণ। তাঁর বললার বিষয় ছিল ‘প্রীতির বীজ অঙ্কুরণঃ উত্তর পূর্বের বাংলা সাহিত্য’। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন ‘প্রীতির বীজ অঙ্কুরণ’ কথাটা তিনি নিয়েছেন কোচবিহারের রাজার আহোম রাজাকে লেখা একটি চিঠি থেকে, যে চিঠির ভাষা ছিল বাংলা। অসমে বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চার শুরু ব্রিটিশ আসবার পরে থেকে এই বিশ্বাস থেকে তিনি সরে আসবার কথা বলেন, এবং যথোচিত তথ্য দিয়ে নিজের বক্তব্য উপস্থিত করেন। প্রতিবেশী সমাজ চিত্রের উপস্থাপন এবং সেই সেই সমাজের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কের বৈচিত্র পূর্বোত্তরের বাংলা সাহিত্যকে এক স্বতন্ত্র চরিত্র দিয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। দ্বিতীয় বক্তা ছিলেন, তিনসুকিয়ারই বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি এবং লেখক, ‘পানচৈ’ কাগজের সম্পাদক কমল শর্মা। তাঁর বলবার বিষয় ছিল ‘অসমীয়া ভাষার প্রসার আরু সংকট’ । তিনি অসমিয়া ভাষার জন্ম লগ্ন থেকে ইতিহাসটা সংক্ষেপে টেনে ধরে ব্রিটিশ ভারতে তার প্রতিষ্ঠার সামনে উপস্থিত সংকট এবং সংকট মুক্তির কথা বলেন, সেই সংগে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সমাজের প্রতি প্রেম এবং দ্বন্দ্বের ইতিবৃত্ত তুলে ধরে বিশ্বায়ন যে নতুন সমস্যা সমস্ত মাতৃভাষার সামনে এনে হাজির করেছে, তাই নিয়ে সবাইকে একত্রে ভাবনা  চিন্তা এবং কাজ করবারা আবেদন রাখেন। এই দুই বক্তা ছাড়াও এবারে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল পূর্বোত্তরের বিশিষ্ট বাংলা কবি সঞ্জয় চক্রবর্তীকে। তিনি নিজের লেখা এক গুচ্ছ কবিতা পড়ে সভাকে সুরভিত করে তোলেন।  তাঁর কবিতার গুণমুগ্ধ ছিলেনই তিনসুকিয়ার কবিতা পাঠক এবং বাচিক শিল্পীরা। এই প্রথম কবিকে সামনে পেয়ে শ্রোতাদের উৎসাহ এক আলাদা মাত্রা পায়। আরেক কবি এবং যন্ত্র-সঙ্গীত শিল্পী অমিতাভ সেনগুপ্ত উজানের আমন্ত্রণে এসেছিলেন লামডিং থেকে । তাঁর মিনিট কয়েকের পরিবেশনা ‘তালের ভাষা’ দর্শকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়োয়।
         এই সব বিশেষ পরিবেশনা ছাড়াও অনুষ্ঠানে অসমিয়া কবিতা পড়ে শোনান প্রবীণ অসমিয়া কবি এবং লেখিকা পারুল শর্মা, ভোজপুরি কবি এবং সাংবাদিক কৃষ্ণ উপাধ্যায়, বাংলা কবি নীলদীপ চক্রবর্তী, পার্থসারথি দত্ত এবং স্বস্তি স্বাধন চক্রবর্তী। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন দুই কিশোরী শিল্পী পৌষালি কর এবং সুচয়িতা চক্রবর্তী।
            আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি, রবিবার দুর্গাবাড়ি শিশু বিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয়েছিল প্রাচীর পত্র আঁকা প্রতিযোগিতার।  চারটি বিভাগে এই প্রতিযোগিতাতে অংশভাগীদের  ‘আমার ভাষা আমার মা’, ‘আমার ভাষা আমার পরিচয়’ এমন কিছু নির্দিষ্ট স্লোগান বাংলা অসমিয়া এবং হিন্দিতে লিখে  চিত্রিত করতে দেয়া হয়েছিল। ২১শের অনুষ্ঠানের শেষে বিজয়ী প্রতিযোগীদের পুরস্কার তুলে দেন ডাঃ নক্ষত্র বিজয় চৌধুরী, সুজয় রায় এবং সুশান্ত কর প্রমুখ। পুরস্কার হিসেবে তাদের দেয়া হয় একটি প্রমানপত্র, স্মারক এবং শিলচর থেকে প্রকাশিত চিত্র শিল্প বিষয়ের অসমের একমাত্র দ্বিভাষিক কাগক ‘আর্ট-ইকো’র একটি করে  সংখ্যা। এই প্রতিযোগিতার জন্যেই তাঁরা বিশেষ করে কিছু স্যা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তাঁদের প্রশিক্ষকদেরও  স্মারক দিয়ে  সম্মানিত করা হয়। সম্মান স্মারক প্রাপক প্রশিক্ষকেরা হলেন, সর্বশ্রী ভানু ভূষণ দাস, কঙ্কন দাস,  সিদ্ধার্থ গৌতম বসু, সত্যজিৎ লোধ,  রমা বারৈ, এবং অভিষেক রায়। বিজয়ী প্রতিযোগীরা হলো ক বিভাগে (২য় শ্রেণি অব্দি )প্রথম- দীক্ষা দাস, দ্বিতীয়- পরিণীতা ঘোষ, তৃতীয় সুমেধা দে; খ বিভাগে ( ৫ শ্রেণি অব্দি) প্রথম-অন্তরা দেব, দ্বিতীয়-শাশ্বতী গগৈ, তৃতীয়- তনিশা সাহা; গ বিভাগে ( ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত) প্রথম সাক্ষী দাস, দ্বিতীয়- ময়ূরতৃষ্ণা দাস, তৃতীয়- বেদান্তিকা দেব রায়; ঘ বিভাগে ( ৯ম থেকে উপরের শ্রেণি) প্রথম অঙ্কিতা ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় সুষমা কর্মকার,  তৃতীয় আয়েশা চন্দ।   

                    ০০০০০০~~~~~~~~~~~০০০০০০০
নিচে অনষ্ঠানের কিছু ভিডিও দেখতে পাবেন, বিশেষত কবি সঞ্জয় চক্রবর্তীর কবিতা পঠের অ বিশে
  

বুধবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

মায়া

।। মনোজিৎ দত্ত ।।


(C)Iamge:ছবি


ছায়ায় ছায়ায় কত মায়া
মায়ার ছায়া মাটিতে পড়েনা
মন শুধু ভিজে উঠে 
নিভৃত আড়ালে ...

মঙ্গলবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

চিহ্ন যদি !!

|| শমীক চৌধুরী ||




 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 ।। শমীক চৌধুরী।।

 

 তগুলি চিহ্ন যা ভাষাকে করে সম্পূর্ণ।
 কোনটা আঁকাবাকা, কোনটা সোজা, কোনটা বা হেলানো।
 এদের অব্যবহারে বাক্য কি পেত  সঠিক ভাব ?
 প্রশ্ন , বিস্ময় , বৃহত্তর , ক্ষুদ্রতর , শোক-শংকা ,
 আনন্দ -বিষাদ  অপরিপূর্ণ  হতো সবই।
গুহামানব বোঝেনি তা।
 প্রস্তর লিপি দেয় নি সে মর্যাদা ।


 মানুষ , ইতিহাস থেকে নেয় শিক্ষা ।
 লজ্জাকর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি  অধিকাংশের কাম্য নয়।
বাকিদের তা কাম্য  অধিকাংশের জন্যে।
অধিকাংশ পাবে লজ্জা ফিরে এলে সেই ইতিহাস।
বাকিরা আনন্দ।


 কতগুলি চিহ্ন যদি -
মানবতাবোধ আর অবোধতার মাঝে পাঁচিল হতে পারে -

ঈশ্বরের ধর্ম

  
।। দেবলীনা সেনগুপ্ত ।। 




  

















র্ম মহাসভার দীর্ঘ সারির
    শেষতম স্থানে
    একা দাঁড়িয়েছিলেন ঈশ্বর
    প্রবেশাপেক্ষায়
    বক্তা এবং শ্রোতাদের প্রত্যেকে
    নিজস্ব ধর্মচিহ্ন সহ
    চিহ্নিত কুঠুরিতে প্রবেশ করার পরও
    তিনি দাঁড়িয়েই রইলেন
    একা,অসহায়,  বিভ্রান্ত
     কেননা,
     ঈশ্বরের কোন নিজস্ব কুঠুরি নেই
     ঈশ্বরের কোন ধর্মচিহ্ন নেই
     ঈশ্বরের কোন চিহ্নিত ধর্ম নেই
     প্রেম ও লালন ছাড়া,
     ঠিক এক একা নারীর মতো
      একা নারীর মতোই
     ঈশ্বরের দুচোখে আজ জল শুধু জল
     ভালবাসার ও ভালবাসতে না পারার

সোমবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

কুয়াশা এবং ...














।। মনোজিৎ দত্ত ।।

মাঝে মাঝে তোকে খুব
কুয়াশা কুয়াশা লাগে
চাদরে আবৃত রাখিস  
সরীসৃপ শীতলতা ...
       
তোর শান্ত-নীল চোখে নদী
তোর ঘন কালো চুলে বন্যতা  
হাতেগুনা তোর কটা শব্দে
নৈঃশব্দ নিবিড় গাছের পাতায় ...

একজোড়া রাতজাগা পাখি
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে -
তোর নাম দিয়েছিল-কুয়াশা
ভিজে ভিজে আলো ছায়ায়
গাছে গাছে পাতায় পাতায়
বিনিদ্র রাতে তারায় তারায়
কুয়াশার জলে বন্যা ...

রবিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

হেড়ম্বপুরের প্রীতিকথা --- রণবীর পুরকায়স্থ





সে তো আজকে নয়
প্রিয়তম প্রাণেশ্বরী ইত্যাদি প্রীতির ছায়ামাখা সম্বোধনে লেখা হয়েছে তখন প্রেমপত্র । এবং শেষে ব য় রফলা, ব্রজমোহন কিংবা ব্রজেশ্বরের আদ্যক্ষর । প্রমথর প য় রফলা । হেমাঙ্গিনীর হে । তন্ময় এত পুরনো নয়, তাই লেখে তোমারটি । সেটিও বাতিল হয় মল্লিকার প্রশ্নের জবাব জুতসই না হওয়ায় । মল্লিকা লেখে, কার টি । দুরকম অর্থের দোদুল্যমান প্রতিবাক্যে তন্ময় জানায়, তোমারটি, আবার কার । সেই চিঠি থেকেই নিজেকে বদলে নেয়, লেখে, ইতি তোমার তন্ময় । সম্বোধনে রদবদল হয়, লেখে প্রিয় মল্লিকা কখনও মল্লি । প্রথমে লিখিত কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা । মল্লিকাকে অনুরাগে বিশেষিত করা রবীন্দ্রনাথ সহায় । সেসব কথা, কথার দলিল । আর্য ফ্যাক্টরির তোরঙ্গ থেকে বাছাই করা পুরোনো নতুন ক’খানা প্রত্যয়িত দস্তাবেজ গুছিয়ে রাখে গোদরেজ সিন্দুকের রাঙামাটিতে । সেই সময়ের প্রিয় সড়কে ভ্রমণ যে তার নিত্যদিনের । পথের দুপাশে নতুন করে বনবীথি সাজায় তন্ময় । যা ছিল তা দিয়ে, যা নেই তাও থাকে নবনির্মাণের কর্মশালায়
    সুখ সময়ের মনোকথা পড়ে তন্ময় । কার্বন কপি থেকে উদ্ধার করে সংস্কারের সম্বোধন, প্রিয় মল্লি । মানে কয়েকবছরের পুরোনো হয়েছে সম্পর্ক ।
    ‘তোমার শেষ চিঠিতে বেশ কাব্য করে লিখেছিলে মেঘের বাহনে চড়ে চলে আসবে আমার কাছে । তুমি তো দেখি কালিদাসের বিরহের গাড়ি উল্টোদিকে চালিয়ে দিলে । এরকম হয় না, এখন পূর্বমেঘ চলছে, ম্যাপটা ঠিক হোক তারপর তো চড়ে বসবে । না হলে যে কোথা থেকে কোথা যাবে । আর গেলেই হল, কোথায় যাবে আমাকে ছেড়ে । আমি যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না এক মুহূর্ত । কোশিশ ছবির সঞ্জীব কুমার জয়া ভাদুড়ি আমরা । কথা বলতে পারি না দূরে আছি বলে, ইশারা পাঠাই । সংকেত লিখি ।
    আমি কোথায় থাকি জানো । দেশের নাম মণিপুর, জনপদ থানলন । একটা চার্চের গায়ে ডাকঘর আমার । ইম্ফল থেকে চুড়াচাঁদপুর চার ঘণ্টার বাসপথ । ওখানে থাকতে হবে একরাত । মাঝখানে বিষুণপুর । মণিপুর নিয়ে দুরকম মণিপুরির দাবি, একপক্ষে বলে তাদের রাজধানী বিষ্ণুপুর । ডানদিকের পথে না গিয়ে সোজা এগোলেই মইরাং । নাম শুনেছ হয়তো, আইএনএ সেনাবাহিনী নাগাপাহাড় দিয়ে মইরাঙে ঢুকছে । ওখানে আছে নেতাজির পূর্ণাবয়ব মূর্তি, আইএনএ স্মারক, ইত্তেহাদ, ইতমাদ, কুরবানি । আছে জাদুঘর । আরও একটা কিছু আছে এখানে, লোকতাক হ্রদ সত্যি তাক লাগিয়ে দেয় । হ্রদের জলে মানুষের গ্রাম, মাছের সংসার আর পরিযায়ী পাখি । একদিন ভোরের বেলা তোমার সঙ্গে বেড়াতে যাব স্বর্গপুরীর হ্রদের পারে । উল্টোপথ হয় যদিও, বয়স কম তো, একটু ঘোরাঘুরি হয় । আবার পথ সোজা করতে পিছিয়েও যেতে হয় । চুড়াচাঁদপুরে বিরতির পর গমন আবার । পথের বর্ণনা তো কালিদাস দিয়েছেন । দিনের শেষে উত্তরিবে এসে গির্জাবাড়ির ডাকঘরে, পাহাড় চূড়ায় । এখানকার স্থানীয় মানুষরা সিম্‌তে একটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী । আরও কত আছে, পাইতে, মার, মিজো, নাগা । ইশাই ধর্মাবলম্বী সবাই । ইশুকে ওরা ডাকে লালপা । আমাকেও ডাকে ঈশ্বর পুত্রের ডাকনামে । তুমি যেমন বলতে যৌবনের রবীন্দ্রনাথ । রোগা পটকা লোকটাকে রবীন্দ্রনাথ বলায় মিট্‌মিটে সুখ পেয়েছি । আমার দাড়ি আরও দীর্ঘ হয়েছে । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা খুব মনে পড়ে, এখানে মেঘ সরমার মত চরে । সরমা মানে কুকুর । গাভীটাভি নেই এদেশে । এখানে মাংস বলতে কুকুর আর শুয়োর । সারাবছর মেঘ আমার মতো বিরহী হয়ে পথ হাঁটে । ঝমঝমাঝম মিলন হয়, আমার হয় না । খাবারে কোনো বৈচিত্র নেই, পাহাড়ে কুকুর শুয়োর ছাড়া ডাল ভাত গেঁড়ি আর ইম্ফল চুড়াচাঁদপুর থেকে নিয়ে আসা রাই সর্ষের হলদে হয়ে যাওয়া পাতার সবজি, বলে লাইপাতা । সহকর্মী দুজন মণিপুরি, ওসব খাওয়া আমিও খাই । ওখানকার আদিবাসীরা আমাদের বলে ইন্ডিয়ান । আর, সিম্‌তে মেয়ে একটি আছে মারিয়া । ওর কিচেনে রাত হলে গ্রামের ছেলেরা জড়ো হয়, গিটার বাজিয়ে গান গায় । ওর দোকানে অনেক রকম পানীয় । আমাকে চা খাওয়ায় মারিয়া, আমার সঙ্গে নাচে । গান গাইতে বলে, গাই ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ , সুরেও লাগে, সবাই কোরাসে গায় বাংলা না জেনেও । মারিয়া তোমার মতো অনেকটা, এত প্রেমিক তবু নিঃসঙ্গ সে । আমাকে মনের কথা বলে, বলে এক ভারতীয় তার মনের মানুষ । কে সে বলেনি । রহস্য করে কী বলতে চেয়েছে বুঝিনি । তোমার যৌবনের রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে ফেলেনি তো । তার লালপা ।  মারিয়াকে ভাল না বেসে থাকা যায় না । তোমার কথা বলিনি ওকে । যদি প্রবাসের রাতগুলি আমার ব্ল্যাকআউট করে দেয়, সেই ভয়ে ।’
     তন্ময় চিঠি লেখে কার্বন কপি করে । এক হপ্তা ধরে চিঠি লেখা । সর্বক্ষণ সঙ্গে থাকে মল্লিকা । কথা বলা শুধু, কাগজে কলমে । ডাকঘরে তো অন্য কাজ নেই । রবিবারে গির্জাঘরে উৎসব হয়, গ্রামের টাটকা সবজি নিয়ে আসে ভক্তজন, ইশুকে উৎসর্গ করে । এত এত সবজি দিয়ে কী হবে, পাদ্রি ব্রাদার অনেকটাই বিক্রি করে দেয় । তন্ময়ও কেনে । সারাদিন তো শুধু রান্না করা, মেঘ দেখা আর চিঠি লেখা, এই তো কর্ম । রানার যেদিন আসে সেদিনই কাজ । সপ্তাহে একদিন আসে কাঁধে বৃষ্টিরোধক চটের থলি নিয়ে । কোনদিন খইদঙ কোনদিন রঘুমণি । ফেরার ডাকে তন্ময় ঢুকিয়ে দেয় তার ব্যাক্তিগত চিঠি । মাকে দাদাকে দু-একজন বন্ধুকে লেখা চিঠি দেয় ডাকব্যাগে । শুধু মল্লির চিঠিতে শেষ থাকে না, ডাকটিকিটও না । বিয়ারিং হওয়ার ভয় নেই, হাইলাকান্দি প্রধান ডাকঘরের চাকুরের কাছ থেকে তো আর শুল্ক নেবে না বিভাগ । মল্লিকার কাছে চিঠি লেখাও একটা লাগাতার বিষয় । তাই শেষ থাকে না । সাময়িক বিরতির একটা নাম দিয়ে, খামে ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দেয় । কখনও কখনও তোমার তন্ময় লিখতেও ভুলে যায় । খইদঙ কিংবা রঘুমণির ঘণ্টি বেজে উঠলেই মন আনন্দে নেচে ওঠে । গুণচটের থলিতে যে আছে সাতরাজার ধন মানিক, মল্লিকার চিঠি । ফেরার সময়ও ঘণ্টি বাজিয়ে যায় । বল্লমের ফলার কাছাকাছি কাঁধে থাকে ডাক পেটিকা । আর একটি ছোট পেটিকা থাকে কোমর কশিতে, ডাকহরকরার ব্যাক্তিগত সম্পত্তি । দশাসই চেহারার খইদঙ যখন নেমে যায় জঙ্গলে মনে হয় দৌড়বীর নামছে হাজার মিটার দৌড়ে । নিমেষে হারিয়েও যায় জঙ্গলের সুন্দর । সুকান্ত কবিতার  পত্রদূত অবিকল । শম্ভু ভট্টাচার্যর নাচ দেখিনি তন্ময় । দেখিনি মুকুন্দ ভট্টাচার্যর রানারও । তবে শুনেছে এখনও, এই সত্তর বয়সেও যুবাপুরুষ নেমে পড়েন মঞ্চে রানার নাচতে । মল্লিকা সন্দেহ করে তন্ময়কে, জানতে চায় কী করে জানে এত সমাচার । সে তো কলকাতার ছেলে । শিলচর যায়নি জীবনে, মুকুন্দদাকেও দেখেনি । তন্ময় জানায়,
    ‘শিলচরের শিখা দত্ত কাজ করে ইম্ফল জিপিওতে । ওদের একপাড়ায় বাড়ি, মুকুন্দদাদের । এপার ওপার রাস্তার উল্টোদিকে হেমলতা প্রেসের গলিতে বাড়ি । বলেছে সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিবেশ বাড়িতে । কেউ গানে কেউ নাচে পারদর্শী । ভাই অনন্ত ভট্টাচার্য লোকগানের ভাণ্ডারী, কয়েক হাজার গানের সংগ্রাহক । শিখার মতো মেয়ে হয় না বুঝলে, মণিপুরি গান গায়, নাচে, নাটক করে । স্বামী মণিপুরের বিখ্যাত নাট্যব্যাক্তিত্ব । সারা ভারতব্যাপী নামডাক । একদিন গেলাম কোয়াকাইথেলে ওদের নতুন বাড়িতে । শিখা আমার সঙ্গে সিলেটি ভাষায় কথা শুরু করে । আমি কিছুই বুঝতে পারিনি । কথাটা তোমায় বলি ‘হিদল খাইবা নি, ইরম্বা’ শিখার ধারণা আমি সিলেটি । আামার পদবি নাকি সিলেটি ছাড়া হয় না । আমি জানি । জন্মসূত্রে আমি সিলেটি বটে কিন্তু ভাষা জানি না । জন্ম কলকাতার ঝামাপুকুর লেনে, দেব সাহিত্য কুটীর-এর গলি, শুকতারা শিশুসাথীর বাড়ি । শিখা একটু থেমে যায় অপ্রতিভ । বলে এরকম শুঁটকি মাছের সিলেটি নাম হিদল, হিদলের সঙ্গে শুকনো লংকা কাঁচা সবজি কিছু কন্দ মিলিয়ে ভাপে তৈরি মণিপুরি ব্যঞ্জন ইরম্বা । ‘খাইবা নি’ র অর্থ খাবেন তো । খেয়েছি শিখার প্রলোভনে । পচাই মাছের গন্ধে আমার অনিচ্ছাকে পাল্টে দিয়েছিল মেয়েটি । খেয়ে সাবান দিয়ে মুখ ধুয়েছি দুদিন । এরপর থেকে শিখার বাড়িতে পরিচিত বাঙালি খাদ্যই পরিবেশিত হয়েছে । শিখার স্বামী ঐনাম তোম্বা থাকে দিল্লিতে, ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার শিক্ষক । প্রতিবেশী আমিও যাই নিত্যদিন, বিদেশি বিভূঁইয়ে একা রমণীর একমাত্র বাঙালি ভরসা, বন্ধু । শিখা একদিন... পরে লিখব । রানার এসেছে ।’
       এরকম ডটচিহ্নের মজা করে তন্ময় । ঈর্ষা জাগানিয়া শূন্যস্থান পূর্ণ করতে দেয় মল্লিকাকে । পুরোনো চিঠি পড়তে পড়তে তন্ময় হাসে । আসলে মল্লির সাদা মনে কাদা নেই, তন্ময় যা বলে তা-ই বিশ্বাস করে । কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় বিশ্বাস করেছিল সূর্য পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করে । প্রমাণও দিয়েছিল তন্ময় । কলকাতার প্রতিটি ল্যাম্পপোষ্টে, ফুটপাঠের স্কার্টিঙে লেখা ছিল এখনও যেমন আছে । নইলে রানারের কথা বিশ্বাস করে । ইম্ফলে রানার কোথায়, রাণারের দেশ থানলন থেকে কবে সরে এসেছে । তবে এও সত্য এরকম এক একটি চিঠিবোমার পর মল্লি অনেকদিন চুপ করে থাকে । চিঠি লেখে না । মল্লিকার চিঠি না পেলে তন্ময়ও ডাকে দেয় না তার দৈনিক বর্ণদূত । একবার তো একসঙ্গে তেষট্টি পাতার পার্শেল পাঠিয়েছে হাইলাকান্দি প্রধান ডাকঘরে । নয় হপ্তা কোনও চিঠি লেখেনি মল্লি অভিমানে । তন্ময়কেই মান ভাঙাতে হয়েছে লাইটনিং ডাকে, লক্ষ্মীবাজার বাড়িতে তো টেলিফোন নেই, পাশের বাড়ির নম্বর জোগাড় করে ডাক পাঠাতে হয়েছে । বড়সড় ফাঁকির স্তোকবাক্যে ভুলিয়েছে । মল্লিকাকে খুশি করতে বলেছে চাকরি ছেড়ে এবার হাইলাকান্দি চলে আসছে পাকাপাকি, কিছু একটা জুটিয়ে নেবে । তন্ময় এরকম মিথ্যে বলে, মল্লিকা ভাবে সত্যি । সত্য জেনে আবার অভিমান হয়, তন্ময় আবার বজ্রডাকে মিষ্টি করে বলে, এবার বিয়ের কথা পাড়বে হাইলাকান্দি গিয়ে । তবে চাকরি ছাড়ার কথাটা একেবারে মিথ্যে বলেনি তন্ময় । একটা মতলব আছে, নইলে কেন দুম করে ইস্তফা দিয়ে দেয় অর্থনীতির এম এ ।
      ইম্ফল থেকে ডিমাপুর যাওয়া খুব সহজ । সকালের বাস বিকেলে পোঁছে দেয় । তবে তন্ময় তো আর সহজ পথের পথিক নয় । সে সড়কপথে যাবে শিলচর, শিলচর থেকে ট্রেনে ছত্রিশটা পাহাড়ি সুড়ঙ্গ পার হয়ে যাবে লামডিং, লামডিং থেকে দুঘণ্টা তিনঘণ্টা বড়বাজার চারঘণ্টায় পৌঁছবে ডিমাপুর । হাতে সময় দশদিন । কার্ড এনভেলাপ ইনল্যান্ড লেটার বিক্রির চাকরি ছেড়ে ল্যান্ড লেবার ক্যাপিটাল আর অ্যাডাম স্মিথের কাণ্ডকারখানা নিয়ে কথা বলার চাকরি ডিমাপুর কলেজে  । তবে তন্ময় যে একেবারে বেহিসাবি তাও নয়, শিলচর যাওয়ার দুটো দিক সে খোলা রেখেছে । এক, হাইলাকান্দি লক্ষ্মীবাজারের লক্ষ্মীদেবীর সন্দর্শন, দুই, এই দশদিনে শিলচর হাইলাকান্দি করিমগঞ্জে কোথাও যদি একটা মাস্টারির চাকরি জুটে যায় । মল্লিকা বলেছে হাইলাকান্দির এস এস কলেজে একটা পোস্ট খালি আছে । তন্ময় বলেছে আবার গ্রাম । মল্লিকা বলেছে গ্রাম নয় শহর । সিনেমাহল আছে । টাউন হল আছে হাইলাকান্দিতে । আর আসাম হলেও ওখানকার মানুষ সবাই বাঙালি, সরকারি ভাষাও বাংলা । তন্ময় ভাবে মন্দ কী, মল্লিকাহীন জীবনের অনভ্যস্ততা কাটবে । মারিয়া শিখার সঙ্গে বেয়াড়া সম্পর্কও এড়িয়ে যাওয়া যাবে । আর কোথাও কিছু না জুটলে হুগলি নদীর পারে ঝামাপুকুর লেন তো রইলই ।
    স্থলপথে শিলচর ভ্রমণে এসেই সব ওলটপালট হয়ে যায় । এমন সুন্দর স্বদেশ যে থাকতে পারে জানতই না তন্ময় । মল্লিকাও বলেনি তার নদীমালার কথা । জিরি চিরি মধুরা ধলেশ্বরী সোনাই রুকমিনি এবং দূরের জাতিঙ্গা, দামছড়া । বড়াইল পাহাড় থেকে বের হওয়া বরাক সুন্দরীর আঁকাবাঁকা রূপ । কিছুদূর করিমগঞ্জেও গিয়েই আখের রসের মতো মিঠে পানির নদী কুশিয়ারা । ওদেশে আখের অন্য নাম কুশিয়ারা । ওপার বাংলাদেশে গিয়েই নৃত্যপরা নদীর নাম সুরমা । সুরমা থেকে ব্রহ্মপুত্র গঙ্গা হয়ে বঙ্গোপসাগর । তার মানে হুগলি নদীতেও ধলেশ্বরীর জলস্পর্শ আছে । এতসব জানার পর তন্ময় লেখে,
    “আমি এখন শিলচরে কুসুমানন্দ হোটেলে । এত কাছে তবু এত দূরে । তোমার সঙ্গে আর দেখা হল না । দুদিকের পথই বন্ধ, এদিকে মাটিজুরির পুল ভেঙে গেছে ওদিকে ধলেশ্বরের পথ জলমগ্ন । আমি কলকাতাই ফিরে যাব মনস্থ করেছি । প্লেনের টিকিট কেটে নিয়েছি । আমি অপেক্ষা করব তোমার, যতদিন না তুমি আমার হয়ে কলকাতায় আসবে আমি প্রতিদিন গঙ্গার ঘাটে যাব, দেখে আসব তোমাকে । তোমার ধলেশ্বরী শুনেছি এসে মিশেছে গঙ্গায় । নদীর মতো হয়ে তুমি কত কথা বলে যাবে আমাকে । তবে এবারের চাকরিছাড়া বেড়ানোটা খুব উপভোগ করেছি । এত পাহাড় ডিঙিয়ে তবে পোঁছতে হয়েছে তোমার কাছে । এত এত নদীগিরির শেষে । তোমার সঙ্গে দেখা হল না কিন্তু উপলক্ষ তো তুমি । শিলচরের এক কবি লিখেছিলেন – ‘তুমি আছ বলে মেঘে জল...’ তবে এত জলের কল্পনা কবি করেননি । এ কেমন অভিবাদন বলো, শিলচরে পা দেওয়ার পরেই ঝমঝমাঝম্‌ । কিন্তু এর আগের সব কিছুই তো দারুণ ছিল । পূর্বস্থলী ভ্রমণের সুখ ছিল । সেই চেনাপথ, চুড়াচাঁদপুর হয়ে । থানলন একরাত, রাতের গানবাজনায়ও কিছুটা লারেলাপ্পা । মারিয়া পাশে বসতে বলে, যেমন বসেছে গির্জাঘরের দিনগুলিতে । বসেছি পুরোনো দিনের উষ্ণতায়, উনুনের উত্তাপ আর অনেকদিন পরের মারিয়া আরও সুন্দর হয়েছে । মারিয়া বলেছে কলকাতা যাবে, পাহাড়ি মেয়েকে শহরে কেমন সুন্দর দেখবে কে জানে । মারিয়া আমাকে একটা ফুল আঁকা রুমাল উপহার দেয় বিদায়ের সময় । এবার যাত্রা পারবুং, থানলনের মতোই এক জনজাতি অধ্যুষিত লোকালয় । ওখান থেকে টিপাইমুখ, জিরিবাম । নদী পেরিয়ে জিরিঘাট ফুলেরতল নামের একটা ছবির মতো গ্রাম, টিলাভুমি আর সমতলের সুষম বণ্টন, আনারসের বাজার বিখ্যাত । মধুর মতো মিষ্টি বনের টিয়াফল । সোজাপথে শিলচর, মাঝখানে এক পিরের বাড়ি । জ্যান্তপির দেখিনি জীবনে । বাঁশকান্দির পিরের কেরামতি ভাঙা হাড়গোড় জুড়ে দেওয়ায় । আমি বললাম আমাদের জুড়ে দাও । পিরবাবা বললে, অভঙ্গ জোড়া যায় না । হাসলেন, শাদির বিধান দিলেন ।”
    তন্ময় হাসে । এটাও একটা নকল চিঠি । মানে ভুল চিঠি । মানে মিথ্যে কথা । মাটিজুরির পুল ভেঙে গেলেও মানুষ নৌকায় পারাপার করে, ধলেশ্বরের পথ জলমগ্ন হলেও মোহনপুর দিয়ে হাইলাকান্দি যাওয়ার ভিন্ন পথ আছে । এসব তাতিয়ে দেওয়ার, মল্লিকার মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার কথা । লিখেছে কার্বন দিয়ে, দুটোই রয়ে গেছে পেছন চালায় লুকোনো চালকুমড়োর মতো । কিন্তু এর পরেও তো লেখা হয়েছে একতাড়া । এমন তো নয় যে মল্লিকার সঙ্গে যখন দেখা হবেই তখন আর কেন লেখালিখি । নাকি নতুন বাংলা দেখার সুখে ভুলেই গেল প্রিয়তমাকে । তৃতীয় বাংলা বলে হোটেল ম্যানেজার মিথিলেশ । বলে বাংলার তৃতীয় ভুবন । বরাক নদী আর তার উপত্যকা নিয়ে খুব গর্ব অধিবাসীদের । তাই তো ওরা বাড়িতে থাকে না । কোথায় গেছে জানিয়েও যায় না । শিলচর এসেই পরদিন গেছে তন্ময় হাইলাকান্দি । প্রধান ডাকঘরে খোঁজ নিয়ে জেনেছে মল্লিকা ছুটিতে । বাড়িতেও তালাবন্ধ । আবার গেছে দুদিন পর, পড়শি বাড়ির কেউ একজন এসে বলল রোজকান্দি যেতে পারে । চাবাগানে ওর মামার বাড়ি । রোজকান্দি থেকে ফেরার পর চিঠিবন্ধের রাগ কমতে থাকে একটু একটু করে । চিঠি তো নয়, দেখা হওয়ার মাইনিউটস লিখে পাঠায় ।
    ‘ তোমার হাইলাকান্দি পৌঁছানোর দুরকম পথ আছে, একটা ডানদিকে একটা সোজা । ডানদিকের পথটা একটু দুর্গম, ফিরেছি সেই অগম্য পথেই । মাটিজুরি পর্যন্ত খানাখন্দ, নদী পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তা মাইলের পর মাইল, পাহাড়ের পর পাহাড়ের শ্রেণি । ডাকাতের ভয়ে গাড়ি ঘোড়াও কম সন্ধে হতে না হতে । পাহাড় শেষ হতেই গঞ্জের বাজার ধোয়ারবন্দ, মিজোরাম খুব কাছাকাছি, উগ্রপন্থীও আছে আশেপাশে । তবে সব ভয় ভাঙিয়ে দেয় তোমাদের চা বাগানের অপরূপ সৌন্দর্য । চায়ের কচি পাতার গন্ধে বিবশ হয়ে যায় মন । মন যে শুধু তোমাকে ডাকে, উৎকণ্ঠায় ভর করে পোঁছই রোজকান্দি চা বাগান । তোমার মামার বাড়ি, চা বাগানের, বিশাল এক সংরক্ষিত বনভূমি, জলাভূমি । দার্জিলিং গেছি, চা বাগান দেখা হয়নি দুচোখ ভরে । বাগান দেখা হয়, তোমার মামার বাড়ির আতিথেয়তা ভুলব না । তোমার মামির রান্না থোড় মচার ঘণ্টর স্বাদ এখনও ভুলতে পারিনি । হরিণের মাংস খেতে সুস্বাদু শুনেছি খেয়ে বুঝেছি শোনা কথায় স্বাদ মাপা যায় না । দারুণ । মাছ মাংসের লোভে শাক সবজির লোভে মনে হয়েছিল থেকে যাই বাকি কয়েকটা দিন । কুসুমানন্দয় আর ফিরব না । তোমার মামার বাড়িতে কোন পরিচয়ে থাকি বলো তো । তোমার মামা তোমাকে ভালবাসেন খুব । আমাকেও অপছন্দ হয়নি । তোমার বাবাকে তো বলেই দিলেন বিয়ে হবে বাগানের বাড়িতে । এত আয়োজন লোকজন লক্ষ্মীবাজারে পাওয়া যাবে না । বাংলা সিনেমার প্রেমের দৃশ্যে যেমন সাইড টক হয়, আমিও বাবা মামার কথার মাঝেই তোমার কানে শুনিয়ে দিই ডায়লগ,
--- দেখলে তো পিরবাবার কথা মিলে গেল ।
তুমি অবাক অভিনয়ে বলেছিলে,
--- কী কথা ।
--- শাদির কথা ।
--- বিয়ে । ও তো কথার কথা । বাল্কের হাতে নাড়ু ধরিয়ে শান্ত করা ।
--- আমিও বালক ।
তুমি চোখের ইশারায় কোনও স্মৃতি উস্‌কে দিয়েছিল প্রগলভতায়,
--- বালক ব্যাঘ্র । সে না হয় হল, কিন্তু এই পিরবাবাটি কে । তুমি যে বললে গুরুদেব ।
--- সে আছেন একজন শালগঙ্গায় । তিনিও বললেন বিয়ের কথা ।
--- গেছ তুমি আশ্রমে ?
--- গেছি । তিনি খুব ভালোমানুষ । প্রচুর ধনসম্পত্তি । পুরিয়া করে কদমগাছের মাটি বিক্রি করেন । মানুষের অগাধ ভক্তি ।
  তুমি সন্দেহ করেছিলে আমার কথায় ।বলেছিলে,
--- গুরুদেব কিন্তু বাক্‌সিদ্ধ ।  
আমিও যুদ্ধে গেছি । বলেছি,
--- তাই তো মনে হচ্ছে । বললেন বরাক ভূমিতে সুলক্ষণা পাত্রী পাওয়া যাবে না ।
--- কেন ?
--- শব্দদোষ আছে । বাক্যদোষও আছে ।
--- তাহলে আর কী, চলে যাও খাচ্ছি যাচ্ছির দেশে
 সত্যি বলছি তোমার চোখে সেদিন আমার সর্বনাশ দেখেছি । রাগলে পরে তোমাকে সুন্দর দেখার সৌভাগ্য হয়েছে সেদিন ।’
 শব্দদোষ আর বাক্যদোষের কথা বললে সিলেটিরা রাগে । সিলেটের বাঙালিদের বাংলার উচ্চারণ একটু ভিন্ন । অনেক বর্ণে অকারণ জোর দেয় । শব্দ প্রকরণও একটু খটোমটো । তন্ময় চলে আসে শিলচর পরদিন, মল্লিকা থেকে যায় মামারবাড়ি । কোনও কথাই হয় না । সবসময় বড়রা ছোটরা ঘিরে রইল যে । মল্লিকাও কোনও উৎসাহ দেখায়নি একটু সময় বের করার । তাহলে কী দাঁড়াল। মল্লিকার মনের পরিবর্তন । আর ভালো লাগছে না সহপাঠী বন্ধুকে, নাকি নতুন বন্ধু হয়েছে কোনও ডাক বিভাগের কর্মী । লক্ষ্মীবাজারে পাশের বাড়ির অতি উৎসাহী যুবকটি কী, যার নাম দেবাশিস কানুনগো, যে দিয়েছে বাগানের সূত্র । স্থানীয় ভিক্টোরিয়া স্কুলের মাঝবয়সি ড্রইং মাস্টার । তাও বা কী করে হয়, সেই কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে ফাজলামি করার মতো সংলাপও তো বলে গেল প্রেমের প্রথামতো । ডায়লগের শেষে রাগ অভিমানটাও একই আছে । কুঞ্জদ্বারে তার সদাজাগ্রত বনমল্লিকা তো তাহলে একই আছে । তবু কেন উচাটন যায় না । শহরের কেন্দ্রে হোটেলটাও মন্দ না, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন খাওয়া ভাল থাকা সস্তা । মায়া হোটেল গ্র্যান্ড হোটেল থেকে ভাল । আরও কয়েকটা দিন থাকাই যায় । কিন্তু তন্ময়কে টানে রোজকান্দি চা বাগান । তাই চিঠি লেখা বন্ধ কয়েকদিন । কয়েকদিন পরের চিঠিটায় থাকে নতুন মোড় ।
    ‘ হোটেল ম্যানেজার একটা ভ্রমণ ইটিনিনারি তৈরি করে দেয় আমাকে । প্রথম দিন খাসপুর, কাছাড়ি রাজার রাজধানী, এখন ধ্বংসাবশেষ । দেখলে তো বাঁশকান্দির পিরবাবা আর শালগঙ্গার বাবাজির কথা কেমন মিলে গেল । দুজনেই বলেছিলেন যেতে । অভীষ্ট সিদ্ধ হবে । কিসের অভীষ্ট কে জানে । নতুন জায়গা দেখার আনন্দ আমার সবসময় । গিয়ে তো ভালই হল । এক বিশাল রাজত্বের কথা জানা গেল । একদিকে মধুরা আর একদিকে নাক্‌টিছড়া নদী দিয়ে সুরক্ষিত রাজধানী এখন দুই চা বাগানে বিভক্ত । শিবেরবন্দ ও খাসপুরে মদেশিয়া চা শ্রমিক ছাড়াও কাছাড়ি বর্মনদের বাস । যদিও খাসপুর ও থালিগ্রামের বাইরে সেই রাজবংশীয় জনগোষ্ঠী একেবারে কোণঠাসা । কবেই রাজ্য ভেঙে দুভাগ হয়েছে । হিড়িম্বারা উত্তর কাছাড় ও মিকির পাহাড়ে আর বর্মনরা খাসপুর সহ কাছাড়ে । খাসপুরে শুধু চুন সুরকি আর খসা পাথরের ভাঙা রাজ-অট্টালিকা এখন জঙ্গলাকীর্ণ । রক্ষণাবেক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই । একা বোকার মতো দেখি আর ভাবি কী বিখ্যাত ছিল রাজধানী । সংলগ্ন গ্রাম থালিগ্রামে গিয়ে জলতেষ্টা পায় । নিতান্ত কৌতূহলের তেষ্টা । রাজরাজড়াদের নিয়ে বিশদ জানতে গ্রামবাসীর মতো সানন্দ সহায় কেউ হয় না । শহরে থাকতে গ্রাম সম্পর্কে কোনও ধারণাই তো গড়ে ওঠেনি আমার । প্রথম ধাক্কায় থানলনের জনমানবহীন পাহাড় গ্রামে দেখলাম শুধু আকাশবাড়ির মেঘ আর ডাল বরাবর গৃহপালিত কুকুর । মারিয়ার কিচেনে নিশিবাসর । আসল গ্রামের চেহারাটাই চিনতে পারতাম না থালিগ্রাম না এলে । বাঁশের বেড়া দেওয়া বাড়ির সীমানায় যে গেট, তাকে ওরা বলে ঘাটা । এ কেমন নাম, নদীর ঘাট নাকি । ঘাটা খুলে যে কেউ ঢুকে যেতে পারে, কোনও বাধা নেই । মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক, আর পাঁচজন বাঙালির মতোই দেখতে, কথাবার্তাও স্থানীয় বাংলায় । তবু কোথাও একটা ব্যতিক্রম আছে, সে কি চোখের পাতায়, একটু ছোট, চিন, বর্মি কিংবা নেপালিদের একটা আদল । কিন্তু ব্যক্তিত্বের কম নেই কোথাও, আবার একটা মিষ্টি স্বভাবের আভাসও আছে । আমাকে দেখেই চিনতে পারেন, বলেন কলকাতা থেকে আসছেন । আমি হ্যাঁ এবং না–এর আমতা আমতায় মণিপুর থেকে শিলচর পর্যন্ত স্থলপথের ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনিয়ে দিই । মাটির দাওয়ায় বসতে দেন একটি আসনে, জানি না সতরঞ্চি বলে কী না আসনটিকে । ছোট একজনের বসার মাপে তোমার মামার বাড়িতে দেখেছি, বলেছিলে সুজনি । সুজনি থেকে আলাদা রংবেরঙের সুতোয় বোনা, একেবারে অপ্রতিম, অন্যরকমের সুন্দর এই আসনখানি । সুন্দর এখানেই বসতে ডাকছে । এরমধ্যেই ভিতরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আর এক সুন্দর, হাতে জলপাত্র অন্য হাতে থালা, থালায় কয়েকটি নাড়ু, সম্ভবত নারকেলের । আমি দেখছি যুবতীর পরিধেয়, সবুজ হলুদে মেশানো, শাড়ি নয় কিন্তু শাড়ির মতোই, ফানেকও নয়, অসমিয়া মণিপুরি সংমিশ্রণ । মেয়েটি গৌরী, দীর্ঘাঙ্গী । দুভাগ কিংবা তিনভাগের কাপড়ে এক অপরূপা । গৃহস্বামী মধুমঙ্গল বর্মন বলেন, আমার মেয়ে কাঞ্চনী । আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় অন্য প্রশংসা, এত মোলায়েম, এত কোমল । এদিকে কাঞ্চনী ওদিকে আসন । তোমাদের দেশের সুজনিতে হাত দিয়ে অনুভব করি সুন্দরকে । বিব্রত হয়ে বলি সুখাসন কথা । ঘরের বোনা ছোট মাদুরখানার নাম পাতঞ্চি । অবিবাহিত মেয়েরা বোনে । গুটিপোকার সুতো দিয়ে বোনা । প্রশংসিত পুত্রীর সঙ্গে পিতারও ভাল লেগে যায় বিদেশি পথিককে । শুধু জল নাড়ু নয়, দ্বিপ্রাহরিক ডালভাতের নিমন্ত্রণও রক্ষা করতে হয় সেদিন আমাকে ।’
     মধ্যমা আর তর্জনী তর্জনী আর মধ্যমা করে করে তন্ময় মধ্যমাকেই জিতিয়ে দেয় । মধ্যমায় যে থালিগ্রাম । থালিগ্রাম থেকে ফিরে এসে তন্ময় হোটেলবন্দি হয়েই থাকে । মল্লিকাকে কথা দিয়েও হাইলাকান্দি যাওয়া হয়নি । বেচারি ছুটি শেষ করে ফিরে যাবে বলছে হাইলাকান্দি । এদিকে যে শিলচর ছেলেদের সরকারি স্কুলের বাংলাভাষার শিক্ষক মধুমঙ্গল বর্মনের অপেক্ষায় থাকতে হয় । শুধু মধুমঙ্গল নয় কাঞ্চনীর জন্যও অপেক্ষা করে তন্ময় । মধুমঙ্গল না এলে ভাবে সে-ই যাবে আবার থালিগ্রাম, শেষবারের মতো দেখে আসবে ডাকের সাজের প্রতিমা । আবার অভিমানও হয়, অস্থায়ী ঠিকানা তো দিয়ে এসেছে, একদিন দেখা দিতে পারত পিতা কন্যা । যেদিন দুপুরে তন্ময়ের মধ্যমা নেচে ওঠে আনন্দে সেদিন রাতেই লেখে মল্লিকাকে ।
   “ জানো, আমার মনের জোরকে জিতিয়ে দিয়ে আজ কুসুমানন্দ হোটেলে এলেন মধুমঙ্গল বর্মন । সুদৃশ্য মোড়কে এক উপহার নিয়ে । বললেন, পাতঞ্চি । বললেন আপনার ভাল লেগেছিল, আমার মেয়ে নিজের হাতে বুনেছে । আমরা এই মহার্ঘ বস্তুটি সমাজের বাইরে দিই না । আপনি ব্যতিক্রম তাই একটি শর্তে এই উপহার । আমি বলি, উপহারে শর্ত থাকে না । মধুমঙ্গল বলেন, জানি, না মানলে কিছু করার নেই, এ শুধু সামাজিকতা । অবিবাহিত মেয়েরা তাদের প্রিয় পুরুষকে দেয়, প্রথা বলতে পারেন । মানুষটির আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে বলি, তবে তাই হবে । মেনে নিই শর্ত, আপনার কন্যা কাঞ্চনী আমাকে প্রিয় ভেবেছে এইতো বড় উপহার, পাতঞ্চিটাও সঙ্গে থাকল । এবার বলুন শর্ত । মধুমঙ্গল এবারও বিনীত, বলেন, শর্ত কিছুই নয়, শুধু নিজের কাছে রাখবেন । তিনি আবার বলেন সংযোজনে, প্রিয়র কাছে থাকা মানে তো নিজের কাছেই থাকা । আমি বলি, আচ্ছা । প্রিয় ছাড়া কাউকে দেব না, নিজের কাছেই রাখব । টা আপনারা এই সুদৃশ্যে সুজনি ছাড়া অন্য জিনিস করেন না । তিনি বলেন, হ্যাঁ আমাদের বাড়ির মেয়েদের সব কাপড়ই তো নিজস্ব তাঁতে বোনা, গামছা পাতঞ্চি আমরা পুরুষরাও বুনি । তন্ময় বলে, না, বলছিলাম, আসামে তো এন্ডি মুগা পাটের কাপড়, আরও অনেক কিছু তৈরি হয়, জাপি, বাঁশ বেতের জিনিস, প্রয়োজনীয় ঘর সাজানোরও মধুমঙ্গল বলেন, ওসব করে বাঙালি নমশূদ্ররা, বোনে পাটের কাপড় অনেক রকম । আমরা শুধু পরম্পরা বজায় রাখছি । সবাই তো এখন শহরমুখি । অবাক কাণ্ড বলো তো, এত সুন্দর সিলেটি বাংলায় কথা বলেন তবু বলছেন বাঙালি নমশূদ্র কথা । আপনিও তো বাঙালি, আমার সপাট প্রশ্নের জবাব দেন মধুমঙ্গল বিনীতভাবে । আমরা বাংলাভাষায় কথা বলি কিন্তু আমরা ডিমাছা । বাউলা রাজার বংশধর । কাছাড়ের বর্মনরা খুব সুখী, সাদাসিধে মানুষ । সে কী আর বলতে, বইয়ে পড়েছি নীলদর্পণের দীনবন্ধু মিত্র একবার এসেছিলেন থালিগ্রাম কার্যব্যপদেশে, নিয়ে গেছিলেন একজোড়া কাপড়ের জুতো বন্ধুর জন্য । বলেছিলেন ভালমানুষের দেশ থেকে আনা । জুতো জোড়া উপহার দিয়ে বলেছিলেন ‘কেমন দিলাম’ । বন্ধুর জবাবও ছিল জুতোসই, বলেছিলেন ‘তোমার মুখের মতো’ । রসরাজ বঙ্কিমের কথা বড় মুখ করে বলে বেড়িয়েছেন দীনবন্ধু ।”
    তন্ময়ের মনে এখন অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব । কী হয় কী হয় । মল্লিকার মন বোঝা যে ভার । বিয়ের কথা বললে এড়িয়ে যায় । বলে চাকরি নেই । বলে, এরকম বোকা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো যায় না । মল্লিকা কেমন যেন এক বদ্ধ ঘরের বন্দিনী হয়েই রইল তার জীবনে । তাই তন্ময় যেখানেই যায় ভিন্ন রমণী নিয়ে উপাখ্যান লেখে চিঠিতে । মল্লিকাকে ঈর্ষান্বিত করে । কিন্তু মল্লিকা যে এক অনড় অস্তিত্ব তার জীবনে সে কোথাও বারবার বুঝিয়ে দেয় তার বিশ্বাস দিয়ে । মারিয়ার কথা, শিখার কথা মাঠে মারা যাওয়ায় হতাশ তন্ময় পিরবাবার কথা সাজায়, সাজায় সাধুবাবার শব্দদোষ কথা । শেষ পর্যন্ত কাঞ্চনীকেও সাজিয়েছে । খাসপুর এবং তৎপরবর্তী ঘটনার বিবরণ দেওয়া পত্রলেখা নিয়ে তন্ময় এবার কুসুমানন্দ ছাড়ে । ডিমাপুর কলেজে জয়েন করার আগে একটা হেস্ত নেস্ত হোক । এবার যাওয়া হাইলাকান্দি । অভিজ্ঞান পৌঁছে দিতে প্রিয়গমন । মধুমঙ্গল যে বলেছেন প্রিয়র কাছে থাকা নিজের কাছে থাকা । বাংলার শিক্ষক মনের কথা সাজিয়ে দিয়েছেনরোজকান্দি বাগানের কাছাকাছি বড়জালেঙ্গা পৌঁছেই মনে পরে তার শর্তাধীন উপহারটার কথা । মনের আসনের যে কত নাম, পাতঞ্চি নামটা বড় মনের মতো রঙে রং করা । স্বপ্নে দেখা আসনখানি মল্লিকাকে দিয়ে সে নির্ভার হবে এবার । শিখা মারিয়া কাঞ্চনীর প্রিয়নামও সমর্পণ করবে মল্লিকায় । ব্যাস আর কাকে ভয় । সন্ধ্যা আঁধারে তাই বাগবাহারের অরণ্যপথেও সে নিঃশঙ্ক, যেখানে ডাকাতের হা রে রে রে ভয় । বিকল চিত্তকে মুচকি হাসি দিয়ে ঠিক করে নেয় তন্ময়, সন্ধ্যা সমাগমের আগেই সে পোঁছে যায় প্রিয়াভবনের প্রধান ঘাটায় । তার পরই তো লক্ষ্মীর ঘর, লক্ষ্মীবাজার, শহর হাইলাকান্দি ।
সে আজকে নয়        
   তন্ময় মল্লিকার এখন কথাও লেখা আছে চিঠিতে । খোলা তোরঙ্গের মণিমুক্তো সাজিয়ে নিলেই তো আখ্যানের বিস্তার আবার । তাই, আপাতত সবুর, বিরতি ।
                                               (সকালবেলা) 

চব্বিশ ঘন্টার একুশ

 ।। মনোজিৎ দত্ত।।

 
 
(C)Image:ছবি



















মার মা'র মুখের মায়ায়
প্রতিদিনের 'একুশ' আঁকা
তবু আজও 'একুশ' চব্বিশ ঘন্টার
মা'র নাভি বেয়ে
আমার ধমণীতে
একুশের প্রবাহ
তবু 'একুশ' আজও চব্বিশ ঘন্টার


ক্যালেন্ডারের 'একুশ'
ঘড়ির 'একুশ'
কবিতার 'একুশ'
মাউথপিসের 'একুশ'
মঞ্চের 'একুশ'
একুশের মায়া আঁকে
তিন একুশের বিবর্ণ চোখে
একুশের বিশ্বায়নে ...

'একুশ' আজও চব্বিশ ঘন্টার

শনিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

ধর্মের বোতল? ধর্মান্তরিত জলের-বোতল!

।। পার্থঙ্কর চৌধুরী।।

স্থান, চৌরঙ্গি, শিলচর শহর। ২০১৪। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। সময় আনুমানিক সকাল ১০টা। দামী ‘ব-লে-রো’ গাড়ি। নম্বর-প্লেট WB দিয়ে শুরু; বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটা পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা। ‘কৃষ্ণ বলো- আগে চলো’। সামনে-পিছনের বাম্পারে বলিষ্ঠ অক্ষরে লেখা। আপাততঃ স্তব্ধ গাড়ি। ভিতরে কেউ বসা নেই।  মিনিট খানেক পর নাক থেকে কপালের পুরোটা জুড়ে তিলক কাটা বছর ২৩-২৪ বছরের এক তরুণী ভক্ত দেখা গেলো। এর আরও এক মিনিট পর ঐ একই  উঠতি বয়সের তরুণ ভক্ত। দুজনেই স্তব্ধ গাড়ির এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করছে।
এর আরও দু মিনিট পরের ঘটনা।
          গাড়ির দরজা খুলে নিমিষে ৩-৪ টা জলের বোতল ছুঁড়ে ফেলা হল, পরিস্কার রাস্তায়, হরিদাস-বাবুর পাড়ায়।  
            আরও এক দেড় মিনিট পর…!
          দাড়িওয়ালা মুসলমান এক রিকশাওয়ালা যাচ্ছিলো ঐ পথ দিয়ে। ফেলে দেওয়া খালি বোতল-গুলো দেখে দাঁড়ালো একটু। নিমিষে বোতল গুলো তুলে নিল। রিক্সার সীট খুলে সে জায়গায় পুরে নিল বোতল গুলো। পুরো ব্যপারটাই ৩-৪ মিনিটে সম্পন্ন হল।
         যে বাস্তব ঘটনাটা এই মাত্র বললাম, সেটা তেমন বড় কোনো ঘটনা নয়। অন্ততপক্ষেঃ আমাদের এই শহরে। চারদিকে যেরকম ধর্মা-ন্তি-করন নিয়ে  হাল্লা, চিৎকার, প্রতিবাদ- প্রসঙ্গ হচ্ছে, তাই জিগ্যেস করতে ইচ্ছে হল, (বোতলকে  Personify-করে), এই ‘বোতলের ধর্ম’  পরবর্তীতে কী হবে’?
         নিজের অজান্তে যে বোতল গুলো ধর্মা-ন্তি-রত হয়ে গেলো… তা নিয়ে কেউ কি গেলো-গেলো রব তুলবে না? আর, পরিবেশ-প্রসঙ্গ কি একে বারেই বাদ…? বাদ দিয়েই কি প্রগতির ‘ব-লে-রো’ আগে চলবে…?’

সংবেদনশীল-দের প্রতীকী এই ঘটনা, কিছু ভাববার খোরাক দিচ্ছে কি…?  

আমার প্রথম প্রেম - সেই Phone Call

।। বৈশালী ঘোষ ।।
 
(C)Image:ছবি

নেক বছর আগের কথা, আমি ক্লাস এইট এ পড়ি।যৌবন আমার জীবনের দরজায় সবেমাত্র কড়া নাড়া শুরু করেছে। গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়েছে, তারপরই পরীক্ষা।তাই পড়াশুনোর চাপটা একটু বেশিই ছিল। মা রোজ দুপুরবেলা আমাকে অঙ্ক করতে বসাতেন।আর নিজে কিছুক্ষনের জন্য বিশ্রামে যেতেন।
         ওই দিনটাও সেই নিয়মেই চলছিল। মা হয়ত বিশ্রাম করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পুরো বাড়িতে একটা নিস্তব্ধতার ছায়া নেমেছিল। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। প্রথমে ঘাবড়ে গেলাম। মা জেগে উঠবে, ওই ভয়ে দৌড়ে গিয়ে ফোনটা ধরলাম।
-   ‘Hello কে বলছেন ?’
-   ‘আমি’ - একটা দৃঢ় পুরুষালি আওয়াজ।
-   ‘আমি ? আমিটা কে ?’ বললাম - ‘কাকে চাই, আপনার নামটা কি ?’
-   ওপার থেকে প্রশ্ন ‘নাম টা কি খুবই জরুরি?’
-   ‘হ্যাঁ জরুরি।‘
-   ‘তোমার নাম কী ?’
আমি নিজের নাম বললাম । ওই দিন, দশ মিনিটের মত কথা হয়েছিল। চেষ্টা করেও ফোন টা আমি ছাড়তে পারিনি। সারাদিন একটা অন্য রকম অনুভূতি ঘিরে ছিল।
           ফোনটা রোজ দুপুরবেলা আসা শুরু করল। আর আমার ওই ফোনের অপেক্ষায় থাকা।নানা রকম কথা বলতাম আমরা - দেশ, বিদেশ, পাহাড়, নদী সব কিছুই থাকত আমাদের গল্পে।ওটাকি প্রেমের অনুভূতি ছিল ? ওটা বোঝার বুদ্ধি আমার ছিল না। আজকালকার ছেলেমেয়েরা আমাদের মত লোকেদের Stupid বলবে।
            ওই গলার দৃঢ়তা আজও আমার শরীর মনে চমক লাগায়।স্কুল খুলে গেল। আমি Busy হয়ে পড়লাম।  ফোনটা  হয়ত এসেছিল, মা receiveও করেছিল নিশ্চয়ই।কিন্তু, আমি আর কখনো ওই গলাটা শুনতে পাইনি।মাও কিছু আমায় জিগ্গেস করেনি কোনোদিন।আমি আজও বিশ্বাস করি  ফোনকলটা আমার খোঁজে এসেছিল।
            আমার MARRIAGEটা  LOVE করেই হয়েছিল।এখন আমার ছেলে ক্লাস এইট-এ। হয়ত ওর জীবনেও ওরকম একটা Phone Call আসবে – ‘Hellooooooooooooo………’


শুক্রবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

মা-মাটি-মানুষ

।। মনোজিৎ দত্ত ।।




















জকাল আমার আনমনা মা
তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে
মাটি তাকিয়ে আছে
ভিজে চোখে মানুষের দিকে
মানুষগুলি স্বপ্নজ্বড়ে
স্বপ্নের কাঁধে শব্দের তান্ডব ...