“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৩১ মার্চ, ২০১৫

মৃতের গল্প বলা


।।শৈলেন দাস।।
                                               মার বাইকের গতি যেখানে এসে বেড়ে যেত সেই রাস্তাটির নাম মহাসড়ক। জীবনের বাস্তবতা মেনে আমি যখন স্বপ্ন দেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম, কোন গল্প বা উপন্যাসের নায়কের মত নিজেকে ভাবার প্রবণতাও যখন কমে এসেছিল আমার মধ্যে ঠিক তখনই এই মহাপথের সূচনা। কর্মসূত্রে এই পথে রোজ আমার আসা যাওয়া। শিলচর-সৌরাষ্ট্র মহাসড়কের জিরো পয়েন্ট থেকে কলারতল মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্ব এবং সময় দেড় মিনিট। এই অতিঅল্প পরিসরে আমার জীবনের এবড়ো খেবড়ো লেখচিত্র সরলরৈখিক হয়ে যেত নিজের থেকে। পুরনো স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে যেত নতুন করে। সামনের দিকে বড়াইলের দৃশ্য। তার বুক ছুঁয়ে মেঘেদের ভেসে বেড়ানো আমাকে মোহিত করত। মাঝে মাঝে এক দুই ঝাঁক পাখি যখন উড়ে যেত দূরের আকাশে তখন মন পুলকিত হত, ভাবনায় লাগত রোমান্টিকতারর ছোঁয়া। নিজের অজান্তেই অস্পষ্টে বলে ফেলতাম "হারিয়ে যেওনা ............ "
            তারপর একদিন নোটিশ এল। প্রয়াত হয়ে যাওয়া আমার পিতার নাগরিকত্ব নাকি সন্দেহজনক। সেই সূত্রে আমি ডি'ভোটার। শুরু হল আইনি লড়াই। বংশানুক্রমে আমার পূর্বজ-রা নিরক্ষর হলেও দুয়েকটি কাগজপত্র রেখেছিলেন খুব যত্ন করে। সেই কাগজ পেশ করলাম ট্রাইব্যুনাল কোর্টে। কিন্তু মহামান্য বিচারক গ্রাহ্য করলেন না সেই সব। আমার মত সেগুলিও নাকি সন্দেহজনক। অতএব অন্যকোন বিকল্প নথি পেশ করার হুকুম দিয়ে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে আপাত রেহাই দিলেন আমাকে।
             এর কিছুদিন পর এল একটি ফর্ম। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এন.আর.সি.)-তে নাম তুলতে হলে অবশ্যই তা পূরণ করে দুমাসের মধ্যে জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট সরকারি কার্যালয়ে। সাথে দিতে হবে ষোলটি বিকল্প নথির মধ্যে যেকোন একটি। আমার চিন্তা বেড়ে গেল কয়েক গুণ। এদিকে ডি'ভোটার মামলার পরবর্তী শুনানির দিন বাকি আরও তিন মাস। এখন কি হবে?
            সেদিন আমি একটু বিমর্ষ ছিলাম। এন.আর.সি.-র ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়ে এসেছি আগের দিন। আমার দেওয়া নথি দেখে সরকারি কর্তার ব্যাঙ্গোক্তি "শরণার্থী ক্যাম্পের ভূয়া বাঙালী এবার যাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে"। সেইকথা ভাবতে ভাবতে আমি উত্তেজিত হয়ে খেই হারিয়ে ফেললাম। বাইকের বেগ কখন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকল বুঝে উঠার আগেই ছোট্ট একটি অঘটন.........।
            কলারতলের মোড়ের চা-দোকানী প্রায়ই গল্প করে কাস্টমারদের সাথে- "আমি ভিনদেশী নই~ আমি ভিনদেশী নই" বলতে বলতেই নাকি আমার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে এবং সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝে সে নাকি আজও শুনতে পায় তার প্রতিধ্বনি।
                 মহাসড়কের মাঝ বরাবর আমি হেঁটে চলি বড়াইলের দিকে......

শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৫

নামডাক

(C)Image:ছবি


 












।।মনোজিৎ দত্ত।।

 কিছু মানুষের ডাকনাম জনতা  
এরা পাখীর ঠোঁটে গুঁজে রাখে সময়    
রাত ভিজিয়ে রাখে স্বপ্নের জলে
সকালের ক্ষত মুছে নরম তুলোয়
মানুষগুলোর ডাকনাম জনতা  

কিছু মানুষের ডাকনাম বিস্ফোরণ
এরা গণতন্ত্র ... পরিবার পরিকল্পনা  
মাইল মাইল মিছিলে যায়
এরা ভোট দেয় বাদাম খায় 
মানুষগুলোর ডাকনাম বিস্ফোরণ 

কিছু মানুষের ডাকনাম নারী
জলের মতো আকার আকৃতিহীন
এরা বাতাসের মতো চুপকথা
এদের নাভিই নদীর উৎসমুখ
মানুষগুলোর ডাকনাম নারী

কিছু মানুষের ডাকনাম লাশ
এরা জীবনের জাবর কাটে
বগলতলায় লাইফ সার্টিফিকেট
মৃত্যু তাদের বসন্ত বিলাস 
মানুষগুলোর ডাকনাম লাশ

শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

আলোর উৎসব




                                                       
                                                
        ।।  ধ্রুবজ্যোতি মজুমদার  (শঙ্কু) ।।




                                                        (১)

কার্তিক মাসের অমাবস্যার সন্ধ্যা। চারপাশে আলোর রোশনাই। ঘন ঘন বাজি পটকার আওয়াজ আর আকাশে নানা রং বেরঙের ফুলঝুরির ছটায় শুভদের গ্রামখানাও আজ নতুন সাজে সেজে উঠেছে। শিলচর শহর থেকে যদিও বেশী দূরে নয় তবু মাঝখানে বরাক নদীটা যেন শুভদের গ্রামটাকে একটা গণ্ডী টেনে দিয়ে গেছে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস এই নদীটার জন্যই গ্রামের উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে আছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা যথেষ্ট ব্যাহত শুধুমাত্র নদীর জন্য। আরও কত দূরবর্তী অঞ্চলও রাতারাতি সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে,কিন্তু শুভদের গ্রামখানা শহরের এত কাছে থেকেও সেই কোন মান্ধাতা যুগে পরে রয়েছে। সরকারী প্রকল্প যাও দুএকটা আসে,তাও আবার স্থানীয় দলাদলির আগুন চাপা দিতে গিয়েই ভস্ম হয়ে যায়। শুভর বিশ্বাস যে আজকাল কেউই আর সার্বজনীন স্বার্থ নিয়ে মাথা ঘামাতে চায়না। সবাই নিজ নিজ উন্নয়ন নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু না চাইলেই কি আর সমস্যা শেষ?
     শুভর মনটাই যতসব গণ্ডগোল পাকিয়ে তোলে। প্রায়ই ছোট থেকে ছোট বিষয় এমনভাবে মনে গেঁথে যায় যা কিছুতেই তুলে ফেলতে পারেনা।

                                 (২)
   সমস্ত গ্রামের সাথে তাল মিলিয়ে শুভদের বাড়ির উঠানে;দাওয়ায় আলো জ্বলছে। ছোট ভাই-বোন মিলে বাজি পুড়ছে। কার্তিকের এই দীপাবলির সন্ধ্যা শুভর খুবই প্রিয়। দীপাবলির সাথে শুভর জীবনের অনেক স্মৃতি বিজড়িত।প্রত্যেক বৎসর দীপাবলির সময় সে নিজের বাড়িতে পরিবার পরিজনদের সাথে যাপন করতেই ভালোবাসে। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রিয় হলো দীপাবলির রাতে নিজ হাতে আলো জ্বালানো। হয়ত জীবনের পথে অনেক আঁধার অতিক্রম করে আসতে হয়েছে বলেই আলোর প্রতি তার একটা অন্যরকমের টান ও ভালোবাসা। বাজিতে যথেষ্ট ভয় থাকলেও মোম জ্বালানোটা সে কখনই মিস করেনা।
     কিন্তু বিগত পাঁচটি বৎসর ধরে ব্যতিক্রম ঘটে চলছে। চোখের সামনে এত আলো জ্বলছে কিন্তু এর একটিও শুভ নিজে জ্বালায়নি। একটা বাজিও সে নিজে ফোটায় নি।
     আজ যেন সে এই আলোর মেলার মধ্য থেকে চিরপরিচিত অন্ধকারটাকে খোঁজার চেষ্টা করছে। দাওয়ায় বসে আলোর দিকে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে থাকলেও তার মন কোন সুদূর প্রান্তরে হুহু করে ছুটে চলছে অন্ধকারের গভীরে।

     শুভ ভাবতে থাকে- কতক্ষণই বা আলো কে জ্বালিয়ে রাখা যায়?! যার যতটুকু সামর্থ্য তা ফুরিয়ে গেলেই আবার সেই আদি সত্য আঁধারএসে গ্রাস করে নেবে চারপাশ। হ্যাঁ, “সামর্থ্যবস্তুটি সত্যিই মারাত্মক। এই সামর্থ্য অর্জনের জন্যই তো এই দুনিয়ায় এত কর্মব্যস্ততা। কর্মমুখর পরিবেশে আছে সুকর্ম ও কু-কর্মের ছড়াছড়ি।
-        কি রে,শরীর খারাপ নাকি?
মায়ের কথায় চিন্তার জগত থেকে বেরিয়ে আসে শুভ।
-না না, শরীরতো ঠিকই আছে। সংক্ষিপ্ত জবাব দেয় সে।
-একটাও মোম জ্বালিয়ে দিলি না যে!
-তোমরা জ্বালাচ্ছোতো,জ্বালাও না। আমি দেখছি।
   মা চলে গেলেন অন্য কাজে। কিন্তু সত্যি কথাটা মাকেও বলতে পারল না।বলতে পারল না যে আজ থেকে  পাঁচ বৎসর পূর্বে এমনই একটা দিনে সে এমন একটা নিষ্ঠুর বাস্তবের সাথে।বলতে পারল না যে আজ থেকে পাঁচ বৎসর পূর্বে এমনই একটা দিনে সে এমন একটা নিষ্ঠুর বাস্তবের সাথে পরিচিত হয়েছিল যা তাকে প্রায়শই ভারাক্রান্ত করে তুলে। সেই ছোট্ট ঘটনাটি শুভর মনোজগতে একটা কত বড় এলোমেলো ঝড় তুলে দিয়েছিল সেটা যে একমাত্র শুভ ছাড়া কেউই জানেনা। সব পরিসংখ্যান জট পাকিয়ে গিয়েছিলো অথচ এরকম কত ঘটনাইতো অহরহ আমাদের চারপাশে ঘটে চলছে। অসংখ্যবার আমাদের কারো না কারো চোখে পড়ছে,কিন্তু আমরা তা দেখিনা; দেখতে পাইনা। ছোট খাটো অনেক বিষয়ই আমরা অনেকেই অদেখা করে পাশ কাটিয়ে যাই। শুভও এরকম সংবেদনহীন হতে অনেক চেষ্টা করেছে,কিন্তু পারেনি। কখনও কখনও শুভ ভাবে সে কি তাহলে সমাজের চোখে নিরর্থক ও বেকার বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিতে দিতেই জীবনটা কাটিয়ে দেবে? অথচ শুভ ভালোভাবেই জানে যে সে শত চেষ্টা করেও এই নিরর্থক(?!) বিষয়গুলিকে সমাজের চোখে অর্থবহ করে তুলতে পারবেনা বরং সমজে উপহাসের পাত্র হতে তার বেশী দেরী হবে না। তবু সে ভাবে। উত্তরণের পথ এর খোঁজ করে। সম্পূর্ণ একাকী।

                             (৩)
যে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে শুভ কাজ করে,সেখানে আগ থেকেই বলা ছিলো যে সেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবে। সন্ধ্যার আগে আগেই বাড়ি ফিরতে হবে তাই প্রয়োজনীয় কিছু বাজার সারতে গিয়েছিল শুভ। আর সেখানেই ঘটেছিলো বিপত্তিটা। পসার সাজিয়ে বসে থাকা বাজি পটকার দোকানে প্রচণ্ড ভিড়। শুভর অবশ্য তাতে অসুবিধার কিছু ছিলো না। দোকানী অনুদাকে আগে থেকে বলা ছিল,সে নিশ্চয় তালিকা অনুযায়ী বাজি-পটকা-মোম এতক্ষণে ব্যাগে ভরে রেখে দিয়েছে। অনুদা অন্য খদ্দেরকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় শুভ তাগিদ না দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে কেনা বেচা লক্ষ্য করছিলো। কী প্রচণ্ড মূল্যবৃদ্ধি!! তবু সবাই যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী কিনছে। দেখাদেখি হোক অথবা সাময়িক স্ফূর্তির খোঁজেই হোক অথবা অন্য কোনো অজানা মানসিকতার তাগিদেই হোক বেশিরভাগ মানুষই নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী (কখনও সাধ্যের ঊর্ধ্বে উঠেও) আনন্দ উৎসবে সামিল হতে চায়। কেউ হয়ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে আর কেউ বাধ্যতামূলক। এই ব্যাপারটা শুভকে প্রায়শই ভাবায়। এমনই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সহসা চোখ দুটি আটকে গেলো দুটি খুদে ক্রেতার উপর এসে। বছর সাতেকের একটি মেয়ে,আর ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে বছর পাঁচেকের ছোট ভাই। বাচ্চা দুটিকে শুভ চেনে। ওর কর্মস্থলের উল্টোদিকে কোথাও ওরা থাকে। ওদের মা এদিকটার বেশ কয়েকটা বাড়িতে কাজ করে। প্রায় রোজই ওদেরকে এক দুবার দেখতে পায় শুভ।বোনটি অনেকক্ষণ ধরে কখনও একটা চরকি আবার কখনও ফুলঝুরি আবার কখনও অন্য কোনো বাজির দাম জিজ্ঞেস করছিলো। আর দাম শুনেই কেমন যেনো হতোদ্যম হয়ে পড়ছিল। চোখ মুখে একটা ফ্যাকাসে হতাশা স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছিলো মেয়েটির। শুভ লক্ষ্য করছিল যে দোকানী অনুদাও তেমন পাত্তা দিচ্ছিল না ওদেরকে। অনুদা অন্য বড় বড় খদ্দেরদের তোষামোদেই ব্যস্ত। সেই অবসরে শুভ যেনো একটু একটু করে প্রবেশ করছিলো বাচ্চা দুটির মনোজগতে। একটা অব্যক্ত ঘোর এর মধ্যে ডুবে যেতে লেগেছিল সে। নিজেকে আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টাও বিফল হতে লাগল।

                             (৪)
প্রত্যেকটা বাজিই নজর কাড়ছে।সবগুলিই নেবার একটা লুলোপতা চোখেমুখে ফুটে বেরোচ্ছে।অথচ হাতের মুঠোতে যে মাত্র দুটি দশ টাকার নোট! অসহায় চোখে মেয়েটি তাকিয়ে দেখে নিজের হাতের এই নগণ্য ধনরাশিকে। ছোটভাই অপেক্ষাকৃত কম সমঝদার থাকার কারণে দিদির হাত ধরে টেনে টেনে দিদি এটা নে,দিদি ওটা নেবলে পীড়াপীড়ি করছিল।কিন্তু দিদি হয়ত কিছুটা বুঝতে পারছে যে এই দুটি দশ টাকার নোট এই দোকানীর কাছে নগণ্য বলে বিবেচিত হলে কি হবে;এই বিশটি টাকা ঈপ্সিত সুখের উপযুক্ত মূল্য না হলে কি হবে;যে মাএই বিশটি টাকা দিয়েছে ওর কাছে এই টাকার মূল্য কতটুকু!!
   মেয়েটির এই হতভম্ব অবস্থা শুভর চোখ এড়ালো না। নিজের অজান্তেই চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসছিল।এই বাচ্চা-দুটোর মধ্যে শুভ স্পষ্ট দুটি পরিচিত চেহারা দেখতে পাইতেছিল। শুভ জানে যে এই শিশু দুটির কোনো অপরাধ নেই।একমাত্র ভুল হল এই যে ওরা দরিদ্রের সন্তান। ওদের সবকিছুতে সম-অধিকার নেই। কিন্তু এই বয়সে ওরা এটা বুঝতে অক্ষম। ওদেরকে নিয়ে ভাবার কেউ নেই। অথচ আমরা উৎসবের নামে কোটি কোটি টাকা নষ্ট করব। রঙ বেরঙের আলোর বাহারের তলায় দাঁড়িয়ে সাম্যের দাবী করব। শব্দ দূষণের তোয়াক্কা না করে আমাদের উল্লাস প্রকাশ করব। আকাশে রঙের রোশনাই জ্বেলে আমাদের অহং স্বগতই উচ্চারণ করবে-ওহে ঝুপড়ী-বাসী,তোমরা তোমাদের চালের ফাঁক দিয়ে চেয়ে দেখো। কতকিছুই তোমাদের কাছে নেই। কতকিছু হতে তোমরা বঞ্চিত, কতকিছুই তোমাদের অধরা
        আমরা আনন্দ করব,কি আসে যায় যদি বা পাশের ঘড়টিতে কেরোসিনের বাতিও না জ্বলে,আমার বাড়িতে তো আলো আছে (প্রয়োজনের চেয়ে বেশী)। কারো হাঁড়ি না চাপলে আমি কেন দুঃখিত হব? আমি কি দায়বদ্ধ? আমি শুধু আমার কথাই ভাবব। এটাই মনুষ্যচরিত
   কিন্তু শুভ পালন। অনূর্ধ্বর নিকট হতে নিজের ব্যাগ-বন্দী খুশীগুলি চেয়ে নিলো। সেখান থেকে কয়েকটা বের করে ছোট ছেলেটির হাতে ধড়িয়ে দিয়ে বলল-ভাই-বোন মিলে এই বাজি গুলি পুড়িয়ো। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল মেয়েটি। ছেলেটা এক হাতে বাজিগুলো ধরে দিদির চোখে কাতর ভাবে তাকিয়ে রইল অনুমতির আশায়। মেয়েটির সঙ্কোচটা বুঝতে পারছিল শুভ।বলল-নিয়ে নাও কিচ্ছু হবে না। বাজির প্যাকেটগুলি নিয়ে ভাইটি যদিও খুব খুশি হয়েছিল;কিন্তু বোনটির কোনো ভাবান্তর দেখা গেলোনা।এক আশ্চর্য চাহনিতে শুভকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে চলে গিয়েছিলো। অন্যরা কেউ ব্যাপারটা খেয়াল না করলেও অনুদার ব্যবসায়ী চোখ কিন্তু লক্ষ্য করেছিল আদ্যোপান্ত ঘটনা। হয়ত সেও খুব আশ্চর্য হয়েছিল,কিন্তু মুখে কিছু বলেনি। শুধু বাজির টাকা রাখার সময় এক অজানা কারণে সর্বমোট টাকা হতে পঞ্চাশ টাকা কম রাখল। কারণ জিজ্ঞেস করাতে বলল-এমনিতেই ডিসকাউন্ট দিলাম,আমার লাভ ঠিকই হয়েছে

                            (৫)
সেদিন বাড়ি ফিরে লুকিয়ে খুব কেঁদেছিল শুভ।সেই থেকে পাঁচটা বৎসর পেরিয়ে গেলো কিন্তু শুভর মনে সেই নিষ্পাপ দুটি চেহারা গেঁথে আছে। কর্মস্থলের পরিবর্তন হয়েছে। শিশুগুলিকে আজ অনেকদিন ধরে দেখেনি,কিন্তু বিশেষ করে দীপাবলির রাতে ওই চেহারাগুলি নিয়মিতভাবে মানসে ফুটে উঠে।
        এই আলোর উৎসব হাস্যকর ঠেকে শুভর কাছে। সেই থেকে প্রত্যেক দীপাবলিতে সে একটি প্রার্থনাই জানিয়ে আসছে কালীর কাছে-মা,কবে আমাদের আভ্যন্তরীণ আঁধার টা নাশ হবে? কবে আমরা আমাদের সুখের সংজ্ঞাটাকে একটু হলেও পরিবর্তন করতে সক্ষম হব? কবে আমরা বুক উঁচিয়ে বলতে পারব যে-আমরা মানুষ’,আর মনুষ্যত্বের মেলবন্ধনই আমাদের উৎসব।
       
        আজও এই প্রার্থনাটাই করছে শুভ।সে জানেনা তার এই প্রার্থনাটা কবে মঞ্জুর হবে,অথবা আদৌ কি হবে??


অ-কবিতা

।। শৈলেন দাস।।


(C)Image:ছবি









বেগ শেষ হয়েগেছে
দু:খরাও নাড়া দেয়না আর
অনুভূতিগুলি মৃতপ্রায়
হৃদযন্ত্র অসাড়।
মস্তিষ্ক আজ স্মৃতি শূন্য
শব্দেরা পলাতক
জীবনে ঘটেছে ছন্দপতন
কবিতা আসবে কহাতক!

প্রতি,হেমাঙ্গ বিশ্বাস



।। দেবলীনা সেনগুপ্ত।।










তোমার হেম- অঙ্গে
কখনও বা মেখে যায়
হেমন্তের গোধূলি রঙ বিষাদ
ফসলগন্ধী আলপথ ধরে যেতে যেতে
তুমি ক্রমশঃ মিলিয়ে যাও
দূর থেকে দূরে-
আর আমরা, আজকের রঙ্গনটেরা
হারিয়ে ফেলি তোমাকে।
ভুলে যাই,
প্রকৃত সত্যের কোনও
ডান-বাম হয় না ,
একাগ্র সরল রৈখিক পথেই
তার নিঃশঙ্ক গতায়াত
তীক্ষ্ণ আলোকফলার মত।
তোমার মাটি-দাগ গানের সুরে
সে অবিরাম সত্য
তার নির্ভেজাল সাদা রঙে ফুটে ওঠে
কুলখুড়ার উঠানে
মঘাই ওঝাআর
রত্ন-রাভা ব্যাখ্যানে।
অযথার লাল-সবুজ-কমলার কারিকুরিতে
বারবার ভেঙ্গেচুরে যায়
তোমার প্রতিকৃতি
অস্পষ্ট হয় অবয়ব ,
তারপর একদিন
সব রঙ  শোষিত হয়
নেমে আসে নিকষ কালো
ডুবে যাই বিপন্ন আঁধারে...

সূর্যোদয়ের আলোয় তাই
কাঁপা হাতে আঁকি তোমার মুখ
নিজেকে খুঁজে পেতে
নিজেদের ফিরে পেতে...