“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

ওরিওলিডি

 ।। সুব্রতা মজুমদার।।

          

  
        এ
ই মাস কয়েক আগের কথা । প্রলয় বাবুদের পেঁপে বাগানে একটি ওরিওল এসে বসেছিল । অ্যামেরিকান না ইন্ডিয়ান ই । এটা প্রথমবার নয়, ওরিওল প্রায়ই ওর বন্ধুদের নিয়ে ওই পেঁপে বাগানে আসে । কিন্তু সেদিন ধরা পড়ে যায় বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে আসা মিস্ত্রী লোকমান আলির হাতে । প্রলয়বাবু চা বাগানের বাবু, তাঁর বাড়িতে এতো পেঁপেগাছ রয়েছে যে বাগানের শ্রমিকরা কেউ কেউ তাঁকে ‘পিপা বাবু’ ও বলে । এতো বিশাল ওঁর পেঁপে বাগান । প্রতিদিনই নানা রকমের পাখি আসে পাকা পেঁপে খেতে । চা বাগানে এমনিতেও অনেক রকমের পাখি দেখা যায়, সব কটার নামও সবাই বলতে পারে না ।

           লোকমান আলি সেদিন প্রলয়বাবুদের বাড়িতে রিপিয়ারিং এর কাজ করছিল । চা বাগানের এটা নিয়ম-- পারতে কোথাও নতুন বাড়ি ঘর করা হয় না, ওই যা আছে এটার মধ্যেই মেরামত চলে । খানিকটা মা-ঠাকুমার চুড়ি যেমন ঘষে-মেজে চলতে থাকে সেরকম । এসব ক্ষেত্রে বাবু-শ্রমিকের অবস্থান প্রায় একই । এজন্যই তো বলে ‘বাবু-শ্রমিক ভাই ভাই/ আদায় করব পাই পাই’ । সে যাকগে ভাঙা টুটার মধ্যে জোড়াতালি লাগিয়েই চলে, আর এই ভাঙা জোড়া দেয়ার মানে ওদের ভাষায় রিপিয়ারিং এর কাজ একমাত্র লোকমান আলিই ভালো জানে তাই সব বাড়িতেই ওর ডিমান্ড । লোকমান আলির আবার একটা স্বভাব রয়েছে, হবি বলা যায় । রাস্তার কুকুর, বেড়াল যদি এমনি পড়ে থাকতে দেখে, বা কোন সময় কোনো সুন্দর পাখি দেখে, তখন তার বাড়ি নিয়ে যায় আর নিজের সন্তানের মতো আদর যত্নে রাখে । সে কিন্তু একা নয়, বাড়িতে সবাই আছে ওর । তিন বউও আছে, ছোটবউ এর ঘরে সন্তান না থাকলেও লোকমানের ছেলেমেয়ে সব মিলিয়ে সাতটা । সেদিন বাবুদের বারান্দায় বসে লোকমান চা খাচ্ছিল, প্রলয় বাবুর স্ত্রী লোকমানকে চা দিতে দিতে বলছিলেন,

--- উড়িয়া আও উড়িয়া আও কইয়া আর কারে ডাকিয়া আনতে রে, কালকেউ নু গেলা এক পার্টি ।

লোকমান কিছু বুঝে উঠতে পারে না, তাই জিজ্ঞেস করে,

--- হামকে কিছু বলছো ঠাকরান ?

--- তুমারে নায় বা । অউ শুনরায় নানি আমরার কয়ফল বাগানো উড়িয়া আও পাখিয়ে ডাকের, এরা ডাকলে কুটুম আইন, কুটুম পাখি বা । কালকেউ গেলা আমার এক মাসিশাশুড়ির পরিবার, আজকে আবার ডাকের, অখন আবার কে আইতা কি জানি ।  

--- কুটুম আসলেও কোনো চিন্তা নাইখে ঠাকরান, বাগানের ফিরি আটা তো আছেই ।

--- অয়, কিন্তু শুনা তো যার ইতাও বন্ধ অই যাইব ।

--- না না কেউ নাই মানবেক । 

--- তুমরা আর মান্তায় না মান্তায় কিতা । তুমরারে তো যেরকম রাখব কোম্পানিয়ে, ওরকমউ ... 

  প্রলয়বাবুর স্ত্রীর কথা শেষ হওয়ার আগেই পাখি আবার ডাকে ‘উড়িয়া আও’ । ডাক শুনে লোকমানের ইচ্ছে হয় পাখিটাকে দেখার, সে চলে যায় বাবুর পেঁপেবাগানে । গিয়ে দেখে ডানা কালো, মাথা কালো, শরীর হলুদ, ঠোঁট গোলাপি রঙের একটা সুন্দর পাখি পেঁপে গাছে বসে পেঁপে খাচ্ছে আর ডাকছে ‘উড়িয়া আও’ । এটাই আসলে ইংরাজিতে ওরিওলিডি গোত্রের ওরিওল । বাংলায় এর অনেক নাম, কালোমাথা বেনেবউ, হলুদ সোনাবউ, কুটুম পাখি ইত্যাদি । কথায় বলে, ‘বেনেবউ এলো তো মন ভালো হলো’ । এমন চনমনে ভঙ্গি করে এই পাখি, একে দেখে মন অকারণেই মেতে ওঠে । পাশের গাছেও আরো দুটো রয়েছে, কিন্তু লোকমান এই পাখিটাকেই দেখছিল। পাখির পেঁপে খাওয়া লোকমানের মন কেড়ে নেয় তখন সে অনেক কষ্ট করে একটা ফন্দি করে পাখিটাকে ধরে । পাকা পেঁপে দুটো গাছ থেকে তুলে মাটিতে রেখে দেয়, বাবুর বাড়ি থেকে একটা টুকরি নেয় তার মধ্যে একটা দড়ি লাগিয়ে, ছোট্ট বাঁশের একটা খোঁটার মতো টুকরিটাতে লাগিয়ে দড়ি হাতে একটু দূরে গিয়ে বসে । বোকা ওরিওল গাছ থেকে মাটিতে নেমে এসে পেঁপে খেতে যায়, লোকমান তখন দূর থেকে দড়ি টান মারে আর ওরিওল ফেঁসে যায় টুকরির ভেতর ।

      লোকমানের এইসব কাণ্ডকারখানা ওর ছোটবউ একদম পছন্দ করে না । রোজই প্রায় এরকম আপদ একটা না একটা নিয়ে আসে আর সারাদিন ওগুলো নিয়েই থাকে তাই ছোটবউ এর হিংসেও হয় । বড়বউ, মেজোবউ ওসবে নেই, তারা তাদের ছেলেপুলে, সংসার কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত । আগেই বলেছি ছোটবউ এর ছেলেপুলে নেই তাই লোকমানই ওর সংসার কাজকর্ম সব । কিন্তু লোকমান সেরকম সময় দিতে পারে না কারণ ও ওগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকে ।  ফিসফিস করে গালাগাল ও দেয় ছোটবউ কিন্তু লোকমান কারো কথা শুনে না । ওরিওলকে আদর করে বুকে জড়িয়ে বাড়িতে আনে, পুরনো একটা খাঁচা বের করে সেটার ভেতর পাখিটাকে রেখে বলে,

--- হে রে ময়না, হামার সাথে থাকবি ? হামি তোকে আদর করে যতনে রাখব । তবে রোজকায় নাই ডাকবি ‘উড়িয়া আও’ । সময় সময় ডাকবি, নাইলে কুটুম নাই আসবেক ।

ময়না না, ওরিওল । লোকমান আদর করে ময়না বলেছে । ওরিওল আর ওসব ভাবছে নাকি, তার মাথায় তো তখন একটাই চিন্তা এই খাঁচা থেকে বেরোবে কী করে । আর কী কোনোদিন আকাশে উড়তে পারবে না ? ওর দুই বন্ধুও হয়তো ওকে খুঁজে খুঁজে পাগল হবে ।

     লোকমান পাখিটাকে যেরকম এনেছে, সেরকম যত্নও করত খুব । প্রতিদিনই যা পারে ভালো খাবার এনে দেয়, স্নান করিয়ে দেয়, মাঝে মাঝে খাঁচা থেকে বের করে কোলে নিয়েও বসে যেন একেবারে নিজের সন্তান । কিন্তু ওরিওল তা বুঝবে কেন, এত আদর যত্ন ভালবাসা সে বোঝে না । বনের পাখি বনেই ফিরে যেতে চায়, চিন্তা তার একটাই পালাবে কি করে ? একদিন ডিসেম্বরের সকাল, ওরিওল মুখ গুঁজে খাঁচার ভেতর ঘুমিয়েছিল । ভোর হয়েছে, অন্য পাখিদের কিচিরমিচির শুনে ওরও ঘুম ভাঙে । আকাশে পাখিদের উড়তে দেখে ভাবছিল সেও যদি উড়ে যেতে পারত । বারান্দায় খাঁচায় বসে পূর্বের সূর্য দেখতে দেখতে হঠাৎ সে দেখল তার খাঁচার দরজা একটুখানি খোলা, দেখে আনন্দে ভাবে ‘ইস জানলে তো রাতেই পালিয়ে যেতাম’ । অনেকদিনের বন্দি পাখি উড়ে যায় আকাশে ।   

     গল্প শেষ হয় না এখানেই । উড়তে উড়তে ওরিওল চলে যায় ওই প্রলয়বাবুর পেঁপে বাগানে যেখানে তার বন্ধুদের ছেড়ে গেছিল । ভাবছিল বন্ধুদের সাথে দেখা হবে, তারা হয়তো মন খারাপ করে বসে আছে ওর জন্য । কিন্তু সেরকম কিছু হল না । ওরিওল দূর থেকেই দেখতে পায় ওর দুই বন্ধু বেশ মজাতেই রয়েছে, একজন আরেকজনকে ঠোকর দিচ্ছে আর পেঁপে খাচ্ছে । তা দেখে ওরিওল সেখান থেকেই ঘুরে যায় আর উড়তে থাকে অজানার উদ্দেশ্যে । আকাশে উড়তে উড়তে ভাবতে থাকে সেও তো একদিন এদের মতোই ছিল, স্নেহ আদর যত্ন ভালবাসা ওগুলো বুঝত না, লোকমানই তো তাকে ওসব শিখিয়েছে । লোকমান তো ওর কেউ নয় তাও নিজের সন্তানের মতো আদর যত্ন স্নেহ করে । বাড়ির বেড়ালটাও তো এখন আর ওকে দেখে লাফঝাঁপ দেয় না ভাবে ওযেরকম ওরিওলও সেরকম তাই দুজনেই এখন বন্ধু । বনের পাখি এরকম ভালবাসার মায়ার জালে জড়িয়ে যায়, ঠিক করে খাঁচায় ফিরে যাওয়ার । লোকমান ওরিওলকে ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে চুমু খায় । 

      বাগানের সবাই পাখিটাকে লোকমানের ‘গোদ নেয়া বেটা’ বলে । পাখিটাও সোহাগে থেকে থেকে একেবারে নাদুসনুদুস হয়ে গেছে । কিন্তু হঠাৎ জানি সবকিছু কেমন হয়ে যায়, ওরিওল লক্ষ্য করে লোকমান আর তার খেয়াল রাখে না । ওরিওলের নাওয়া খাওয়া কিছুরই না । কেমন জানি বদলে গেছে লোকমান । শুধু ওরিওল না বাড়ির বেড়াল, গরু, কুকুর, হাঁস, মুরগি, কবুতর কারো প্রতিই এখন আর ধ্যান নেই । অন্যরা কিছু না ভাবলেও ওরিওল মনে মনে খুব কষ্ট পায় কারণ ওইতো ছিল লোকমানের সবথেকে প্রিয় । ওরিওল কিছু বোঝে না শুধু দেখে, সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকার পর সন্ধ্যার পরে অনেক লোকজন আসে লোকমানের বাড়িতে, মিটিং হয়, ধর্মকর্মের আলোচনা হয় তাতে, ভালো খাওয়া দাওয়াও হয় । অনেক রাতে বাড়ি ফাঁকা হয়, তারপর লোকমান ঘুমিয়ে পড়ে । ওরিওল বারান্দায় খাঁচায় উপোস থেকে বসে বসে সব দেখে আর কষ্ট পায় মনে মনে । মিটিং করতে করতে লোকমানও একটা মেম্বারের পদে নিযুক্ত হয় ।

   লোকমানের অনেক দিনের ইচ্ছে মক্কা বেড়াতে যাবে । কিন্তু সেটা আর হয় না কারণ লক্ষীপুরের দিলখুশ চা বাগান থেকে মক্কা তো আর সামনে না, অনেক দূর । তাছাড়া লোকমানের এতো টাকাও নেই । এবার সে তার তিনটে ‘দামা গরু’ বিক্রি করেছে, ‘জমিন’ ও বিক্রি করে অনেক টাকা পেয়েছে, তাই অনেকদিনের ইচ্ছেপূরণ করতে বড়ছেলেকে নিয়ে চলে যায় মক্কা ঘুরতে । কয়েকদিন থেকে ওরিওল এর খাঁচার দরজা খোলাই থাকে কেউ তাকে আটকায় না, কিন্তু ওরিওল নিজেকে লোকমানের সঙ্গে, বাড়ির গাছপালা, কুকুর বেড়াল সবকিছুর সাথে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছে যে সে আর কোথাও যেতে চায় না । বাড়িতেই এই গাছের ডালে ঔ গাছের ডালে উড়তে থাকে কিন্তু লোকমান ওসব খেয়ালই করে না । লোকমান যখন কাজে যেতে বাড়ি থেকে বেরোয় তখন ওরিওল তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গাছে বসে ঠোকর দিয়ে দিয়ে মাটিতে পাতা ফেলে, মাঝেমাঝে ডাকও দেয় কিন্তু কাজে ব্যস্ত লোকমান তা বুঝতেই পারে না । লোকমান রওয়ানা হয় মক্কার উদ্দেশ্যে, এদিকে ওরিওল না খেয়ে খেয়ে অযত্নে শুকিয়ে যায়, শরীরে পোকাও হয় । লোকমান ছাড়া বাড়ির কেউই কোনোদিন ওরিওলএর যত্ন করে নি ।  মক্কা থেকে ফেরে লোকমান, খাঁচায় চোখ পড়তেই তার মনে পড়ে পাখিটার কথা কিন্তু কই সেই পাখি ? লোকমান ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক খুঁজে বেড়ায় পাখিকে কিন্তু কোথাও পায় না । প্রথম প্রথম খাঁচার ভেতর বন্দী পাখিটা কত না ছটফট করেছে উড়ে যাওয়ার জন্য, তারপর লোকমানের স্নেহ পেয়ে যত্ন পেয়ে আকাশ ভুলেছিল । সময় বিকেলের সূর্য অস্ত যাওয়ার, ফাঁকা খাঁচার দিকে তাকিয়ে কি জানি কি ভাবতে থাকে লোকমান !

কোন মন্তব্য নেই: