“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫

গছ তলর বিহু - এক স্বর্ণালী অভিজ্ঞতা

।। আশু পাল।।
কৃষি-প্রধান ভারতে অধিকাংশ সামাজিক উৎসবই কৃষি, ফসল, উর্বরতা ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত। আসামের জাতীয় উৎসব বিহুও এর থেকে পৃথক নয়। কার্তিক সংক্রান্তিতে কঙালি বিহু’, পৌষ সংক্রান্তিতে ভোগালি বিহুআর চৈত্র সংক্রান্তিতে রঙালি বিহু’ – সবগুলোই কৃষিকর্মের প্রেক্ষাপট সঞ্জাত। সুদূর অতীতে নাকি ভোগালি বিহু ছিল সবচেয়ে ব্যাপক, কিন্তু পরবর্তীতে রঙালি বিহু অসমীয়া সমাজে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চৈত্রের শেষ দিনে নামঘরএ ঈশ্বরের কাছে আবেদন জানিয়ে বিহুর সূত্রপাত করা হয়, আর সমাপন অনুষ্ঠান হয় ১২ বা ১৩ বৈশাখ। চৈত্রের মাঝামাঝি থেকেই শুরু হয় হুচরি। দলে দলে যুবক যুবতীরা নাচ ও গানের দল তৈরি করে পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেচে-গেয়ে বিহুর আগমনী বার্তা পৌছে দেয়। ওটাই হুচরি। রাত দুটোয়ও যদি হুচরির দল কোন বাড়ির সামনে গিয়ে ঢোল বাজায়, গৃহস্বামী তার পরিবার সহ ঘুম থেকে উঠে হুচরি দলকে স্বাগত জানান, আপ্যায়ন করে আনেন, সাধ্যানুযায়ী চাল ডাল ও টাকা পয়সা দিয়ে তাদের খুশি করেন। হুচরির ঢোল বাজানো শুনেও যদি কোন গৃহস্থ ঘুমিয়ে থাকেন, উঠে তাদের আপ্যায়ন না করেন, তবে সমূহ অমঙ্গল এটাই প্রচলিত বিশ্বাস। 
       বৈশাখের দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ দিনে চার-পাঁচটা গ্রামের মানুষ মিলে, নিজেদের সুবিধামত কোন একটা খোলা মাঠে, কোনও একটা গাছতলায়, সমবেত হয়ে নাচ-গান করেন। তার আগে সেই গাছের গোড়ায় মাঙ্গলিক গামোছাজড়িয়ে কৃষি ও গ্রামীণ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের প্রতীকী উপস্থাপনা করে পুজো করেন। তার পরেই শুরু হয়গছ তলর বিহুউদযাপন। অবিবাহিত যুবতীরা এক জায়গায় ঘুরে ঘুরে বিহুনাচ নাচে। অবিবাহিত যুবকেরা ঢোল বাজায়, নাচে আলাদা ভাবে। মাঝবয়সী ও প্রবীণ পুরুষেরা আরেক জায়গায়। বিবাহিতা মহিলারা অন্য জায়গায়। একই মাঠের বিভিন্ন জায়গায় একই সাথে চলতে থাকে এই নাচ গান। ঢুলিয়ার ঢোলের বোল শুনে প্রবীণা মহিলারাও অন্তত দু-চার পাক না নেচে থাকতে পারেন না। শহুরে মঞ্চে বিহু নাচ অনেক দেখেছি। একই ধরণের কাপড়ে সুসজ্জিতা, সুবেশা, সুন্দরী মেয়েরা বেশ কিছুদিন রিহার্সালের পর অপূর্ব দক্ষতায় মনোহারিণী নাচ পরিবেশন করে। দেখলেই বোঝা যায়, যৌবনের জয়গান চলছে। কিন্তু গছ তলর বিহু-র চরিত্র ভিন্ন। ধনী-দরিদ্র, যার যেমন কাপড় আছে বাড়িতে, দক্ষ বা অদক্ষ - যে যেমন নাচতে পারে, নতুন বা পুরোনো যার যেমন ঢোল আছে, সবাই নিঃসঙ্কোচে মিলিত হবে গাছের তলায়। নাচবে গাইবে বাজাবে প্রাণের টানে। সাত থেকে সাতাত্তর বয়সের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। 
             অতীতে এই গছ তলর বিহুথেকেই নাকি যুবক-যুবতীদের অনেকে জীবন-সাথী বেছে নিয়ে পালিয়ে যেতো। অভিভাবকেরাও সেটা মেনে নিতেন খুশি মনে। দু-চার-পাঁচ-সাতদিন পর ওই যুবক-যুবতীকে ডেকে এনে সামাজিক বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। কেউ কেউ বলেন, সেই ধারা এখনও পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। অবিবাহিতাদের নাচ যখন চলছে, বাঁশের ঘেরা দেওয়া নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে থেকে দু-চারটে যুবকের মন্তব্য শুনেছি, “এই যে, চশমা লাগিয়েছ বলে একবার কি আমার দিকে প্রেমের চোখে তাকানো যায় না ?” আজানুলম্বিত কেশদামের অধিকারিণীকে উদ্দেশ্য করে কেউ বলছে ওই কোমর ছাড়ানো ঘন কালো চুলের রাশি কি আমার জন্য নয় ?” কাজল নয়না কোন হরিণীকে উদ্দেশ্য করে কেউ বলছে, “ ওই কাজল কালো চোখের গভীরে ডুবে মরেছি, এবার টেনে তোলো। লাল টিপ পরা যুবতীর উদ্দেশ্যে মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে, “ আর কত টিপ পরবে, এবার সিঁদুর দিতে চাই। সরস মন্তব্যের জেরে যদি কোন নাচনী মুচকি হেসে ফেলল, সাথে সাথে হৈ হৈ করে উঠলো যুবকের দল, “হয়েছে, হয়েছে, তোর ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে রে বিড়াল। অভিভাবকদের  অনেকেই শুনতে পাচ্ছেন মন্তব্য গুলো, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছেন না, ধমকও দিচ্ছেন না।


      
   ৩০ চৈত্র থেকে আজকের দিন পর্যন্ত ভদ্রতার সীমারেখার মধ্যে এসব চলতেই পারে, আগামীকাল এমন হলে কিন্তু কান মুলে দেওয়া হবে।  এমন একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতার সুযোগ কি ছাড়া যায় ? গতকাল (১২ বৈশাখ, ১৪২২, রবিবার) আমরা কয়েকজন মিলে চলে গেলাম তিনসুকিয়ার পানিতোলার পাশে বরুয়াহোলা গ্রামে। নীলাভ নয়ন বরদলৈ আমাদের অত্যন্ত প্রিয় সংস্কৃতিকর্মী আমাদের গাইড। আন্তরিক আতিথেয়তায় আমাদের স্বাগত জানালেন গ্রামের মানুষ। ফটো এবং ভিডিও রেকর্ডিং করার সুযোগ করে দিলেন। বিকেলে রোদের তেজ যখন একটু স্তিমিত হয়ে এলো, একের পর এক মোট ছয়টি গ্রামের মানুষ দলে দলে এসে উপস্থিত হলেন পূর্ব-নির্দিষ্ট গাছের তলায়। নেচে গেয়ে ঢোল বাজিয়ে ওই সাংস্কৃতিক মিছিল দেখেই আমি উদ্বেলিত হয়ে ওঠলাম। আয়োজকেরা মাইকে ঘোষণার মধ্য দিয়েই শুরু করলেন অনুষ্ঠানমালা। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে নাচুনী, গাইয়ে, বাজনদার সহ উপস্থিত সবাইকে দেওয়া হল নুন-আদাকুচি সহযোগে ভিজিয়ে রাখা কাঁচা ছোলা আর মুগ। আপ্যায়নের এই ধারাই চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। ঘুরে ঘুরে কিছু ছবি তুললাম। ঢোলের তালে একবার নাচার ইচ্ছা যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু অতিথিদের নাচ অভিপ্রেত নয়, তাই ইচ্ছাকে চাপা দিতে হল। ফেরার পথে বাইকের পিছনে বসে নীলাভ আমাকে বলল, “ আশুদা, দেখলেন তো, আমরা যে বলি, ‘বিহুঅসমীয়া জাতির রক্তের সঙ্গে, প্রাণের সঙ্গে মিশে আছে তা আসলে শহুরে বাবু সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত মানুষের মধ্যে নয়, বিহু বেঁচে আছে গ্রামের সহজ সরল সাধারণ গরীব মানুষের মধ্যে। বাইক চালাতে চালাতে কথাটা যেন মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করলাম।

কোন মন্তব্য নেই: