“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৫

মা





( অসমের তরুণ কবি শহিদুল হক। থাকেন শিলচরে। স্নিগ্ধা নাথ সম্পাদিত কাগজ 'আমাদের সমকালে'র  ৩৬তম বর্ষ, ১ম সংখ্যা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে প্রথম কবিতাটিই এই। পড়ে মুগ্ধ না হয়ে থাকা গেলো না। মাকে, নিয়ে আবেগিক কবিতা প্রচুর পড়া গেছে। শহীদুল লিখেছেন এক নতুন প্রতি-আখ্যান। না পড়িয়ে তাই থাকা গেলো না। ঈশানে তুলে দিলাম।--- সুশান্ত কর)









আমার মা, নেলি-গহপুরের সময় সদ্য বালিকা।
কাপড়ের গাঁট পিঠে নিয়ে হারিয়ে যেতে দেখেছেন শ’শ’ বাস্তুহারাদের।
এর চারবছর পরেই বালিকা বয়সী তার বিয়ে
মেট্রিক পরীক্ষা দেয়া হয় নি,
তারপর কোনোক্রমে একমাস পড়ে পাশ...
বিয়ের তিন বছরের মাথায় কন্যা সন্তান,
তারপর আরেকটি কন্যাসন্তান জন্ম দিয়ে
বাবরি দাঙ্গার অসময়ে পুত্র সন্তান, মানে আমি।
মা’র দ্বিতীয় কন্যা , স্বপ্না যার নাম। শিশু বয়সেই মারা গিয়েছিল।
পুষ্টি-অপুষ্টি সয়ে আমরা এক বোন এক ভাই আজ অবধি জীবিত।
পোয়াতি মার শরীরে মাংস ছিল কম, অ্যানিমিয়া পেয়ে বসেছিল।
বহুদূর বড়াইলের ওপার নগাঁও ছেড়ে, মা এসেছে বরাকে।
প্রত্যন্ত গ্রাম-দেশে মানুষজন নতুন, তাদের চলাফেরার ধরণ অন্য
তার উপর বন্ধু নেই, সই নেই, আর হাড় ভাঙ্গা সংসারের খাটুনি,
স্বামীর রক্ত-চোখ আর পোয়াতি পেটে দেওরের লাথি...
এসব নির্মম পরীক্ষা আর যন্ত্রণা পার হয়ে,
মা হয়েছিল শক্ত, বিদ্রোহী আর চরম রকমের আক্রামক।
সংসারের চুঙায় ফু দিতে দিতে মায়ের আর শরীর বলে কিছু রইল না।



যেদিন বড় হয়ে পৃথিবীকে চিনতে শিখলাম
অস্থির সংসারের চাপে একাই বিড় বিড় করতে দেখেছি মা’কে।
গত তিন দশক ধরেই মা চাইছিল খানিকটা সুস্থির হয়ে চাপমুক্ত হতে,
কিন্তু তা কোনোভাবেই হয়ে উঠছে না।
নিজে কম খেয়ে আমাদের খাওয়াতে  মা’কে কেউ শেখায় নি।
আমাদের মানুষ করতে মা দিয়েছেন অক্ষরজ্ঞান,
দ্বীনি শিক্ষার নামে কিছু হাবিজাবি কঠিন আরবি,
আরেকটু বড় হবার পর শিখিয়েছেন নামাজ,
আর কোরান শেখাতে দিয়েছিলেন সত্তর টাকা বেতনের এক অলৌকিক মোল্লা।
সরকারি স্কুলে দু’বছর পড়ানোর পর,
মা ভেবেছিলেন প্রাইভেটে দেবেন,
কম খেয়ে কম পরে প্রাইভেট স্কুলের বিলাসী খরচ দিয়েছিলেন মা।
আমি স্কুলে টিফিন বিলিয়ে দিতাম শুনে,
মা আমায় দিয়েছিলেন সহজ স্বার্থপরতার পাঠ...
পরের উপকার করো, কিন্তু নিজের স্বার্থটা বজায় রেখো।
বড় ক্লাসে আমি রাত জেগে পড়তাম আর
অকারণে মা রাত জাগতেন আমার সাথে।


মা’র বড় নড়বড়ে ইকনমি আমি অনেকবার ভেঙ্গেছি বায়না ধরে,
মা তা সহ্য করেছেন।
মা আমাকে প্রেমে পড়তে দেন না, প্রেমে পড়লে মা’র কাছে আমি অপরাধী।
পার্টি, পলিটিক্স, ইউনিয়ন, গরীব, মেহনতি...।
শব্দগুলি আমার মুখে শুনলে
মার কাছে আমি অপরাধী।
মাল্টিন্যাশনাল, জোব, বড় চাকুরি, মাইনে,
রিসোর্ট, আবাসন, গাড়ি---
শব্দগুলি আমার মুখে শুনলে,
মার কাছে আমি আদরের দুলাল।


তিন দশক পর আজ মা চার সদস্যের পরিবারের মালকিন।
মা’র হাতে আছে আজ টিভির রিমোট, সংসারের রিমোট,
মা নিজ কৌশলে রিমোট টিপেন
নিজ কৌশলে সামলাতে জানেন সব কিছু।
নিরাপত্তা পেতে মা’র বিশ্বাস হচ্ছে শিথিল---
নামাজ পড়েন না পাঁচ ওয়াক্ত নিয়মিত।
আমাকে ধার্মিক হতে তেমন চাপ দেন না।
বাবার সাথে মাথা তুলে কথা বলতে জানেন।
মার্কেটের প্রচলন বুঝে শাড়ি কিনতে জানেন।
জানেন সিরিয়াল দেখতে,
রাজনীতি বুঝেন মিডিয়ার তালে।


মা’র সোনার সংসার , মা’র লড়াইর সংসার
মা’কে শিখিয়েছে অনেককিছু,
মা’কে দেখতে দেয়নি বাইরের পৃথিবী
মা’র লড়াইর সংসার মা’কে শিখিয়েছে ঘরকুনো হতে
মা’র সোনার সংসার, মা’কে করেছে বড়ই সেকেলে...

কোন মন্তব্য নেই: