“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৫

‘সুয্যিমামা কথা থেকে পেলেন এমন আলো’


(C)Image:ছবি




।। রজতকান্তি দাস ।।

‘সুয্যিমামা কথা থেকে পেলেন এমন আলো’। একটি কবিতায় কবি এক শিশুর মুখে এই প্রশ্নটি তুলে ধরেছেন। দেখা যাচ্ছে যে আমাদের দেশেও এ নিয়ে অনুসন্ধিৎসা ছিল। তবে সবশেষে কবি যখন ‘...আছেন ভগবান,যা কিছু সব তিনিই করেন সবই তাঁহার দান’ বলে এই অনুসন্ধিৎসার চিরসমাপ্তি ঘটান তখন মনে এই অনুসন্ধিৎসার পেছনে কোনও ধরণের বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি ছিল না। ঈশ্বরের মহিমা কীর্তনই ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথের ‘শান্তিনিকেতন’ প্রবন্ধে পাই যে তিনিও বাঙালি ছাত্রদের মনে কোনও প্রশ্ন জাগেনা দেখে হতাশ হয়েছিলেন। ভারতীয় ছাত্রদের মনে প্রশ্ন জাগেনা দেখে বিদ্যাসাগরতো কলেজের পাঠ্যক্রমই পাল্টাতে চেয়েছিলেন। আইনস্টাইন এক জায়গায় বলেছেন, ‘আমি কোনও জিনিয়াস নই। তবে আমার কৌতুহল অন্যদের চাইতে বেশি’। মানুষের এই কৌতুহলই কিন্তু মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় যেখানে সাধারণভাবে আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলো এর নিবৃত্তি ঘটায়।

               ইউরোপের বিজ্ঞানীদের মধ্যে সূর্যের শক্তির উৎস নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলে এসেছে কয়েক শতাব্দী ধরেই। কারণ সূর্যের শক্তি এতটাই বেশি যে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনার অবধি ছিল না। প্রথমে মনে করা হয়েছিলো যে হাইড্রোজেন গ্যাসের দহনই হল সূর্যের সমস্ত শক্তির উৎস। তবে হাইড্রোজেন গ্যাস তো আর এমনি এমনি জ্বলবে না, এর জন্য চাই অক্সিজেন। তবে সূর্য থেকে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ শক্তির নির্গমন হয় তাতে দেখা যায় যে হাইড্রোজেন গ্যাসের দহনই যদি এই শক্তির উৎস হয়ে থেকে তাহলে বড়জোর এক হাজার বছর পর্যন্ত সূর্যের পক্ষে আলো ও তাপ দেওয়া সম্ভব। অথচ এই পৃথিবীতে এমন সব জীবাশ্ম আছে যেগুলো কয়েক’শ কোটি বছরের পুরোণো। তার মানে সূর্য কোটি কোটি বছর ধরেই আকাশে এমনি করে জ্বলছে। আধুনিক বিজ্ঞান জানিয়েছে যে সূর্য প্রায় ৫০০ কোটি বছর ধরে এমনি করে জ্বলছে এবং প্রায় আরও ৫০০ কোটি বছর ধরে জ্বলবে। তাই অন্তত হাইড্রোজেন গ্যাসের দহন সূর্যের শক্তির উৎস হতে পারে না। তাহলে এমন কী হতে পারে যা হাজার কোটি বছর ধরে জ্বলতে পারে অথচ নিঃশেষ হয় না। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীদের পক্ষে তা জানার কোনও উপায় ছিল না। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা নানা ধরণের থিওরির জন্ম দিয়েছিলেন যার কোনটাই শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। এই সব বাতিল থিওরি নিয়ে কিছু লেখার নেই।

           সূর্য হল একটি নক্ষত্র। এই নক্ষত্রগুলোর শক্তির উৎস কী? এই প্রশ্নের উত্তর ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীদের জানার কথা ছিল না কারণ এর জন্য এমন এক বিশেষ আবিষ্কারের প্রয়োজন ছিল যা প্রকৃতির নিয়ম সম্পর্কে আমাদের ধ্যান-ধারণার মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ১৯০৫ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্বের মাধ্যমে এই কাজটি করে দিয়েছেন। যার ফলে অন্যান্য অনেক রহস্যের উদ্ঘাটন যেমন হল তেমনি সূর্য সহ সমস্ত নক্ষত্রের  আলোক ও উত্তাপ শক্তির উৎস সম্পর্কেও আমরা জানতে পারলাম।

          সূর্য একটি নক্ষত্র। তাই অন্যান্য নক্ষত্রগুলোর শক্তির যে উৎস, সূর্যেরও তাই। প্রায় ১৪৭০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং- মধ্য দিয়ে এই ব্রহ্মাণ্ডের সূচনা হয়েছিল বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। প্রায় শূণ্য অবস্থা থেকে স্পেস ও সময়ের এই যাত্রা। ঐ সময় প্রচন্ড দ্রুতগতিতে যখন এই ব্রহ্মাণ্ড বিস্তার লাভ করছিলো তখন শক্তির বিকিরণ ছড়িয়ে পড়েছিল এই ব্রহ্মাণ্ডে। প্রাথমিক অবস্থায় ব্রহ্মাণ্ডের যে উত্তাপ ছিলো তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এতো দ্রুতগতিতে আয়োতনে বাড়ার ফলে ব্রহ্মাণ্ডের তাপমাত্রাও কমে আসছিলো তেমনি দ্রুতগতিতে। এই তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ফলে শক্তির বিকিরণ থেকে পরমানুতর কণিকার সৃস্টি হতে থাকে। এমনি করে এক সময় প্রাথমিক পরমানু অর্থাৎ হাইড্রোজেন পরমানুতে ভরে যায় ব্রহ্মাণ্ড। কিন্তু এই প্রসারমান ব্রহ্মাণ্ডে এই হাইড্রোজেন পরমানুও প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে ধাবমান ছিল কারণ সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই প্রসারিত হচ্ছিলো অসম্ভব দ্রুতগতিতে। বাতাস যখন খুব দ্রুতগতিতে ধাবমান হয় তখন যেমন ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয় তেমনি প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে ধাবমান হাইড্রোজেন গ্যাসের মধ্যেও স্থানে স্থানে ঘূর্ণি দেখা দিতে শুরু করে। এই ঘূর্ণিগুলোই নক্ষত্রের মূল উৎস। যা সংখ্যায় এতটাই যে পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রতটে যতোগুলো বালিকণা আছে, তার চাইতেও বেশি।

             প্রচন্ড গতিতে ধাবমান হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘূর্ণিগুলোর মধ্যে যখনই বস্তু জমাট বাঁধতে থাকে তখনই ওগুলোর মধ্যে দেখা দেয় মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। এই মাধ্যাকর্ষণের টানে আশপাশের সমস্ত গ্যাস সেখানে পূঞ্জিভূত হতে থাকে। একসময় এই জমাট বাঁধা গ্যাসপূঞ্জ আকারে বিশাল হয়ে যায় এবং আশপাশের সমস্ত বস্তুকণিকা এর কোন না কোন গ্যাসপূঞ্জে এসে জমাট বাঁধে, যার ফলে মাঝখানের জায়গা ফাঁকা হয়ে মহাশূণ্যের সৃস্টি করে।


            এই জমাট বাঁধা গ্যাসপূঞ্জগুলো যখন এদের অভ্যন্তরীণ মাধ্যাকর্ষণের টানে ক্রমাগত সঙ্কোচিত হতে থাকে তথন এদের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণও বাড়তে থাকে বর্গীয় হারে। এই সঙ্কোচনের ফলে তাপমাত্রার বৃদ্ধি হতে থাকে। আমরা জানি যে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বস্তুর অভ্যন্তরীণ পরমানু কণিকাগুলোর মধ্যে কম্পনও বাড়তে থাকে। গ্যাসপূঞ্জগুলোর ক্রমাগত সঙ্কোচনের ফলে তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে যখন তা প্রায় ১০০ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছাড়িয়ে যায় তখন পরমানুগুলোর কম্পন এতোটাই বেড়ে যায় যে এগুলোর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে একটি হাইড্রোজেন পরমানু অপর একটি হাইড্রোজেন পরমানুর মধ্যে সমাহিত হয়ে যায়। একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ফিউশন প্রক্রিয়া। এই ফিউশন প্রক্রিয়ায় দু’টি হাইড্রোজেন পরমানু মিলে একটি হিলিয়াম পরমানুর সৃষ্টি করে। যার ফলে বস্ত ভর (mass) কিছুটা হ্রাস পায়। কিন্তু বস্তু ও শক্তির মোট পরিমান সবসময়েই সমান থাকে যার কোনও হ্রাসবৃদ্ধি হয় না। তাই ফিউশন প্রক্রিয়ার ফলে যে বস্তুর হ্রাস হয় তা শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং এর পরিমান আইনস্টাইন আমাদের দিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত E = mc2 (পড়ুন mc square) সমীকরণের মাধ্যমে। এখানে ‘C’ হলো আলোর গতি যা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার ও যার বর্গফল হলো ৯ লক্ষ কিলোমিটার অথবা ৯০০০ লক্ষ মিটার বা  ৯০০০০০০০০০০ সেন্টিমিটার । এই সংখ্যা দিয়ে ভরের (mass) পরিমানকে গুণ করলে শক্তির পরিমান পাওয়া যায়। অর্থাৎ যৎসামান্য বস্তুরও শক্তিতে রূপান্তরের ফলে বিপূল পরিমান শক্তির উৎসরণ ঘটে। এই শক্তিই সূর্যসহ অন্যান্য সমস্ত নক্ষত্রের শক্তির উৎস যেখানে প্রতি মূহুর্তে বিপূল সংখ্যক বস্তুকণিকা ফিউশন প্রক্রিয়ার ফলে প্রতি মূহুর্তে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে চলেছে। তাই হাজার কোটি বছর ধরে এই নক্ষত্রগুলো আকাশে জাজ্বল্যমান থাকতে পারে। তবে মা যখন তার শিশুসন্তানকে বলেন ‘আছেন ভগবান, যা কিছু সব তিনিই করেন সবই তাঁহার দান’, তখন কিন্তু মনে হয় কোনও এক আদৃশ্য শক্তি হয়ত বা আছে যা এই সমস্ত সৃষ্টির মূল।

কোন মন্তব্য নেই: